গল্পঃ আফজল মাস্টারের গল্প

আফজল মাস্টারের গল্প
সালেহা চৌধুরী
ঘটনা যখন মানব আর দানবে যুদ্ধ চলছিল সেই সময়কার।
খাঁদের বাড়ির বাইরের ঘরটা আফজল মাস্টার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সময় কাটানোর ঘর বানিয়ে ছিলেন। খাঁদের দুজন জোয়ান ছেলে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। কোথায়? দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কোথায় গিয়েছে এইসব তরুণ তরুনী এমন কি মধ্যবয়স্ক এবং কখনো বৃদ্ধ। সামনে একটা আগুনোর নদী পার হয়ে কি পেতে চেয়েছিল ওরা। এক রাশ স্বপ্ন একটা বোতলে ভরে ওরা অপেক্ষা করছিল কখন সেইসব স্বপ্ন গুলোকে বোতলের মত মুখ খুলে দিনরাতের সহচর করবে। আহা কি সেই সব দিন। যখন সারাদেশের মানুষ একজন আর একজনের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এমন ঘটনা কেবল হয়েছিল একবার। আবার কি হবে এমন বন্ধুত্ব? কেন হবে না? হবে। সকলে কেবল একজন আর একজনকে ভালোবেসে বেঁচে থাকবে। দেখা হলেই হেসে বলবে Ñ ভালোতো বন্ধু? তারপর বাতাসে উড়িয়ে দেবে বাতাসা। যেখানে নদীরা হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে সাগরে চলে যাবে। ওদের বুকে কেউ ক্রশবিদ্ধ করবে না। আহা! আসবে না এমন দিন ? আসবেই। গাছেরা সবুজ থেকে আরো সবুজ হবে। কেউ ওদের কাটবে না। আর ঘাসেরা গালিচার মত বিছিয়ে রাখবে নিজেদের। রোদ পোড়া ঘাস নয়। টসটসে সবুজ ঘাস। ভাবতে ভাবতে আফজল মাস্টারের চোখ ছল ছল হয়। রুমাল ভেসে যেতে চায়।
স্যার আজ কোন গল্প করবেন? মৌটুসি আর ওর ভাই দিব্য প্রশ্ন করে।
তিনি স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে আসেন। স্বপ্নের বোতল গুলো ছিপি খুলতে পারে না। না পারুক। তবু ওরা নদীতে ভাসছে। ভাসছে। ভাসছে। একসময় ডাঙ্গা পাবে। তখন সবগুলো ছিপি খুলে যাবে। স্বপ্ন তুলোর বলের মত বাতাসে উড়বে। হাত বাড়ালেই স্বপ্ন ধরে ফেলা যাবে। দানা দানা স্বপ্ন মিহিদানার মত চেহারা পাবে। আসবেই সেইসব দিন।
আজ আমি আরিআডনির গল্প করব। আফজাল মাস্টার বলেন। ও কেমন করে থিসিয়াসকে একটা উলের বল দিয়েছিল। যে সুতো ধরে থিসিয়াস মাইনোটরকে মেরে ফেলে। তারপর মেজ চিনে ফিরে আসে সে এক অসাধারণ গল্প।
মাইনোটর দেখতে কেমন ছিল স্যার? মৌটুসি প্রশ্ন করে। এই গ্রামে যতগুলো পরিবার জমা হয়েছিল তাদের কচিকাচাদের নিয়ে আফজল মাস্টার গল্পের আসর করতেন। এর মধ্যে টুকটাক পড়াশুনাও ছিল। সকলে বলে— উনি স্বপ্ন ভাসিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আছেন।
আফজাল মাস্টার কোন উত্তর দিতেন না। এবার মৌটুসির প্রশ্নে বলেন -ওর আর্দ্ধেক শরীর ছিল দানবের মত আর আর্দ্ধেক শরীর ষাঁড়ের মত। ওর কাছে ছেলেপুলেদের পাঠানো হতো। ওকে কেউ হারাতে পারত না। তখন ও সেইসব ছেলেপুলেদের মেরে ফেলতো।
খেয়ে ফেলতো স্যার? কথা প্রশ্ন করে। কথার বোন ছড়া বলে -খেয়ে ফেলতো? না স্যার?
আফজাল মাস্টার এই আসরের সবচেয়ে ছোট গল্পকে কোলে নিয়ে বলতেন – অমনই কিছু করতো।
তারপর কি হলো স্যার? পলাশ প্রশ্ন করে।
থিসিয়াস নামের একজন বীর বলে- এবার আমি যাব ওকে মারতে। থিসিয়াস খুব বড় বীর ছিলেন। আজিয়ান রাজার ছেলে।
আমাদের দেশে এমন বড় বীর আছে স্যার?
এখন সব গুলো মুক্তিযোদ্ধা থিসিয়াসের মত বড় বীর।
তারপর কি হলো?
তারপর আরিআডনি থিসিয়াসকে ভালোবেসে ফেলে। বলে -শোন থিসিয়াস এই নাও উলের বল। যখন মাইনোটরের গোলক ধাঁধায় যাবে এই উলের বলের চিহ্ন রাখবে তা হলে মাইনোটরকে মেরে এই উলের বলের চিহ্ন ধরে ফিরে আসতে পারবে। ওর গোলক ধাঁধায় না হলে হারিয়ে যাবে। পথ খুঁজে পাবে না।
কথা ওদের মধ্যে একটু বড়। কথার বয়স বারো। সে একটা আশ্চর্য প্রশ্ন করে – স্যার মুক্তিযোদ্ধাদের কেন এখন আরিআডনির মত কেউ উলের বল দেয় না?
তিনি একটু ভাবেন। তারপর কথাকে কাছে ডেকে বলেন- কত সব আরিয়াডনি এই করছে এখন। সব পরে জানা যাবে। কথা বলে – স্যার আমি আরিআডনি হতে চাই।
তিনি হেসে বলেন Ñ তুমিতো তাই। ওই যে সেদিন একটা লোক এসেছিল বন্দুক কাঁধে করে তুমি তোমার ভাগের সব খাবার ওকে দিয়েছিলে তাই না?
কথা বলে-আপনি কি করে জানলেন স্যার?
সেটা জানা কোন কঠিন কিছু? সেই যুবক যেতে যেতে বলেছিল- এই শালিখপুরে এমন সব সোনার ছেলেপুলে জড়ো হলো কেমন করে? আপনি আপনার গল্পদিয়ে ওদের ভেতরটা সোনার মত ভালোবাসায় পূর্ন করছেন স্যার?
তা কেন ? আমি বলেছিলাম। ওরা এমনই সবসময়।
এরপর তিনি আবার পুরণো আরিআডিনির গল্পে ফিরে যান। ঠিক তখনি টিনের ছাদে ঝুম বৃৃষ্টি নামে। তিনি সকলের হাতে শ্লেট ধরিয়ে দিয়ে অংক করতে বলেন। আর বলেন- কাল তোমরা এমন একটা গল্প নিয়ে এই খানকাঘরে আসবে কেমন? তখন মোতি সবুজ শাড়ি পরে কলাপাতা মাথায় দিয়ে হাতে কি যেন নিয়ে ঘরে ঢোকে। পেছনে বোঁচা।
কি এনেছো তুমি?
ডালের বড়া মা ভেজেছেন। আপনাদের দিল। বোঁচা সকলের হাতে ছোট ছোট কলাপাতার প্লেট ধরিয়ে দেয় ওরা ডালের বড়া খায়। মোতি হাসতে হাসতে চলে যায়। এ বাড়ি সে বাড়ি কাজ করে মোতি। বয়স পনেরো ষোল। যার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে সে যুদ্ধে গেছে। যুদ্ধ থেকে ফিরলেই বিয়ে। ঢিবির মত খোঁপা। আর সবুজ শাড়ি পরা দিঘল শরীর। সারাক্ষই কিছু না কিছু করছে। কখনো এর বাড়ি। কখনো ওর বাড়ি।
ছেলেমেয়েরা চলে গেলে রব্বানি নামের মাঝবয়সী একজন আসেন। তিনি আফজাল মাস্টারের দিকে তাকান। কিছু একটা বলতে চান মনে হয়। আফজাল মাস্টার ঘরটা গুছিয়ে বসে আছেন। কি যেন ভাবছেন গভীর করে। -স্যার আমি আরিআডনি হতে চাই কথার কথা মনে হয়। মেয়েটা বড় সরল।
ছেলেমেয়েদের পড়ানোর নাম করে ভালোই আছেন। খাবার, কিছু পয়সা। মুক্তিযুদ্ধে যেতে ভয় পান? তাই এই অছিলা? রব্বানি বিশ্রি করে আফজল মাস্টারকে বলছে।
ডালের বড়া খাবেন? আফজল মাস্টার বলেন। তারপর বলেন -আমি ভীতু মানুষ। ওসব যুদ্ধ টুদ্ধ আমাকে দিয়ে হবে না। তবে টাকাপয়সার কথা কি বলছেন?
ছেলেমেয়েরা মায়েরা আপনাকে পড়ানোর জন্য টাকা দেয় না?
আফজাল মাস্টার জ্বলজ্বলে চোখে দূরের আকাশ দেখছেন। ভাঙ্গা মেঘে সুর্য। বলেন -তাহলে আমার কাজটা আপনি নেন। শুনেছি আপনি টাইটেল পাশ। কোন মাদ্রাসার শিক্ষক। ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দেন।
বাজে বকবেন না। আপনি যা করছেন করেন। অমন তাগড়া শরীর আর একটা বন্দুক কাঁধে ঝোলাতে এত ভয় কিসের? আফজল মাস্টার পায়ে হাত বোলান। নীল প্যান্টটাতে। বলেন – কি জানি কিসের ভয়।
অনেকে আছে এই অসময়ের সুযোগ নিতে চায়।
আফজাল মাস্টার কোন কথা বলেন না। বলেন -দশ বছর হলো এই গ্রামে আমি। এই গ্রামের সুখ দুঃখে জাড়িয়ে গেছি। এবার তিনি ওঠেন। লাঠি ভর করে নিজের ঘরে যাবেন বলে ঠিক করেন। সবসময় লাঠি ভর করে হাঁটেন। সকলে বলে এটা তাঁর অভ্যাস।
মা আমাকে একটা গল্প দাও। মা বলেন -নানুর কাছে যাও। উনি গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসে থাকেন। নানু তখন মাগরেব পরে দীর্ঘ মোনাজাত করছেন। মৌটুসি নানির কাছে গিয়ে বসে। বলে -কাল স্যারকে গল্প শোনাতে হবে নানু আমাকে একটা গল্প দাও।
নানু একটা গল্প দেন। মৌটুসি গল্পটা শোনে। হাসান হোসেনের গল্প। ফোরাত নদীর গল্প। কাল সকলকে একটা নতুন গল্প করতে হবে। নানু খোয়াজ খিজিরের গল্প করেন। বলেন – কখনো পুকুরে নেমে হিসু করবে না। ওখানে খোয়াজ খিজির থাকেন।
পরদিন আফজাল মাস্টার মোতিকে বলে -তুমি গল্প শোনাও দেখি। খালি এটা ওটা খেতে দাও। একটা গল্প কর। বস কথার পাশে।
সকলে হাসে। সকলে বলে এবার মোতি গল্প শোনাবে। মোতি বলে কেবল -আমি গল্প জানি না।
মুক্তিযুদ্ধ মানে কি তা জানো?
জি। মানে ভালো দিনের জন্য যুদ্ধ। দানবের দিন শেষ।
ঠিক। এবার আবুল কোথায় গেছে? মানে তোমার সঙ্গে যার বিয়ে হবে সেই আবুল। মোতি আঁচলে মুখ ঢাকে। আফজল মাস্টার বলেন – আচ্ছা তাহলে বল এই বাড়িতে যে দুইজন জোয়ান ছেলে ছিল, কলেজে পড়তো, তারা সব কোথায়?
এবার মোতি মুখ মুছে বলে – তারা সব দানব খেদাবার গেছে। ওর কথায় আবার সকলে হাসে। আফজাল মাস্টার বলেন -ঠিক তাই। দানব তাড়াতে গেছে।
কথা বলে – স্যার আমি আরিআডনি হয়ে সাহায্য করতে চাই।
অবশ্যই। সময় এলেই সাহায্য করবে।
মোতি তুমি এটি কি কর? ভাবী ডাকে তোমাক। বোঁচা এসে জানায়। মোতি তখন পালাতে পারলে বাঁচে। সে গুছিয়ে গল্প করতে জানে না। দু একটা ভুতের গল্প জানে। সেটা এখানে বলা যায় না।
ওদেরা সবসময় ভয় করত কখন হঠাৎ করে গ্রামে মিলিটারি আসবে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে লুটপাট করে চলে যাবে। যাবার সময় কোন সুন্দরী মেয়ে পেলে তাকে বস্তায় ভরে নিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ করে দুষ্টুমি করে কেউ বলে – মিলিটারি। তখনি ত্রাসের সঞ্চার হয়। -ছি ছি মিছেমিছি মিলিটারি মিলিটারি করে না। সত্যি যখন আসবে তখন তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সকলের ক্ষতি হয়ে যাবে।
সকলে এবার বলে – এবার আমরা আপনার গল্প শুনতে চাই। বলেন না স্যার।
তিনি একটু সোজা হয়ে বসেন। দীর্ঘশ্বাস নেন। বলেন -আমার আবার কি গল্প?
বাঃ আপনার আসল বাড়ি কোথায়? সকলে বলে আপনি নাকি অন্য জায়গা থেকে এসেছেন। এটা আপনার গ্রাম না।
আফজল মাস্টার রুমালে মুখ মোছেন। বলেন – দশ বছর আগে আমি এই গ্রামের পাশের গ্রাম সোনাপুরে যাব বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। তারপর এলো শালিখাপুর। বিশাল বটমাথায় এক টলটলে পুকুর। এই দিয়েই গ্রাম শুরু। বড়দিঘি কেবল বড়দিঘি নয় একেবারে শান্তির জলধারা। এখানে হাতমুখ ধুয়ে বসে থাকতে থাকতে মনে হলো এখানে থাকলেই তো হয় । আমার জেলা ছেড়েছি অন্য কোথাও থাকব বলে।
কেন জেলা ছেড়েছেন স্যার? পলাশ প্রশ্ন করে।
সে অনেক কথা।
আপনার জেলা কোনখানে। তিনি বলেন Ñ ফরিদপুরে। আমার মা বাবা নেই। তাই জেলার জন্য কোন টানও নেই। এ ছাড়া ÑÑÑ। এ ছাড়া তিনি শেষ করেন না। বলেন Ñ সোনাপুরের স্কুলে কাজ করব ভাবছিলাম। তারপর কেমন করে শালিখাপুরের খাঁদের বাড়িতে জায়গা হলো। দুটো বাচ্চাকে বারো থেকে বাইশ করলাম। ওরা এখন দানব খেদাতে গেছে। তরতাজা দুই জোয়ান।
আপনি গেলেও তো পারতেন? ছড়া বলে। Ñ মা বলেছেন যত মানুষ যায় তত ভালো। তাড়াতাড়ি রাক্ষসগুলো লেজ উঠিয়ে দৌড় দেবে।
কেন গেলাম না? বোধকরি তোমাদের জন্য।
ভালোই হয়েছে। আপনি না থাকলে কে আমাদের গল্প শোনাত স্যার?
ঠিক তাই। তোমাদের কথা ভেবেই বোধহয় গেলাম না।
একদিন সত্যি সত্যি মিলিটারি এলো। দিব্য আর মৌটুসি বোঁচার সঙ্গে পুকুরে মাছ ধরছিল। এরপর দেখা গেল ওরা তিনজন আরো কয়েকজনের সঙ্গে দৌড় দিয়ে পাশের গ্রামের দিকে ছুঠছে। মায়েরা, আর সব লোকজন, সকলে। কেবল নানু মই দিয়ে বাড়ির তালায় উঠে আস্তে করে মই টেনে নিয়েছে। কিছু লুটপাট করে একসময় ওরা চলে গেল। যেই ঘরে নানু আছে সেখানে এসেছিল। কিন্তু তালায় যায়নি। নানু তখন খুব ধীরে আয়তুল কুরসি পড়ছে। আসলে সকলেই আয়তুল কুরসি, লায় লাহা ইল্লা আন্তা সবহানাকা এইসব পড়ছে। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কে কি করতে পারবে? কোন মেঘের ভেতর আল্লাহ লুকিয়ে আছেন কে জানে।
সব শান্ত হয়ে গেলে লোকজন একত্রিত হয়। সকলে ঠিক আছে তো? ভালো আছে তো? বাচ্চারা কোথায়? ওরা কেউ হারিয়ে যায়নি তো। এমনি নানা কথা সকলের মুখে মুখে।
হঠাৎ একজন বলে Ñ মোতি কোথায়? তাইতো মোতিতো কোথাও নেই। খুব খোঁজা হলো। মোতিকে পাওয়া গেল না। উঠোনে দৌড় দিয়ে একটা ছাগল বাঁচাতে গিয়ে মোতি কার নজরে পড়েছিল কে জানে।
দুই দিন পর সকলে নিশ্চিন্ত হলো সত্যিই মোতি নেই। সে অন্য কোথায় ভয়ে চলে যায় নি।
আফজাল মাস্টার গর্জন করে উঠলেন। Ñ হতে পারে না। এ হতে পারে না। মোতিকে কে নিয়ে যাবে? এ হতেই পারে না। তাঁকে অমন করে জ্বলে উঠতে কেউ দেখেনি।
নিজের ঘরে ট্রাউজার খুলে দেখলেন Ñ তাঁর কাঠের পা। যেটা কোন এক ডাক্তার দয়া করে লাগিয়ে দিয়েছিল। যখন দরকার হয় পরা যায়। একেবারে মবি ডিকের ক্যাপ্টেন আহাবের মত। পা চলে গিয়েছিল তার। দানব ট্রেন পা কেটে নিয়েছিল। যার কথা কেউ জানতো না। কাটা পড়েছিল পা রেলের পথ পার হতে গিয়ে। ছয়মাস হাসপাতালে ছিলেন। সেইসময় রহিমার বিয়ে হয়ে যায়। কোন বাবা মা কাটা পায়ের একজনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে না। তিনি অন্ধকারে কেঁদেছিলেন। যেন তার চেয়ে নিঃস্ব আর কেউ নেই।
রহিমার বর ওকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গিয়েছিল।
তিনি দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিলেন। সামর্থ্য ছিল না। তাই এসেছিলেন অন্য জেলায়। বাংলাদেশ ছোট। তবু নিজের দুই একজন তাঁর খোঁজ জানে না।
দশ বছর চলে গেছে। সেই পায়ের কথাও সকলে জানে না। লম্বা ট্রাউজারের ভেতরে কি আছে কে জানবে? দুঃখের পাঁচালি গাওয়া তার স্বভাব নয়।
আবার পরলেন ট্রাউজার। তারপর শক্ত করে কোমড় বাঁধলেন বেল্ট। কাঠের পা ওইভাবেই পরতে হয়। একটা বন্দুক যেন কেমন করে জমিয়ে রেখেছিলেন। আজকের দিনের জন্য কিনা কে জানে।
বাইরে মোতির বিধবা মা চিৎকার করে কাঁদছে Ñ হামার মোতি তুই কই গেলু রে। কে তোক লিয়ে গেল। কোন শকুন, কোন কুত্তার বাচ্চা! মোতির মা বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে। এই কান্না শুনে মাথার ভেতরে আগুন জ্বলে গেল।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে বন্দুক নিয়ে বের হলেন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ব্রিজের ধারে এলেন। এই পথ দিয়ে ওরা আবার আসবে। দানবেরা। তিনি জানেন। আর কিছু তরুণও জানে।
খুলিটা উড়ে গিয়েছিল তাঁর। শেষপর্যন্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মারা গেলেন। তাঁর কাঠের পা টা চুড়মার হয়ে গেছে। পুরো শরীর ঝাঁঝরা।
কিন্তু ঠোঁটে লেগে আছে অনাবিল হাসি। শেষ পর্যন্ত একজন যোদ্ধার মুত্যূ এলো। এমন ভাবনা কেবল স্বপ্ন ছিল। মোতি হারানো তাঁকে বললো Ñ আর নয়, একটা পা নিয়েই বেরিয়ে পড়।
গল্পের আসর ভেঙ্গে গেল। রব্বানি আসর জমাতে চেয়েছিল। বাচ্চারা ওর ধারে কাছেও আসেনি। কি জানি কেন? বাচ্চা অনেক সময় মানুষের হ্রদয় দেখতে পায় যে।