আর্স্কিন কল্ডওয়েল : সাহিত্যের বাস্তববাদী ঐতিহ্যের বাহক

আর্স্কিন কল্ডওয়েল : সাহিত্যের বাস্তববাদী ঐতিহ্যের বাহক

আর্স্কিন কল্ডওয়েল :
সাহিত্যের বাস্তববাদী ঐতিহ্যের বাহক
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

“I think you must remember that a writer is a simple minded person to begin with and go on that basis. He’s not a great mind, he’s not a great thinker, he’s not a great philosopher, he’s a story-teller.” – Erskin Caldwell
(Conversations with Erskin Caldwell, University Press of Mississippi, 1988)

আর্স্কিন কল্ডওয়েল সম্পর্কে প্রথমেই বলতে হয় তিনি একজন আদ্যোপান্ত মার্কিন লেখক। কিন্তু আমেরিকান ধনতান্ত্রিক সমাজের যে বর্ণোজ্জ্বল ঝলমলে চেহারা সারা বিশ্বের সামনে বহুল প্রচারিত, তাঁর লেখায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি ফুটে ওঠে। আমেরিকার বিখ্যাত শহরগুলির পরিবর্তে ছোট মফঃস্বল শহর, আধা শহর আধা গ্রাম, খেত-খামার, বাগিচা প্রভৃতি এলাকা তাঁর রচনার পটভূমি। তাঁর চরিত্ররা হল মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষজন, মজুর, ভাগচাষি, বাগিচার কর্মী ইত্যাদি নিতান্ত সাধারণ মানুষ। আবার এদের বিপরীতে এসেছে ক্ষমতাবান ও অর্থবান মানুষেরা। এই সব চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি জীবনের সংঘাত ও সংযোগের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। সে ছবি হিংস্রতার ও ভালবাসার, বাস্তবতার ও রোমান্সের।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনগত বিশালতার ফলে প্রকৃতি ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি জনজীবনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও কল্ডওয়েলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আমেরিকায় বসবাস করতে এসেছে এবং তাদের অভ্যাস, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি সঙ্গে করে এনেছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের আগে পর্যন্ত উত্তরের অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পাশেই ছিল দাসপ্রথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা আধা-সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন একটি সমাজ। গৃহযুদ্ধের পর দাসপ্রথার আইনগত অবসান ঘটলেও সাধারণ মার্কিনীদের মনে তার জের থেকে গিয়েছিল। অন্য দিকে পুঁজিবাদীদের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর বিরোধ শুরু হয়েছিল। এই সব মিলে মার্কিন সমাজ ও সংস্কৃতি এক বিচিত্র, জটিল ও সংঘাতময় রূপ পেয়েছিল। এই রূপটি স্বাভাবিকভাবেই অখণ্ড নয়, কিন্তু জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত; ফলে তার চরিত্রও অনেকটাই স্বতন্ত্র। মার্কিন সমাজের জটিলতাকে তিনি নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় অনুভব করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে-বেড়ানো ও নানা ধরনের জীবিকার সূত্রে সেই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল। তিনি নানা ধরনের মানুষ ও পরিবেশকে দেখেছিলেন, আর জীবিকার দায়ে পরিবেশ ও মানুষের টানাপোড়েনকে চিনে নিয়েছিলেন। সাংবাদিকতার ছকে বাঁধা পথে এই অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করা যায় না বলে তিনি সাহিত্য-রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন।

আর্স্কিন প্রেস্টন কল্ডওয়েলের জন্ম ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর জর্জিয়ার কোয়েটা কাউন্টির একটি ছোট্ট জনপদ হোয়াইট ওক-এ। রেল লাইন থেকে অনেকটা দূরের সেই অনামী এলাকাটি ছিল কয়েকটা বিচ্ছিন্ন বাড়ির সমষ্টি। সেখানে কোনও ডাকঘরও ছিল না। আমেরিকার এই বিশেষ অঞ্চলটি তাঁর রচনায় ছাপ ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু তা বলে তাঁকে আঞ্চলিক সাহিত্যের রচয়িতা বলা যাবে না। তিনি জীবিকার তাগিদে ভবঘুরের মতো এখানে-ওখানে ক্রমাগত ঘুরে বেরিয়েছেন। এই ভ্রমণ তাঁকে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, জীবন, সমাজ ও প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করে তুলেছে। তার ফলে কল্ডওয়েলের রচনায় আমেরিকার মানুষের এক সর্বাঙ্গীণ পরিচয় ধরা পড়ে। তিনি সাহিত্যের পাতায় গোটা মার্কিন সমাজের বিচিত্র, জটিল ও বহুমাত্রিক চেহারা তুলে ধরেছেন।

কল্ডওয়েলের বাবা অ্যাসোসিয়েটেড রিফর্মড চার্চের যাজক হিসেবে দু-এক বছর পরে পরেই এক চার্চ থেকে অন্য চার্চে যেতেন। শৈশব ও কৈশোরে কল্ডওয়েল আমেরিকার দক্ষিণের ছটি রাজ্যে থেকেছেন – ভার্জিনিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়, টেনেসির গ্রামার স্কুল আর জর্জিয়ার হাই-স্কুলে পড়েছেন। সতেরো বছর বয়সে তিনি দক্ষিণ ক্যারোলিনায় একটি ছোট কলেজে পড়তে যান, কিন্তু পড়াশুনার থেকে মালের জাহাজে ঘুরে বেড়ানোতে তাঁর বেশি উৎসাহ ছিল। ভবঘুরেপনার জন্য তিনি একবার ধরাও পড়েছিলেন। এর পর তিনি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, বিলিয়ার্ড রুমে কাজ করে সেখানে দু’বছর পড়ার খরচ চালিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর তিনি ‘আটলান্টা জার্নালে’ কিছুদিন সংবাদিকতা করেছিলেন। জীবনের একটা পর্যায়ে কল্ডওয়েল বহু বিচিত্র বৃত্তি অবলম্বন করেছেন, যেমন – খেত থেকে আলু তোলার কাজ, তুলোর খেতে কাজ, কাঠুরের, কোচোয়ান, মঞ্চ-সহকারী, রাঁধুনি, সেলসম্যান, দেহরক্ষী, পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় ইত্যাদি। এই সময় হেলেন ল্যাগিনানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় এবং তাঁদের তিনটি সন্তান হয়। এর মধ্যেই তিনি অনেকগুলি ছোটগল্প লেখেন। কিন্তু সবকটিই বিভিন্ন পত্রিকা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়।
কল্ডওয়েলের প্রথম প্রকাশিত লেখাগুলি হল ‘দ্য বাস্টার্ড’ (১৯২৯) এবং ‘পুওর ফুল’ (১৯৩০)। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘টোব্যাকো রেড’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। বছর দু’য়েক পরে এই উপন্যাসের নাট্যরূপ প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তার সুবাদে কল্ডওয়েলের রচনা সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ বেড়ে যায়। তবে ১৯৩৩ সালে ‘গডস লিটল একর’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল ‘ট্রাবল ইন জুলাই’ (১৯৪০), ‘এসথারভিল’ (১৯৪৯), ‘এপিসোড ইন পামেটা’ (১৯৫০) এবং ‘গ্রেটা’ (১৯৫৫)। তাঁর পরবর্তী পর্বের রচনাগুলি অবশ্য প্রথম পর্বের লেখাকে কোনও দিক থেকেই ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

সাংবাদিকতা কল্ডওয়েলের বহুকালের শখ ছিল। কিন্তু সংবাদিকতাকে তিনি বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করেননি, কারণ সেখানে সৃজনশীলতার অবকাশ নেই। তা হলেও সাংবাদিকতার দিকে প্রবণতা ও সমাজতত্ত্বের প্রতি আগ্রহ থেকে ১৯৩৭ সালে আলোকচিত্রশিল্পী মার্গারেট বোর্ক-হোয়াইটের সহযোগীতায় তিনি তৈরি করেছিলেন ‘ইউ হ্যাভ সিন দেয়ার ফেসেস’। [হেলেনের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনি এই মহিলাকেই বিয়ে করেন। বছর পাঁচেক পরে এঁর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি বিয়ে করেন জুন জনসনকে]। ইউ হ্যাভ সিন দেয়ার ফেসেস-এ লেখায় ও ছবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের ভাগচাষীদের জীবনকে ধরা হয়েছিল। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেকোশ্লোভাকিয়াকে নিয়ে এই পদ্ধতিতেই তিনি তৈরি করেছিলেন ‘নর্থ অব দ্য দানিয়ুব’ (১৯৩৯) এবং ‘সে, ইজ দিস ইউ. এস. এ’ (১৯৪১)। আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘অল আউট অন দি রোড টু স্মোলেনস্ক’ (১৯৪২)। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৫ পর্ষন্ত পঁচিশ খণ্ডে প্রকাশিত মার্কিন লোকজীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্থ আমেকরিকান ফোকওয়েজ সম্পাদন করা।

লেখকজীবনের প্রথম পনেরো বছরে কল্ডওয়েল কুড়িটা ছোটগল্প সংকলন, উপন্যাস, সমাজতাত্বিক রচনা, যুদ্ধ-বিষয়ক সংবাদ ও ভ্রমণকাহিনি লিখে ফেলেছিলেন। তিনি যখন লেখা শুরু করেন আমেরিকায় তখন এক অদ্ভুত সময় চলছে। প্রেসিডেন্ট হুভারের সমৃদ্ধির আশ্বাসের মধ্যেই দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল। তখন কমিউনিস্ট জুজুর ভয় দেখানোর পাশেই বিরাট অর্থনৈতিক মন্দার কালো ছায়া। এদিকে শ্রেণীবিরোধ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছিল। কাজের দাবীতে দেশজুড়ে শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভুখা মিছিল। তার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের পেনশন কেটে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের উপর জেনারেল ম্যাকার্থারের নির্দেশে সেনাবাহিনি আক্রমণ চালায়। সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের জেরে পরিবর্তন ঘটে। রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন, শুরু হয় ‘নিউ ডিল’ পর্ব। অপেক্ষাকৃত সহনীয়, অনুকূল পরিবেশে কল্ডওয়েলের সমাজ-সচেতন সাহিত্যিক সত্ত্বা আরও বেশি করে লেখার সুযোগ পায়। তার আগেই অবশ্য তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘আমেরিকান আর্থ’ (১৯৩১) প্রকাশিত হয়ে গেছে। এর দু’বছর পরে তাঁর আরও একটি ছোটগল্পের সংকলন ‘উই আর দ্য লিভিং’ (১৯৩৩) প্রকাশিত হয়। ঐ বছরই সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি বিখ্যাত ‘সিলভিয়া’ গল্পটি লেখেন। এর পর প্রকাশিত হয় ছোটগল্প সংকলন ‘নীল টু দ্য রাইজিং সান’ (১৯৩৫) ও ‘সাউথওয়েজ’ (১৯৩৮)।

পরের কয়েক বছরে মার্কিন সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তীব্র হতে থাকে। এক দিকে সাধারণ আমেরিকানরা স্পেনে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে লড়াই করতে গেছেন, নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে চেয়েছেন। অন্য দিকে ভেতর ভেতরে বর্ণবিদ্বেষের চোরা স্রোত রয়েই গেছে। তখন কমিউনিস্ট বিরোধিতার নানা পথ বের করা হচ্ছে, পুঁজিবাদীদের ফ্যাসিবাদ-প্রেম কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে কাজ করেছে। রুজভেল্টের সীমিত সদিচ্ছাগুলোও নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। চারদিকে যখন এই টালমাটাল পরিস্থিতি চলছিল, তখন কল্ডওয়েলের রচনাও আপন গতিতে এগোচ্ছিল। বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমাজ-সচেতন করে তুলেছিল, যা সেই সময়ের বিভিন্ন রচনায় পরিস্ফুট।
তিনের দশকে কল্ডওয়েল ছিলেন বামপন্থী পত্রিকা ‘নিউ মাসেস’-এর লেখক। তাঁর সেই সময়ের রিপোর্টাজে ধরা থাকত দরিদ্র মানুষের অবর্ণনীয় দুরাবস্থা, নিগ্রোদের প্রতি নির্যাতন প্রভৃতির বিবরণ। নিপীড়িতের প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র মন নিয়ে তিনি চেয়েছিলেন বিপ্লবী লেখক হতে এবং নিজেকে তা বলতেও তিনি দ্বিধা করেননি। অন্য অনেকের সঙ্গে থিওজোর ড্রাইজোর, ল্যাংস্টন হিউজেস, রিচার্ড রাইট এবং আর্স্কিন কল্ডওয়েল বিপ্লবী কর্মসূচী ও আদর্শের প্রতি অনুরক্ত লেখকদের একটি কংগ্রেস আহ্বানের জন্য প্রচার করেছিলেন।

হাওয়ার্ড ফাস্ট গোত্র বিচারে কল্ডওয়েলকে আমেরিকান সাহিত্যের বাস্তববাদী ধারার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেই হিসাবে তিনি নিঃসন্দেহে এক মহান ঐতিহ্যের বাহক। এই ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল ন্যাথানিয়েল হথর্ন, হেরমান মেলভিল, মার্ক টোয়েন ও জ্যাক লণ্ডনের হাতে। বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে জন স্টেইনবেক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রমুখের মতো কল্ডওয়েলও সেই ঐতিহ্যকেই বহন করেছিলেন। এই বাস্তববাদকেই হাওয়ার্ড ফাস্ট চিহ্নিত করেছিলেন বুর্জোয়া বাস্তববাদ বলে – যা বস্তু বাদী নয়, বরং মূলগতভাবে ভাববাদী। কিন্তু তাতে সাহিত্যিক কল্ডওয়েলের কৃতিত্ব মোটেই খাটো হয় না। তাঁর ‘গডস ওন একর’ উপন্যাসে যে চরিত্রগুলোকে দেখা য়ায় তারা দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ কৃষক। কিন্তু তারা এমন এক সমাজ-ব্যবস্থার শিকার, যা তাদের সব মানবিক গুণাবলীকেই নষ্ট করে দেয়। যৌনতা হল তাদের মুক্তি এবং একমাত্র আশ্রয়ও বটে। এই লোকগুলির দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা. মানবিক বোধের অপমৃত্যু ইত্যাদির নিখুঁত ভাষাচিত্র অঙ্কণ তাঁকে মার্ক টোয়েনের মতোই সোশ্যাল ক্রিটিক করে তুলেছে। ওয়াল্টার অ্যালেন সংগত কারণেই বলেছিলেন কল্ডওয়েল হলেন দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের গোগোল।

অনেক সমালোচকের মতে উপন্যাসের থেকে ছোটগল্পেই কল্ডওয়েলের সার্থকতা বেশি। এটিই তাঁর সব থেকে স্বচ্ছন্দ বিচরণক্ষেত্র। আবার কেউ কেউ মনে করেন জীবনের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ রূপের সম্বন্ধে যে ব্যাপক অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছিলেন, উপন্যাসের বিস্তৃততর ক্যানভাসই তার চিত্রায়নের পক্ষে সব থেকে উপযোগী। কিন্তু তুল্যমূল্য বিচারে মনে হয় ছোটগল্পগুলিতেই তাঁর লেখকসুলভ অন্তর্দৃষ্টি গাঢ় ও গভীর। মোটামুটিভাবে তাঁর প্রথম পর্বের সব রচনাতেই সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে আগ্রহের প্রকাশ ঘটেছে। সেই আগ্রহ তাঁর ছোটগল্পের গঠনরীতি ও রচনাশৈলীতে অনেক বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। যে সমাজ-সচেতনতা তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রধান বৈশিষ্ট্য তা ছোটগল্পের মধ্যে অনেক বেশি তীব্র। সাধারণভাবে বলা চলে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে সাধারণ মানুষের জীবন ও অমানবিকতা আরো তির্যক ভঙ্গিতে ও ব্যঞ্জনধর্মীতায় চিত্রায়িত হয়েছে।

কল্ডওয়েল শুধু নিস্পৃহভাবে এই অমানবিকীকরণের রূপায়ণই করেননি, তিনি ছোটগল্পে এক ধরনের প্রতিবাদও জানাতে চেয়েছিলেন এবং পাঠকের চেতনার মর্মমূলে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন। এই জন্যই তাঁর ছোটগল্পে নিগ্রোদের কথা আসে। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়া নিগ্রোদের জীবন, তাদের উপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার, লিঞ্চিং – এসব শুধু ‘নিউ মাসেস’ পত্রিকার রিপোর্টাজ হয় না; আসলে তা ছোটগল্পের উপাদান হয়ে ওঠে। তিনি যখম এই গল্পগুলি লিখেছিলেন তখন তাঁর মধ্যে ক্রোধ ও বিষাদ, আশা ও প্রতিশ্রুতি যুগপৎ ক্রিয়াশীল ছিল। তিনি যেমন এক দিকে দেখিয়েছেন নিপীড়ক শ্রেণীবিভক্ত সমাজ সাধারণ মানুষের মানবত্বকে শুষে নেয়, তেমনই অন্য দিকে তাঁর আশাবাদ মনে করিয়েছে জীবনের আকাঙ্খা থেকেই চরম বিজয়ে পৌঁছানো যায়।

কল্ডওয়েলের গল্পে শোষকদের তুলনায় শোষিত নিগ্রোরা অনেক বেশি মানবিকতাবোধ ও জীবনীশক্তির অধিকারী। আবার তাঁর কিছু গল্পে লিঞ্চিং-এ উৎসাহী শ্বেতাঙ্গরাও নিতান্ত সাধারণ মানুষ। এর থেকে বোঝা যায় পরিবেশ ও শেখানো ঘৃণা তাদের কেমন বিষাক্ত করে তুলেছে। এ ভাবেই একটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বাইরের ও ভিতরের হিংস্র চেহারা তিনি প্রকট করে তোলেন। আবার তাঁর জীবন-সম্পৃক্ত মনোভাব এবং জীবনের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম থেকেই লঘু কৌতুকের বা স্নিগ্ধ রোমান্সের গল্পগুলি রচিত হয়। কিন্তু এই গল্পগুলিতেও তিনি কোনও কৃত্রিমতায় বিশ্বাসী নন। সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবন থেকেই তিনি গল্পের চরিত্র বেছে নেন ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেন। সেই জন্যই তিনি একদা বলেছিলেন – “I’m not interested in plots. I’m interested only in the characterization of people and what they do.” সাধারণ মানুষের জীবন থেকেই তিনি ভালবাসা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ বা কৌতুকের উপাদান বেছে নেন। এক সময় তাঁর গল্প সম্পর্কে অনৈতিকতা ও অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল এবং কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর রচনার অন্তর্লীন জীবনপ্রেম পাঠককে ঠিকই টেনে রেখেছিল।

কল্ডওয়েলের ছোটগল্পের বর্ণনাভঙ্গি অত্যন্ত নিরাসক্ত এবং দৃষ্টিভঙ্গীও নৈর্ব্যক্তিক। এই নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গল্পগুলির আভ্যন্তরীণ নিষ্ঠুরতাকে যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, অন্তত যেখানে তিনি এই নিষ্ঠুরতাকেই চিহ্নিত করতে চান। ফলে তা পাঠককে কেবলই ধাক্কা দিয়ে চলে, বিশ্রামের অবকাশ দেয় না। তাঁর ভাষা একেবারে ঋজু ও নির্মেদ। আবার ডিটেলস-এর প্রতি তাঁর মনোযোগ অনেকটা চলচ্চিত্রের মতো। কল্ডওয়েলের লেখা অনেক সময় মার্ক টোয়েনের কথা মনে করায়। আবার কোনও কোনও লেখা মনে করিয়ে দেয় হেমিংওয়ে বা অ্যালবার্ট মালৎস-কে। কিন্তু কল্ডওয়েল কোনও ভাবেই তাঁদের অনুকারক নন – যদিও তিনি দীর্ঘদিন এই লেখকদের সহযাত্রী ছিলেন।

১৯৮৭ সালের ১১ এপ্রিল অ্যারিজোনার প্যারাডাইস ভ্যালিতে কল্ডওয়েল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮৩ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি ২৫টি উপন্যাস, ১৫০টি গল্প, ১২টি নন-ফিকশন গোত্রের রচনা, দুটি আত্মজীবনী এবং তরুণ পাঠকদের উদ্দেশ্য দুটি বই লিখেছিলেন। এ বিষয়ে সমালোচকেরা সকলেই একমত যে কল্ডওয়েলের লেখকজীবনের প্রথম পর্বের রচনায় যে জোর খুঁজে পাওয়া যায় তা পরবর্তীকালের রচনায় অনুপস্থিত। জীবন থেকে তাঁর মুখ ফিরিয়ে নেওয়াই হয়তো এর কারণ। আসলে সংগ্রামী মানুষের লড়াই ও প্রগতিবাদী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে বাস্তবের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যায়। তখন নিছক রচনাশৈলী ও বাহ্যিক অলংকরণের সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু রচনার অন্তঃসারশূন্যতার কারণে সে দক্ষতাও প্রায়ই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকের অনেক আমেরিকান লেখকই পেটি-বুর্জোয়া দোদুল্যমানতায় অথবা ম্যাকার্থিজমের দাপটে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে অনেকেই রং বদলেছিলেন এবং লড়াই ছেড়ে আপাত স্বস্তির আশ্রয় বেছে নিয়েছিলেন। এমনকী যে হাওয়ার্ড ফাস্ট একদা দলত্যাগীদের তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়েছিলেন তিনিও পরে ‘নেকেড গড’ লিখে হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন। সে তুলনায় কল্ডওয়েলের পরবর্তীকালের রচনা তাৎপর্যহীন হলেও তেমন মিথ্যে বলা যাবে না। অন্তত লেখকজীবনের প্রথম পর্বের রচনাগুলির জন্যই তাঁকে মনে রাখতে হবে।