উপন্যাসঃ পাথরকন্যা

উপন্যাসঃ পাথরকন্যা

পাথরকন্যা
হামিদ মোহাম্মদ

।। এক ।।

–একটি লোক আইছিল, আইয়া কয়–এইটানি চান্দু ডাকাইতের বউ? আবার কয়–এটা কয় নম্বর?
–মুই লুকাই গেলাম বাঁশর তরজা ঠেইল্লা।
কনচান দেখি এইটা কি কয়? হি কথা কি আমি জানি! তুমি ডাকাইত, না ডাকাইত নায়! আবার জিগায় কয় নম্বর।
–তুমি কিছ্ছু কয় নাই?
–নাহ। আমি আবার কী কইমু।
–কে জিগাইছে? মেম্বার? চানমিয়া কিড়িমিড়ি খেয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়। একটু দম ধরে ডান হাতটা ঝাড়া দিয়ে স্বগতোক্তি করে–আমার পিছ লাগছে। পুড়াই মারবে লোকটা।
চান্দু মিয়া মানে চানমিয়া। পুরো নাম চানমিয়া বেপারি। এটা বংশগত নাম নয়। চানমিয়ার বংশধর বেপারি বা ব্যবসায়ী ছিলেন না। কিন্তু লোকে এক ডাকে বেপারি বললে চেনে। পাথরের ব্যবসা, ইন্ডিয়ান নাসির বিড়ি, খাসিয়া পান তারপর সিজন এলে সময় বুঝে ধানের ব্যবসাÑআগন বা বৈশাখ মাসে। এই ধানের ব্যবসা করতে গিয়েই চান মিয়া আজমিরিগঞ্জের এক বনেদি ঘরের মেয়ে জুলেখাকে বিয়ে করেছে। আজমিরিগঞ্জে ধানের বড় ব্যবসায়ীকে বেপারি বলে, কেউ কেউ সদাগরও বলে। বেপারি নামটা এখানেই পাওয়া।
বৈশাখ মাসে নৌকা নিয়ে গ্রাম চষে বেড়ান ধান কেনার কাজে চানমিয়া বেপারি। লোকে তাকে সদাগর যখন বলে, তখন মনে হয় এর মাঝে একটা মায়া বা মহব্বত মাখানো আছে। সদাগর শব্দটার মাপ বড় বড় মনে হয়, নিজেকে বড় ব্যবসায়ী ভাবতেও খারাপ লাগে না চানমিয়ার। গাল ফুলিয়ে, পান চিবুতে চিবুতে কথা বলেন যখন চানমিয়া, তখন তাকে বড় মহাজনই মনে হয়। এতে এক সময় একটা পরিচয়ও দাঁড়িয়ে যায়Ñ পরিচয়টা হয় বেপারি বলে। কিছু দিনের মধ্যেই কদরও বাড়ে বেপারির গেরস্তদের বাড়ি, বউ—ঝিসহ পুয়া পাংড়াদের কাছেও ময়—মোলাকাত কম নয়। আর বৈশাখ মাসে ধান কেনা লাভজনক হওয়ায় বেশ কয় বছর ধরেই চানমিয়া বেপারির আজমিরিগঞ্জে আনাগোনা বাড়ে, নাম—ডাকও বেড়ে যায়।
সেই পরিচয়েই জুলেখার পিতা আবদুল আলী দত্ত মহাশয় প্রস্তাবটা পেয়ে সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান। কেউ মনে করতে পারেÑবিয়ের প্রস্তাব মুখ থেকে ছাড়ার পরই যেন অনেকটা মাটিত পড়ার আগেই লুফে নেন তিনি। শুনতে, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত বিষয়টি টেকলেও, চান মিয়া উপযুক্ত বর বললে কম বলা হবে। পেরা—সরিষার তেল মাখা তেল জবজবে চেহারাটা তো কম চিকচিকে নয়, পুরো দস্তুর তেলতেলা। বিয়ের পর জুলেখারও খুশি খুশি ভাব, দেখলে মনে হয় সেও এক ধাপ উঁচুতে উঠেছে। ক’দিন পর সিলেট শহরের লাগোয়া ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারিতে থাকা চানমিয়ার স্থায়ী ডেরায় উঠবে। সেখানে নাকি শত শত মানুষ, কাজ আর কাজ, কাজে ডুবে থাকে সবাই। জুলেখা বৈশাখ মাস এলেই ধান কাটায় আসা মৈমনসিংহা কিছু লোকজন শুধু দেখে। তাও চানমিয়ার কাছ থেকে শোনা বিশাল সংখ্যক লোকের বর্ণনা সমিল নয়, তুচ্ছ। বছরের বাকি দশ মাসই এই হাওর অঞ্চলে মানুষ বলতে ছিটেফোঁটা।
জুলেখা শুনেছে, ভোর হওয়ার আগেই পাথর শ্রমিক, ট্রাক—ড্্রাইভার, হ্যান্ডুম্যান ও অন্যান্য লেবারের হাকডাকে বাতাসেও সাঁই—সাঁই রব উঠে। এই সাঁই—সাঁই পরিবেশের একটি চিত্র অল্পদিনেই মনের মধ্যে এঁকে নেয় জুলেখা। হাতছানিটা দেখে কখনওবা চোখের সামনে হয়তবা বাস্তবে, কখনো ঘুমের ভেতর, কে যেন হাত নেড়ে নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছে আর সে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। যে লোকটির হাত ধরছে সে লোকের শরীরে ভেজা ধানের গন্ধ নেই, মাছের আঁশটে বয়ার বের হয় না মুখ বা বগল থেকে। কাপড় থেকে লাক্স সাবানেরই মৌ মৌ মৌতাত ভেসে আসে নাকে, মগজে পাক খায়।
জুলেখা যতটুকু জানে সে হল কালনী নদীর সাথে মিশেছে সুরমা ও কুশিয়ারা। সেই কালনী নদীর মোহনায় আজমিরিগঞ্জ। ছোট বেলায় পড়েছে সুরমা নদীর আত্মকথা। আমার নাম সুরমা, তাই বলে চোখে দেয়ার সুরমা নয়Ñসেই সুরমা নদী। আরও শুনেছে জুলেখাÑএই সুরমা নাকি সিলেটের উজানে ভোলাগঞ্জের পর জকিগঞ্জ নামক স্থানে পাহাড় বেয়ে উঠেছে ইন্ডিয়াতে, যেখানে হিমালয় পর্বত। কী অপরূপ দৃশ্য! বর্ণনা শুনেই পাগল হয়ে ছটফট করছে জুলেখা, জুলেখার ভেতরে এক ধরনের উতাল—পাতাল হাওয়া, হাওয়া নয়Ñভাব, হৈ—হৈ করা, উদাস উদাস।
সেই জায়গায় লোকটি বললো, চান্দু ডাকাতের বউ এইটা নাকি? কয় নাম্বার?
জুলেখার ভেতরটা চেত করে ধরে। যেন তেলের বাগার দেয়ার চেত শব্দ, বুক এফোড়—ওফোড় করেই বিরান করছে নিজের মাংশ।
এ রকম নানা ভাবনায় কাটে একাকী সময়টা জুলেখার। যে ভাবনাগুলোর তেমন আগা—মাথা নেই, সেগুলোও ভর করে। এলোমেলো ভাবনায় হামাগুড়ি দিয়ে আসে নিজস্ব কতকিছু। কখন যেনবা তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে তারই আরাধ্যপুরুষ মিলিয়ে যাবে মধ্যরাতে। পাথরে ঘসা—খাওয়া খসখসে চানমিয়ার দশ আঙুল তার তিলোত্তমা বুকে নড়ে উঠবে অন্ধকার চিরে। এক সময় মুষ্টিটা বড় থেকে ছোট হবে বিশেষ কায়দায়। তারপর, জুলেখা জেগে দেখবে রাত কাবাড়, আজান পড়ে পড়ে অবস্থায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরবে চানমিয়া বেপারির পাত্তরের মত শরীরটা। কোন কিছু জিজ্ঞেস করার ফুরসত কই? সে যে কামলা সামলাতে ছুটবে ক্রাশার মেশিনের চোঙার পাশে, চুনের মত ধোঁয়া ওঠা জায়গায়, নয়তো ত্রিশ বা চল্লিশ হাত তলে খনিতে অথবা বোমা মেশিন দ্বারা পাথর তোলার জন্য পাথরের স্তর ফাটানো বা আলগা করার বিধ্বংসী কাজে।

।। দুই ।।
জুলেখার নাম ছিল শরবরী দত্ত। ১৯৯২ সালে পুরো পরিবার মুসলিম হওয়ায় ‘নও মুসলিম’ হিসেবে নাম রাখা হয় জুলেখা বেগম। কাবিনে লেখা হয়েছে স্কুলের খাতায় লেখা জুলেখা বেগম নামটাই। যদিও অন্যরা বংশগত ‘দত্ত’ উপাধিটা জুড়ে দিয়ে জিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যটা।
জুলেখা শুনেছে দাদীর কাছে তাদের ঐতিহ্যিক নানা গল্প। ‘দত্তবাড়ি’র শান—শওকত, পূজাপার্বনের নানা কিসিমের অনুষ্ঠানাদির বর্ণনা এখনো কানে বাজে। বাপের বাপ দাদা, এক সময় ভেবেছিলেন পূর্ব বাংলাই তাদের জন্য নিরাপদ। হিন্দু—মুসলিম বিবাদে দেশভাগ হউক, তবু তারা থেকে যাবেন পূর্ব বাংলায়। পশ্চিম বাংলা হিন্দুপ্রধান হলেও, পশ্চিম বাংলায় যাবেন না। এমনকি সিলেটের রেফারেন্ডামে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটও দেবেন। কেননা, বর্ণহিন্দু প্রথা বা তার প্রভাব কোনদিন পছন্দ নয় দাদা এবং এই বংশগ্রোত্রের। বর্ণ প্রথার দলনের চেয়ে মুসলমানদের আচার—ব্যবহার উত্তম। যদিও দত্ত সম্প্রদায়ের সমস্যা নয় বর্ণহিন্দু প্রথায়। কিন্তু তাদের গ্রামে এক ঝাঁক কৈবর্ত, মৎসজীবী শূদ্র, চন্দবৈদ্য এবং নিম্নশ্রেণীর কৃষিজীবী দাসদের বসতি। এরাই আকড়ে আছে তাদের। ওরা বলছে ‘দত্ত’ বাবুরা যদি পূর্ব বাংলায় থেকে যায়, তবে তারাও থাকবে। দত্তরা বর্ণপ্রথার তেমন ধার ধারেন না। অন্তত তাদের আশ্রয়ে এবং মুসলমানদের উদারনীতির ফলে বর্ণপ্রথা থেকে মুক্তি মিলবে ঐ নিম্নবর্গ জাতিকুলের। ‘ভটবাবু আর চ্যার্টাজি’দের পায়ের নীচে বসতে হবে না কখনো। তাদের হাতের অন্ন খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। কে কাদের অন্ন খেলো, কি না—খেলো সেসব দিন শেষ হবে। সুতরাং ভোট দাও পাকিস্তানের পক্ষে। ভোটের সময় এটাই ঘটলো।
কিন্তু হিসেবটা যে এতো সরল নয়, সেটা এই ‘দত্ত’বাবুরা বুঝেননি। অল্পদিন পরেই শুরু হল ১৯৫০—এর দাঙা, হিন্দু মুসলিম কাটাকাটি। তখন অসহায় হয়ে পড়ে নিম্ন ও গরীব হিন্দু পরিবারগুলো। জমি কেড়ে নেয়ার সুযোগটা নেয় বলবান মুসলমানরা। দত্ত বাবুদের আশ্বাস দেয় কতিপয় ব্যক্তি। বলেন— ‘আপনারা চুপ থাকেনÑআমরা আছি।’ এই কথা বলে কোন এক রাতের গভীরে কচুকাটা দিল কৈবর্তবাড়ির কর্তাকে, তার সন্তানদেরকে। ক’দিন পরেই পালিয়ে গেল নবশূদ্র বাকী পরিবারগুলো। কমে গেল হিন্দু বসতি। চন্দবৈদ্যদের পরিবার ও দাস গোত্রদের খুনখারাবির পরিবর্তে আরো কী কী ঘটল, কানাগোসা শোনা গেল গ্রামে।
১৯৬৫ সালে ভারত—পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলো। হিমশিম খেলেন বৃদ্ধ হওয়া দাদা—দাদীরা। এখন আর কারো আশ্বাস পেলেন না, মনে হলÑকারো কাছ থেকে আশ্বাস পেলেও, কোন কাজ দেবে না। উত্তর বন্দের ধানিজমি বেদখল হলেন তারা। এটা নাকি ‘এনিমি প্রপাটি’। সরদার বাড়ির বড় সরদার নাম ‘আবদুল আজিজ সরদার’ ডাকনাম ‘আজই সরদার’ ভূমি অফিসের লোক দিয়ে দখল নিলেন। বাঁধা দেওয়ার সুযোগ তিল পরিমাণ পাওয়া গেল না। কাগজ দেখিয়েই দখলপর্ব সমাপ্ত হল। ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সরদারসাব বা ‘আজই সরদার’ যা করেছেন, তা ঠিকইÑসরকারের খাস তসদিকে ভূমি ‘এনিমি’ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কেননা, দত্তবাবুর ছোট ছেলে সপরিবারে কলকাতা বাড়ি করে চলে যাওয়ায় তাদের অংশ, অর্ধেক সম্পত্তি ‘এনিমি’ হয়েছে।
কিছু জমি বিক্রি করতে চাইলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার হিন্দু প্রপ্রার্টি বা জমি বিক্রি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন। যত টাকায়—ই জমি বিক্রি করুন না কেন, জমির বিঘাপ্রতি পাঁচ’শ টাকা মূল্য দলিলের পিঠে লেখা থাকবে। যে কোন সময় সরকার এই টাকা ফেরত দিয়ে কেড়ে নেবে বা দলিল করে নেবে। এই বিধিবদ্ধ নিয়ম বা আইনের কারণে ক্রেতা পাওয়া ভার। এতে আরও অসহায় হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ ‘ব্রজ নারায়ন দত্ত’ বাবু। যত দোষ দেয়া যায় তত দোষ দিতে থাকেন পুত্ররা। কেন যে তাদের বাবা—চাচারা মুসলমানের দেশকে আপন ভেবেছিলেন, নিরাপদ কেন ভেবেছিলেন, এই ফিরিস্তি নিয়ে মাঝে—মধ্যে ঝগড়া—ঝাটিও বাঁধে নিজেদের মধ্যে। শত ভুল স্বীকার করেও এখন স্বস্তি নেই, পুত্রদের বুঝ দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। জুলেখা শুনেছে ব্রজ নারায়নের বড় পুত্র তার বাবা রাজ নারায়ন দত্ত একটু বেশি ভড়কে গিয়েছিলেন।
এরপর আসে একাত্তর সাল।
শুরু হয় দেশে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার জন্য এ যুদ্ধ বাঁধার ফলে চনমনে হয়ে ওঠেন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়। প্রথমে ভীত হয়ে পড়লেও যুদ্ধ বাঁধার পর পরই আইডিয়াটা মোড় নেয় ভিন্ন ধারায়। দেখা গেল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামীলীগ পন্থী অন্যান্য রাজনীতিক দলের কর্মী নেতারা। এরা মুসলমান হলেও আখ্যা দেয়া হল, এরা ভারতের দালল। ভারতে আশ্রয় নিল প্রায় কোটি মানুষ। এ আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে মুসলমান থাকলেও সর্বাধিক সংখ্যক হিন্দু ছিল। গরু—ঘরবাড়ি লুট হল হিন্দুদের। পুড়িয়ে দেয়া হয় সহায় সম্পদ। এক বিরান ভূমি বাংলাদেশ।
৯ মাস প্রবল যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হল। জন্ম হল ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ শ্লোগান আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হল।

।। তিন ।।

চান্দু ডাকাইতের বউ কইয়া যে লোকটি জুলেখাকে ক্ষেপাইতে চাইল, সে ভোলাগঞ্জ এলাকার একটি ইউনিয়নের মেম্বার। সে আবার স্থানীয় নয়, উঠরা। উঠরা বলতে সিলেটের বনেদি বা মূল বসিন্দা লোক নয়, তারা হল, এ অঞ্চলে আবাদী। এদের বাড়—বাড়ন্ত এখন বেশি। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশভাগের পর মৈমনসিংহা, কিশোরগঞ্জা ও নেত্রকোণার দরিদ্র ভূমিহীন লোকেরা এসে দলে দলে বসতি স্থাপন করে গড়ে তুলেছে গ্রাম,গঞ্জ,হাট নিজস্ব বসতি। হাল আমলে তারা হয়ে উঠেছে পঞ্চায়েতের প্রধান এমনকি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান—মেম্বার পর্যন্ত। এক সময় দেশভাগের আগে এ অঞ্চলের জন¯্রােত ছিল আসামমুখী। দেশভাগ হওয়ায় দুইস্থান দুই রাষ্ট্র। এছাড়া আসাম অঞ্চলে বাঙালিদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আর নেই, বরং আসাম থেকে বাঙাল খেদাও আন্দোলন শুরু হয়েছে দেশভাগের আগেই। ব্রিটিশ সরকার জমি দেয়ার কথা বলে পাহাড়—জঙ্গল আবাদ করিয়ে ফসলি জমি তৈরি করার পর চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে কথা উঠেছে। আসামের মূল ‘অসমীয়’ জনগোষ্ঠীও বিগড়ে গেছে বাঙালির ওপর। ব্রিটিশ তো তল্পিতল্পা গুটিয়ে যায় যায় অবস্থা, সেই জমানায় অসমীয়দের প্রবল আক্রোশের তোড়ে বাঙালিরা পালায় পালায়। সেই থেকে মৈমনসিংয়া, কিশোরগঞ্জা এবং নেত্রকোণার বাঙালিরা সিলেট অঞ্চলের আধা—পাহাড়ি এলাকায় বন—জঙ্গল আবাদ করেই বসতি করছে,করছে আরও।
চানমিয়া বা তার মত আরও অনেকে প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি এদের দবদবি কতদূর। ভোটের সময় ভোর থেকেই ভোট সেন্টারে ভোলাগঞ্জের পাথর কোয়ারির কামলা বউ—ঝিসহ পুরুষদের জাল ভোট দানের জন্য লাইনে দিয়েছে। কাচা—টাকা পেয়েছে বটে। কিন্তু নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে নিজে। যখন বুঝতে পেরেছে,তখন আর সময় নেই, বেলা অনেক গড়িয়েছে। এমনকি গত কিছুদিন আগেও এমপি ইলেকশানে জালভোটের কারবার করেছে চান মিয়া। যার জন্য আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে হারিয়ে বিএনপির এমপি হল। অথচ মোটে কথা ছিল না এমন হবার। তবে এখন ভোটারের সচিত্র আইডি প্রবর্তন হওয়ায় জাল ভোটের ব্যবসা নেই। তবে এর চে বড়টা এখন হয়, সেটা হল গভীর রাতে ভোটের বাকস ভোট দিয়ে ব্যালটে ভর্তি করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। যেখানে যে প্রার্থী শক্তিশালি বা সরকার দলীয় প্রার্থী, সেখানে এ সহজ কাজটি করেই ইলেকশান কর্মটি সম্পাদন করেন প্রার্থী। এতে চরিত্র হনন শুধু নয়, রীতিমত জোর যার মুল্লুক তার।
এই ধরণের এক ইলেকশানে জেতা ফজলু মেম্বার। যে নাকি লেবার শ্যাডের চিপায় চিপায় ঘুরে আর নানা পিছলামি করে। জুলেখাকেও সে তার এই ফুঙ্গামির অংশ হিসেবে ক্ষেপাতে গেছে। ক্ষেপাবেই না কেন, সে যখন মেম্বার হয় তখন জাল ভোটের জন্য চানমিয়া বেপারি কোয়ারির কামলাদের ভোটের লাইনে দেয়নি। রাতে ভোট বাকসে ভরার পরও লাইনে লোক চাই, যেটা লোক দেখানোর জন্য জরুরি। ফজলু মেম্বারকে চানমিয়া বেপারি ইলেকশানের দিন কোন সহায়তা করেনি বরং শহরে চলে যায় সামান্য ছুঁতোয়।
ফজলু মেম্বার জেদ ধরেই আছে, যে সময়, যেভাবে পারে চানমিয়া বেপারির ক্ষতি করে, সুইয়ে সুতোর বদলে গাছ ঢুকায়। নানা বেধড়ক, বেফাস কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, খুঁজতে থাকে আকাম—কুকাম, ফের—ফোর, ফাঁকফোকর।
জুলেখা বেগম চানমিয়া বেপারির দ্বিতীয় বউ। প্রথম বউ ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে দু’মাইল পশ্চিমে বাঘার পার গ্রামে নিজ বাড়িতেই আছে। এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান নিয়ে পরিবারের আরও অন্যান্য সদস্যদের সাথে থাকা সেই বউয়ের নাম আমিরা বেগম। চানমিয়ার আরও দুই ছোট ভাই আছেÑআলিম, ছালিম। বাপেরখালি জমি—জিরাত চাষবাস করেই চলে বছর। পাথর কোয়ারির ব্যবসায় ভিড়েছে শুধু মাত্র চানমিয়া বেপারি।
ফজলু মেম্বারের পুরো নাম ফজলু মিয়া। কিন্তু পর পর দুইবার মেম্বার হওয়ায় তার নামের সাথে মেম্বার যোগ হয়ে এখন নামটাই ফজলু মেম্বার হয়ে গেছে। তাই, সবাই জানে, দুই দুইবারের ইউনিয়ন মেম্বার হওয়ায় ফজলু মেম্বারের দাপট একটু বেশি।
এদিকে, দু’বছর আগে ভোলাগঞ্জ পাথর—কোয়ারিতে বোমা—মেশিনের করা পাথর তোলার খনি বা ‘গাতে’ পাহাড় ধসে তিনজন পাথর শ্রমিক চাপা পড়ে মারা যাওয়া এবং পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে মামলা, চানমিয়া বেপারিকে পুলিশের আসামী করা, সব মিলিয়ে কোণটাসা চানমিয়া বেপারি। এর আগে কয়েকবার পাথর শ্রমিকরা এক দুই জন খনিতে মরেছে চাপা পড়ে। তবে এতটা মাশুর হয়নি। হয়েছে এবার। সেই জায়গায় তাল ঠুকেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। উপরন্তু ফজলু মেম্বার ঘি ঢেলেছে-এক গুণ, দ্বিগুণ, তিনগুণ, এক টানা।
ঘটনার পনের দিনের মাথায় পাথর কোয়ারি বন্ধ করে দেয় উচ্চ আদালত, অর্থাৎ পাথর তোলা স্থগিত। বেকার হয়ে পড়ে হাজার হাজার পাথর শ্রমিক, ক্রাসিং মেশিন বন্ধ হয়ে পড়ে, ট্রাক বা পরিবহন ব্যবসাও নাই হয়ে যায়।
এই দুর্দিনেই চানমিয়া বেপারি আজমরিগঞ্জে গিয়ে বৈশাখ মাসে শুরু করে বোরধান কেনা, তথা ধানের আড়ৎদারি ব্যবসা। সেখানেই তৈরি হয় নতুন এক জগত চানমিয়া বেপারির। দুই বছরের মাথায় সেই জগতের এক প্রান্তে এসে জুলেখাকে বিয়ে করেই নতুন সংসারের সূচনা করে চান মিয়া।
দু’বছর পর আবার উচ্চ আদালত পাথর কোয়ারি খুলে দেয়, বা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে চান মিয়া বেপারি ছুটে আসে পাথর কোয়ারির পাথর তোলার পুরনো ব্যবসায়। সঙ্গে নতুন বউ জুলেখা বেগম। দু’বছর পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় ফজলু মেম্বারের নতুন দাপট বেড়েছে, ক্ষমতার নয়া মেরকরণ হয়েছে। চুরি করে পাথর তোলা ও বিক্রির নয়া ফন্দি তৈরি হয়েছে। সেই জায়গায় পিছিয়ে পড়েছে চানমিয়া বেপারি। এলাকা—ছাড়া মানুষ থিতু হতে গিয়ে নতুন সংকট, নতুন ছটাবরদারির শিকার চানমিয়া বেপারি।
অথচ, এক সময় চান মিয়া বেপারি মানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ মিয়ার সন্তান বা বড়পুত্র। সুরুজ মিয়ার মূল বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলার সিঙ্গেরকাছ গ্রামে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভোলাগঞ্জে ছিল ৫ নং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প। এখানে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন হেলাল, ক্যাপটেন আবদুর রউফ, ক্যাপ্টন নূরুন্নবীসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চৌধুরী, ইয়ামিন চৌধুরী, ডা. হারিছ আলী। এবং তাদের সাথে প্রবল দাপটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ আলী। ‘রাজাকার’—এর ত্রাস মানে সুরুজ মিয়া। ধরা পড়া ‘রাজাকার’কে গাছে লটকিয়ে পা উপরে অথবা পা নিচে দিয়ে ঝুলিয়ে ধুম পেটা, তারপর চারপাঁচটা জড়ো করে এক গুলিতে এফোড়—ওফোড়। ঠেলে ধোলাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার করিৎকর্মার নাম সুরুজ মিয়া কমান্ডার। এ কাজটি সুচারুরূপে আর কেউ পারতেন না, পারতেন একমাত্র সুরুজ মিয়া। তাই সুরুজ মিয়ার কদর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যেমন, অত্র এলাকার মাঝেও সমান।
মুক্তিযুদ্ধের পর সুরুজ মিয়ার পছন্দ হয়ে ওঠে পাহাড় তলের এ সমতল এলাকাটি। এর আগে ত্রিশ বা চল্লিশ বছর পূর্বে সুরুজ মিয়ার সাত চাচার মধ্যে পাঁচ চাচা ভোলাগঞ্জ এলাকার বাঘারপার গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সস্তায় জমি কেনা, দু’ফসলা ফসলি জমির জন্য বিখ্যাত পাহাড়—তলের সমতল ভূমির তুলনা হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পর সুরুজ মিয়া চাচাদের দেয়া হিস্যায় বাড়ি করে আসেন। তারাও সাতভাই, দুই বোন। জমজমাট, ধুমধাম পারিবারিক কাজ—কাম। সবাই লন্ডনীবাড়ি বলতে শুরু করে। কেননা, এ অঞ্চলে প্রথম পাকা বাড়িই তাদের। সিঙ্গেরকাছের জমিজিরাত বেশি দামে বিক্রি করে পুব ও পশ্চিমে দুই সারি ঘর তুললেন পাকা করে। জমি কিনলেন আরও কয়েক হাল। সাঁই সাঁই অবস্থা। লন্ডনী বাড়ি নয়তো কী। বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ মিয়াকে এলাকার লোকে সমীহ তো করেই, কেউ কেউ রীতিমত কাঁধে নিয়ে ঘুরবে এমন হাল বা দশা। কেউ ভয়ে, কেউ সাহসী মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিয়ে নাম করে, সম্মান করে।
এই থমথমি থেমে যায় ক’বছর পরে সাত ভাইয়ের পৃথক সংসার পাততে গিয়ে। সুরুজ মিয়ার প্রথমপুত্র চানমিয়া সদ্য চাঙা হয়ে ওঠা পাথর ব্যবসায় মনযোগ দেয়। তখন এই ফজলু মিয়ারা সবেমাত্র কিশোরগঞ্জ থেকে আসা ছেবড়া বালক মাত্র।
ফজলু মেম্বারের দাপট দেখে চানমিয়ার গা শির শির করে। বেপারি নাম মুছে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনে মনে ভাবে আবার যদি একটা মুক্তিযুদ্ধ হত। তবে তড়পানো বের করতো, বাপের নাম রাখতো সেও। সেই দিন নেই, এখন আ—ঘাটে ঘাট, অমানুষ মানুষ। এটা যুগের তাল, যুগের ভাষা।
চানমিয়া বেপারি পাথর ব্যবসায় নেমে প্রথম পাথর কিনে স্টেক করে বিক্রি করতেন। লম্বা বারকি নৌকায় করে পাথর পানি থেকে তুলে আনতো। ‘বেইলচা লেবার’ দিয়ে বারকি মালিকরা পাথর তুলতো। সেই বারকি মালিকরা ঠকিয়ে দিতো স্টেকওয়ালাদের। চানমিয়া প্রথমে ব্যবসায় নেমে, বহু ঠকেছেন। বড় পাথর কয়েকটি নৌকায় ভরলেই নৌকা ডুবু ডুবু। ছোট পাথরের মাঝে বড় পাথর নৌকায় তুলে ফিতে দিয়ে মেপে দিতো বারকি মালিক। বড় পাথরের ফাঁকে অনেক জায়গা ফাফা থাকতো, কী পরিমাণ ফাফা থাকতো তা অনুমান করা যেতো না। সুতরাং এই পাথর ভাঙার পর দেখা যেতো কমপক্ষে তিন বা চার ফুট পাথর কম। পাথরের ব্যবসার এই ফাঁক—ফোকর শিখতে গেছে চানমিয়ার কমপক্ষে দু’বছর।
এতে ঘুরতে হয়েছে জাফলংয়ের সবুজ বনের ভেতর ডাউকি নদীর পাথর কোয়ারি। পাহাড় দু’ভাগ করে নেমেছে ডাউকি নদী। ঝর্ণার ঝির ঝির পানির ¯্রােত, ঝুলন্ত ব্রীজ, খাসিয়া বস্তি সংগ্রামপুঞ্জি, হেলে—পড়া সবুজ পাহাড়। নয়নাভিরাম একেই বলে।
খাসিয়া—জৈন্তা পাহাড়টাই এক অপূর্ব সবুজ এক—তাল অবিশ্বাস্য স্বর্গপুর। বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর জৈন্তাপুর থেকে পশ্চিমে নেত্রকোণার সুসংদূর্গাপুর হয়ে একেবারে জামালপুর কুচবিহার শিলিগুড়ি।
চানমিয়া বেপারি ব্যবসার খোঁেজ ভোলাগঞ্জ থেকে গেছেন ছাতকের চেলা। চেলার নিকট বাঁশতলা, বাংলাবাজার। এলাকাটির চেলা নাম হয়েছে পাহাড়ি শীর্ণ চেলানদীর ঝিরঝিরে ¯্রােতের সৌন্দর্যকে ঘিরে। বর্ষায় হাজার হাজার বারকি নৌকার উজানভাটি এতো অপূর্বÑনা দেখলে, বর্ণনা দিয়ে কোন ভাষায়—ই তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এরকম হাজার নৌকার হৈ—হৈ অবস্থা সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা এলাকার জাদুকাটা নদীর দৃশ্য। লোকে বলে জাদুকাটা নামের মাহাত্ম্য আলাদা। সে নদীতে খুব বেশি মাছ ধরা খেতো। একদিন এক কৃষানিকে তার স্বামী মাছ ধরে দিয়েছেন। তিনি নদীর তীরে বসেই মাছ কুটছিলেন। মাছ কুটতে কুটতে এক সময় তার কোলের সন্তান ঘুমিয়ে পড়ে। তিনি শিশুটিকে মাছেদের পাশে শুইয়ে রেখে দেন। মাছ কাটতে কাটতে সহসা ভুলে নিজের ঘুমন্ত সন্তানকে মাছ মনে করে কেটে ফেলেন। কাটার পরেই তিনি বুঝেন এবং বলে ওঠেনÑহায় হায় এতো মাছ নয়, আমার জাদু! তিনি চিৎকার করে ওঠেনÑ‘জাদুকাটা’! তখন থেকেই এ নদীর নাম জাদুকাটা। এতো সুন্দর সুন্দর মিথ বা কিচ্চা কাহিনি জড়িয়ে আছে সিলেট—সুনামগঞ্জের পাহাড়ি তলে পর্বত দু’ভাগ করে আসা স্বচ্ছ পানির জাদুকাটা নদী শুধু নয়, এ অঞ্চলের কত শত নদী—ঝর্ণার নামের পেছনে। জৈন্তা—খাসিয়া পাহাড় আরও কত ঐতিহাসিক নানা কাহিনির অঞ্চল। আছে খাসিয়ারা নদী। চানমিয়া প্রকৃতি নিয়ে তেমন না ভাবলেও ব্যবসার আঁধার বলেই মান্য করে জীবনের সঙ্গে গেঁথে নেয়া প্রকৃতিটাকে আপন ভাবতে ভাল লাগে।

।। চার ।।

জুলেখা বেগম আগে ভাবেনি বা শুনেওনি যে চানমিয়া বেপারির আরেকটি বউ আছে। আছে দু’সন্তানও। বাঙালি কেন, যে কোন দেশ—জাতির রমণীর জন্য এটা বিষময় বা বিষাক্ত বিষয়। চটে গিয়ে লাভ নেই। লোকে এখন ডাকাতের বউ বলুক বা বেপারির বউ বলুক কোনটাই সুখ বহন করে না। লোকটি যে বেপারি ছাব্বা গায়ে লাগিয়ে গাঁও—গেরামের সহজ সরল মানুষদের বিশ্বাস অর্জন করে ধাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সেটাই তার পুঞ্জি বা পুঁজি। এখন তার বাড়িতে থাকা বউয়ের একটাই নির্দেশ দ্বিতীয় বউ তথা জুলেখা বেগম যেন বাঘারপার গ্রামে পা না দেয়। জুলেখাও বুঝেছে লোকটার নানা কু—নাম,কু—অভ্যাস সব কিছু গায়ে মেখে চলতে হবে। এই ভোলাগঞ্জের টিলার চিপায় ধলাইনদীর বগলে আধবিঘার বাড়ির জয়—জিরাত খেয়েই তার চলতে হবে। এ বাড়িটি চানমিয়া তৈরি করেছেন ব্যবসা করতে গিয়ে। সঙ্গে আছেন আরও পাঁচÑছয় ঘর মানুষ। জুলেখার মাথায় ঘুরে এখানে যেন আর কেউ ভাগ না বসায়, এ সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে। এখন মানতে হবে এইটুকুই ভরসা কিংবা স্বস্তি।
আজমিরিগঞ্জের মায়া ছাড়ার আগে নিজ কল্পনা এবং চানমিয়ার নিকট থেকে শোনা গল্পে জুলেখার মনে একটি চিত্রময়তা তৈরি হয়েছিল ভোলাগঞ্জ জায়গাটি নিয়ে। জায়গাটি সে রকমই, চমৎকার। এক লাফ দিলেই ইন্ডিয়া অর্থাৎ নো—ম্যানস ল্যান্ড পাড়ি দিলেই অন্যদেশ। এক সময় এক দেশ ছিল এপার ওপার। জৈন্তাপাহাড়কে ছুরি দিয়ে কেটে যেন বাংলাদেশে এসেছে ধলাই নদী। এ নদীর পানি সত্যিই এক স্বর্গীয় কোমলতায় ভরা। ভোলাগঞ্জ ছাড়াও আছে সামান্য দূরেই বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি।
ভোলাগঞ্জের ‘গোলআলু’ এক সময় সিলেট অঞ্চলে ছিল বিখ্যাত খুব। এই গোলআলু সিদ্ধ বা পুড়ে ভর্তা খেতে খুব ভাল লাগত। পোড়া আলু বা সিদ্ধ আলু কিংবা তরকারিতে সব অবস্থায়ই দানাদার ছিল, স্বাদও আলাদা। এই আলুর জন্য বিখ্যাত ভোলাগঞ্জ মূল বাজারটি বর্তমানে ভারতের সীমানায়। পাশেই পাড়–য়া গ্রাম। পুরোনো বসতি। এই গ্রামেও রয়েছে একটি বনেদি বাজার। যাকে পাড়–য়াবাজার বলায় হয়। ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি সিলেটে তাদের শাসন কায়েম করলে বিখ্যাত এই ভোলাগঞ্জ এলাকায় চোখ পড়ে। আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলের বনজ সম্পদ, পাথরসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ লুটে নিতে এখানে গড়ে তুলে ‘কুঠি’। ‘কুুঠি’ মানে ব্যবসাকেন্দ্র। এই ব্যবসাকেন্দ্রের নাম হয়ে ওঠে কোম্পানিগঞ্জ। বর্তমানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোন অস্থিত্ব নেই, কিন্তু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গ্রামটি আছে। যার নাম কোম্পানিগঞ্জ। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করলে অতি অল্পদিনেই সমগ্র বাংলা এমনকি ভারত উপমহাদেশকে করায়ত্ব করতে সময় লাগেনি। স্কটিশ নাগরিক রবার্ট লিন্ডসে ১৭৬২ সালে ভারতে আগমণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করণিক হয়ে। ১৭৭৮ সালে সিলেটের কালেক্টরেট হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সিলেট আগমণ করেন লিন্ডসে। অতিঅল্প দিনেই সিলেট থেকে পাথর, চুনা পাথর, তথা খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, আফিম, পশুপাখি, হাতি, বাঘ ধরা ও বিক্রি, জাহাজ তৈরিসহ নানা ব্যবসা ফেঁেদ বসেন তিনি।
তখনকার সময়ে সিলেটে এত বাঘ ছিল, পৃথিবীর অন্য কোথাও সে সময় ছিল না, বলে আত্মজীবনীতে লিখেছেন লিন্ডসে। প্রাচ্যের বিভিন্ন বন্দরে মালামাল খালাস করে জাহাজও বিপুল অর্থে বিক্রি করে দিতেন। উপার্জিত অর্থে তার মাকে ৩১,০০০ পাউণ্ডে একটি স্টেট কিনে দেন স্কটল্যান্ডে। একই সময়ে তার এক সহোদরকে ব্রিটিশ এমপি নির্বাচনে ১৫শ পাউন্ড দিয়ে সাহায্য করেন।
১৭৮৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র ১২ বছর সিলেট ছিলেন এই দুর্দান্ত ব্যক্তি। তার সময়েই সংঘটিত হয় সৈয়দ হাদা মিয়া ও সৈয়দ মাদা মিয়ার সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধÑযা ছিল ব্রিটিশ ভারতে প্রথম ইংরেজ বিতাড়নের সশস্ত্র বিদ্রোহ। নৃশংসভাবে রবার্ট লিণ্ডসে এই স্বাধীনতা সংগ্রামী ভ্রাতৃদ্বয়কে হত্যা করে বিদ্রোহ দমণ করেন।
এই সময়ে, মূলত শোষণের কারণেই ছোটবড় অসংখ্য দুর্ভিক্ষ হয় বাংলায়, এমনকি সমগ্র ভারতেও ঘটে। টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলী খান ইংরেজদের নিকট বসকারের যুদ্ধে পরাজিত হলে তিনি উৎফুল্ল হন। সেখানে যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সিলেট অঞ্চলে দুর্ভিক্ষাবস্থা চলার সময়ও স্বজাতির সাহায্যে ৫ হাজার টন খাদ্রশস্য বা চাল নিজ জাহাজে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া কথিত আছে, আলুর পাশপাশি কোম্পানির লোকজন আফিম চাষ করাতো চাষীদের দিয়ে। পরবর্তীতে উত্তরবঙ্গে নীল চাষও ছিল এর একটি ধারাবাহিকতা। তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছেÑশুধু মাত্র এক চালানেই নাকি ৪০০ টন আফিম দক্ষিপূর্ব এশিয়ার চীনে বিক্রি করেন। এতে ৪০হাজার পাউণ্ড মুনাফা লাভ করেন লিন্ডসে।
হাল আমলের কোম্পানিগঞ্জ নামের উপজেলাটির ‘কোম্পানিগঞ্জ’—এর অতীত বৃত্তান্ত হল এই। ‘কোম্পানি’র আমল কোনভাবেই এ অঞ্চলের জন্য সুখকর ছিল না, তবুও কেউ বলতে পারে না ভোলাগঞ্জ বা পাড়–য়া নামটি ঐতিহ্যবাহী, বিখ্যাত হওয়ার পরও উপজেলাটির নাম কোম্পানিগঞ্জ কেন। কেউ কেউ বলেন, গ্রামটির প্রতিপত্তি আছে, এছাড়া ভোলাগঞ্জ তো সীমান্তের ওপারে, পাড়ুয়া সীমান্ত ঘেষা। কিন্তু কোম্পানিগঞ্জ সীমান্ত থেকে দূরে, তাই বেছে নেয়া হয়েছে কোম্পানিগঞ্জ নামটি। শুনতে মনে হয়, বুঝিবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন এখনও চলছে বা বিদ্যমান। চানমিয়া বেপারির মাথায় এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। উত্তর পায় না। চানমিয়া এও জানেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল অফিস পূর্ব লন্ডনের যে স্থানটিতে ছিল, তা ভেঙে গুড়িয়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে লয়েডস নামক ব্যাংকের একটি ভবন। ইংরেজরাই কলংকজনক এই প্রতিষ্ঠানের চিহ্ন রাখতে চায়নি, সে জায়গায় আমরা করছি এর তাবেদারি।
চানমিয়া আরো ভাবেন, ‘মেঘালয়’নামটি নিয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলংয়ে অবকাশ যাপনের সময় এ অঞ্চলটিকে ‘মেঘালয়’ নাম দিয়েছিলেন। পাহাড়ের চিপায় চিপায় সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়, দেখতে অপরুপ লাগে। কবি মুগ্ধ হন। অঞ্চলটির নাম দেন ‘মেঘালয়’। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এ্ই মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতেই। ১৭৫সে.মিটার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড আর কোথাও নেই। বছওে কমপক্ষে সাত—আট মাস এই বৃষ্টিপাতের ঢল—নামা ভাটি অঞ্চলটিই বাংলাদেশের সিলেট—সুনামগঞ্জ। বৃষ্টিপাতের ঢলের তোড়েই মেঘালয়ের বনজ ও খনিজ সম্পদ কোনটি ভেসে, আবার কোনটা গড়িয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। বর্তমানের ভোলাগঞ্জ ও জাফলংয়ে গড়ে ওঠা পাথর ব্যবসাটিও স্বর্ণখনির রূপ নিয়েছে এইভাবে।
কবি গুরুর অবকাশ যাপনের সময়টিতে শিলংয়ে বসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত কাব্যোপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ লিখেছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথের দেয়া নামকে যদি গুরুত্ব দিয়ে এই মাত্র সেদিন ২১ জানুয়ারি ১৭৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মেঘালয় রাজ্য’, তবে আমরা বাংলাদেশীরা কেন ১৯৮৬ সালে শোষণ ও শাসনের স্মৃতিকে ধরে রাখতে অঞ্চলটিকে কোম্পানিগঞ্জ নাম উৎকীর্ণ করলাম। ভাবতে গিয়ে এক পর্যায়ে মাথার চুল ধরে এক হেচকা টান দেন চানমিয়া। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা সুরুজ মিয়ার কথা মনে করে আশ্বস্ত হন। তিনি বলেছিলেন, নিজের জন্য কিছু করিও না, পারলে দেশের জন্য কিছু করো।’ তার কিছু করার যোগ্যতা নাই, তিনি অত বড় মানুষও নন, তাই এসব ভাবনার দরকারও নাইÑএই বুঝ নিয়ে জীবনের পথে ছুটে চলেন চানমিয়া।
পাড়–য়া ও টুকেরবাজার এবং কোম্পানিগঞ্জ বাজার থেকে ওপারের বাজারগুলোতে এপারের মানুষ সওদা নিয়ে যায়, আবার নিয়েও আসে সওদা। খুব একটা বাঁধ সাধে না দু’দেশের বর্ডারে পাহারায় থাকা ফোর্স। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ও নির্দিষ্ট পণ্যই কেনা সম্ভব। নির্দিষ্ট পণ্যের বাইরে রয়েছে ব্যবসা করার জন্য চোরাইপথে আনা খাসিয়া পান, নাসির বিড়ি, সাতকরাসহ আরও নানা পণ্য। বেআইনিভাবে আনা গবাদিপশুর ব্যবসাও চলে এ বর্ডারে। মানুষ বেআইনি ব্যবসা করার জন্য জান সপে দেয়া দেখে জুলেখা হিমশিম খায়। তার প্রার্থনা, আর যাই হোক, চানমিয়া যেন এসবে না জড়ায়।
লোকটির জন্য মায়া হয়। সে অনেকের কাছে দেবতার মত মান্যও। তারা লেবার। লেবার মহিলারা তাকে খুব পছন্দ করে। কেন পছন্দ করে তার তথ্য জোগাড়ের পর জুলেখা হতভম্ব। কেউ বলে সে ভাড়া স্বামী খাটে, এতে কিছু আয় হয়। জনপ্রতি ১০টাকা। এরকম ১শ মহিলার ভাড়া স্বামী সে। এই ১শ মহিলা এক জায়গায় নয়, এরা জাফলং, বিছনাকান্দি, ধলাই, সাদাপাথর এলাকা, ছাতকের চেলা এবং সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার জাদুকাটা নদীর বালু মহালে। সে অবাক হয় এটা কেন এবং কেমন করে সম্ভব। যা মাথায় ঢোকা অসম্ভব তা নিয়ে ভাবতে না চাইলেও রহস্যজনক একটি কারণ জুলেখাকে তাড়া করে। সে শুনেছে, চানমিয়ার এই ভাড়া খাটার বিষয়টি নিয়েই তার প্রথম বউয়ের সাথে লাগালাগি, বনিবনা নেই। বিবাদ এখান থেকেই। এক পর্যায়ে সে বা চানমিয়া নি:সঙ্গ হয়ে পড়ে। পরিবারের ঠাই মেলে না। গড়ে তোলে ধলাই নদীর পারে ছোট্ট একটি ডেরা, যেখানে আজকে রীতিমত একটি গ্রামের নমুনা ‘আটঘরী গাও’। কাকতালীয়ভাবে এসময় পাথর কোয়ারি দু’বছর কোর্টের রায়ে বন্ধ থাকলে ধানের ব্যবসায় নামে চানমিয়া। এই ধানব্যবসার সূত্র ধরেই তাদের পরিবারের সাথে সখ্য ও পরিচয় এবং জুলেখার সঙ্গে বিয়ে।
যতদিন চালু ছিল ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ততদিন চানমিয়ার স্বামীভাড়া ব্যবসাও ছিল। বন্ধ হলে ঐ ব্যবসাও লাটে ওঠে। চুরি—চামারি করে কিছু পাথর ব্যবসা চললেও তা পেট ভরার মত বড় কোন উপায় ছিল না।
জুলেখার প্রশ্ন ছিল কেন স্বামীভাড়া বা বিষয়টা কি! চানমিয়া হেসে উত্তর দেয়।Ñস্বামীভাড়ার কারণ হল, স্বামী নেই বা বিয়েই হয়নি কিংবা স্বামী সাথে আসেনি এরকম মহিলাদের কলোনীর মালিকরা ঘর ভাড়া দিতো না। প্রথমত স্বামীছাড়া মহিলারা নিরাপদ নয়, যৌন হেনস্তা হওয়ার আশংকা থাকে। এধরণের ঝামেলা মালিকরা এড়িয়ে থাকতে চায়, দ্বিতীয়ত মহিলারা যদি ভাড়া না দিয়ে চলে যায়, তারও একটা বিহিত ব্যবস্থা দরকার। অন্যদিকে মহিলারা একজন অভিভাবকের আশ্রয়ে থাকা নিরাপদ মনে করে। এইভাবেই এ ধরনের স্বামীভাড়া ব্যবসাটা পাথর কোয়ারি এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠেছে। এছাড়া নারী শ্রমিকের প্রাধান্যও অন্য একটি কারণ। একটি রুম একজন নারী ভাড়া নিল, সঙ্গে নিল আরও তিনজন। এ তিনজন মালিকের অজানাও হতে পারে আবার জানাও হতে পারে। এই তিনজনের একজন স্বামী দেখাতে পারলেই বস খালাস, নিরাপদ। এই নিরাপদ কাজটিই বা জিম্বাধারির কাজটিই করে চানমিয়া। বুঝলে খুব সাদাসিদে বিষয়, না বুঝলে জটিল, ধুম্রজালময়।
এই জটিল এবং ধুম্রজালময় ব্যবসাটি চালায় চানমিয়া।
আরেকটি ব্যবসা আছে। সে ব্যবসাটি কমপ্লিট অন্ধকার জগত। জুলেখাকে চানমিয়া চিনিয়ে দিয়েছে সব। চিনিয়ে দেয়ার কারণ যাতে কোন ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। ধলাই নদীর পারে যে বাড়িটি চানমিয়ার, তা থেকে প্রায় কয়েকশ গজ দূরে একটি গুচ্ছগ্রাম আছে। এটি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ যখন দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন গরীব মানুষদের বরাদ্ধ দিয়েছিলেন। দিনে দিনে এগুচ্ছগ্রামটি বেহাত হয়েছে। এখন ওখানে এক ঝাঁক নারী থাকে, এগুলোর পরোক্ষ মালিক ফজলু মেম্বারসহ এলাকার আরও কতিপয় উর্ধতন ব্যক্তি। এখানে পাথর বহনে নিযুক্ত ট্রাক ড্রাইভার, হেলপার ও উঠতি পাথর ব্যবসায়ীরা মৌজ করে, টাকা ঢালে নানা কিসিমের ছুঁতোয় রাত বা দিন কাটায়। জুয়া খেলাও একদম চলে না এমন নয়, আড়ালে আবডালে চলে।
জুলেখা আসমানে হাত তুলে দোয়া মাঙে অনেকটা নিজের অজান্তেই। যেন এসব পাপ কাজ থেকে যাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছে তাকে যেন আল্লাহ মুক্ত রাখেন।
জুলেখা স্বস্তি পায়, যে ফজলু মেম্বার তাকে তীর্যক দৃষ্টি ফেলে দেখেছিল, সেই লোকটি ততটা ভাল নয়, সেটা চানমিয়ার বলা প্রয়োজন হয়নি, সে নিজ থেকেই লোকটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেয়েছে। এখন ঘৃনা—ই জাগে, বুঝতে পেরে কিছুটা শান্তিও মেলে।

।। পাঁচ ।।

আমাকে ডাকাইত কইছে ফজলু মেম্বারÑসেই মাজেজাটা কওন দরকার। না অইলে তুমি জুলেখা বেগম আমাকে চিরদিন ভুল বুঝবা। তুমি বউ, তোমার মনে কেন থাকবে যার সঙ্গে ঘর—সংসার করছো সেই লোকটি ডাকাইত। কথাগুলো চানমিয়া বেপারি জুলেখা বেগমের শরীরে শরীর চেপে বললো। জুলেখা বেগম চোটপাট এমনিতেই কিছু বলে না, তার মতে বউ হয়ে গেলে ডাকাইতের বউ আর সাধু মানষের বউ, সব বউ এক, সব সোয়ামী এক। তফাৎটা সংসারে সুখ অইল কি না, সেইটা আসল। হেসে ওঠার ভঙি শরীরে ছড়িয়ে জুলেখা বলেÑকওন লাগত নায়, আমার বুঝ আছে। ডাকাইত অও, আর না অও, সোয়ামী।
Ñনা, আমার শান্তি নাই যেদিন ফজলু মেম্বার কইছে হেদিন থাকি।
হোন, সেই ডাকাইতের কিচ্ছা।
আমরা ছিলাম চার বন্ধু। বন্ধু কিভাবে অলাইম, সেইটাই আসল। আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ মিয়ার বড় সন্তান। এই এলাকার মানুষজন সমীহ করে, সম্মান করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে। আমিও ফুরফুরে ভাব। কাজ—কাম করি না। বাতাস শুকে শুকে বেড়াই। খাই—দাই ঘুমাই। জাফলং যাই, ছাতক যাই সুনামগঞ্জ, একবারে জাদুকাটা পর্যন্ত। মনে মনে ভাবি ব্যবসা করমু। অথচ ব্যবসা—ট্যাবসা বুঝি না। আমরা গেরামের মানুষ। ব্যবসা আমাদের পরিবারের কেউ করে না। ব্যবসার বুদ্ধি—সুদ্ধিও নেই। তাই, একটু ঘুরাঘুরি করি। এর আগে জমিজমা বিক্রি কওে কিছু পুঞ্জি যোগাড় করে পাথর ব্যবসায় নেমেছিলাম। কপাল ভালা নায়, কপালের ফেরে সব পুঞ্জি খোয়া গেছে।
বলছিলামÑএইভাবে জুটে গেল এক এক করে তিনজন।
জাফলং ঘুরতে গিয়ে পেলাম মামার দোকানে একটি লোক প্রায়ই বসে মজাছে লাল চা খায়, চা খেতে আসা অন্য লোকজনের সাথে চুটিয়ে গল্প করে। তার দাবী এই গুটি কয়েক ঝাঁপফেলা দোকানের ছোট্ট বাজারটি যে লোকটির নামে ‘মামার দোকান’ হয়েছে, সেই লোকটি তার দাদার দাদা হন। ছয়টি খুঁটির ওপর বাঁশের চটি দিয়ে বানানো বেঞ্চের মাঝে হাঁটু গেড়ে বসে প্রায়ই এ গল্প করে লোকটি। যেদিনই দেখা হয়, সেদিনই আমি গল্পের মাঝখানে পাই। গল্পের শুরু বা গোড়ায় পাই না। আমিও গল্প শুনি। গল্পের ধরণ একেক দিন একেক রকম। গল্প কম শুনিনি। আমার বাবা একজন গল্পবাজ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের গল্প তার কাছ থেকে বহু শুনেছি। দারির চেছির মাঝে দাঁড়িয়ে শোনা গল্প, বাবা বলছেন দারির মাঝে জলচকিতে বসে সময় বেসময় আর শুনছেন এক ঝাঁক যুবা,বৃদ্ধ পৌঢ়, যারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি বা বয়স হয়নি বা হলেও যায়নি ভয়ে বা ইচ্ছে করেই। আমার তো জন্মই হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পঁচাত্তরের নভেম্বরে আমার জন্ম।
বিশাল দেহের মানুষটির ছবিই দেখেছি। কারোর সাথে মেলাতে গিয়ে এরকম দেহের লোক খুঁজেই পাইনি আমি।
গল্পবলার এই লোকটি বললো, মামার দোকানের মামা নাকি বঙ্গবন্ধুর মত বিশাল দেহী, দেখতে কী এক ঝড়ের বেগে হাঁটালোক ছিল মামা, সংগ্রামী মানুষ। তিনি নাকি প্রথম টাঙ্গাইল থেকে আসা লোক, প্রথম জাফলংয়ে এসে বসতি স্থাপন করেন। তখন বাঘ নামতো সন্ধে হবার আগেই সমতলে। তিনি এসে এই প্রথম দেখেন, মাটি থেকে চার পাঁচ হাত উঁচুতে ঘর বা খাসিয়াদের পুঞ্জি। খাসিয়ারা ঘরকে পুঞ্জি বলে। কেন, সেটির সমাধানও পেলেন সহজেই। সেটি হল বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য এই পদ্ধতিতে ঘর তৈরি। মানতেই হয় বুদ্ধিটা। আরও একটি বিষয় হল, বর্ষাকাল বা বৃষ্টির সময় পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি উপায় উঁচুতে ঘর বানানো।
মামার দোকানে বেঞ্চিতে বসে গল্পবলার গাল্পিক লোকটির নাম ইজ্জত আলী। পূর্ব পুরুষ মৈমনসিংয়া। দু’ পুরুষ আগে বসতি। মামার দোকানের মামার সূত্র ধরেই আসা। তবে কেউ—ই মামার দোকানের মামার নাম জানে না। জৈন্তা এক সময়ের ‘সীয়াম’ রাজ্যের রাজধানি, পৌরাণিক নানা কাহিনির কেন্দ্রস্থল, খাসিয়া সম্প্রদায়ের আবাসভূমি। ১৮৩৫ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত জৈন্তা ছিল স্বাধীন রাজ্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিলেট করতলগত করলেও জৈন্তার দখল নিতে সময় লেগেছিল ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত। একইভাবে পাশ্ববর্তী মণিপুর রাজ্য ব্রিটিশরা যুদ্ধের মাধ্যমে দখলে নেয় ১৮৯১ সালে। পাহাড়ি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি খাসিয়া ও মণিপুরীরা প্রাণপণে লড়াই করে হারে।
সুপারি, কমলালেবু, তেজপাতা, আদা, এলাচ, আর পান এ অঞ্চলের জীবনযাপনের সাথে যুক্ত বনজ উৎপাদন। এ বনজ সম্পদকে বাজারজাত করতেই ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্রিটিশরা তৈরী করে শিলংÑডাউকি পাকা রাস্তা। এর আগে স্থানীয় বাজারগুলোই ছিল ব্যবসায়ীদের একমাত্র ভরসা। এই ব্যবসাটি প্রসারের লক্ষ্যে আসামের তৎকালিন রাজধানী শিলং পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করতে উদ্যোগী হন আসামের গভর্ণর মাইকেল কীনস। আসাম ডিস্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারের রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ১৯২৮ সালে শুরু হওয়া শিলংÑডাউকি ৭১ কিলোমিটারের এই রাস্তাটি নির্মাণ শেষে খুলে দেয়া হয় ১৯৩৩ সালে। ১৬ ফুট চওড়া রাস্তার জন্য খরচ হয়েছিল সেই সময়ের ২০ লক্ষ ২৮ হাজার ৪১১ টাকা। মোট ৪ বছর সময় লেগেছে। এতে ৬ হাজার শ্রমিক কাজ করেছে। এছাড়া ১২ ফুট চওড়া ৩৩ ফুট লম্বা ডাউকি সাসপেন্সশন ব্রীজÑযা ‘ঝুলন্ত ব্রীজ’ নামে খ্যাত, সেই ব্রীজ নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১লক্ষ ৮৪ হাজার ৮৯৩ টাকা। এর আগেই তৈরী করা হয় ‘সিলেটÑডাইকি’ ৫৫ কিলোমিটার সড়ক।
জাফলংয়ে তখনকার উল্লেখযোগ্য ব্যবসা ছিল পান চাষ। গাছে গাছে পানের লত তুলে দেয়া হতো। সে থেকে পান তুলে বাজারে বাজারে বিক্রি। পাইকাররাও পানের ‘বরজ’ থেকে এসে পান পাইকারি দামে কিনে নিতো, আজও নেয়। পানচাষের বনাঞ্চলকে ‘বরজ’ই বলে। ইজ্জত আলী প্রথম শোনা মামার ব্যবসা পান পাইকারির দামে বিক্রিকেই উল্লেখযোগ্য ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে। দিনে দিনে মিশে গেছে খাসিয়াদের সাথে। খাসিয়াদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষরা ঘরকন্নার কাজ করে, মেয়েরা বাজারে ব্যবসা করা তথা সওদাপাতি কেনাবেচা, চাষবাস সকল কাজের কাজী। এছাড়া মেয়ে—পুরুষরা কাপড় বুনে, নিজের বোনা কাপড় পরে, বিক্রিও করে। সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের সকল লেনদেন এক ভিন্ন জগত। ইজ্জত আলী এদের স্বয়ম্বর সমাজে থিতু হন এক সুন্দরী খাসিয়া কন্যাকে বিয়ে করে। ছোটবেলা শুনেছেনÑ‘অ্যাক গাছে পানসুপারি/অ্যকই গাছে চুন/ কিবা দ্যাশে আইলামরে ভাই/ কি বা দ্যাশের গুণ।’ কথার মর্ম বুঝলেন এখন, বিয়ের পরÑযে পানের পাতায় কাকের ‘অ্যা’কে চুন বলা হচ্ছে।
জাফলংয়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যকে মনের মাধুরী মিশিয়ে দেখার আগ্রহ মাখা তরুণ—তরুণীদের ভীড় বাড়ত শীতকালে তখন। এছাড়া সে সময় কলেজের ছাত্র—ছাত্রী এবং বড় বড় অফিসাররাও আসতেন সপরিবারে।
দু’একটি ট্রাক শীতকালে এসে নিয়ে যেত ডাউকির তল থেকে জমে ওঠা বালু। চালনি দিয়ে চেলে নিতো নুড়ি পাথরও কেউ কেউ। পাথর ব্যবসা বলতে এর চে বেশি কিছু ছিল না জাফলংয়ে।
ইজ্জত আলীর সঙ্গে গেলাম তার টঙ ঘরে। সেখানে আমাদের দু’জনের গল্পের আসর বসে মাঝে মাঝে। আসরটা বসে আমার আগ্রহে—ই। জর্দা দিয়ে পান—সুপারি দলা মেখে চুনসেমত চিবুতে চিবুতে ইজ্জত আলী বললেন, ভাই বলবো কী। ক’বছর গেল। তা মনে নেই। তবে স্বাধীনতার কুড়ি বছর পর নাকি, সেই নব্বই সাল হবে। শুরু হল ক্রাসিং মেশিন বসা। মেশিন দ্বারা বড় বড় পাথর ভাঙার শেষ নেই, চললো রাত দিন। খুঁতি ভরে টাকাওয়ালা এলো। টাকার ঝনঝনানি। কত শত লোকজনের চক্কর আর কি। পাথরের চালান ঢাকা, নারায়নগঞ্জে,চাদপুর আর কত কত জায়গায়।
ইজ্জত আলী পেয়ে গেলেন টাকার খনির সন্ধান। প্রশ্ন করলামÑ কিভাবে! কানে কানে বললেন, এই যে আমাদের সিলেট শহরে বসিন্দা ডাক্তাররা আছে না, তারা। তাগো, কত টাকা কে জানে।
এই টাকার খনির সন্ধান পেলাম, অসুখ অইয়া একবার ডাক্তারের হাওলায় ছিলাম সাতদিন, তখন।
শুনলাম, ১৯৭২ সালে ‘আইপি’ ব্যবসা নামক এক ধরণের ব্যবসা শুরু হয় বিলাতি টাকার। সেটা নাকি কাগজ কিনতে হতো ব্যাংকে গিয়ে। একাউন্টে জমা হতো পাউণ্ড। ‘আইপি’ মানে ইম্পুট অব পাউন্ড। পাউন্ডের আমদানি। কী জটিল এক ধরনের টাকার ব্যবসা। বাচ্চু নামের এক ব্যক্তি শুরু করেন ব্যবসাটি। দেখতে দেখতে শ’খানেক তরুণ ব্যবসায়ী নামেন এই পথে। সিলেটের হাজার হাজার লোক বিলাত থাকেন, তাদের আর্জিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই সহজ পদ্ধতিতে বিদেশ থেকে টাকার আনার পথ খুলে দেন। এতে ইনভেস্ট শুরু করলেন সিলেটের ডাক্তাররা, তাদের পড়ে থাকা জমা অলস টাকায় ব্যবসা তখন তরুণদের। লক্ষ—কোটি। শোনা কথা, এতে জমজমাট হয়ে ওঠে নতুন ব্যবসাটি।
ধুমছে চললো ব্যবসাটি। একদিন হঠাৎ করে দেখা গেল চেহারা চিকচিক করা তরুণদের মধ্যে বেশিরভাগ লা—পাত্তা। কেউ গেছে পাকিস্তান, কেউ গেছে হিন্দুস্থান, কেউবা দুবাই। ডাক্তারদের মাথায় হাত।
এই চ্যাকা খাওয়া ডাক্তাররা আবার শুরু করলেন পাথর ব্যবসায় টাকা ঢালা, অর্থাৎ টাকা খাটানো। ইজ্জত আলী এই রকম দাঁতের ডাক্তার একজনকে রাজি করিয়ে বেশ টাকা নিয়ে আসে পাথর ব্যবসায়। সেই থেকে চলছে ব্যবসা। শরিক হলাম আমিও। বললাম, দোস্ত আমিও আছি তোমার সঙ্গে। সাইট মেইনটেইন্যান্স আর কিছু টাকা খাটানো মিলে ব্যবসা মন্দ নয়, বলতে গেলে জমজমাট।
জাফলং ঘেষা ডাউকি নদী। জৈন্তা পাহাড়কে দু’ভাগ করেই নেমেছে বাংলাদেশে। বর্ষায় বৃষ্টি হলে হু—হু করে নামে পাহাড়ি ঢল। এই ঢলের পানির সঙ্গে বালু আর পাথর সোনার মত চলে আসে বাংলাদেশ। ডাউকি বাংলাদেশে নামার পর কিছু দূর গিয়ে নাম হয় গোয়াইন নদী, পরে যোগ হয় পিয়াইন নদী। দুটির মিলিত ¯্রােতের একটি অংশের নাম হয়ে যায় চেঙ্গের খাল। জৈন্তার দক্ষিণ পাশ থেকে নেমে আসা আরেকটি ¯্রােত নাম সারি নদী, এই মিলিত ¯্রােত চেঙ্গের খালের বৈশিষ্ট হল স্বচ্ছ পানি। নীল পানি। নদীটি সুরমায় পড়েছে ছাতকের কালারুকা গ্রামের কাছে উত্তরমুখী সুরমার মোড়ে।

।। ছয় ।।

কিছু দিন পর ব্যবসা এক্সপান্ড করার কথা উঠলো। দু’জনেই একমত হলাম। ছাতকের চেলা নদীর ¯্রােত বাহিত বালু, পাথর ব্যবসা। বোল্ডারও সংগ্রহ হয় চেলা নামক স্থানের নিকটে বাঁশতলায়।
এই বাঁশতলা ঐতিহাসিক স্থান। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পটির ব্যবস্থাপনায় ছিলেন এমএন এমএ আবদুল হক, হেমচন্দ্র পুরকায়স্থ, ডা. হারিছ আলীসহ ইদ্রিছ আলী ও আবদুল মজিদ প্রমুখরা।
চেলা নদী চ্যাপ্টা নদী। ডালপালা মেলে বন—বাদাড় ধুমড়ে—মুষড়ে নদীর পাহাড়ি ঢল নামে। সকাল হলেই হাজার হাজার বারকি নৌকা ছুটে পাথর বোঝাই করে। খালি নৌকাগুলো ¯্রােত উজিয়ে যায় বাম পাশে, আর পাথর বোঝাই নৌকাগুলো ভাটির পথে দাঁড় বেয়ে ছুটে। দেখতে ডুবু ডুবু লাগে। কোন সময় যে ডুবে যাবে এই রকম ভয় থাকে। তবে যারা নৌকা বায়, তারা এটা মনে করে না। তামেশকির বা দর্শকরা এই ব্যবসার সাথে যুক্ত নয়, এমন লোকেরা শংকিত থাকেন। একেবারে যে এসব পাথর বা বালু বোঝাই বারকি নৌকা ডুবে না, তা কিন্তু সত্য নয়, বছরে পাঁচ—দশটা নৌকা ডুবে। গরীব বারকিওয়ালাদের গোয়ার কোলে বাঁধা বউয়ের রেঁধে দেয়া ভাত, তরকারির ঝোল, আলুভর্তা,ভাজা মাছ ইত্যাদিসহ থালা—বাসন ভেসে যায়। তারপর নৌকা পানির নীচ থেকে তুলতে চারপাঁচ দিন ব্যবসা বন্ধ থাকে। ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে টাকা ধার বা সুদে নেয়। খোরাকি চালাতে গিয়ে ঋণ বাড়ে শ্রমিকদের। ডুবে যাওয়া নৌকা তুলতে বেশি বেগ পেতে হয় না, কারণ চেলা নদী বেশি গভীর নয়। ছাতকের উত্তরের বন—খাগড়ার বনকে পাড়ি দেয় পাহাড়ি পানি অনেকটা ছিতরিয়ে ডালপালা মেলে ভরাং বা ঢালার মত। বারকি নৌকাগুলো চিকন লম্বা। উজান বাইতে ¯্রােতের টানে বেগ পেতে হয় না। তাতানো রোদকে ফেরানোর জন্য নরসিংদির বাবুরবাজারি গামছা মাঝিদের মাথায়, কোমরেও আরেকখান গা মোছার জন্য। কারো বা গেঞ্জি গায়, কারো নেই, দড়ির মত ভাঁজপড়া চিকচিক শরীর। কেউ বৈঠা বায়, কেউ দাঁড় বায় আবার কেউ লগি ঠেলে। মাঝে মাঝে পানি সেচতে হয়। পানি সেচার জায়গাটি নৌকায় বালু বা পাথরের মাঝখানে ফাঁক করা প্রায় দুই ফুটের মত জায়গা। টিনের হেওত দিয়ে পানি ছুঁড়ে মারা এবং পানির শব্দ, আসলেই এক ছন্দের জন্ম দেয়। আর এই পানি সেচার কাজটি করে পরিবারের ছোট সন্তানÑছেলে বা মেয়ে। বারকি বাওয়া মোটের ওপর এটি একটি পারিবারিক পেশা বা ব্যবসা। গতরখাটা। বর্ষায়—ই চলে একমাত্র এই বারকি খাটা। পাহাড়ি ঢল—ই বারকি চালনার উপযোগী। ছাতক বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর উত্তরপারের খাস জমি বা ব্যক্তি মালিকানা জমিগুলোই ভরে ওঠে বালু ও পাথর স্টেকে। ব্যবসায়ীরা বারকিওয়ালাদের নিকট থেকে কিনে রাখে স্তুপ করে করে। আবার কেউ কেউ সারা বৎসরই বিক্রি করে চলে। জমিয়ে রাখা পাথর ও বালু শীতকালে বিক্রি শুরু হয়। কালেকশান বন্ধ থাকায় বেশ দাম উঠে তখন।
জুলেখা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাচ্ছিল। ঠেলে জাগিয়ে দেয় চানমিয়া। বলে শোন, মজার কথা।
Ñআমি এর আগে অনেকবার ঘুরে গেছি এ অঞ্চলটি। আমার পার্টনার দোস্ত ইজ্জত আলীকে বললাম, দ্যাখো, ছাতক এবং সুনামগঞ্জ পাথর ও বালু ব্যবসার জন্য উপযুক্ত জায়গা। ছাতকে সুরমা নদী বেশ গভীর। যার জন্য ‘আন্দাবোট’ ভিড়ে। ‘আন্দাবোট’ মানে মাল বা বালু ও পাথর পরিবহনের বড় জাহাজ। সুনামগঞ্জেও এই সুযোগটা আছে। যে সুযোগটা ভোলাগঞ্জ এলাকা বা জাফলংয়ে নেই।
দোস্ত ইজ্জত আলী কথা মত রাজি হলেন। তবে পরামর্শ দিলেন, ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য ছাতক ও সুনামগঞ্জে পার্টনার দরকার।
আমরা দু’জনের পক্ষে এত বড় ও বিস্তৃত জাফলং থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত মহালগুলোয় ব্যবসা চালনা করা সম্ভব হবে না। ভাল পার্টনার পেলে ব্যবসা চালাতে আপত্তি নেই।
অল্পদিনেই আমরা আরও দু’জন ব্যবসায়িক বন্ধু পেলাম। জানি দোস্ত হলাম চারজন। চার দোস্ত মিলে শুরু হল ব্যবসা। নতুন দোস্তদের মধ্যে ছাতকের দোস্তের বাড়ি ছাতকেই। বাপেরখালি ব্যবসা তার। বাপ ছিলেন জগন্নাথপুরের রসুলগঞ্জের, বড় গেরস্তের সন্তান। ছিল বড় বাড়িও। প্রথম প্রথম ব্যবসায় লস দিয়েছেন। পরে বুঝলেন তাকে সুবিধে করতে দিচ্ছেন না এলাকারই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। কানে কানে কেউ কেউ চালু একটি কানকথা শোনাল। যেটি এতদিন আমল দেননি। কানকথাটি হলÑছাতকে পাথর ব্যবসায় টিকতে গেলে সাদী করা চাই বড় কোন ব্যবসায়ীর মেয়ে। তলিয়ে দেখা গেল কথাটির গুঢ়ার্থটা ফেলে দেয়ার মত নয়। একটি বড় সেইফ গার্ড যাকে বলে, সেটি তুচ্ছ ভেবে, ফেলে দেয়ার বিষয় নয়। যেই ভাবা সেই কাজ। জুটে গেল কন্যা। যিনি আমাদের ছাতকের জানি দোস্ত আকবর আলী, তার মা, নাম খোদেজা খাতুন,বউ হয়ে এলেন আকবর আলীর বাবা হুরমত আলীর ঘরে। তারপর, চললো পাথর ব্যবসা। কোথায় যেন একটি সযতœ সুযোগ এসে ধরা দিল আকবর আলীর বাবা হুরমত আলীর ব্যবসায়।
এরপর আর কোন লস দেননি হুরমত আলী ব্যবসায়। হুরমত আলীর চালু ব্যবসা বর্তমানে চালাচ্ছেন হুরমত আলীর পুত্র আকবর আলী।
‘কামরূপ কামআইখ্যা’র গল্পের মত বিষয়টি মনে হলেও সত্য ঘটনা বলেই জানে মানুষজন।
দেখতে দেখতে ঢাকার কাঁচপুর ব্রীজের তলে গড়ে ওঠা ক্রাসিং মেশিনগুলোর এক চেটিয়া সাপ্লাইয়ার হলেন আকবর আলী, তবে পুঞ্জি—সটের কারণে থেমে যেতে হয় মাঝে মাঝে। যখন পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব পেলেন ইজ্জত আলী ও চানমিয়া বেপারির নিকট থেকে, তখন মোটামুটি চাঙা হয়ে উঠলেন আকবর আলী।
সঙ্গে নিলেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার আলী আহমদকে। তরুণ মানুষ। সবেমাত্র মদনমোহন কলেজ থেকে বিকম পাশ। ব্যবসায় আসে ওয়ার্কি পার্টনার হয়ে। এটা নতুন পদ্ধতি বলতে হবে। আলী আহমদ পিতা ইসকন্দর আলী মাস্টারের একমাত্র পুত্র। প্রাইমারি স্কুলের টিচার তিনি। পুত্র ও এক কন্যার জনক। তিনি পুত্রকন্যাকে পড়তে দিলেন সিলেট শহরে। ভর্তি হল তারা মদনমোহন কলেজে। থাকার ব্যবস্থা হল একটি মেসে। বাবা ইসকন্দর আলী পড়েছেন ‘পেয়িং গেস্ট’ থেকে। সে এক মজার চল ছিল। টাকা দিবেন মাসিক হারে ২ বা ৩শ। নির্বিঘেœ খাওয়া—দাওয়া থাকা। এখন জমানা বদলে গেছে। পেয়িং গেস্ট প্রথা উঠে গেছে। হয়েছে মেস প্রথা। এটাও খারাপ নয়। আলী আহমদ ও তার বোন করফুন নেসা মেস করেই থাকে। তবে প্রাইামারি স্কুলের টিচার পিতা মেসের খরচাপাতি কুলোবার তওফিক বলতে গেলে নেই। সাহসটা অন্য জায়গায়। ভাইবোন দু‘জনই ঠিক করে নেয় টিউশানি করবে। তাই—ই হল। সবচে মজার ব্যাপার হল, সিলেট শহরে বেশ কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে। নিয়মিত বিয়ে—সাদীর অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। একদিন এক বন্ধুর মারফত একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুযোগটা হল, কেউ চিনবে নাÑকনে না বর পক্ষের, যে কোন হলে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে ধুমছে খাওয়া। গোপনে অনেকেই এটা করে থাকে বা করছে। তারা দু’ভাইবোন এ পদ্ধতিতে পেটপুরে খাওয়া শুরু করে। এবং প্রায় দু’বছর এই অদ্ভুত ‘ফাও খাওয়া’ কর্মটি করেই জীবন অতিবাহিত করেছে।
আলী আহমদ নির্বিবাদে বিকম পাশ করেই চাকরি পেয়ে যায় এলাকার নিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর মিয়ার ‘টাঙুয়ার হাওরের রামসা’র প্রকল্পে। বেতন কম নয়। খেয়ে—ধেয়ে বেঁচে বর্তে চলবে পিতা—মাতা আর বোনকে নিয়ে। নব্বই দশকের নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের শুরুতেই এই প্রকল্পটার যাত্রা শুরু।
সেই ‘টাঙুয়ার রামসা’র প্রকল্পের ভেতরে গোপনে চলে আরেকটি ব্যবসাÑসেটি হল পাহাড় থেকে নেমে আসা জাদুকাটা নদীর বালু তোলা ব্যবসাটি। বলতে গেলে জমজমাট কাণ্ডকারখানা বা ব্যবসা।
চেয়ারম্যান আলমগীরের নিকট তারই এক সহপাঠীর বাবার লাখখানেক টাকা পাওনা ছিল। চেয়ারম্যান হওয়ার আগে লোকটি ‘ভূমিহীন’দের নিয়ে জলমহাল নিয়ে আন্দোলন করতো ‘ভাসানপানি’র। লোকটির নিকট থেকে গল্প শোনা আলী আহমদের। আলী আহমদ বলেছে সেই গল্পটি। গল্পটা এমনÑ‘বাবারা জানো, মাসকা—মাস গেছে দু’টাকার একটি নোটও চোখে দেখিনি আমি। তখন দু’টাকার নোট—ই ছিল সবচে ছোট। আর আন্দোলন করতে গিয়ে লোকের খড়ের ফেইনে ঘুমাতে হত। ভাটি অঞ্চলে কোথাও রাতে ঘুমানের জায়গা—ই পাওয়া যেত না, বলতে হয়, দুস্কর—ই বটে। গরীব মানুষদের নিয়ে আন্দোলন, তাদের কয়জনের—বা ভাল ঘর ছিল, বাড়তি লোকদের থাকার জায়গা দেবে। এই অবস্থায় স্বচ্ছল পরিবারের খড়ের ফেইনই একমাত্র স্বম্বল ছিল। এখন সেদিন নেই। ইলেকশান এল। হল ‘রামসা’র। এই রামসা এনে দিল টাকার বান্ডিল। তোমাকে বেতন দিতে পারছি বিশ—পঁিচশ হাজার টাকা। কেউ এত টাকা চোখেও দেখেনি, স্বপ্ন স্বপ্ন। কী বাবাজান ঠিক কিনা?’
সেই চেয়ারম্যান আলমগীর আমাদের আলী আহমদের বন্ধুর বাবাকে বললো, কীসের পাওনা টাকা, ওসব বাদ দেন, আসেন রামসা’য়। কাড়ি কাড়ি টাকা। কত নেবে?।
আলী আহমদের বন্ধুর বাবা ভয় পেয়ে যান। যাননি তিনি। কিন্তু আলী আহমদ গল্পটি শুনে থতমত খেয়ে যায়। কী যেন জাদুর কথা এসব। জাদু—ই। টাকা তো টাকা—ই। বনে কোথায়? যেন মেশিন।
কিছু দিন যেতে না যেতে সেও শিখে ফেলেছেÑটাকা আসার দোর। মানে, পেয়ে গেছে টাকা আসার দরজা।
এই গল্প শুনে আকবর আলী, ইজ্জত আলী, চানমিয়া বেপারি ঘেমে ওঠে। জড়িয়ে ধরে আলী আহমদকে। জানি দোস্ত হয়ে ওঠেন অল্পদিনে।
যে আলী আহমদ বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘ফাও খাওয়া’ ব্যক্তি ছিল, সেই আলী আহমদ এখন টাকার কুমির। সুদের ব্যবসা জুড়ে বসেছে। খবর নিয়ে জানা গেল, সুনামগঞ্জে লোকজন ব্যাংকে টাকা—পয়সা খুব একটা রাখেন না। ব্যাংকের শাখা—টাখাও তেমন নেই। আছে ক’টা সরকারি ব্যাংক। সোনালি, রূপালি, অগ্রনী, উত্তরা এবং কৃষি ব্যাংক। সরকারের বিভিন্ন লেনদেন করার মধ্যেই ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম মূলত সীমাবদ্ধ।
ততদিনে বেসরকারি কোন ব্যাংক শাখা খোলেনি। বিষয়টি সোজা। লোকজন ব্যাংকে টাকা—কড়ি কম রাখে। ব্যাংকের সুদের হার কম। পাবলিক যারা সুদের বা দাদন ব্যবসা করে বা লগ্নিতে টাকা খাটায় তাতে লাভ বেশি। সুদের হার যে যে রকম পারে, সে রকমই চলে। তাই সুদ ব্যবসা সুনামগঞ্জে জমজমাট। আলী আহমদ এই জমজমাট ব্যবসায় নাম—ডাক ওয়ালা মানুষ। এছাড়া লোকাটির আছে জাদুকাটা নদীর বালুমহালের ব্যবসা। সেখানে রাজনৈতিক নেতারাও তাকে সমীহ করে চলেন। এত দিনে তার হাতে আছে অনেক ছেলেপিলে। ভোটের বাক্স ছিনিয়ে নেয়া থেকে জাল ভোট এমন কি হাল আমলে রাতে ভোট দেয়ার সাহসী অনেক যুবক।
এক সময় লোকজন নদীর তল থেকে বালু তুলে বারকি নৌকা ভরেই বিক্রি করতো কন্ট্রাক্টর বা ক্রেতাদের কাছে। আলমগীর চেয়ারম্যানই প্রথম বালু মহাল লীজ নেন। লীজ নেয়া চালু করেছেন এমপি সাব। এমপি সাব নন, মূলত জেলা প্রশাসক ডাক প্রথা চালু করেছেন। এখন এই ভাবেই চালু আছে বালুর ব্যবসা। শোনা যায়, এই বালু মহাল কেন, অন্য ব্যবসার জন্যও একটা সিন্ডিকেইট তৈরি হয়েছে। সিন্ডিকেইট কি বা কি রকম তা আলমগীর চেয়ারম্যান দেখেননি, শুনেছেন। তারা রাজনৈতিক নেতা। নেতারা কন্ট্রোল করেন।
আলী আহমদ এখন গদগদে গোদাওয়ালা ব্যক্তি। কত ব্যবসা কন্ট্রোল করেন তিনি, সুনামগঞ্জের পুরোনো ব্যবসায়ীরা জানেনও না। গত বছর থেকে খেয়াঘাট, লঞ্চঘাট এমনকি পুরোনা বাসস্ট্যাণ্ডে যে ঢাকাইয়া বাস থামত, সেখানেও সিন্ডিকেইট ব্যবসা শুরু হয়েছে। সবেমাত্র কৈশোর উত্তীর্ণ যুবকরা এসব চালায়। অনেকে বলে সঙ্গে অথবা তলে তলে আছেন নাকি এমপি, পৌরসভার চেয়ারম্যানও।
চানমিয়া, ইজ্জত আলী, আকবর আলী এবং আলী আহমদ মিলে চার দোস্ত পাথর, বালুসহ আরও নানা ব্যবসার জন্য যে জোট তৈরি করলেন, এক দিন তারাও বুক মেলাতে গিয়ে রস—ছলে বলে উঠলেন একে অন্যকেÑএটাও একটা ‘সিন্ডিকেউট’। হা—হা করে হেসে তারিফ করলেন নিজ নিজ এবং বুকে থাপ্পড় মেরে উচ্চারণ করলেন ‘কে বলে বোকা আমরা

।। সাত ।।

তল্লাটে প্রচার আছেÑবোকা নয়, বুদ্ধিমান সিন্ডিকেইটÑআমাদের চারদলীয় জোট তথা ‘ফোরপ্লাস এজেন্সি’। লোকে কৌতুক করেই বলে ‘চারদলীয় জোট’। ঢাকা, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জসহ দেশের সর্বত্র যেখানে যেখানে পাথরের চাহিদা সেখানেই ব্যবসার জাল পাতলাম। বড় বড় ক্রেতা এখন কম নয়, হাতের মুঠোয়। ছাতক ও সুনামগঞ্জে আসা ‘আন্দাবোট’ তথা কার্গো জাহাজগুলো মাল পরিবহনের জন্য রীতিমত ধর্না দেয়। নাহার, খান, আলমগীর, জাহাঙ্গীর ও জুমা খান কোং আরও কত নামে নেভিগেশন কোম্পানি আসে আর মাল বোঝাই করে নিয়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে। আলী আহমদ কন্ট্রোল করেন সুনামগঞ্জ, আকবর আলী ছাতক, ইজ্জত আলী জাফলং এবং আমি চানমিয়া ভোলাগঞ্জ।
এর মধ্যে আমি চানমিয়া—ই একমাত্র কম শিক্ষিত। কিন্তু বুদ্ধি—বাদ্ধার দিক থেকে কম নয়। এটাই সকলে স্বীকার করে, আদর করেই দু’কথা শোনায় কেউ কেউ। মাঝে মাঝে বুব্ধি—বাদ্ধা—পরামর্শের জন্যও লোকজন ভেড়ে।
দু’তিন বছরে আকাশচুম্বি যে ব্যবসা গজিয়ে ওঠেছিল, একদিন সহসা তা কিন্তু ধফাস করেই মাটিতে মিশে যায়। কেন মিশে যায়, কোন ভুলে সেটা ঘটে, তা কি জানা ছিল?
একজন লোক একদিন হাজির হল জাফলংয়ের অফিসে। ইজ্জত আলী ছিলেন সেখানের দায়িত্বে। বর্ণনা শুনে আমরাও খুব প্লিজড। লোকটির সাথে কথা বলতে গেলে সময়—ই পাওয়া যায় না ভিআইপিদের ফোনের জ্বালায়। কী বলবো। আর খাঁটি দুবাই’র সুগন্ধির ভুরভুরে ঝাঁঝালো তেজ। এই মাত্র সুগন্ধি—মাখা, লোকটি যেন এলো দুবাই থেকে। আড়ংয়ের শাদা ধবধবে পাঞ্জাবি, পিঠে ঘি—রঙা চাদর ঝুলানো। চড়চড়ে ইস্ত্রি—করা পাজামা। উচ্চতায়, চেহারায় গড়পরতা বাঙালিকে হার মানানো ব্যক্তিটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, এমন কথা বলতে সাহস হবে না কোন পুতের। ইজ্জত আলীর ফোন পেয়ে আমি গেলাম, পাশেই ছিলাম। লোকটি বসে আছে তার ল্যাণ্ডক্রোজার গাড়িতে এসি ছেড়েÑহাতে রুমাল। গরমের দিন, ঘাম মুছতে মুছতে লোকটি আমাকে হাত তুলে সালাম দিল। কী যে আদবের লোক। মাসাল্লাহ।
বিষয়, লোকটির দু’টি হাসপাতাল নির্মাণ হবে। একটি নারায়নগঞ্জ আর অন্যটি ঢাকায়। তার কাটা—পাথর লাগবে কয়েক লাখ ফুট। দু’লাখ টাকা অগ্রিম, মাল ডেলিভারীর পর বাকী পয়সা সমান জাগাত পেমেন্ট। লোকটির নাম শাহেদ আহমদ।
আলোচনা হল অন্য পার্টনারদের সাথেও।
গত ক’বছরে জাফলং, ভোলাগঞ্জ এবং ছাতকে বসেছে অসংখ্য ক্রাসার মেশিন। যেগুলো এলাকায় পাথর ভাঙার কল বা মেশিন বলেই পরিচিত।
আগে বিদ্যুৎ ছিল না জাফলং বা ভোলাগঞ্জের এক্কেবারে নদীর পার পর্যন্ত। খাম্বা বাণিজ্যের চিপায় পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ থেমে গিয়েছিল, নতুন সরকার এসে সেগুলো দ্রম্নত ব্যবস্থা করে দেয়। এখন জাফলং বা ভোলাগঞ্জ বিদ্যুতে ফকফকা, আলোময়। আর দিনরাত পাথর কালেকশান, সেই সঙ্গে ক্রাসিং তো চলছেই, থেমে নেই, তদুপরি স্টেকের পর স্টেক। সহ¯্রাধিক লেবার বা শ্রমিকের গায়ে—গায়ে লাগা অবস্থা। ব্যবসায়ীদের আনাগোনা, সাপ্লাইয়ার ও দালালদের পদভারে গম—গম সর্বত্র।
টাকার ঝনঝন শব্দে জাফলং আর ভোলাগঞ্জ শন শন রৈ—রৈ করছে। কোথায় থেকে যে এত টাকা আসে, কেউ বলতে পারে না। এক সময় ছাতককে পাথরের একমাত্র ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হত। কিন্তু তারও একটি ছন্দ, মাত্রা ছিল। মূলত, এখন যে গতি পেয়েছে এই অঞ্চল ছাতককে হার মানাচ্ছে। বালু—পাথরের ব্যবসাটি এমনইÑমনে হচ্ছে, ইমারতের পর ইমারতে ছেয়ে যাবে বাংলাদেশ, সেদিন বেশি দূরে নয়।
আমাদের পাথর সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটিও রমরমা তখন। ডাক্তারদের নিকট থেকে পুঁজি পাওয়া কোন সমস্যা নয়। ‘ফোরপ্লাস এজেন্সি’ নামে গড়ে ওঠা আমাদের ব্যবসার পুরো তহবিলটা ডাক্তারদের প্রদত্ত টাকার। বড় তহবিল। সেই কারণে আমাদের অবস্থান অন্য পাথর সাপ্লাইয়ার নিকট বেশ সমীহের। সুনামগঞ্জেও কম নয়, যথেষ্ট হিসেবের মধ্যে আমাদের ‘ফোরপ্লাস এজেন্সি’। সুনামগঞ্জে হাত বাড়ালেই কত টাকা চাইÑপাওয়া যায়। সেখান থেকে বালু সাপ্লাইয়ের কনট্রাক্টগুলো চলে। সুনামগঞ্জের ‘ফুলতলা’র বালু দেশসেরা। পরীক্ষায় বুয়েটের নির্ধারিত সর্বোচ্চ মানের। সুতরাং সেখানে আমাদের ব্যবসার অবস্থা কোন অংশে কম লাভজনক নয়।
কিন্তু আমরা যখন পাথর সাপ্লাইয়ের বড় কন্ট্রাক্টটি পেলাম তখন সকলের চোখ পড়ে। ঢাকাস্থ সাইট পরিদর্শন করে আরও আপ্লুত হলাম। যেখানে শাহেদ আহমদের অফিস, সে অফিস তো মহা ধুমধামের। নামজাদা নামজাদা মানুষের ভীড় লেগেই থাকে। চেম্বারের ওয়ালে ফটো গ্যালারি। ফটো গ্যালারিতে রয়েছে এমপি,মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও ছবি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাশাপাশি মন্ত্রী বসা, প্রধানমন্ত্রীর নিকটস্থ দাঁড়ানো, প্রেসিডেন্ট করমর্দন করছেন। তাক লাগানো, চোখ ধা—ধানো হুলস্থুল বিষয়। আমাদের পার্টনাররা সবাই একমতÑ এই লোকের সাথে ব্যবসা হবে না তো কার সাথে হবে। বোধ হয় দিন ফিরছে, রাতারাতি একটা কিছু ঘটুক না, কিন্তু সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটা যোগাযোগ তৈরির ব্যবস্থা হবে। আমরা চাইছিলাম ‘পদ্মাসেতু’ বা ঢাকা এলিভেটর এবং মেট্্েরা রেলে পাথর সাপ্লাইর একটা সুযোগ পাওয়ার। এই কন্ট্রাাক্ট পেয়ে মনে হল বোধ হয়Ñপথ পেয়ে গেছি।
এই সময়টিতে সিলেট—ঢাকা হাইওয়ের কাজ শুরু হয়েছে। গদিতে আওয়ামীলীগ সরকার। কিন্তু বিরোধী দলীয় এক রাজনীতিক কন্ট্রোল করেন ঢাকা—সিলেট মহাসড়কের পাথর সাপ্লাই। জাফলংয়ের সব পাথর ক্রাসিং মেশিনের মালিকদের কন্ট্রাক্ট করে রেখেছেন, কেউ পাথর বিক্রি করতে পারবে না, তিনি সিলেট—ঢাকা মহাসড়কে পাথর নেবেন। আমরা এর আগেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এই অবস্থায় নতুন এই কন্ট্রাক্টটি আশার আলো মনে হল।
এরপরও, আমরা বিপাকে পড়লাম। আওয়ামীলীগ—বিএনপি রসি টানাটানি করেই, ছোট দালাল, বড় দালাল ধরে একটা মোটামুটি ব্যবস্থা হল, আমাদের নতুন কন্ট্রাক্টে পাথর দিতে রাজি হলেন ঐ বিরোধী দলীয় লোক, কনভিন্স হলেন তিনি, তবে দর একটু বেশি।
ভোলাগঞ্জ এবং জাফলং মিলিয়ে দু’জায়গা থেকে লাখ খানেক পাথর সাপ্লাই হল ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে।
এরপর, শুরু হল দৌঁড়—ঝাঁপ বিল আদায়ের পালা। চলতে লাগল ঢাকা, নারায়নগঞ্জ দৌঁড়। মাঝে মাঝে শাহেদ আহমদ ১০/১৫ হাজার টাকা হাতে তুলে দিয়ে বলেÑযান ভাই, কিছুদিন গেলে টাকার বন্যা বইবে,তখন কত টাকা নিবেন। যান মিষ্টিখাওয়ার টাকা দিলাম। যান। বলে পিঠ হাতিয়ে বিদায় করে, ধরতে পারেন তাড়িয়ে দেয় লোকটি। এরকম ঘুরাঘুরি কওে বছর যায়। টান পড়ে ব্যবসায়। যাদেও নিকট থেকে বাকি শর্তে মাল ডেলিভারি দিই, তাদের তাগাদার এত—ই চাপ বাড়েÑশ্বাস ফেলার ফুরসত মেলা ভার হয়ে দাঁড়ায়।
একদিন শাহেদের অফিসের এক লোক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললো, ভাইসাব ভাগেন, বেশি হাটহাটি কইরেন না, কাঁচপুর চিনেন? কাঁচপুরে ব্রিজে নিয়ে নীচে শীতলক্ষায় ছেড়ে দেবে, বস খালাস। বুঝলে বুঝেন, না বুঝলে মরেনÑযাই বলে লোকটি লিপটে উঠে উপওে চলে গেল। কত তলায় গেল বুঝা গেল না। আমি আর ইজ্জত আলী হা করে তাকিয়েই থাকলাম। মানুষের মূলধন হিসেবে খাটানো টাকার কী হবে, এই চিন্তায় ঘুম হারাম। চার বন্ধু চার জায়গায়,জাফলং, ছাতক, ভোলাগঞ্জ আর সুনামগঞ্জ পড়ে রইলাম। বোকা সেজে দিলাম মাথায় হাত। সুদের টাকার কারণে দখল করে নিল টাকার দাদানওয়ালা আলী আহমদের সুনামগঞ্জের বাড়ি। সাদা স্টাম্পে দস্তখত দিয়ে টাকা আনার জন্য মেয়াদের পর অটো রেজিস্ট্রি হয়ে গেল বাড়ি। পুলিশ এসে বের করেদিল আলী আহমদকে। এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়ি।
কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল আমাদের অন্যান্য পাওয়ানাদারদের মামলা। ঘরছাড়া হই। ছাব্বা লাগে টাকা মারার। অর্থ্যাৎ ডাকাত পরিচয় হল, নাম রটে গেল ডাকইতের। টাকা মেরে দেয়ার বদনাম ফজলু মেম্বাররাই ছড়িয়ে দিল এখানে সেখানে। এই হলাম ডাকাইত। মামলাগুলোর পেছনেও ইন্ধন ফজলু মেম্বারের যে ছিল না, তা বলা মুষ্কিল। কাজে—কামে এটা বিশ্বাস হয়, সে জড়িত।

।। আট ।।

আমি যখন বউ হয়ে ভোলাগঞ্জের এ অরণ্য—জঙ্গলার মাঝে এসেছিলাম, তখন অচিন ছিল সব কিছু। অনেক দিন মনের মাঝে অনেক কৌতুহল, দেখবো ভোলাগঞ্জ বর্ডারে থাকা ‘মুক্তিযুদ্ধ— ব্যাংকার’ বা ক্যাম্প। মনে মনে ছিল হেঁটে হেঁেট দেখবো ‘শাদাপাথর’ এলাকাটি। এছাড়া বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি, বর্ডারের কাছে তেজপাতাবন, রাতারগুল জলাবন। সখ ছিল ঘুরবো বনে বনে। কিন্তু হয়ে উঠলো না। তোমার খালি পাথর পাথর ব্যবসা। ভোর হলেই দৌঁড়, গভীর রাতে ফেরা। এক চরকির মাঝে বাঁধা ঘুর্ণির জীবন। আমারও সওয়া হয়ে গেছে। এই ছোট্ট ডেরা,পাকা ঘর বলতে মাত্র তিনটি রুম, পাকের রান্না ঘর, এক চিলতে বারান্দা, কয়েকটা আম গাছ, বরই গাছ একটি, কাঠাল গাছ টুণ্ডা দু’টিসহ কলাগাছের ফেড় ডানে বায়ে তিনটিÑএইটুকু সম্পদ। এই টুকুতেই আমার বিচরণ। সাথে আরও পাঁচটি ঘর। রমজান ড্্রাইভার, আমীর আলী ড্রাইভার, বিন্দিয়া, সৈয়দালি ও কমরউদ্দিন। তাদের প্রত্যেকের সংসার, ছেলেমেয়ে রমরমা অবস্থা না হলেও ভোলাগঞ্জের শত ধরনের ব্যবসায় মাথা খাঁটিয়ে আয় করে কম—সম নয়, সংসার চলার বুঝ।
Ñতা জানি, কিন্তু আমার চোখ তো ছিল উপরে। বড় ব্যবসার দিকে। জুলেখার বালিশকে কাছে টেনে বলল চানমিয়া বেপারি।
Ñহুম, বাবা এলেন গত মাসে। তুমি খোঁজ রাখলে কই। তুমি তখন জাফলংয়ের ব্যবসার চালান নিয়ে ব্যস্ত।
Ñতোমার অপেক্ষা করতে করতে একদিন গেলাম রমজান ড্্রাইভারের বউকে নিয়ে ভোলাগঞ্জ বাজার অবধি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প ছিল, সেই জায়গাটি দেখতে। বাবা বললেন, গা শির—শির করে উঠেছিল ক্যাম্পটি দেখে। মনে হয়েছিল নাকি এটা সোনারগা’র ‘পানামনগর’। এখানে ইতিহাস আমাদের। এই যেন দেখা যাবে সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর পদচিহ্ন, ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের ভরাট কণ্ঠটি কখন ভেসে আসবে, ডা.হারিছ আলী স্টেথিস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে ছুটবেন আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার উদ্দেশেÑএরকম অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল এ পুরো জায়গাটিতে আছে সহ¯্র মুক্তিযোদ্ধার পায়ের দাগ, বাতাসে আছে বারুদওয়ালা গায়ের গন্ধ।
আমি জুলেখা বেগম মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার জন্ম—ই হয়নি। আমি কতটুকু—ই জানি, যা জেনেছি তোমার কাছ থেকে। শুনেছি তোমার বাবা সুরুজ মিয়ার বীরত্ব কথা। ধরে—আনা রাজাকার, পাঞ্জাবি আর্মিদের গাছে লটকিয়ে পেটানো, তারপর এক সময় গুলি করে পিয়াইন নদীর চির চির করে বয়ে যাওয়া জলে ঠেলে ভাসিয়ে দেয়া হত লাশ। বাবাকে যা পারি, শোনা কাহিনিগুলো বলেছি।
চানমিয়া নাসির বিড়িতে দম দিয়ে কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে বললো,Ñকী বললেন তিনি?
Ñকতবার বলেছি, তুমি বিড়ি ছাড়। মরবে তুমি বিড়ি টেনেই।
Ñকী আর বলবেন। আরও বলেছি, তোমার বাবার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সেই লোমহর্ষক কাহিনি। যতটুকু তোমার নিকট থেকে জেনেছিলাম, সেটি গর গর করেই বলেছি। গল্পের ভেতর কী ¯্রােত যে ছিল আবেগ ও স্বপ্নের, সেটিই আমাকে তাড়া করেছে বেশি। সেই টেংরাটিলার গল্প।
তোমার বাবা আমার শশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ আলীর বয়স চৌদ্দ বা পনের। তিনি বিশ্বনাথের সিংগেরকাছ থেকে এসেছিলেন খালার বাড়ি ছাতকের টেংরটিলার পাশে সুরিগাও গ্রামে। বেড়াতে নয়, অনেকটা আশ্রয়ের উদ্দেশে। সিংগেরকাছ গ্রামে হানা দিয়েছিল পাঞ্জাবি। সেই তাড়া খেয়ে টেংরাটিলার নিকট সোজা উত্তরে সুরিগাও গ্রামে। বর্ডার ক্রস না করে গুঁতি খাওয়া, লুকিয়ে থাকা। টেংরাটিলায় ছিল ইপিআরের একটি ক্যাম্প। এটির থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয় ইপিআরদের। পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা এখানে ডিউটি করছিল। কিন্তু মার্চের শেষের দিকে এলাকার আওয়ামীলীগাররা লাটিসোটা—দা—কুড়াল নিয়ে আক্রমণ চালায় ক্যাম্পে। তারপর থেকে খালি পড়ে আছে ক্যাম্পটি।
তুমি বলেছিলে তিনি বললেন, একদিন শোনা গেল পাঞ্জাবি এসে গেছে। সকাল বেলা নারী—পুরুষ বালকবালিকা বৃদ্ধ—যুবক—যুবতীরা দৌঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে। আমিও দৌঁড় দিলাম। এরকম কয় দিন পর পরই দৌঁড়ের উপর থাকতে হয় এলাকাবাসীকে। প্রাণ বাঁচানোর এই মহড়া হয়ে গেল নিয়তি। সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনাটি যে ঘটল সেদিন আমার মাথা ঘুরে যায়। গ্রামের মানুষ ঠিকই দৌঁড়াচ্ছে, বালবাচ্চাসহ নারীপুরুষ। দেখা গেল একজন মহিলা একটি শিশু প্রসব করেছে দৌঁড়ের মাঝে। পড়ে আছে আইলের পাশে। কেউ তাকাচ্ছে না, কেউ তাকে কোন সহায়তাও করছে না। মানুষের তাকোনোর সময় কই? কী করে বাঁচা যায়। সকলের প্রাণ রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা। দেখা গেল প্রতিদিন এক বা দু’জন কম বয়সী মেয়ে—মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলে পাঞ্জাবিরা ধরে নিয়ে গেছে, আবার কেউ বলে মরে গেছে খালে ডুবেÑসাঁতার জানা ছিল না। এও দেখেছিÑদুএকজন তরুণকে না—মেরে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে ভর্তি করে দেয় রাজাকার বাহিনিতে, কানজোঁকা লাঠি গছিয়ে দেয় ক্যাম্প পাহারায়। মাঝে মাঝে বুড়োদের টেং ভেঙে পঙ্গু করে ফেলে যায়। কোন কোন দিন গরু—বাছুর ছাগলও ধরে নিয়ে জবাই করে খায়। কী এক নরক পরিস্থিতি। ‘পাঞ্জাবি আইছে’ বললেই দৌঁড় শুরু হয়।
এই সব ঘটনা বিশেষ করে ঐনারীর সন্তান—প্রসব ঘটনার দৃশ্য আমাকে এমনভাবে শক্তি যোগায়, যে আমি টেংরাটিলার পাশে খালার বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিলেন যুদ্ধকে ভয় পেয়ে, সেই আমি সুরুজ আলী যত কম বয়স হউক স্থির করলাম মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে।
পরদিনই গেলাম যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে রিক্রটিং ক্যাম্পে। ক্যাম্পে ছিলেন হেমবাবু, ডা.হারিছ আলী, আবদুল হক এমএনএন। তারা কেউ—ই আমাকে সিলেক্ট করতে চাইলেন না, কম বয়স বলে তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হলেন। আমি নাছোড় বান্ধা। একদিন সিলেকশনে থাকা কমান্ডার মতি নন্দী বললেনÑ চল, এই নদীটা সাতরিয়ে ওপার যা, দেখি পারছ কিনা। আমি জটফট পরনের কাপড় খুলে লুঙ্গিটা মালকোচা দিলাম। এই বয়সে আমার মত বালকরা নদীতেই খেলা করি বেশি। লাইখেলা, ডাঙগুলি আরও কত কি, আর নদী সাঁতরানো কি এমনি হান্দেস কাটা কিছু?
নদীতে নামতে যাবো, এমনি তিনি হাত চেপে ধরে আটকালেন। মুখ—থতনিতে হাত বুলালেন। দাঁড়ি লেশমাত্র চিহ্নি নেই, কচি মুখ আমার। মায়া ভরা কণ্ঠে বললেন, যাÑআজকেই ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে দেবো শিলং।
এই তো টেনিং নিলাম, যুদ্ধ করলাম, দেশ স্বাধীন হল।
এই গল্পটি তোমার মুখ থেকে শোনা। বাবাকে শোনানোর সময় দেখলাম বাবার চোখে জল।
তোমার বাবার জীবন—গাঁথাকে আমি গেঁথে নিয়েছি আমার জীবনেও। এই রক্তাক্ত কাহিনি সকলেরই, আমাদেরও।
কিন্তু আমার বাবা এবং আমাদের পরিবারের কাহিনিগুলো কী কম রক্তাক্ত! সেটা পরে বলবো।
বাবা জানতেনই না তুমি আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছো। তিনি জেনে খুব চুপসে যান। বলেছি, দোষ নেই তোমার। তোমার স্ত্রী থেকেও ছিল না। ওরা তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের বাড়ি দখলে তাদের। আরও আছে ভাই তিনজন, স্ত্রী ও দুই সন্তানÑতারা সকলে একজোট। জমি—জমা বিক্রি করে পাথর ব্যবসায় নেমে পুঞ্জি নিয়ে উঠতে না—পারার কারণ সংসারে ছেদ ঘটে। সুতরাং আরেক সংসার আছে বা তার অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি তোমার যে প্রয়োজন ছিল না, তাই বাবার নিকট তুলে ধরলাম। বললাম, আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।
আরও বললামÑঅন্তত একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে স্বামী হিসেবে পেয়েছি, যার গায়ে মুক্তিযুদ্ধের গন্ধ, ধমনীতে অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি রয়েছে, না—কে না বলার ক্ষমতা আছে, এতেই আমি সন্তোষ্ট।
একটু দম ধরেই থাকলাম। কিছুক্ষণ পরেই বললাম, আমার বাবার গ্রামের অবস্থা, বাড়ির দশা জানো এখন কোন পর্যায়ে!
একটু শ্বাস নিয়ে বললামÑজানি তোমার তোমার জানা নেই। সেটা বলার জন্যে বাবা এসেছিলেন এখানে। আমার অবস্থাও ভাল নেই দেখে প্রথমে কিছুই বলতে চাননি। আমি যখন তোমার ব্যবসার উত্থান—পতন এবং পারিবারিক বিপর্যয়ের সারংসার বললাম তখন বাবার রাগ নেমে এলো। যাবার সময় বললেন আমাদের বর্তমান দশার কথা। সেকি লোমহর্ষক! আরেক মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা শুনলাম। শুনলাম ভুলের পূর্বাপর, বিশ্বাসভঙ্গসহ নানান তথ্য। স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। চিন্তার সাথে নেই কোন যোগসূত্র ভবিষ্যত দিনযাপনের।
তিনি বললেন, রে বাপ, আমাদের কথা ভেবে লাভ নেই। আমরা ভিটে মাটিচ্যুত হয়েছি। জমি—জমা সব এখন হয়েছে ভেস্টেড প্রপ্রাটি। দখল নিয়েছে আজিজ সর্দার, আবু তালুকদাররা।
অভাবÑঅনটনে আমাদের জমি—জমা বিক্রি করে ফেলেছিলাম। এর আগে তোমার কাকাদের সম্পত্তি লীজ নিই। আর এখন দেখা গেছে, আমাদের কোন সম্পত্তি নেই, যা আছে সব তোমাদের কাকাদের, যারা কলকাতা চলে গেছেন কেউ সাতচল্লিশে, কেউ পয়ষট্টিতে আবার কেউ বায়াত্তুরের পর। আমরা পচাঁত্তরের পর মুসলমান হয়ে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এটা নাকি আইন। সনাতন ধর্মের কেউ ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তিতে ভাগ থাকে না, সেটা তো জানা ছিল না। মনে করেছিলাম মুসলমান হলে আর কেউ আমাদের সংখ্যালঘু ভাববে না। মুসলমানের দেশে মুসলমান হয়ে থাকা ভাল। সেই সুখ,স্বপ্ন কোথায় যে উবে গেল, কঠিন জমানা এল।
ঊাপবা বললেনÑআমরা এখন আজমিরিগঞ্জের বাজারের দোকানের পেছনে ছাপটা বানিয়ে নিয়েছি। খারাপ নয়, বলতে পারিছ ভালই আছি। দোকান আর ঘর এক সাথে। ডর কম। এক সাথে ঘুমাই, ভাত খাই, সংসার চালাই। ছেলেরা বড় হয়েছে। বউ আনতে চাই ঘরে। কিন্তু কোথায় কী হবে, সেই দু:শ্চিন্তায়—ই দিন যায়।
এই ছিল বাবার কথা। আমার মেয়ের বয়স তিন বছর। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, নানারে, ‘সুখের লাগি বাঁধিনু ঘর/ দু:খের লাগি অইছি পর’। সমাজটাই পর। বড় করুণ তার ভেতরের কাহিনি, যা দেখি, তা বাহিরটা। সব রঙ—চঙা–রঙিন ভুবন।
যাহোক, জীবনের ঘূর্ণিঝড় কত দুর্বিপাকের, সেটা সকলেই টের পায় প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। চানমিয়ার কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে জুলেখা বলেÑশোন, আমিও কিছু করে খেতে চাই। আমি দেখেছি এখানে অনেক ধরনের ব্যবসার চান্স আছে।
–কী ব্যবসা?
— যেমন ধরো, চানাচুর বিক্রি হয়, ঝাল—গরম, পানবিড়ির উপরি দোকান শন—পাঁপড়ি . . .।
–তুমি কী এগুলো বিক্রি করবা?
–এগুলো না। আমার পছন্দ একটি আছে।
–সেটি কি?
–বলবো?
–হ বল।
–মি ‘ভাপা পিঠা’ বানিয়ে গরম গরম এই পাথর কোয়ারির লেবারদের নিকট হেঁটে হেঁটে বিক্রি করবো। তুমি কী বল?
লেবারদের সাথে তো অনেকদিন কাজ করলাম। তাদের সাথে বরফ—হিম পানিতে নামতে হয়। কী ভয়ানক ঠাণ্ডা পানি।
কিন্তু এতে তো পানিতে নামতে হবে না। শুকনায় থেকেই চলবে।
— বেশ, ভাল। চেষ্টা করে দ্যাখো। এটা তো তেমন হান্দেসকাটা নয়, যেÑখুব কঠিন।
তবে তোমার মেয়ে কী করবে?।
–সে আমার সাথে থাকবে। এখনো তো স্কুলে যায় না।
আমার সাথে থাকলে ক্ষতি কি?।
–না, ঠিক আছে। আমি বাড়ি থাকলে আমার কাছে থাকবে। না থাকলে তোমার সাথে।
এত রাত—জাগা ঠিক নয়। আজ বেশি কথা বলে সময় কেমনে যে গেল। জুলেখা পাশ ফিরে ঘুমাতে চেষ্টা করে।

।। নয় ।।

একদিন খবর এল চানমিয়া বেপারি সিলেট জেল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে কুমিল্লা জেলে যাবে অল্প দিনেই। একটি হাত হাতে আসা চিঠি পেল জুলেখা। জেলগেটে একবারই দেখা করেছে জুলেখা। তাও অনেক কষ্টে। লোকে যাকে বলে কাঠ—খড় পোড়ানো। এই কথাটির মর্মার্থ জুলেখা এদিনই টের পায়। শাড়ির খুটে বাধা টাকা কতবার বের করে গুনে দিতে হয়েছে কখনো পিয়নকে,কখনো পেয়দাকে, শেষমেষ পেটমোটা দারোগাকে। সে কী জানি জেলের কোন বড় অফিসার। যাহোক, দেখা করতে দিনভর দৌঁড়াদৌঁড়ি করে যে সময় টাইম পেল, তখন বিকেলÑশেষ সময়, শেষ দর্শনার্থী। হাত ছুঁয়ে কয়টি কথাই না বলেছে, এর চেয়ে সমস্যা হয়, মেয়েটি তার বাবাকে দেখে যখন ‘বাবা’ বলে ভে করে কেঁদে দেয়। কাঁন্না থামাতে গিয়ে পিতা—কন্যার কী করুণ পরিস্থিতি।
কুমিল্লা জেলে স্থানান্তরের খবরটা এল এক জেইলার অর্থাৎ আসামীর ভাইয়ের মাধ্যমে। সেলিম নাম, সে তার ভাইকে জেলে দেখতে গিয়েছিল।
জুলেখাপরের সোমবার জেলের দালাল গোছের একটি লোক ধরে সিলেট যান। গিয়ে দেখেন আজই সকালে চানমিয়া সিলেট ছেড়েছেন। নিয়ে যাওয়া হয়েছে কুমিল্লা জেলে। দালাল ধরা থেকে অন্যান্য বিষয়ে গাঁটের বেশ টাকা খরচও হল। কয়েকটা গামছাও কিনেছিলেন চানমিয়ার জন্যে, রংপুরী গামছা চানমিয়ার প্রিয়। কিছু পান, হাকিমপুরী জর্দা।
বিফল হয়ে ফিরে আসার সময় পান, সুপারি ও জর্দার গাট্টিটা সালুটিকর এসে ওসমানি বিমান বন্ধর পেরিয়ে ‘চেঙ্গের খাল’ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেন জুলেখা বেগম। এই প্রথম এত গোস্সা ওঠে জুলেখার। তখনই মনের মাঝে ভেসে ওঠে প্রকৃত সংগ্রাম শুরুর নানা কথা, বিষয় কিংবা স্বপ্নÑযা—ই বলা হোক না কেন।

রমজান ড্রাইভারের বন্ধ করে রাখা উপরি দোকান ঘরটি তার বউ ছায়রা খাতুনের নিকট থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যবসাটি শুরু করলেন জুলেখা বেগম। রমজান ড্রাইভার ট্রাক এক্সিডেন্ট মামলায় ৭শ্রমিক নিহতের ঘটনায় জেলে এক বছর। তার বন্ধ দোকানটি সিলেট জেলে চানমিয়া বেপারি গিয়ে দেখা করেই সাব্যস্ত করলেন। ভাড়া ঠিক হল রোজ ৫০টাকা। ভোলাগঞ্জের মেইন সড়ক থেকে কোয়ারিতে নামা রাস্তার পাশেই ঝুপরি দোকানগুলোর একটি এই উপরি—দোকান। চা—স্টল থেকে ভাতের দোকান রয়েছে ঝুপরিগুলোতে। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজন, পাথর, শ্রমিকরা চা খায়, ভাত খায় পান সিগারেট বিড়ি আরও নানা কিছু। ভাড়া করা এই দোকানটিতে জুলেখা জুড়ে বসে ‘ভাপাপিঠা’র দোকান, সঙ্গে বিড়িপান সিগারেট এবং চা। মরচাগুড়ের লাল চা—ই বেশি চলে।
মরচাগুড়ের ভাপাপিঠা। সামান্য নারকেলের কুচি মেশানো। ভাপাপিঠা মানে বাঙালির জিভে রস, আসলেই অদ্ভুত মজা। গপ—গপ করে গরম গরম পিঠা নারীপুরুষ খেতে থাকে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অনেকেই বলেÑ‘বহুদিন পর আলাদা একটা স্বাদ পাইলাম।’
কয়েকদিনে মধ্যে একটা পরিচয় তৈরী হয়ে গেল জুলেখার দোকানের। কেউ বলে চান্দুমিয়ার বউর দোকান, কেউ বলে জুলেখার দোকান। জুলেখাও আর মনে ধরে—না কে কি নামে ডাকে বা ডাকল। একদিন অনেক গরমাই ছিল চানমিয়ার, তার ব্যবসার রমরমা অবস্থা ছিল। এখন তা নেই। ‘পড়াগরু’র কোন দাম নাইÑএমন দশা। সুতরাং বাঁচতে গেলে দুপয়সা কামাই করা চাই, সেই চড়াই উৎরাই পথে চলতে গেলে কে কি বললো, ভেবে লাভ কি। তবে ‘স্বামীভাড়া’ ব্যবসা থেকে বহুত সুনামের ‘ভাপাপিঠা’র দোকান বা ব্যবসাটি।
জুলেখা ছিল সহায়—সম্পদে ভরপুর এক রমরমা পরিবারে বেড়ে ওঠা ‘হাওরকন্যা’। ছিল এক দল ভাইবোন, খেলার সাথীদের জমজমাট জগত। কিন্তু মানুষের জীবন থেমে থাকে না, চলমান এক অস্থির গতির প্রাকৃতিক নিয়ম।
এই নিয়মের হেরফেরেই মানুষ হয়ে ওঠে কখন কী তা বুঝা মুস্কিল। কপালের ফেরে জুলেখা বেগম পাথর কোয়ারি শ্রমিক, ভাপাপিঠা’র দোকানি অতি সাধারণ একজন রমণীÑ যার জীবন সংগ্রাম ঘামে—ভেজা এক চিলতে রোদ।
এই রোদে জীবনকে মেলেই চলছে কোনরকম। সাড়ে তিন বছরের কন্যা সন্তান দীপাকে কোলে—কাঁখে চলা অচিন নয়Ñএমন এক নারী সে। অনেক মানুষের ভীড়ে জুলেখা আলাদা কেউ নয়। শত লোক শত ব্যবসা খুলে বসে আছে এই ভোলাগঞ্জে। সরকারি সড়কের পাশে পাথর কোয়ারি থেকে মাইল দূরে টুকেরবাজার। আরও মাইল পশ্চিমে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা সদর। স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠা এই উপজেলাটির সদর এলাকাটি শহরের রূপ নিচ্ছে দিনেদিনে। স্কুল, কলেজ, হোটেল, শপিং সেন্টার অফিসার্স কোয়ার্টারস কত কি সাঁই সাঁই করে নির্মাণ হচ্ছে। অল্পদিন আগে ভোলাগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্থল—বন্দর। বাংলাদেশ—ভারতের মধ্যে নিয়মিত আমদানি—রফতানির বিরাম নেই। এতে কমেছে চোরাচালান, পাচার, জাল—জালিয়াতি। ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে নানাভাবে, যার যে—রকম পথ খুলছে, সে দাড়া—দিশায়। এমনি এক সংগ্রামের ভীড়ের ভেতর জুলেখা।
চানমিয়া বেপারির জেল হবে, সেটা ভাবতে গেলে চোখের সামনে স্বপ্নভাঙা এক রাত্রিই উপস্থিত মনে হয়। মাথার ওপর আকাশ ভাঙার শব্দ শোনা যায়নি। লোকে বলে কাঁচ ভাঙার শব্দ শোনা যায়, হ্নদয় ভাঙার শব্দ শোনা যায় না। ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল পাতানো সুড়ং পথে যাত্রার পদধ্বনি শুনতে পায়নি। টের পায়নি কোন অদেখা বিপদ সংকেতেরও।
জুলেখার বেগমের ভাপাপিঠা’র দোকান খুলে বসার এক সপ্তাহ পর সোমবার ভোররাতে চানমিয়া বেপারিকে পুলিশ এসে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তারা বলে, ওসি সাব খবর দিয়েছেন দেখা করার জন্য, যেতে হবে। বাড়তি কাপড় পরতে দেয়নি তারা। গাড়িতে তুলেই প্রথমে কোম্পানিগঞ্জ থানা, পরে সিলেট জেল। থানায় গেলে ওসি সাব তার জেল হওয়ার কাগজ দেখান। কোর্টে হাজিরা না—দেওয়ায় ওয়ারেন্ট হয়েছে কয়েকবার। কাগজে আছে ওয়ারেন্ট, কিন্তু পুলিশ কোনদিন খোঁজ নেয়নি আসামীর। চানমিয়ার মনে আছে সরকারবাদী কেইস এইটুকু মাত্র। তবে ঐ সময় হাজারদশেক টাকা ফজলু মিয়া মেম্বারের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলÑযাতে পুলিশী হয়রানি না—হয়।
বহুদিন গেছে, কোন খবর নেই। বেনামীতে চলা মামলার রায় হয়েছে চানমিয়া বেপারির সাত বছর জেল। জেল হয়েছে নিরীহি শ্রমিকদের ‘গাতা’য় নামিয়ে পাথর তোলার কাজে নিযুক্ত করার অপরাধে। ৫জন শ্রমিক ‘গাতা’র মধ্যে পাথরচাপায় মরে যাওয়ার হুকুমের আসামী চানমিয়া বেপারি। তারই হুকুমে এই শ্রমিকরা ‘গাতা’য় নামে।
যে জুলেখা ছিল উত্তাল কালনী নদীর কোলে বড় হওয়া কিশোরী, ডিঙি নৌকায় নদী পাড়ি দিত না, ভয়ে কাতর হয়ে সামান্য ঢেউয়েও তির তির করতো বুক, সেই হাওর—নদীর কোলে বড় হওয়া জুলেখা বেগম মোটেই সাহসী কেউ ছিল না। সাধারণত হাওর—নদীর কোলে বড় হওয়া মানুষেরা সাহসী বেপরোয়া হয়, উজানে ছুটে চলায় দক্ষ মাঝি না—হলেও লড়াই করে বাঁচে। সেই দুর্মর উত্তাল প্রকৃতির মধ্যে জুলেখার পিতৃপরিবারের ঐতিহ্যটা ছিল লাজুক ঘরের মেয়ে হয়ে বেড়ে ওঠা। সংগ্রামটা তাদের না—চেহারায়, না পেশিতে ছিল। গ্রাম্য মধ্যবিত্ত পরিবারের বাঁধন এমনই অটুট ছিল যুগযুগ যাবৎ।
এই ভোলাগঞ্জের নাান জাতের পাথর নিয়ে খেলা—করা পরিবেশই পাল্টে দেয় জুলেখার বুকে থাকা কম্পমান শক্তিকে। অচিরেই পায়ে জোর বাড়ে ডিঙিয়ে চলার। বিশেষ করে, চানমিয়ার জেলে যাওয়ার পর একা যুদ্ধে নামে সে। সঙ্গী সাড়ে তিন বছরের কন্যাসন্তান। কখনো কখনো মনে হয়Ñজীবনটাই হয়ে গেছে এক পেশে শাড়ি। এই অবস্থায় ঘুর—ঘুর করে পেছন পেছন ঘুরায় মেয়েটি। কাপড়ের খুটে ধরেই থাকে বেশিরভাগ।
ভাপপপিঠা’র দোকানের পাশাপাশি জুলেখা বেগম মধ্যে—মধ্যে ধলাইনদীর হাঁটু বা কোমর পানিতে নেমে পাথরও তুলে বারকি নৌকায়। কামলা খাটে কোন ঠিকাদারের। এ ধরনের কাজ পায় তুমুল বৃষ্টির পর পাহাড়ি ঢল নেমে গেলে। ঢল নেমে যেতে সময় লাগে বড়জোর তিন—চার ঘন্টা। ঢলের তোড়ে পাথর নামে পাহাড় থেকে। বৃষ্টি থামার পর পাথর তুলতে দলে দলে ধলাইনদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকজন–নারী—পুরুষ সকলেই। ঝড়ের পর আম কুড়ানোর ধুম—পড়া দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় নদীর তলায় গড়িয়ে আসা পাথর নিয়ে কাড়কাড়ির দৃশ্য। বৃষ্টির জল—নামা ধলাইনদীর জলে ধোয়া পবিত্র বুকটা খুবড়ে খুবড়ে শকুনের মত খায় লোকেরা। নদীর সটান—শোয়া দেহটা কাঁপিয়ে শা—শা শব্দে পাথর বোঝাই ট্রাক হাঁটু জলেও নেমে যায়। নৌকার পাশাপাশি ট্রাকের বাড়তি সুযোগ নেয়ার এ তোলপাড় করা আচরণ শ্রমিকরা ভাল পায় না। এই পাথর খেকোরা নদীর শান্ত পরিবেশকে খান খান করে, টুকরো টুকরো বানায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে, চোখ মাতাল—করা মনোরম পাহাড়—নদীকে ছিন্নভিন্ন তুলোধূনো করেও যেন ক্ষান্ত হয় না।
এমনি পরিবেশে জীবনের বাঁক এমনই কঠিনÑপাথর তুলতে গিয়ে ক্লান্ত জুলেখা পাহাড়ি নদীর বরফগলা ঠাণ্ডা জলে হিম হয়ে যায়। কোমর পর্যন্ত বেচেত হয়ে ওঠে। জল ঠাণ্ড হলেও ক্লান্তি তো এক সময় ভর করেই। টলটলে জলকে তখন দেখতে মনে হয়Ñএক চুমুকে সব জল গিলে ফেলা যাবে।
ঢুক—ঢুক করে ধলাইনদীর জল হাতের ডাবু দিয়ে গিলতে গিলতে নিয়মিত কামলাদের চিপায় চিপায় ঘুর—ঘুর করে ঘুরতে—থাকা ফজলু মিয়া মেম্বারকে একদিন জুলেখা বলতে চেয়েছিল, জুলেখা হারে নাই, জিতে। গতর খাটাই বাঁচতে জানে চান্দুর বউ। কিন্ত কোন কথাই বলে না। তার চাল—চলন দিয়ে, টুকটাক কথাবার্তা দিয়ে, কখনো গতরের গন্ধ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ‘অত সহজ নয়’।
ফজলু মিয়া মেম্বার যে চানমিয়ার জেলে যাওয়ার অন্যতম কারিগর, এই বিষয়টি জুলেখার বুঝতে গণ্ডগোল হয়নি। এই ফজলু মেম্বার কখনো চানমিয়াকে বানায় ডাকাইত, কখনো বানায় মাইয়া লোকের খাস—লোক, যেটি ‘স্বামীভাড়া’ বলে পরিচিত। চানমিয়া বেপারির প্রাক্তণ ‘ঘর—ভাঙার’ পেছনেও এই ফজলু মেম্বারের হাত ছিল বলে লোকে বলাবলি করে। আর এখন পুরোপরি চোখ ফেলেছে জুলেখার ওপর।

।। দশ ।।

প্রিয় জুলেখা, শুভেচ্ছা নিও। রমজান ড্রাইভার এক বছর জেল খেটে আজ বাড়ি গেল। তার মুক্তিতে আমার আনন্দে ধরে না। দুর্ঘটনায় লেবারে মৃত্যুর মামলায় সেও জেল খেটেছে। আমিও লেবার মৃত্যুর ঘটনার আসামী, জেলে আছি। তার ঘটনাটি ঘটে পাথর বোঝাই ট্রাক উল্টে সালুটিকর ব্রিজের নিকটে অন্য একটি ট্রাক পাস দিতে গিয়ে। ট্রাকটি সড়ক থেকে ফসকে উল্টে গিয়ে খালে পড়ে যায়। রমজান ড্রাইভার নিজে বাঁচলেও ট্রাকের ওপর বসা লেবার ৭ জনই পাথরচাপায় মারা যায়। আর আমার ঘটনা একটু ভিন্ন। বোমা ফোটানো হয়েছে সকালে, পাথর তোলা হবে। বিশাল গর্ত। যাকে ‘গাতা’ বলা হয়। এই ‘গাতা’ বা গর্ত থেকে শ্রমিকরা পাথর তুলছিল। এটা নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে, দুঘর্টনা ঘটলো। হঠাৎ, শা শব্দ করে গাতা’র উপরের অংশ ধ্বসে পড়ে শ্রমিকদের ওপর। পাথর চাপা পড়েই পাঁচজন এক্কেবারে কমপক্ষে চৌদ্দ হাত তলে।
পাথর তোলা শ্রমিক ছিল আমার কন্ট্রাক্টের। মানুষের হাহাকার, কান্নার মাতম, আহাজারি, কে কাকে সামলায়। অভাবনীয় দৃশ্য।
বোমা মেশিনে পাথর তোলায় সরকারের নিষেধ। তাই দিনের বেলায় বোমা ফাটানো হয় না। দিনের বেলায় বর্ডার এরিয়ায় বিজিবি পাহারায় থাকে। সন্ধ্যায় পাহারা শেষ হলে শুরু হয় এক দুই দশটির মত বোমা বিস্ফারণ। এটা অলিখিত এক নিয়ম। বিজিবির জানা, এসব রাতে ঘটে। এতে তাদের দায়িত্বে বর্তায় না। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে দিনের বেলায়, মানুষ মারা গেল দিন—দুপুরে। পুলিশ এলো। কোম্পানিগঞ্জ থানা কাছেই। ‘গাতা’ থেকে লাশ তোলার কোন উপায়—ই নেই। আমার কী দোষ? কিন্তু আসামী হলাম আমি।
উপরের কথাগুলো বলতে গিয়েও কোনদিন বলা হয়নি। জেলে বসে চিঠিখানা লিখিলাম, এজন্য যে, আমি যে দিকে যাই, যে দিকে তাকাই, সেদিকেই দোষের পাল্লায় ঠাঁই আমার। স্ত্রী সন্তানের কাছে সব স্বামী বা পিতা নির্দোষ কিংবা মহান। আমি মহান কেউ নই, কিন্থু যতটুকু অপরাধী ভাবা হয়, ততটুকু কি? সেটাই মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটাচ্ছে। মন ভাল নেই, ঘুম আসে না। রাত জেগে কাটে।
যাহোক, আজ চিঠি লেখার অন্য একটি কারণ। প্রথমটি রমজানের মুক্তি হওয়ার সুযোগ। আগে ছিলাম সিলেট জেলে। কিন্তু এখন অনেক দূরে, কুমিল্লা জেলে। দেখা হওয়ার সুযোগ কম। তাই, হাতে হাতে একটি চিঠিখানা পৌঁছে যাবে তোমার নিকট, এটা এক ধরণের আনন্দ।
এত দিনে অনেক কথা জমা হয়েছে। অনেক অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আমার একটি আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, সব মানুষেরই জেল খাটার অভিজ্ঞতা দরকার। এখানে এসে আমি অনেক কিছু, বিচিত্র সব বিষয় শিখেছি। মানুষের কি শেখার শেষ আছে?
আমি এখানে এসে দু’জন আশ্চর্য রকম লোককে পেলাম, একজন শিল্পী, কার্টন আঁেকন, আর একজন কবিতা লেখেন। কবিরাও জেল খাটে, এটা আমার ধারণার বাইরে। আমি অল্প লেখাপাড়া জানা লোক। কিন্তু এই সব মারপ্যাঁচ বুঝার জ্ঞান নেই বা ছিল না। এখন অবাকই হলাম। কবি লোকটি শুধু কবি নন, রীতিমত একজন বিজ্ঞানি। তিনি দেশ—বিদেশ ঘুরে—আসা লোক। পড়েছেন বহু দেশে। বিলাত, ফ্রাস আরও কত দেশ।
যে বিষয়টি আমাকে অবাক কওে সে বিষয়টি হলÑতিনি কুমিরের চাষ করেন। শুনে তোমার গা শির শির করে শিউরে উঠবে। যতটুকু জানি কুমির মানুষ ধরে খায়, এক লহমায় গিলে ফেলে আস্ত মানুষ। সেই কুমিরকে আদর দিয়ে লালন—পালন কী ভয়ানক ব্যাপার। রূপকথা বৈকি? তার বউও পাখি প্রেমিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যায় পড়–য়া মেয়ে। দু’জনের প্রেম করে বিয়ে। কী সোনায় সোহাগা যেন। আমার বুক ভরে গিয়েছিল তাদের জীবনের কথা শুনে। তিনি বললেন, তিনি যে পাগল নন, সেটা প্রমাণ করতে গেছে ষোল বছর আর কুমির চাষের প্রজেক্ট পাশ করাতে গেছে দশ বছর এবং ঘুরতে হয়েছে ৩২টি টেবিল।
তবে আমার কৌতুহল অন্য জায়গায়।
কবি আমাকে একটি গল্প বললেন চমৎকার। গল্পটি হলÑ তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একদিন চার বন্ধু মিলে গেছেন শহরে ঘুরতে। শহরটি তাদের কাছে নতুন। অন্য জেলার মানুষ তারা। কেউ সিলেট, কেউ ময়মনসিং, কেউ রংপুরের, বগুড়ার। সুতরাং কথিত সমুদ্রকন্যা চট্টলা দেখার সমান কৌতুহল।
ঘুরে ক্লান্ত। একটি রেস্টুরেন্টে বসলেন চা খেতে। চুটিয়ে গল্প চলছে। এমনি একজন রেগে ওঠে। বললো, তুই দেখি খালি ইংলিশে কথা বলছিস, আমরা চারজনই বাঙালি, কেন বলতো? তার রাগ দেখে, রাগী বন্ধুকে থামিয়ে কবি লোকটি বললেনÑদেখ, আমরা চারজনই বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র, দু’একটা ইংরেজি লাইন বললে কী এমন দোষ হল? এ কথাটি তিনিও ইংরেজিতে বললেন। যা হোক, বিষয়টির নিষ্পত্তি এখানেই।
গল্পটা আরেকটু দূর। এ রকম আরেকটি ঘটনা ঘটে দশ বছর। তিনি তখন বিলেত থেকে দেশে এসেছেন ছুটিতে। সিলেট তখন ছোটখাটো শহর নয়, পুরোদস্তর মহানগর। জিন্দাবাজার একটি বিখ্যাত নানা বিপনিবিতান আর রেস্টুরেন্টের সমারোহে। আবার একই রকম পরিবেশ, চার বন্ধু বসছেন চা খেতে। এর মধ্যে একজন বার বার ইংরেজিতে কথা বলছেন। এক সাথে এমসি কলেজে পড়–য়া চার বন্ধু নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এক সময় রাগ উঠলো কবির। তিনি ভাল ইংলিশ জানেন, কিন্তু কথা বলেন বাংলাতেই। ইংরেজিতে কথা বলতে থাকা বন্ধুর কথার উত্তর তিনিও ইংরেজিতে দিতে থাকেন। তার ইংরেজি বলার চমৎকার উচ্চারণ,প্রকাশ ভঙ্গি দেখে বন্ধুটি তখন আপ্লুত হয়ে যায়। মনোযোগী কবির প্রতি। চা পান শেষে ওঠার সময় চেপে ধরে বন্ধুটি বাড়িতে দাওয়াত খেতেই হবে একদিন। চাপাচাপিতে রাজি। সময় করে একদিন গেলেন। বন্ধুটি নিজ ঘরে স্বাগত জানিয়ে ডেকে নিয়ে এলেন দশ/এগারো বয়সের কন্যাকে। বললেন, আমার মেয়ে ভাল ইংলিশ জানে, আপনি তার সাথে কথা বলেন। এরপর, চলে গেলেন ভেতরে। মেয়েটি চটচট কথা বলতে শুরু করে আমার সাথে। বুঝা গেল মেয়েটিকে আমার সম্বন্ধে নিশ্চয় একটা ধারণা দেয়া হয়েছে। তা না হলে কোন কারণ ছাড়া এমন গর গর করে কথা বলবে কেন। পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে। এই ঘটনায় তিনি বললেন, বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খাওয়ার সব আনন্দ মাটি তখন। ঘটনাটি ঐদিনের চা পানের দিনের অংশ। লোকটি বুঝাতে চেয়েছে, তার মেয়ে ভাল ইংলিশ জানে। কবি ভাবলেন, সামান্য ছাড় দিলে জীবনে কী ঘটে সেটা বুঝতে কত দিন গেল।
জুলেখা বক্তৃতার মত শুনতে লাগবে এ গল্পটি। এটি বলার একটি উদ্দেশ আছে। উদ্দেশ্যটি হলÑ আমার মেয়ে এখন বড় হচ্ছে। আমি চাই না সে পাঠশালা পাশের আগে ইংলিশ শিখুক। দেখেছি, আমাদের পাথরকোয়ারি ভোলাগঞ্জের লাগোয়া টুকেরবাজারে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল হয়েছে। এটি দেখে তুমি একদিন খুব আপ্লুত হয়েছিলে, আমিও হয়েছিলাম। কিন্তু আজকে এই কবি আমাকে যে শিক্ষা দান করলেন,তা এক অনন্য শিক্ষা। আগে মাতৃভাষা শিক্ষা, পরে বিদেশী ভাষা। বড় হলে আস্ত পৃথিবী খোলা আছে শিক্ষার জন্য। কিন্তু মা—বাবা হিসেবে নিজ সন্তানকে মাতৃভাষা না শেখালে কোনদিন শেখা হবে না। সে হারিয়ে যেতে বাধ্য। যে জন্য ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রম্নয়ারি শহীদ হল আমাদের কৃতী সন্তানেরা রফিক, জব্বার,বরকতসহ অসংখ্য তরুণ। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের জন্য গুলি খেয়ে মরল তারা। আমরা কী ভুলে চলবে সেই আত্মদান?
গল্প—শোনানোর এই কবি বিদেশ ঘুরেও হারিয়ে যেতে চাননি কুহেলিকায়, তার বন্ধু কার্টুনিস্ট আশিসও হারিয়ে যেতে চাননি। কিন্তু তারা জেলে কেন? সেটা তোমার সহজ প্রশ্ন হতে পারে। জানার আগ্রহটা স্বাভাবিক। সেটা ভিন্ন বিষয়।

।। এগারো ।।

জুলেখার ভাপাপিঠার দোকানের সামনে এসে পাঁচ সাতজন যুবক গোল হয়ে দাঁড়ায়। তাদের হাতে কিছু লিফলেট। লিফলেটে লেখা ভূমিহীন ক্ষেতমজুর সমিতি। লিফলেটগুলো মানুষের হাতে হাতে বিলি করে তারা বললো, আমরা ধলাই নদীর পারের ‘আটঘরি গাও’ উচ্ছেদের খবর পেয়ে এসেছি, কেউ কি আছেন এখানে, ইউনিয়ন মেম্বারকে দরকার। আমরা জানতে চাই, কি কারণ এবং কেন এই উচ্ছেদ?
একজন এগিয়ে এসে পরিচয় দিল সে ইউনিয়নের মেম্বার, নাম ফজলু মিয়া। ফজলু মিয়ার জানা গতকালই উপজেলার ভূমি অফিসের লোকজন এসে হাত—মাইক দিয়ে ঘোষণা করে গেছে, কারা কারা আটঘরী গাও—এর বাসিন্দা। তাদের কাগজপত্র নিয়ে উপজেলা ভূমি অফিসে যাওয়ার জন্য। এবং হাতে হাতে নোটিশও দিয়ে গেছে ঐ লোকজন যে, কেউ কোন কাগজপত্র প্রদর্শন করতে না—পারলে এবং ৭ দিনের পর স্ব—ইচ্ছায় সরে না গেলে, সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসের দায়িত্ব হবে বলপ্রয়োগ করতে ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে।
ফজলু মিয়া মেম্বার এই সংবাদটি জানেন এবং স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে অবহিত করেই ঐ লোকজন এসেছিলেন। সর্বোপরি তাদের কার্যাদি সম্পাদন করে গেছেন। তিনি যুবকদের অবহিত করে বলেন, তারা কি সাহায্য চান?
যুবকদের একজন সংগঠনের স্থানীয় শাখার সভাপতি পরিচয় দিয়ে বললো, আমার নাম গোলাম কিবরিয়া। ভুমিহীন ক্ষেতমজুর সমিতির সভাপতি। আমাদেও সংগঠন কাউকে সরকারি ভূমি থেকে উচ্ছেদ দেখতে চায় না। সব মানুষ দেশের নাগরিক, বসবাসের অধিকার সমান সব মানুষের। সরকার বন্দোবস্ত দেবে, খাজনা নেবেÑবস, উচ্ছেদ করার মানে কি?
জুলেখা পরিচয় দিয়ে বললো, আমি সেই আটঘরী গাও—এর বাসিন্দা। আমার স্বামী জেলে। আমার মাথায় আকাশভাঙা অবস্থা। কোন কাগজপত্র নাই, কোন কিছু থাকলে আমার স্বামী বলতে পারে, আমি জানি না।
পানের মধ্যে চুন লেপে হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে পান মুখে পুরে গোলাম কিবরিয়া বললেন, আমরা আছি, চিন্তার কোন কারণ নাই বোন।
আধঘন্টার মধ্যে বেশ লোকজন জড়ো হয়ে যায়। কেউ কেউ যুবকদের সমর্থন করে বলেন, আমরাও কইছি, উচ্ছেদ করা যাবে না। ফজলু মিয়া মেম্বারও চা—য়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুর মিলিয়ে বললেন, আমিও তাদের আশ্বাস দিয়েছি।
যাওয়ার আগে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর সমিতির যুবকরা ধলাইনদীর পারে গড়ে ওঠা ‘আটঘরী গাও’ ঘুরে গেলেন। পাশে ‘সাত বস্তি’তেও এক নজর গেলেন তারা।
একটু দূরে উঁচু নয়Ñএমন আধা—পাহাড়ি ঢালে সরকারের আশ্রায়ন প্রকল্পের ‘একটি পরিবার একটি বাড়ি’ শ্লোগানের নবনির্মিত ‘সবুজ বসতি’র সাড়ে ছয় শ ঘর দেখতে গেলেন যুবকরা। সেই সঙ্গে আটঘরী গাও’এর লোকজনকে ডেকে তাদের নিজ নিজ দরখাস্ত লিখে প্রত্যেকের হাতে দিয়ে বললেন, শুনেছি মন্ত্রী আসবেন এক সপ্তাহর পর, ঐ ‘সবুজ বসতি’র ঘর বরাদ্দ দিবেন, আপনারা সেই সময় মন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত জমা দিবেন। আমরাও থাকব। কেমন?
জুলেখাকে ইঙ্গিত করে গোলাম কিবরিয়া বললেনÑচিন্তা করবেন না, বললাম তো আমরা আছি আপনাদের পাশে।
জুলেখা বেগম ও রমজান ড্রাইভারের বউ সখিনা যুবকদের দেয়া লিফলেট পড়তে থাকলেন পাশাপাশি বসে। সন্ধ্যে নামে নামে অবস্থা। লিফলেটের লেখাগুলো পড়ে আশ্বস্থ হয়ে ঊঠলেন মাগরিবের আজানের আগে।

।। বারো ।।

ঘুমের মধ্যে বার বার মনে মনে জপে জুলেখা ‘এওলারটুক’ ‘আদিত্যপুর’ গ্রামগুলোর নাম। এসব গ্রামে থাকা খাস জমি, ভূমিহীন পরিবারদের পাইয়ে দিয়েছে এই সমিতি। এওলারটুকে শতাধিক আর কমপক্ষে ৫০টি পরিবারকে তারা পাইয়েছে যথাক্রমে ১০বিঘা করে কয়েক হাজার বিঘা। জুলেখার জপতে থাকা লিফলেট যেন একটি আলোর রেখা হয়ে ভাসতে থাকে চোখের সামনে। এতদিন যে অšধকার দেখছিল চোখে সেখানে আলোর নিশানা ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

ধীরে ধীরে ঘুমের ভেতর গলে যায় জুলেখার চোখ, এমনকি শরীর। গরমের চটে থিকথিকে বিছানায় চট লেগে যায়। ক্লান্ত শরীর বেফানা হয় এক সময়।
কিভাবে কোথায় যেন পৌঁছে যায় ঘুমন্ত জুলেখা। চমকে ওঠে সুর্যের আলোয় রাঙা হয়ে ওঠা সকালটায়। রঙিন পতাকায় শোভিত ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারির বালুমাঠ। এই মাঠে কোনদিন এত বড় জনসভা হয় নাই বলে লোকের মাতামাতি। জুলেখা ও সখিনা এক পাশে বাঁশের ধন্নার নীচে বসে আছে। সবুজ শাড়ির খুটে বেঁধে নিয়েছে ভাঁজ করা দরখাস্তটি। লোকের ঠেলাঠেলি এমন পর্যায়ে হয়ত হুমড়ি খেয়ে পড়ে মরবে কোন সময়, কে জানে। ভোটের সময় এ রকম ঘটে। পরে সারা বছর বা কয়েক বছর কোন সভা হলেও আর এত মানুষ জমে না। এবারে মানুষের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার কারণ ‘আশ্রয়াণ’ প্রকল্পের ঘর সমঝানোর সভা তাই, ব্যতিক্রমটা চোখে পড়ছে আলাদা করেই।
জুলেখা দরখাস্তখানা ফজলু মিয়া মেম্বারের নিকট দেয়নি। ফজলু মিয়া তিনদিন আগে বলেছিল, দরখাস্তটা তার কাছে দিতে হবে। জুলেখার বিশ্বাস হয়নি লোকটাকে। যে দিন ফজলু মেম্বার দরখাস্ত চাইতে গেল, পরের দিনই ভূমি অফিসের লোকজন পুলিশ নিয়ে ‘আটঘরী গাও’ এর ঘরদোর ভেঙে দেয়। ফজলু মেম্বার এদের আটকালো না, কোন বিশ্বাসে দেবে তার হাতে দরখাস্তখানা। বরং সে আকারে ইঙ্গিতে যা বলতে চেয়েছে তা বিষ্ময়কর।
ঘর ভাগার একদিন আগে ফজলু মেম্বার জুলেখাকে ডেকে কথা বলে। পান চিবুতে চিবুতে বলেছে, বেপারি কেন পাগল হয়ে বিয়ে করেছে, সেটা কি মুই বুঝি না। কেন যে সে বলতো এ তো জুলেখা নয় ‘পাথরকন্যা’। ‘হাওরকন্যা’কে বানাইলাম ‘পাথরকন্যা’। শেষ পর্যন্ত পাথরের ফুল।
সে আরও বললো, ঘর বানানোর সময় বলেছি বেপারিকে এখানে এই পাশে এক্কান মসজিদ বানাই লও, কথা শুনলা না। ঘরের পাশে একখান মসজিদ যদি অইত, মসজিদ ভাঙায় কেউ মত দিত না। ঝুপ বুঝে কোপ মারতে হয়, বেপারি বুঝল না।
জুলেখা এই মেম্বারের ধুরবসন্ধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আজ নয়, বহু দিন থেকেই। কেমনে দু’আনার ক্ষতি করবে, সেটার জন্য ঘুর ঘুর করে আশে পাশে ঘুরায়, চক্কর দেয়। এটাই তার কাজ। ঝুপ বুঝে সে কোঁপ দেয়Ñএটা তার জন্যই মানায়। যখন আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘরের দরখাস্ত চাওয়া হয়েছিল, তখন জুলেখা দরখাস্ত দিয়েছিল। এই ফজলু মেম্বারই বলেছিল, তোমাদের ঘর আছে, যাদের ঘর নাই তাদের জন্য এই প্রকল্প। এই কথা বলে দরখাস্ত ফেরত দেয়। আর এখন বলে ভিন্ন কথা, নানান বানি—জানি। সুতরাং কোন ভরসায় তার হাতে দরখাস্তের কাগজ দেবে। আস্ত একটা শয়তান. . .।
মন্ত্রী এলেন বিকেল ৩টায়। অথচ সকাল দশটা থেকে মাইকে আহবান চলছে। মন্ত্রী আসার পর মূল বক্তৃতা পর্ব, এর আগেও বক্তৃতা দিয়েছেন কমপক্ষে ত্রিশজন। এলাকার পোলাপানসহ এটুরমাপেটুরমা, ছিচকে নেতা। এমনও হয়েছে জীবনে যাকে রাজনীতি করতে দেখা যায়নি, সেও উঁকি দিয়ে মাইকে একচোট আঞ্চলিক দাবী—দাওয়া অনেক কিছু। গানও হল। ক্বেরাত দু’টিতিনটি গাইলেন মাদ্রাসার তালবে—আলেমরা।
মন্ত্রী বক্তৃতা দেয়ার আগে আবার শ্লোগান। এর আগে মঞ্চে ওঠার সময়ও এক নাগাড়ে শ্লোগান দেয়া হয়েছিল। এই জন্য পোলাপান রেডি করে রাখা হয়েছিল মঞ্চের কাছেই।
মন্ত্রী বক্তৃতায় উঠে মাইকে বড় একটা ফু দিয়ে বললেন, আচ্চালাইমু আলাইকুম। ভোলাগঞ্জবাসী আপনারা আমার সালাম নিন। আপনারা জানেন, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। আর এই সড়ক তৈরিতে লাগে পাথর। পাথরের দেশ আপনাদের ভোলাগঞ্জ। ধলাইনদীর নিয়ামত।
যারা পাথর তোলে তাদের ঘর থাকবে না, মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না, তা আমাদের সরকার সহ্য করবে না। তাই আপনাদের জন্য সাড়ে ছয়শ ‘সবুজ বসতি’ নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমি আজ চাবি তুলে দিচ্ছি আপনাদের হাতে।
এই সময় লাইন ধরানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফজলু মেম্বারসহ স্বেচ্ছাসেবকরা। জুলেখা উঠে লাইনে আসতে চাইলে হাতের ইশারায় জুলেখাকে বসিয়ে দেয়। বেশ কয়েকবার জুলেখা চেষ্টা করে কেঁদে ফেলে। পাশে বসা সখিনা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দেয়। হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, ধয্য ধরো বইন, আল্লা দেখরা। শেষে অইবো একটা উপায়।
শ’খানেক চাবি মন্ত্রীর হাত থেকে নিলেন নানান বয়সের লোকজন। ক্যামেরার ক্লিক,ফ্লাশ লাইট জ্বললো কত শত বার। ভিডিও হল একটানা কমপক্ষে দশটি টেলিভিশন ক্যামেরার। কী যে অপরূপ দৃশ্য। এ যেন রাষ্ট্র ছুটে চলেছে. . .।
এরপর, মন্ত্রী ক্লান্ত হয়ে বললেন, বাকী চাবি আপনারা চেয়ারম্যান—মেম্বারসাবের নিকট থেকে সমঝে নেবেন। আমি বিদায় নিলাম।
দফায় দফায় শ্লোগান। মন্ত্রী স্টেজ থেকে নেমে রওয়ানা দিলেন জীপ গাড়ির দিকে। পেছনে ছুটলেন নেতা পাতিনেতা,পোলাপান, জড়ো হওয়া এলাকার লোকজন। জনস্রোতও নিমেষেই ছুটলো মন্ত্রীর পিছু।
জুলেখা ও সখিনা উঠে দাঁড়াতে গিয়ে উঠতে পারলো না। টপকিয়ে লোকজন যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। জুলেখার ঘাড় বরাবর কে যেন বসে পড়ে। এরপর শুয়ে পড়ে অনেক লোকজন। তলে পড়ে যায় জুলেখা।
আধ ঘন্টা না এক ঘন্টা কেউ বলতে পারে না জুলেখার খবর, জুলেখা মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট। পদ পিষ্ট হয়েছে। এক্কেবারে যারা ভিড়ের বাইরে ছিল, অতি উৎসাহী নয়, মন্ত্রীর পিছে দৌঁড়েনিÑএরকম চার পাঁচ জন এসে জুলেখাকে তুলতে চেষ্টা করে। দম যায়নিÑবললো একজন চিৎকার করে।
ঘটনাটি চোখে পড়েছিল রমজান ড্রাইভারের। সেছিল এদিন স্বেচ্ছাসেবকদের কাছাকাছি। ফুটপরমায়েশ কাজে নিয়োজিত। সেখান থেকে দৌঁড়ে গিয়ে একটি পাথর বোঝাই তিনটনা ট্রাক নিয়ে আসে। ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপার পরিচিত লোক। হাত—পা ধরা না লাগলেও মিনতি করেই নিয়ে এসেছে।
সখিনাসহ কয়েকজন হাতে হাতে তুললেন ট্রাকের ওপর জুলেখাকে। জুলেখার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কে কিভাবে নিয়ে এসেছে এরমধ্যে টিনভর্তি নদীর জল। ঢালা হচ্ছে মাথায়। একজন জোরে কথা বলে উঠলো, এই এই যে ঠাণ্ডা লাগাই দিবেন, একটু থামান ভাই। আরেকজন বললো, সিলেটে হাসপাতালে আগি নিয়ে লই, দেখেন দেখেন জান আছেনি ধড়ে!
ট্রাকটি যখন ভোলাগঞ্জ সড়কে সিলেটমুখী হয়ে চাকা তুললো তখন দেখা গেল মন্ত্রীর গাড়ি ধুলো উড়িয়ে অনেক দূরে। পেছনে পুলিশ, অফিসার ও নেতাদের গাড়ির বহর।
পাথর বোঝাই না জুলেখা বোঝাই গাড়ি যাই বলা হোক এক রত্তিও এগুচ্ছো না। চাক্কা থেমে আছে। সামনে ততক্ষণে কয়েশ ট্রাকÑতিন, পাঁচ, সাত টনা। গিয়ার চেপে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করছে ড্রাইভাররা। রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্য ট্রাকের বডিতে জোরে থাপ্পর মারছে হেলপাররা। চারদিকে হুলস্থ’ল। যে যার মত হৈ—হৈ করছে। সকলেরই বাড়ি ফেরার ধুম। সড়কটি ভোলাগঞ্জ সড়ক নামে পরিচিত। কোম্পানিগঞ্জ থানা বা উপজেলা হয়েছে স্বাধীনতার পর, আশির দশকে। থেমে থেমে সিলেট—ভোলাগঞ্জ সড়কটি অনেক বড় হয়েছে। যারাই এমপি মন্ত্রী হয়েছেন সকলেই ভোটের সময় বলেছেনÑকোম্পানিগঞ্জ আমার উপজেলা। আর এর উন্নয়ন,সড়ক বড় করা আমার কাজ। কাজ হয়েছে সত্যি,কিন্তু আশ্বাসের তুলনায় সামান্য। দুটি গাড়ি পাস হতে ঝুঁকি। পাথর বোঝাই ট্রাক হলেও তো কথা নেই। মাঝে মাঝে ঘষা লেগে যায়। এই অবস্থায় মন্ত্রী না—যাওয়া পর্যন্ত সড়কটি বন্ধ ছিল। কোন গাড়ি চলেনি। তাই মন্ত্রী যাওয়ার পর গাড়ির বহর হয়েছে সিলেটমুখী। সিলেট—ভোলাগঞ্জ সড়ক হয়ে ওঠেছে নিমেষে যমপুরীই বলা যায়। এই যমপুরীর মাঝখানে জুলেখার নিথর জগত।
সড়কটি ট্রাকের বহর শুন্য হতে সারা রাতই পার। মাত্র পনের মাইল পথ। ভোর ছ’টায় পৌঁছল সিলেট ওসমানি হাসপাতালে জুলেখা—বোঝাই ট্রাকটি। টেনে হাত কাত করে নামানোর চেষ্টা চলে মানুষটিকে। হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন, রোগী তো কমপক্ষে পাঁচ ঘন্টা আগে মারা গেছে। পাথরভর্তি ট্রাকের ওপর জুলেখার নিথর দেহ। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন–উপুড় হয়ে শোয়া পাথরকন্যা জুলেখার দিকে।