গল্প:সময়ের পরিবর্তনে

সময়ের পরিবর্তনে
জাহ্নবী জাইমা
অর্থির ঘরের দিকে তাকিয়ে তিথির চোখে আবার পানি এসে গেলো। সারা ঘরে ছড়ানো ছিটানো জামা কাপড়, মেঝের উপর পুরনো জুতো, ছেঁড়া মোজা, ফাটা টেবিল টেনিস বল, সব মিলেমিশে এলোমেলো হয়ে গেছে। এতো বছর ধরে তিনি মেয়ের পিছনে পড়ে থেকেছেন ঘর গুছিয়ে রাখার জন্য। তার একটা কথায় ছিলো, ‘অর্থির ঘরে গরু হারালো বাছুর পাওয়া যাবে।’ মা মেয়েতে এই নিয়ে নিত্য কত যে ছোট বড় খ-যুদ্ধ লেগেছে। সেই ঘর কত যে ছোট বড় খ-যুদ্ধ লেগেছে। এতো তা-বের মধ্যেও এখন কী ভূতুড়ে রকম ফাঁকা। ল-ভ- জিনিস পত্রেই শুধু অর্থিকে টের পাওয়া যাচ্ছে। দুবছর আগে অর্বিড উড়ে গেছে সুদূর আমেরিকায়। এ বছর কোনও ক্রমে দু’মাসের জন্য কী একটা স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ম্যানেজ করে বাংলা দেশে এসেছিলো, সেও তিন মাস হয়ে গেলো। আজ আর্থিও চলে গেলো কানাডায়। আগামী সোমবার থেকে তার সেমিস্টার শুরু। তিথি বা তন্ময় কাউকে সে সঙ্গে যেতে অ্যালাউ করেনি। সে কি বাচ্চা মেয়ে না কি একটা, যে বাবা-মা পৌঁছে দিতে যাবে? এতোগুলো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে যাচ্ছি মা, চিন্তা করছো কেন? কোন অসুবিধা হবে না। আমি পৌঁছেই ফোন করবো ঠিক আছে? ঠিক না থেকে আর উপায় কি বাবা, তোদেরই তো সময় এখন, ২১ শতকের আধুনিক মেয়ে হিমালয় জয় করেছিস মাথা উঁচু করে। মা হলে বুঝবি। পড়ার টেবিলের পাশেই অর্থির টেডি উল্টো হয়ে পড়ে আছে অনাদর অবহেলায়। এককালে এই টেডি ও অর্থিকে আলাদা করা যেত না। শয়নে স্বপনে খাবার টেবিলে সর্বত্রই টেডি সাথে থাকতো। অতবড় মেয়ে তবুও টেডিকে সে ছাড়বে না, অর্থি ও টেডি দুই দেহ এক প্রাণ। তাদের পৃথক করে এমন সাধ্য কার। তারা যেন অবিচ্ছেদ্য অভিন্ন। আজ বুঝি সত্যিই টেডির দিন ফুরিয়েছে। অর্থি এতদিন সত্যিই বড় হয়েছে। পড়ে থাকা টেডিকে তুলে যতেœ রেখে দেন তিথি। গিটারটা এখনো ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা তার ষোলতম জন্মদিনের উপহার। গিটারের জন্য সে কি জেদ। গিটারের নেশা কবেই কেটে গেছে। যন্ত্রটা ধূলোয় আপাদমস্তক ঢেকে পেড়ে আছে, তার উপরে ঝুলে আছে রংচটা বাতিল টি শার্ট। ছানারা যে যার নিজের আকাশে উড়ে গেলে মা পাখির বুঝি এমনটাই লাগে। খালি ঘরে অর্থির দলা মোচড়া বিছানার একধারে বসে বসে ভাবতে থাকে। এই তবে সেই বহুশ্রুত এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম। শূন্য নীড়, অর্বিডের সময় এতোটা ফাঁকা লাগেনি। বোধহয় সেই সময় অর্থি বাড়িতে ছিলো বলে। তাছাড়া অর্বিড সবসয়ম বর্হিমুখি, আড্ডাবাজ ষোলোঘণ্টা বন্ধুমহলের সঙ্গে কাটায়। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো নিতান্তই প্রাকৃতিক। খাওয়া ঘুম ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকর্মের জন্যই তার বাড়ি আসার প্রয়োজন পড়তো। এমন অর্বিড যে মার্কিন মুলুকে পড়াশোনা করতে যাওয়ার সুযোগ পাবে এ কথা সে নিজেও বোধ হয় ভাবতে পারেনি। অবশ্য পরীক্ষার ফলাফল তার বরাবরই আশ্চর্য রকমের ভালো হতো। কী করে যে হতো, সেটা তিথির কাছে আজও এক রহস্য। তাই তাকে খুব মিস করেনি তিথি। অর্থিটা কিন্তু একটু মা ন্যাওটা ছিলো ছোট থেকেই। সকালের বিভিন্ন রকম ব্রেকফাস্ট, বিকেলের ঠা-া-ঠা-া চকোলেট কিংবা ভ্যানিলা গন্ধী দুধ, পরীক্ষার আগে সারারাত জেগে উম্মাদের মতো পড়া মুখস্থর সময় মাঝরাতের ঘুমতাড়ানি কফি। লেটেস্ট স্টাইলের জামা তৈরি করানো থেকে শুরু করে বন্ধুদের বিশ্বাস ঘাতকতার হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞা বর্ণনা সব কিছুর জন্যই বহুদিন পর্যন্ত মাকে তার দরকার ছিলো। এবার যেন বারে বারেই মনে হচ্ছে সব শেষ। ফাইনাল উপসংহার…। এর পরে আর কিছু নেই। অর্থি অবশ্য মাকে অনেকবার আশ্বস্ত করে গেছে, কেঁদো না মা, দেখো আমি ছোটখাটো ছুটি হলেই চলে আসবো। কিন্তু সবাই জানে বাস্তবে তা হয় না। প্রথম দিকে মোটামুটি ঘন ঘন আসা যাওয়া তার পর একবার মন বসে গেলে নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন জগৎ তৈরি হলে হয়তো অনেক কষ্টে বছরে একবার সামারভ্যাকেশনে আসা হবে। তার পরে তো ক্যাম্পাসিং ইন্টারভিউ কতো কিছু চালু হয়ে যাবে, এতো সবের মধ্যে বাবা মায়ের জন্য সময় কোথায়? ভাগ্যিস মোবাইল নামক যন্ত্রটা আবিষ্কার হয়েছিলো, তার বদৌলতেই কিছুটা হলেও যোগাযোগ হয়তো থাকবে। ইন্টারনেটে কদাচিৎ কথা হয় কারণ এন্টারনেটে এন্টারটেইনিং আছে অনেক। মাতৃত্বের ফুল টাইম ডিউটি থেকে এবার তাহলে অবসর, এখন থেকে কেবল মাঝে মধ্যে সন্তানদের বিশেষ পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতরণ। তাও তারা দয়া করে চাইলে গায়ে পড়া পরামর্শ অবশ্য আজকালকার ছেলে মেয়েরা বিশেষ পছন্দ করে না। নচেৎ নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে শুধু দেখে যাওয়া। একটা ভারি নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় তিথি। মনে মনে নিজেকে ঝাঁকি দিয়ে ছত্রভঙ্গ ঘরটাকে ঠিকঠাক করার কাজে হাত লাগায়। এই বিষাদ বিহ্বলতা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসা দরকার। দুই ছেলে মেয়েই তার সুস্থ প্রাণবন্ত, সফল। পড়া শোনায় অত্যন্ত ভালো ব্যবহারেও কেউ সহজে কোনও ত্রুটি বের করতে পারবে না। এর বেশি মা হিসাবে আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? সে তার নিজের কর্তব্য যথাসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছে। ছানা পোনাদের খুটে খাওয়ার মতো বড় করে দিয়েছে এবার ডানা খুঁজে নিতে বেরিয়ে পড়েছে। তা তো বেরোবেই। এখন না হয় ক’দিন আবার শুধু তন্ময় আর সেই রইলো। হয়তো সেই সদ্য বিবাহোত্তর বা প্রাক শাবক দিনগুলোর মতো অষ্ট প্রহরের উদ্দাম সান্নিধ্যে নয়, তবুও অনেকদিন পরে নিজেদের আবার কাছাকাছি হওয়ার সুযোগটাই বা মন্দ কী? মা হয়ে থাকতে থাকতে তো স্ত্রী হওয়াটা যেন প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। মনে হয় আজকাল সত্যি বলতে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের পিছনে অবিশ্রাম দৌঁড়ে বেড়ানোর মানষিক ও শারীরিক ঘানি চক্কর থেকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মুক্তি সে কি নিজেও চায়নি কখনও? তাদের দু’জনের সব কথারই বিষয় বস্তুতে আজকাল থাকে ছেলেমেয়ের সাফল্য আর সমস্যা। নিজেদের ছোট খাটো ভালো মন্দ আর ইচ্ছের আলোচনাগুলো কবে যে চাপা পড়ে গেছে মনেও পড়ে না। একটা শক্ত রুটিনের মধ্যে সে আর তন্ময় ঢুকে গেছে। যার কেন্দ্র বিন্দু অর্বিড ও অর্থি। এবার না হয় একটু নিজেদের মতো করে বাঁচার অভ্যেস করা যাবে। পুরনো হয়ে আসা সম্পর্কটার গায়ে একটু নতুন বাতাস লাগবে। কতদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। শুধু আমরা দু’জন। আজকাল ম্যাগাজিনগুলোতে ছোট বড় কতো রকম বেড়ানোর প্যাকেজের বিজ্ঞাপন বেরয়। কতো বর্ণিল বালুকাবেলা, উদ্ধত তুষার শীর্ষ পাহাড়, রঙিন সূর্যাস্ত আর তারা নিবিড় রাত কাগজের পাতা থেকে হাতছানি দেয়। কতবার তিথি নিজেকে আর তন্ময়কে বিজ্ঞাপনের হাস্যমুখী হাতে হাত রাখা দম্পতির উপচে পড়া সুখের দৃশ্যে নিজেকে কল্পনা করেছে। ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে না হয় জেনেই নেওয়া গেলো যে ওরা পেশাদার মডেল, ছবি তুলতে আসার আগে হয়তো কোনওদিন একে অপরকে দেখেওনি, কিন্তু ওরা তো জানে, কী নিপুনভাবে একটা স্বপ্নকে বিক্রি করতে হয়। তার সেই বিজ্ঞাপনী স্বপ্নের ছোট ছোট টুকরোগুলো ঘিরেই তিথি মনে মনে নিজেই আরও কতো স্বপ্ন বুনেছে কতদিন। কাছে দূরে কতো জায়াগা তো এখনও দেখা বাকি। অর্বিড অর্থির ছুটি ধরে ধরে আর কটা স্থানে বেড়ানোইবা হয়েছে। ছেলেমেয়ে বড় হলো। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি করবে, তারা স্বামী-স্ত্রী গর্বিত মুখে পর্দার পিছন থেকে সন্তানের সাফল্যের একটুখানি ভাগ নেবে। সারা জীবন কষ্ট করে, আমার এই দুটি রতœ এমন হিরের টুকরো তৈরি হয়েছে? সবার হয় না আমাদের হয়েছে। আমরা পেরেছি তাদের দু’জনের মিলিত অহংকার, আত্মীয় পড়শির ইর্ষায়, কুটকুট করে। ছেলে এ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং মেয়ে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে চাট্টিখানি কথা। কয়েক বছর পার করে, জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে বাড়িতে বউ আসবে, জামাই আসবে। গুল্লু গুল্লু নাতী নাতনি হবে, সারাদিন ধরে তাদের নিয়ে আহ্লাদ লুটো-পুটি, এ স্বপ্নের টানই কি কিছু কম? এই সুখ কল্পনার জাল বুনে বুনেই তো ফাঁকা দিনগুলো ভরে ফেলা যায়। ন্যান্সীর খুনসুটির গানটার কলি বাজছে স্মাট ফোনটায়, খুনসুটিতে ছিলো শুরুটা ‘বন্ধুতায় কাছে আসা, প্রণয় হলো পরিণয়ে, পূর্ণতায় ভালোবাসা। মনেরই গোপন কথোপোকথন চলবে সারাক্ষণ…। হয়েছো তুমি আপন, চল না এই নতুন জীবন রঙে রঙে রাঙ্গাবো দু’জন। দুজনে রব আজীবন’
বুকের ভিতরে আটকে থাকা পাথরটাকে সম্ভাব্য সুখের যথেচ্ছ রঙিন চকচকে মোড়কে ঢেকে ফেলে তিথি। নতুন জীবন শুরু করার প্রথম পদক্ষেপ এখন তার রান্না ঘরের দিকে। ছেলেমেয়ের কেক পিৎজ্জার আবদার মেটাতে মেটাতে অনেকদিন তন্ময়ের পছন্দের কিছু রান্না করা হয়নি। খাবার টেবিলে আজকাল আর বিশেষ কথাবার্তা হয় না, অর্থিটা থাকলে তাও একটু কলকল করে এটা ওটা বকতো। আজ তো আরও চুপচাপ। বলতে গেলে নিঃশব্দেই খেয়ে যাচ্ছিলো দু’জনে। প্রায় শেষ গ্রাসে পৌঁছে তন্ময় বোমাটা ফাটালো। একটা কথা মানে অনেকদিন ধরেই বলবো ভাবছি। তিথি আনমনে রুটি ছিঁড়ছিলো তন্ময়ের গলার স্বরে সজাগ হয়ে মুখ তুলে চাইলো, কিছু বললে আমায়? বলছিলাম, এবার আমার নিজের জন্য কিছুটা স্পেস দরকার।’ নিজের জন্য স্পেস মানে? একটা আলাদা ঘর? কেন, অফিসের কাজের জন্য? অর্বিডের ঘর তো এখনো খালিই পড়ে আছে, ওটাকেই তোমার কাজের ঘর করে নিতে পারো। তিথি সত্যিই বুঝতে পারেনি কী বলতে চাইছে তন্ময়। এখন ভাবলে নির্বুদ্ধিতায় হাসি পায়, কিন্তু কথাটার আসল তাৎপর্য তার মাথাতেই আসেনি। কী করে আসবে। চব্বিশ বছর ধরে যার সঙ্গে ওঠা বসা এবং অবশ্যই শোয়া, যাকে তিথি বহুবার হাতড়ানো আলমারির তাকের মতোই আগা পাস্তলা চেনে বলে মনে করে। তার এরকম আচমকা ঘোষণার পিছনে যে আরও গভীর কোনও অর্থ থাকতে পারে সেটা কল্পনা করতে না পারাটাই সেই মুহূর্তে তার কাছে স্বাভাবিক ছিলো। তন্ময় বললো, উফ্ ডোন্ট বি সো স্টুপিড। সেই স্পেসের কথা বলছি না আমি। স্পেস মানে নিজের মতো করে নিজের মনের মতো লোকের সঙ্গে জীবন কাটানোর স্পেস, স্বাধীন জায়গায়। তন্ময় মুখ না তুলেই উত্তরটা ছুঁড়ে দেয়, কণ্ঠস্বরে প্রবল বিরক্তি। তিথি আরও বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের মনের মতো লোক মানে? ‘মানে আই হ্যাভ ফাউন্ড সামওয়ান এলস।’ সামওয়ান এলস, অন্য কেউ, তন্ময় অন্য আর একজনকে খুঁজে পেয়েছে, যে তিথি নয়। তিথিকে বাদ দিয়ে অন্য কারও সঙ্গে তন্ময় জীবন কাটাতে চায়। তাহলে এতোদিন যেটা কাটছিলো সেটা কী? জীবন ছিলো না সেটা? কী ছিলো তবে? কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। তিথির চকচকে নতুন জীবনের স্বপ্ন শুরু হতে চলেছিলো আজ। এই সময় থেকে তন্ময়ের জীবনের স্বপ্ন কি তবে তিথির স্বপ্নের থেকে আলাদা? এই উদ্ভ্রান্তির মধ্যেও তিথির হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা মনে হলো। এই সব কথাগুলো কেন সবাই ইংরেজিতেই বলে? নেকস্ট মান্থ থেকে নিবেদিতা ও আমি এক সঙ্গেই থাকবো ঠিক করেছি। তন্ময় খুব নির্বিকারভাবে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে আবার বলে বোতল থেকে কাঁচের গ্লাসে টানা ধারায় ঝরে পড়তে থাকা পানির শব্দটা তিথির কানে অতিরিক্ত জোরে আঘাত করতে থাকে। নিবেদিতা, নামটা জানা। মানুষটাও মুখ চেনা, দুয়েকটা অফিস পার্টিতে দেখা হয়েছে। সেই বস্তাপচা গল্প। তিথির মাঝবয়সী স্বামী তার হাঁটুর বয়সী গ্লামারাস সহকর্মীর আকর্ষণে হাবুডুবু খেয়ে নতুন স্পেসের খোঁজ করছে। কিন্তু নিবেদিতা কালেকার তো সিঙ্গাপুর অফিসের স্টাফ ও তাই আজকাল সিঙ্গাপুর ট্যুর হঠাৎই এতো বেড়ে গেছে। তিথি এতটায় বোকা, কিছু বুঝতেই পারেনি। ‘এ সব কি বলছ তুমি?’ ভয়ে আশঙ্কায় তিথির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। ‘তন্ময় খুব সন্তর্পণে একটা ধরে রাখা শ্বাস ছাড়ে বলছে, যে আয়্যামলিভিং ইউ। তিথিকে কেমন বোকা বোকা দেখায়, পরবর্তী আধা ঘণ্টা তার স্মৃতিতে সম্পূর্ণ ঝাপসা। তন্ময় অনেক কিছু বলছিলো তাকে, কিন্তু সে একটা কথাও শুনতে পায়নি, শুধু দেখছিলো তন্ময়ের লালচে হয়ে ওঠা ফর্সা মুখে তামাটে ঠোঁট দুটি নড়ছে। হঠাৎই খেয়াল হয় তন্ময় আর কিছু বলছে। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়? কিন্তু কি বলবে সে? কি বলতে হয় এরকম পরিস্থিতিতে তা তো তার জানা নেই। আগে তো কখনও কিছু বলেনি। তিথি প্রাণপণ শক্তিতে আড়ষ্ট জিভ নেড়ে কথাগুলো উচ্চারণ করে। জানি, তন্ময়ের স্বর এখন অস্পষ্ট। কারণ অর্বিড এতোদিন পর ছুটিতে এলো বাড়িতে, আর অর্থির কানাডায় যাওয়ার তোরজোড় চলছিলো। তুমি এতো ব্যস্ত ছিলে ওদের নিয়ে। ভেবেছিলাম বাচ্চারা চলে গেলে, বাড়ি ফাঁকা হলেই বললো, অর্থি গেছে এখনও চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। আর একটু অপেক্ষা করতে পারলে না, এতো তাড়া তোমার? তিথি অবাক হতেও পারে না, তার পরেই একটা তীক্ষ্ম প্রশ্নের প্রহার তাকে আপাদমস্তক ফালা ফালা করে দেয়, অর্বিড থাকতেই। তিনমাস আগে থেকেই এই ভাবনা চলছিলো? তা হলে আরও কতদিন আগে এ পর্বের সূচনা হয়েছিলো? কবে থেকে কতদিন ধরে তোমরা কিছুতেই… বাক্যটা শেষ করতে পারে না সে।’ এবার তন্ময়কে সত্যিই অস্বচ্ছন্দ দেখায়। তিথি কাতরে ওঠে বলে, কত দিন? তন্ময় চুপ করে থাকে। তিথির নিশ্বাস আটকে আসে। কতদিন, কত মাস তন্ময় নিজেকে দুই দেশের দুই শহরের দুই শয্যায় দুই নারীর মধ্যে ভাগ করে চলেছে। কত দিন ধরে চলছে এই লুকোচুরি খেলা? তিথি মন খারাপ করে তন্ময়ের ব্যাগপত্র গুছিয়েছে, ‘তোমার বিদেশ ট্যুর আজকাল বড্ড বেশি বেড়ে যাচ্ছে। কোম্পানি কি তোমাকে ছাড়া আর বাইরে পাঠানোর লোক পায় না? এই সব বলে বলে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়েছে। তন্ময় তখন মনে মনে আরেক নারীর কল্পনায় উত্তেজিত, উদগ্রীব হয়ে প্রহর গুনেছে, কতক্ষণে উড়ে যাবে তার কাছে? তাই কিছুদিন হলো কবে ফিরবে জানতে চাইলেই অমন রেগে উঠেছিলো? ‘কাজ শেষ হলেই ফিরবো। এখন কি করে বলবো কবে কাজ শেষ হবে? না ফিরে কোথায় যাব? তিথি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইল। সত্যিই তো মানুষটার উপর কাজের এতো চাপ, তার উপরে বউও যদি ঘ্যান ঘ্যান করে অসন্তুষ্ট তো হবেই, সেই অসন্তোষের পিছনের কারণ, এখন বুঝতে পারি। তন্ময় বলে, ‘আয়্যাম লিভিং দিস প্লেস অ্যান্ড শিফটিং টু সিঙ্গাপুর আমি ট্রান্সফারের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি পেলেই পার্মানেন্টলি চলে যাবো।’ তিথি বলে, আমার অর্বিড অর্থি? তোমরা এ বাসাতেই থাকবে। কথায় কথায় রাত বেড়ে যায়। টেবিলময় ছড়ানো ছিটানো এঁটো বাসন তুলতে ভুলে গেছি। একা একা তিথি বসেই থাকে।
আজ থেকে ছয় সপ্তাহ হলো তন্ময় সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সারা বাড়িময় তিথি একা পাথরের মতো স্থবির হয়ে গেছে। এতগুলো বছর আষ্টে-পৃষ্টে সংসার করার পর যে মানুষ একজন স্ত্রী ও দুইটি বিবাহ যোগ্য সন্তান নিয়ে সুখি না, সে, যে চুলোয় গিয়ে সুখী হতে যাচ্ছে যাক। সেদিনের পর থেকে তাদের মধ্যে কথা বার্তা হয়েছে খুব কম। তিথি পরের দিন থেকেই অর্থির ঘরে নিজের শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে নিজের ঘর ছেড়ে। অকস্মাৎ স্বামী পরিত্যক্তা হওয়ায় কষ্টের থেকেও যে সাঙ্ঘাতিক অনুভূতিটা তিথিকেই চেপে ধরলো তা হচ্ছে লোক জানাজানির ভয়। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী কমপ্লেক্সের লোকজন? আজ না হয় কেউ কিছু জানে না, দুদিন পরে তো জানবেই। তখন? রাস্তায় একা হাঁটলে মানুষ মুখ দেখাদেখি করে বিরবির করে কিসব বলবে। এ সম্ভাবনা কল্পনা করে সে শিউরে উঠেছিলো। বাস্তবে অবশ্য দেখা গেলো তার আশঙ্কাটা নিতান্তই অমূলক। ফ্লাটবাড়িতে বসবাসের একটা সুবিধা হচ্ছে কেউ কারও হেঁসেলের খোঁজ রাখে না। তাছাড়া তন্ময় আজকাল এতো বেশি বিদেশে বাইরে বাইরে থাকছিলো যে, তার না থাকাটাই সকলের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। কাজেই তিথির একা থাকাটা অন্যবারের একা থাকার চেয়ে একেবারেই আলাদা এটা সেভাবে কারও নজরেই পড়েনি। সুতরাং নিশ্চিত, বাকি রইলো অফিস কলিগ ও বন্ধুবান্ধব এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনি কখনও। লোক লজ্জার ভয়টা আর রইলো না। তখন তিথির মনে আসতে শুরু করলো শতশত প্রশ্ন ও রাগ। মূল প্রশ্ন একটাই কেন কেন কেন? কেন করলো এটা তন্ময়। তার স্ত্রী হয়ে উঠাতে কি কোনও ত্রুটি ছিলো? সে তো যাথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছে একটা নিটোল পরিপূর্ণ সংসার গড়ে তুলতে, তবে কি তার সেই চেষ্টাটাই বড্ড বেশি তন্ময়ের দমবন্ধ করে দিলো? তাই তাজা হাওয়া নেওয়ার জন্য একটা নতুন বারান্দা খুঁজতে হল তাকে? প্রকৃতি নাকি শূন্যতা সহ্য করতে পারে না। তার নিজস্ব নিয়মে খালি জায়গা কিছু না কিছু দিয়ে ভর্তি হয়েই যায়। কোথায় ফাঁক থেকে গিয়েছিলো তিথির তিল তিল নির্মাণে যে সে শূন্যস্থান আরেক জনকে এসে ভরতে হলো। না কি তার নারীত্বেরই কোনও অভাব রয়ে গেছে? ছেড়ে আসা শোয়ার ঘরের আয়নায় প্রতিবিম্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিথি উত্তর খুঁজতে থাকে। উগ্র মাথা ঘোরানো সৌন্দর্য় না থাকলেও একটা ঢলঢলে নরম চোখ টানা লাবন্য তার বরাবরই ছিলো। দুই সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের এতখানি বড় করার পারেও সেই লাবন্য তাকে ছেড়ে যায়নি। বরং দিনে দিনে আরও পেলব আরও ¯িœগ্ধ হয়েছে। কেন তাতে মন ভরলো না তন্ময়ের, ঠিক কি চেয়েছিলো সে? কোন অজ্ঞাত অমোঘ ছিদ্র দিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গের এই কালসাপ ঢুকলো তাদের সংসার বাসরে? বাসি দাম্পত্যের ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য চিহ্নে জর্জরিত ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে ঝাঁক ঝাঁক উত্তরহীন প্রশ্নের অবিশ্রাম আঘাতে আঘাতে ক্লান্ত তিথির ভিতরটা বিবাগে বিতৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকে। এখান থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে না পারলে যেন আর বাঁচবে না। এমনটাই মনে হতে থাকে তার। একটাই জায়গার কথা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো হঠাৎ মনে পড়ে তার। যেখানে গেলে কোন রকম করুণার মুখোমুখি হতে হবে না। দ্রুত রবিবারের গ্যাফিটির পাতা উল্টে ট্রেনের সময়টা দেখে নেয় তিথি। ওয়ার্ডোবের উপর থেকে স্কাই ব্যাগটা টেনে নামায়। অসহিষ্ণু হাতে জামা কাপড় ভরতে থাকে ঠেসে ঠেসে। রতন পল্লীতে সোমার বাড়িটার সব থেকে বড় আকর্ষণ এর চারদিকে ঘোরানো চওড়া বারান্দা। আজ থেকে পাঁচদিন হলো এখানে এসেছে তিথি। এসে অবধি বেশিরভাগ সময়টা তার এই বারান্দাতেই কাটছে, বুধবার সন্ধ্যারাতে ঝড়ো কাকের মতো যখন এসে পৌঁছেছিলো, সোমা একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেনি তাকে। যেন এই সময়ে তার এমনিভাবে উড়তে পুড়তে আসাটাই স্বাভাবিক ছিলো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা তীক্ষ্ম দৃষ্টি চালিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে শুধু বলেছিলো ¯œান করে আয়, গ্রিনটি করেছি। ‘ঠা-া পানিতে বহুক্ষণ ধরে ¯œান করেছিলো তিথি সেই রাতে। পানির ধারায় সব ক্লান্তি, সব গ্লানি তাপের যত বন্ধন সব বুঝি ধুয়ে যাচ্ছিলো, সোমা দরজায় ধাক্কা না দিলে সে বোধ হয় পানি ঢেলেই যেত। খেতে বসে অল্প দু-চার কথায় কী ঘটেছে তার জীবনে সে ব্যাপারে সোমাকে মোটামোটি একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলো। খোঁচাখুচি করা সোমার স্বভাববিরুদ্ধ, তা আজও করেনি। এর জন্যই এত অশান্তির মধ্যে এই জায়গাটার কথাই তিথির মনে পড়েছিলো। সেই স্কুল থেকে সোমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। আজ এতো বছরেও তা একই রকম। এই একমাত্র মানুষ যে ছোট বেলা থেকে বিনা প্রশ্নে বিনা সমালোচনায় তার প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য যাবতীয় আনন্দ বা বিষাদ নিঃশর্তে ভাগ করে নিয়েছে। বিশ্বভারতীর ইংরেজির অধ্যাপিকা সোমা বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তিথি ও অন্য সব বন্ধুরা খুব বকেছিলো তাকে। সোমা কিছু না বলে তার বিখ্যাত একপেশে হাসিটা হেসে সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। অবশ্য এখন যদিও মনে হচ্ছে বুদ্ধিমানের শেষ হাসিটা সেই হেসেছিলো। ঢাকায় ভোরে উঠলেও ভোর দেখা হতো না। এখানে রোজ বারান্দায় বসে বসে তিথি নতুন দিনের আগমন বার্তা দু’চোখ ভরে দেখে। প্রতিদিন দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রূপ পাল্টে পাল্টে তার সামনে ধরা দেয়। অনেক সকালে সোমা যখন ক্লাস নিতে বেরিয়ে যায়, তখন সে স্তব্ধ হয়ে বারান্দায় বসে থাকে, যখন সোমা ফেরে তখনও সে বারান্দাতেই। মাঝে এক সময় উঠে ¯œানটা সেরে নেয়। তাড়া দিয়ে তাকে খেতে নিয়ে আসে সোমা, খাওয়াটা কোনও ক্রমে শেষ করেই আবার তিথি তার পুরনো জায়গায়। খাঁ-খাঁ দুপুরের তীব্র দাহে চোখে জ্বালা ধরলেও সে নড়ে না। ছাতিমের ঝাঁপালো পাতার আড়াল থেকে ঘুঘুপাখির অলস একটানা ডাক শুনতে শুনতে যেন এক সম্মোহনে তার বুকের ভিতরের উথাল পাথাল ঢেউগুলো আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসতে থাকে। আমাকে বলেনি সে, সেদিন যখন অমন আলু-থালু হয়ে ট্রেন ধরার জন্য বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলো তখন হঠাৎ তার মোবাইলটা বেজে ওঠে। স্তম্ভিত হয়ে সে দেখোছিলো স্ক্রিনে তন্ময়ের নাম। কেন যে ফোনটা কেটে দেয়নি সেটা তার নিজের কাছেও রহস্য। একবার হ্যালো বলেই চুপ করে গিয়েছিলো সে। তন্ময় নিজেই কথা বলছিলো তারপর ছেলেমেয়ের খোঁজ নিচ্ছিলো। তার কান ভুল করে না থাকলে তন্ময়ের গলায় স্পষ্ট অনুতাপের সুর শুনেছে তিথি। এটা কি আর একটা নতুন কৌশল? না কি নতুন খেলনাটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ মনে হয়েছে পুরনোটাও একেবারে ফেলে দেওয়াটা বোধ হয় উচিত হবে না। বরং দুটোই হাতে রাখা ভালো, একটার মনোহরি রংচং উঠে গেলে আবার কিছুদিন অন্যটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাবে। তার দিক থেকে একেবারেই কোনও সাড়া না পাওয়ায় কিছুক্ষণ পরে তন্ময় বোধহয় একটু হতাশ হয়েই আচ্ছা রাখি তাহলে, বলেই ফোনটা ছেড়ে দেয়।
একদিন তন্ময় স্পেস চেয়েছিলো কিন্তু একটুখানি স্পেস এখন তিথিরও ভীষণ দরকার। নিজের মনকে বোঝার জন্য, জানার জন্য, সবার থেকে দূরে একা সম্পূর্ণ নিজস্ব কিছুটা স্পেস। সোমা বিশেষ ঘাঁটায় না তাকে, মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়ের আতপ্ত সন্ধ্যায় বরফঠা-া জিরা ভেজানো পানি হাতে পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে, তার হাতেও একগ্লাস ধরিয়ে দেয়। মাথার উপরে টাঙানো নক্ষত্র খচিত বিশাল এক কালো কুচকুচে আকাশের চাঁদোয়ার নিচে দুজন চুপচাপ বসে থাকে। শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলো, অর্থি, অর্বিড জানে? অর্বিডকে জানিয়ে কি হবে বল? এত দূরে আছে ছেলেটা, পড়াশোনা করতে গেছে ওখানে, এখন ওকে এসব বলা মানে শুধু শুধু স্ট্রেস বাড়ানো। জেনেই বা কী করবে ও? একদিন না একদিন তো জানবেই। তখন দেখা যাবে। অর্থিকেও কিছু বলিসনি? না। কিন্তু বাবার কথা? না। তিথি আনমনা হয়ে বলে বাবাকে তো ফোন বা নেটে বিশেষ কোন যোগাযোগ করে না। ওর যত কথা তো আমার সঙ্গেই। ওই বলেছি যে ওর বাবা এখন কিছু দিনের জন্য সিঙ্গাপুরের অফিসে বসছে, কাজের চাপ আছে খুব। কবে বাংলাদেশ আসতে পারবে তার কিছু ঠিক নাই। যেটা তিথি সোমাকেও বলতে পারে না। অর্থিকে সত্যি কথা বলার সাহস তার নেই। বাবাকে অর্থি মনে করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা সবচেয়ে ভালো মানুষ জানে, সেই মানুষের পদঙ্খলনের খবরে অর্থির রুদ্ধবাক আহত চেহারাটা তিথি কল্পনাতেও আনতে চায় না। তিথি যেমন শুনেও বিশ্বাস করতে পারেনি, অর্থিওর তাই হবে। তার পর অবশ্যম্ভাবীভাবে পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ জাতিকে ঘৃণা করবে। সতেরো বছর বয়েসে পৃথিবীটা বড্ড বেশি সাদা আর কালোতে আঁকা থাকে। ধুসরের কোনও শেডই যে সেখানে ঠাঁই পায় না। অর্থির সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়বে তার বাবার উপর। এছাড়াও মাকে প্রশ্ন করবে কি অন্যায় মা তোমার, বাবা আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলো। পারবে না তিথি সেই অবুঝ দু’টি মনের অভিমানের মুখোমুখি হতে। সে তো ছেড়ে যায়নি তন্ময়ই ছেড়ে গেছে তার ঘর ঘরনিও দুই সন্তান তবে সেই এর দায় নিক। অপরাধ যার স্বীকারোক্তির ভারও তাকেই তো বইতে হবে। তাই তিথি নিরবিচ্ছিন্ন অবসর যাপন করে। ফেরার তাড়া নেই সংসারের দাবি নেই, শুধু একটার পরে একটা দিনের আসা আর চলে যাওয়া। মাঝে মাঝে বিকেলে হাঁটতে বেরয়। সোমাও কোনও কোনও দিন সময় পেলে সঙ্গ দেয়, না হলে একাই চলে যায় সে শালবনের মধ্যে দিয়ে লাল মাটির পথ ধরে এক একদিন এক একদিকে। এর মধ্যে তন্ময় চৌধুরী আর দু’দিন গভীর রাতে ফোন করেছে তাকে। মস্ত বড় ভুল হয়েছে তার এ কথা শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলেও ফেলেছে। ফিরে আসতে চাইছে তিথির কাছে। বুঝতে পারে তিথি। আসলে লুকোচুরি খেলাটার মজা ততক্ষণই যতক্ষণ সেটা লুকানো থাকছে। একবার সবার চোখের সামনে এসে গেলে খেলার আর কোন থ্রিল থাকে না। নিবেদিতা আর তন্ময়ের খেলাটাতেও এখন আর কোনও ঝাঁঝ নেই। ছকে বাঁধা গল্প দিয়ে শুরু হয়েছিলো, সেই ছক ধরেই তন্ময়ের গ্রেট লাভ স্টোরিটা বড় তাড়াতাড়ি তেজপাতার মতো শুকিয়ে গেলো। বেচারা! কিন্তু আমাকে কী মনে করে তন্ময়? সংসার বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পোষা জীব। যার নিজস্ব কোন ভালো লাগা মন্দ লাগা নেই। সুখ দুঃখ রাগ অভিমান ব্যথা পাওয়া, কষ্ট পাওয়া কিছুই নেই? গদগদ হয়ে একবার ভুল হয়ে গেছে বললেই তিথি আই লাভ ইউ লেখা ভ্যালেন্টাইন ডে মার্কা লাল লাল হার্ট শেপের বেলুন নিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে রিসিভ করতে ছুটে যাবে এয়ারপোর্টে। জীবনটা কী হিন্দি সিরিয়ালের মতো একতা কাপুরের ইচ্ছে ঘুরি নাকি? তিথি তাই কোনও নিশ্চিত জবাব দেয় না তন্ময়কে, জবাব তার নিজেরই জানা নেই। তিথি শুধু বলেছে ভাবছি,ভাবিনি এখনও ভেবে দেখি। এরই মধ্যে সোমার এক প্রতিবেশীর সঙ্গেও আলাপ হলো রফিকুল ইসলাম তারা। সোমার বাড়ি ছেড়ে দু-তিনটি বাড়ির পরেই থাকেন ভদ্রলোক। নিজের পরিচয় দেন রঙের মিস্ত্রী বলে, আসলে খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ফাইন আর্টে পিএইচডি করেছেন ইউ.এস.এ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার চিত্রশিল্প প্রদর্শণী হয় এবং উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়। চেহারায় তাঁকে চেনা দায়। খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেন, তাঁর চিত্রকর্মের টাকা দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করেন। তিনিও সোমার মতোই একা থাকেন। তিথি প্রথমে ভেবেছিলো ব্যাচেলর, পরে শুনলো স্ত্রী ছিলেন, বছর পাচেক হলো ক্যান্সারে মারা গেছেন। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যবশত তাঁদের কোনও ছেলে মেয়ে হয়নি। প্রথম যেদিন দেখা হলো, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয় হয়, সোমা ও তিথি উত্তরায়ণের সামনে দিয়ে বৈকালিক ভ্রমণ পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরছিলো, উনি উল্টোদিক থেকে একটি বিশালাকার কুকুরের চেন মুঠোয় ধরে রীতিমতো হন হন করে আসতে আসতে সোমাকে দেখে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেলেন। স্বাভাবিক ভদ্রতায় ওদেরও হাঁটা থামাতেই হলো। কী ব্যাপার রফিক ভাই, এমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছেন? সোমা হেসে ফেলে। হ্যা লরাকে নিয়ে বের হয়েছি সেই ছুটিয়ে ছাড়ছে। আমার একমাত্র সঙ্গি তো সে তাই একটু এক্সট্রা কেয়ার চাইছে। তিথির কোন কালেই কুকুর বিড়াল পছন্দ না। রফিক সাহেবকে সম্বোধন করে বললো সোমা, ও হচ্ছে তিথি আমার বাল্য বন্ধু বাংলাদেশ থেকে এসেছে। রফিক সালাম জানিয়ে বললেন, শান্তিনিকেতনে কি এই প্রথম আসা হলো? না না এসেছি তবে দুই একদিনের জন্য। এবার অনেকদিনের জন্য। থাকুন, থাকুন, তাড়া কিসের ঘুরুন ফিরুন, দেখার জানার অনেক কিছু আছে এখানে। তবে সে শান্তিনিকেতন তো আর নেই, এখন হয়েছে যত হঠাৎ বড়লোকদের নিকেতন। ভদ্রলোকের গলায় প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ। সোমা হঠাৎ আচ্ছা ভাই আসি বলে ঘরমুখো হয়। তিথি আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলো না। বাব্বা যেমন কুকুর তেমনি মালিক। রফিক ভাইকে এখানে সবাই চেনে। খুব ভালো মানুষ, ক্রিয়েটিভ লোকেরা ওরকম একটু বেখেয়ালী হয় সাদা মনের। এই গেলো প্রথম সাক্ষাৎ। এর পরেও প্রায়ই এখানে দেখা হতে থাকলো। সোমার বাসায় সান্ধ্য চায়ের আড্ডায় এলেন দুয়েক দিন। পরিচয় গাঢ় হতে অবশ্য তিথিও স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে তিনি ভালো মানুষ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিলো অন্য জায়গায়। তিথির যষ্ঠইন্দ্রিয় তাকে স্পষ্ট সংকেত পাঠাচ্ছিলো যে এই ব্যাক্তিটি তার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। যদিও তিথি তাকে কোন রকম আভাস বা প্রশ্রয় কিছুই দেয়নি, অথচ রফিক আকারে ইঙ্গিতে ক্রমশ যথেষ্ট পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তিথিকে তাঁর ভালো লাগছে। বাড়িতে একদিন খেতেও ডেকেছিলেন দুই বান্ধবীকে। অবশ্য একটা মিক্সড গ্যাদারিঙের ওসিলায়। তিথি এসব উটকো ঝুটঝামেলায় পড়তে এখন মোটেও ইচ্ছুক না। তার দুই সন্তান নিয়ে আগামী দিন দিব্বি কেটে যাবে। একটা মেয়ে মধ্য বয়সে একা হলেই লভ্য মনে করতে হয় না কি? সোমা একদিন টিপ্পনি কেটে বললো, কি রে তুই এবার চিত্রশিল্পীর মডেল হতে চলেছিস না কি? রফিক সাহেব তোর একটা পোট্রেট করতে আগ্রহ জানিয়েছে। আমার! দিলিতো বুড়ো বয়সে বেচারার মাথাটা ঘুরিয়ে কুপোকাত করে। আমাকে তোর ব্যাপারে আগ্রহ জানিয়েছে, এখন বল তুই কি…। আমি তোর বিষয়ে সব কিছু আগেই তাকে জানিয়েছি, এটা ভাবিস না যে তুই শিকড়বিহীন একা। তোর ছেলে মেয়ে আছে কিন্তু একদিন তারাও বিয়ে করে সংসার চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তুই তখন কি করবি? কাকে কি বলিস তুই তো বিয়েই করিসনি। তা তুই বিয়ে করে ফেল তার মানে রফিক সাহেবকে, শোন তিথি আমি তো বিয়েই করবো না। আর তুই তোর একাকিত্বের জন্য দায়ি না? তন্ময় যদি তোকে ও বাচ্চাদের ছেড়ে অন্য মেয়ের সাথে ঘর করতে পারে তুই কেন পারবি না? দেখ তোর ছেলে মেয়েকে জানিয়ে তুই বিয়ে করবি সমাজে মাথা উঁচু করে বলবি তুই নির্দোষ, কোন ভুল করিসনি। তিথি হঠাৎ বললো ভাবছি পরশু বাংলাদেশে ফিরবো। সোমার সব কথা অগ্রাহ্য করে তিথি বললো। বেশ তো ছিলি, হঠাৎ আবার যাওয়ার তাড়া উঠলো কেন? না রে তন্ময় ফিরবে শনিবার তাই দু’দিন আগে গেলে অনেক কাজ করা যাবে সংসারে। সোমা এমন চমকে উঠলো তন্ময় আসছে মানে আর তার আসার সঙ্গে তোর ফিরে যাবার সর্ম্পক কি? বাঃ যেতে হবে না? এতোদিন বাড়িতে কেউ নেই, আসল প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো তিথি। কতো দিনের জন্য আসছে তোর বর? কতোদিন না রে সিঙ্গাপুর থেকে চলেই আসছে একেবারে। ও তাই তুই তার ফাঁকা জীবনে মলম লাগানোর জন্য ঘর গুছাতে যাচিছস। এই প্রথম বার সোমা তাকে বুঝতে পারছে না। তিথি তন্ময়কে একটা চান্স দিচ্ছে প্রথম জীবনে সুখি হয়নি কিন্তু দ্বিতীয় বার শুরু করতে যাচ্ছে দেখা যাক এই বোঝাপড়ার জন্যই তাই আবার যবনিকা উত্তোলন আর একবার শূন্য থেকে শুরু জানে তিথি। তন্ময় ঠিক তার উল্টো মানসিকতার মানুষ তবুও যদি ঠিক করা যায় শুধু মাত্র ছেলেমেয়ের স্বার্থের কথা ভেবে সংসারকে টিকিয়ে রাখা। ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগে না ঠিকমতো, একটা দাগ থেকে যায়। তন্ময় তিথির বিশ্বাসের অস্তিত্বকে ছিড়ে ফেলেছে। শুধুই ত্যাগ বৃহত্তর স্বার্থে। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে যাবে চিরটা কাল। যে প্রশ্নটা সে কোনও দিনই তন্ময়কে করতে পারবে না। কিন্তু বারবার জানতে ইচ্ছে করছে। যদি তাদের দু’জনের অবস্থানটা পাল্টে যেত, যদি ভূমিকায় অদল বদল হয়ে তিথি স্পেসের সন্ধানে বাড়ির বাইরে বিদেশে গিয়ে আবার ফিরে আসতে চাইতো, তা হলেও কি গল্পের শেষটা এইরকমই হতো? যদি নিবেদিতা তাকে প্রতারণা করে ছেড়ে চলে না যেতো তবে কি সে ফিরে আসতো সেচ্ছায়… না কি অন্যকিছু…।