গল্প: দংশন

গল্প: দংশন

দংশন
শামীমা সুলতানা

আলমারির তিন নাম্বার তাক খুলতেই কেমন একটা ঝাঁঝালো গন্ধ বেরিয়ে আসে।সে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড।রাগটা রাঙা রোদের মতোই তেতিয়ে ওঠে আমার।মূর্খ আহম্মক মেয়ে মানুষটা এখানে যে কী রেখেছে! কোনভাবেই রেহাই দিলনা আমায়। অশান্তির বীজ বুনে রাখছে চারপাশ। জীবনটা তাওয়ায় ভেজে কটকটে করে দিয়েছে।আরো কতোকিছু যে দেখতে হবে আমায়।হ্যাচকা টানে ফেলে দেই তাকের সব।

গত মাসের তিন তারিখে আপদটা চলে গেল। হ্যাঁ, চলেই গেল। যেকোন কারণেই কিছুটা যাতনার উত্তাপ জ্বালা জ্বলছিল,তবে মুক্তির স্বস্তিতে বুকের ভেতর চড়ুই ঝাঁক উড়ছিল।কবে থেকেই মিতুকে ঝুলিয়ে রেখেছি।আজ কাল করে করে প্রায় দুটো বছর।মিতুও ধৈর্যের ছিপি খুলে অস্থির করে তুলছে রাত-দিন।অবশ্য মিতুর ওই অস্হিরভাব দেখতে আমারও বড্ড বেশি ভালো লাগে।ওর ছেলেমানুষী কর্ম আমায় জাগিয়ে তোলে পুরোদমে।ঝপাৎ করে ঝাপ দিতে চাই ওর উষ্ণ জলে।উফ!ওর মাঝে কী একটা আছে।আমাকে বয়স কমিয়ে দেয়,তারুণ্য বাড়িয়ে দেয় বিশের কোঠায়।

যাই হোক,আজ পনেরো দিন।

মিতুকে কথা দিয়েছি ঠিক একমাস দশদিন পার হলেই তোমার আমার বিরহের অবসান হবে গো কইতুরি। তারপর তুমি আর আমি মিলে একই ছাদের তলে একই লেপ তোশক বালিশে বাকুম বাকুম করবো দুজন।
আগে কথা রাখো।তারপর আদিখ্যেতা কইরো–মিতুর ঝামটা দেয়া তাচ্ছিল্যটা বুকে গেঁথে আছে শিলের মতোই। ওকে পাওয়ার জন্যে তীর বেঁধা সারসের মতো ছটফট করছি সে কথা কাকে বলি। ওরে মেয়ে মানুষ!তোর অবুঝ হৃদয় আমায় চিনলো না আজও।
যেকোন মূল্যে মিতুকে দেয়া কথা রাখতেই হবে তাই তোড়জোড় করে গুছিয়ে নিচ্ছি চারপাশ।

আমি জিহান। বড্ড অসুখী আর বিদঘুটে জীবন শেষ করে অবশেষে মুক্তির আস্বাদে উড়ছি পেখম খুলে।শুনেছি পুরুষ ময়ূর প্রেমিকাকে খুশি রাখতে নৃত্য করে।আমি শুধু নৃত্য নয় উড়ছি, ভাসছি,উদ্ভ্রান্ত হাসছি।

সে কথা কী আর বলবো,আমার উড়নচণ্ডী দশাকে দমন করতে মা তোড়জোড় করে বেঁধে ফেললো আমাকে।তখন আমার সবেমাত্র জীবন শুরু।আর শুরুটাই বোকামির বাক্সে ঢুকে পরা।ওখানে উল্লাস নাই, চমকে যাওয়ার মতো চমক নেই, রঙচঙে সাজসজ্জা নাই। আছে একটা সেকেলে গোছের শরীর।দাসত্বের মানসিকতার একপুটলি কাপড়। বাসর ঘরে ঢুকেই আমি আঁতকে উঠি।ফাঁস লাগানো দড়ির থেকে মুক্তি পেতে কতো কি-ই- না করেছি। যত হাঁসফাঁস করছিলাম ততটাই আটকে যাচ্ছিলাম।যাতনার যতো রকম কসরত করার করেছি।অবহেলার বিষবৃক্ষ রোপণ করেছি রাতের পর রাত। নীলুকে দেখলেই গা গুলিয়ে যেতো।তবুও রেহাই দেয়নি আমায়।ততদিনে অবশ্য মিতুকে পেয়ে যাই। আমরা দুইজন দিনভর পাশাপাশি ডেস্কে কাজ করি,বিকেলে বেরিয়ে পড়ি হাত ধরে। আমাদের উন্মাদনা টগবগে।কৌতূহল আর তারুণ্য ফুটছিল দুইজনের। আমরা চড়ুইজীবনের সুখ খুঁজি ক্ষণে ক্ষণে। লুকিয়ে রাখা যায় না যৌবনের স্ফুরণ।গোপনীয় পরিণয় আর কতো?
তবু্ও মায়ের মুখ রক্ষা করতে ঘরে ফিরি।
ঘরে ঢুকলেই পায়ে হাত দিয়ে জুতা খোলে নীলু।শার্ট খুলে দিতে আগ বাড়ায়।ওহ! অসহ্য লাগে সব।এই সরে দাঁড়াও,তুমি কী বাদীর প্রাকটিস করে আসছো? তুমি এসব করে আমাকে কী বোঝাতে চাও।চাষাভুষা কাপড়ের পুটলি কোথাকার!চুপচাপ চোখ মোছে।মায়াবী অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।আমার তাতে কী?ওই দৃষ্টিতে আমার জাহান্নাম দেখি।আমি চাই হুরি মিতু!আহা!কবে যে পাবো!

একদিন মা জোর করে তার বউমাকে আমার সাথে ঘুরতে পাঠায়। যতো কিছুই করি, মাকে কষ্ট দিতে পারিনা।শত অন্যায় করি আর যা কিছু সব বাইরে। ঘরে আমি মায়ের আঁচল জড়ানো সুবোধ সন্তান। তাই ঢেঁকি গেলা অনুরোধ রাখতে হয়।আমার সাথে ঘুরতে এসে নীলুর সে কী আহ্লাদ!শরীরে লেপ্টে থাকে জোঁকের মতোই।প্রথমে রক্ত চোষা মনে হলেও ধীরে ধীরে অনুভুতিতে মিশে যাই।ওর শরীরের কেমন এক কমনীয় কোমলতায় আমিও ভাঙতে থাকি মনে মনে। সেদিন পার্কে হাঁটতে হাঁটতে কেমন একটু নরম হয়ে পড়ি ওই সরলতার।একগোছা বকুলের মালা কিনে ওর খোঁপায় গুঁজে দিয়ে চুলের ঘ্রাণ শুখে তৃপ্তি পাই। কাঁচের চুড়ি কিনে হাত দু’টো ভরিয়ে দেই।আমার আজলা ভরা আদরে ওর খুশি দুই চোখে।তারপর নিয়ে যাই শপিংয়ে।একটা লাল জমিনের সোনালী পাড়ের শাড়ি কিনি।তারপর দুজনে সিনেমা দেখি।পুরা তিন ঘন্টা ওর রাঙা হাত জড়িয়ে রাখি বুকে।আনন্দে ওর চোখ ছলছল করছিল।
সে রাতে কী সুন্দর লাগছিল ওকে।শিমুল ফুলের মতো টুকটুকে লাল পরী,পলাশ রাঙা ঠোঁট,পিঠ জুড়ে একরাশ কালো কেশ নিতম্বে ঝুলছিল। আমি যখন ওর হাতটা ধরে কাছে টানি থরথরে কাঁপছিল নীলু।সহসাই ভেঙে পরে বুকে।আমিও বদলে যাই।নাকি সেটা ছিল পুরুষের কামুকতা?সে যায় হোক ওটাই ছিল আমাদের দুজনের একমাত্র রজনী।আমার শরীরের উষ্ণতা নীলুর জন্যে ওটাই প্রথম ওটাই শেষ।সে রাতে প্রথম সে পুরুষ চেনে। তপ্ত নিশ্বাসে প্রথম পরিচয় প্রথম প্রণয় । মনে পড়ে, আপ্লূত নীলু আমার বুকে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদেছিল।সে কান্না সুখের স্রোতের। মনে মনে ঠিক করি নীলুকে গুছিয়ে নেবো আমার মতো করে। নতুন করে সাজিয়ে নেবো,রাঙিয়ে নেবো। ওর কুসুম জলে উষ্ণতার ওম দেবো। শেখাবো প্রেম,ফোটাবো কলি,সোহাগে জাগিয়ে তুলবো ঘুমন্ত নারীকে।

জানি না কেন পারলাম না।

আমি পারি নাই।বরং সেই সকাল থেকে আরো বেশি ঘৃণা ঢালি আরো বেশি বিষ দৃষ্টি ফেলি নীলুর দিকে।আরো বেশি বজ্রাঘাত করি।সেই রাতের স্পর্শগুলো কাঁটার মতোই ফুটছিল নীলুর শরীরে।

আর আমি শাওয়ারে ধুয়ে ফেলতে চাই সেই রাতের স্মৃতি ।গরম জলে স্নান করি দীর্ঘ সময়।এতো ঘৃণা! গুলিয়ে যাচ্ছিল শরীর। বেশ কিছুদিন বাসায় ফিরিনা আমি।মাকে বলি ট্যুরে যাচ্ছি।আমি আর মিতু তখন অভিসারে।কক্সবাজার বেলাভূমিতে আমাদের দুই জোড়া পা আনন্দে হাঁটছে ।কাটছে বালুতে মাখামাখি সময়।রাতের তাঁরার সাথে আমরা ডুবি ভাসি।আহা!হিরন্ময় সময়।

আমি নীলুকে পুরুষ চেনাই, উষ্ণতার সুখ চেনাই।এখন সে উপভোগের সুখ চিনতে পারা নীলু। প্রতিক্ষণ আমার ভালোবাসায় ভাসতে চায়। আমি ততটাই ঘৃণা ছড়াই ।

এই আঘাত সইতে পারে নাই নীলু।প্রতিরাতে তার পাড় ভাঙে,প্রতিদিন ধসে পরে ধৈর্যের জমিন।পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগে আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল।ওর দুই চোখে ছিল অশ্রু। আমি তখন মুক্তির পথ খুঁজছি। তাই অশ্রুকে ভেবেছিলাম গহীন সমুদ্রের কান্ডারি।পার হয়ে আমি কূলে ভিড়তে চাই। ওপারে মিতু আমার অপেক্ষায় আছে ফুলকুঞ্জ সাজিয়ে।

মিতুকে অভ্যর্থনা জানানোর পুরো প্রস্তুতি চলছে।বাসার আনাচে কানাচে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে নীলুর চিহ্ন যা খুঁজে পাচ্ছি ধুয়ে মুছে সাফ করছি দক্ষ হাতে।
সবশেষে,
আলমারির তিন নাম্বার তাক। হ্যাঁ, আলমারির তিন নাম্বার তাক।যে তাকে চোখ রাখি নাই কস্মিনকালে। যে তাকে অবহেলার বিষ ঢেলে ঢেলে ডুবিয়ে মেরেছি সুখ স্বপ্নের বাসর। যে তাকে দীর্ঘ শ্বাস জমেছে বিগত দুইটি বছর।যে তাককে ভেবেছি আমার সর্বনাশ,সেই তাকেই কিনা এক সমুদ্র অশ্রু জলের বসবাস!

সেখানে যক্ষের ধনের মতোই সঞ্চিত আছে কাঁচের চুড়ি, শ্যাতলা পড়া বকুলের শুকনো মালা, রঙচটা নুপুর আর সেই শাড়ি।সেই শাড়িতে সঞ্চিত ছিল নীলুর দুঃখ যন্ত্রনা বিরহের অষ্টপ্রহর।বিষণ্ন বিকেলের ধোঁয়া ওড়া এককাপ চা।রাতের গভীরে নিঃশ্বাসের তপ্ত হাওয়া।দরজায় উঁকি দেয়া একজোড়া ক্লান্ত চোখ।

আমি মিতুকে ছুঁতে পারিনা আর। আমার সর্বাঙ্গে এখন নীলুর বসবাস। ওই ঘ্রাণ ওই সুখ পেতে আমি প্রতিরাতে ঘরে ফিরি।আলমারির তিন নাম্বার তাক প্রতি রাতে জেগে ওঠে জীবন্ত নীলু হয়ে। প্রতিটি রাতে আমি নীলুকে পুরুষ চেনাই। নীলু আমার প্রেম,প্রিয়তম প্রেয়সী। আমাকে শপে দেয়া নীলুর স্বত্তাকে বুকে চেপে ভালোবাসার খেলা খেলি। এক শরীরে আমরা দু’জন।

দংশন যাতনার সুখ কুড়াই।