উপন্যাসঃ ছায়াস্মৃতিপাঠ

উপন্যাসঃ ছায়াস্মৃতিপাঠ

ছায়াস্মৃতিপাঠ
ফজলুল হক

আমি অভিনব বন্দ্যোপাধ্যায় । একজন গল্পকার । যারা আমার গল্পের পাঠক তারা প্রশংসা করলেও সমালোচকরা মনে করেন আমি সময়ের থেকে এক’শ বছর পিছিয়ে আছি । অর্থাৎ আমি ঠিক মুরগির ডিমে তা দেওয়া থেকে বাচ্চা ফোটার সময়ের মধ্যে আছি । তারা বলেন লেখার জগতে আমার এখনও জন্ম হয়নি । বলতেই পারেন । আমি আমার পূর্বের লেখাগুলির পর আর লিখব না মনস্থির করেও এই দীর্ঘ লেখা লিখব বলে কেন এত ব্যস্ত হয়ে পড়ছি তা প্রচারের আলোকে আসার অভিপ্রায় থেকে নয় । নিজেকে এ ব্যাপারে বার বার নিবিড় অনুসন্ধানী প্রশ্ন করেও জেনেছি অ-লেখার মধ্যে প্রবল ভাবে থেকে যায় প্রচার আকাঙ্ক্ষা । প্রকৃত লেখার কাছাকাছি পৌঁছানোর সহজ পথ বলেও মনে করে অনেকে । একটা সাদা পাতায় কিছু লিখব বলে কলম নিয়ে বসা আর মনোসংযোগের সন্ধিক্ষণে পৌঁছানো স্বতন্ত্র বিষয় । নিজের ক্ষেত্রে এক দু’ঘন্টা কখনও একটা দিন অথবা তারও বেশি সাদা কাগজটি অক্ষত থাকে । পূর্বেও এই একই রকমের নিয়মে সারাজীবনে ঐ ক’টি মাত্র উপন্যাস লিখতে পেরেছি । নতুন লেখাটির ক্ষেত্রে সাদা কাগজ শূন্য থাকার সময়স্রোতে পরিকল্পনা মতো ঐ রচনায় যা আগামীতে লিখব সেই চরিত্রগুলির মধ্য থেকে প্রধান চরিত্রটি পীড়া দেয় । অদৃশ্য আক্রমণ করে, ভাবনার অক্ষম বিন্যাস ও সংলাপগুলির খেদ যেন অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতার সাথে বেরিয়ে আসে তার স্মৃতি ছায়া-উপচ্ছায়ায় । আমি অবিন্যস্ত ভাবনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিনাটির ব্যাপারে শিল্প নৈপুণ্য ও যত্নশীল ছিলাম না । তাই চরিত্রটির বাস্তব উদ্ভাবন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না । বাইরের পৃথিবীর পর্যাপ্ত বদল ঘটছে খুব দ্রুত গতিতে । কোনও সত্য টেকসই হচ্ছে না । আমার পূর্বের লেখা নিয়ে ভবিষ্যতের গল্পের নায়ক নায়িকারা ক্ষেপে ওঠে এক নিপুণ মগ্নতার গভীর থেকে । তাদের লাল চোখ ও কথা পীড়নক্লান্ত শব্দগুলি শিল্প হয়ে উঠবে নিশ্চিত ভেবে চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই । এরই ফাঁকে আমার তন্ময়তার ভিতর অবিকল সেই মেয়েটিকে দেখতে পাই । সে সামনে এসে দাঁড়ায় । নিজেকে আমার লেখার পাঠক বলে দাবিও করে আমাকে চিনে নিতে সাহায্য করে । আমি নিশ্চিত জানতাম সে কঠোর সমালোচকও বটে । বাস্তবতা ভুলে যাই । এই মুহূর্তটাকে ধরে রাখার জন্য প্রাণবন্ত হয়ে সে বলে , বিশ্বাস করা বা না করাটা তোমার সমস্যা ,কিন্তু, আমি তোমার লেখার সত্যিকারের একজন সৎ পাঠক । মেয়েটি থামল আর তার চোখের দৃষ্টি আমার মুখের ওপর ফেলল । সে যে আমার লেখাটির প্রধান চরিত্র । আমি যে তার-ই গল্প এতগুলো বছর পেরিয়ে লিখতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । লেখার চেষ্টা করেও লিখতে পারছি না ।
তার প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনও উত্তর জানা নেই । সত্যিকারের একজন লেখক তোষামোদপূর্ণ শব্দ বাক্যে সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে না । “পরিহাসের বিষয়বস্তু আকাশ থেকে পড়ে”, এই বাক্য লেখার জন্য লেখকদের অশ্লীল মন্তব্য শুনতে হয়েছে । এখন মেয়েটির প্রতুল কথা বর্তায় পরিহাসের উপচ্ছায়া থেকে মুক্তি পাব না ধরে নিয়ে তাকে দেখব না বলে দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলি । মেয়েটি তেড়ে আসে । অসম্ভব স্মার্ট মেয়ে,তার গায়ে লেপটে থাকা টি-সার্ট টপকে শরীরী সম্পদ ভয়ংকর ঔদ্ধত্যের দাবি জানায় । আর ওর চামড়ার সাথে মিশে থাকা জিন্স শরীরের আপত্তিকর জায়গায় একটি ভৌগোলিক চিহ্ন এঁকে দেয় । যেমনটি বহু বছর আগে এক মেট্রো রেলের টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইন দিতে দেখেছিলাম । ওকে থামাতে গিয়ে ওর নাম ব্যবহার করি যে নামটি কাল্পনিক ,গল্পে ব্যবহার করব । সে আরও ক্ষিপ্রতার সাথে আমার জামা ধরে জোরে হ্যাঁচকা টান মারতেই পড়ে যাই ওর শরীরে । অথবা এমনটাই ভেবে নিই । ওর ভরি স্তনের চাপ অনুভব করি । আমার ভর তখন ওর শরীরে । আমি তাকে সুমগ্না বলে ডেকেছিলাম । মেয়েটি রহস্যজনকভাবে জেনে যায় আমার লেখায় ওই নামটি ব্যবহার করব । জানল কি করে তা গবেষণার বিষয় । এই নামটিতে সে গোটা লেখা জুড়ে পরিচিত হতে চায় না । তাই সে বার কয়েক আপত্তি জানিয়েছিল আমার ভাবনা ও রচনার মগ্নতার প্রাককালে । যখন চরিত্রগুলি নিয়ে নিজের মধ্যে খেলি, রঙ তুলি দিয়ে সাজানো, ভাঙাচোরা সময়ের ভিতর,তখন আলোকোজ্জ্বল এক শূন্যতার ভিতর দিয়ে পরিক্রমা করি । আমার চারপাশে গোটা গল্পের চরিত্রগুলি হাঁটতে থাকে । কেউ মাঝ পথে হারিয়ে যায় । কেউ মারা যায় আর যারা গন্তব্যে পৌঁছায় তাদের একজন হয়ে ওঠে মেয়েটি । যে এখন একহাতে জামা অন্য হাতে আমার শরীর চেপে ধরে আছে তার অসম্ভব উত্তেজক অর্ধনগ্ন বুকে । তার কন্ঠস্বরে আগুন ঝরছে , ওই নামটা আমার পছন্দ নয় । একেবারে বানানো, মমুলি . যা তোমার লেখক যোগ্যতাকে প্রশ্ন চিহ্নে দাঁড় করিয়ে দেবে । আর আমার মনে হয় সমালোচকরা ঠিক বলে , তুমি এক’শ বছর পিছিয়ে আছ ।
তখন এক শূন্যতার ভিতর দিয়ে নিজেকে অলৌকিক জীবনের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি । আমার নিজের বানানো জাদুঘরগুলি এক একটা চরিত্র আমাকে চিনিয়ে দেয় । কোনও গোপনীয়তা নয় একেবারে খোলা অবস্থায় আমাকে বিস্মিত করে ।এই জাদুঘরের কোনও এক কোণে আমি বসি আর লেখার জন্য নত হই সেই সব চরিত্রগুলির কাছে যারা আমাকে একটি সফল গল্পের জন্ম দিতে সাহায্য করবে ।
তার বাহু বন্ধনে শিহরিত । জীবন প্রবাহের প্রক্রিয়ায় রত অনুভূতি প্রবণ অভিজ্ঞ যন্ত্রটি ছটফট করতে শুরু করে কাল্পনিক যৌন শিহরনে । দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তিঘুম ছেড়ে জেগে ওঠার চেষ্টা । যদিও তাকে পাত্তা দিতে রাজি নই । এখন ওর দুটি হাত মানবসত্ত্বার একটি রূপে কার্য করতে পারদর্শী হয়ে উঠতে চাইছে । তাকে প্রশ্ন করি , তবে তুমি বলো কী নামে ডাকব তোমাকে ?
লেখা শুরু করার আগে নাম নিয়ে আমার বিলাসিতা মাথা চাড়া দেয় । মেয়েটির নাম নিয়ে এক শূন্য প্রারম্ভিকতা থেকে একটি ইচ্ছে মতো নাম ব্যবহার করার মধ্যে শিল্প থাকে না । নাম একটি সময়কে চিহ্নিত করে , সামাজিক মূল্যায়ন করতে পারে সে বিষয়ে আমার অক্ষমতা প্রকাশ পায় । মেয়েটি বলে ওঠে, আমার নাম যেভাবে আমার নিজস্ব গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ অথবা অনিয়ন্ত্রণ করে ,যে নামটি আমার জন্ম পরিচয় চিনিয়ে দেয় , সেই নামটি ব্যবহার যোগ্য । যেটা তুমি হামেশা ব্যবহার করতে ।
আমি তার বাস্তব অবয়ব খুঁজি । কল্পনা করতে হয় না । একটি গ্রামের প্রান্তিক অন্তজ শ্রেণীর পরিবারের লাগামহীন জন্ম প্রক্রিয়ায় সন্তান সন্ততির অভাবের আর্ত কোলাহল শুনতে পাই । যেখানে স্মার্ট ফোন , ল্যাপটপ, অত্যাধুনিক আসবাবের ছাপ নেই ,আছে এক জীবন সংগ্রামের ব্যর্থ ইতিহাস । তার মধ্য থেকে একটি নাম বেরিয়ে আসে , আমি উচ্চারণ করি , কটরি !
হ্যাঁ,তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল দেখায় । সে আমাকে দীর্ঘ চুম্বনে বেঁধে রাখে । আশ্চর্য তারপর যা ঘটল তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না । সে আমাকে তুলে নিল , আমি তখন একটি থার্মকোলের মানুষ, এতটাই হালকা বায়ুস্তরে সহজেই ভাসানো যায় । জাদুঘরগুলি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল , আর তাকে মনে হচ্ছিল সে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী । একটি জাদুঘর যার একটি কোণায় আমার চেয়ার টেবিল ও একটি ল‍্যাপটপ রয়েছে । যেখানে রোজ আমি অলৌকিক কারুবিদ্যায় অক্ষর সাজিয়ে শব্দ , শব্দ সাজিয়ে বাক্য এবং বাক্যগুলি একজোট করে একটি উপন্যাসের রূপ দিতে সক্ষম হই । নিজের ইচ্ছায় এ ঘরে আসা আর চরিত্র আমাকে তুলে আনবে এই পার্থক্য সন্দেহাতীত একটি জাদু বেষ্টিত কাজ । এক ধরনের শাস্তি । আর কটরি নাম ধারণ করে মেয়েটি এই শাস্তি আমাকে দিতেই পারে , তার চোখ দেখলে বোঝা যায় কাজটি করা তার পক্ষে কতটা সহজ । সে আমার নিজের বানানো জাদুঘরটি নতুন করে দেখিয়ে দিতে থাকে , যা আমার চোখে কোনও দিন ধরা পড়েনি । বিশাল প্রবেশ দ্বারটির ভিতর দিয়ে সুসজ্জিত ঘরের গালিচায় দাঁড় করিয়ে একটি চুম্বন দেয় । গালিচাটি মোঘল স্থাপত্যকলার অলঙ্করণ রীতিতে তৈরি । দেওয়ালে প্রাচীন শিল্পকলার প্রদর্শনী । আমার চেয়ার টেবিলের অতুলনীয় কারুকর্মের শিল্পদক্ষতা যা নিবেদিত কোনও দৈব শক্তির চরণযুগলে । আমি সেখানে বসলাম । এবার লিখব । কটরি তার দুই হাত আমার কাঁধের উপর রাখে , লেখার আগে যা লিখবে সেটা সম্পর্কে তোমার জানার মধ্যে কোনও ফাঁকি যেন না থাকে । ভাববার অবকাশ ছিল না যে , যাকে আমার গল্পের প্রধান চরিত্র বলে কল্পনা করেছি সে কী করে রক্ত মাংসের শরীর হয়ে আমার সামনে আসতে পারে । আমাকে বলতে পারে , আমার ভিতরে ঢোক , আমাকে দেখ , শিরায় শিরায় প্রবাহিত হও । আর তুমি ফিরে যাও শুরুতে ।
মুহূর্তে তার সাথে নিবিড়তার দৃশ্য মনে পড়ে, তাকে চিনতে পারি । সেই ফেলে আসা যাপনের সাথে মিশে থাকা এক ব্যতিক্রমী যুবতি । এটাই ঘটে আমার সাথে ,যখন লেখার টেবিলে বসি । আমার ভাঙাচোরা টেবিল চেয়ার রাজকীয় আকার ধারণ করে । পলেস্তরা খসে যাওয়া ঘরটি বাদশাহী মহলে রুপান্তরিত হয় । আর চরিত্রগুলি জ্যান্ত হয়ে ওঠে ।
লেখার শুরুটা করব এক চমকপ্রদ ঘটানা দিয়ে , ভুল ভেবেছিলাম ,যা লিখব তা আগে কেউ লিখে যায়নি । ভুল শুধরে নিতে লেখার ঘরে শুধু বসেই থেকেছি । কটরি তার সব রকম যৌন কারুকলা শুরু করবে তার ইঙ্গিত পাচ্ছি । এই জাদুঘরে আলাদা বিছানা নেই । এমনটা ‘নিসর্গের রূপকথা’ লেখার সময় রুনা নামের চরিত্রটির বেলায় ঘটেনি , ফরিদার বেলায় আরও ভিন্ন রকম আবহ । তখন জাদুঘরটি নিজে নিজেই বদলে যেত । মোঘলীয় আসবাব দেখা যেত না । যেগুলো ঘরটিকে আলোকিত করত তা অতি সাধারণ । যেখানে মিলনের তাৎপর্য আলাদা করে ব্যাখ্যা করতে হয় ।
তারপর কটরির অদৃশ্য উপস্থিতিতে মহলটি প্রেমময় হয়ে ওঠে । এখন ও নিজেকে খুব স্বাভাবিক করার কাজে ব্যস্ত । আমি ছুটে গিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতাম ,কিন্তু তা হবার নয় ,যা হবার তা খুব প্রাণবন্ত ভাবে ঘটবে । কটরি তার জামার একটা বোতাম খুলে একটু কাত হয়ে বসেছিল । জীবনে অনেক বড় বিস্ময়ের সম্মুখীন হয়েছি তবে এমনটা নয় । হ্যাঁ , ঠিক বহু বছর আগে এই লেখাটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি । যখন কটরির অস্তিত্ব এক অদ্ভুত গতিশীলতার দিকে টেনে নিয়ে যায় । এখন গন্তব্যে থিতু হব । ও লেখাটি শুরু এবং শেষ করব ।
অদৃশ্য হাত আমার হাত ধরে টানে, গালিচায় তার শরীর আমার শরীরের ভার বহন করবে । এমন ভয়াবহ যৌনতা উৎপাদনকারী অন্ধকার যার শুরু আলোকোজ্জ্বল মহান অনুভূতির ভিতর । তারপর অন্ধকার ! অবদমনের সময়ক্লান্ত মরুভূমি । একজন লেখকের জীবনের শ্রেষ্ট সৃষ্টির বিচরণ ক্ষেত্র । বাস্তবিক যৌনতা সৃষ্টির উৎসমুখ । সে এক অনেক দিনের পুরনো রণক্লান্ত সৈনিক, যুদ্ধের আপৎকালীন উচ্চারিত শব্দগুলো তাৎক্ষণিকভাবে আপনা আপনি দেহভঙ্গির সাথে সাথে বেরিয়ে আসছিল । আমার দ্বিগুণ শরীরের ভার নেয়ার আশ্চর্য দক্ষতা সে সেইসময় অর্জন করে নেয় । তার ক্ষমতা প্রকাশের বিচিত্র শিল্পকলায় আমি আনন্দ বিস্ময়ে প্রায় পাগল হয়ে যাব । অবশেষে যুদ্ধ থামে একসময় । পৃথিবীর সময়ের সাথে এই জাদুঘরের সময় মিলবে না জেনেও আমি তাকে প্রশ্ন করি , ঘড়ির কাঁটা কতটা বদল হয়েছে ?
আবেগ মথিত কন্ঠে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় , আয়ুষ্কালের সব সময়টুকু চলে যাক না, তাতে কী যায় আসে । এই জাদুঘর কোনো সময়ের হিসাব দেয় না । উচিত না, কারণ টা তোমার অজানা নয় ।
জানি না , এখন তোমার কাছে নতুন করে জানতে চাই ।
তবে শোন ,এই জাদুঘরে তোমার সৃষ্টির মহাপ্রলয় ঘটবে । মহান পৃথিবীকে তুমি সম্পূর্ণ আধুনিক শিল্পসুষমায় রঞ্জিত নতুন কিছু উপহার তুলে দেবে । যতদিন না দিতে পারছ ততদিন এই মহাযুদ্ধ চলতেই থাকবে । আর আমি হব তোমার সর্বক্ষণের সারথি
আমি ফিরে আসি টেবিলে, যেখানে আমার লেখার কাজটি শুরু করব । সেটি তখন চরম নৈঃশব্দের গভীরে নিঃশব্দতার একটি সাদামাটা টেবিল চেয়ার পাতা ঝুপড়ির মতো স্যঁতসেতে ঘর,কোনও জাদুঘরের মায়াজাল নেই ।

দুই :
সে অনেক বছর আগে প্রথম যেদিন মেয়েটিকে দেখি তখন তাকে কটরি বলে চিনতাম না । ওর কাদা বালি মেশানো রঙ সঠিক বর্ণনার অপলাপ । ওর ম্লান চোখজোড়া, বিভিন্ন রঙের , নীল, সবুজ, হলুদ লালের ছোপ হতে পারে ,যখন সে সূর্যের আলোর দিকে তাকায় । আবার বদলে যেতেও পারে ধূসর, জলকাদাময় জলের মতো কখনও পোড়া হাড়ির কালির মতো । তার বাবাকে আমি দেখেছি বহুবার । গাঁয়ে গিয়ে শুনেছিলাম তার আত্মহত্যার কথা । সেগুলি এখানে লিপিবদ্ধ করব না । ওগুলো এমন কি আশ্চর্যের বিষয় ? যা আগে অনেকে লিখেছেন, অতি সাধারণ যেটা আকছার অতি গোপনে ঘটে থাকে, বিষদ, বিবরণ দেয়ার যুক্তি আছে কি ? এটা তো স্বাভাবিক যে, পরিবেশ ,বাসস্থানের অপ্রতুলতা, একটি মাত্র আট বাই আট ফুট ঘরে চার সন্তান ও তার মা বাবার শোবার মেঝেয় পাতা চটের অভাব , ছেলে মেয়েদের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা শেষে গভীর রাতে যৌন সুখ পেতে মায়ের পাশে বাবার শুয়ে পড়ার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা,পাপ থাকতে পারে না । বরং মায়ের জায়গায় যুবতি মেয়ে ,অসাবধানবশত জায়গা বদল ,বাবার এক মুহূর্তের শয্যা সঙ্গিনী, এসব এক দৈব পরিহাস ছাড়া কী হতে পারে । ওই মুহূর্তটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি , নিজের অসংযমী কামকে ক্ষমা করার মতো কোনও যুক্তি ছিল না বাবার হাতে । বাবার মৃত্যুটা ওদের পরিবারের অভিশাপ , যা কাম্য ছিল না । যদিও এসব লেখার মধ্যে সম্মানজনক কিছু নেই । লিখতেও চাই না । এ গ্রাম তো বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতোই । যেখানে রাজনীতির কুটকচাল পরিবেষ্টিত মানুষজন । অভাব অনটনের তাৎক্ষণিক লাভ অথবা উপার্জনের লোভে অনৈতিক কাজগুলোকে জীবিকার অঙ্গ বলে মানতে কোনও নীতিবোধ কাজে দেয় না । ওদের পাড়াটা ততোধিক প্রান্তিক । দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারগুলির সাথে ওরা ঠাঁসাঠাসি করে বাস করে । নোংরা অপরিচ্ছন্ন , অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবার কথা মাঝে মধ্যে ভোটের সময় শোনা গেলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি । হাতে মেসিন নিয়ে ঘোরে নেতাদের সিম কার্ডরা । বিপদ বুঝলে ডিলিট করার পারমিশন দেয়া থাকে । জমি জায়গা এক সময় যা বর্গাদারের হাতে ছিল , এখন তা কিছু পার্টি কর্মীর মালিকাধীন । এমনকি পড়ে থাকা নালা-নর্দমা , আগাছা ভর্তি পতিত জমি , ছোট ছোট বন বাদাড় সাফ করে মালিকানায় রেখে দেয়া রাজনীতি করা মানুষগুলোর উপার্জনের অধিকার । এ সব কাজগুলি অর্থের জন্য ভাড়া খাটে এ পাড়ার লোকেরা । ওর বাবাও তাদের মধ্যে একজন ছিল । পাড়ার লোকেরা সন্ধ্যায় মদের আসর বসিয়ে আনন্দ উপভোগ করে । সুযোগ পেলে অপরের বউ এর কাছে সুযোগ নেবার চেষ্টা করে , ধরা পড়ে প্যাদানিও খায় । হাত পা ভেঙেও দেয় । আবার সকালে হাসপাতাল নিয়ে যায় সব কিছু ভুলে গিয়ে । কচি মেয়েরা কামনার শিকার হয় সুযোগসন্ধানী পার্টিকর্মীর হাতে । এইসব লাম্পট্যবিস্তারকারী দিন রাতগুলি আলাদা কোনও অর্থ বহন করে না । জীবন ধারার সাথে মিশে স্বভাবিকতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়েছে । বাবা মারা যাবার পর কটরি কয়েকবার যৌন আক্রমণের শিকার হয়েছে । গায়ে গতরে পাপ অথবা পবিত্র সৃষ্টির মহান চিহ্নগুলি দেখা দিতেই যারা দায়ী তারাই তাকে গ্রাম ছড়া করে । এসব আমার লেখার বিষয় নয়।
মাঝে মাঝে শহর থেকে গ্রামে যাই , খাস ও বর্গা করে দেবার পর তখনও কয়েক বিঘা জমির একটু টান অবশিষ্ট ছিল, ও গুলোর গতি করতে পারলে পাকাপাকি ভাবে লেখায় পেশাদার হয়ে উঠব । সেদিন তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল ,প্রান্তিক ছিল আমার সাথে । তার গ্রাম দেখার সখ । বন্ধুত্বের দাবি মেটাতে তাকে সঙ্গে আনা । ওর কাছে গ্রাম যেন একটা চিড়িয়াখানা । গ্রামের মানুষগুলো বিশেষ করে মেয়েরা সহজ লভ্য । চাইলেই বিছানায় নেয়া যায় । না তার মানে এই নয় যে সে একজন লম্পট । প্রকৃত পক্ষে প্রান্তিক একজন অভিজ্ঞতাহীন ভালমানুষ । যার মধ্যে সরলতা ছুঁয়ে থাকে বেশি । আমার জানার মধ্যে ফাঁকি থাকতেও পারে । গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করি না । আমি তাদের বাড়িতে যেতাম ছাত্র জীবনে । তার বোধ শূন্যতার মুহূর্তগুলি তার ওপর প্রতিনিধিত্ব করার একটা সুযোগ পাই । তার আনলিমিটেড বাজে খরচ করার রাশ টেনে কার্যকরি খরচের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি । তখন সে মান্যতা দিত । আমরা বৃষ্টিতে একটি স্কুল প্রাঙ্গনে থেমেছিলাম । যে স্কুলটিতে আমার বাল্যকাল জড়িয়েছিল । তার দামি কারটি গাছের তলায় রেখে স্কুল বারান্দায় আসি । সেখানে চার পাঁচজন মেয়ে আশ্রয় নিয়েছিল । তাদের মধ্যে কটরি একজন । তাকে আগে দেখেছি এই বাক্যটির ওপর বিশ্বাস নেই । পরের দিনগুলিতে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাব কি পাব না , সে বিষয়টা মুখ্য ছিল না । তবে তার বিষন্ন মুখখানা বাইরে প্রকাশ করবে না এমন একটা মানসিক দৃঢ়তা লক্ষ্য করেছিলাম । তারপর প্রান্তিক তার ব্যাগ থেকে দামি ক্যামেরাটি বের করে কয়েকটি ছবি তুলে নেয় । দেখেছিলাম তার ক্যামেরার ফোকাস বেশির ভাগ সময় কটরির মুখে চোখের ওপর পড়ছিল । কটরির দুই ভ্রুর মাঝে গোল তিলটি যা তার টিপের কাজ করে , প্রথমে তার রূপ বর্ণনায় আমি বলব না । প্রান্তিক পেশাদার ফটোগ্রাফারের মতো ছবিগুলো তুলেছিল । ছবিতে কপালের ওপর পড়ে থাকা কুন্ডলী পাকানো কালো চুল যেন সাদা কপালের শূন্য জমিতে শ্বাস টেনে নিচ্ছে । এটা শিল্পের পর্যায়ে চলে যায় । পরে মেয়েটির বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে অনেক কিছু জানতে পারি । ততদিনে ওর শরীরে নতুন চারা গাছে বীজ অঙ্কুরিত হবার সূচনা পর্ব । কিছু একটা ঘটবে যা কয়েকটা মাস পার হলেই বোঝা যেতে পারে । মেয়েটি মেধাবী । স্কুলের শিক্ষকগণ চেষ্টা করেও তাকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না । সামাজিক সম্মানের প্রয়োজনীতার কথা বলে গ্রামের লোকেরা তাকে তাড়িয়ে দেবার যুক্তিটা খাড়া করবে । আর অধিকাংশ লোক তা সর্মথন করে তাকে ও পরে তার পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করার কাজটি সুসম্পন্ন করবে ।
আমরা গ্রামে যাবার পর গাঁয়ের লোকেরা সতর্ক করে আমাদের । মেয়েটির শরীরের অভ্যন্তরে যে প্রক্রিয়াটি অতি গোপনে চলছিল, দশ মাসের এক আলোকিত শূন্যতার অনিশ্চিত যাত্রাপথে পাড়ি দেব বলে , সে খবর গ্রামের অনেকের কাছে তখনও পৌঁছায়নি । প্রান্তিক বাধ্য করছিল তাদের পাড়ায় যেতে । স্যাঁতসেতে অপরিচ্ছন্ন সরু রাস্তায় নিজেদের মুখ আড়াল করে ওদের পাড়ায় আসতেই পর পর কয়েকটি ঘর থেকে জোড়ায় জোড়ায় চোখ আমাদেরকে লক্ষ্য করছিল । আমার শহিদ বাবার সামাজিক প্রতিষ্ঠার কথা ভেবে প্রান্তিককে বলে ফেলি , বেশি দেরি করা যাবে না ,কেউ দেখে ফেললে ?
সেদিন হঠাৎ সে পরিপক্ক্ মানুষের মতো কথা বলেছিল , তুমি তো লেখক, নিজের দিকে একবার চেয়ে দেখেছ ?
কোনও কথা বলিনি তারপর । সে মেয়েটিকে ইশারায় ডাকে , কী নাম যেন তোমার ?
ভুলে গেলেন ? সেদিন স্কুল ঘরে যে বললাম । না ভুলে যাওয়ার ভান করছেন ? সব পুরুষ মানুষরা এটা করে থাকে । মেয়েদের কাছে মহান হতে এই নাটকটির খুব প্রয়োজন ।
কেউটের ছোবলে এতটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয় না , এই মেয়েটির পরিশীলিত নিপুণ বাক্যবানে আমার যেমনটা হল । আশ্চর্য ! সেই সঙ্গে তার গভীর পর্যবেক্ষণের ইঙ্গিত পেলাম । কটরির প্রতি কৌতূহল বাড়ার আর কোনও কথার দরকার পড়ে না । তাকে শুধাই, কোন ক্লাসে পড় ।
সে সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছি । তার চোখ ও মুখের বক্র বিতৃষ্ণা আমার জানার ইচ্ছেটাকে প্রবল করে দেয় , কতদূর পড়েছিলে ?
সে তার সাবলীল ভঙ্গিমায় ফিরে আসে , এসব প্রশ্ন অর্থহীন ।
গ্রামের মেয়েরা এভাবে কথা বলতে পারে এই অভিজ্ঞতা আমার ছিল না । ছোটবেলার খেলার সাথী যারা ছিল এমনকি আমি নিজেও কথা বলার ক্ষেত্রে গেঁয়ো ছিলাম । প্রান্তিক পরে একদিন বলেছিল , তার অস্বাভাবিক মনে হয়নি , কারণ মেয়েটি দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল । সেদিন সে তাকে পড়াশোনার সুযোগ করে দেবার কথা বলতেই মেয়েটি জ্বলে উঠেছিল । এটাও আগের পুরুষগুলির মতো টোপ বলে সে অগ্রিম ভেবে নেয় । তার অন্য একটি কারণও ছিল । প্রান্তিকের মধ্যে ও নকল চালচলনের আভাস পায় । তবুও সে তাচ্ছিল্যপূর্ণ ধৈর্য ধরে ,তার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে । প্রান্তিক ছবি তোলে , পাড়ার ভিতরে গ্রাম বাংলার এমন অপরিচ্ছন্ন রূপ তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে । ধরা পড়ে কটরির অজান্তে তার বিষাদপূর্ণ অসতর্ক ভঙ্গিমার অজস্র ছবি । যেগুলি আমি পরে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলাম । তার মায়ের আকুতি ভরা চোখ ধরা পড়েছিল এক অনৈসর্গিক তৃষ্ণায় । হয়তো তাদের অনিশ্চিত যাপনের ভবিষ্যৎ ভেবে । ওর মাকে ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে দেখেছি কাজ করতে । কমিউনিষ্ট ঘরাণার আমার মা তাকে জাতের ছূত বাঁচিয়ে স্নেহ করত । আর সতর্ক করত , যেন তার মেয়েকে সাবধানে রাখতে ।
প্রান্তিক ফিরে যায় শহরে । আমি থেকে যাই বিষয়জনিত কারণে । তবে বুঝতে পারছি একটা আকস্মিক সম্পর্ক অনুভূত হচ্ছে আমার ভিতরে । বুঝতে পারি এই সম্পর্ক পরস্পরের বিশ্বাসের জায়গায় পৌঁছাতে চাইছে । আর বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক মূল্যহীন । তবে কেমন করে একটি সত্যকারের সম্পর্কে পৌঁছানো যাবে সেসব বিষয়ে আমার আলাদা কোনও পরিকল্পনা ছিল না । যদি তা স্বাভাবিক ও স্বতস্ফূর্ত না ঘটে , তাহলে ঐ পর্যন্ত গিয়ে থেমে যাওয়া উচিত ।
কটরি সম্পর্কে সেসব অপবাদ অথবা ঘটনাগুলি তখনও পর্যন্ত সর্বত্র পৌঁছায়নি । এর ই ফাঁকে তার সাথে আমার একদিন দেখা হয়ে গেল । তখন চৈত্রের এক তপ্ত দুপুর ,এই সময় সবুজ ধানে ঢাকা পড়ে আছে গ্রামের নগ্ন জমিগুলি । চারদিকে সাবমার্সিবল পাম্প জলের জোগান দেয় বরো ধান চাষে । গ্রামের চাপা কলগুলি জলের জোগান দিতে পারে না । ও এসেছিল পানীয় জল নিতে , আমার বর্গাদার লোকটি যে পাম্প চালায় , সুযোগ নেয়ার জন্যে তাকে জল দেয় । সেখানে আমাকে দেখে সে মুখোমুখি দাঁড়ায় । সেই সময় দূর থেকে ধেয়ে আসা দমকা হাওয়া আমাদেরকে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে কোনও রকম অঘটন ছাড়াই স্তিমিত হয়ে এল । যা হল ,সে কেবল তার দাঁড়িয়ে থাকা জায়গা থেকে সরে এসে আমাকে স্পর্শ করার দূরত্বে পৌঁছে গেল । সে আমার চেয়ে না জানি কত বছরের ছোট । পরে এক সময় জানতে পারব । তার রয়েছে পুরুষ টানার মতো এক সুন্দর শরীর ও শরীরের যাবতীয় যন্ত্র সৌখিন আসবাবের মতো । আমি ভেবে নিই, নিবিড়তর সম্পর্কের ব্যাপারে সে অনিচ্ছুক নয় । এ ব্যাপারে প্রান্তিক গভীর কল্পনা বিস্তারে অনেক দূর অবধি পৌঁছাতে পারে , যা আমি পারি না । তাকে সরাসরি প্রশ্ন করি , কী চায় সে । সে বুঝিয়ে দেয় জলের প্রয়োজন কেন পড়েছে । তাকে সাহায্য করি । তারপর সে সংকোচহীন প্রশ্ন করে , আমি পড়তে চাই , নব দা তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পার ?
নব দা , যেন কতদিনের চেনা মানুষটির কাছে আবেদনের অধিকারে স্বরটি বেরিয়ে আসে । আমি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বোকার মতো সাথে সাথে উত্তর দিই, প্রান্তিক তো তোমাকে বলেছিল , সে তোমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবে ।
তোমার কথা বল ? তার মুখের আদল পাল্টে অপেক্ষা করে কিছু শোনার ।
ওর এই উত্তরটি আমার নিজস্ব শূন্যতাকে চিহ্নিত করে দেয় । দুঃখ নয় ,ভাবলেশহীন গম্ভীরতা ন্যায় কথা বলার ক্ষেত্রে আস্তাহীন মনে হয় । আমার সম্পর্কে এই কথাগুলি সত্য , কিন্তু কারণগুলো ভিন্ন । এই রকম এক যুক্তির ওপর শক্ত হতে চেষ্টা করলেও মানব সত্ত্বার কোনও চিহ্ন বা গন্ধ থাকে না । চোখের সামনে নিসর্গের সূক্ষ্ম ছবি , সবুজ পাতার হিন্দোল হৃদয়ের দরজা খুলে দেয় না । তাকে বলি, আমি কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি , পরে আর আসা হবে কিনা বলা যাবে না ।
এমন অর্থহীন কথা আগে বলেছি কিনা মনে করতে পারি না । এমনটি বার বার ঘটলে নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে ।
তুমি কি শহরে থাকবে মনে কর ?
আপাতত সেই রকম ঠিক আছে ।
তোমার ঠিকানাটা যদি জানা থাকত তবে কোনোদিন শহরে গেলে দেখা করতাম । অবশ্য আমি যদি শহরে যেতে পারি ।
চলে যাবার সময় ওর পায়ের শব্দ দীর্ঘদিন ধরে শুনেছি , ও যেন আমার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ।
তিন ।।
আমি লেখাটি শুরু করব । সেই অভিপ্রায় শেষ পর্যন্ত মেটে না । যদিও আমার টেবিল চেয়ার এক অলৌকিক ইন্দ্রজালে কটরির নিয়ন্ত্রাধীন হয়ে পড়ে । তবুও একটি বাক্যে লিখতে পারি না । তবে লিখব । এত বছর পর কটরি একটি চরিত্র হয়ে আমার জাদুঘরে নিয়ত আমাকে জড়িয়ে রয়েছে । তার অদৃশ্য উপস্থিতি আমাকে টেবিলের বসতে বাধ্য করে ,ঘরটি মায়াময় হয়ে ওঠে । আর কখন যে রাত এসে পড়ে , হায়! লেখার প্রয়োজনীয় সব কিছু জাদুদণ্ডে পরিণত হয়ে যায় । জাদু ঘরটি একটি সুন্দর আদল ফিরে পায় । এই সময় ঘরের বাইরে নির্দোষ বৃক্ষের আদৃশ্য সুগন্ধী বাতাস আমাকে মগ্নতার শৃঙ্খল পরিয়ে দেয় । প্রতীক্ষা করে থাকি এক মহান নৈঃশব্দের । যার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে এক সোজাসাপটা জীবন-ইতিহাস । যার মহাজাগতিক আধার হয়ে উঠবে আমার কলম ও শূন্য খাতার পাতাগুলি । এক অনৈসর্গিক যাত্রাপথে আমার বিচরণ শুরু হয় । খুঁজে পাই জীবন নামক ঘটনাবলীর ঐশ্চর্য্য ভাণ্ডার । তখন আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে একটি জীবন । যে আমার গল্পের চরিত্র হয়ে উঠতে পারে আশ্চর্য জীবন মহিমায় । সেই জীবন কটরির ।
আমার চোখে ভেসে ওঠে বাস্তবের এক ভিড়ঠাঁসা রাম্তায় জনকোলাহল । এগিয়ে যাই ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর ভর না করেই । সুরঙ্গ পথের শুরুতে বিভ্রান্তিকর মানুষ যেখানে একের পিছনে এক দাঁড়িয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পাতালে প্রবেশের পথটি ভিড় মুক্ত করে নেয় । সেখান থেকে সারি বেঁধে ওরা যায় টিকিট কাউন্টারে । ফোকর গলে হাত ঢুকে যায় । এসবই শৃঙ্খলা মেনেই চলে । ঘন্টা খানেক পর আমি লাইনে দাঁড়াবার অধিকার পাই । পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকি ।
প্রান্তিকের সাথে দেখদেখি বন্ধ । দূরত্বও বেড়েছে । সময়াভাব দায়ী বলে নিজেকে সুবিধা মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় তা আমি করব না । বলব ,আমিই দায়ী । এক অবাঞ্ছিত ঈর্ষা , ক্রোধ গোপনে আমার মনোজগতে বিস্তার লাভ করে অল্প কিছুদিন । শরীরে এক ধরনের পীড়ন অনুভব করি । যার কোনও ব্যাখ্যা নেই । ওদের বাড়ির সঙ্গেও সম্পর্কটা ম্লান । বন্ধুত্বের খাতিরে ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতাম । যা একটি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েছিল । এখন দু’জনেই ফিল করি এই দূরত্ব স্বাভাবিক । আমি নিজের মতো করে বাস করি শহরের এক জনবহুল আধা অভিজাত পাড়ায় । বসবাস নিয়ে আমার দক্ষতার প্রশংসা এখনকার বন্ধুরা করে, বাজারের তুলনায় ভাড়া অনেক কম । বাড়িআলা রাজনীতি করা একজন । দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর সরকারের পতন হলে , অনৈতিক ইনকাম বন্ধ হয়ে যায় । প্রথমে ভেবেছিল কয়েক বছর পর আবার তাদের সরকার এলে হাল ফিরে যাবে । নূতন সরকার একটানা এক দশক পার করে দেয়ার পরও পতনের কোনও লক্ষণ না দেখতে পেয়ে বাড়িটি ভাড়া দিয়ে পরে বিক্রী করে দেশের বাড়ি ফিরে গেছে । মেরামত না করা বাড়িটির এখন জীর্ণ দশা । শহরের এই ছিমছাম পরিবেশে তখনকার ক্ষমতাবানরা পছন্দ মতো সরকারি জমি বন্টন করে নেয় নিজেদের মধ্যে । একটি অত্যাধুনিক উপ নগরীর পত্তন করে । যেখানে সভ্যতার উন্নত জীবন যাপনের সব রকম সুবিধা পাওয়া যায় । সরকার এ ব্যাপারে সচেতনও থাকে । যে ঘরে আমি থাকি , বেডরুম বলি , তার জানালা ছুঁয়ে থাকে একটি বকুল গাছ । সকালে ঘুম ভাঙাতে আসে একজোড়া বুলবুলি । গান গায় । শুয়ে শুয়ে গান শুনি । তারপর লাল হলুদ নীল রঙের সংমিশ্রণে গলার চারিপাশ রাঙিয়ে একটি কাঠ ঠোকরা ঠক ঠক আওয়াজ তুলে জানিয়ে দেয় আমার ব্রেক ফার্ষ্টের সময় হয়েছে । সারাদিন হরেক রকমের পাখির সমাবেশ ঘটে । গেটের দু’পাশে বড় রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার শাখাগুলি লালে লাল । বিপরীতে রাধা চূড়ার আবির মেশানো ফুলবাহার । কলেজ ছাড়ার পর এতগুলো বছরে এক বারই এসেছিল প্রান্তিক । সেই প্রথম সেই শেষ । তার জীবন যাপনে কর্পোরেটর ছাপ । শ্বাস নেয়ার সময় নেই ; শুনেছি তার চারপাশে সুন্দরী মহিলাদের ভিড় । আমি তার সাথে যোগাযোগের টেষ্টাও করি না । তবে তাকে নিয়ে প্রতিদিন টুইটারে দু এক লাইন লেখা হয় । এসবের মধ্যে তার যোগ্যতা প্রকাশ পেলেও তেমন স্পর্শ করে না । বরং ভিন্ন মনে হয় । বুঝেছিলাম, সম্পর্কের স্থায়িত্ব পছন্দ করে না । সম্পর্ককে একটি অভ্যাস মাত্র বলে আত্মতৃপ্তি পেতে চায় । ফলে প্রত্যেকের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে অচিরেই । আমাকে এসব বিষয়ে কিছু বলেনি , পরে একদিন না জানিয়ে আমার ঘরে এসে সরাসরি বলে, আমাদের সম্পর্কটা চিরতরে ভেঙে দেওয়াটাই উত্তম কাজের মধ্যে একটা ।
আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি এই ভেবে যে, ওর আর আমার সম্পর্কের বিষয়ে কথাগুলি বলছে, বোকার মতো দাঁড়িয়েছিলাম ওকে বসতে না বলে । এই সামান্য সৌজন্যবোধ আমার থাকার কথা । ও আমার চোখে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে , এতটা অবাক হবার কথা আমি বলিনি ।তুমি ভাবতে পারবে না যে ,তাকে বহুবার ফোন ,ম্যাসেজ করেও কোনও উত্তর পাইনি । কেন তার জবাবও আমার কাছে নেই ।
আমি স্বস্তির শ্বাস নিই । ওকে বসতে বলি হাতের ইশারায় ।
না ঠিক আছি ।
কী ঠিক আছ, কার কথা তুমি বলছ ?
কটরি ছাড়া আবার কে ?
এক আশ্চর্য গোলক ধাঁধায় ঢুকে যাচ্ছি । রহস্য অন্ধকারে কোনও পথ দেখা যাচ্ছে না ,সে চরম বিরক্তি প্রকাশ করল ,অভিনব সত্যি করে বলতো, তুমি জানো না ? কটরি এখন কোথায় ?
যেন আমার জানার সহজ রাস্তাগুলি সে বানিয়ে রেখেছিল । সে জানত এতগুলো বছর আমি অনবরত কটরির খবর রাখতাম , এইরকম মিথ্যে অনুমানে তার শরীরের বিশেষ করে তার মুখের , চোখের ,বক্র ঠোটের ভাষা বুঝিয়ে দিতে চাইছে , আমাদের বন্ধুত্ব যথার্থ আন্তরিকতায় নেই, যে, তাকে টিকিয়ে রাখা যাবে । তার কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ সহ্য করতে না পারার সাথে কটরির সম্পর্কে জানা না জানার যোগসূত্র নিবিড় । সে কোথায় আছে, কেমন আছে , পড়াশোনা করে কি না এসব জানার কোনও সুযোগ আমার ছিল না , অথবা সুযোগ খোঁজার চেষ্টাও ছিল না । গ্রামের সাথে যোগাযোগ নিজের অবহেলায় ছিন্ন হয়েছে । কটরি নামের মেয়েটির অসহায়তার ,তার বিপর্যয়ের সময়ে তাকে সাহায্য না করা এসব আমার আত্মকেন্দ্রিকতা ও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেলেও তা মনের মধ্যে পুষে রাখিনি । ও মনে করিয়ে দেবার পর লজ্জা বোধ করি । নিজের চরমতম অপরাধ থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিককে আক্রমণও করে বসি , তুমি তাকে বিছানায় দাবি করেছিলে , যেমনটি তুমি করে থাক । কিন্তু তোমার জানা উচিত যে , সব মেয়ে তেমন নয় ।
আরে ধুত ! তুমি বোকা বোকা কথা বলো না তো । সব মেয়েরাই পুরুষ কামনা করে , এর মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই ,সব মেয়েই এক রকম , তারা বিলাস আর শক্তিশালী পুরুষ চায় , আর যা বাকি থাকে তা তাদের ন্যাকামী । তোমাকে নিয়েও তার ন্যাকামী দেখেছি এই কয়েক বছর । সে তোমার খোঁজ করতে চাইত এই সত্যটা সে প্রকাশ করত না , কিন্তু তার আচরণে সেই সত্যিটাই বেরিয়ে আসত । তুমি আর একবার ভেবে বলোতো ,সে কি তোমার এখানে এসেছে বা এসেছিল ?
প্রান্তিক পাশের ঘরগুলি দেখতে আমাকে ডাকার দরকার মনে করল না । তার এই সন্দেহ আমাকে অবাক করল । হজম করে নিলাম ,তার অস্থিরতা , উদ্বেগ নিয়ে ভাবছি , সে ফিরে এল দ্রুতগতিতে । তারপর খাটের ওপর শুয়ে পড়ে । উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছিল । করুণা শব্দটির সাথে আমার তেমন সখ্যতা ছিল না ; কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ভিতরে করুণার উদ্রেক হল । তার মাথায় হাত রাখলাম । স্পর্শতরঙ্গে তার শরীরের ক্রুদ্ধ আর্তনাদ শুনলাম । এভাবে প্রান্তিককে চিনতে কষ্ট হয় । তার অস্থিরতার উপসম ঘটাতে ফেলে আসা আমার একান্তদিনের স্মৃতির বস্তাপচা স্তুপের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিলাম । সেখানে কটরির উপস্থিতি কল্পনাবিলাস । আমার নিজের খামখেয়ালি , মা বাবার সামাজিক প্রতিষ্ঠার মান্যতা দেওয়া , আর অবাঞ্ছিত কিছু মানুষকে সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না । কটরি মনের কোনও এক গোপন আঁধারে থাকলেও তাকে আলো দেবার ভাবনাটা ছিল ভয়ের , আতঙ্কের । অন্যথায় বাবার মর্যাদার অবনতি হত । যেহেতু মৃত্যুর পরেও আমার বাবার সুনাম এখনও পূর্বের মতোই আছে।
সবটা শোনার পর প্রান্তিককে লজ্জিত মনে হল না । সত্যিকারের চরিত্র যা দীর্ঘ দিন তার সাথে সহবাসে বুঝেছি এ সেই প্রান্তিক নয় , যে একটি মেয়ের জন্য এমন বিধ্বস্ত ও হিংস্র হতে পারে ।
একটা ভয়ের ব্যাপার আছে , ও কিছু করে বসলে ? মাঝে মাঝে ও বলত, সে পালিয়ে যাবে অনেক দূরে । পিলিজ, তুমি ওকে একটা ফোন করবে ? তুমিই আমাকে ওর খবর জানাতে সাহায্য করতে পার । এই নাও ফোন নাম্বার । এ কথা বলছি তাকে না পাওয়ার জন্যে নয় , বিপদের সম্ভাবনা দেখে । এমন কিছু ওর কাছে আছে যে আমাকে বিপদে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট ।
ফোন নাম্বার খুঁজতে সে তার মোবাইল গ্যালারি থেকে দেখাল কটরি ও তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলির ছবি । ছবিগুলি ভ্রমণের । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মনোরম দৃশ্য ধরা রয়েছে তার মোবাইলে । আমি তখন হারিয়ে যাচ্ছি এক কল্পনার জগতে । আর ঐ ছবিটির অনুসঙ্গে , সমুদ্র কিনারে ওরা আলিঙ্গনরত , উপরে নীল আকাশ, পিছনে নীচের পৃথিবী , লম্বা হয়ে পড়ে আছে পুবের অপসৃয়মান ছায়া । দিগন্তের উপরে কমলার মতো বিশ্রামরত সূর্যটাকে দেখা গেল । ওদের কে দেখলাম । ওদের অশ্লীলতা মাথার রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয় । নগ্ন দুটো শরীরের অস্বাভাবিক লাম্পট্য বেশ্যাখানার বিছানার সাথে মিলে যায় ।
ওই ছবিটার সাথে দিনের আলো নিভে আসছে ওরা দু’জনে শরীরের সাথে শরীর জড়িয়ে পা ফেলছে টলমল । একটি দু’টি করে রাত আকাশে তারারা আলো জ্বালছে মিটিমিটি । কটরি কথা বলছে , কোথায় নিয়ে যাবে প্রান্তিক , আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে চল ,যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না । এই নোংরা পৃথিবী আমাকে পুড়িয়ে ফেলার আগে তুমি আমাকে পুড়িয়ে ফেল ।
দেখছি হাতে কোনও শক্তি পাচ্ছে না প্রান্তিক , যেন এখনই লুটিয়ে পড়বে সৈকত-বুকে । সারাদিনের রমণক্লান্ত শরীর আবার ষাড়ের মতো দুলছে । তারপর সব অন্ধকার । ততক্ষণে প্রান্তিক ছবিগুলো শেষ করে ফোন নাম্বার বের করেছে , এই নাও , ফোন কর , একবার শুধু জেনে নাও সে কোখায় ।
তারপর শান্ত প্রান্তিক ,কীভাবে কটরিকে জীবনে জড়িয়ে নেয় , কীভাবে তাকে আলোর পথ চিনিয়ে দিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্রিয়াকলাপকে সাধারণ করে দেয় ,জীবন যে শুধু ব্যথা পাওয়ার জন্য নয় , শুধু সম্মান পাবার জন্য নয় , জীবন উপভোগেরও, সেখানে ন্যায় অন্যায় খুবই অপেক্ষিক ,সব কিছুকে সহজ করে মেনে নেয়ার নামই জীবন । এই বোধ কটরির মধ্যে সতন্ত্র রূপে বিকশিত হতে সুযোগ করে দেয় ।
আমি বিস্ময়ে ওর চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে আছি । তার জীবন-ইতিহাস শুরু করার আগে বলেছিল , কটরি একটা আশ্চর্য মেয়ে , যাকে বিশ্বাস করা যায় না , অথচ বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকে না ।
অসার বোধ করি । এই একটি মুহূর্ত যা আমার ক্লান্তিকর কৌতূহল বাড়িয়ে দিতে সক্ষম । আগে অনুমান করতে পারিনি যে প্রান্তিক ঠিক কতটা ভাল বলতে পারবে । কেন না তখনও জানি না সে ভাষা ব্যবহারে শব্দের আবেদন কতটা শিল্পিত করতে পারবে । যা আমাকে নয় অন্যকেও স্পর্শ করবে নিবিড় ভাবে । সে রাতে সে খাটের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
শীতল হয়ে আসছে রাত । ও ঘুমিয়ে পড়লেও আমার চোখে ঘুম লাগেনি । দাঁড়িয়ে ছিলাম জানালার ধারে । যেখানে ভোরের সূর্য ওঠার প্রস্তুতি দেখলাম ।
চার ।।

পাতাল রেলের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি । হঠাৎ তাকে দেখলাম পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে । একেবারে ভিন্ন রকম । প্রান্তিক ছবিতে না দেখালে চিনতে পারতাম না । গ্রামের কটরির সাথে এখনকার স্মার্ট কটরির কোনও মিল খুঁজে পেলাম না । সে চিনতে পেরেছে তার ঠোঁটের হাসি রেখাটি ফুটে উঠতেই বোঝা যায় । টিকিট কাটার প্রয়োজন অনুভব করছি না । নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেই । কোন অলৌকিক নির্দেশে লাইন থেকে সরে আসি । দেখলাম সেও বেরিয়ে এল । পেছনের লোকটি ছুটে তার জায়গাটি দখল করে । একেবারে মুখোমুখি দু’জনে । কথা বলার ব্যকুলতা আছে ,বলতে না পারার অস্থিরতাও । কোনও এক দৈব শক্তি আমাদের ওপর ভর করে , কেড়ে নেয় আমাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ।
নব দা ।
তার কন্ঠস্বরের আবেগ ও আবেদনে বাহির পথের সিঁড়িতে বসে পড়ি দু’জনেই । এবং এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় পাতাল রেলগুলির মতো চলে যাচ্ছে । রেল কতৃপক্ষের সুরেলা মেয়েটির ঘোষিত নির্দেশগুলি আমাদের কানে ঢুকছে, হৃদয় স্পর্শ করছে না । কটরি অভিযোগ করে সময় নষ্ট করেনি । তবুও সময় দ্রুতগতিতে ছুটছিল । সে কোনও গোপনীয়তা রক্ষা করেনি । শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করছিল , আমি বীতশ্রদ্ধ হচ্ছি কি না , অথবা তার উপস্থিতি পছন্দ করছি কি না । তার কথা বলার মধ্যে কোনও হতাশাব্যঞ্জক শব্দ ছিল না । এমনকি তার দীর্ঘশ্বাসগুলি ছিল মার্জিত । এই ক’টা বছরে আগের প্রাত্যহিক জীবন ধারার সাথে এখনকার সত্যটি খাপ খায় না । আর আমরা সাধারণভাবে অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতের কারণটি নির্ণয় করি, পৃথিবী গোলাকার বলেই এমনটি ঘটে । তার পেটের ভিতর এক তরলীয় অন্ধকারে শিশুটির গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল । আলোকোজ্জ্বল সেই সম্ভাবনাটি গ্রামের আনাড়ি দাইকে দিয়ে গোপনে মেরে ফেলা হয় । সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে অথবা গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারে বা যেমনটি হয়ে থাকে হামেশা । কিন্তু কটরি আকশ্মিক ঘটনাটি সাধারণ সত্য বলে স্বীকার করে নেয় নিজের কাছে । মুহূর্তটির স্পর্শকাতরতা , নিষ্ঠুরতা , নানাবিধ অস্পষ্টতার ভিতর তখন তার জীবন বোধের উন্মেষ ঘটে । আর পরের বছরগুলিতে অনুশীলিত নির্যাতনকে সহজেই অতিক্রম করার মনোবল পেয়ে যায় । পরে তাকে গ্রাম ছাড়ার কাজটি পাকাপোক্ত করে দেয় তারা , যারা তার ক্ষতি করে নিজের সম্মান বাঁচাতে সফল হয়েছিল ।
জানো নব দা, সেই চরম বিপর্যয়েও মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগিয়ে যাই দিকশূন্যপুরের দিকে । কোথাও পৌঁছাতে হবে এই সংকল্প নিয়ে সম্মান ,অসম্মানের তোয়াক্কা না করে মহান জীবনের পরিপুরক হয়ে উঠতে হবে আমাকে ,নানাবিধ প্রশ্ন এড়িয়ে ।
তাকে কোনও প্রশ্ন করিনি , সে অত্যন্ত সহজ ও কোথাও কিছু অঘটন ঘটেনি এমনই স্বাভাবিকতা নিয়ে বলেছিল, কী আশ্চর্য ! নব দা জানো , তোমার প্রত্যাখানের অপমান সহ্য করেও প্রথমে তোমাকেই খুঁজেছিলাম ।
আমার অভিব্যক্তিহীন মুখমণ্ডলে চেয়ে সে অপেক্ষা করছিল । হতাশ হয়েছিল ! বিষয়টি নিয়ে কোনও কথা ওঠেনি সত্য,কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছিলাম । এই সময় আমার অতীতের বিষয়গুলো নিয়ে লক্ষ্যহীন কথাবার্তার মধ্যে সময়কে সহ্য করছিলাম । একসময় অস্থির হয়ে উঠছিল সে । আমি তাকে তার বাসায় পৌঁছে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই সে বলে , সে একাই যেতে পারবে । আর ও বলেছিল , ইচ্ছে করলে তুমিও আমার মেসে যেতে পার ,যদিও সেটা মেয়েদের মেস ,তবে ছেলেদের গেস্ট রুম আছে ,যদি তোমার প্রতিষ্ঠার অসম্মান না হয় ।
সুযোগ পেয়ে যাই ,বলি , তাহলে তুমিই চল আমার সাথে ।
তার মুখমণ্ডল আলোকিত দেখাল, সে হয়তো আমার থেকে এমন একটা প্রস্তাব আশা করেনি ।
নিজস্ব সত্তার উপস্থিতি গ্রাহ্য না করে প্রান্তিকের হাত ধরি । বলতে শুরু করেও প্রান্তিক সম্বন্ধে গুছিয়ে বলা হয় না । ছেঁড়া ছেঁড়া অগোছাল, বাক্যগুলি পরস্পর সম্পর্কহীন , সবটা বুঝে উঠতে পরিনি । সাহস করে তার হাত ধরি , সেও আমার হাতখানা শক্ত করে ধরেছিল । ধীর শান্ত গলায় বলল, চল ।
অনেকটা ঘুর পথে আসতে হল আমাদের । রাস্তায় মিছিল ছিল , প্রায় প্রতিদিন এমনটা হয়ে থাকে । এই শহর একটু অন্যরকম । এখানে যারা বাস করে তার সকলেই প্রায় প্রতিবাদী । হাতে ফেস্টুন নিয়ে কাতারে কাতারে পথ পরিক্রমা করে । সাধারণ জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায় । হাসপাতাল যাবার পথে রাস্তায় আটকে দেয়,রোগী মারা যায় । তাতে কার কি আসে যায় ? পথ হাঁটতে হাঁটতে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাই । শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছিল একসাথে । এই হাঁটার বাধ্যতা আমার আত্মা পবিত্র আলোর সন্ধান পেতে থাকে । সরাসরি বেডরুমে তাকে নিয়ে আসি , মুখোমুখি হলে একটু বেশি আবেগ ,উদারতা এটা যেন আমার স্বভাব সিদ্ধ । কিছু খেতে হবে । অবিশ্বাস্যভাবে সারাটা দিন অভুক্ত আছি টের পাইনি । ওকে বসতে বলে আমি চা বানাই , পাউরুটি সেঁকে মাখন মাখিয়ে আসতে দেরি হল । সে নির্বিকার বিছানায় শুয়েছিল । আমার হাতে চায়ের ট্রে ও পাউরুটির প্লেট দেখে সটান উঠে পড়ে । খাট থেকে নেমে খুঁজতে থাকে কিছু । টেবিলের ওপর খবরের কাগজ পায় । সেটা বিছানার ওপর পেতে বলে , ওখানে রাখ ।
মনে হল, ও, এমনভাবে জীবন কাটায় যেন পূর্বজন্ম থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছে । অথবা মেয়েদের সহজাত রূপটি প্রকাশ পায় ।
চায়ে চুমুক দিই আমরা । সে প্রশ্ন করে , তুমি একা থাক ? যদিও অর্থহীন প্রশ্ন ।
হ্যাঁ , একাই থাকি ।
ওর খাওয়া দেখে বুঝতে পারি সে অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত,বলি , আর কিছু নেবে? মুড়ি ছোলাভাজা , পিয়াজকুচি , সরষে তেল ? আদাও নিতে পার ।
তাকে উৎফুল্ল দেখাল, ওহ ! কী সাংঘাতিক ! কতদিন মুড়ি খাইনি । তুমি গাঁয়ের কথা ভুলে যাওনি দেখছি ।
তাহলে বানাই ?
খাব তবে একটু পরে , চায়ের বতরটা নষ্ট করব না ।
আমি হাসলাম , বতর শব্দটি তোমার মনে আছে দেখছি ।
সে বলল, সব মনে আছে । তবে মনে রাখতে চাই না । ্প্রান্তিকের সাথে দেখাটা একটা দৈব যোগ বলতে পার । তখন আমার জমিন একেবারে খটখটে ,শুকনো । আবাদ হবে না এই হতাশায় দিন গুনছি । গাঁ ছেড়েছি, পেটের ভিতর ভ্রুণটি হত্যা করে ।
কটরি বলেছিল , ন্যায় অন্যায়ের পাঠ জীবন থেকে শেখে মানুষ । ঐ বয়সে তার জীবন যা তাকে শিখিয়েছে দীর্ঘ যাপনে তা অমূল্য সম্পদ । কেবল যুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই অপরাধ নয় । তাই একটা ভিড় ঠাসা বস্তিতে প্রান্তিক তার যে ভিজে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ,তখনকার সেই হাতটি ছিল মহান দেবদূতের হাত । আর তাকে টেনে তুলেছিল তার ভাড়া করা একটি ঘরের নরম বিছানায় । রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল । পরের দিন সকালে প্রান্তিক তাকে আদর করেছিল । বিশ্বাস যুগিয়েছিল সে তার দায়িত্ব নেবে । নিয়েও ছিল , কলেজে ভর্তি করা থেকে যাবতীয় সহযোগিতায় কোনও ফাঁকি ছিল না । তিন বছর তো আর কম সময় নয় । এর পর হয়তো আর বেশি কিছু দাবি করবে না বলে প্রান্তিকের মনে হলেও বাংলা ভায়া সাহিত্যে মাস্টারস করার আবেদন জানায় কটরি । আবেদন শব্দটি সে সচেতনভাবে ব্যবহার করে । দয়ার ক্ষেত্রে এমনটাই করতে হয় । প্রান্তিক সে আবেদন মঞ্জুর করেনি । বুঝিয়ে দিয়েছিল যে,এমন আশা করা অন্যায় একজন “রাখনির” , যার কাজ হবে মালিকের খেয়াল খুশি মতো তার বিছানায় যাওয়া ।
কটরির এই কথাগুলি আমার নিজস্ব শূন্যাকেও চিহ্নিত করতে চাইছে প্রবল অভিযোগসমৃদ্ধ বায়ু স্তরে । কেউ পুরনো দুঃখ যন্ত্রণা লালন করতে চায় না , কটরি তো নয়ই । তবুও তার ভিতরের মহাশূন্যতা থেকে কথাগুলি বেরিয়ে আমাকেই যেন অপমানে বিদ্ধ করছে । হঠাৎ সে আমার হাত ধরেছিল, আমাকে তোমার এখানে কিছুদিন থাকতে দেবে ? ভাবছ কতটা লজ্জাহীন হলে এভাবে চাওয়া যায় । আসলে আমার মেসে তিনমাসের ভাড়া বাকি । প্রান্তিকের থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি । মুক্তি চাই আমি । অথচ এভাবে লুকিয়ে কোনো কাজের খোঁজ করা যায় না ।
জানি না কেন ভয় পেলাম তার কথায় । এতটা ভয়ের অনুভূতি যা আগে কখনও হয়নি । তার অপাপবিদ্ধ উচ্চারণ আমাকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয় । বুঝতে পারছি আমার নিজস্ব অনুভূতিতে সংবেদনশীলতা জন্ম নিচ্ছে । মনে হল কটরি সত্যি সত্যি আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়তোবা ভিন্ন যাপনের খোঁজ করছে । তার অন্তসারশূন্যতা তাকে একটি আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য করছে । মুহূর্তটা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, অপ্রত্যাশিতও বটে । আবার গভীর নৈরাশ্য থেকে ঘটেছে তেমন নয় , কটরি কথা বলার সময় স্বাভাবিক ছিল ।
বললাম, একটু বিম্রাম নাও ,আমি ততক্ষণে অন লাইনে ডিনারের ওর্ডার দিয়ে ফেলি ।
পরের দিন দশটায় ঘুম ভাঙল । আমি ছিলাম গেস্ট রুমে, আমার বিছানায় সে । রাতে ভাল ঘুম হয়নি , এমনটাই হয়ে থাকে নিজের বিছানা ছেড়ে , ভোরের দিকে ঘুম এল । ঘুম ভাঙার পর দ্রুত দেখতে এলাম সে উঠেছে কি না । বিস্মিত হলাম , দেখলাম শূন্য বিছানা , আর পড়ে আছে এ ফোর সাইজের কয়েকটি কাগজ । তাতে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর । শব্দগুলি ভেসে উঠেছে নিজস্ব সত্তায় । কটরির হাতের লেখা । সে চেয়েছিল অল্প ক’টা দিন । পর পর তিনটি পাতা তুলে নিই । আর এক বেদনাদায়ক পীড়ন ও উৎকণ্ঠায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে ।
এতটা সময় দিয়ে এত লেখার পর সে অদৃশ্য হয়ে গেল ? আর আমি ঘুমিয়েছিলাম ? মুক্তি পেতে চাইছি শ্বাসরোধী আশঙ্কার হাত থেকে , যা আমাকে মেরে ফেলতেও পারে । ও কোথায় ! কোথায় যেতে পারে সে ? এই প্রশ্নগুলি ও উৎকন্ঠার কারণগুলি স্পষ্ট হতে থাকে ক্রমশ । তার অল্প ক’দিনের জন্য থাকতে চাওয়াটা অপরাধ বলে ধরে নেয়াটা আরও বড় অপরাধ ।
সূর্য তখন অনেকটা উপরে । আলো এসে পড়েছে খাট জুড়ে । দেখি, বিছানা শুধু না , ঘরের সব আসবাবে হাত লেগেছে তার , জানালার কাঁচও পরিষ্কার , বাড়ির সু গৃহিনী যেমন করে থাকে । এবার আমি ধৈর্য হারিয়ে সম্বোধনহীন চিঠিটা পড়তে থাকি ।
তোমাকে একটি অবাঞ্ছিত দিনের মুখোমুখি হতে দিতে পারি না । আমার উপস্থিতিহীন সময়টা গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগবে মনে করেই চলে এলাম । পরবর্তী দিনগুলির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা অভাব আছে এই সত্যটি মেনে নিলাম কারণ অতীতে নরক বাসের অভিজ্ঞতা আমার সাথে রয়েছে । আমি বিশ্বাস করি সব খারাপের ভিতর ভাল কিছু গোপনে অপেক্ষা করে । আবার সব ভালোর ভিতরেও খারাপের বার্তা থাকে । প্রান্তিক আমাকে এক অদ্ভুত শরীর উপহার দিয়েছিল । শরীরে যে এত মূল্যবান সম্পদ রয়েছে , শরীর আমাকে শিখিয়ে দিল । আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলিয়ে দেয় প্রথম রাতেই । ওর দেহ আমার আধার হয়ে ওঠে । দু’হাতের শক্ত বেড়া আমার অস্তিত্বকে বিলীন, প্রকাশহীন করে তুলেছিল । ওর কঠিন পৃষ্ঠদেশ,উদর, ঘন লোমের জঙ্গল ,গোঁফের সূচালো অগ্রভাগ , প্রভাববিস্তারকারী বক্ষদেশের আক্রমণ এমন পৌরুষের কাছে সমর্পণ ছাড়া উপায় থাকে না । আমি তার দুই চোখের মাঝখানে ঠোঁটদুটি চেপে ধরি । সে আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করছে , বুকের ওপরে তুলছে , আমার দু’পায়ের সবটুকু ক্ষমতা কেড়ে দু’ভাগে ছিঁড়ে দিয়েছে । শুধু শরীরের ঢেউ-এ ডুবছি আর ভাসছি ,আর তার বুক পাক খেয়ে খেয়ে নেমে যাচ্ছে শরীরের নীচে ডুবে যাওয়ার জন্যে । উত্তাল ফেনায় ফেনায় ঢেকে দিচ্ছে আমার নাভিমূল,ও নীচের বন্দরে ওর অস্তিত্ত্বের শেষ বিন্দুটি উগরে ফেলতে চাইছে ।
তারপর কলেজ পরীক্ষার দিন এলে ,আমি তার কাছে নির্জনতা চেয়ে বসি ; সে ষাঢ়ের মতো ক্ষেপে গিয়ে আমাকে আপত্তিকর মিলনে বাধ্য করে । তিন বছর,যতদিন না কলেজে ফাইনাল পরীক্ষা না শেষ হয় ,ততদিনে তার আসল চেহারার সাথে পরিচয় ঘটে ,ওকে একটি পশু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না আর । একদিন পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে এলাম । গোপনে একটি মেসে থাকি ।
আর পড়তে পারিনি তখন । স্নায়ুর ভিতর রক্তস্রোত বন্ধ হয়ে আসছিল বাকি অংশ না পড়ে পাতা গুলো উল্টে পাল্টে শেষের লাইনে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করি === কাল অনেক রাত্রি অবধি আমরা পাশাপাশি কথা বলেছি ; নানা ভাবে তোমাকে আমার অসহায়তার কারণগুলি বলবার চেষ্টা করেছি । তুমি ছিলে নির্বাক ; আগে যেমন ছিলে । কিকরে তোমার ঘরে থাকি বলো ? অথচ তোমাকে সম্মান করি আগের মতোই । কারণ কোনো পুরুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও তারই বিছানায় একাকী শুয়ে থাকার চেয়ে আর কোনো বড় সৌভাগ্য , সম্মান একটি নারীর কাছে হতে পারে না ।
প্রণাম নিও । নীচে ফোন নম্বার দিলাম , জানি এই চিঠি পড়ার পর আমাকে ফোন করতে চাইবে ।
পাঁচ ।।
খাটের উপর হাঁটু মুড়ে বিছানায় ঝুঁকে কাগজগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে রাখি । মুহূর্ত পরে আবার কাজগগুলো পূর্বের আবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে ফোন নং খুঁজতে থাকি । ফোন করতে হবে তাকে । এর বাইরে আর কিছু ভাব যায় না । রান্নার মেয়ে ফুলন এসেছে । বেল বাজছে । রোজ এঘর ওঘর কাজ করে শেষে আমার ঘরে আসে । রোজগার ভাল । ফুলটুসির মতো শরীর বেচেও টাকা কামায় । বাইরেটা সাদা ধপধপে । দরজা খুলে দিই , অমনি তার শাসন ও নকল প্রেম মিশ্রিত কন্ঠস্বর , কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি , শরীর খারাপ হলো নাকি দাদা ? আমার আবার আজ তাড়া আছে ।
সে প্রতিদিনি শেষের বাক্যটি ব্যবহার করে ; আবার একটু মিহি গলায় কাছে ডাকলে , বিড়ালের মতো পায়ের কাছে লেজ নড়ায় । গোপন কারণটি ছাড়া চরিত্রটি কাজে লাগবে জেনে তাকে চটাই না । দশ বিশ টাকায় কাজ হয় না , একশ টাকার নোট হাতে দিলে তার মুখের জ্যামিতি বদলে যায় , বেতনটা ন্যায্য পাই তারপর শুধু শুধু বাড়তি টাকা নিতে কি ভাল লাগে দাদা ? কিন্তু পেট !
নিয়মিত আপ্ত বাক্যটি বলার পর আমার মুখের ওপর চোখ রাখে , ভাল করে পায়ের পাতা পর্যন্ত জরিপ করে তারপর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, ও দাদাবাবু কি হয়েছে তোমার ? এমন দেখাচ্ছে কেন ? মুখ চোখ বসে গেছে, চল ঘরে চল, বিশ্রাম নেবে । সে আমার হাত ধরে টানে, বিছানায় শুইয়ে দেয় , তুমি শুয়ে থাক, আমি তোমার জন্যে জামা কাপড় আনি, এই বাসি কাপড় ছেড়ে দাও । এটা তার সরাসরি আসল কাজটি না করে ভিন্ন পথে এগিয়ে যাওয়া । তারপরের কাজগুলি সে করে অত্যাধিক যত্ন নিয়ে, আমার শরীর থেকে জামা কাপড় খোলে, বিছানা থেকে উঠতে না দিয়ে । আর সেটা করার সময় আমার দেহের অপ্রকাশিত নিষিদ্ধ অঞ্চলগুলি কৌশলে অথবা গতানুগতিক কার্য সম্পন্ন করার রীতিতে স্পর্শ করে । আশ্চর্য তার মুখের রেখাচিত্র বদলায় না । কেবল আমি ভিতরে ভিতরে শিহরন অনুভব করি । নিজেকে সেই আকশ্মিক ভাল লাগা থেকে মুক্ত করতেও পারি না । সে আমাকে প্রশ্ন করে ঠান্ডা লেগেছে , ‘শরীলে’ ব্যথা ? কি রান্না করব ?
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ,নিজেই কত রকমের কথা যার মধ্যে এক সরল আন্তরিকতা আমাকে ছুয়ে যায় মাঝে মাঝে । এটাই সত্য যে আমার সব রকম অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাই এক অসম্ভব যৌন সুখের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে । এমনটা আগে কখনও হয়নি তা না , তবে আজ অন্য রকম । তবে কি কটরির সাথে গভীর রাত পর্যন্ত যৌন আলোচনাগুলি ভিতরে ভিতরে ক্রিয়াশীল ? রাতে আলাদা বিছানায় শোয়ার মধ্যে মিথ্যাচারের চিত্রটা ফুটে ওঠে বেশি । সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল কটরি ।
এক ব্যাখ্যাহীন ঘোরের মধ্যে ফুলনকে বলি অথবা আপনা আপনি ঠোঁটের ফোকর গলে বের হয় , হ্যাঁ একটু লাগছে ।
সে প্রায় চিৎকার করে ওঠে , আমি ঠিক ধরেছি , শুয়ে থাক । আমি ‘বিরেক ফাসট’ বানিয়ে দি খাও আগে , আরপর গরম সরষে তেলে রসুন ফুটিয়ে মালিস করে দেব । দেখবে একদিনেই সর্দি ছেড়ে পালাবে ।
আধ ঘন্টার মধ্যে ব্রেকফার্স্ট আমার হাতে ধরিয়ে দেয় । কটরির চিঠি র পাতাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চোখের সামনে । তুলে নিলাম । উল্টে পাল্টিয়ে একটি পাতায় চোখ থামল —- “তুমি হয়তো জানো বিচরণ ভূমির অনিয়ন্ত্রিত গতিটানে কৌতূহলের সীমা ছুঁতে ভেসে যাব একসময় । আমার হাতের নাগালে থাকবে কাঙ্ক্ষিত উপকরণ । তা এতটাই সহজলভ্য যে , কোনটা নেব কোনটা নেব না সেটা ভাবার বিচার বুদ্ধি থাকবে না । তখন হয়তো তুমি মৃতমাংসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে ছায়াপথের অলিন্দে নিজেকে পোড়াবে । পুড়ছ জেনেও খবর নেব না , বরং গ্রহণের তালিকা ফাঁকা করে রাখব , নতুন খবরের জায়গা করে দিতে ।
একথা বলার যে কয়’টি কারণ তা আমার মন গড়া নয় । জীবন আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু । শরীরকে দিয়েছে ভোগের আনন্দধারা । নির্যাতনগুলি স্থান পায়নি । যাপনের নিয়ম রীতির ব্যতিক্রম মনে হলেও এটাই ঠিক, এইভাবেই ইতিহাস সত্যি হয় ।
কত নামে তোমাকে সাজাই ;কোনোটাই তোমাকে স্পর্শ করে না , তোমার পছন্দ হয় না । আমার ভিতরের আমিটার মূল্যায়ন না করে বাস্তবতার কদর্য দৃষ্টি থাকে তার ওপর । এইসব টের পাই তোমার কাছে এলে । নাভিমূলের উপরিভাগে মানুষ যে মূল্যবান বস্তুটি যত্ন করে বেঁধে রাখে ; সেখানে আমি তোমাকে রেখেছি । সেই ধরে রাখার অবস্থানটা তোমাকে অনুসরণ করে । প্রতিটি অনুপল তোমার সাথে থাকতে চায় । তাই সে তোমার শ্বাসপতনে মূর্চ্ছা যায় । বুঝি কতটা দূরত্বে তুমি রয়েছে ।
প্রান্তিক চলে গেছে , বলতে পার আমিই পালিয়ে এসে আত্মগোপন করেছি । সে আমাকে খুঁজছে । ভালবাসার টানে নয় , শাসন করার অধিকারে । এরপর তোমাকে দেখলাম টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে । আবার শুরু হল প্রত্যাশার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন । কেউ কারও বিকল্প হতে পারে না । আবার আমার অতীত তোমার পছন্দ নয় জেনেও মনে হয় এই মহা পৃথিবী সব কিছু ফিরিয়ে দেবে । সেই প্রত্যাশায় অনুভূতির দরজা খুলে তোমার ঘর অবধি হেঁটে গেলাম ।
আমি জানি কোনো রকম যুক্তি মেনে জীবন তার গন্তব্যে বা পথের শেষে পৌঁছায় না । আমার আন্তত তাই মনে হয় । জীবনের আত্মাকে এক মহা জটিলতার আত্মা বলা যেতে পারে । মানুষ সবকিছু যতটা সহজ ভাবে ততটা সহজ নয় । আমি এমন এক বর্তমানের ওপর নিবিষ্ট, যে বর্তমান প্রকৃতরূপে প্রসারিত হয়ে আমার অতীতকে নিজস্ব দিগন্ত থেকে মুছে দেয় । সাম্প্রতিক অনেক ঘটনার একটি হয়ে উঠি , যার কোনো আগামী দিন নেই । তোমার “ছায়াবৈরী” উপন্যাস আমি পড়েছি । দেখেছি এই পৃথিবীতে মানুষ কেমন করে নিজের কাছে নিজেই বৈরী হয়ে উঠছে । একেবারে নিখুঁত চিত্র তুমি এঁকেছ । আমি তোমার “নিসর্গের রূপকথা”ও পড়েছি, দেখেছি মানুষ কত আসহায়, নিজের নিয়ন্ত্রণে তার নিজের কোনো হাত থাকে না । অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভালো মন্দের কোলে আত্মসমর্পণ করতে হয় । আমিও তার থেকে আলাদা নই । আমার কাছে যদি ভবিষ্যতের কোনো মূল্য না থাকে , তাহলে কিসের সাথে আমি জড়িয়ে আছি ? ভগবানের সাথে ? দেশের সাথে ? মানুষের সাথে ? তার উত্তরটাও তোমার কাছে হাস্যকর ঠেকবে , আমি ক্ষয়িষ্ণু সমাজের উত্তরাধিকার ছাড়া আর কিছুই নই । এটাই সত্য ।
রসুন তেলের পোড়া গন্ধে আমার বিভোরতা কাটে । দেখি ফুলন আবার মায়ামোহময় দৃষ্টিতে আমাকে নিরিক্ষণ করছে । তারপর সে অতি সতর্ক হয়ে দ্রুত অমাকে ঠেলে বিছানায় শুইয়ে দেয় । পায়ের তলায় তেল মালিস করতে শুরু করে । একসময় তার হাত ও হাতের আঙুলগুলো আমার সারা শরীর দখল নেয় । গরম তেল ও তার আঙুলের জাদুবিদ্যার ঐন্দ্রজালিক পারদর্শিতায় আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি সম্পূর্ণ ভাবে । সেচ্ছায় আত্ম সমর্পণের এক আলোকোজ্জ্বল শূন্যতার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি । আমার শরীরের বিশেষ অঙ্গটি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতেই , ফুলন উঠে দাঁড়ায় , বলে , দাঁড়াও ছটফট করো না ,শাড়িটা খুলি , নোংরা হয়ে যাবে,তুমিতো আজ পর্যন্ত একটা শাড়ি কিনে দিলে না ।
ছয় ।।
রাতে কটরিকে ফোনে ধরি । সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল । তার ভারী কন্ঠস্বরে জড়তা জড়ানো । হ্যালো শব্দটি লম্বাস্বরে সময় নিয়ে উচ্চারণ করে ।
আমি । গলা চেনা যাচ্ছে ?
বাম হাতে ধরি ফোন । বার বার ডান বাম এভাবে বদল করা আমার অভ্যাস ।
আমাকে চিনে নিতে ওর কষ্ট হয়নি । পরিষ্কার গলার আওয়াজ, ভাবতে এতটা সময় লাগল তোমার , আমি ভেবেছিলাম সকালেই ফোন করবে , যে বিশ্বাসে ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম । বিকেল বুড়িয়ে যাবার পর আশা ক্ষীণ হতে থাকে । রাতের শুরুতে অস্থিরতা নিয়ে শুয়ে পড়েছি , এমনটা আগে কখনও হয়নি । আমাকে তুমি যেমন খুশি ভাবতে পার , কিন্তু আমি তোমাকে আত্মীয় বলে জানি । একই গ্রামে আমাদের জন্ম শুধু সেটাই কারণ নয় , তোমাদের বা্ড়ির সাথে আমাদের পরিবারের একটা আত্মিক যোগ ছিল । অন্তজ শ্রেনীর অচ্ছুতের দূরত্ব মেনেও তোমার মা আমার মাকে ভালবাসত, সে আমার মায়ের কাজের পরিচ্ছন্নতা কি না জানি না । সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কতবার যে তোমার মায়ের কাছে দূরত্ব রেখে আদর খেয়েছি ! কতবার থালাভর্তি ভাত মাংসের ঝোল , জানবে কী করে ? তুমি তো তখন হোস্টেলে । তোমার মনে নেই , একবার আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি , তুমি তখন কলেজ , মা বলেছিল , তুমি এলে অংকের খাতাটা নিয়ে যেতে , যেগুলো পারিনি সেগুলো শিখে নিতে । আমাদের পাড়ায় আমি একমাত্র লেখাপড়া করতাম । বাকিরা যারা আমার বয়েসি তারা গোবর কুড়িয়ে , জ্বালানি ,অথবা পুকুরে মাছ ,গুগুলি হাতড়ে দিন কাটাত । পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করতাম বলে সফি মাস্টার বাড়িতে নিয়ে যেত । ফেরার পথে তোমাদের বাড়ি । উঁকি মারতাম তোমাদের দরজায় ,ঢুকতে ভয় লাগত, তোমার মা দেখতে পেলে আমাকে ডাকত । মুড়ি আর কাঁচা গুর , মানে আখের গুর দিত । বৃহত্তর পরিচিতির মাঝে এসব তোমার মনে থাকার কথা নয় ।
হঠাৎ সে চুপ করে যায় । আমি অস্থির হয়ে তাকে বলি , তারপর ? থামলে কেন ? বলো বলো কী হল তারপর , আমার কিছুই মনে নেই ।
কী করে থাকবে ? আমি কি তখন সুন্দরী যুবতি ছিলাম ? তখন আমি পুচকে একটি মেয়ে যার সারা শরীর জুড়ে অপরিচ্ছন্নতার ছাপ । যার নাকে ঝরত সর্দি । চুলগুলি জট পাকানো , বাদামি রঙের । কারও দৃষ্টি পড়ত না আমার ওপর, তোমার কি দোষ বলো ?
সেদিনের কথা বলো ।
সেদিন তুমি সব আংকগুলি করে আমাকে বলেছিলে, নিজে করে দেখাতে । আমি সবগুলি পারিনি , তুমি কলম দিয়ে আমার মাথায় খুঁচে দিয়েছিলে । কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে মাথার মধ্যে শুকিয়ে গেছিল । লাভের মধ্যে লাভ হয়েছিল কলমটি তুমি আমাকে দিয়েছিলে । সেই কলমটি এখনও আমার কাছে আছে : যদিও তাতে আর লেখা হয় না । তারপর তোমার মা বাবা শহিদ হলেন , হাজার হাজার লোক শোকে বিহ্বল হয়ে আমাদের গ্রামে ছুটে এল । তোমার বাবার শহিদ বেদি হল । পার্টির লোকেরা তাকে নিয়ে , তার আদর্শের কথা বলে ভোটে সেবার জয়লাভ করল ।
এক রহস্যমুগ্ধতায় বিভোর হয়ে শুনছি কটরির দীর্ঘশ্বাস ; আমারও শ্বাস পতনের শব্দ দেয়ালের নীরবতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে । সে বলল, ঘুমিয়ে গেলে নাকি ?
না. তুমি কাল সকালে একবার এসো ।
কেন ? কাল যে হবে না ।
না,না তোমার কোনও অজুহাত শুনতে চাই না , অধিকার সুলভ কন্ঠস্বরে জানাই, ফোন রাখছি কাল সকালে এসো , অপেক্ষা করব ।
তারপর চোখ বুজেছিলাম । ঘুমের বহু দরজা পার হয়ে আসার পর, অন্ধকারে আলোকিত করে রাখার স্বপ্নযাপনের ম্লান মৃদু আলোর উপস্থিতিতে চোখ খুলতেই হল । তখন এক ভিন্নতর চিন্তা স্রোতে বিন্দু বিন্দু শব্দের বুদবুদ । ফুলনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শিহরন ,বা তার শরীরের অস্তিত্ব সেখানে নেই , যদিও বিছানা থেকে তার রতিসুখের গোগানি ভেসে আসছে । নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না । উপুর হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি । তখন দৃশ্য ঠেলে কটরির অদৃশ্য উপস্থিতি পূর্ণ জ্যোতি স্থাপন করে । চুড়ান্ত অপমানের পরেও আত্মবিশ্বাসে তার এগিয়ে আসা ও একটি চুম্বনের প্রতীক্ষার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই । আমার সৃষ্টি যতই উর্বর , সৃজনশীল হোক না কেন ওর ভিতরের ছবি ঠিক মতো তুলে ধরতে পারব না । যদিও রাতের নির্জনতায় একাকী নিজের কাছে নিজেই ভগবান হয়ে উঠি । পৃথিবীর ঘোরতর বিপদের দিনে খুব সহজেই মুক্তির সহজতম পথ খুঁজে পাই । আমার লেখার ক্ষেত্রেও সে রকমই ঘটে থাকে , কল্পনা করতে পারি ,কটরি আমারই খাটে বসে আছে । হ্যাঁ স্পষ্টত আমি দেখতে পাই ,তার পিঠের বিস্তৃত লোভনীয় জায়গা ফাঁকা । কোমর সরু হয়ে আবার মেদহীন চওড়া উরুময় । ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে ।ওর সম্মোহনসৃষ্টিকারী শরীর ,ওর আওয়াজ যেন জাদুসূচের মতো আমার হৃৎপিণ্ডকে বিদ্ধ করে । এই অবস্থার ভিতর আমি জানালার ধারে মাথা চেপে ধরি , শুনতে পাই শব্দের টুকরো টুকরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধ্বনি কটরির অনুপস্থিতিকে সূচিত করছে । মুহূর্তে আমার চোখ খুলে যায় , এটাই সত্য যে ,সে কোনও মতেই আসতে পারে না । এমন কি সকালটাও অনিশ্চিত হতে পারে । দু’টি ভিন্ন ধরনের বাস্তবতা অথবা পরাবাস্তবতার সংঘর্ষে আসার হয়ে পড়ি । সব রকম বন্ধনমুক্ত হয়েও এই ম্রিয়মান মুহূর্তের শান্তি, ফুলনের পৃথিবী কাঁপানো স্তদ্ধতার চেয়েও স্পর্শকাতর । অথচ গোপনে বা প্রকাশ্যে যে কোনও রকম সম্পর্কের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারি আমি,এতদিন যা ঘটেছে ।
যৌনতার বিষয়ে আমার ক্ষমতা ও অক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে । আবার এই বিষয়ে আমার বক্তব্যে থুথু ছিটাতেও পারে ; তবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার জীবনে ফুলনই প্রথম নারী যে আমাকে যৌন বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে । ছিটে ফোঁটা যৌনতা বিষয়ে অতি সাদামাটা পাঠ নিলেও সেটা ছিল আতি সাধারণ পাতি গেরস্থালি জীবনের যৌনাচার,এটাই সত্যি । যে কারণে আমার লেখার জাদুঘরে কটরির মতো চরিত্রের আর্বিভাব ঘটলে সে সহজেই বলতে পারে , প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাহীন লেখার মধ্যে মিথ্যাচার স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের চোখে । এখন বুঝতে পারি আমার লেখাগুলি মিথ্যাচারের অতিকথন । ফুলনের শরীর ও শরীর সম্পর্কিত যা কিছু দিনের আলোতে শিখিয়ে দিয়ে যায়,আমার লেখাগুলির সাথে তার মিল নেই । সেই মোহাবিষ্টতায় কটরিকে ফোন করা হয়নি, রাতে তাকে ফোনে ধরতে হল ।
সকালের প্রতীক্ষা শেষ হবার নয় । সন্দেহের কোনও ছায়া ব্যতিরেকেই আমি তারই অপেক্ষায় ছিলাম । দূরের আকাশ থেকে ভেসে আসা ধোঁয়ার মতো মেঘ সকালকে গিলে ফেলেছে বহুক্ষণ আগেই, কারণে অকারণে শঙ্কিত হয়ে উঠছি । কমলা রঙের সূর্য দেখে ঘুম থেকে উঠেছি । তখন আকাশ ছিল পরিষ্কার । এখন ছায়ারা বিস্তার ঘটাচ্ছে পৃথিবীর বুকে । ফুলন আসবে না । ওর ছেলের চিকিৎসার জন্য পীরবাবার মাঝারে যাবে । এরা দৈবে বেশি আস্তা রাখে । উপরে চোখ মেলে তাকায়, দেবতারা আছে সেখানে । লোকের বাড়িতে কাজ করে । ফাঁকা ঘরে দেহের ওপর একজন পুরুষকে চিৎ হয়ে শোয়ায় । মাথার ওপর আকাশে অপচ্ছায়া ভেসে যেতে দেখে । বিশ্বাস করে অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে প্রেতাত্মা , যারা বলে দেয় ভবিষ্যৎ , যেখানে সুদিন আসে না ।
কটরি আসবে কি না এই বিষয়টি ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে যেতে মন চায়নি ,জানি না কেন । অপচিন্তা মাথার ভিতর বিস্তার লাভ করে ।
বৃষ্টি ! হঠাৎ পরিবেশ পালেটে যায় । উত্তর পশ্চিম থেকে হাওয়া ঝড়ের বেগে বৃষ্টির সঙ্গে আছড়ে পড়ে । কিছুক্ষণের মধ্যে মন হল নীচের পৃথিবী কোনও নদীর প্রবহমান উপরিতলের মতো । জলের ওপর জল,তার অবিরাম ধারা । ক্ষুধা পেয়েছিল,দেখা যেতে পারে কিচেনে কী আছে । ঠিক তখন ই ভিজে বিধ্বস্ত কটরি এসে সামনে দাঁড়ায় ।
কটরির বাবা কাজল একজন শিল্প সচেতন মানুষ বলে কেউ কেউ মনে করত । এখন সে নেই । তার অপমৃত্যু নিয়ে অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছে।চল্লিশ বছর একটি জীবনের আয়ু’কাল নিতান্তই হতাশা ব্যঞ্জক,অপরদিকে আমার পিতার মতো শিক্ষিত আদর্শবাদী মানুষ মনে করেন ,মাতাল, নৈতিক বাছ বিচার নেই ,খায় আর পয়দা করে , মা বোন ভেদাভেদ নেই, তাই ওদের গড় আয়ু পঞ্চাশের মধ্যে । কেউ কেউ জানে অভাব,অপুষ্টি জনিত কারণে ওই পাড়ায় মৃতের সংখ্যা বেশি । অজানা রোগে অনেকে মারা যায় । পাড়াটিতে পনেরটি পরিবারের বসবাস যারা দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে । বাকি গ্রামের উচ্চ মধ্যবিত্ত , আর বাবার মতো জোতদার পার্টি কর্মীর বাস । যারা ইচ্ছে করলে ওই পনেরটি পরিবারের দায়িত্ব অনায়াসেই নিতে পারে ,তেমনটি হবার নয় । কেন না ওই পরিবারগুলি কায়িক পরিশ্রম করে তাদের খেতে,অল্প বেতনে তাদের কাজ করিয়ে নেওয়ার সুবিধা পায় ,ভোটের সময় তাদের ভূমিকা প্রধান হয়ে দাঁড়ায় ,অভাব না থাকলে এই সুযোগ হয় না ।রাজনীতি করা যায় না । এসব দুর্গন্ধময় পচা দৃশ্য । প্রাচীন কাল থেকে এক ই রকম ,এ নিয়ে কত লেখা হল , কতজনে নোবেল পেল,ওদের অবস্থার পরিবর্তন হল না ; এখন আর এগুলো লেখার বিষয় নয় । নেশার ঘোরে কে কোথায় কার ঘরে ঢোকে , এসব নিয়ে সকালের জন মুনিষ খাটা মানুষগুলোর রুচির বদল ঘটে না । কটরি এমন এক পরিবেশ থেকে নিজেকে অসাধারণের ভূমিকায় পৌঁছাতে বধ্য পরিকর । দেহের শুচি অশুচি নিয়ে ভাবার সময় কোথায় ! আর সে মনে করে এই শব্দগুলো অভিধান থেকে তুলে দেয়া উচিত । কেননা এগুলি কেবল নারীদের বেলায় ব্যবহৃত হয় । গ্রাম্য জীবন , সেখানে যাপনের মধ্য দিয়ে যে মূল্যবোধ গড়ে ওঠে সেখান থেকে সে সহজেই বেরিয়ে এসেছে । তার সাথে কথা বলে জানা যায় , ভিন্ন এক মূল্যবোধের জন্ম দিয়েছে সে নিজে । জীবন তাকে শিখিয়ে দিয়েছে ; সে মনে করে জীবনই প্রকৃত ধর্মগ্রন্থ । এই ধর্মগ্রন্থের নীতিকথাগুলো প্রকৃত সংঘর্ষের মধ্য ধেকে বেরিয়ে আসে । সংঘর্ষগুলির মধ্যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির শিকার তার বাবার সাথে শারীরিক মিলন , বাবার আত্মহত্যা, এবং মাতব্বরদের নির্যাতনের অভিজ্ঞতা ।
এই ভিজে শরীরে ঠান্ডা লেগে যাবে জেনেও তুমি দাঁড়িয়ে আছ ? ঘরে যেতে বলবে না ? তুমি কি ডেকে আমাকে অপমান করবে ?
তার কথায় লজ্জা পাই । এত প্রতীক্ষা যার জন্য সেই যখন সম্মুখে দাঁড়িয়ে তখন আমি নির্বাক । দ্রুত ঘরে আসি ,ওকে দেখিয়ে দিই আলমারি । তারপর আমার লেখার ঘরে ফিরে আসি । কিছুক্ষণ পর সে আসে দুই হাতে দু’টো কাপ , এই নাও, কফি বানালাম , এই ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে ।
বলার কিছু পাচ্ছি না ,কাপটি হাতে নিয়ে ওকে দেখি,পয়লা বৈশাখ এক পাবলিসারের উপহার দেওয়া পাঞ্জাবীটা সে পড়ছে । প্রথমে আঁৎকে উঠি, পরে সামলে নিই, ওদিকে কটরি তার ফোলা ফোলা চোখে বিস্ময়ে তাকিয়ে আমার বিস্ময়কে উপভোগ করছিল । কফিতে চুমু দিই, আমার তখনও ব্রেকফার্ষ্ট হয়নি । ঝড়জলে লাঞ্ছের ওর্ডার দেয়া হয়নি, তুমি লাঞ্ছ করবে তো ?
বাহ্ ! তুমি তো কথায় কথায় বেশ অপমান করতে পার ! তা কর , তবে জেনে রেখো আমি বেহায়াকেও ছাড়িয়ে যেতে পারি । তোমার অপমান আমাকে স্পর্শ করে না ।
এমনটাই হয়ে থাকে । কেন হয় ? ও এলেই কথা বলতে গিয়ে বেফাঁস কথা বলে দি ই কেন ? ও আমার মুখোমুখি হলেই আমার মধ্যে যে কোনও কারণেই হোক পরিবর্তন যে ঘটে চলে তা কি ও বুঝতে পারে ? যদি পারে তবে সেটা হবে লজ্জার ।
এত বেলা অবধি না খেয়ে আছ , দরকার নেই বাজার থেকে খাবার আনার,আমি রান্না করে দিচ্ছি । চল কিচেনে কী আছে দেখি । সে চুমু দিয়ে কফি শেষ করে ফেলে , ব্রেড আছে ? ডিম ?
আমি ঘাড় নাড়ি, সে এগিয়ে যায় কিচেনে । আমি তার পেছনে । হঠাৎ সে পেছন ফেরে, আচ্ছা বিয়ে করোনি কেন ? আবশ্যে আজাদ থাকার অনেক সুফল আছে । ইচ্ছে মতো উপভোগ করা যায় ।
না । তেমন পাইনি ,যাকে বিয়ে করতে পারি ।
বাঁচা গেল ! নিশ্চিন্তে রান্নাটা করতে পারব । আসলে আমি কোনও ব্যক্তিগত কথা জানতে চাই না , সেদিন রাতেও তাই জানতে চাইনি , তোমার কেউ থাকলে জানার পর রান্নায় মন বসত না ।
তারপর একটু ঠোঁট কাঁপে তার, এইটুকু হাসির নানা রকম অর্থ হতে পারে । কী জানি সব কিছু কেমন ভৌতিক বলে মনে হয়েছিল ।
অমন করে আমার দিকে তাকালে–এই বেহায়া আমি লজ্জায় পড়ে যাব । যাও তুমি বিশ্রাম নাও । আমি দেখি তোমার ফ্রীজে কী রয়েছে ।
আমাদের লাঞ্ছ সারতে বিকেল গড়িয়ে যায় ,কটরি বলে, আজ আর ঘুমাতে হবে না অবেলায় , বিকেলটা গল্প করে কাটিয়ে দিই । আমাকে কেন ডাকলে জানা হয়নি ।
আমি স্বাভাবিক । খাবার সময়ও ছিলাম । ওর রান্নার প্রশংসাও করি । কেন ডেকেছি বলার আগে জানতে হবে ও কী চায় । বালিসটা টেনে কোলের ওপর রাখি , তখন ও সরে আসে আমার কাছাকাছি , আর একটা নেবে ? এনে দেব ?
না থাক , তুমি সেদিন বলছিলে না ? যে প্রান্তিক তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল , করলে না কেন ?
কটরি আমার মুখের দিকে তাকায়, আমার বিয়ের সাধ মিটে গেছে ,সংসারেরও । বিয়ে মানে তো সমাজ স্বীকৃত ধর্ষন । আমি তোমাকে সম্মান করি ,মিথ্যে বলব না , আমি নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই । যেখানে যাপনের সরলতা থাকবে । মিথ্যাচার থাকবে না । বিয়ে না করে কোনো মনের মতো বন্ধু যদি পাই তার সাথে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব । ওই যে বলে না একটা গালভরা নাক কুচকানো কথা লিভ টু গেদার । জানো তো , আমারা প্রতিটি মুহূর্ত মিথ্যার সাথে জড়িয়ে থাকি । আমার ক্ষেত্রে তেমন টা নয় ,কোনো কারণ নেই ,কোনো ক্ষেত্রেই নিজেকে আড়াল করি । এই যেমনটা বললাম , কোনো সন্তান চাই না, কেননা আমি পারব না তাকে তার যোগ্য পাওনা মিটিয়ে দিতে ।
তারমানে ? কী বলতে চাইছ তুমি ?
বললে তো তোমাকে দিয়ে বলতে হয় , এই যে তুমি সেদিন আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে এলে , তোমার বিছানা ছেড়ে দিলে ,অথচ তোমার আমার মধ্যে কোনও লুকানো সম্পর্ক নেই ।
সে তো তোমার মতো একটি মেয়ের জন্যে !
তার মানে ? আমি তো সমাজে একজন চতুর্থ শ্রেণীর নিম্ন জাতের মেয়ে ।
না ,সে ভাবে ভাবি না , ভাবলে ,তোমাকে আমার বিছানায় শুতে দিতাম না । গলার স্বর উচুতে ওঠে অজান্তে ।
এটাই কি সত্যি ?আসলে তোমার ভেতরে যা বাইরেটা কি এক ই রকম ?
কী বলছ এসব ! কতটা জানো আমার সম্পর্কে ।
যেটুকু জনার জানা হয়ে গেছে । এই যে তুমি সেদিন রাতে আমাকে রেখে দিলে , তোমার বিছানা ছেড়ে দিলে , তুমি দেখাতে চাইলে একা নারীকে সম্মান দেখানোর মতো মহান মানুষ তুমি । একটু ভেবে দেখ এর মধ্যে মহত্বের কিছু নেই , একটা মানুষ আর একজন মানুষের এমনটাই করা উচিত । যেটা মিথ্যাচার তা হল ভান করা , আমাকে একা পেয়ে তোমার প্রচন্ড ইচ্ছে হতেই পারে আমাকে আদর করতে । পারলে না । নারী পুরুষ খুব স্বাভাবিক ভাবে মিলিত হবে এর মধ্যে ন্যায় অন্যায় , শুচি অশুচি থাকবে কেন ? অন্তত আমি বিশ্বাস করি না । হ্যাঁ , প্রান্তিকের ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত নেয়া যায়নি ব্যাভিচার মনে করে নয় , তার ভোগের ধরনটা পশুর থেকেও খারাপের দিকে চলে গেছিল বলে । কী রাগ হল ? তা রাগতে পার , তবে বলে ফেল কেন সকালে আসতে বলেছিলে ?
আমি শুনি, উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না । সে আমার নীরবতাকে অবহেলা না তাচ্ছিল্য করল ভাবি ।
জানো, নিজেকে কোনো ভাবেই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি না । সূক্ষ্ম , গতিশীল রাখি সর্বদা । সূক্ষ্মতার অর্থ ইচ্ছাশক্তি,দৃঢ়তা । দুর্বলতা নয় । সম্ভবত সেই কারণে আমি মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারি । একাকীত্বকে ভয় পাই না । ভিড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে ভালবাসি । মানুষের চোখে কৌতূহল ফুটে উঠতে দেখি । ওদের কামনা –বাসনা জেগে ওঠে । এভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ তোমার জানা নেই । আমার মধ্যে জীবন শুরু এবং শেষ । বুঝতে পারি না কেন তোমরা অশান্তির মধ্যে ঢুকে থাক ! এভাবে থাকা বুদ্ধি নাশ করে । আমাদের ভেতরের আনন্দ,উৎসাহে জল ঢেলে দেয় । বিছানা ছেড়ে উঠে যায় সে , জল খায় , তারপর আমার মুখোমুখি বসে , তুমিতো জানো আমাদের গ্রামে কয়েক ঘর অন্তজ শ্রেণীর বাস । যাদের কোনো অভিভাবক নেই । বর্ণ প্রতিষ্ঠিত মানুষের অনিচ্ছাকৃত দয়ায় বেঁচে থাকে । বাছ বিচার মেনে সংকুচিত জীবন যাপন করে । তেমন একটি পরিবার থেকে আমার মুখে বড় বড় কথা শুনছ, বেমানানই নয় অপরাধও বটে । প্রথাগত ভেদাভেদ তোয়াক্কা না করে তোমার বিছানায় উঠে আসা স্পর্দ্ধার নিশ্চয়ই । আবশ্য তোমরা নিজেদের লালসায় যখন আমাদের মতো মেয়েদের বিছানায় তোলো ,সেটা ভিন্ন বিষয়, তোমাদের চোখে অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে না । তোমার মতো অনেকের পাশাপাশি নিজেকে দাঁড় করাবার সাহস রাখি । এর মধ্যে কোনো অপরাধ ও স্পর্দ্ধা দেখি না ।
আমি তাকে যত দেখছি তত আকৃষ্ট হচ্ছি । তার বাগ্মিতা ,বাস্তব শিক্ষা, উজ্জ্বল স্মৃতি সূক্ষ্ম কৌতুকরসবোধ ওর ব্যক্তিত্বের চরম দিক । তার উপস্থিতি আমার ঘরের পরিবেশ মোহময় সুন্দর করে তুলছে । মনে হয় সে একজন প্রকৃত হৃদয়স্পর্শী মানুষ । আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি ওর সৌন্দর্য আমার অন্তরের অপ্রকাশিত নিঃসঙ্গতা নিঃশেষ করতে পারে ।
কথার পর কথা শেষ হয় না । আমিও ধৈর্য ধরে শুনি । বলুক , ওর মনের গভীরে পুষে রাখা ক্ষোভ, লুকিয়ে রাখা ক্রোধ থেকে মুক্তির পথ-কথা বলতে দেওয়া । কথার তরঙ্গস্রোত বয়ে যায় । আমি ওর পিছে পিছে ডিনার বানানোর কাজে সাহায্য করি । ঘড়ির দিকে নজর ছিল না । রাতের নিঃস্তব্দতা নেমে এসেছে শহর জুড়ে । ডিনারের পর আমি বলতে চেয়েছিলাম, এই মুহূর্তে আমার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় তুমি । পারলাম না । তার আগেই ও বলে দেয়, আমি তোমার সাথে ঘুমাবো ?
এই সুয়োগ মেয়েদের থেকে আগেও এসেছে আমার জীবনে । নৈতিকতার ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না । শুধু গোপনতা রক্ষা করি । সামাজিক প্রতিষ্ঠা অক্ষুন্ন রাখতে গোপনতা জীবনদায়ী ট্যাবলেট । পরক্ষণেই মনে হলে , আমি এই রকম ! ছিঃ !তার সরাসরি প্রস্তাবে সমস্যা মুক্ত হই । ভেতরে ভেতরে কল্পনা করে নিতে আটকায় না রাতের যুদ্ধে ফুলনকে ছাড়িয়ে যাবে কটরি । শেষ পর্যন্ত আমি দ্বিধামুক্ত হব । মিথ্যাচার সরিয়ে শুয়ে পড়ব তার পাশে । শরীরের দিকে নজর পড়বে ,তখন সে দুষ্টুমিভরা হাসি নিয়ে অপেক্ষা করবে । কল্পনার স্রোতের মাঝে আচমকা জেগে উঠি এক অনৈসর্গিক আকাঙ্ক্ষায় । মনের গহীন অন্ধকারে অনুভূতির দরজা খুলে যায় । ধাতব পিন্ডের মতো বেড়ে ওঠে কিছু । স্পষ্টত বুঝি ধীরে ধীরে ভয়ংকর শক্তি নিয়ে তার প্রকাশ ঘটবে । সতর্ক হতে হবে । আত্মরক্ষার যুদ্ধে নিজেকে তৈরি রাখতে হবে । যদিও তা চাই না । এই মিথ্যাচারে শরীর লাল হয়ে ওঠে । ঘামতে শুরু করি । ওদিকে শিরায় শিরায় রক্তের প্রবল গর্জন ।
কটরি কথা বলে, সিদ্ধান্ত নিতে জট পাকিয়ে ফেলেছ মনের ভিতর । এমনটা আশা করনি । তুমি বিশ্বাস করতে পার যে, তুমি জোর না করলে নিজে থেকে কোনো অপত্তিকর কাজের কৌশল করব না । তবে কেন তোমার পাশে শুতে চাইছি ? প্রশ্নটা স্বাভাবিক তোমার মনে জাগতে পারে,তাই জানাই, রাতে শোয়ার পর আমার ঘুম আসে না । অনেক রাত অবধি জেগে থাকি,তুমি পাশে থাকলে যেটুকু সময় জেগে থাকব গল্প করে কাটানো যাবে ।
এমন নিষ্পাপ সরল উচ্চারণে আমার আত্মা আলোকিত হয় না । সন্দেহ মেশানো দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে । মশকরা নয় তো ? ওর রাত পোশাকের নীচে নীলাভ ছায়ায় শরীরটা পুরোপুরি পরিষ্কার ভেসে উঠেছে । বাম হাত স্ফীত স্তন আঁকড়ে, মসৃণ পেটের ত্বকে ডান হাতের আঙুল । স্থির হয়ে সেঁটে গেল দু’চোখের দৃষ্টি । এসব কেন ? ওর প্রতি সহানুভূতি না ভালোবাসা , না আমার স্বভাব যা আমাকে লালসায় আলোড়িত করে চলে । নাকি কটরির অপমান, অপমানের অনুভূতি এতটাই প্রবল, যে সে নিজের ছাড়া অন্যের চিন্তাও করে না । এভাবে নিজেকে লোভনীয় করে তোলার কারণ ? মাঝারি গড়নের এই সুন্দরী যুবতি নগ্নতার কৌশল সাজিয়ে রেখেছে কেন ? এতসব ভেবেও আমার ভেতরের গর্জন শুনতে পাই, সে শুনতে পাচ্ছে কি না জানা নেই । দেখি টান টান লম্বা লম্বি পড়ে রয়েছে এক নারী শরীর যার শরীরময় রাজকীয় সম্পদ আভিজাত্যের মর্যদা কেড়ে নেবার , চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট । চোখ খুলি, আবার বন্ধ করি । তার চোখ বন্ধ । যেন প্রতীক্ষাপ্রহরের শেষ মুহূর্ত । ঘামতে থাকি । একটু পর ঘামের গন্ধ বের হবে । তেতে উঠবে বিছানা বালিশ । অপমানে তার ক্রোধ প্রবল হয়ে উঠতে পারে । অন্ধকার ঘিরে ধরবে আমাকে । পরক্ষণেই যৌন আকাঙ্ক্ষার শাখা-প্রশাখা ওই অন্ধকার ফুঁড়ে কচি বাঁশের মতো বেড়ে উঠবে । তখন ই চোখ বন্ধ করে অনুভব করি , পোশাক ঠেলে আকাশ ছুঁতে চাইছে আমার উৎপাদন যন্ত্রটি । এরপর উন্মাদের মতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে । যদিও জানি , অসামাজিক আপত্তিকর কাজের পর বিধ্বস্ত শরীরে নিজেকে নীচ মনে হয় ,এমনটা বার বার ঘটেছে । এটাও সত্যি অনৈতিক রতিক্রিয়ার পর উষ্ণ হয়ে ওঠা আপমানের বিদ্রুপ নগ্নভাবে প্রকাশ করতে কটরিরও দেরি নাও লাগতে পারে । পরে ভিন্ন কোনও পুরুষকে লজ্জাকর বিবরণও দিতে পারে বা দেবে । ভয় ? না অন্যকিছু ? জানি না , ওর দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখি এক অতি নিষ্পাপ সরল যুবতি ভেসে বেড়াচ্ছে স্বপ্নের দেশে ।
সাত ।।
নিজেকে চিনতে আমার ভীষণ কষ্ট হয় । আমাকে নিয়ে আমি নিজে যা বলি ,তার অধিকাংশ অতিকথন । জানি কোনও এক সময় নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না । কটরির সাথে যত ঘনিষ্ঠ হই তত নিজের স্বচ্ছতার কাছে দায় বেড়ে যায় । তার সাথে সম্পর্কটা কি ,খুঁজে বের করা বিস্ময়কর । আমি কি চাই ? দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে আমার বিশ্বাস ছিল না । অন্যদের মতো বিশ্বাস করি অভ্যেসের নিয়মিত ব্যবহারে সম্পর্ক টিকে থাকে । তার উপস্থিতি কোন ধরনের সত্যকে তাড়া করে ? আজানা অন্ধকারের শিল্প কৌশল ? বুঝতে পারি না ।
যেমন করে বুঝতে পারিনি কীভাবে লিখতে শুরু করেছিলাম । নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া হয়নি । নিজেকে প্রশ্ন করিনি কেন লিখছি ? কাদের নিয়ে লিখছি । তাদের সম্পর্কে কতটা জানি । না, আমার মাথায় বই পড়া দৃশ্যগুলো কল্পনার সত্য-মিথ্যা বাজার ধর্মী চরিত্র বানিয়ে প্রকাশ করা ? যাতে মননের রক্ত ক্ষরণ নেই । না, ভিতরের সত্যটি প্রকাশ করার মতো চরিত্র দৃঢ়, শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি ? হৃদয় সংলগ্ন বিষয় নিয়ে কিছু বলা অত সহজ নয় । অনেকেই সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না । আমার ক্ষেত্রে এই বাক্যটি কি প্রযোয্য ? একজন অপরিচিত মানুষের সংশয়, আতঙ্ক, অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি ,ভলোবাসার আলোছায়ায় ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত জীবনকে জটিলতা থেকে মুক্তি দেবার পথ বাতলে দেবার মতো বোকামী অন্য কিছুতে নেই । জীবন সংঘর্ষের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে নিহিত প্রকৃত লেখা, বিশ্বাস করতে শুরু করি ।
সকালে ঘুমভাঙাবার কেউ থাকে না । আমি একা । ফুলনকে বাতিল করেছি । তার চাহিদা অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছিল । কটরি যে ক’দিন ছিল. দিনগুলি তার আচরণের তারতম্য অসভ্যতার পর্যায়ের ও নিম্ন মানের । সংসারের রান্না করা ও অন্যান্য কাজের বাইরে সে তার খোলা শরীর নিয়ে এমনভাবে কথা বলত, কটরিকে বুঝিয়ে দিতে সাহায্য করত যে আমার সাথে তার প্রতিদিন বিছানায় কাজ থাকে । কাজ বাতিল জেনে সে দু’মাসের টাকা চেয়ে বসে । আর বিড়বিড় করে যা বলছিল আমার কানে তা পৌঁছায়নি । তারপর থেকে ফুলনের জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে ।
টানা কয়েকদিন থাকার পর কটরি অপেক্ষাকৃত উন্নত পরিষেবাযুক্ত একটি মেসে জায়গা করে নেয় । লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে এমন একটা নিশ্চিত ভরসা , তাকে আর অপমানিত হতে হবে না ব্যবস্থাটিতে সে খুশি হয়েছিল । তার হাতে একটি কলম দিয়ে বলেছিলাম, এইটে নাও , এটা দিয়ে আর তোমাকে খোঁচা দেব না ।
ও হেসেছিল ,মহান হবার বাসনা নিয়ে নয় , হৃদয়গভীরে সুপ্ত মূল্যবোধকে সম্মান ও তাকে মানুষরূপে মর্যাদা দিতে এই পদক্ষেপ । ছুটির দিন অথবা আমার অবসরের দিনগুলি ওর উপস্থিতিতে মধূর হয়ে ওঠত । ওর রান্নার হাতটি বেশ ভাল । ও আমার বিছানায় শোয় । প্রথম থেকেই আমার সম্মতি ছিল । কয়েক মাসেই ওর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায় । ওর পোশাকের পরিবর্তন আমাকে স্বস্তি দিয়েছিল ,আমি আশ্চর্য হইনি । জানতাম ওর অভিজ্ঞতাপুষ্ট একটা জীবন রয়েছে । সেখান থেকে শিখে নিতে সময় লাগে না । যৌবনের ফুল শোভিত একটি মেয়ে তার অশ্লীলতার কেন্দ্রবিন্দুগুলি পদর্শিত করতে ব্যকুল হয়ে ওঠে । তখন মনোযোগ সহকারে তার অনুভূতি বিবেচনা করলে বিস্মিত হতে হয় না ।
এরই মাঝে তাকে একদিন ডাকি , জানতে চাই তার স্বাভাবিক প্রয়োজনটা মিটছে কিনা । এটা জানার জন্য তাকে আসতে বলা ? হাস্যকর ঠেকে । কারণ সারাদিন ম্যাসেজ ,হোয়াটস আপ , আর রাত্রে ফোন সচল থাকে ঘুম না আসা অবধি । তাহলে ? নিজের সাথে এই মিথ্যাচারের শেষ নেই । রান্নাঘরে উঁকি মারি , ওর চোখে অশ্রুকণা ঝরে পড়তে দেখি । আমি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম । তার কাছে যাই । সম্পর্ক ভেঙে যাবার মুহূর্তে এ ধরনের কান্না এসে জমা হয় চোখের কোণে । যা তার ক্ষেত্রে বেমানান ।
ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় শুয়ে এক বিরল শূন্যতা অনুভব করি । নৈঃশব্দের অন্ধকারে ভাবনার স্রোত বয়ে যায় । তখন সত্য-মিথ্যা নিয়ে ভেতরে ভেতরে আলোড়ন চলে , মুক্তি পাই না । স্বপ্ন পূরণের দায় কি কটরির পরিবর্তন ? ভিতরকার ভাবনাগুলো ( কোনোদিন বাইরে আসে না ) খুব দ্রুত নড়াচড়া করে ভিন্ন ভিন্ন পথে । বাস্তবের ভাবনার সাথে তার মিল থাকে না ।
আমি দীর্গক্ষণ পর তার কাছে যাই । কাঁধে হাত রাখি । সে আশ্রুপূর্ণ চোখজোড়া তুলে আমার দিকে তাকিয়েছিল , হাজার হাজার বছরের কৃতজ্ঞতা ও এক অজানা তৃষ্ণা নিয়ে । অনুভব করি আমার বন্ধুত্বকে সে সম্মান জানাতে চায় । তাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল । এটা আমার পছন্দ ছিল না । বলেছিলাম , তুমি যেমনটি তেমনটি থেকো । আমার সন্তুষ্টির জন্য জোর করে নিজেকে আমার পছন্দমতো করে তুলবে তাতে আমি আনন্দ থেকে দুঃখ পাব বেশি । আর একটা কথা , আমি তোমাকে করুণা করিনি , যা আগে করা উচিত ছিল , করতে পারিনি ,সেই অপরাধ বোধেও না , অথবা কোনও কুকর্মে আমন্ত্রণ জানাব এমনটাও নয় । আশা করি এতদিন আমার পাশে শুয়ে থেকে সেটা বুঝেছ ।
চোখ মুছে সে ফিরে তাকায় , মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছ । কতদিন লেখার টিবিলে যাওনি ? মনে তো হচ্ছে আমি যাওয়ার পর টেবিলে বসনি । ধুলো আর কাগজ কলমের অবস্থান দেখে বোঝা যায় । তোমার ল্যাপটপ কাঁদছে ।
তুমি কি এক ঢুক হুইস্কি নিতে চাও ?
জানি তুমি দক্ষ টিচার , পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে পার , তাই বলে আমি ভুলে যাব না , জবাব তোমাকে দিতেই হবে ।
সে দেব , তবে আমার এবারের লেখাটা হবে তোমাকে কেন্দ্র করে ।
আমাকে নিয়ে । দুর্গন্ধ ঘাঁটতে তোমার ভাল লাগে ?
আমি হুইস্কির বোতলটা নিয়ে আসি , দু’টো গ্লাস দাও , এখানেই দাঁড়িয়ে পা ন করব । তোমার রান্না দেখব ।
এবেলায় , মানে এই সময় কি পান করার সময় ? কী যে কর না !
এবেলা ওবেলা নয় , পান করার ইচ্ছে হয়েছে তাই , তাছাড়া তুমিও রান্না করার ক্লান্তি থেকে রেহাই পাবে একটু নেশা করলে ।
কোমরে বাঁধা ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাপ এগিয়ে দেয় । বুকের খালি অংশটা ঢাকা পড়ে যায় । আমি হেসে ফেলি পরে এক চুমুকে গোটা এক পেগ পান করে গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিই । হাসিটা ওর পছন্দ হয়নি সে তরল গলায় ঢেলে বলে, হাসলে কেন? ব্যঙ্গ করছ ? নিজের জন্য ঢেলে আর এক পেগ ঢালে আমার গ্লাসে , তোমাকে বলেছি শরীর নিয়ে কোনো বাতিক নেই আমার । অন্তরালে মানুষের, বলতে পার ; পুরুষের নজরে পড়ব কেমন করে ? আমার সৌন্দর্য তো দেখানোর জন্যে । এখন যা করলাম তা আমার ইচ্ছেকে সম্মান জানানোর জন্য করলাম । এর মধ্যে তোমার হাসির কোনো কারণ দেখি না । নারী হিসাবে আমার যে একটা সামগ্রিক অস্তিত্বের মূল্য আছে সেটা পুরুষরা মানতে চায় না । যে কোনো সংঘর্ষে প্রতিটি পুরুষ নারী উভয়ের বোধের পরিবর্তন ঘটে । কখনো কেউ বলতে পারে না যেটা ঘটছে সেটাই তার মূল্যবোধের জায়গাটা স্থায়ী করে দিচ্ছে । উল্টে বলা যায় , বার বার বদলে যাওয়া মূল্যবোধের মধ্যে একদিন এক নির্মল সত্যে পৌঁছানো যাবে । তোমাদের ভয় কোথায় জানো ? নারীর যোনিপথ আর জরায়ুর মধ্যে ।
বোতলটা শেষ হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করিনি । আমি বিস্ময়ে চুমুক দিয়ে চলেছিলাম । চোখের সামনে আদ্ভুত জগতের দুয়ার খুলে উড়ানের হাতছানি । নিময় নীতি , ন্যায় অন্যায়ের বাইরে আর একটা বিশ্ব যা শুধু তার অভিজ্ঞতালব্ধ । পাতার পর পাতা বই পড়ে যা জানা যায় না ।
দুপুরের রান্না শেষে বিছানায় বসেছিলাম । আমার শরীরটা ঝিমঝিম করছিল । ও বলল, আর না, মাতাল হয়ো না পিলিজ । আমি জানি যৌন মিলন এক আকশ্মিক ঘটনা , যা যে কোনো সময়ে ঘটতে পারে । আমি জানি কী প্রত্যাশায় তুমি সেখান থেকে বিরত থাকতে চাও । তোমার শরীর টলছে , একটু শুয়ে পড় আমার কোলে , ট্রাস মি, আমি বেশ্যার মতো আচরণ করি না , করবও না । করলে এতদিন তোমার পাশে থেকেও অভুক্ত থাকতাম না । যদিও তুমিও জানো আমিও জানি অভুক্ত থাকার কারণটা অর্থহীন ।
বুঝতে পারি নেশা লেগেছে ওর , আমি ওর মুখে হাত চেপে ধরি ,তুমি যা ভাবছ তা নয় । ওর হাতখানাও শক্ত করে ধরি ।
তাহলে অন্য কারণ ? একটা ঘটনা বলি তোমাকে , কে আছে আর ,যাকে বলব ।
বলো । বলে যাও । আমার সবটা জানতে ইচ্ছে করছে ।
প্রান্তিক এতটাই কামবিলাসী ছিল যে পর পর দু’বার মিলিত হবার পর রাতেও লাম্পট্য বিস্তার করতে চায় জোর করে । গর্ভনিরোধক নেই বলে তাকে বিরত থাকতে বলি । জানতাম আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে ওর বিপদ বাড়বে , সে দায়িত্ব নিয়ে গলায় শেকল পড়তে চায় না । এই ভয়ে ও হয়তো আমাকে রেহাই দেবে । কিন্তু না , সে আমাকে বাধ্য করে বিকল্প প্রথায় । সে আমাকে জোর করে উপুর করে ফেলে দেয় । ততক্ষণে আমার নিরাভরণ শরীরে লাম্পট্যের আঁচড়গুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । এমন শীল্পহীন যৌনযন্ত্রণার মহাজাগতিক আর্তনাদে অজ্ঞান হয়ে পড়ি যখন সে আমার পশ্চাদে তার ইস্পাতের মতো যন্ত্রটি চাপ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দ্রুত ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে । আমার আর্তনাদ ওকে স্পর্শ করে না । মুহূর্তক্ষণ পরে ও দুহাতে আমার মুখ চেপে অশ্লীল চিৎকার করে কাঁপতে কাঁপতে ঝিমিয়ে পড়ে ।
এখানেই শেষ নয় শেষ রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায় এক স্পঞ্জের মতো নরম শক্তিশালী দন্ডের মতো কিছু একটা আমার মুখে ঢোকাবার চেষ্টা চলছে । এভাবে অপমানিত হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল আমার ।
আমার বলার মতো কোনও ভাষা ছিল না । শুধু তাকে কাছে টেনে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলাম , আজ রাতে তুমি থেকে যাও ।
আট । ।
এইসব দৃশ্যগুলি কেবলি ফিরে ফিরে আসে ,টেবিলটি যতক্ষণ মায়াজাল বিস্তার করে রাখে আর অদৃশ্য কটরি তার যৌবনের দরজা খুলে আমাকে হাতছানি দেয় । জীবনের এই ক্লান্ত বিকেলে শেষ লেখাটি লিখতে এতটাই বিড়ম্বনা যে একটি বাক্যও গড়ে ওঠে না, কেবল টেবিলে এসে বসি আর কটরির শাসন, লিখতে বলার অনুরোধ ,কত যে নতুন নতুন ভাবে নিজেকে হাজির করা , তার চেষ্টার ত্রুটি নেই । ব্যর্থতার এই সত্যটি সময়ের স্রোতে বয়ে চলেছি । একা । তবুও নিজের কাছে নিজে আসতে পারতাম না । যদিও জানতাম লেখনীর মাধ্যমে নিজের আরও নিকটে পৌঁছানো যায় , যদিও জানতাম এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা অর্থহীন ।
তিন বছর সে এক আলাদা রহস্যসময়তার ভিতর ও আসত সপ্তাহ শেষে । বাকি দিনগুলি আমার রান্নার মেয়ে আমাকে সঙ্গ দিত । তার চাহিদা বাড়লে বদলি নতুন কেউ আসত , এইভাবে রান্নার মেয়ের বদলের প্রক্রিয়া চলতে থাকে । তবে ফুলনের মতো পারদর্শী কেউ না । এদের শেখাতে হত । শনি রবিবার ওদের ছুটি দিতাম । কটরি এলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত দিনগুলি । শুধু লেখা ছাড়া শহরের কোনও খবর জানার প্রয়োজন ছিল না । কটরির ছায়া-উপচ্ছায়া ঘিরে এক অলোকিক স্বর্গভূমি তৈরি হয়ে যেত এই নিসর্গ রঙ্গমঞ্চে ।
সে রাতে তাকে অনুরোধ করতেই সে থেকে যায়, পান করার পর তার চুলের মধ্যে ধীরে ধীরে আঙুল চালিয়ে বিলি কেটে দিই । মনে হয়েছিল সে ঘুমিয়ে পড়েছে , পরে হাত সরিয়ে নিতেই অনিভূতিবলে বুঝতে পারে , আর পাশ ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে । তার মুখের ওপর ভেসে উঠত, ম্রিয়মান মুহূর্তের এক মিশ্রসুখ । আমিও অনুভব করি বাতাসের স্পর্শগ্রাহ্য জমাট বেঁধে ওঠা । মৃদুভাবে ওর নাড়াচাড়া দেখি , ঘরের বিবর্ণ আলোয় ওর মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে । এইভাবে ওর উপস্থিতির রাতগুলি মহান নৈঃশব্দের ভিতর তাকে খুঁজে পেতাম । সকালে ঘুম ভাঙলে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলত, দেরি হয়ে গেল, ক্লাস আছে , যেতে হবে ।
আমার মনে হয় , দু’জনেই একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম , গভীর শ্রদ্ধাশীলও বটে । হয়তো তাই ধীর গতিতে নেমে আসা অশ্রুজলের ফোঁটাগুলি অসহনীয়ভাবে গড়িয়ে পড়তে দেখে শরীরে কম্পন শুরু হত । ওর অন্তর গূহার ভিতরের প্লাবণ যে কোনও সময় একটি ছোট নদীর সৃষ্টি করতে পারে । ও চলে যাবার পর আমিও চোখের জল ফেলি । অভাবটা কোথায় জানা সত্ত্বেও একে অপরের কাছে উন্মুক্ত হতে পারিনি কেন তার ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই । সে এতটাই স্পষ্টবাদী যে ,ওর এমনটা কোনও যুক্তির হিসাবে মেলে না । এমন জোর দিয়ে বলা যাবে না যে কোনও এক সন্ধ্যায় সে এসেছিল আমার আহ্বান ব্যতিরেকে । করুণা থেকে না অপরাধ বোধ ? যদিও সে জানত এমন মূল্যবোধের পাত্রী সে নয় । সুখানুভূতির প্রভূত আনন্দঘন মুহূর্তগুলি তাই কোনোদিন বিষাদে ভরে উঠত । আর সেইটি জীবনের সবথেকে পরিপূ্র্ণতা বলে মেনে নিয়ে সময়কে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাই ওর ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টের দিকে । খবরের কাগজে প্রথম দেখি । সফলতার আনন্দ ভাগ করে নিতে ওকে ফোন করে বাড়িতে ডাকার কথা ভাবছি , তখন ই তার ফোন এল , সে ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে , তুমি কোথায় ? এখন একবার তোমার কাছে যেতে চাই ।
চলে এস, আমি অপেক্ষায় আছি ।
সেই মুহূর্তটা বর্ণানা করা যায় না , যখন সে দরজা থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে । আমিও ওকে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরে লেখার টেবিলে নিয়ে আসি । তার অস্থির নাড়াচাড়া আর টেবিলের কাঁপুনি মিশে যায় । শরীরে স্পর্শে চেয়ারের কোঁকানি শুনি ,যখন ওকে জড়িয়ে বসে পড়ি । সে আমার বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করছে , তার ডান হাতটি পায়ের দিকে ঝোলাবার তাগিদে ঝুঁকে পড়ে । আমার পায়ের পাতায় চোঁয়ার প্রবল ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগায় । আর তার বুকের স্পর্শে বুঝিয়ে দেয় সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাবোধটি । একজন সাহসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে হাতের বন্ধন শিথিল করি । সে প্রণাম সেরে আমার বুকে মুখ গুঁজে জোরে শ্বাস নেয়, বুঝতে পারি সম্পর্কটিকে সে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে চায় । দু’হাতে তার মুখ তুলে দেখি তার চোখের পাত ভিজে , আজকের দিনে কাঁদতে নেই ।
না ,এ কান্না নয় এ আমার জয়ের আনন্দ যা ভাগ করে নিতে এসেছি তোমার সাথে ।
স্মৃতির মাদকতা বর্তমানকে কুয়াশাবৃত্ত করে রাখে । আমার লেখার জাদুঘর অতীতের নিসর্গলোকে মুগ্ধবিষাদে ডুবে যায় ।
আমরা সেদিন বেরিয়ে পড়ি কয়েক বছরের না দেখা শহরের শরীরী সৌন্দর্য দেখতে । সেও এক অলৌকিকতার বিশ্বাসের ডানা মেলে দেয় । আমারা একটি বারে ঢুকেছিলাম । তখনও সেখানে ভিড় জমেনি । আমরা কোণের চেয়ার দু’টি দখল করার সুয়োগ পাই । পরে যখন বারটি মাতালময় হয়ে উঠবে তখন বেরিয়ে যাব । তারপর ও পছন্দমতো অর্ডার দেয় । পাশে এক মাঝ বয়সি সুন্দরী ভদ্রমহিলা দু’জন অল্প বয়সি যুবকের মধ্যমনি । কটরি সেদিকে চোখ ফেরায় । টেবিলের নীচে মহিলার বাম হাতটি বামদিকের যুবকটির দুই উরুর মাঝখানে খেলা করে । ডান দিকের যুবকটি ডান হাত মহিলার তলপেটের নীচে ক্রন্দনরত । কটরি আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে , অপ্রতিরোধ্য পেশাদারির পরিচয় পেলাম । এক টুকরো মাংস আমার মুখে তুলে দেয় সে । ধীরে ধীরে টেবিলগুলির কলরব শুরু হয় । নীলাভ আলোয় কাউন্টারের অল্প বয়সি ম্যানেজারের মুখখানি সরল , তার দৃষ্টি সজাগ, নিয়মমাফিক শৃঙ্খলার ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে সতর্ক ।
সেদিন কোথায় না ঘুরলাম । ভিক্টোরিয়ার আসেপাশের পার্কগুলির বাতাসে মিশে থাকা যৌনঘ্রাণ, একবারে প্রকাশ্যে পাশাপাশি জোড়ায় জোড়ায় একে অপরের শরীরে লেপটে থাকা , চুম্বনের শব্দগুলি বায়ু তরঙ্গে ভসিয়ে দেয়া, এবং আপত্তিকর বলে চিহ্নিত প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার দ্রুত ক্রিয়াশীল অঙ্গ সঞ্চালনের দৃশ্য দেখে উষ্ণতা অনুভব করি । আমরা গঙ্গা তীরে একটি ছই তোলা নৌকা ভাড়া করে গঙ্গার বুকে ভাসতে থাকি । তার অস্বাভাবিক উৎফুল্ল মুখমণ্ডল দেখে বলি , এখন কি করবে ভবছ ?
সে আমাকে আবার প্রণাম করে , তুমি যা বলবে ।
আমি তার মাথায় হাত রাখি । নৌকা জল কাটে , অদ্ভুত একটা শব্দ , ছন্দে ছন্দে , জলের বুকে প্রদীপের আলো আকাশের তারার মতো মিটমিট , আমি তন্ময় তার চোখের তারায় । সে বলে , সত্যি বলতে কি তুমি আমাকে জড়িয়ে না নিলে আমি সাহস পেতাম না । যদিও আমি খুব সাহসী । তোমার বুকেমাথা রেখে পানসি করে স্বর্গে যাওয়া , ইনপ্যাক্ট আমি এই ইচ্ছেটা তোমাকে বলে তোমাকে লজ্জা দিতে চাইনি । না চাইতে অবিশ্বাস্যভাবে একসঙ্গে এম এ, নেট সব হয়ে গেল । তুমি না চাইলে কি হত ? না তোমার দেয়াগুলো করুণা বলে ভাবিনি । কাঁদতাম অন্য কারণে । তোমার নীরবতার যন্ত্রণাগুলো সামাজিকভাবে অস্বীকার করা যায় না ।তোমার সমস্যাটা চিরকালীন । অচলায়তনের এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর তোমাকেই ভাঙতে হবে । এটা আমার দুর্ভাগ্য । জন্ম তো দৈবের কারিকুরি । আমি কি করতে পারি ? জানি তুমিও আমার মতো নিভৃতে চোখের জল ফেল । প্রতিবাদহীন এই সহমর্মিতা আমি সহ্য করতে পারি না । আমি অতটা ভিখারী নই , যে, তোমাকে দেয়ার মতো কিছু নেই আমার ? দুঃখ তো সেইটাই , আমার কী আছে একবারও তাকিয়ে দেখলে না !
সন্ধ্যা নামলে আমরা টেক্সি করে বাড়ি ফিরেছিলাম । ফেরার পথে পানও করেছিলাম । সে পোশাক খুলে ওর নিজস্ব আলমারি যখন ও আসে ব্যবহার করে, সেখান থেকে একটি হলকা পোশাক পরেছিল । আমি সেকেলে বাথরুম থেকে ফিরে দেখি সে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে । ওর হালকা পাতলা রাত পোশাকের অন্তরালে দেখতে পাই এক কামোদ্দীপক নারী শরীরের অলোকবিচ্ছুরণ । রক্তের ভিতরে তখন আমার নিজস্ব ব্যাখ্যাহীন চলাচল , বহুবারের মতো । আগের মতোই ভাবি এক সুসংগত আলোকপাত একটি সঠিক বিন্দু অভিমুখী হয় । না হলে সাদা কাপড়ের ওপর কলঙ্ক ছিটানো কালি হয়ে ওঠে । তখন আমি নিজস্ব শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরি । প্রচীন দুর্গগুলোর ফটক বন্ধ করি । যেগুলো সত্যি সত্যি শূন্য খোলস । জীবনের প্রতিষ্ঠাচিহ্ন সরিয়ে ভিন্ন ক্ষমতার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় ।
আগের মতো আমি তার পাশে শুয়ে পড়ি । সে হয়তো টের পেয়েছিল ,সেই মুহূর্তটা ছিল অনুভূতির কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর । কেন না বিস্ময়ভরা চোখে দেখে নিয়েছিলাম ওর শরীরের স্পষ্টচিহ্নগুলি । তখন ও আমার হাতখানা চেপে ধরে । নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে একটি আকশ্মিক সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে যাবে হয়তো । এই ভাবনার অনুভূতি প্রকাশ মোটেই সহজ নয় । মুহূর্তটা বাঁচিয়ে রাখা যায় না তাই আমি কৃতজ্ঞ । ওর ধরে রাখা হাতটার ওপর আমার হাতটা রাখি । সে যেন স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে বলতে থাকে, না নেশার ঘোরে নয় , এটাই সত্য একটা মানুষের ভেতরে অন্য একজন মানুষ থাকে ,তাদের মধ্যে মিল খুব সামান্য । তোমাকে চেনা যায় না । তোমার মাত্রাধিক অনুপ্রেরণায় কিছু চাইতে গিয়ে থেমে গেছি । পূর্বের ঘটনা মনে পড়ে যায় । চুপ করে আছ যে ? জানি তুমি চিরকাল ই বাকবিমুখ ।
বিছানায় নূতন ঝকঝকে চাদরে নিজের নগ্ন শরীরের সাথে ভিন্ন একটি নারী শরীরের নগ্নতা বিমুগ্ধদৃষ্টিতে আগে কি তাকিয়ে দেখনি ? তবে সমস্যাটা কোথায় ? তারপরেও এই মুহূর্তের চূড়ান্ত গন্তব্যের অন্তজ্ঞান অনুভব করি । ধীরে ধীরে একটি হাত তার মাথায় রাখি । সে হাত সরিয়ে দূরত্ব রচনা করে , তার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে , একটা বিষয়ে নিজেকে বদলে ফেলেছি, ভয় হয় … ও থামে ।
আমি তাকে কাছে টানার চেষ্টা করি , কীসের ভয় ?
তোমার ওপর নির্ভরতা বেড়ে গিয়ে নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছি । একা একা কিছু সিদ্ধন্ত নিতে পারি না । এই ক’টা বছর নিতে হয়নি কারণটা হয়তো সেটাই । সফল হয়েও, এত উজ্জ্বলতা নিয়েও কেমন যেন অন্ধকার চারপাশ । তাই চেষ্টা করেছি তোমার অনুমতি না নিয়ে কিছু করতে, যাতে আমার একটা চাকরি হতে পারে । আর সেই ব্যাপারে আমি তিন দিনের জন্য বাইরে যাব । তোমার অনুমতি চাই ।
নিজের সচেতনায় সুক্ষ্ম ভেদাভেদের সীমানা টপকে সে আমাকে জড়িয়ে নেয় ।
নয় । ।
অনৈতিক যৌনাচারের ঘৃর্ণায় তার প্রতি আমার যৌন আকর্ষণ নেই এই ধারণাটা সে বয়ে বেড়ায় । ওর ব্যবহারিক জীবনে অনৈতিক যৌন সংযোগ যে একমাত্র কারণ তার এই ভুল ধারণা ভেঙে দেবারও চেষ্টা করিনি । আমার বিশ্বাসের দৃঢ়তা নিয়ে সংশয় ছিল না । জানতাম তার জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সৃষ্টিশীল কর্মের যে সুযোগ করে দিয়েছি তা সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাবে । তাই শিষ্টাচার বিরুদ্ধ প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকি । যে কারণে তার প্রশ্নের উত্তরও কম দিই । যদিও এগুলি আমার নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না । একই বিছানায় শোব আর যৌন আকর্ষণ থাকবে না এর মধ্যে মিথ্যাচার থাকে বেশি । আমি পছন্দ করি এই মিথ্যাচারটি আমাদের মধ্যে রাখতে । তার জন্য সতর্ক থাকতে হত যদি অতি মাত্রায় পান করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মিথ্যাচারটি প্রকাশ্যে না এসে পড়ে । সেই রাতটা ছিল অন্য রাতের চেয়ে ভীষণ আলাদা । শুধু রাত নয়, সন্ধ্যাটাও ভিন্ন রেসিপি দিয়ে পরিপক্ক । আমি বাইরে ছিলাম সারাদিন । তিনদিন আগে কটরি কাজে যাবার পর আমার লাঞ্ছ বাইরে সেরে নিতাম ।ঘরের দরজা খোলা দেখে বুঝতে পারি সে এসেছে ,কেননা ডুবলিকেট চাবি ওকে ছাড়া আর কার হাতে দিতে পারি ? রান্না ঘর থেকে পিয়াজ, রসুনের গন্ধ নাকে লাগলে চুপচাপ দরজায় দাঁড়াই । এই রকম এক আনন্দময় সন্ধ্যায় উপলব্ধি করি, যে, একজন যুবতি নারী আমাকে ভালবেসে রান্না করে খাওয়াবে । ওর রন্ধন শিল্পের মগ্নতা ওকে নিবিড় নীরবতার মাঝে বেঁধে রেখেছিল । আমি গুড ইভিনিং বলতেই সে চমকে উঠেছিল , ছুটে এসেছিল আমার নাগালের মধ্যে । ওর কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিই , একটা ফোন করে দিতে পারতে, আমি আগে ফিরে আসতাম ।
ওর মুখের হাসি লেগে ছিল , তাহলে মজাটা হত না ।
এই হাসিটির ভিন্ন রকম অর্থ হয় । সে নিজেকে বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করে আমাকে প্রণাম করে বলেছিল, চা না কফি?
এই প্রণাম করার অভ্যাসটা ত্যাগ কর , আমার ভাল লাগে না । তার হাতটা ধরে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে বলি, মজাটা কি ?
সবটা কি তোমার ভাল-মন্দ দেখে করতে হবে মশাই ? সাফল্য হল এক দৃঢ় মানসিক প্রত্যয়ের সংকল্প , এই সত্যটা যে চিনিয়ে দেয় সে গুরু ,তাকে প্রণাম করব নাতো আর কে ?
মুহূর্তে নিজের পোষা মিধ্যাচারগুলি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে । আমার সম্পর্কে যত সত্য সব মিথ্যাচারের সাথে এজমালি মূলধন । গোপনতা বজায় না রাখলে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যদা হানি হয় । আবার এইসব ভাবলে সব যুক্তি অযুক্তির মধ্যে নিজেকে কৌতুককর জোকার বলেও মনে হয় ।
ও চলে গেছিল রান্না ঘরে , যাবার আগে বলে দেয়, ফ্রেস হয়ে নাও , তোমার জন্য কফি আনছি । ওর পায়ের ছন্দে মিশে থাকে এক ব্যাঙ্গাত্মক অভিব্যক্তি, যা আমাকে জানিয়ে দেয় দুষ্কর্ম , নিভৃতে ঘটমান অপরাধ ,ভণ্ডামিতে পূর্ণ আমার জীবন ইতিহাস । কটরির জীবনাদর্শের সাথে তার তুলনা চলে না । তার সাফল্যের বিশেষাধিকারগুলো মূল্যায়িত হবে যেখানে সত্য-মিথ্যা সমান গুরুত্ব পাবে ।
যে চিন্তাটা দীর্ঘক্ষণ চাপা দিয়ে রেখেছিলাম তা বজ্রনির্ঘোষের মতো বেরিয়ে আসে । সত্যি সত্যি আমি কি তার কাছে পরাজয় মাথা পেতে নিয়েছি ? তার শিশু সুলভ কৌতুকগুলি মনে পড়ে । তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ প্রাণবন্ত সাহসী পদক্ষেপ আমার সত্তাকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে দেয় । এইসব চিন্তাস্রোতের ওপর বাঁধ দিয়ে দেয় কটরির প্রেমকোমল হাতের স্পর্শ , চিন্তার কিছু ঘটেছে কি ? যদি না ঘটে তবে বিষাদ কেন ? এই নীরবতা ভাল লাগে না । একটু পান করা যাক , মনে হচ্ছে কতদিন একসাথে পান করিনি । কাবাব করেছি , চিকেন কোরমাও নিতে পার চাট হিসেবে মন্দ নয় । ডিনারে দেব তোমার ফেবারিট আলুপোস্ত, মুগের ডালনা , বড়ির ফোড়ন দিয়ে পিরিং সাক , মনে আছে তোমার গ্রামে তোমাদের আলুবাড়িরতে পিরিং শাকে বন লেগে যেত , তুমি জানবে কী করে ,ক’দিন বা গ্রামে যেতে ! আমার মনে আছে তোমাদের আলুবাড়িতে নিরেন দিতে গিয়ে আমার বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত , তখন পিরিং শাক , বেথো শাক , মেথি শাক হেঁটকা শাক কত রকমের যে শাক হত, মাঝে মাঝে মন চলে যায় গাঁয়ে । একবার যাবে ?
তার হাতের আঙুল ঘোরা ফেরা করে আমার বুকের লোমগুলির ফাঁকে । এক নিরবিচ্ছিন্ন সুখ শিহরন আমাকে ভেতর থেকে জাগিয়ে দেয় , কোথায় ? গ্রামে ? কী হবে , কে আছে যে যাব , ঘর বাড়ি বিষয় সব তো বেচে দিয়েছি , তবে কীসরর মায়া ?
মায়া কি শুধু বিষয় সম্পত্তির ? প্রকৃতির প্রতি তোমার শ্রদ্ধা হয় না ?
হয় বলেই তো “ছায়ানিলয়” লিখেছি ।
পড়েছি ; তোমার সব বই আমার পড়া । সে যতই প্রশংসিত হোক না কেন , তাতে তোমার কৃতিত্ব কোথায় ?
কী বলতে চাও ?
বলতে চাই, যা ঘটেছে তাই লিখেছ , পাত্র পাত্রী সব তো বাস্তব, চরিত্রের নামগুলোও বদলাওনি , ফলে চরিত্রের নাম এক অদ্ভুত সুন্দর । চাঁদ-নিহার তুমি দিলে চাঁদনিহারা । ইচ্ছে করলে দু একজন তোমার ওপর মানহানি মামলা করতে পারে । আর তোমার মহাশূন্যের সংলাপ ? সে তো তোমার অক্ষমতার প্রকাশ । নারী নারী করে গোটা বই টা তোলপাড় করে দিলে , নিয়ে শেষ বেলায় আবার তাকে গৃহবন্দি করলে । কী লাভ হল? আসলে কি জানো , তোমরা যা জানো তা লেখার সাহস নেই , যা জানো না তাই লিখে বাহবা কুড়িয়ে নাও । নারীশরীরপাহারাদারদের খুশি করা । পারবে আমাকে নিয়ে লিখতে ? ফুলনকে নিয়ে ? লিখলে তোমার চরিত্রটি কালিমালিপ্ত হবে ।
ফুলনের বিষয়টা ও জেনে গেছে তাহলে ? তার জানা না জানার ওপর কোথাও কি আমাদের সম্পর্কের হেরফের ঘটবে ?এমন দুঃশ্চিন্তা আন্দাজ করে ফেলে কটরি , সেই অনুমানে আমাকে কাছে টানে, একেবারে বুকের সাথে বুক চিটিয়ে ধরেছিল । আমি বাধা দিতে পারিনি । সে বলেছিল, মানুষেরা সত্যমিথ্যার সংমিশ্রণে যাপনের শেষদিন পর্যন্ত কাটিয়ে দেয় । এটাই সত্য । তাই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া অঘটনগুলি নিয়ে ভাবি না, এর জন্য আমি দায়ী নই । এই বিশ্বাস আমার নিত্য সঙ্গী । ছাড় ওসব , একটা কথার জবাব দাও তো ?
স্পর্শে জানিয়ে দিই । বলো কি জানার আছে ?
এই যে আমি তিনদিন পর এলাম, কোথায় ছিলাম কেন ছিলাম আমার সুবিধা অসুবিধা এসব জানতে ইচ্ছে করে না তোমার ?
প্রশ্নটা কেন করেছিল সেটা ভাবতে থাকি , তখন আমার ভিতর এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত ভালবাসা কিছু একটা ইঙ্গিত করছিল । তাকে দেখে মনে হয়েছিল , প্রশ্নটি করার পর আগের মতো উত্তরের আশা না করে হাল ছেড়ে দিয়েছে । তাই তাকে বলি , আমার ধারণা তুমি সবটাই বলবে । তুমি কি ভাব লেখকদের মন বলে কিছু