মানিকরতন শর্মার অণুগল্প

মানিকরতন শর্মার অণুগল্প

বে- দখল

ঢাকার মোহম্মদপুরের আদাবরে চাকরি করে মন্থন। রাত-দিন খেটে যায়। যখনি টেক্সিতে ওঠে কিংবা ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ায় তখনি কী যেন খোঁজতে থাকে সে। প্রজ্জ্বলিত বোধের দুচোখ মেলে শুধুই দেখে যায় ঢাকাকে। কাম-মায়াবী ঢাকাকে তার কাছে রহস্যময় লাগে। নিঃশ্বাসে ধেয়ে আসে পোড়া মবিলের ঢেউ। পাকস্থলিতে জমা হয় কষ্টের ধুলোবালি। পার্কগুলোতে কতগুলো কীটের দৌরাত্ম্য দেখে সে। শাহাবাগ, টিএসসি আড্ডাবাজদের মগজে খেলে কেবল সিঁড়ি ওঠার প্রতিযোগিতা। তেলেসমাতি তেলে সাঁতার কাটে ওরা। দু’দিন আড্ডা দিয়ে বুঝেছে মন্থন। ভাল্লাগে না তার। কিন্তু যতক্ষণ আছে ততক্ষণই বাজপাখির চোখ মেলে রাখে সে। হয় তো মিলেও যেতে পারে একদিন। এক সময় সিসার ঢাকায় হাফিয়ে ওঠে।
ঝলমলে সন্ধ্যার অন্ধকার। এলএডির ঝলকানো আলোতে ছুটছে কতকগুলো ফ্যাকাশে মুখ। হঠাৎ মুখোমুখি সিটে বসে সে। মেয়েটি বসতেই বুক ধরপর ধরপর করতে থাকে। আসলে কী সে! বিশ্বাস করতে পারে না মন্থন। সেই চোখ সেই কাঁচাসোনা বর্ণ। যাকে একদিন দেবদারু ছায়ায় হারিয়েছিল। মুহূর্তে চেনা গল্প দৃশ্যপটে এগিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর সামনের স্টেশনে নেমে যায় মেয়েটি।
পরদিন বাড়ি ফেরার তাগাদায় ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে ওঠল মন্থন। সিটে বসতে গিয়ে দেখে এয়ারফোন লাগিয়ে সানগ্লাসওয়ালী এক তরুণী বসে আছে। মন্থনকে দেখে বলল, ভাইয়া সরি, স্টেন্ডিং টিকেট।
মন্থন জানালার ওপাড়ে ছুটে চলা ঘনকুয়াশার আকাশটা দেখে। আর ভাবে এভাবেই বুঝি জীবনের সিটটিও বে-দখল হয়ে যায়।

প্রত্যাগমন

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বদলী হল রজত আলী। শহরের নিকট স্কুল। উদ্দেশ্য তিন সন্তানকে মানুষ করবে সে। কলেজ পেরুতে না পেরুতে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। ছেলে শান্তশিষ্ট, চুপচাপ স্বভাবের। বাবা-মাকে যথেষ্ট মান্য করে। নাম রবিন। ছোট্ট মেয়েটা গালর্স হাই স্কুলে পড়ে। সুখ আর স্বপ্নের পথ ধরে এগিয়ে চলে রজত আলীর সংসার।
শহরের সংস্কৃতি ও জীবনধারা খুবই ফাস্ট। মিলাতে পারে না সে। মূলত ছেলে-মেয়ের সুবিধার জন্যই গ্রাম ছেড়ে আসা।
রবিন এসএসসিতে জি-৫ পেয়েছে। মা-বাবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। নামাজে বসে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করেছে ওরা।
কলেজের কড়িডোর যেন নীল আকাশ। স্বপ্নের ডানা আরো প্রসারিত হতে থাকল তাঁর। নিত্য-নতুন বন্ধু জুটতে থাকে। শান্ত রবিন হঠাৎ উল্টে গেল। অচেনা এক বদমেজাজী রবিনকে দেখতে পেল পরিবার।
পরন্ত এক বিকেলে বন্ধুদের সাথে বেরুবে বলে ঝটফট বেরিয়ে যায় সে। মা ভয়ে ভয়ে দু’বার বলতে গিয়ে থেমে যায়।
পরদিন সন্ধায় পুলিশের মাধ্যমে জানতে পারে তিনজন বন্ধু মিলে এক মেয়েকে বলাৎকার করেছে সে।
স্বপ্নময় পরিবারটি অকাস্মৎ চোরাবালির খাদে মিশে গেল। কান্নার ধ্বনি বুকের ভেতর উথলে ওঠেছে শুধু। ডুকরে ডুকরে কেবল কেঁদেছে রজত আলী। নির্বাক নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেছে কেবল। কদিন হলো ঘর হতে বেরুতে পারছে না সে। প্রতিবেশীর মুখ, সহকর্মীর চোখ, কার কাছে দেখাবে সে।
হঠাৎ অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে রজত আলীর হালকা স্টোক হয়েছে। মা খোদেজার আঁচল ভেজাই থাকে দিনভর। কারো চোখে চোখ মেলে তাকাতে পারে না সে। কটাক্ষের তীর এসে ছাড়খার করে দিচ্ছে সবকিছু। বোনটির দিকে আঙুল তুলে কেউ কেউ বিষকথা ছুড়ে দেয়।
একদিন কাকডাকা ভোরে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে চুপিচুপি গ্রামের বাড়ি রওনা হয় খোদেজা। নির্বাক রজত আলী। শিশুর মত ফেলফেল করে ঘরের ভাঙা জানালা দিয়ে কী যেন দেখেই যাচ্ছে সে।

আঁধার ভোর

স্বপ্নভাঙা ঘুম নাকি ঘুমভাঙা স্বপ্ন; বিষয়টা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে তরুলতা। ভালোবেসে ছিল যাকে তাকে বুঝতে দিয়েছে ঠিক কিন্তু কখনোই বলেনি । চোখের ভাষায় মন লেন-দেন করেছে শুধু। নিখুঁত সুন্দর তরুলতা। মোহাচ্ছন্ন ছিল অনেকেই। কেবল ধারণ করেছে একজনকেই। যে কিনা অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। জেনে-শোনেই মনে মনে মন অর্পণ করেছে সে। তরুলতা যেমন স্মার্ট তেমনি বুদ্ধিপরিপক্বও। নিজের দায় হতে পরিত্রানের জন্য এক সকালে অশথের ছায়ায় জিজ্ঞাসা করেছিল, প্রণয়ের পরিণতি পরিণয়ে কী সম্ভব! ছেলেটি দীর্ঘশ্বাসের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলেছিল ‘না’।
তরুলতা যে চোখে ওর পুরো সত্তা পাঠ করেছে সে চোখে প্রস্থানও দেখেনিল। কতটা ভাঙলে কখনো কখনো সমুদ্রও নিঃস্ব হয়ে যায়। অকস্মাৎ প্রলুব্ধ আকাক্সক্ষা বিষাদে ছেয়ে যায় তার । তারপর থেকে দীর্ঘ বত্রিশটি বছর হারিয়ে গেল ছেলেটি।
ঐশ্বর্যের ডামাডোলে ঘর করে স্থিত হল তরুলতা। কিন্তু বৈভব তাকে ভুলতে দেয়নি সেই মন পাঠের প্রেমকে। খোঁজতে থাকে পলে পলে। কেউ জানে না, বলতে পারে নি কাউকে। বুকের গহ্বরে কে যেন বারবার ডেকে গিয়েছে শুধু। নিজের মনের কাছে বারবার হোঁচট খেয়েছে। কখনো গানে, কখনো কবিতায়, কখনো গল্পের প্লটে ডুবিয়ে দিয়েছে উচাটন মনকে।
বুকের অন্তকরণে সেই মুখাবয়ব স্বপ্নের বেলা ভূমিতে কেবল হেঁটে বেরায় ।
একদিন আচমকা ভার্চুয়াল দেয়ালে খোঁজে পেল তাকে। তরুলতা যেন নিজেকেই খোঁজে পেল নতুন করে। সেই পুরোনো মনপাঠ, ছেলেটি মুগ্ধ। তরুলতা ভাবে কিছুকিছু বিরহে চন্দ্রজ্যোতি প্রেমও প্রদোষে হাসে।
রাত তখন পৌনে চারটা। স্বপ্নে ভেঙে গেল ঘুম। নিঝুম অন্ধকারে কী যেন খোঁজতে থাকে তরুলতা। মনের কোণে বাজতে থাকে, আঁধার করেছে আবার আমার ভোর।