প্রবন্ধঃ গ্রামবাংলার ছোটদের হারিয়ে যাওয়া খেলা

প্রবন্ধঃ গ্রামবাংলার  ছোটদের হারিয়ে যাওয়া খেলা

গ্রামবাংলার ছোটদের হারিয়ে যাওয়া খেলা
রেখা রায়

আমি বড় হয়েছি অবিভক্ত মেদিনীপুরের ক্ষেত্রপাল নামক এক অখ‍্যাত গ্রামে। এখন এটি পূর্ব মেদিনীপুরে পড়েছে। গ্রামের সকলেই মূলত কৃষক। ব্রাহ্মণ, হাড়ি, ডোম আছে। ডোমেরা সেঁচনি, কুলা, চালনি, টঁকা, খেলি, পালি, কুলপি, ঘুনি, মুগরি ইত‍্যাদি বাঁশের নানা জিনিস তৈরি করে বিক্রি করত। ঢাকী হিসেবে খুব নাম ছিল ওদের পুরুষদের। হাড়িদের সংসার কিভাবে চলত মনে করতে পারছি না। ভিক্ষে করত কেউ কেউ…দেখেছি।
গ্রামে বেশির ভাগের কেউ ভাগচাষী তো কারুর সম্বচ্ছরের খরচ কোনোক্রমে চলে যাবার মত জমিজমা আছে। অবস্থাপন্ন বলা যায় না কিছুতেই। অনেকেই দিন আনা , দিন খাওয়া মানুষ। অন‍্যের কাজে শ্রম দিয়ে সংসার চালায়। তাতেও আধপেটা খেয়ে থাকতে হয় প্রায় দিনই। তাই বিলাসিতা, শখ, আদর, ভালোবাসা…এই শব্দগুলো তাদের জীবনে বিন্দুমাত্র ছিল না। অভাবের মধ‍্যেও মা ষষ্ঠীর কৃপায় সন্তানদের সংখ‍্যা বেশ বাড়বাড়ন্ত ছিল! আগাছার মতই তাদের বেড়ে ওঠা। পেটের খোরাক জোগাতে পারতো না বাবা মা, তো খেলনা কিনে দেবে কোত্থেকে! যাদের কিনে দেবার ক্ষমতা আছে, তারাও ওটিকে বাহুল‍্য মনে করত। মাটির পুতুল সুলভ ছিল মেলায়। পাতলা প্লাস্টিকের মেয়ে পুতুল, পাখি পাওয়া যেত। তাদের পিছনে বাঁশি লাগানো থাকত। শরীরে চাপ দিলে প‍্যাঁ পুঁ আওয়াজ উঠত। তাই নিয়ে বেশ খেলা জমত। টিনের ব‍্যাঙ কটকটি, কুলের বীচি পোরা টিনের হুইশিল বাঁশি, কমদামী প্লাস্টিকের বাঁশি, টিনের ঝুমকো নিয়ে বড়দের কানের গোড়ায় আওয়াজ তুলে তাদের বিরক্ত করার মধ‍্যে বেশ আনন্দ ছিল। খেলার সরঞ্জাম খুব কম ছিল না আমাদের।
ছোট বেলায় কত রকম, কত খেলা যে খেলেছি!
খেলার সরঞ্জাম তো প্রকৃতি থেকে পাওয়া। নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে খুঁজে নিয়ে খেলা। এখনকার বাচ্চাদের মত বাবা-মার কিনে দেওয়া খেলনা নয়। এখন শিশুরা খেলে বাবা-মার ইচ্ছে অনুযায়ী। স্বাধীনতা নেই হতভাগাদের। আর আমরা খেলেছি নিজেদের ইচ্ছে মত। উদ্ভাবনী শক্তি,মেধা আর আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে এর মাধ‍্যমে। শারীরিক কসরৎ, বুদ্ধিমত্তা, নেতৃত্বের মনোভাব, পারস্পরিক সহযোগিতার আন্তরিকতা…কি নেই তাতে !
গ্রামের মাটির বাড়ির চব্বিশ ইঞ্চি দেওয়ালের বেশ ক-টা কুলুঙ্গি ভরে থাকত আমাদের খেলনাতে। বড়রা আবর্জনা ভেবে ফেলে দিলে মড়া কান্নায় ঘরের চালে কাক চিল বসতে পারত না। সেরকম মাঝে মাঝেই ঘটত। লিখতে বসে বার বার স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হচ্ছি। শৈশব কৈশোরের খেলার সঙ্গীদের মুখগুলো ভিড় করে আসছে। তাদের কেউ কেউ আজ আর ইহজগতে নেই।
বর্ষাকালে মাঠঘাট জলে কাদায় একাকার। পাড়ায় যার বাড়ির দাওয়া বড়,তার বাড়িতেই জমত খেলা।আমাদের বাড়িতেই জড়ো হত সবাই। পাড়ায় ঢোকার মুখে বিশাল বাড়ি আমাদের। সেসব খেলায় সকলের সমান অধিকার। ছেলে বা মেয়ে…এমন ভাগ ছিল না। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কত তীরধনুক বানিয়েছি আর রাম সেজে সীতা, লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসী হয়েছি!
উঠোন থেকে কাদা তুলে পুতুল গড়তাম। ন্যাকড়ায় আলতার ছোপ দিয়ে বানাতাম ছাপা শাড়ি। বিকেলে মায়েরা চুল আঁচড়াতে বসত। কাঁকইতে উঠে আসা চুল বাঁ হাতের তর্জনীতে জড়িয়ে গোল গোল করে চালের বাতায় গুঁজে রাখত, বাসন মাজার নুটি তৈরি করবে বলে। ফেলে দেওয়া মায়েদের সেই চুলে ঢাকত পুতুলের ন্যাড়া মাথা। কত না কাল্পনিক গল্প,কাল্পনিক সংলাপ !গিন্নিপনা,দুষ্টুমি,আদর,রান্নাবাটি…সবই ঠাঁই পেত।মাটির উনুন তৈরি করে নারকোল মালায় বিয়ে বাড়ির পঞ্চব্যঞ্জন। ঐ যে..
“ঘাসের পাতা লুচি হল
ভাজা শিশির ঘিয়ে।”…আমাদের ঐ সব কাজ দেখেই তো লেখা।
কালেভদ্রে বড়দের কারুর হাতে সিগারেট প্যাকেট দেখলে হাঘরের মত আকিয়ে থাকতাম। কখন প‍্যাকেটটি ছুঁড়ে ফেলবে আর আমরা তুলে নেব।প্যাকেটের রাংতাটি জোগাড় করতাম সযতনে। যেন মহার্ঘ‍্য জিনিস একটি। ফুরিয়ে যাওয়া খাতার পাতা ছিঁড়ে তেকোনা ভাঁজে তৈরি করতাম মুকুট। আর রাংতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাবলা আঠা দিয়ে সেঁটে দিতাম তার ওপর। যে কোনো ঠাকুর বিসর্জনের সময় উপস্থিত থাকতামই। ঠাকুরের যাবতীয় চকচকে জিনিস সংগ্রহ করেছি। মায়েদের ছেঁড়া বাতিল শাড়িতে সেজে শুরু হত যাত্রা পালা।ষষ্ঠীমঙ্গল,শীতলামঙ্গল,মনসামঙ্গল,চণ্ডীমঙ্গল, যুগীযাত্রা…..কত কি ! সত্যিকারের যাত্রা পালার গ্রীনরুমে উঁকি দিয়ে শিখে নিতাম মুখ রঙ করা। দিদি পিসিদের স্নো-পাউডার চুরি করে,আলতায় ঠোঁট রাঙিয়ে কী আনন্দ ! পুঁতির মালা অমূল্য সম্পদ! যাত্রার বিষয় বড় কথা নয়,সাজাটাই বড়। গরু তাড়ানোর তেলমাখা বাতা তলোয়ারের অভাব পূরণ করত।
ডোমেরা বাঁশের চোঁচ দিয়ে পতিঙ্গা তৈরি করে বিক্রি করতে আসত। দশ নয়া দিয়ে কিনে দিত বড়রা। মধ‍্যে কাঠি দেয়া থাকত। হাতে নিয়ে জোরে দৌড়োলে বাঁই বাঁই করে ঘুরত। সোঁও সোঁও শব্দ উঠত।
দাওয়ায় খড়ি দিয়ে ঘর কেটে কুলো খেলা। শহরে বলে এক্কা দোক্কা। কম পক্ষে ন-টি ঘর। এতে বেশি খেলোয়াড় না হলেও চলবে। দুজন হলেই খেলা শুরু। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ঘরে ফেলতে হবে ঘুঁটি। ঘুঁটি মানে এক টুকরো খোলাম কুচি। প্রতিবার এক পায়ে লাফাতে লাফাতে মুখে “কিৎ কিৎ” বলতে বলতে ঘুঁটি এগিয়ে নিয়ে চলতে হবে পা দিয়ে। সব ঘর ঘোরা হয়ে গেলে পিছন ফিরে ঘুঁটি ছুঁড়ে ঘর দখল করতে হবে। সেই ঘরে তখন অন্য কেউ পা দিতে পারবে না। অন্যকে ঐ ঘর লাফিয়ে পার হতে হবে। চিকে পা পড়লে,দম ছাড়লে বা চিকে ঘুঁটি পড়লে দান গেল। গাছতলা, উঠোন, পুকুর পাড়, ছোট একটু মাঠ পেলেই চলবে।
বত্রিশ ছেলি (ছাগল) আর দুটো বাঘ নিয়ে বাঘবন্দী খেলা। দুজন লাগে। তেঁতুলের বীজ, ঝাঁটার কাঠি এক ইঞ্চি করে ভেঙে, সেই টুকরো বা খোলামকুচি হল এই খেলার ঘুঁটি। পুকুরের সান বাঁধানো রানায়,মন্দিরের পাকা চাতালে পাকিপাকি ভাবে ঘর কেটে রাখা হত কোথাও কোথাও। নয়তো মাটির দাওয়ায় খড়ি দিয়ে ঘর কেটে খেলা। একই ঘরে মোগল-পাঠান খেলাও চলত। দাবার মত বেশ বুদ্ধিদীপ্ত খেলা। মোগল-পাঠানে ষোলো ষোলো করে বত্রিশ ঘুঁটি লাগত।
বর্ষার জলে উঠোনের মাটি ধুয়ে বেরিয়ে পড়ত শক্ত শক্ত নুড়ি। পাথরের মত নয়,এ অন্যরকম। পাঁচটা ঘুঁটি নিয়ে জমত খেলা বর্ষার দুপুরে। একটা ঘুঁটি নাচিয়ে ওপরে তুলে,সেই অবসরে নীচে পড়ে থাকা ঘুঁটি একটা একটা করে অতি সাবধানে তুলতে হবে। পাশের ঘুঁটি যেন নড়ে না যায়। নড়ে গেলেই দান যাবে। কখনও এক হাতে,কখনও দু হাতে …..শর্তানুযায়ী খেলা। দুজন হলেই খেলা শুরু।
বৃষ্টি একটু ধরলেই ইজেরের পকেট ভর্তি খোলামকুচি নিয়ে চললাম পুকুর পাড়ে দল বেঁধে।হাতের কায়দায় পুকুরে ছোঁড়া খোলামকুচি তখন ব্যাঙ হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলল জলের ওপর,বেশ কিছু দূর। এ হল ব্যাঙ লাফানো খেলা।
বর্ষার শুরুতে গাছে গাছে টিকরি টিকরি বুনো জাম প্রচুর। তলতা বাঁশের ডগা এক বিঘত সমান কেটে নিতে হবে গাঁট সমেত। গাঁটে ফুটো করতে হবে অতি সাবধানে,যাতে একটা কাঁচা জাম ডান হাতের বুড়ো আঙুলের চাপে একটু জোরে ফুটো দিয়ে ঢোকানো যায়। এবার বাঁশের চোঙের চেয়ে একটু বড় শক্ত পোক্ত একটা কঞ্চির এক দিকে ন্যাকড়া জড়িয়ে নিতে হবে। ফুটোতে কাঁচা জাম ঢুকিয়ে ন্যাকড়া জড়ানো কঞ্চি চোঙের ভেতর সজোরে ঠেলে দিলে “ফট” করে শব্দ হবে আর জামটা বন্দুকের গুলির মত ছুটে যাবে কিছুটা দূরে। কারুর গায়ে লাগলে আর বলতে হবে না! কানচাপাটি অবধারিত পুরস্কার। কাপড়ে লাগলে জামের কষ উঠবে না এ জীবনে। কঞ্চির ন‍্যাকড়া ওয়াসারের কাজ করে।
ওরকম এক হাত বাঁশের চোঙ নিয়ে দোলের সময় পিচকারি তৈরি করতাম। দোল চলে গেলে ঐ দিয়ে হাঁস তাড়াতাম। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রথম পাঠ আর কি ! বাহবা তো দিতই না কেউ, উপরন্তু বাঁশ নষ্ট করার জন্য পিঠে দু চার ঘা জুটত।সে আর এমন কি!!
বর্ষার দুপুরে সদরের তক্তপোষে বসে চোর-পুলিশ খুব জমত। চারটে চৌকো ছোট ছোট কাগজে লিখতে হবে..চোর-৪০০,ডাকাত-৬০০,
পুলিশ-৮০০, বাবু-১০০০। তারপর যত্ন করে হোমিওপ্যাথির পুরিয়া মোড়ার মত কাগজে মুড়তে হবে। মুড়ে লটারির মত ছড়িয়ে দিতে হবে। যার হাতে যা উঠবে,সেটাই নিতে হবে। বাবু নির্দেশ দেবে পুলিশকে,”পুলিশ,চোর ধর।” ধরতে পারলে পুলিশ আটশো। নয়তো সে শূন্য। বাবু সব সময় হাজার।খাতার পাতা ভর্তি হিসাব।
দেশলাই বাক্সের ওপরের কাগজ জমিয়ে তাস খেলাও ছিল বর্ষার দিনে।
এখনকার বাচ্ছারা ক্লাস চলাকালীন পিছনের বেঞ্চে বসে টিচারকে ফাঁকি দিয়ে এখনও ক্রশ গোল্লার কাটাকুটি খেলে। ওটি আমরাও করেছি। খাতার পাতা নষ্ট করার জন্য মারও খেয়েছি কত। আমি তো ছবি এঁকে পাতা নষ্ট করার জন্য প্রায়ই মার খেতাম। তবুও থামতাম না। একটু জেদি ছিলাম কিনা !
এবার ম্যাজিক। আমরা অন্তত তা-ই বলতাম। কাঁটা ও পাতা সমেত বাবলা গাছের সরু ডাল ডান হাতে নিয়ে সজোরে বাঁ হাতের কনুই থেকে কব্জির মধ্যে কয়েক ঘা সপাং সপাং মারতে হবে। তারপরই মার থামিয়ে ডান হাত সজোরে ক্লক ওয়াইজ ঘোরালে ডান হাতে বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোঁটা দেখা দেবে।এটাই ম্যাজিক। কাঁটার ঘা দিলুম বাঁ হাতে,অথচ রক্ত বেরোল ডান হাতে !
আরও একটা ম্যাজিক ছিল। ডান হাতের তর্জনীতে খসখসে গামছা জড়িয়ে দুই ভ্রূ-র মাঝখানে সিঁথি পর্যন্ত গায়ের জোরে ঘষলে”কৃষ্ণ নাম”ফুটে উঠবে।হায় রে নামের মাহাত্ম্য! কপাল ঘষে ঘষে রক্তারক্তি। পরের দিন মায়ের মার !!
বর্ষা গেল। এল শরত। শিউলি এল গাছ ছাড়াতে।নারকোল বাগলা জড়ো হল উঠোনের এক ধারে।মা-ঠাকুমারা অবসর মত বঁটিতে পাতা চেঁছে পিঁচ বার করবে। এই অবসরে বেশ কিছু পাতা বাগলা থেকে হাওয়া ।এক একটা পাতা গোড়া থেকে একটু চিরে নিয়ে অন‍্য হাতে ধরে সজোরে ছেঁড়া পাতা টান দিলেই মূল পাতাটা হাউই। নারকোল পাতার বাঁশি “ভু ভু জোলা”-কেও হার মানায়। বড়দের বিরক্ত করার জন্য এর জুড়ি নেই। পাতার ঘড়ির কি বাহার! ফুল তৈরি করে ভাই বোন ভোলাও।বাগলায় বসে অন্যকে দিয়ে টানাও। গাড়ি গাড়ি খেলা। অপার আনন্দ !! সুপুরি বাগলায়ও একই খেলা জমে। নারকোল পাতায় বিশেষ কায়দায় গিঁঠ দিয়ে পতিঙ্গা তৈরি করা যায়। মধ্যে খেজুর কাঁটা গিঁথে দৌড়োলে ঘোরে বনবন।
গ্রীষ্মকালে তাল শাঁস বের করার পর পরিত্যক্ত চারটি তাল বাঁশের বাতা দিয়ে যোগ করে নিলে বেশ গাড়ি তৈরি হল। সামনে পেটো দড়ি বেঁধে গড়গড়িয়ে চলল গাড়ি হাতের টানে।
কলাপাতার গোড়ার দিকের মোটা শির হাতখানি কেটে মাঝে একটি দন্ড রেখে দু পাশে দুটি চোকলা কেটে দুদিকে ভাঁজ করে নিতে হবে নিচের দিকে। নিচের দিকে যেন আধ হাত গোটা থাকে ধরার মত। তারপর হাতের কায়দায় দুদিকে জোরো জোরো নাড়ালে চপাট চপাট শব্দ উঠবে। এও এক মজার খেলা বটে।
হেমন্তে ধান উঠবে। উঠোন নিকিয়ে ঝকঝকে তকতকে। সুতরাং কোনও ঝামেলা করা যাবে না ওখানে। চল স্কুলের মাঠে। নরম মাটি পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঠুকে ঠুকে অগভীর একটা গর্ত করা হল। এক বিঘত একটা কঞ্চি বসাতে হবে গর্তের উপর আড়াআড়ি। ওটি হল কড়ে। হাত দেড়েক একটা কঞ্চি বা গাছের সরু ডাল হল ডাঙ। ডাঙ গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে কড়েকে ছিটকে ফেলতে হবে দূরে। ফিল্ডাররা লুফে নিলে আউট। মাটিতে পড়লে ফিল্ডাররা তুলে ছুঁড়বে খেলুড়ের দিকে। সে ক্রিকেটের মত ব্যাটিং করবে। যত দূরে পড়বে,সেখান থেকে গর্ত পর্যন্ত ডাঙ মেপে তত পয়েন্ট। একে কড়ে-ডঙ,ডাঙ-কড়ে বা কোথাও কোথাও ডাঙগুলি খেলা বলে। একই সরঞ্জামে একটু অন্য ভাবেও কোথাও কোথাও খেলা হয়।
লুডো,সাপ লুডো মায়েদের শুধু নয়,ছোটদেরও জনপ্রিয় খেলা। বড় ছোট সমান চোট্টামি করে লুডো খেলায়। কান্নাকাটি অবধারিত।
গ্রাম বাংলায় ধাসা বা গাদি খেলা বেশ জনপ্রিয় এবং অভিজাত পর্যায়ের। অপেক্ষাকৃত বড় ছেলেরা খেলত। খেলুড়ে কম পড়লে আমাদের নিত। কিন্তু বলত দুধে-ভাতে।
এত পরিশ্রমের খেলা যে প্রচণ্ড শীতেও পাড়ার কাকা দাদাদের খালি গা বেয়ে দর দর করে ঘাম ছুটত। ওরা কোদাল দিয়ে ঘর কেটে রাখত। মাঠ জুড়ে ঘর। দু দলের সাতজন করে মোট চোদ্দ জনের খেলা। প্রতি চিকে একজন করে হাত পা ছড়িয়ে এমনভাবে দাঁড়াবে যাতে তাকে ফাঁকি দিয়ে তার হাত গলে অন্য ঘরে না চলে যায় বিপক্ষ খেলোয়াড়। একজন দক্ষ খেলুড়ে লম্বালম্বি চিকে ছোটাছুটি করবে। সব চেয়ে সেরা,সতর্ক এবং বিচক্ষণ খেলুড়ে হবে সে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় ঘরের মাথায় পৌঁছে ডাক দেবে “বোম্বাই বাস”।অন্যরকম শব্দও বলে কোথাও কোথাও। মোট কথা হল…
আমি তোমাদের হাত গলে মাথায় এসেছি … জানানো সকলকে। তারপর মাথা থেকে চিকে চিকে প্রহরী এড়িয়ে যেখান থেকে খেলা শুরু হয়েছিল সেখানে সেই ঘরে পৌঁছোনো। মাঝ পথে তাকে প্রহরী ছুঁয়ে দিলে সে মোর হল আর মুখ কালো করে সে চলে গেল ঘরের বাইরে। চোট্টামি কম ছিল না। ফলে চিৎকার চেঁচামেচি মারপিট কান্নাকাটি ছিলই। বড়রা মারামারি থামাতে যেত।বাবা মা-রা ওর মধ্যে ঢুকত না। টস করে খেলা শুরু। টসের জন্য খোলামকুচি যথেষ্ট। এক পিঠে ক্রশ,অন্য পিঠে কিছু না।এভাবেই হেড টেইল। মাঠের দু ধারে দর্শক কম হত না।
অপেক্ষাকৃত ছোটদের মধ্যে” বউ বসন্ত “বেশ জনপ্রিয় ছিল। মাঠের দু প্রান্তে দুটি বড় বড় গোল বৃত্ত। মোটামুটি চার পাঁচ জন খেলুড়ে যাতে দাঁড়াতে পারে। একটাতে বউ এবং অন্যটিতে বউ-এর লোকজন। “চু-উ-উ-উ-উ “..বলতে বলতে অন্য দলের ফিল্ডারদের তাড়া করবে বউ-এর দলের লোকজন। আর চুউউউ বলা ছেলে বা মেয়েটি দম ছেড়ে দিলে এবং ঐ অবস্থায় বিপক্ষের লোক তাকে ছুঁয়ে দিলে সে মোর হয়ে বাতিল হল। অন‍্যপক্ষের কেউ মোর হলে সে বেঁচে উঠে আবার খেলায় যোগ দেবে। সেই অবসরে বউ অন্য প্রান্তের বৃত্তে নিজের দলের লোকজনের কাছে ছুটে আসবে। তাহলেই জিত। মাঝপথে প্রতিপক্ষের কেউ বউকে ছুঁয়ে দিলে দান গেল। দম ছেড়ে যদি খেলুড়ে নিজের দলের ঘরে ঢুকে পড়ে তো সে মোর হল না। টসে জিতে খেলা শুরু। দু দলের খেলা।
গ্রামে বেশির ভাগ লোকের বাড়ি খড়ের ছাউনি দেওয়া। দু এক জনের বাড়ি টালির চালের। চালের ওপর হনুমানের পালের পদধূলি পড়লে মড়মড় করে টালি ভাঙত। আমরা তখন ভাঙা টালি কুড়িয়ে জমা করতাম বাড়ির এক কোনায়। প্রয়োজন মত সাইজে ভেঙে নিয়ে অমূল্য সম্পদের মত রক্ষা করতাম। সে সব আবার মাঝে মাঝে চুরিও যেত। তখন আমাদের গোয়েন্দাগিরি করতে হত গোপনে। সেও মজার খেলা। বেপাড়ার চোরকে নাকে ক্ষত দিয়ে যথাস্থানে টালি গুছিয়ে রেখে যেতে হত। না হলে তার পিঠের ছাল চামড়া তুলে ডুগডুগি বাজাবার হুমকি দেওয়া হত।
আমাদের নজরদারিতে গুণে গুণে টালিভাঙা ফেরত দিত বেচারা !!
লিখতে বসে আজ সেই সব স্মৃতি ভেসে আসছে। খড়ি ওঠা খালি গা ,দড়ি বাঁধা ঢলঢলে ইজের,তেলহীন মাথা,নাকে শিকনি নেমেছে ঠোঁট পর্যন্ত,কানে পুঁজ গড়াচ্ছে,হাতে পাঁচড়া,শরীরের এখানে ওখানে কাটা ঘা শুকিয়ে গিয়ে মামড়ি ওঠা,ধুলো-কাদা মাখা পা,পিলেপান্ডুলে কালো কুলো ছোট্ট ছোট্ট চেহারাগুলো ঘোরা ফেরা করছে চোখের সামনে।
বাড়ির বড়রা খুব একটা মাথা দিত না। কখনও কখনও মারামারি ছাড়াতে চড় চাপড় দিত অবশ্য,কঞ্চির বাড়ি পড়ত সবার পিঠেই। নিজের ছেলে পরের ছেলে ভাব ছিল না। অন্যবাড়ির ছেলে-মেয়ে নিজের বাপ-মায়ের কাছে লাগান ভাঙান করত না কখনও।
তো,ঐ হাত বেগদা মাপা ছোট ছোট ভাঙা টালি সাতটা সাজিয়ে গাছ করা হত মাঠের মাঝে। “পিট্টু” (অপভ্রংশে পিন্টু) খেলার জন্য। দু দলের খেলা টসে জিতে। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে একজন রাবারের লাল বল (তখন অন্য রঙের বল দেখিনি কিনা) ছুঁড়ে গাছ ভেঙে দেবে। প্রতিপক্ষ ঐ বল দিয়ে প্রথম দলের কাউকে আঘাত করলে সে মোর। বল যদি কারুর গায়ে না লাগে এবং সেই অবসরে প্রথম দল গাছ সাজিয়ে ফেলে তো পয়েন্ট তাদের দখলে। “মোর”..শব্দটি দান যাওয়া অর্থে ব্যবহৃত। ঐ খেলা অনেক পরে কেউ আমদানি করেছিল। প্রথম থেকে গ্রামে দেখিনি।
এই নামে কোলকাতায়”সায়ক”গোষ্ঠীর একটা নাটক এই সেদিনও অনেকদিন চলেছিল মঞ্চে।
কড়ে ডাঙ বা ডাঙগুলির মত নরম মাটিতে গর্ত করে “মার্বেল খেলা” জমে উঠত। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল গর্তে রেখে মধ্যমা দিয়ে একটা মার্বেল অন্য মার্বেলে লাগাতে হবে। পরে কাঁচের শৌখিন গুলি এসে সাদা মার্বেলের দিন গেল। কাঁচের গুলির মধ্যে কত ডিজাইন। খুব সুন্দর।
শহরতলিতে কোকাকোলার বোতলের ছিপি এসে কাঁচের গুলির জায়গায় “ছিপ্পু খেলা “শুরু হল। তখন কাঁচের গুলিও হারিয়ে গেল। এখন তো ওসব আর দেখাই যায় না! কেবল সরকারি স্কুলে “গুলি-চামচ” বা “স্পুন রেস”-এর সময় গুলির খোঁজ পড়ে।
পা হড়কানো কাদায় ঝমর ঝমর বৃষ্টিতে বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলা বা কাবাডির তুলনাই হয় না। অবশ‍্য তখন কাবাডি নামটাই অজানা। বলতাম… চু কিৎ কিৎ খেলা। দু দলের খেলা। দম এবং কসরৎ দুটোই লাগে। মাঠে চিক কেটে রাখত কাকারা।একজন একজন করে খেলুড়ে অন‍্য ঘরে যাবে কিৎ কিৎ বলতে বলতে। একদমে সে অন‍্য ঘরের খেলুড়েকে ছুঁয়ে নিজের ঘরে ফিরলে এক পয়েন্ট। যাকে ছুঁল সে চিকের বাইরে চলে যাবে। অন‍্যদলের একজন মরলে সে বেঁচে উঠবে। আর মোর করে ফেরার পথে যদি খেলুড়েকে অন‍্য ঘরের লোক চেপে ধরে আর সে দম ছেড়ে দেয় তো সেই মোর হয়ে চিকের বাইরে। গায়ের জোর লাগে এ খেলায়।
সন্ধ্যে বেলা ঘরে ফিরে কাদা ধোয়ার অছিলায় পুকুরে আর এক প্রস্থ ঝাঁপাই আর ধরাধরি খেলা,পুকুর তোলপাড়। কাকারা এসব খেলতো। আমরা ছোটরা তখন সারাক্ষণই দর্শক। হাততালির লোক চাই তো !!
গরমের ছুটিতে বটের ঝুরি ধরে দোল খেতে খেতে পুকুরে ঝাঁপ, ডুব সাঁতার দিয়ে পুকুরের তলানিতে ঠেকা জল ঘোলা করা,পুকুরের ওপর ঝুঁকে পড়া নারকেল গাছে উঠে মাঝ পুকুরে কত কায়দায় কত ঝাঁপ…কোথায় লাগে স্যুইমিং পুল !! ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। প্রতিবেশিদের বকুনি,মায়ের হাঁক…দূর ছাই !! এই তো সবে এলাম !!
কত কঞ্চি যে পিঠে ভেঙেছে !! তবু নির্ভয় !!
বর্ষায় বেড়ার ধারে কালসিমে গাছের বাড় বাড়ন্ত।কত পোকা আসে। তাদের চকচকে শক্ত লম্বাটে ডানায় টিপটিপ ছাপ। অতএব ঐ পোকা ধরে ডানা ছিঁড়ে বাবলা আঠা দিয়ে টিপ পরেছি কত!!
ঝিঙে মাচায় হলুদ ফুলে কালো কালো ভোমরার গুনগুন। হুল ফোটালে রক্ষে নেই। তখন খসখসে ডুমুর পাতা বা কুমড়ো পাতা ঘষে ঘষে হুল বার করে চুন লাগালেই হল। চুন নেই তো তেলাকুচো পাতা হাতের তেলোতে নিয়ে রগড়ে রস বার করে লাগিয়ে নিলেই হল। বড়রা জানবে কেন?
গামছা ভাঁজ করে ভোমরা ধরে দেশলাই বাক্সে ভরে নাও। একটু ফুটো রাখতে হবে না? নইলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে যে !! গান শোনাবে কি করে !!
হ্যাঁ,ঐ বাক্সের ভেতর থেকে একটা একটু মোটা এবং লম্বা সুতো ,আর একটা দেশলাই বাক্সের গায়ে ভেতর থেকে গিঁট্টু দিয়ে আটকে নাও।
তারপর এক জন খালি দেশলাই বাক্স নিজের কানে চেপে ধরে এন্তার মিনি মাগনা বাজনা শোন। ঐ রকম দু টো দেশলাই দিয়ে সিনেমার মত টেলিফোনও করা যায়।
কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। যে ভোমরা ধরে যন্ত্র তৈরি করেছে,তার তখন কি ডাঁট !! তাকে তেল দিতে হবে আমাদের। নইলে ফক্কা।
সারাদিন কত রকম,কত রঙের ফড়িং ওড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য ধরে ওদের পেছনে দৌড়ে লেজ চেপে ধরে ফেললে হাতে দেয় মোক্ষম কামড়। রাজ ফড়িং ধরা সব চেয়ে শক্ত। তার আকার বেশ বড়। কামড়ও তেমনি। ফড়িং ধরে,তার লেজে সুতো বেঁধে দিনভর ওড়াও। একা একাই খেলো। সঙ্গী না জুটলে কি খেলা যায় না! কত্ত খেলা আমাদের!
কে যেন একবার শিখে এল ফড়িং ধরে তার লেজটা কিছুটা কেটে ফেলে,ঐ কাটা জায়গার সরু চোঙে ডাঁটি সমেত দুব্বো ঘাসের ডগা ঢুকিয়ে ছেড়ে দিলে কি সুন্দর ময়ূরের মত ওড়ে!!
সেটাই কতদিন করলাম সবাই। একদিন বাবা দেখে ফেললেন। বকলেন খুব। বললেন..তোদের হাঁটু খুলে আমগাছের ডাল বেঁধে দেব। দেখি কেমন লাগে!!
তারপর আর কখনও ঐ খেলা খেলিনি।
বর্ষাতেও মাটির ঘরের কাঁদালে কত ধুলো! সেখানে ঘুরঘুরে পোকা নিপুণভাবে ছোট ছোট মসৃণ গর্ত তৈরি করে রেখেছে কত ! ওপরটা বৃত্তাকার। একটা সেন্টার থেকে ক্রমশ বড় হতে হতে এক ইঞ্চি ব‍্যাসের বৃত্ত। সামান‍্য গভীর গর্ত। কি আছে ওতে !! তর্জনী দিয়ে আস্তে আস্তে খুরখুর করতে করতে সাবধানে ধুলো সরিয়ে দেখি..ওম্মা,এ যে এতটুকু এতটুকু নরম নরম পোকা !! ছারপোকার চেয়ে একটু বড় গায়ে গতরে। ধুলো ধুলো রঙ ! সামনে এতটুকু এতটুকু দাঁড়া কাঁকড়ার মত। কাঁসার বাটিতে জল নিয়ে তার ওপর ছেড়ে দিলে খালি পিছিয়ে পিছিয়ে বাটিতে ঘুরতে থাকে। তারপর মরে যায় নিশ্চয়ই। খোঁজ রাখিনি আর। সেও একটা খেলা বটে!
কিন্তু এখন ভাবি.. কি নিষ্ঠুরতা !!
শীতের উঠোনে খড়ের গাদা পড়েছে দু তিনটে। উঠোন সাফসুতরো। এই সময় লুকোচুরি জমে ভালো। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে চাপড় মেরে “উবু , দশ কুড়ি” গুণে যার গায়ে শ হল সে মোর দেবে। সে উঠোনে ধান মাড়ানোর জন‍্য যে তাড়া পোঁতা আছে, দু তাতে চোখ ঢেকে দাঁড়াবে, অন‍্যরা এখানে ওখানে উঠোনের চৌহদ্দির মধ‍্যে লুকোবে। গাদার পেছন বা খড়ের ভেতর ঢুকে লুকোনোতে বেশ মজা। লুকোনো দল থেকে একজন তাকে সাড়া দিয়ে জানিয়ে দেবে যে…এবার খোঁজো। তাকে এড়িয়ে সকলে তাড়া ছুঁয়ে দিলে, সে বেচারি আবারো মোর দেবে। এইভাবে চলবে খেলা। তাড়া ছোঁয়ার আগে একজন কাউকে ছুঁয়ে দিলে সে মোর বা চোর হয়ে অন‍্যদের খুঁজবে।
চোখে গামছার পট্টি বেঁধে কানামাছি খেলার সময় একটি ছড়া আমরা বলতাম…
“কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যাকে পাবি তিকে ছোঁ।”
যাকে ছুঁল পট্টিবাঁধা খেলুড়ে, সে মোর দেবে।
কেউ যদি খেলায় চোট্টামি করে তো “আব্বুলিশ” বলে সাময়িক থামা। ফয়সালা হলে আবার খেলা শুরু। এটা যে কোনো খেলাতেই চলবে।
কত খেলার কথা আর বলি! আমরা গোল হয়ে মুখোমুখি বসলাম উঠোনের মাঝে। “উবু দশ কুড়ি” গুণে একজন চোর হল। এবার চোর গোল হয়ে বসা সব খেলুড়েদের পিছন দিয়ে ঘুরবে কাপড়ের বল হাতে। বসে থাকা কোনো খেলুড়ের পিছনে বল ফেলে দেবে নিঃশব্দে। যার পিছনে বল পড়েছে সে বুঝতে পেরে উঠে বল হাতে ঘুরতে থাকবে। তার ফাঁকা জায়গায় বসবে আগে যে চোর দিয়েছে সে। আর কেউ যদি বুঝতে নাই পারে যে তার পিছনে বল পড়েছে তো আগের চোর তার পিঠে কয়েক ঘা রাম ঘুষি দিয়ে তাকে ঠেলে চোর দিতে বলবে। এও এক খেলা।
একটা কঞ্চি দিয়ে সাইকেলের বাতিল টায়ার গড়গড়িয়ে ছুটে চলার মধ‍্যে বিশাল ভারসাম‍্য আছে। আমি কোনোদিনই টায়ারকে পোষ মানাতে পারিনি। অনেকে কামারশালা থেকে মোটা তার বাঁকিয়ে এনে খেলত।
খোন্তাখুন্তি খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। এতে পাঁচজন লাগে। বেশ বড় চৌকো ঘর। তার চার কোনে চারটি গোল্লা কাটা। চারজন খেলুড়ে চারটি ঘরে আর একজন হল চোর। চোর সবার কাছে গিয়ে বলবে…খোন্তাখুন্তি দাও না।
অন‍্যজন উত্তর দেবে…উসকো বাড়ি যাও না।
সে অন‍্যজনের কাছে গেলে এরা পরস্পর ঘর বদল করবে। চোর যদি কোনো ঘর দখল করে তো, সেই ঘরের খেলুড়ে চোর দেবে।
নারকোল মালা দিয়ে দাঁড়িপাল্লা তৈরি করে মাটির বাইট(ওজন মাপক) তৈরি করে দোকানদার না সাজলে কী চলে? এক সের, আধ সের, এক পো ওজনের বাইট উনুনে পুড়িয়ে ধুলোমাপা হত। ধুলো? আরে না না, ওটাই তো চাল।
এবার ছড়া বলে খেলার কথা বলি…
মেঝেতে হাতের চেটো উপুড় করে মেলে “ইকড়ি-মিকড়ি চাম চিকড়ি/ চামের কাটা মজুমদার/ধেয়ে এল দামুদার…”এমন খেলা ছোটদের মধ‍্যে এখনো আছে।
দুজন হাত ধরে হাত উঁচু করে গেটের মত করে দাঁড়াবে, একটি ছড়া বলতে বলতে। ছড়াটি হল…”ওপেনটি বাইশকোপ/ঠাঁই ঠুঁই টাইশকোপ/চুলটানা বিবিয়ানা…”। অন‍্যরা লাইন দিয়ে গেটের ভেতর দিয়ে গলে যাবে। যেখানে ছড়া শেষ হবে, সেখানে ঐ গেটের মুখে যে থাকবে তাকে গেট সাজা দুজন বন্দি করে ফেলবে।
“এলাডিং বেলাডিং সইলো/ কিসের খবর পাই লো/
রাজামশায় একটি বালিকা চাইলো।
কোন বালিকা চাইলো?
…অমুক বালিকা চাইলো।
নিয়ে যাও নিয়ে যাও…”বলে বলে দু দলের মধ‍্যে খেলা। ছোটবেলায় না বুঝে খেলেছি। এর পিছনে লুকিয়ে থাকা কষ্ট এখন বুঝে খারাপ লাগে। সামাজিক একটি ব‍্যাধি ছড়ার মধ‍্যে লুকিয়ে আছে…রাজামশায়রা তখনো বালিকা চাইত মনোরঞ্জনের জন‍্য। আর গর্বিত বাবা মা ঠেলে পাঠিয়ে দিত অপাঙক্তেয় কন‍্যা সন্তানটিকে।
দলবেঁধে কাঁঠালচোর খেলা…”কাঁঠাল গাছে জল দিতে দিতে কোমর ভেঙে গেল/একটি কাঁঠাল খেতে পেলামনি চোরের পেটে গেল”। একজনের দুই কাঁধ থেকে, কোমর থেকে, চার পাশ থেকে কাঁঠাল ঝুলবে। আর গৃহস্থ পাহারা দেবে।
মেঝেতে বাবু হয়ে কয়েকজন বসলে যে ছড়াটি বলে বলে হাঁটু ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা চলত তা হল…
“আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে/ঢাক ঢোল ঘাঁঘর বাজে/বাজতে বাজতে চলল ঢুলি…”ইত‍্যাদি।ছড়া শেষ হবে যে হাঁটুতে, সেই হাঁটু মুড়ে বসতে হবে। সেই খেলুড়ের দু হাঁটু মোড়া হয়ে গেলে তার জিৎ। বড় হয়ে বুঝেছি আমরা গ্রামবাংলার ডোম সৈন‍্যের যুদ্ধযাত্রার বর্ণনা বলতে বলতে খেলেছি।
দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজনের হাতে হাতে তালি দিতে দিতে যে ছড়াটি বলেছি তা হল…আইকম বাইকম তাড়াতুড়ি/যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি…”
“আমপাতা জোড়া জোড়া/মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া…”।
এ ছাড়া এমনি এমনি লাইন দিয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে স্কুলের সর্দার পড়ুয়ার মত পড়িয়েছি বন্ধুদের। তার ছড়াগুলিও বেশ সুন্দর। একসময়ের দেশের অবস্থা, সামাজিক কত কথা তার মধ‍্যে লুকিয়ে আছে। যেমন…
“সারেগামাপাধানি/বোম ফেলেছে জাপানি।
বোমের ভিতর কেউটে সাপ/ইংরেজ বলে বাপরে বাপ।”
গ্রামের ছোটদের মুখে উচ্চারিত এইসব ছড়ার প্রকৃত উচ্চারণ খুঁজতে গেলে চলবে না। বিকৃতি তো আছেই। তবু শুনতে আজো বড় মিঠে লাগে। আমি ছোটবেলার উচ্চারণটাই বজায় রেখেছি।
কতটুকু বলতে পারলাম জানি না।
তবে না বলা থেকে গেল আরো অনেক খেলা। সবটাই তো স্মৃতি থেকে বলা। আজকালকার ছোট ছোট ফ্ল‍্যাটবাড়িতে বাবা মায়ের আপনি-কপনির সংসারে একটি মাত্র সন্তান। আর তারা বঞ্চিত হচ্ছে প্রাণের অনাবিল আনন্দ থেকে। বাবা মায়ের রক্তচক্ষু সর্বদা তাদের দিকে। খেলার মাঠেরও অভাব আছে। ছোটদের মধ‍্যে স্মৃতিশক্তির ব‍্যায়াম, শারীরিক ব‍্যায়াম হচ্ছে না। তাদের মধ‍্যে আন্তরিকতা, সহমর্মিতাবোধ, তিতিক্ষার স্ফূরণ ঘটছে না। সবেতেই যেন যান্ত্রিকতায় ভরা আজকের সমাজ। কল্পনাশক্তি হারিয়ে গেছে তাদের। উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটছে না। দোকানের কেনা খেলনা বা কম্পিউটার গেম কতটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারে জানি না। প্রাণের যোগ না হলে চলে কী?
সবশেষে বলি…এখানে আমি মূলত আমাদের গ্রাম মেদিনীপুরের ছোটদের খেলার কথা বলার চেষ্টা করেছি। এসব খেলা এবার পত্রিকার পাতাতেই থেকে যাবে শুধু…এটাই কষ্টের।