গল্প: গোলাপে কাঁটা বলে কেউ কি গোলাপ তুলে না

গল্প: গোলাপে কাঁটা বলে কেউ কি গোলাপ তুলে না

গোলাপে কাঁটা বলে কেউ কি গোলাপ তুলে না
স্বাতী চৌধুরী

এইডা আবার কি ?
কোনডা ?
এই যে বুকের মধ্যিখানে।এইডা এইখানে দিছো ক্যান? টেবিলে বিছানো জামার বুকে আঙুলের টোকা দিয়ে আনতারা বলে, লোকে পরথমেই এইডা চাইবার উসিলায় আমার বুকের পাইল চাইয়া থাকবো।এইডা কাইটা ফালাও।
ধুর পাগলি।কে কি চাইল আর কইলো হেইডা ভাইবা অত কাম নাই।খারাপ মানুষেরা কত কিছু দেখে আর কত কিছু করে, কত কিছু কয়।এইসব খারাপ মানুষেদের অত পাত্তা দেওয়ার কাম নাই।শোন, এইডা একটা গোলাপ ফুল দিছি।তরে আমার সবসুমায় গোলাপ ফুল দিবার মন লয়, কিন্তু দিমু ক্যমনে? কেউ না কেউ যুদি দেইখা ফালায়? আর গাছের গোলাপ আর কতখান সুমায় থাকবোইবা তোর কাছে? সুগন্ধি নষ্ট হইয়া গেলেতো তুইই ফালাইয়া দিবি।তারচে এই ভালা যে, জামার বুকে ফুল দিলাম, আমার এই ফুল তোর বুকের ভিতরে থাকবো।যখনই ফুলটা দেখবি বুকের ভিতরে আমারে অনুভব করবি।ইচ্ছা হইলেও আমারে ভুলতে পারবি নারে গোলাপী।জানস আমি না সারাক্ষণ তোর বুকের ভিতরে ফুলের গন্ধ হইয়া থাকতে চাই রে…. জামা ছেড়ে আনতারা এবার সামিরের মুখের দিকে চোখ তুলে চায়। সামিরের চোখে কোন দুষ্টুমি নয় শুধু মুগ্ধতা ছড়িয়ে থাকে।এত কিছু বোঝার বয়স তখন নয় আনতারার।মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে।পনের ষোল বছরের কিশোরীর চপলতায় সে সারাক্ষণ তিড়িং বিড়িং করে। সামিরের মুখের কখা সে বুঝতে পারে কিন্তু চোখের ভাষা বোঝার ফুরসত কই তার ? তবে আজ ওচোখে চেয়ে যেন তার উচ্ছলতা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল।সে স্থির চোখে সামিরের চোখে চোখ রাখলো।তারপর সবটা অনুবাদ না করতে পারলেও যেটুকু পারলো তাতেই তার সারা শরীরে একটা রিনিঝিনি বেজে উঠল ।
নিজের মুখের দিকে আনতারার এই স্থির হয়ে চেয়ে থাকায় সামিরও অবাক চোখে চেয়ে থাকে। এই চপল কিশোরীর এমনরূপ তার কাছে অভূতপূর্ব। সে বলে, কি দেখছিস এমন কইরা ?
তোমারে দেখি, বলে হাতের মুঠোয় ধরে নতুন জামাটি নিয়ে দৌড়ে পালায়।সামির সেই পালিয়ে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে।
আনতারা দৌড়ে বাড়ীর পেছনের পুকুর পাড়ে যায়। তার মা মেয়ের দৌড়ে যাওয়া দেখে পিছু নেয়। ও মাইয়া কই যাস ? কিন্তু মা আর মেয়ের নাগাল পায় না। সে দৌড়াতেই থাকে। মা পিছে পিছে দৌড়ায় আর বলে অ ঝি, কই যাস তুই ? নতুন জামা হইছে ? সামির অত তাড়াতাড়ি জামাডা বানাইয়া দিয়ালাইছে ? দেহি না মা একবার গায় দে, কেমুন লাগেরে তরে দেহি ?
প্রতিবেশী দর্জি চাচার ছেলে সামির।পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার দোকানে বসে বাবাকে টুকটাক সাহায্য করতো। গ্রামের সকলে কি তারিফ করতো।দেখো সামিরটা কী ভালf ছেলে।এই বয়সে বাপেরে কেমন সাহায্য করতে আসে।আর এভাবেই সে শিখে ফেলে দর্জির কাজ।কাজ শিখে ফেলায় অভাবের সংসার একা টানতে না পেরে বাপ আর সামিরকে মেট্রিক পাশের পর আর পড়ালেখা এগিয়ে নিতে দেয়নি।নিজের সাথে কাজে লাগিয়ে দেয়।সেই থেকে সামিরও এখন পেশাদার দর্জি এবং দক্ষতায় সে বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে।বাজারের দোকানেই বাপ বেটা বসতো। এখন বাড়ীর সামনের ঘরটার একপাশে কোঠা তুলে আর একটা দোকান করেছে।সকাল বিকাল সামির এখানে কাজ করে।তাতে গ্রামের খদ্দেরগুলোর সুবিধা হয়। বাইরে যেতে হয় না বলে গ্রামের প্রায় সকলেই তার খদ্দের। তবে সামির সারাদিন এখানে কাজ করে না। দুপুরে বাপ বাড়ীতে এলে সেই সময়টায় আর সন্ধ্যার পর সে বাজারের দোকানে বসে কাজ করে।পাশের বাড়ীতে একজন দক্ষ দর্জি থাকতে আনতারার মা ছেলেমেয়ের পোশাক তৈরির জন্য আর কোথাও না গিয়ে সামিরকে দিয়েই তৈরি করিয়ে নেয়।ছোটবেলা থেকে তাই আনতারা সামিরের হাতে তৈরি করা জামা পরে বড় হয়েছে।মা এখন কাপড় কিনে দিয়ে আনতারাকেই বলে যা সামিরকে দিয়ে বানিয়ে নিয়ে আয়।কাপড় হাতে নিয়ে আনতারা সামিরের বাড়ীর দর্জিখানার ঘরের দিকে ছুট লাগায়। বাবা বলে, ও ঝি ছুটছিস ক্যান?হাইটা যা মা; নাইলে হুচট খাইয়া পড়বিতো!কে শোনে কার কথা ? আনতারা ছুটেই চলে..
সামির হয়তো টেবিলে কাপড় কাটায় ব্যস্ত, তাতে কি, থ্রি পিসের কাপড় সামিরের টেবিলে ছুড়ে দিয়ে তার দাঁড়াবার সময় নেই্।ছুটতে ছুটতেই বলে সামির ভাই,তাড়াতাড়ি দিও।তারপর দে ছুট।কখনো সামিরের মুখের দিকে তাকানোর সময় হয়নি আনতারার।সামির শুধু এ আওয়াজটা শুনেই বর্তে যায়।সে ঘাড় ঘুরিয়ে আনতারাকে দেখতে চায় কিন্তু তার মুখটা আর দেখা হয় না।সে দেখতে পায় একটা চপলা বনহরিণী ছুটছে।মুগ্ধ হয়ে সে তার এই ছুটে চলা দেখে।আরো অনেক মেয়ে তার দোকানে আসে পোশাক তৈরি করতে। তারা তার সাথে হাসিমুখে কথা বলে, কেউ কেউ ভাবও জমাতে চায়।কিন্তু সামিরের মন এদের কারো গলার সামির ভাই আওয়াজ শোনার অপেক্ষায় তো থাকে না যেমন থাকে আনতারার মুখে সেটা শোনার জন্য। সামির নিজেকে প্রশ্ন করে ।কেন এমন হয়? দিন দিন মেয়েটিকে দেখার জন্য, তার সাথে দুটো কথা বলার জন্য তার পিপাসা যেন বাড়তেই থাকে।অথচ সে খালি তিড়িংবিড়িং ছুটেই চলে আর তার সাথে সম্পর্কতো এইটুকু- “এ্যাই সামির ভাই” বলে একটা আওয়াজ।তবু এইটুকুতেই যেন সকল পিপাসা মিটে যায় আর আবার সেটুকু শোনার জন্য সে নতুন করে তৃষ্ণার্ত হতে থাকে।সামির বুঝতে পেরেছে এরই নাম তবে প্রেম বা ভালবাসা যাই হোক।সিনেমা, টেলিভিশন নাটকেতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মানুষের এই প্রেমের কথাই বলে। গানের কথায়ও এই প্রেম ভালবাসারই বাজার।সামির তার নিজের মতো করে বুঝে তার মানে প্রেম ভালবাসা হইল কারোর জন্য বুকের ভিতর আনচান করা! একটা অসুখ নাই অসুখ!আর তার কথা ভাবলেই খালি সুখ!সেই আনতারা আইজ আমার লগে অত কথা কইল?আমার চউখে চউখে চাইল?জামার বুকের গোলাপ ফুল বানানোটা তবে স্বার্থক হইল?জামার বুকে ফুল তোলার জন্য সামির নিজেকে ধন্যবাদ দেয়।
আর জামা নিয়ে দৌড়ে পুকুর পাড়ের ঘাটলায় বসে থাকে আনতারা।সারা শরীরে এখনো তার রিনিক ঝিনিক বাজছে।বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা হাপড়ের মতো উঠছে নামছে।সেটা স্থির হচ্ছে না কিছুতেই।পুকুরের শান্ত টলটলে জলের ভেতর সে নিজের ছায়া দেখে।এ কোন লাজবতী আনতারা?একেতো সে চেনে না!চুল আঁচড়ানোর সময়,মুখে ক্রিম মাখার সময় আয়নায় যে নিজেকে সে দেখে,এ যেন সে নয়!! সামির ভাই এ কি কথা কইল? আমার বুকের ভিতরে সে গোলাপ ফুলের গন্ধ হইয়া থাকতে চায়?এমন সুন্দর কখা কোন মানুষ কইতে পারে ?
সে বুকে হাত দেয়।হৃদপিন্ডটা এখনো তাদের বড় ঘরে ঝোলানো দাদার আমলের পুরনো ঘড়িটার পেন্ডুলামের মতো লাফাচ্ছে।তবে কি সামির ভাই সত্যি সত্যি তার বুকের ভেতরে এসে বসে আছে?আনতারা নিজেকে প্রশ্ন করে।কিন্তু এইডা হয় কি কইরা? সামিরভাই তো হের দোকানে বইয়া কাপড় কাটতাছে।সে ভাবে।ভাবে এই কথা কি কাউকে বলা যায় ?
এই কথা কারে কওন যায় ? মায় তো পিছন পিছন ডাকছিল,মায়েরে জিগামু? না।আনতারার মন সায় দেয় না।সে বুঝতে পারে এইসব কথা মাকে বলা যায় না।তবে কি নয়নিরে কওন যায় ? নয়নিও একজনরে বুলে পছন্দ করে।না নয়নিরেও কওন যাইত না।তাই দুনিয়াসুদ্দা লোকরে সব জানাইয়া দিব।যে একটা পেট পাতলা মাইয়া না।তাইলে কারে কওন যায়?কারে কওন যায়?আপন মনে কথা বলে মেয়ে।শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে ধুর!কাউরে কিচ্ছু কওয়ার দরকার নাই।হাতের জামাটা কোলের উপর বিছিয়ে সে বুকের কাছের গোলাপটা দেখে তার উপর হাত বুলায় এবং আশ্চর্য সে যেন তাতে সামিরকে অনুভব করতে পারে।ঘরে গিয়ে সে জামাটি পরে বসে থাকে আর কিছুক্ষণ পর পর গোলাপের গায়ে হাত বুলাতে থাকে। তখন তার কেবল সামিরকে দেখতে ইচ্ছে করে।ওর কখা শুনতে ইচ্ছে করে। অথচ আজকের আগে কতদিন সামির তাকে পিছু ডেকেছে।সে ফিরেও তাকায়নি। আজ সামিরের মু্খে কি দেখলো সে ?
পড়তে বসে কিচছু ভাল লাগে না। শুধু সামিরের মুখ ভেসে ওঠে। শুধু সামিরের কথাগুলো কানে বাজে। অংক করতে গিয়ে সে খাতার পাতায় কাটাকুটি করে। পাতায় পাতায় শুধু সামির সামির নামের জপমালা যেন। লিখে আর কাটে।তারপর পাতাটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে দলা পাকিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে। তারপর মা যখন রাতের খাবার খেতে ডাকে তখন নিজেকে ঐদিনের মত সামলে নেয় সে ।পরদিন অকারণে সামিরের দোকানের দিকে হাঁটতে থাকে। সামিরও যেন তক্কে তক্কে ছিল। আজ তার চলায় বনহরিনীর চপলতা নেই। লাজুকপায়ে সে এগিয়ে যায়। সামির ডাকে, আনতারা কোথায় যাস ?
না এমনি।
শোন
বলো.
শোন না ?
বলো না ?
দোকানে কেউ ছিল না। আনতারা ঘরে ঢুকে। সামিরের চোখে চোখ তুলে তাকায়। ডাকছিলায় ক্যান ?
তুই এদিকে আইলি ক্যান ?
বাহ্ রে ! আমার বুঝি এইদিকে কোন দরকার থাকতে পারে না ?
সামির হাসে হ।কত দরকার আমার জানা আছে।দরকার তো তিড়িং বিড়িং লাফানো ।তয় আইজ যে লাফাইলি না বড়? সামির একটু থামে।তারপর বলে আমি যে তরে এট্টু দেখবার লাইগা পথের পাইল চাইয়া থাকি হেই হুঁশ একবারের লাইগাও হয়না বুঝি মহারানীর ?
মহারানী ? কে ?
কে আবার ? তুই !
এমন স্তুতি শুনে চপলা কিশোরী বিগলিত হয়।সে শুধু সামিরের মুখের দিকে চেয়েই থাকে।দৃষ্টি ফেরায় না। কি বলবে কিছু বুঝতে পারে না।শুধু ভাললাগার এক সুস্নিগ্ধ আবেশে আচ্ছন্ন হতে থাকে। আর নিজের প্রতি আনতারার এমন মধুর দৃষ্টিপাতে সামিরের খুশী আর ধরে না। তার হাসির উচ্ছাসে ভাঙ্গা দোকানঘরটায় বাঁশি বেজে ওঠে।
এই অকারণ আসা যাওয়া, অকারণ হাসি আর উচ্ছাস ফুরায় না্, দিনে দিনে সেটা বাড়ে। কখনো কলহাসির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। আশেপাশের লোকেরা গুনগুন করে।
গুনগুনানি আর গুনগুনানি থাকে না সেটাও ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। আর তার ঢেউ শেষে আছড়ে পড়ে আনতারার মা বাবার বুকের বেলাভুমিতে। সে বাতাসে প্রবল ঘৃণা ও আক্রোশ । আক্রোশের আগুন যখন সামিরকে ভস্ম করে দিতে উদ্যত সেটা কোনভাবে জেনে যায় আনতারা।
মা বাবা আর ভাইয়েরা কথা বলছিল।অকস্মাৎ সেটা তার কানে আসে। বড় ভাই এর যুক্তি সকলের পছন্দ হয়। সে বলে ঘটনাটা কোনকরকম ধামাচাপা দেওন গেলে লোকে আর কয়দিন মনে রাখবো ? একসুমায় সব ভুইলা যাইবো।
কিন্তু সেইটা কিভাবে করবায় ভাবছোনি কিছু? ছোট ভাই প্রশ্ন করে। সকলে বড় ভাই এর উত্তরের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।বড় কিছু একটা চিন্তা করে তারপর বলে-আমি দেখছি,কাজ সাইরা অনেক রাইতের বেলা বাড়ী ফিরে সামির।
বড়ভাই একটু থেমে আবার বলে, হেই সুমায় সামির প্রায় একলাই থাকে। আমরা তক্কে তক্কে থাকুম । যেদিন সে একলা থাকবো তখন তারে দুইজনে মিইলা ধইরা এক্কেরে বাইন্ধা লমু। হাত পাও মুখ বান্ধুম। হেরপর গলা টিইপ্যা মাইরা পাশের ডোবাতে ফেলাইয়া দিমু। হঠাৎ রেগে ওঠে সে। রাগে গরগর করতে করতে বলে, কি সাহস! ফকিন্নির পুত অইয়া আমার বইনের লগে পীরিত করে? আমার ভোলাভালা নাবালক বইনটারে সে পটাইয়া নিজের কইরা লইব সেইটা আমি হইতে দিমুনা আব্বা। তার চোখ ঠিকরে যেন আগুন বের হয়। সেই আগুনে সেখানে উপস্থিত সকলের চোখে আগুন জ্বলে।আব্বা অর্ডার দেয়- হ! দে শেষ কইরা ফকিন্নির পুতেরে–ছোট ভাইও বড়ভাই এর সাথে একমত হয়। শুধু মা একটু দ্বিধান্বিত হয়।
ফকিন্নির পুত সামির তার সরল মেয়েকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছে বলে ছেলেটার উপর তার বেজায় রাগ আছে বটে কিন্তু তাই বলে একবারে প্রাণে মেরে ফেলতে তার মায়ের মন সায় দেয় না।কথাটা ভাবতেই সামিরের মায়ের মুখটা মনে ভাসে। সামিরের মুখটাও।পাশাপাশি বাড়ীতে দুই মা তাদের প্রথম সন্তানকে বড় করতে গিয়ে একে অপরের সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় পাশাপাশি চলেছে।মায়ের দৌড়ানি খেয়ে কতদিন সামির তার আঁচলের তলায় আশ্রয় নিয়েছে।শান্তশিষ্ট ছেলেটার প্রতি তার মনে কোনদিন স্নেহ মায়ার কমতি ছিল না।আজ সেই ছেলেটাকে তার ছেলেরা মেরে ফেলবে? মা নিষেধ করে।বাপসকল এমন কাজ করিস না। আল্লার দোহাই। তোরা তারে শাসাইয়া ভয় দেখাইয়া দেখ-
না আম্মা এভাবে হয় না।এমন ঘটনা কোনকদিন বোঝাইয়া থামানো যায় নাই।দেখো না সিনেমা নাটকে? বোঝাইলে প্রেম আরও বাড়বো।আর তোমার যে মাইয়া? তারে কে বোঝাইব?সামির জেতা থাকলে তোমার মাইয়ারে এই পথ থাইকা কেউ ফিরাইতে পারবানা।
মা তবু মানতে পারে না।সে রোদনের মতো বলে,নারে বাজান তোরা এমন করিসনা।আল্লার গজব পড়বো। এই কাম করছে বুইল্লা তার উপুর আমারও রাগ আছে কিন্তু তার লিগা জানে মাইরা ফেলাইবি?ওরে তোরা শোনরে,সেই ছুডু বেলা থাইকা আমি হেরে পুতের মতই আদর করছি।তোরা অন্য ব্যবস্থা নে।ঝিরে আমি ভালা পোলা চাইয়া বিয়া দিয়া দিমু তোরা তাড়াতাড়ি নায় সেই ব্যবস্থা কর।
ছেলেদের বাবা বলে,শোন পোলারা,তোরা তোদের কাজ কর।তোর মায়েরে আমি সামলাইতাছি।ছেলেরা বেরিয়ে যায়।বাবা মাকে বোঝানোর জন্য নানা কথা বলে যায়।মায়ের এক কানে ঢুকে সেটা অন্য কান দিয়ে বের হতে থাকে।তার চোখে কেবল সামির আর তার মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।আর মনে মনে সে অন্য পরিকল্পনা করে।দরজার ওপাশ দিয়ে যেতে যেতে আনতারা সামিরের নামটা শুনেছিল ।সামির সম্পর্কে কি বলছে সেটা শোনার জন্য সে থমকে দাঁড়ায় আর বাপ ভাইয়ের ভয়ংকর পরিকল্পনা শুনতে পায় ।সামির ভাইকে ওরা প্রাণে মেরে ফেলবে?কেন?সে তার সাথে গিয়ে একটু হাসাহাসি করে বলে,একটু কথা বলে,তাই ?সামির ভাইয়ের কাছে সে তো সেই ছোটবেলা থেকেই যায়।হ্যাঁ এটা ঠিক যে আগে সে সামির ভাইয়ের সাথে এতক্ষণ ধরে কথা বলে নি,এভাবে হাসাহাসি করে নি।কিন্তু তার ভাল লাগে বলেই সে কথা বলে,হাসে।এটা যদি মন্দ কাজ বা অন্যায় হয় তাকে বুঝিয়ে বললে,নিষেধ করলেই পারতো ।সামির ভাইয়ের জীবনের জন্য সে না হয় তার এই ভাললাগাটুকুকে বিসর্জন দিতে পারতো।সে ভাবছিল বাপ ভাইকে গিয়ে সেকথা বলবে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরা তা বিশ্বাস করবে না।মা তো নিষেধ করলো,মার কথাতো কেউ শুনলো না তবে তার কথা কেন শুনবে ? আনতারা ভাবে এভাবে হবে না। তাই সামিরকে বাঁচানোর জন্য সেও অন্য পরিকল্পনা করে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর আনতারর বাপ ভাই বিকেল হলেই বাজারে চলে যায়।বাপ আর বড় ভাই ব্যবসার জন্য ছোট ভাই প্রাইভেট পড়তে।অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ওরা বাড়ী থেকে চলে গেলে অনতারার মা এমন কি পাড়া পড়শীর চোখ এড়িয়ে সামিরের দোকানে যায়।চাচীকে দেখে সামির খুব খুশী হয়।সে দোকানের একমাত্র প্লাস্টিকের চেয়ারটা ঝেড়ে মুছে এগিয়ে দিয়ে বলে বসেন চাচীআম্মা।অন্যদিন হলে চাচীআম্মা ভাতিজার এই খাতির যত্নে বিগলিত হতো।আজ মুখ গম্ভীর করে বলে আমি বসতে আইছিনারে সামির, তোরে একটা কথা কইতে আইছি।
কথা?সামিরের বুকটা ভয়ে কেঁপে ওঠে।কি কথা কইবো চাচী? তবে কি আনতারার লগে তার ভাবসাবের কথা চাচীআম্মা জাইনা গেছে?আর চাচীআম্মা কখাটা কিভাবে বলবে সেটা ভেবে না পেয়ে ইতস্তুত করে। সেটা দেখে সামির তার স্বাভাবিক মোলায়েম সুর থেকেও আরও যতটা সম্ভব মোলায়েম করে বলে, কি কথা কইবেন চাচীআম্মা কন। তারপর নত মুখে দাড়িঁয়ে থাকে।
তুমি এই গেরাম থাইকা দূরে, অনেক দূরে চইলা যাও ।পারলে আউজকাই।নাইলে আমার পুতেরা তোমারে জানে মাইরা ফেলাইব।এর বেশী কিছু কইতে পারুম না। যিডা কইছি হিডা করো বলে চাচীআম্মা ঝড়ের গতিতে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়।সামির বোঝা না বোঝার মাঝে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে চাচীআম্মার চলে যাওয়া দেখে।দূর থেকে মাকে সামিরের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে পেছনের দরজা দিয়ে আনতারা এবার সামিরের ঘরে এসে ঢুকে। ঘরে ঢুকে আম্মা ক্যান আইছিল- এই পশ্নটা করে বটে সে, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সে সকালে বাপ ভাই এর পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত জানিয়ে বলে তুমি চইলা যাও সামির ভাই।যেখানে খুশী চইলা যাও।অনেকদিন পরে যখন সবার রাগ পইড়া যাইবো তখন তুমি বাড়ী আইসো।নাইলে ওরা তোমারে মাইরে ফেলাইবো
আনতারার কথা শুনে এবার সামিরের কাছে সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়।তাদের ভাবসাব জানাজানি হয়ে গেছে।সে গরীবের পোলা,ওরা বড়লোক এই অহংকারে লাগছে তো?তার লিগা হেরে তারা মাইরা ফেলাইব? এমন ভয়ংকর তারা?হেরা তার ছোট বেলার দোস্ত আছিল না?একসাথে খেলতে খেলতে বড় অইছে না ? চাচীআম্মার প্রতি সে কৃতজ্ঞতাবোধ করে।তিনি তার স্নেহের পাত্রকে মরতে দিতে পারেন না তাই পালিয়ে বাঁচতে বলেছেন।আনতারাও তাকে সত্যিকারের ভালবাসে বলে সেই একই কথা বলেছে কিন্তু পালিয়ে কি সত্যি বাঁচা যায়?সে পালিয়ে গেলে তার মা বাবা ভাইবোনের কি হবে?কিন্তু আনতারা?তাকে ফেলেইবা সে যাবে কোথায় ? এই মেয়েটির মুখের একটু কথা,হাসির একটুকরো রিনিরিনি শোনার জন্য সে যে জীবনও দিতে পারে ! আনতারা নাহয় ছেলে মানুষ,প্রেমের গভীরতা এখনো আসে নি তার মনে।তাই শুধূ একপক্ষের বাঁচার কথা ভেবেছে।ভেবেছে পালিয়ে গিয়ে সামিরভাই বেঁচে থাকুক।নিজের কি হবে সেটা ভাবেনি সে।সামির এবার একটু শক্ত হয়।গলার স্বর গম্ভীর করে ডাকে,আনতারা!এমন প্রগাঢ় সম্বোধনে আনতারা চমকে ওঠে।সে সামিরের দিকে চোখ তুলে চায়।দেখে ওচোখে বিহ্বল দৃষ্টি।কি বলবে বুঝতে না পেরে সেও শুধু অসহায় বোবা চোখে চেয়ে থাকে।সামির বলে, আমারে যে পালিয়ে যাইতে কইলি আমার জন্য তোর কষ্ট হইবো না?আমারে না দেইখা থাকতে পারবি ?
আনতারা ভাবে।ওড়নার কোণা আঙুলের ডগায় পেচায় তারপর দাঁতে কাটে।বলে এমন কইরা ভাববার সুমায় পাইলাম কই ? খালি তোমারে বাঁচানোর কথাই ভাবছি।
সামির আবার বলে আমার জন্য তোর কষ্ট হইবো না ?
হইবো তো।কিন্তু কি করুম ? কান্নার দলায় আনতারার গলা আটকে আসে।তোমার সাথে কথা না কইলে তোমার মুখের কথা না শুনলে আমার যে দিন কাটে না সামির ভাই।তাও তুমি পালিয়ে যাও, তুমি বাইচা থাকো।ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হইব।
পালিয়ে যামু?সামির যেন আনমনে বলে।মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিছু ভাবে।তারপর আনতারার হাত ধরে বলে,ঠিক আছে পালিয়ে আমি যামু।চাচীআম্মাও আমারে পলাইতে কইছে।চাচীআম্মাও চায় আমি বাইঁচা থাহি। তবে আমি একা পালামু না আনতারা।আমি তরে নিয়া পালামু।তুইও চল।আইজ আমি আর বাজারের দোকানেই যামুনা।বাড়ীতেই থাকুম।তোর ভাইয়েরা রাইতের বেলা আমার জন্য পথে খাড়াইয়া থাকবো তো?রাইতের বেলা হেরা ফিরা আইব।তুই ব্যাগট্যাগ গুছাইয়া রেডি থাকবি।শেষ রাইতে ভোরবেলার এট্টু আগে আমরা বাইরাইয়া যামু।সারারাইত আমি প্যালেন করুম কোথায় যাওয়া যায়।যাবি আমার লগে আনতারা?সামিরের হাতে ধরা আনতারার হাত কেঁপে ওঠে। তার ভয় লাগে আবার ইচ্ছেও করে সামিরের সাথে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে।
কিন্তু সে কি ঠিক হবে ? লজ্জা কলংক কিংবা দুঃখ কষ্টের কথা সে ভাবে না।সে অন্য কিছু ভাবে।মূহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় সে।না,এটা ঠিক হবে না।চপল মেয়েটির বয়স যেন মূহূর্তে বেড়ে যায়।তার মনে পড়ে কিছুদিন আগে তাদের স্কুলের ক্লাস টেনের মেয়ে সুজাতা প্রেম করে পালিয়েছিল।তারা নাকি এখান থেকে অনেকদূর পালিয়েছিল কিন্তু পুলিশ ঠিক তাদের ধরে ফেলে।আঠারো বছরের আগে বিয়ে করা ঠিক নয়,এটা বাল্য বিবাহ। ক্লাসে এগুলো শেখায় তাদের।এটা অন্যায়।সুজাতার প্রেমিক নাবালিকা অপহরণের দায়ে এখন জেল খাটছে। আর লজ্জ্বায় অপমানে সুজাতা পড়া ছেড়ে দিয়েছে।আনতারা ভেবে দেখে সে সামিরকে চায়,ওকে ছাড়া তার কষ্ট হবে কিন্তু সে লেখাপড়াও করতে চায় আর সবচে ভয়ের ব্যাপার যে তার মনে হচ্ছে,এভাবে সে সামিরকে পাবে না।বরং তাকে হারাতে হবে।তার ভাইজানেরা যেকোনভাবে তাদেরকে ধরে ফেলবে আর তাকে কোথাও জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে আর মাঝপথে মিছেমিছি সামিরের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।তাই এভাবে পালিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।সে সামিরকে তার ভাবনার সবকথা জানায়।বলে তুমি অবুঝ হইও না সামির ভাই ।এইবার তুমি একা একাই পালাও।তুমি ভাইবো না। আমি তোমার লাইগা অপেক্ষায় থাকুম।আগে জীবনটা বাঁচাও। আমি ততদিনে মেট্টিক পাশ করুম।সকলে তোমার কথা ভুইলা যাইব কিন্তু আমি ভুলুম না।তুমি যেখানে যাইবা সেইখানে একটা ঠিকানা বানাও।আমার বয়স যখন আঠারো হইবো কেউ আমারে আর আটকাইয়া রাখতে পারবো না ।
সামিরের হাতে তখনো আনতারার হাত।সামিরের চোখের পানিতে সে হাত ভিজে গেছে।সে সামিরের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলে এইবার আমারে যাইতে দেও সামির ভাই। কেউ আইয়া পড়বো।তুমি যেখানেই থাকবা ভালো থাকবা।তোমার ফোন নাম্বার আছে আমার কাছে।আমি তোমারে ফোন করুম কিন্তু ভুলেও তুমি ফোন করবা না।তোমার আমার মাঝে যোগাযোগ আছে এটা কাউরে বুঝতে দেওয়া যাইব না।আমি পড়াশোনা লইয়া এমন ব্যস্ত হমু যে,সবাই ভাবব আমি তোমারে ভুইলা গেছি।
সামির কিন্তু হাত ছাড়ে না।সে আনতারার নীচু মুখ তুলে দিয়ে বলে আমার চউখের পাইল চাইয়া কথা ক, তুই সত্যি আমারে ভালবাসোছ?সত্যি আমার লিগ্যা অপেক্ষা করবি? তাই যদি হয় তবে আমি পালামু আর যদি তর ভালবাসা সত্যি না হয় তয় আমি পালামু না।আইজ রাইতের বেলা আমি একলা একলা রাস্তা পার হমু।তর ভাইয়েরা আমারে মাইরা ফালায় তো ফালাইব।তুই ছাড়া আমার এই জীবনের কুনু দাম নাই আনতারা।এবার সামির হাত ছেড়ে দেয়।
কিন্তু আনতারা তখনই চলে যেতে পারে না।সামিরের কখায় তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে।তবু সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তেমনি স্থির কন্ঠে বলে,কাউরে ভালবাসলে তারে বিশ্বাস করতে হয় সামির ভাই।
একটু থেমে সে আবার বলে,আমার কিন্তু তোমার উপর একটুও অবিশ্বাস নাই,হের লাইগাই কইতাছি তুমি যেখানে খুশী চইলা যাও।যদি অবিশ্বাস থাকত তাইলে ভয় পাইতাম,এইটা মনে কইরা যে অন্য জায়গায় গেলে তুমি আমারে ভুইলা যাও কিনা।তোমার উপর বিশ্বাস আছে বইলাই আমি সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় থাকুম। এইবার তুমি ঠিক করো তুমি কি করবায়।আমি যাই..।আর এক মূহূর্ত দেরী না করে এক দৌড়ে সামিরদের উঠান ও তাদের নিজেদের উঠান পেরিয়ে নিজের ঘরে এসে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে।তারপর নিরব কান্নায় বালিশ ভিজাতে থাকে।
আনতারার চলে যাওয়াটা ভোজবাজির মত ঘটে গিয়েছিল।শেষমূহূর্তে মেয়েটা যে সুরে আর ঢঙে কথা বলছিল তাতে সামিরের মনে হয়েছে এযেন আনতারা নামের কোনো চপল কিশোরীর কথা নয়।তার নিজের থেকেও পরিণত কোন নারী কন্ঠের কথা শুনছিল সে।মেয়েটা তার শেষের প্রশ্নে খুব আহত হবে এটা সে বুঝতে পারেনি।যখন বুঝতে পারলো তখন কিছু করার আগেই সে চলে গেল।বিদায় বেলাটা সে মেয়েটাকে এমন নিরানন্দে ভরিয়ে দিলো?অথচ মেয়েটা কত চোখ এড়িয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে তার কাছে এসেছিল তাকে বাঁচাবে বলে। আফসোসে চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছিল সামিরের। সত্যি সত্যি সে মনের দুঃখে আঙুল কামড়াতে লাগলো।
সারা বিকেল সামির বাড়ীতেই শুয়েছিল।মা বাবার প্রশ্নের জবাবে সে জানায় তার শরীরটা ভাল নেই।সন্ধ্যার ট্রেনে ঢাকায় গিয়ে সে ডাক্তার দেখাবে।বাবা বললো, আমি কি তর লগে আমু ?
না না। তোমার গিয়া কাজ নাই। আমি একলাই যাইতে পারুম।
তাইলে সাবধানে যাইস।রোজগেরে ছেলের শারিরীক অসুস্থতায় সামিরের বাবাকে একটু বেশী চিন্তিত মনে হয়।যাওয়ার সময় মা দোয়া ইউনুছ পড়ে ফু দেয়।প্রতিদিন যে ব্যাগে ভরে কাপড় নিয়ে বাজারে যায় সেই ব্যাগে নিজের কিছু কাপড়চোপড় আর দরকারী জিনিস ভরে রেখেছিল সামির।যাওয়ার সময় সেই ব্যাগ হাতে বের হলে মা কিছু বুঝে নি।সন্ধ্যার আগে বাড়ী থেকে বের হওয়ার মূহূর্তে আনতারার ভাইয়েরাও তাকে দেখে।সামির আড়চোখে দেখে দুইভাইয়ের মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা বিনিময় হয়।
বাজার থেকে বাড়ী ফেরার পথে দুগাঁয়ের মাঝখানে একটা নির্জন ফাঁকা জায়গা আছে।সেখানে কোন দোকান পাট বা লোকালয় নেই।দুচারটি বড় গাছ আর কিছু ঝোপ জঙ্গল ইতস্তুত ছড়িয়ে আছে।তারই আশেপাশে ঘাপটি মেরে বসেছিল আনতারার দুই ভাই।অপেক্ষা করছিল সামিরের ফেরার জন্য।রোজ এ পথ দিয়েই সামির সাইকেল চালিয়ে বাড়ী ফেরে।এসময় হঠাৎ কখনো একটা অটোরিকশা নয়তো সাইকেল বা রিকশা বিক্ষিপ্তভাবে চলাচল করে। প্রায়ই সামিরের সাথে তেমন কেউ থাকে না।ওরা সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে।সামিরকে একা পেলেই দুজন মিলে ঝাপটে ধরবে তারপর শেষ করে দেবে।বাড়ী থেকে আবারো সেই পরিকল্পনা করে তারা বেরিয়েছিল। কিন্তু কোথায় সামির?রাত সাড়ে দশটা থেকে বসে আছে তারা।ছোটভাই বারবার ঘড়ি দেখছে। কখন বারোটা বেজে গেছে।এখন প্রায় একটা বাজতে চলল।তবে কি আজ সামির ফিরবে না ? নাকি তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ী চলে গেছে সে ?
ভাই আর কতক্ষণ?ফিসফিস করে ছোট বড়কে প্রশ্ন করে।আজ কি তবে সামির শালা ফিরবে না ভাই ?
চুপ কর।বড়ও ফিসফিসায়।আর একটু দেখি।একটা বাজতে দে।
একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ওরা বাড়ী ফিরে আসে।পরদিন এবং পরপর আরো তিনদিন সকালে দুপুরে বিকালে রাতে বাড়ীতে এবং দোকানে চোখ বুলিয়ে তারা যখন কোথাও সামিরকে খোঁজে পায় না তখন তার বাবার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে চাচা সামির কোথায় ?
তখনও সামিরের বাবা সামিরের কোনও খবর জানেনা।তাকে উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।ডাক্তার দেখানোর নাম করে ছেলে ঢাকা গেল,আজ তিনদিন সে বাড়ী ফিরে নি।ফোন করলে ফোন ধরছে না।সামিরের নিখোঁজ হওয়ার খবর সারা গ্রামে আর বাজারের বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো।তবে লোকজন সেইসাথে কিছু মুখরোচক খবর ছড়াবে ভেবেছিল কিন্তু তাদের সেই আশায় জল ঢেলে দিল আনতারার নির্বিকার চলাফেরা।সে আগের মত স্কুলে যায়, প্রাইভেটে যায় বান্ধবীদের সাথে কিশোরীসূলভ চপলতায় মেতে ওঠে।
সামির হঠাৎ কেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল এর কারন খুঁজে পায় না কেউ।এর মাঝে তিনবছর পেরিয়ে গেছে। তিতাসের ঘোলা জল আরো ঘোলা হয়েছে। কিন্তু কেউ গবেষণা করেও কারনটা জানতে পারেনি। কারন জানে আনতারা আর তার মা।জানে সামিরের বাবা মা।নিরুদ্দেশ হওয়ার দিন সাতেকের মাথায় সে বাবা মাকে সবটা জানিয়ে দিয়েছিল।বাবা মা তারে অনেক বকাঝকা করেছে।তার মত কূলাঙ্গারের সাথে সম্পর্ক রাখবে না বলেছে। কিন্তু সামির সেটা হতে দেয়নি।সে কর্মঠ ছেলে দেশের কোথাও থেকে সে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে।তার রোজগার ছাড়া এতবড় সংসার বাপের পক্ষে টেনে নেয়া সম্ভব নয় সে জানে।তাই নিজের খরচের টাকা রেখে বাকীটুকু বাপের কাছে বিকাশ করে পাঠিয়ে দেয়।বাপ ছেলেকে ক্ষমা করে দিয়েছে সাথে সাথেই। সত্যিত ছেলে তার অন্যায়ত কিছু করেনি।একজনকে ভালবেসেছিল শুধু।তার জন্য ওরা তাকে জানে মেরে ফেলতে চেয়েছিল? তাই আজ সে দেশান্তরী!এখন তারাও যদি তাকে ত্যাগ করে ছেলেটার প্রাণে সইবে কেমন করে?
আনতারার বাপ ভাই বুঝেছিল আনতারার মায়ের কারনে সামির পালিয়ে বেঁচেছে।মাকে তারা অনেক বকাঝকা করেছে।বেচারী চুপ করে শুধু শুনেছে।মেয়ে সামিরকে ভুলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে,হাসিখুশী আছে।সামিরটা বেঁচে আছে আর নিজের ছেলেদেরও খুনখারাবীর মত গোনার আজাব থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এই তার শান্তি।না হয় ওদের থেকে দুটো মন্দ কথা শুনলো তাতে কি আসে যায়?শুধু আনতারার ব্যাপরটা ওর বাপভাই বুঝতে পারে না।সামির না হয় পালিয়ে গেছে কিন্তু আনতারা কি সত্যি সামিরকে ভুলে গেছে?কিন্তু কি করে?তার মত জেদী মেয়ে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এত স্বাভাবিক হয়ে গেল?তারা বিশ্বাস করতে পারে না। আবার বিশ্বাস করে।কারন মেয়েটা শুধু জেদী নয় খেয়ালীও।খেয়ালের বশে সামিরকে মন দিয়েছিল হয়ত এখন খেযালের বশে আবার ভুলেও গেছে।ভাবে এটাই যেন সত্যি হয়।
এর মাঝে তিন বছর পার হয়ে গেছে।আনতারা এইসময়ে এসএসসি পাশ করেছে।এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল।রেজাল্ট বের হলে আনতারাদের বাড়ীতে আনন্দ আর ধরে না।মেয়ে এপ্লাস পেয়ে পাস করায় কেজি কেজি মিষ্টি কিনে এনেছে তার বাবা।লোকজন আসছে মিষ্টি খাচ্ছে।সকলে তাকে ধন্য ধন্য করছে।কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন সে এই ধন্য দেয়ার ধার ধারছে না।সে আনমনে থাকে। কি যেন ভাবে।একটা বিষন্নতায় ডুবে যায়।এই বাড়ীতে দিন ফুরিয়ে এসেছে তার।সামির সিলেট শহরের গিঞ্জি গলিতে বাসা বেঁধেছে।ছোট্ট এক কামরার ঘর।খুব একটা আলো বাতাস নাকি ঢুকে না সেখানে।একটা কাঠের চৌকি,দড়ির আলনা।গোটা দুয়েক এলুমিনিয়ামের হাড়িকুড়ি আছে।এককামরা ঘরের পেছনে একটা একচিলতে বারান্দায় রান্নাঘর।ঘরের পাশেই টিউবওয়েল আছে । এসব নিয়েই ঘরগেরস্থালি পাততে হবে আনতারাকে।এবং আনতারা যত পড়াশোনানা করতে চায় তার ব্যবস্থাও করে রেখেছে সে।ফোনে সর্বশেষ যেদিন কথা হয়েছে এসব বলেছে তাকে সামির।যদি বাপের ঘরের সুখশান্তি ভুলে গরীবানা সংসারকে সে বরণ করতে পারে তবে সে যেন প্রস্তুত থাকে।ফোনে ইশারা করলে সে আর তার বন্ধু এসে নিয়ে যাবে তাকে।
সিলেটী বন্ধুকে নিয়ে তিনবছর পর রাতের অন্ধকারে একটা বোরকা পরে সামির আসে নিজ বাড়ীতে।পরদিন সকালে কলেজে যাওয়ার নাম করে আনতারা ব্যাগ নিয়ে বাড়ীর পাশের শহরের দিকে রওযানা দেয়। তার আগে আগে বোরকা পরা সামির আর তার বন্ধু।নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা হেঁটে যায়।হাঁটাপথ একসময় শহরের ব্যস্ত রাস্তার জনারণ্যে মিশে যায়।জনারণ্যে অনেকগুলো কালো রঙ্গীন সিটকাপড়ের বোরকাপরা নারীর সাথে সামির আর আনতারার কালো বোরকাও মিশে যায়।তারা হাত ধরাধরি করে হাঁটে এবং শহরের বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়।পেছনে পড়ে থাকে আজন্মের স্বজন, চিরচেনা গ্রাম,নদী,গাছপালা-ঝোপজঙ্গল, ফুলপাথী।বুকটা ফেটে যাচ্ছে আনতারার।সবকিছু ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট যেন তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে কাঁটা হয়ে ফুটছে।সে কাঁটার আঘাতে তার পদতল রক্তাক্ত হচ্ছে।তবু সামনে পা বাড়ায় সে।