পল্লব রায়ের কবিতা

বিরহ মঙ্গল
এভাবেই একটু একটু করে
সরে যেতে পারো আলোকবর্ষ দূরে,
মাড়িয়ে যেতে পারো ফুলেল আঙিনা, বহতা নদীর উচ্ছ্বল কলতান
মাড়িয়ে যেতে পারো পাহাড়, পাথরের হৃদয় বিদীর্ণ করা গলিত চিৎকার,
নিমিষেই ছেড়ে যেতে পারো নীলাক্ষার সবটুকু নীল
কিংবা আমার দৃষ্টির সীমানা
শূন্যতার ওপারে গড়ে নিতে পারো সুখী দাম্পত্য।
কিন্তু যে তুমি জড়িয়ে আছো আমার সুদীর্ঘ রাতের বিনিদ্রতায়
যে তুমি মেখে গেছো আশাহত আঙুলের ডগায়
যার সোনালি ফলজ বুকের সোঁদা গন্ধে মোহিত আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস
যার নামে হৃদয়ে আবাদ করেছি এক পৃথিবীর সবটুকু দীর্ঘশ্বাস
সেই তুমি-
চাইলেই এই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
কারণ, তোমার বিরহ কেবলি বিরহ নয়-
তোমার আরও গভীরে যাবার;
তোমাতে আরও একনিষ্ঠ হবার প্রেরণা।
আমিও বৃক্ষের মতো
শেষ পাখিটাও পালক ঝেড়ে উড়ে গেছে-
বহুদূর শূন্যতায় ফেলে রাখা চোখে- শিশির জমেছে ধীরে,
ডুকরে কেঁদেছে ডাহুক,
বাকলে লুকিয়ে যত হাড়ের ক্ষত;
আমারও চেতনাগুলো অন্ধকার ভূক গাছেদের মতো মৌন মুখর,
সবুজ ঝরে গেছে নৈঃশব্দে, গোপনে ক্ষয়ে গেছে একা হবার দুঃসাহস।
দীর্ঘশ্বাসের লালাতুর জিহ্ব, এঁটো করে ফেলে গেছে মন
আমার শাখায়-পাতায় ধুঁ ধুঁ বেদনা নূপুর পায়ে
নেচে গেছে অকথ্য প্রলয় নাচন।
আমাকে ডেকে নেয়নি কেউ
যে হাত নির্ভরতা দিয়েছিল মুঠো শক্ত করে-
সে হাত, বেছে নিয়েছে অন্য আলোর ঢেউ;
আমাকে ডেকে নেয়নি কেউ!
দিবসের শেষ ফোঁটা রোদ, ডুবে গেছে কাকচক্ষু কাজলে অতলে
ডানায় পরাগ মেখে উড়ে গেছে মধুখোর মক্ষির দল
বিষাদ নেমেছে ঘোর মাঠে মাঠে কামনার হলুদ বাসরে।
হৃদয়ের সবকটি তোরঙ্গ খুলে উলোট-পালোট করে দেখেছি-
তুমিও কোনো পথের সংকেত রেখে যাওনি;
খুব পরিচিত এই বুনো অন্ধকারে!
নগ্নতার মৌতাত
তোমার নগ্নতাকে
আমার জন্ম-মৃত্যুর মতো সুন্দর বলে মানি
তুমি নগ্ন হলেই দক্ষ শিল্পী হয়ে ওঠে আমার দুটি হাত।
তোমার ঠোঁটের তীক্ষ্ণ লাঙলে আবাদ হলে উদোম চিবুক,
আমিও শস্যের বীজ হাতে ছুটে যেতে পারি ঠা ঠা রোদে পুড়ে যাওয়া মাঠে,
বীর্যবতী করে তুলতে পারি সঙ্গমে উন্মুখ খড়খড়ে মাটি।
তোমার বেহায়া আঙুল যদি গোপন কথার চিতায় জ্বেলে দেয় প্রণয় আগুন
তোমার নামে উৎসর্গ করতে পারি প্রতি ফোটা ঘাম ও পুলকিত খুন।
তোমার মৃদু কম্পিত সুডৌল স্তনে কান পাতলেই
যদি শুনতে পাই মহাজীবনের ওঙ্কার
দুহাতে অন্ধকার নিংড়ে আবিষ্কার করতে পারি কাঙ্ক্ষিত আলোর আঙুল,
তোমার খোলা চুলের সুগন্ধে যদি মাতাল করে দাও বুকের হাঁফর বন্দি বন্য বাতাস
তোমার নাভীতে কিংবা যোনিতে লুকানো পুথি
তর্জমা করে বলে দিতে পারি-
মানুষ কিংবা প্রেমিক সৃষ্টির ইতিহাস।
জন্ম নেবার খেলায়,
তুখোড় প্রেমের মন্ত্রে
তোমাকে জাগিয়ে রাখতে পারি সুদীর্ঘ রাত!
তুমি যদি আমার প্রেমিকা হও !
তুমি যদি আমার প্রেমিকা হও-
তোমার বিষাদের অরণ্যে বন কোকিলের হৃদয় বিদীর্ণ করা চিৎকার হবো
মৃতপ্রায় বৃক্ষের গতরে ঢেলে দেব পিরিতের টগবগে ওম
আমাদের চুম্বনগুলো ফুল হয়ে ফুটবে, আমাদের চুম্বনগুলো পাখি হয়ে উড়বে;
বাতাসে ছড়িয়ে দেব বেপরোয়া প্রেম
বাতাসে ছড়িয়ে দেব প্রণয়ের আঘ্রান
আদরে গলিয়ে দেব ব্যথার পাষাণ, আদরে ফোটবো চোখে রক্ত শিমুল।
তুমি যদি আমার প্রেমিকা হও-
তোমার বেহায়া ঠোঁটে ঠোঁট রেখে লিখে দেব মুক্তির উদ্যত রক্তস্লোগান,
তোমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখবো মন্থনে;
তোমাকে সারারাত মাতিয়ে রাখবো নির্মাণে।
প্রতি ইঞ্চি মাটিতে এঁকে দেব ফসলের নকশা, ছিঁড়ে দেব সব পিছুটান।
তুমি যদি আমার প্রেমিকা হও-
তোমাকে বেপরোয়া ছোঁবো, তোমার নিসাড় পাহাড় নিংড়ে বেরিয়ে আনবো নদী,
বেরিয়ে আনবো উচ্ছ্বল ঝরনার কলতান,
তোমাকে ডানায় বেঁধে নিয়ে উড়ে চলবো আকাশ থেকে আকাশে
মাতাল নাবিক হবো, গভীর সমুদ্রে ভাসাবো হৃদয়ের
সাম্পান।
তুমি যদি আমার প্রেমিকা হও-
তোমাকে কাগজ করে লিখবো- আদিম আঙুলের শাশ্বত আখ্যান।
মৃত্যুর মৌসুম
এখন মৃত্যুর মৌসুম
মনে ও বনে দারুণ বন্য বাতাসে উড়ছে বেদনার উত্তরীয়
মৃত্যুর ফরমান হাতে নিয়ে-
তোমার চোখের মতো অলৌকিক, ঈশ্বরের ক্ষয়িষ্ণু চোখ
আমাকে শাসিয়ে যাচ্ছে অবিরত,
আমাকে বাধ্য করছে, বেয়াদব সংস্কারের পেয়ালায় চুমুক দিতে।
তবু আমি বিচলিত নই দুঃখে,
তবু আমি ভেঙে পড়িনি, ছিটকে পড়িনি কোনো আঘাতে অলক্ষ্যে।
কারণ আমি জেনে গেছি-
মৃত্যুই পরিত্রাণের একমাত্র উপলক্ষ নয়;
বয়সী সময় বৃক্ষ হতে খসে পড়া প্রতিটি পাতার মর্মরে
লেখা থাকে নব জীবনের উত্থান।