গল্প: খুড়োমশাই

খুড়োমশাই
সিদ্ধার্থ সিংহ
থুত্থুড়ে খুড়োমশাই এক মুহূর্তের জন্যও বালিশটাকে হাতছাড়া করেন না। মাথায় দিয়ে তো শোনই, মনে হয় ঘুমের মধ্যেও ধরে থাকেন। সকালে নিম দাতন করার সময় হাতের কাছাকাছিই রাখেন। স্নান করতে যাওয়ার আগে রোদে বসে গায়ে তেল মাখার সময়ও চোখে চোখে রাখেন। পুকুরে ডুব দিতে যাওয়ার আগে, পাড়ে উঠে পরার জন্য নিয়ে যাওয়া ধুতি দিয়ে ভাল করে ঢেকে রেখে যান। যাতে কারও নজরে না পড়ে। খেতে বসার সময়ও পাশে রেখে খান। কোথাও বসলে কোলে নিয়ে বসেন।
বাড়িতে তাঁর চার-চারটে ভাই। বয়সে তাঁর চাইতে ঢের ছোট হলেও সকলেই প্রায় বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁদের একগাদা ছেলেমেয়ে। মেয়েদের বিয়ে-থা হয়ে গেছে। তারা নাতি-নাতনি নিয়ে সব ঘর-সংসার করছে। ছেলেগুলোও বিয়ে করে বউমা নিয়ে এসেছে ঘরে। তাদের ঘরেও বাচ্চাকাচ্চা থিকথিক করছে।
তারা কেউই ওই বালিশটার দিকে এত দিন ফিরেও তাকায়নি। একেবারে তেলচিটে হয়ে গেছে। যেহেতু খুড়োমশাই একা, বিয়ে-থা করেননি— তাই ভাইবউ, বউমা, এমনকী তাদের ঘরের মেয়েরাও মাঝে মাঝে তাঁকে বলে, হ্যাঁগো খুড়োমশাই, দাও না বালিশটা। তুলোটুলো বের করে বালিশের খোলটা একটু কেচে দিই। শুকিয়ে গেলে আবার নাহয় ওই সব ভরেটরে আগের মতো করে দেব গো। ওটার গন্ধে যে তোমার কাছেই ঘেঁষা যায় না…
কিন্তু তাতেও তাঁর ঘোর আপত্তি। বালিশের খোল তো দূরের কথা, বিশ্বাস করে কাউকে বালিশের ওয়ারটা পর্যন্ত মনে ধরে খুলে দিতে পারেন না তিনি।
কী এমন ধনসম্পত্তি আছে গো ওটার মধ্যে যে, সারাক্ষণ বগলদাবা করে ঘুরে বেড়াও? কেউ এ ধরনের কোনও প্রশ্ন করলেই উনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, সে আছে একটা জিনিস। কিন্তু সেটা যে কী জিনিস, কাউকেই উনি সেটা খোলসা করে বলেন না। আর বলছেন না দেখেই এখন সবার নজর গিয়ে পড়েছে ওই বালিশটার ওপরে। কী আছে ওটার মধ্যে! কী আছে!
এই কৌতূহলটা হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে, এই পরিবারের পুরুষদের মধ্যে বালিশে করে কিছু রেখে যাওয়ার একটা বাতিক আছে। এই খুড়োমশাইয়ের বাবাও বুড়ো বয়সে যে বালিশটা মাথায় করে শুতেন, রোগশয্যায় থাকার সময় তিনি একদিন তাঁর ছেলেমেয়েদের ডেকে বলেছিলেন, শোন, আমি যখন মারা যাব, তখন কিন্তু অন্যান্য বাড়ির লোকেদের মতো আমার সঙ্গে বিছানাপাটি দিলেও এই বালিশটা কিন্তু কিছুতেই দিস না।
বড় ছেলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন বাবা?
মেজ ছেলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন, এর মধ্যে কি কিছু আছে?
সেজ ছেলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তা হলে এটা কী করব?
খুড়োমশাইয়ের বাবা বলেছিলেন, এর মধ্যে একটা রামাবলী আছে। আমি মারা গেলে এই বালিশটা আমার ছোট ছেলেকে দিয়ে দিস। দশ দিনের দিন ও যখন ঘাটকাজ করবে, তখন যেন এই বালিশটার ভিতর থেকে রামাবলীটা বের করে সেটা গায়ে দিয়েই আমার কাজ করে, কেমন?
তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর কথা মতোই দশ দিনের দিন যখন রামাবলী বের করার জন্য ছোট ছেলে ওই বালিশটা ছিঁড়ল, দেখা গেল, রামাবলী কোথায়? বালিশের মধ্যে শুধু গাদা গাদা টাকা।
তাই বালিশের মধ্যে রামাবলী বা ওই জাতীয় কিছু একটা আছে বললে, নির্ঘাৎ তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ধরেই নেবে, উনিও তাঁর বাবার মতো বালিশের ভিতরে টাকাপয়সাই রেখে যাচ্ছেন। এটা ভেবেই হয়তো খুড়োমশাই মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলছেন না। তবে না বললেও, এই ভাবে তাঁর বালিশ আগলে রাখা দেখেই সবাই আন্দাজ করছে, ওই তেলচিটে বালিশটার মধ্যে কী আছে…
তবু এ জিজ্ঞেস করে, ও জিজ্ঞেস করে, সে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু উনি কাউকেই কিছু বলেন না। কায়দা করে ঠিক এড়িয়ে যান। আর উনি যত এড়িয়ে যান, ততই সবার সন্দেহ বাড়তে থাকে। নিশ্চয়ই ওটার মধ্যে তেমন কিছু আছে।
আসলে খুব ছোটবেলায় একদিন হঠাৎ করে উনি বাড়ি থেকে কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলেন! যখন ফিরে এলেন তখন প্রায় প্রৌঢ়ত্বে এসে পৌঁছেছেন। উনিই বললেন, হাতের লেখা অত্যন্ত খারাপ বলে বাবা এমন বকেছিলেন যে, উনি নাকি রাগ করে যে-দিকে দু’চোখ যায়, সে দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন। এবং হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন বহু দূরের একটা রেল স্টেশনে। সেখানে গিয়ে কোনও কিছু না জেনেই একটা দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে বসেছিলেন। একদম শেষ স্টেশনে নেমে উনি যখন খিদের জ্বালায় কাঁদছিলেন, সে সময় এক দম্পতি তাঁকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁরা নাকি খুড়োমশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার কে কে আছে? তখন খুড়োমশাই নাকি বলেছিলেন, আমার কেউ কোত্থাও নেই। আমি একা। তখন তাঁরা একটা ভাল দিনক্ষণ দেখে মহা ঘটা করে তাঁকে দত্তক নিয়ে নেন।
তাঁদের ছিল গোটা দেশ জুড়ে নানা রকমের ব্যবসা। তাঁরাই তাঁকে লেখা পড়া শিখিয়েছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী হলেও তাঁর হাতের লেখা এত পেঁচানো ছিল যে, বেশির ভাগ লোক তার পাঠোদ্ধার করা তো দূরের কথা, বুঝতেই পারত না, ওটা বাংলা, উর্দু না চিনা ভাষায় লেখা। তবু তিনি অনেক দূর পর্যন্ত পড়েছিলেন। পড়াশোনার পাট চুকে যাওয়ার পরে সেই ব্যবসা উনি দেখাশোনা করতে লাগলেন এবং সেই ব্যবসা নিয়ে তিনি এতটাই ডুবে গেলেন যে, যখন হুঁশ হল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তত দিনে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেই দম্পতিও। ফলে সমস্ত ব্যবসার একচ্ছত্র মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু তিনি ব্যবসাটা পুরোপুরি হাতে নেওয়ার পরেই নাকি সেই ব্যবসায় মন্দা দেখা দিতে শুরু করে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই একদম লাটে উঠে যায় যাবতীয় ব্যবসাপত্র।
উনি যখন এখানে আসেন তাঁর তখন একগাল দাড়ি। পরনে জোব্বা মতো কী একটা। পিঠে বিশাল বড় একটা বোঁচকা। শরীরটাও কেমন যেন জুবুথুবু। তাঁকে দেখে প্রথমে তো কেউ চিনতেই পারেনি। যখন চিনল, তাঁর জন্য ছেড়ে দেওয়া হল একটা ঘর। ভাইয়েরা ‘দাদ দাদা’ বলে ডাকলেও, ভাইদের কোনও ছেলেমেয়েই তাঁকে আর ‘জেঠু’ বলে ডাকতে পারল না। কারণ, তাঁর কথা তারা জানতই না। শোনেইনি কোনও দিন। ফলে তাঁর পরের ভাইকেই ওরা জেঠু বলে ডাকত। একজন জলজ্যান্ত জেঠু তাকতে আর একজনকে কি নতুন করে জেঠু ডাকা যায়! না, এক নম্বর জেঠু, দু’নম্বর জেঠু; কিংবা বড় জেঠু, ছোট জেঠু অথবা নতুন জেঠু, পুরনো জেঠু, বলা যায়? তাই তারা ডাকা শুরু করল খুড়োমশাই বলে। আর তাদের দেখাদেখি সবার কাছেই তিনি হয়ে উঠলেন— খুড়োমশাই।
সব ক’টা ভাইই তাঁদের ঘর হাট করে খুলে রাখলেও তিনি কিন্তু তার ঘর সব সময় আটকে রাখতেন। ঘরে থাকলে ভিতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিতেন। আর সামান্য সময়ের জন্য বাইরে গেলেও দরজায় তালা আটকে যেতেন। তাঁকে তখন ভাই-ভাইবউরা খেতে-পরতে দিলেও তাঁর মনে হতে লাগল, কেউ যেন তাঁকে ঠিক মতো কদর করছে না। তাঁকে মানুষ বলে মনে করছে না।
এর পরেই হঠাৎ একদিন সবাই দেখল, চোস্ত-পাঞ্জাবি পরে সক্কাল সক্কাল তিনি বেরোচ্ছেন। হাতে একটা বালিশ। তাঁকে ও ভাবে যেতে দেখে কে যেন বলে উঠেছিল, কই যাও গো খুড়োমশাই?
উনি বলেছিলেন, কই আর যামু? যাওয়ার জায়গা তো একটাই। চুলার দুয়ার।
— এ সব কথা বলতে নেই গো খুড়োমশাই। হাতে ওটা কী?
— শকুনের চোখ ঠিক ভাগাড়ের দিকে, না? দেখতাছিস না বালিশ…
— সে তো দেখছিই। কিন্তু বালিশ নিয়ে যাও কই?
— তোর হাউড়ির কাছে।
— আমার শাশুড়ি তো অনেক দিন আগেই স্বর্গে চলে গেছে গো…
— আমিও তো সেখানেই যাচ্ছি।
না। সে দিন সারা দুপুর আর বাড়ি ফেরেননি উনি। ফিরেছিলেন সেই রাত্রে। রাত্রেও কিছু দাঁতে কাটেননি। সারা দিন কোথায় ছিলেন, কী করেছিলেন, কী খেয়েছিলেন কাউকেই কিছু বলেননি। তবে তার পর থেকেই তাঁর হাতে দেখা যেতে লাগল সেই বালিশটা। বালিশ নিয়ে তাঁর আদিখ্যেতা দেখে প্রথম প্রথম সবাই হাসাহাসি করলেও কিছু দিন পর থেকেই অনেক বলতে শুরু করল, হয়তো সারা জীবনের সঞ্চয় উনি ওটার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন। তাই যক্ষের মতন সারাক্ষণ ওটাকে আগলে রাখেন। কিন্তু আগলে রাখলেও উনি আর কত দিন! বয়স তো কম হল না! কবে দুম করে চোখ বুজবেন, কোনও ঠিক আছে!
চোখ বুজলে কে পাবে ওটা! কাকে দিয়ে যাবেন উনি! পেতে গেলে তো ওঁর মন জয় করতে হবে। উনি যা খেতে ভালবাসেন, তা ওঁর মুখের সামনে এগিয়ে দিতে হবে। দরকার হলে তাঁকে আদর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে উনি যে টিভি সিরিয়াল দেখতে পছন্দ করেন, নিজেদের ভাললাগা-মন্দলাগা জলাঞ্জলি দিয়ে সেটা খুলে দিতে হবে। ইদানীং ওঁর খুব চাকুমচুকুম খাওয়ার জিভ বেড়েছে। প্রয়োজন হলে সেই মতো আইসক্রিম, বনকুল… না। দোকান থেকে নয়, পাতি হজমিওয়ালার কাছ থেকে হজমিমাখা, চালতার আচার এনে দিতে হবে। এবং সবথেকে যেটা বড় কথা, সেটা হল— ওঁর কোনও কথাতেই রাগ করা চলবে না। যত কষ্টই হোক, যত বিরক্তই লাগুক, ওঁর মুখের উপরে ‘না’ বলা চলবে না। ইচ্ছে না করলেও ওঁর মন জুগিয়ে চলতে হবে।
প্রত্যেকটা ভাইয়ের ছেলেমেয়েই তাঁকে তোয়াজ করে চলতে লাগল। শুধু তোয়াজ নয়, তোয়াজের যেন বন্যা বয়ে যেতে লাগল। এ এটা করে তো, সে সেটা করে। কে কাকে টেক্কা দেবে, তা নিয়ে যেন অলিখিত কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল। খুড়োমশাই নিজেও টের পেতে লাগলেন, নিজের ছেলেমেয়ে থাকলেও এমন সেবা বুঝি তাঁকে কেউ করত না। দারুণ সুখে আছেন তিনি। তিনি যত সুখে আছেন, ঠিক ততটাই অ-সুখে আছে বাকিরা। কেউই আন্দাজ করতে পারছে না, ওই বালিশের ভিতরে ঠিক কত ভরি সোনা আছে। কত হিরে-জহরত আছে। কত জমিজমার দলিল আছে এবং নগদ কত টাকা আছে। তবে, যা-ই থাকুক না কেন, সেটা যে খুব একটা কম নয়, এ ব্যাপারে বাড়ির প্রায় সকলেই নিশ্চিত।
এমন সময় দিন কয়েকের জন্য এই বাড়ির মেজ ছেলের সেজ মেয়ে ঘুরতে এল তার বাবা-মায়ের কাছে। সঙ্গে তার ছোট মেয়ে চম্পা। সামনের বার নাকি উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। যেমন ছটফটে, তেমনই মিশুকে। তেমনই আবার বাচাল। কোনও কথা পেটে রাখতে পারে না। হড়হড় করে বলে দেয়। সব সময় তার মুখে যেন কথার ফুলঝুড়ি ফুটছে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ব্যস, তার মধ্যেই সে খুড়োমশাইয়ের এমন নেওটা হয়ে গেল যে, তা আর বলার নয়। সে আগেই মায়ের কাছে শুনেছিল ওই বালিশের কথা। এখন স্বচক্ষে সেটা দেখে সে বলেই ফেলল, এর মধ্যে কী আছে গো? খুড়োমশাই তো কিছুতেই বলবেন না। মেয়েও তেমনই নাছোড়বান্দা। অবশেষে প্রায় আধঘণ্টার পীড়াপীড়িতে খুড়োমশাইয়ের মুখ থেকে সে বের করে ফেলল, ওই বালিশের মধ্যে কী আছে…
যদিও সেটা বলার আগে খুড়োমশাই বারবার করে বলে দিয়েছিলেন, আমি তোকে যা বললাম, তুই কিন্তু এটা আর কাউকে বলিস না, কেমন?
উনি বারণ করলে কী হবে, বরং উনি বারণ করেছেন বলেই হয়তো ওর মনের মধ্যে যুদ্ধ জেতার একটা দম্ভ কাজ করছিল। এত দিনেও কেউ যেটা করতে পারেনি, মাত্র কয়েক ঘণ্টার চেষ্টাতেই ও সেটা করে ফেলতে পেরেছে। আর সে যে এটা পেরেছে, সেটা জাহির করার জন্যই জনে জনে সে বলে বেড়াতে লাগল, একটা কথা বলছি শোনো, কাউকে কিন্তু বোলো না। খুড়োমশাই আমাকে পইপই করে বলতে বারণ করে দিয়েছেন, আমাকে শুধু বিশ্বাস করেন বলেই বলেছেন। আমিও তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই বলছি, খুড়োমশাইয়ের ওই বালিশের মধ্যে না… অনেকগুলো মোহর আছে।
মোহর! তার মানে, যাঁরা ওঁকে দত্তক নিয়েছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর পরে ওই বিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিকারী হওয়ায় তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল, যতই ওঁরা লিখে দিয়ে যান না কেন, ওই দম্পতির নিকট আত্মীয়রা নিশ্চয়ই এটা ভাল চোখে দেখছেন না। তলে তলে হয়তো নানা রকম ষড়যন্ত্র করছেন। তাই তিনি কৌশল করে বিশাল সম্পত্তি হাতিয়ে রাতারাতি সব ক’টা ব্যবসাকে চৌপাট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অত সম্পত্তি তো একদিনে সরিয়ে ফেলা যাবে না। তাই সেটাকে খুব ছোট আকার দেওয়ার জন্য উনি এই মোহরগুলো কিনেছিলেন।
চম্পার মুখ থেকে বাড়ির লোকেরা, বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে পাড়াপ্রতিবেশীরা, পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে গোটা গ্রাম, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। আর এ খবর যে-ই শুনল সে-ই লাফিয়ে উঠল। এবং বলল, শেষ পর্যন্ত তা হলে উনি স্বীকার করলেন! অবশ্য স্বীকার না করেই বা উপায় কী! উনিও তো বুঝতে পারছেন, উনি মুখে না বললেও সবাই টের পাচ্ছে ওই বালিশের মধ্যে কী আছে। ফলে বাধ্য হয়েই উনি বলেছেন।
আর যেই এটা বলেছেন, ব্যস। অমনি খুড়োমশাইকে সেবা করার জন্য যেন সবাই উঠেপড়ে লেগেছে। এমন সেবার ধুম যে, খুড়োমশাইয়ের প্রাণ যায় যায়। প্রত্যেকেই বলতে লাগল, আমি জানতাম ওটার মধ্যে এ রকমই কিছু একটা আছে। না হলে খুড়োমশাই ওটাকে ও ভাবে কখনও আগলে রাখেন!
কিন্তু মোহর থাকলেও ওটার মধ্যে ঠিক ক’খানা মোহর আছে! এটা নিয়ে সকলেই বেশ চিন্তিত। চিন্তিত আর একটা বিষয় নিয়েও— উনি কি মরার আগে কোনও একজনকে বালিশটা দিয়ে যাবেন, না কি সবাইকে ডেকে বলবেন, এখানে যা আছে, তোরা সবাই মিলে ভাগ করে নে। না কি নিজের মর্জি মতো কাউকে বেশি কাউকে কম, এই ভাবে ভাগ করে দেবেন! আর উনি যদি ভাগ করে দেওয়ার মতো অবস্থায় না থাকেন কিংবা কাউকে দেওয়ার আগেই যদি চোখ বোজেন, তখন!
সবাই তক্কে তক্কে আছে ওঁর কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। না। কেউই কাউকে একা কিছু নিতে দেবে না। যে ক’টা মোহর আছে, সবাই ভাগ করে নেবে। উনি তো আর বোকা নন, নিশ্চয়ই মাথা পিছু একটা হিসেব করেই রেখে যাচ্ছেন। আর তা যদি নাও রেখে যান, তা হলে যে ক’টা মোহর পাওয়া যাবে, তা বিক্রি করে সেই টাকা সবাই মিলে সমান ভাগে ভাগ করে নেবে।
কেউ কেউ এটা বললেও, কেউ কেউ আবার এর-ওর সঙ্গে শলাপরামর্শও করতে লাগল। মেয়েদের তো বিয়ে হয়ে গেছে, তারা কেন ভাগ পাবে? কেউ বলল, বড়দার তো প্রচুর টাকা। ও আবার এটায় ভাগ বসাবে নাকি? কেউ বলল, দ্যাখ, আমার দুটো ছেলেই তো বেকার, আমরা কথাটা একটু মাথায় রাখিস। আমার মনে হয়, ফোকটেই যখন পাচ্ছি, যার অবস্থা যত খারাপ, তাকে তত বেশি টাকা দেওয়া উচিত।
রোজই এ সব নিয়ে চলছে। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করে আছে কী হয় কী হয়! না। কারও চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই খুড়োমশাইয়ের অসুস্থতা নিয়ে নয়, ঘুম নেই খুড়োমশাইয়ের কিছু হলে ওই বালিশের কী হয়, তা নিয়ে। উনি আবার কোনও উইলটুইল করে যাননি তো!
অবশেষ খুড়োমশাই একদিন সত্যি সত্যিই চোখ বন্ধ করলেন। করলেন মানে চিরদিনের জন্যই করলেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন সব ক’টা ভাই, ভাইবউ, ভাইপো-ভাইঝি, নাতি-নাতনি, এমনকী মেয়েরাও। সবাই খুড়োমশাইয়ের ঘরে গিয়ে ভিড় করল ঠিকই, কিন্তু কেউই খুড়োমশাইয়ের দিকে ফিরেও তাকাল না। সবার চোখ তখন ওই বালিশটার দিকে। সবারই এক কথা, আগে বালিশটা খোলো। ভিড়ের মধ্যে কে যেন ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে গিয়েছিল, আগে দাহটা সেরে এলে হত না…
না! কে যেন বেশ জোরের সঙ্গেই ধাতানি দিয়ে উঠল। প্রত্যেকেই একবাক্যে বলল— না।
অবশেষে সবার সামনে বালিশটা খুব সন্তর্পণে, আস্তে আস্তে ব্লেড দিয়ে চেরা হল। এত যত্ন করে চেরা হল, যাতে বালিশের খোলের গায়ে সামান্যতম আঘাত লাগলেও, ভিতরে যদি তুলো থেকে থাকে, সেই তুলোর গায়ে যেন না লাগে। না। এতটুকুও আঘাত লাগল না। আঘাত লাগল, ওখানে উপস্থিত থাকা, বালিশের ভিতর থেকে কী বেরোয়, তা দেখার জন্য বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকা ভাই, ভাইবউ, ভাইপো-ভাইঝি, নাতি-নাতনি, এমনকী বোনদেরও। সবাই দেখল, না। মোহর নয়। বালিশের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সাদা রঙের একটা লম্বা মতো খাম। খামটার মুখ আঠা দিয়ে আটকানো। সেটা খুলতেই বেরিয়ে এল ভাঁজ করা এ-ফোর সাইজের ধবধবে একটা পাতা। আর তাতে বিশাল বড় বড় হরফে কালো কালি দিয়ে কমপিউটারে লেখা দু’টি শব্দ— কেমন দিলাম?
লেখাটা দেখা সবাই একটাই হতাশ হল যে, কারও মুখে আর কোনও কথা ফুটল না। সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল।