রম্যরচনাঃ কথার কথা

রম্যরচনাঃ কথার কথা

কথার কথা
স্বপন নাগ

কথায় আছে, কথায় কথা বাড়ে। তা বাড়ুক। কথা ছাড়া জীবনটাই যে পানসে ! হালকা কথা, মিষ্টি কথা, মনের কথা, মুখের কথা, কড়া কথা, কাজের কথা, শেষকথা বা কথার কথা তা যা-ই হোক। একটু ভেবে দেখলে দেখা যাবে, বলার মত কথাও কিন্তু খুব কম নেই।

যাই হোক, কথা হচ্ছিল কথা নিয়ে। চারপাশ জুড়ে কত কথা ! ছোটবেলা থেকে তো কত কথাই শুনে আসছি। সেই মায়ের শাসন থেকে শুরু, কখন থেকে পড়তে বসতে বলছি, কথা কানে যাচ্ছে না বুঝি ! আর এখন, বৌয়ের অভিযোগ, কথা না-শোনাই নাকি আমার স্বভাব।

“সহজ কথা যায় না বলা সহজে”, রবি ঠাকুর বলেছিলেন। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ” এ কথা খুব সহজ কিন্তু কে না জানে সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।” বেশ গোলমেলে ব্যাপার । সহজ কথা সহজ নয় ? এই যে পথেঘাটে, বাসে-ট্রেনে, হেঁটে-শুয়ে মোবাইলে এত কথা বলে লোকে ? ভাবি, কয়েক বছর আগেও , যখন এই মোবাইল যন্ত্রটা হাতে আসেনি, তখন মানুষ কত কথাই না মনে চেপে রাখত ! সুন্দরী ললনা যখন কানে মোবাইল চেপে ধরে দীর্ঘ আলাপনে মগ্ন, ইচ্ছে হয় কানের কাছে জীবনানন্দের পঙক্তিগুলো সজোরে উচ্চারণ করি, “কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে ?” আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সেই কবেই লিখে গেছেন, “কেউ কথা রাখেনি।”

কবিতার কথা থাক, বরং গানের কথায় আসি। আমার জন্মেরও আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন, “কথা ক’য়ো না গো, শুধু শোনো।” কিন্তু কে শোনে কার কথা ! এ কথা চলছে নিরন্তর ! শৈশব থেকে শুনতে শুনতে এখনো মান্না দে-র সেই গান আমাকে দুলিয়ে যায়, “কথা দাও আবার আসবে।” তা কথা কেউ দেয়, কেউ দেয় না। তবু কথা দেওয়া নিয়ে তো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দিব্যি বাজছে, “কথা দিলাম, তুমি আমি যুগে যুগে থাকব সাথে।” আশা ভোঁসলে যখন গান, “কথা হয়েছিল তবু কথা হল না” , তখন আন্দাজ করতে পারি এলেবেলে কথা হয়েছে, কাজের কথা কিসসু হয়নি। তবু তাঁরই কন্ঠে কখনো হতাশাই সুরে সুরে লতিয়ে ওঠে “কথা দিয়ে এলে না”! কথা দিলেও আবার অন্যরকম সমস্যা : “কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায় কী কথা রাখলে বাকি।” তো কেউ কথা দিল, কেউ দিল না, আবার কেউ কথা দিয়েও এলো না, — তবু চলে ; কিন্তু নীরব থাকলে কী করা যায় বলুন তো ! তখন কি গাইতে ইচ্ছে করে না : “কেন কিছু কথা বলো না?” আবার, “কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয় সবই মুখে বলা যায় না !” আমার মত এলেবেলে মানুষের আবার “মুখে বলা যায় না” এমন কথা বুঝে নেবার এলেমই নেই।

এই সব কথা নিয়ে সেদিন আমার এক বন্ধু দীনেশকে বলতে গিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমি যত আমার কথাকে অকাট্য প্রমাণের চেষ্টা করি, দীনেশ ততবারই আমার কথা কেটে দেয়। আগ বাড়িয়ে কথা বলবার লোক নয় যে-মেহমুদ, সেও আমাদের কথায় নাক গলাতে শুরু করল। শুরুতেই একটা মোক্ষম ডায়ালগ ঝেড়ে বসল, “কথায় চিঁড়ে ভেজে না ভাইয়া, করে দেখাতে হয়।” মেহমুদ সেলস্ রিপ্রেজেন্টেটিভ, কথা বেচে খায়। তার কথার ধারও যথেষ্ট। আমাদের তর্ক থামাতে সে বোঝাতে শুরু করল, “কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সাহিত্য হয়, বড় জোর স্টার আনন্দের টিভি ক্যাচাল হয়, কোনো সমস্যার সমাধান হয় না।” সেদিন আমাদের তর্ক থামাতে আমি আর দীনেশ মেনে নিলাম যে মেহমুদ যা বলেছে, তা হক কথা।

কথা যখন উঠল, তবে আমার গৃহিণীর কথা একটু বলি। আমার গৃহিণীটি বেশ কথায় পটু। মিষ্টি কথায় পাড়ার কমবয়েসী ছেলেদের দিয়ে কত কাজ যে করিয়ে নেয় ! সেই মহিলাই আমার বেলায় একদম উল্টো — কথায় কথায় শাসানি। তা হোক। এইভাবেই তো শাসনে সোহাগে দিব্যি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলাম। এ তো কম কথা নয় ! আমাদের মেয়েটাও হয়েছে তেমনি। সেই ছোট্ট বেলায় কথা ফোটা থেকে শুরু করে সারাদিন বকবক বকবক করেই চলেছে। কথার যেন খই ফুটছে ! সারাদিন মোবাইলে কার সাথে কী যে কথা বলে, বুঝি না। কথা তো নয়, যেন কথার ফুলঝুরি !

আমি নিতান্তই সাদাসিধে মানুষ। কারোর কোনো কথাতেই থাকি না। কথার মারপ্যাঁচও বুঝি না তেমন। বৌ আর মেয়ে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। শুধু বৌকে একটু বেশি সমীহ করে চলতে হয়, এই যা ! আমার বৌ রাগী হলে কী হবে, সে কিন্তু এক কথার মানুষ, কম কথারও । তার কথার বড় একটা নড়চড় হয় না।

কথা দিন, কথাটা পাঁচকান করবেন না, তা হলে বৌয়ের একটা দোষের কথা জানাই। আসলে আমার বৌ কথা চালাতে খুবই ওস্তাদ। ও বোঝে না, কথা চালাচালিতে প্রায়ই কথার মানে পাল্টে যায়। তখন উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমারই শরণ নেয়। কড়া কথা ছেড়ে তখন মিষ্টি কথায় আমাকে গলিয়ে দেয়। ভালোবাসা পেলে আমিও যেন কেমন হয়ে যাই। তখন বৌয়ের কথা ফেলতে পারি না। ওর গুনও তো কম নয়। ওর কথা আর কাজে কোনো অমিল পাবেন না। সবই ভালো, শুধু রেগে গেলে সব গন্ডগোল হয়ে যায়। তখন ওর কথার কোনো মাথামুন্ডু ঠিক থাকে না।

বেশ কিছু বছর আগে একবার কীভাবে যেন ওর প্রাকবিবাহ প্রেমের কথা ফাঁস হয়ে গেছিল। তা নিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলে এমন রেগে গেছিল যে পাক্কা তিন মাস আমাদের কোনো কথা ছিল না। এতদিনেও কোনোভাবে ও প্রেমিকের কথা ফাঁস করেনি। শেষে হাল ছেড়ে আমিও আর এ নিয়ে কথা বাড়াই না। বুঝে গেছি, এই প্রসঙ্গে ওর মুখ থেকে কথা বের করা আমার সাধ্যি নয়। সত্যি বলতে আমার বৌ আমার কোনো কথারই ধার ধারে না।

মেয়েটা বড় হচ্ছে। ওর বিয়ের কথা তো ভাবতে হবে ! গত রাতে সাহস করে বৌয়ের কাছে কথাটা পাড়লাম।
বৌ বলল, “এ আর নতুন কথা কী। চেষ্টা করো।”
” তাহলে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিই ?”
“বিজ্ঞাপন ! বিজ্ঞাপন দিয়ে অতনুকে ডাকতে হবে ?”
“মানে !”
“তুমি জানো না, আজ দু’বছর ধরে তোমার মেয়ে সরকার বাবুর ছোট ছেলে অতনুর সঙ্গে প্রেম করছে ?”

আমি সত্যিই জানতাম না। আমার মেয়ে দেখতে শুনতে মন্দ নয়। পড়াশুনোতেও মোটামুটি। তবে নাচে ভালো। কত্থক। যদিও কথাকলি ওর ফেভারিট। লোকে ওর নাচের তারিফ করে। “দেখতে হবে তো কার মেয়ে” এমন ভাব নিয়ে কৃতিত্ব আদায়ও করে আমার বৌ। আর প্রেম করছে বলে শুধু “আমার” মেয়ে ?

আমার শরীরে রাগ নেই বলে সব শুনেও চুপ করে থাকি। একটু থেমে জিজ্ঞেস করি, ” তাহলে কী করব ?”
” কী আর করবে ! সরকার বাবুর কাছে যাও। কথা চালাও। তুমি তো আবার একটা ন্যালাখ্যাপা। এমনিতে কথার জাহাজ, কাজের বেলায় মুখে কথা সরে না !”
একটু একটু রাগ হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল দুকথা শুনিয়ে দিই। কিন্তু রাগটা ঠিক সেভাবে জেগে উঠল না। ও সব কথার কথা বলে পাশ কাটাই। মনে মনে বলি, সব কথায় কান দেওয়া পুরুষমানুষের কাজ নয়। চুপ করে থাকি।
হুকুমের সুরে বৌ বলল, “কথাটা তুললেই যখন আর দেরি ক’রো না। সামনের রোববার সরকার বাবুর বাড়ি যাও। দরকার হলে অতনুর সঙ্গে কথা বলে আসল কথা বের করো। ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের কথা আদায় করে তবেই ঘরে ঢুকবে।”
“ঠিক আছে।”

বলেছি, ঠিক আছে। মানে, কথা দিয়েছি। বৌয়ের কথা সারকথা — সেখানে গীতার কথা, বেদের কথা, রামায়ণের কথা বা মহাভারতের কথা কোনো কথাই নয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, কথা যখন দিয়েছি, কথার খেলাপ হবে না, দেখে নিও ।

কিন্তু সকাল থেকেই আজ শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছে !