প্রবন্ধঃ কবিতায় চিত্র ও চিত্রকল্প, পার্থক্য ও প্রয়োগ-কৌশল

কবিতায় চিত্র ও চিত্রকল্প
পার্থক্য ও প্রয়োগ-কৌশল
আবিদ আনোয়ার
কবিতার প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রে চিত্র ও চিত্রকল্প কোনো অলঙ্কার বলে বিবেচিত হয় নি, অথচ ১৯১০-১৯১৭ সময়কালে পাশ্চাত্যের কবি ও তাত্ত্বিক এজরা পাউন্ড ও এমি লাওয়েল প্রমুখের ‘চিত্রকল্পবাদী’ আন্দোলনের পর চিত্রকল্পকেই কবিতার প্রধান রূপকল্প বলে মনে করা হয়। অন্য যাঁরা এই চিত্রকল্পবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন: রিচার্ড এলডিংটন, এফ এস ফ্লিন্ট, ডিএইচ লরেন্স, জন গোল্ড ফ্লেচার, হিলডা ডুলিটল (যিনি সংক্ষেপিত ‘এইচডি’ কলমী-নাম ব্যবহার করতেন)। আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও যারা চিত্রকল্পবাদকে সমর্থন করে চিত্রকল্পবাহী কবিতা রচনাকে প্রধান কৃত্য বলে মনে করতেন তাঁরা হলেন: জেমস জয়েস, ওয়ালেস স্টিভেন্স, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, টি ই হিউম, হার্বার্ট রীড, টিএস এলিয়ট প্রমুখ।
বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটেও তিরিশি আন্দোলনকারীগণ তাঁদের নতুন কবিতার জন্য যেসব উপাদানকে অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করতেন তা হলো চিত্রকল্প। তবে এই নিরিখে আমাদের বাংলা কবিতা সীমিত সাফল্য ও বহু ব্যর্থতার ইতিহাস হয়ে আছে। তিরিশিদের গুরু বৃদ্ধদেব বসু চিত্রকল্পের ওপর তাঁর আলোচনায় যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের কবিতায় ততটা চিত্রকল্পের চর্চা করেন নি। এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প রচনায় অনেক সফল হয়েছেন বলেই তাঁর কবিতাকে আজও তিরিশি আন্দোলনের প্রধান ফসল বলে মনে করা হয়।
পাশ্চাত্যে একসময় মনে করা হতো ‘রূপকই কবিত্ব’, কেউ কেউ বলতেন “উপমাই কবিত্ব”; আর্থার সীমন্স-এর একটি বইয়ের আলোচনা লিখতে গিয়ে ডবিউ বি ইয়েটস লিখেছেন: কবিতার সব অলঙ্কার বিলুপ্ত হলেও প্রতীক ব্যবহারের গুরুত্ব কমবে না, কারণ তাহলে কবিতা আর কবিতা থাকবে না। এতে বোঝা যায় ইয়েটস বলতে চেয়েছেন: “প্রতীকই কবিত্ব!”
বাঙালি কবি ও তাত্ত্বিকেরা যদিও পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মুখেই ঝাল খান তবুও এখানে কবিতার রূপকল্পবিষয়ক বিশ্বাসে যে বিবর্তন ঘটেছে তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। সর্বশেষ প্রবণতা বিষয়ে ধারণা তৈরির জন্য শুরু করছি জীবনানন্দ দাশ থেকে। তিনি বলেছেন “উপমাই কবিত্ব”; বর্তমান নিবন্ধকারকে-দেয়া একটি সাক্ষাতকারে শামসুর রাহমান বলেছেন ‘প্রতীক-চিত্রকল্পই কবিত্ব”। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন “চিত্রকল্পই কবিত্ব।”
মূলত পাউন্ড-লাওয়েলের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘চিত্রকল্পবাদী’ কবিগোষ্ঠীর বিশ্বাস জয়যুক্ত হয়েছে বিশ্ব জুড়েই। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ”চিত্রকল্পই কবিত্ব” এই সত্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে পূর্বোক্ত বিশ্বাসগুলিও, কারণ কোনো চিত্রই চিত্রকল্পত্ব অর্জন করে না যদি না কোনো প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার অর্থাৎ উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতীক-রূপক কিংবা নিদেনপক্ষে সমাসোক্তির রসায়ন এতে যুক্ত না হয়। সে-অর্থে জীবনানন্দ দাশের উক্তি “উপমাই কবিত্ব’ চিত্রকল্পকেও অঙ্গীভূত করে এবং আমাদের কবিতায় জীবনানন্দ নিজে চিত্রকল্পের চর্চা করেছেন সবচেয়ে বেশি। এই আপাতকঠিন মন্তব্যটির ব্যাখ্যা-
বিশেষণের উদ্দেশ্যেই এ-লেখার আয়োজন। তার আগে ‘চিত্র’ ও ‘চিত্রকল্প’ বলতে আমরা কী বুঝি তা জেনে নেয়া যাক:
বন্তুবিশ্বের, এমনকি কল্পনার জগতেরও, সব জিনিসের একটি নির্দিষ্ট অবয়ব আছে। বস্তুবিশ্বের লাঙল, জোয়াল, কোদাল, কাস্তে, বালতি, ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেমন আমাদের চৈতন্যে এসবের চিত্র ভেসে ওঠে, কল্পনার জগতের ‘পরী’ বা
‘ফেরেস্তা’ বললেও তাদের অবয়ব মূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের মানসলোকে। শুধু শব্দ কেন, ‘কখগঘ’ বা ‘ধনপফ’ বললেও আমরা এ-বর্ণগুলোর চিত্র দেখতে পাই মনের চোখ দিয়ে, তবে নিরক্ষর মানুষের মনে কোনো বর্ণের চিত্র ধরা দেয় না। এতে মনে হতে পারে সব শব্দেরই একটি চিত্ররূপময়তা আছে, কিন্তু তা ঠিক নয়। ‘অঙ্ক’, ‘বিজ্ঞান’, ‘শাস্ত্র’, ‘চিন্তা-ভাবনা’, ‘মতামত’, ‘সহজ’ ইত্যাদি অনেক শব্দ উচ্চারিত হলে আমরা কোনো চিত্র দেখতে পাই না। আবার ‘সুন্দর’, ‘কুৎসিত’, ‘লাল’, ইত্যাদি বললেও দূরান্বয়ী কিছু চিত্র ভেসে ওঠে বটে, তবে তা সহজে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। একটি বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই তা দৃশ্যমান হয়, যেমন: ‘সুন্দর নারী’, ‘কুৎসিত কুমীর’, ‘লাল ফুল’, ইত্যাদি। আবার ‘রাত’, ‘দিন’, ‘সকাল’, ‘বিকাল’, ইত্যাদি শব্দ উচ্চারিত হলে যে-চিত্র ভেসে ওঠে চৈতন্যে তা হলো কিছু সম্মিলিত পরিবেশ বা প্রতিবেশ-চিত্র। এসবকে বলা যেতে পারে ‘দূরান্বয়ী চিত্র’।
কবিতা মানেই কিছু বাক্যের সমষ্টি। অধিকাংশ বাক্য তৈরি হয় কিছু চিত্রবাহী শব্দ ও কিছু চিত্রহীন শব্দ দিয়ে, আবার কোনো কোনো বাক্যে চিত্রবাহী কোনো শব্দই থাকে না। “জীবনানন্দ দাশ বিশ্বাস করতেন: উপমাই কবিত্ব” এই বাক্যে জীবনানন্দ নামক এক কবি-মানুষের চিত্র আমাদের মনে সামান্য ভেসে উঠলেও সামগ্রিক বাক্যটি চিত্ররূপময় নয়, কারণ এতে প্রকাশিত হয়েছে একটি ভাবনা। ভাবনার কোনো চিত্র নেই, থাকে না। অথচ কোনো চিত্রের সঙ্গে যখন ভাবনা যুক্ত হয় তখন তা চিত্রকল্প হয়ে ওঠে।
একটি কবিতা পাঠের সময় আমরা একের পর এক বাক্য পেরিয়ে যাই, যার কোনোটিতে চিত্র থাকে আবার কোনোটিতে থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি” পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাংলার অজস্র ছোট নদীর যেকোনো একটির চিত্র ভেসে ওঠে আমাদের মানসপটে। অথচ কাজী নজরুল ইসলামের “গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান” পড়ার পর একটি ভাবনা দ্বারা তাড়িত হই, চিত্র পাই না।
রবীন্দ্রনাথের এই শিশুতোষ কবিতাটিতে ‘ছোট নদী’র যে-চিত্র দেখতে পাই তা-ও আবার চিত্রেই সীমাবদ্ধ, চিত্রকল্প হয়ে ওঠে নি। কারণ এ-চিত্র পাঠককে কেবল একটি দৃশ্যই উপহার দেয়। এর সঙ্গে কোনো ভাবনা যুক্ত হয়ে আমাদের চৈতন্যকে প্রসারিত করে না–অর্থাৎ অন্য কিছু ভাবতে প্রলুদ্ধ করে না।
একইভাবে “গভীর অরণ্য ছেড়ে উড়ে আসে বনমোরগীরা/বানরের চেঁচানিতে ভরে যায় সেগুনের শাখা/ঝুরিতে সব্জী নিয়ে হেঁটে আসে চাকমা কিশোরী” কিংবা “জমির কিনার ঘেঁষে পলাতক মাছের পেছনে/জলডোরা সাপের চলন নিঃশব্দে দেখছি চেয়ে” আল মাহমুদ-নির্মিত এই দু’টি চিত্রও কেবল পরিবেশের বর্ণনায় সীমাবদ্ধ। দৃশ্যের বাইরে পাঠককে অন্য কিছু ভাবতে প্রলুব্ধ করে না। প্রথম চিত্রটি চট্টগ্রামের চাকমা-অধ্যুষিত এলাকার নিত্যদিনের জীবন-চিত্রকে ধারণ করেছে এবং দ্বিতীয়টিতে আছে গ্রামবাংলার ফসলের ক্ষেতে মাছ ধরার চেষ্টায় এক জলডোরা সাপের আঁকাবাঁকা চলনের দৃশ্য। অল্প কিছু শব্দে নির্মিত এ-চিত্রগুলো ক্যামেরাচিত্রের মতো আমাদের চৈতন্যের ফ্রেমে ধরা দিলেও এগুলো চিত্রকল্প নয়, কারণ এগুলো পরিবেশের বিশ্বস্ত চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট নদীর চিত্রটিও এরকম। কবিতায় ব্যবহৃত এধরনের বিশ্বস্ত চিত্রকে শুধু ‘চিত্র’ বলা হয়, চিত্রকল্প বলা হয় না।
‘চিত্রকল্প’ তা হলে কী? কবিতায় বর্ণিত যে-চিত্র তার দৃশ্যের সঙ্গে একটি ভাবনাকে যুক্ত ক’রে দৃশ্যাতিরেক সৌন্দর্য দান করে, পাঠককে দৃশ্যের বাইরেও অন্য কিছু ভাবতে প্রলুদ্ধ করে, চেতনাকে সম্প্রসারিত করে তাকেই ‘চিত্রকল্প’ বলে গণ্য করা হয়। কাজী নজরুল ইসলামের গানে-ব্যবহৃত “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে” চিত্রকল্পটিতে বিমূর্ত ঈশ্বর মূর্ত হয়ে ওঠেন এক বিশালদেহী শিশুর অবয়ব নিয়ে। সৌর জগতের নানা গ্রহ-উপগহ ও নক্ষত্রকে মার্বেল মনে ক’রে ইশ্বর এক আত্মভোলা শিশুর মতো তার খেলা খেলে চলেছে মহাবিশ্বের মাঝখানে বসে। এই চিত্রটি চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে কারণ দৃশ্যকে ছাড়িয়েও একটি ভাবনা পাঠককে (বা শ্রোতাকে) আলোড়িত করে। উপমেয় ‘ঈশ্বর’ বাক্যে অনুপস্থিত তাই এটি প্রতীকবাহী চিত্রকল্প। জীবনানন্দ দাশের “হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে হিজল ডালের পিছে/অগনন বনের আকাশে” থেকে যে-চিত্র আমাদের মনের ফ্রেমে বন্দী হয় তাতে শুধু দৃশ্যই নয়–দৃশ্যের সঙ্গে বাড়তি কিছু পাই। কোনো এক বিকেলে হিজল ডালের পেছনে সুন্দর আকাশ দেখে কবির মনে হলো তাঁর পরিচিতি এক সুন্দরী ‘শেফালিকা বোস’ হীরের প্রদীপ জ্বেলে মিটিমিটি হাসছে। এই অনবদ্য চিত্রকল্পটিতেও যুক্ত হয়েছে একটি প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার–যার নাম উৎপ্রেক্ষা। উপমান ‘শেফালিকা বোস’ এবং উপমেয় ‘সুন্দর আকাশ’ দু’টিই এই বর্ণনায় উপস্থিত। শামসুর রাহমানের ‘জনৈক সহিসের ছেলে বলছে’ কবিতায় “কে এক কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়া উড়িয়ে কেশর/পেরিয়ে সুদূর আগুন রঙের মাঠ/তাকে নিতে আসে” চিত্রকল্পটি বিশেষণ করা যাক: এই দৃশ্যকল্পে আগুন-রঙের মাঠ পেরিয়ে-আসা এক কালো ঘোড়াকে আমরা দেখতে পাই; পটভূমিতে আগুন রঙের মাঠ ঘোড়ার কালো রঙকে আরো বেশি ফুটিয়ে তুলেছে। কেমন যেন রহস্যময় এই দৃশ্য, কিন্তু তবুও শেষ পঙ্ক্তি “তাকে নিতে আসে” উচ্চারিত না-হওয়া পর্যন্ত এটি চিত্রই থেকে যায়, চিত্রকল্প হয়ে ওঠে না কারণ এই দৃশ্য তখনও বস্তু-প্রতিমায় সীমাবদ্ধ; বস্তু-প্রতিমার সঙ্গে ভাবনা যুক্ত হয় নি তখনও। শেষ পঙ্ক্তি “তাকে নিতে আসে” উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার সলতেয় আগুন লাগে এবং তা চিত্রকল্পের গৌরব অর্জন করে। এক সহিসের ছেলে তার বার্ধক্যকবলিত পিতার মৃত্যুচিন্তাকে রূপায়িত
করেছে এই চিত্রকল্পে। এই কালো ঘোড়া মৃত্যুর প্রতীক। উপমান ‘মৃত্যু’ কবির বর্ণনায়
অনুপস্থিত, তাই এটি প্রতীকবাহী চিত্রকল্প। অন্য বিবেচনায়, প্রতীক ছাড়াও আরো একটি প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার এতে লুকিয়ে আছে। এই সহিস সমস্ত মানুষের প্রতিনিধি–জীবন নামের ঘোড়াকে বাগে আনার সাধনা করতে করতে শেষ বয়সে মৃত্যু নামের এক কালো ঘোড়া সবাইকেই পরপারে নিয়ে যায়। অতএব এই ভাবনায় একটি সমান্তরাল রূপক আমরা বাড়তি উপভোগ করি। প্রকৃত চিত্রকল্প এভাবেই পাঠককে দৃশ্যের বাইরে নিয়ে ভাবিয়ে তোলে, পাঠকের চৈতন্যকে ভাবনায় আলোড়িত করে। যে-প্রক্রিয়ায় এটি ঘটে তা হলো প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারের ব্যবহার। উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক-প্রতীক-সমাসোক্তি যুক্ত না হলে কোনো চিত্রই চিত্রকল্পত্ব অর্জন করে না এবং প্রতীকবাহী চিত্রকল্প অন্যান্য চিত্রকল্পের চেয়ে বেশি হৃদয়গ্রাহী ও সৌন্দর্য-সঞ্চারী।
কবিতায় যত কম শব্দে একটি চিত্রকল্পকে ফুটিয়ে তোলা যায় ততই চিত্রকল্পের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, মনের ফ্রেমে চট করে বন্দী হয়ে যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে বিবৃতিধমী কিছু বাক্যও চিত্রকল্পের অবয়ব তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘পরশ পাথর’ নামের কবিতাটিতে “সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার/তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি’ হেসে হলো কুটিকুটি/সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার” আমাদের বাংলা কবিতার ভাণ্ডারে একটি অনবদ্য চিত্রকল্প, কিন্তু এটুকু বর্ণনায় এ-চিত্রকল্পটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কারণ বর্ণিত ‘সৃষ্টিছাড়া পাগলের’ পূর্ণ পরিচয় না-জানা পর্যন্ত এটি পাঠককে ততটা আলোড়িত করবে না। কবিতার প্রথমেই “ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর/মাথায় বৃহৎ জটা/ধূলায় কাদায় কটা/মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর” পড়ার মাধ্যমে ক্ষ্যাপাকে চেনার পরই সমুদ্র-তরঙ্গের এই ব্যঙ্গ-হাসির অর্থ আরো তীব্রভাবে পাঠক-চৈতন্যে আলোড়ন তোলে। অতএব এই চিত্রকল্পকে সম্পূর্ণ হয়ে-ওঠার জন্য পূর্ববর্তী বিবৃতি কিংবা অন্য কোনো চিত্রের সাহায্য নিতে হয়। চিত্রকল্পটি একটি সমাসোক্তিকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে কারণ সমুদ্র-তরঙ্গের শব্দকে বিকট ‘হাসি’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে-কর্মটি করতে পারে কোনো মানুষ কিংবা অন্য দুয়েকটি বুদ্ধিমান প্রাণী, যেমন ডলফিন।
এভাবে পূর্ব প্রসঙ্গকে কাজে লাগিয়ে পাঠক কোনো কোনো চিত্রকল্পের সৌন্দর্য ভোগ করতে পারেন, যেমন “হায়েনার মতো হিংস্র দু’চোখ, কেশর-ফুলানো ঘাড়/গগনচুম্বী দালানের চেয়ে উঁচুতে নাড়ায় কান/খুরের দাপটে রাজপথে ওঠে মিছিলের হাহাকার/নড়ে ওঠে কাঁচা টিনশেড থেকে ইটের দরদালান” চিত্রকল্পটিতে আমরা কেশর ও খুরবিশিষ্ট একটি প্রাণীর চিত্র দেখতে পাই যার দু’চোখ হায়েনার মতো হিংস্র; প্রাণীটি এতই বিশালদেহী যে তার মাথাটি গগনচুম্বী দালানের চেয়েও উঁচুতে, ঘাড়ের কেশর ফোলা, মিছিলে খুর দাবড়িয়ে দিলে রাজপথে হাহাকার ওঠে। শব্দের অনুষঙ্গে এই প্রাণীটিকে একটি ঘোড়া হিসেবে সন্দেহ করলেও নিশ্চিতভাবে এটিকে চেনা যায় না কেবল এটুকু বর্ণনা থেকে। কিন্তু কবিতাটির প্রথম স্তবকে এই ঘোড়ার পরিচয় দেওয়া আছে এভাবে: “মানতের মতো রেখে যায় কারা যার যার প্রিয় ফুল/পাপড়ির সাথে মাধুরী-মেশানো নানা বর্ণের তোড়া/শহীদ মিনার নিমেষেই দেখে ফাঁকা তার বেদীমূল/একুশের ফুল খেয়ে চলে যায় বাইশের লালঘোড়া…।” এই পূর্ব প্রসঙ্গকে কাজে লাগালেই শেষের চিত্রকল্পগুলোও সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। একুশের চেতনা কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত। একুশে ফেব্র“য়ারিতে শহীদ মিনারের পাদদেশে-রাখা ফুল বাইশ তারিখেই খেয়ে যায়
এক লালঘোড়া–এই চিত্রকল্পে শাসকশ্রেণীর হাতে একুশের চেতনা ও মূল্যবোধের নির্মম অবমাননা মূর্ত হয়ে ওঠে। এটি একটি প্রতীকবাহী চিত্রকল্প, কারণ শাসকশ্রেণীর আচরণকে তুলে ধরা হয়েছে একটি ঘোড়ার প্রতীকে।
অনেক কবিতায় কোনো চিত্রকে চিত্রকল্পের মর্যাদা দেওয়ার জন্য শুধু পূর্ব প্রসঙ্গের নয়, পরবর্তী অংশে বা কবিতার শেষাংশে উলেখিত প্রসঙ্গেরও একটি সহায়ক ভুমিকা থাকে। “মরণের আগে এমনি ক’দিন বাঁকা হেসেছিলো অমলের বউ/গভীর নিশীথে ডাক দিতো যাকে কদমের ডাল/দড়ি হাতে নিয়ে জোনাকির ভিড়ে/বিভোর দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ ভেবে/সম্বিতে ফিরে চমকে দেখতো আরেক সকাল” এই চিত্রে কদমের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টায় এক গ্রাম্যবধুকে জোনাকির ভিড়ে দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সে শেষমেশ ঝুলে পড়তে পারে না এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অন্য অনেক বারের মতো এবারও দেখতে পায় সকাল হয়ে গেছে। যেহেতু এর সঙ্গে কোনো প্রতিতুলনা যুক্ত হয় নি, তাই একে ‘চিত্রকল্প’ না বলে ‘চিত্র’ বলা যেতো। কিন্তু কবিতার পরের স্তবকে যখন এই জোনাকিকে এই গ্রাম্যবধুর বেঁচে-থাকার আকুতি ও ভবিষ্যত সুখের জন্য জ্বলে-ওঠা আশাবাদের সঙ্গে অন্বিত করা হয় তখন আগের চিত্রটিও চিত্রকল্প হয়ে ওঠে। “আরেক সকাল” বাক্যাংশটুকুও তখন এই নারীর কিংবা সকল মানুষের বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন মর্যাদায় ব্যঞ্জনা দান করে।
রঙ-রেখায় যে-চিত্রকেই কোনো চিত্রকর তার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন তাকে চিত্রকর্ম বলতে বাধা নেই। কিন্তু সব চিত্রকর্মই শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে এমন কথা বলা যাবে না যদি না এতে যুক্ত হয় শিল্পসৃষ্টির জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু উপাদান। অথচ কেউ আঁকিয়ে হলেই আমরা তাকে ‘শিল্পী’ বলতেই অভ্যস্ত। প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার যুক্ত না-করে কোনো কবি ও চিত্রকর যখন জাগতিক বা মহাজাগতিক কোনো চিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন যথাক্রমে তার কবিতায় ও চিত্রকর্মে তখন বস্তুলোকের কেবল একটি খণ্ডচিত্রকেই আমরা দেখতে পাই–কবির বর্ণিত চিত্রকে দেখি মনের চোখ দিয়ে, আর চিত্রকরের আঁকা ছবি দেখি চর্মচক্ষেই। এসব বিশ্বস্ত জীবন-চিত্র আমাদের মনকে অতটা নাড়া দেয় না কারণ এগুলো দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। বাস্তবে পথে-ঘাটেই যাকে দেখতে পাই তা কবিতায় বা চিত্রকর্মে দেখলে ভালো লাগে না তা নয়, কিন্তু যখন শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যুক্ত করে একে দৃশ্যাতিরেক মর্যাদা দান করা হয় তখন তা শিল্পবোদ্ধার মন কাড়ে। জয়নুল আবেদীন-এর আঁকা কাদায় আটকে-পড়া গরুর গাড়িকে গতি দান করার জন্য চালকের প্রচেষ্টাকে যখন জীবন-সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দেখি, কিংবা তাঁর আঁকা মুক্তিকামী এক জেদী গাই-এর দড়ি ছেঁড়ার প্রচেষ্টাকে যখন নারীমুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখি তখন বাস্তবের চিত্রও শিল্পকর্ম বা চিত্রকল্প হয়ে ওঠে।
এ-লেখায় উলেখিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট নদীর চিত্র, আল মাহমুদের চট্টগ্রাম বেড়াতে-গিয়ে-দেখা চিত্র কিংবা গ্রামের ক্ষেতের ভেতর জলডোরা সাপের চলন যদি কোনো চিত্রকর এঁকে ফ্রেমবন্দী করেন তবুও একে বর্তমান নান্দনিক বিশ্বাসের নিরিখে
প্রকৃত শিল্পকর্ম বলা যাবে না, কারণ এগুলোতে বস্তু-প্রতিমার সঙ্গে ভাবনা যুক্ত হয় নি অর্থাৎ প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার যুক্ত হয় নি। এগুলোকে আমরা ‘চিত্র’ নামেই অভিহিত করবো, ‘চিত্রকল্প’ বলবো না।
এতক্ষণ চিত্র ও চিত্রকল্পের পার্থক্য বুঝানোর চেষ্টা করেছি এজন্য যে, আমাদের কবিতাবিষয়ক আলোচনায় অনেকেই চিত্র ও চিত্রকল্পকে একত্রে গুলিয়ে ফেলেন। এছাড়া ‘চিত্রকল্পই কবিত্ব’ এই বোধে-আক্রান্ত অনেক নবীন কবিকর্মী ও কবিতা-অনুরাগী এ-বিষয়ে ‘সহজ পাঠ’ খুঁজে বেড়ান।
অনেকে বলেন কবিরা তাদের কবিতায় শব্দ দিয়ে যেসব চিত্র আঁকেন তা-ই চিত্রকল্প। কিন্তু না, সব শব্দচিত্রই চিত্রকল্প নয়, যেমন সব চিত্রকর্মও নয় ‘শিল্পকর্ম’। একইভাবে বলা যায়: সব আঁকিয়ে যেমন শিল্পী নন, তেমনি সব পদ্যরচয়িতাও কবি নন। বোদলেয়র-উত্তর আধুনিকতার মন্ত্রে দীক্ষিত ভেরলেন-মালার্মে-র্যাঁবো-পাউন্ড-লাওয়েল-ইয়েটস-এলিয়ট প্রমুখ ইঙ্গ-মার্কিন কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক হয়ে এই উপলব্ধিজাত উক্তি বেরিয়েছে জীবনানন্দ দাশের মুখ থেকেও। তিনি বলেছেন: “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতই কবিতাবিষয়ক শিল্পচেতনা যতই সমৃদ্ধ হচ্ছে, ততই এই বোধ আরো পাকাপোক্ত হচ্ছে এবং বিস্তার লাভ করছে। আধুনিক কালে শিল্পসচেতন কবি ও চিত্রকরগণ তাদের সৃষ্টিকর্মে বিশ্বস্ত জীবন-চিত্রের চেয়ে চিত্রকল্পের ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ক্রমাগত, কারণ এখন চিত্রকল্পকেই মনে করা হয়ে থাকে কবিতা ও চিত্রকর্মের শিল্পায়নের মূল উপকরণ।
একটি চিত্রকল্পের রূপদান করার কাজে আয়োজন ও শ্রমের দিক থেকে চিত্রকরের চেয়ে কবি অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। কবির কোনো রঙতুলি-ইজেল-ক্যানভাস জোগাড় করার ঝুট-ঝামেলা নেই। একটি কি দু’টি বাক্যে কবি যে-চিত্রকল্প নির্মাণ করতে পারেন তা সম্পাদন করতে চিত্রকরকে অনেক সময় প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয়। কবির নির্মিত অনেক চিত্রকল্প ক্যানভাসে আঁকা চিত্রকরের জন্য দুঃসাধ্যও হয়ে উঠতে পারে। ধরা যাক এ-লেখায় উলেখিত শামসুর রাহমান-বর্ণিত আগুন রঙের মাঠ পেরিয়ে জনৈক সহিসের দিকে ধেয়ে-আসা কালো ঘোড়ার চিত্রকল্পটি একজন চিত্রকর তার ক্যানভাসে তুলে ধরতে চান। আগুন রঙের মাঠ পেরিয়ে-আসা ভয়ঙ্কর একটি কালো ঘোড়া এবং ক্যানভাসের কোথাও একজন বৃদ্ধ সহিসের ছবি আঁকবেন তিনি অবলীলায়, কিন্তু এই ঘোড়াটি যে সহিসের মৃত্যুচিন্তার প্রতীক তা এই শিল্পের ভোগীকে বুঝানো দুঃসাধ্য ব্যাপার বৈ কি!
অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে শাসকের গুলি খেয়ে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন অনেক শহীদ। হয়তো কোনো নেতার বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেমে যান মিছিলে, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন পীচঢালা রাজপথে; রক্তরঞ্জিত হয়ে ওঠে কালো পীচের রাজপথ; তাদের এই আত্মত্যাগে একদিন উদিত হয় আকাক্সিক্ষত অধিকারের সূর্য। এই ভাবনাকে অবলম্বন করে নির্মিত একটি চিত্রকল্প: “কী মন্ত্র শেখালে তুমি?/সম্মোহিত সড়কশিল্পীরা নিজেরই রক্তে-ভেজা হিঙুল তুলিতে/গাঢ় লাল সূর্য আঁকে পীচের ক্যানভাসে…।” কোনো চিত্রকর এই চিত্রকল্পকে তার ক্যানভাসে আঁকতে গেলে তিনি বড়জোর আঁকবেন পীচঢালা রাজপথের একাংশ যেখানে ব’সে (কিংবা শায়িত অবস্থায়) কয়েকজন ব্যক্তি কালো পীচের গায়ে তুলি বুলিয়ে আঁকছে একটি লাল সূর্য; লোকগুলো সম্মোহিত, নিজ শরীরের রক্ত দিয়ে তুলি ভিজিয়ে নিচ্ছে–এগুলো এই চিত্রে ফুটিয়ে তোলা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি দুঃসাধ্য এই শিল্পের ভোগীকে বুঝানো যে, এরা কোনো আন্দোলনে প্রাণ-বিসর্জনকারী শহীদ। অথচ কবিতার পঙ্ক্তিতে এই চিত্রকল্প পাঠকের সঙ্গে মানস-যোগাযোগে অতটা জটিলতার সৃষ্টি করে না।
বাংলাদেশের দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থায় যখনই কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে, নতুন ক্ষমতা-দখলকারী ব্যক্তিগণ নানা আশ্বাসবাণী শোনান দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। জনগণও আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করেন সুদিনের। কিন্তু শেষে তেমন কিছুই ঘটে না। এই ভাবনার একটি চিত্রকল্পময় কাব্যরূপ এরকম: “শূন্যমাঠে ঝিমিয়ে-থাকা বারোয়ারী নিঃস্ব গাভী/হাম্বারবে ফাটায় পাড়া মিথ্যে অলীক দুধের ভারে/তোমরা ভাবো এবার তবে ছিটকে-পড়া ননীর ভাগে ভাগ বসাবে খঞ্জনুলো/বামন যারা খর্বহাতে আকাশ ছোঁবে।” একে অবলম্বন করে কোনো চিত্রকর তার ক্যানভাসে আঁকতে পারেন শূন্যমাঠে ঝিমিয়ে-থাকা কিংবা হাম্বা করে-ওঠা কোনো একটি গাভীকেই কেবল। বরাবর ঝিমিয়ে-থাকা একটি গাভীর হঠাৎ-করে মিথ্যে দুধের খবর দিতে ‘হাম্বা’ করে-ওঠার রূপায়ণ চিত্রকরের জন্য যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি কষ্টসাধ্য এই নিঃস্ব গাভীর রূপকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে তুলে ধরা। অথচ কবিতার পঙ্ক্তিতে তা সম্ভব।
চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে কবি এভাবেই জটিলতায় প্রবেশ করতে পারেন, যেখানে চিত্রকরের নানা সীমাবদ্ধতা রযেছে। শিল্পস্রষ্টা ও শিল্পভোগীর মানস-যোগাযোগ বিঘিœত হয় এমন কোনো চিত্রকল্প কবিও যেমন নির্মাণ করতে চান না, চিত্রকরও তেমনি তার নিজস্ব ক্ষমতায় ও আঙ্গিকে বেছে নেন এমনসব চিত্রকল্পকেই যা ক্যানভাসে রূপায়ণযোগ্য। চিত্রকরের অন্য একটি সীমাবদ্ধতা হলো তিনি কেবল প্রতীকেরই আশ্রয় নিতে পারেন, কারণ উপমানকে না-দেখিয়েই তিনি উপমেয়’র প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে কোনো কবি তাঁর চিত্রকল্প নির্মাণে ব্যবহার করতে পারেন সব ধরনের প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারই–অর্থাৎ উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক-প্রতীক-সমাসোক্তি–এর সবগুলোকেই।
পাশ্চাত্যের নন্দনতাত্ত্বিকেরা চিত্রকল্পকে কযেকভাগে ভাগ করেছেন। এর প্রধান পাঁচটি হলো: (১) দৃশ্যপ্রধান চিত্রকল্প, (২) ধ্বনিবাহী চিত্রকল্প, (৩) স্পর্শানুভূতি-সৃষ্টিকারী চিত্রকল্প, (৪) স্বাদ-গন্ধবাহী চিত্রকল্প, ও (৫) শরীর-উদ্দীপক চিত্রকল্প। আমাদের বাংলা কবিতা থেকে কিছু উদাহরণ দিয়ে এসব চিত্রকল্পের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
দৃশ্যপ্রধান চিত্রকল্প: সব ধরনের চিত্রকল্পেই দৃশ্য আছে সত্য, কিন্ত এক ধরনের চিত্রকল্প আছে যেখানে দৃশ্যটাই প্রধান। “চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে” কাজী নজরুল ইসলামের গানে ব্যবহৃত এই চিত্রকল্পে পুকুরের জলে উজ্জ্বল চাঁদ প্রতিবিম্বিত হয়ে যে অনুপম দৃশ্য তৈরি করেছে এই দৃশ্যটাই পাঠককে আলোড়িত করে। দৃশ্যপ্রধান চিত্রকল্পের আরো কয়েকটি উদাহরণ: (১) হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে/হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে, (২) জ্বলন্ত মেঘের মত আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়, (৩) জীবন যেন জালের মাছি টানছে কালো মাকড়ে, (৪) বৃষের স্কন্ধের মতো নুয়ে আসে রাত্রির আকাশ, (৫) জন্মের দরোজা খুলে দাঁড়াতেই চেয়ে দেখি সাজানো এরেনা/দুঃস্বপ্নের পিশাচের মতো শিঙ নেড়ে তেড়ে এলো জীবন নামের ষাঁড়, (৬) জলমগ্ন বাঙলাদেশ–নাকি এক ল্যাগব্যাগে তরল ড্রাগন/হিমালয় থেকে নেমে গিলেছে শস্যের মাঠ, বন-উপবন। বাংলা কবিতার ভাণ্ডারে এধরনের দৃশ্যপ্রধান চিত্রকল্পই বেশি।
ধ্বনিবাহী চিত্রকল্প: যেসব চিত্রকল্পে দৃশ্যের সঙ্গে একটি ধ্বনিও পাঠক শুনতে পায় সেগুলোকে বলা হয় ধ্বনিবাহী চিত্রকল্প, যেমন (১) সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার/তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি’ হেসে হলো কুটিকুটি/সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার, (২) বিবি’র ধাতব বগা নিজেরই পালক ঠুকরে ডুকরে ওঠে উত্তর আকাশে [বাংলাদেশ বিমানের একটি পেনের শব্দ বুঝানো হয়েছে], (৩) কয়েক হাজার বিকট সন্ন্যাসী চিমটে বাজাতে থাকে চতুর্ধারে…/পাঁচশো কামিনী দলুনিপ্রবণ স্তন বের করে ধেই ধেই নাচ শুরু করে, (৪) নাগিনীর গ্রাসে অর্ধবিলীন ব্যাঙ যেন আমি কেউ/আর্দ্র-করুণ অন্তিম ডাকে জীবনকে ভেংচাই, (৫) আমার আকাশ ছিঁড়ে গেছে ক্রুর শকুনের চিৎকারে।
স্পর্শানুভূতি-সৃষ্টিকারী চিত্রকল্প: যে-চিত্রকল্প তার চিত্রের সঙ্গে পাঠককে একটি স্পর্শের অনুভূতি দান করে তাকে বলা হয় স্পর্শানুভূতি-সৃষ্টিকারী চিত্রকল্প, যেমন (১) ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে রূপসীর পরশের মতো, (২) বাড়ালো মদির চঞ্চু রাজহংসী/জড়ালো আমাকে গাউনের মতো ফুল ডানায়।
স্বাদ-গন্ধবাহী চিত্রকল্প: কোনো কোনো চিত্রকল্পে বর্ণিত বস্তুর স্বাদ কিংবা গন্ধও যেন পাঠকের নাকে অনূভূত হয়। এগুলোকে স্বাদ-গন্ধবাহী চিত্রকল্প বলে গণ্য করা হয়, যেমন (১) কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে/আমার চোখের ‘পরে আমার মুখের ‘পরে চুল তার ভাসে, (২) আমার প্রাতরাশের হলদেটে টাটকিনি মাছের ফাঁকে ফাঁকে/কলার টুমের মতো শুয়ে পড়লো/ভোলার অসংখ্য মৃত কিশোরের শব।
শরীর-উদ্দীপক চিত্রকল্প: এধরনের চিত্রকল্পে পাঠকের চৈতন্যের আলোড়ন বা উদ্দীপনা তার নিজ শরীরেও সঞ্চালিত হয়। শরীরের কোনো অংশে কল্পিত ব্যথার বা আনন্দের অনুভুতিটুকু পাঠক সরাসরি টের পান, যেমন (জিয়ল মাছের ভরা বিশাল ভাণ্ডের মতো নড়ে ওঠে বুক, (২) তোমার টিকলি হয়ে হৃদপিণ্ড করে দুরুদুরু, (৩) দেবতা বেল-এনবিল তার/আজ্ঞাবহ জলের পীড়নে/প্রাণহীন একপাল তাগড়া গরুকে/ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাড়িয়ে ফিরিয়ে/আমার বুকের মধ্যে ঠুকলেন/খড়কে-অলা বিশাল পাঁজন।
বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁদের অনুকারকদের সময়ের চেয়ে বেশি চেতনা-প্রসারী চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে তিরিশি আন্দোলনের পর। আমাদের কবিতার অগ্রযাত্রার বর্তমান পর্যায়েও চিত্রকল্প সবারই আরাধ্য। ইঙ্গ-মার্কিন চিত্রকল্পবাদী কবি ও তাত্ত্বিকদের একটি উদ্দেশ্য ছিলো কবিতা থেকে সব ধরনের বিবৃতিধর্মী পঙ্ক্তিকে বিদায় জানিয়ে কেবল চিত্র ও চিত্রকল্প দিয়েই কবিতা নির্মাণের। এধরনের কবিতাকে বলা হতো ‘চিত্রকল্পবাদী’ কবিতা। এই নিরিখে আমাদের বাংলা কবিতায় যা আছে তার অধিকাংশই ‘চিত্রকল্পবাহী’ কবিতা, প্রকৃত “চিত্রকল্পবাদী’ কবিতা বিরল। চিত্রকল্পবাদী কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, কবিতাটি পাঠ করে শেষ করার পর খ-চিত্রগুলো মিলেমিশে একটিমাত্র সুবিশাল চিত্রকল্প পাঠকচৈতন্যে খেলা করে, যেমন বোদলেয়রের ‘আলবাট্রাস’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’, ‘পরশ পাথর’, জীবনানন্দ দাশের ‘শকুন’ এবং অংশত ‘হায় চিল’। প্রকৃত চিত্রকল্পবাদী কবিতা বাংলা সাহিত্যে বিরল বলেই আমাদের প্রতিভাবান তরুণ ও নবীন কবিদের সামনে পড়ে আছে চিত্রকল্পচর্চার এক বিশাল ক্ষেত্র।