প্রবন্ধঃ ভারতের অবিসংবাদিত মুসলিম জননেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা

প্রবন্ধঃ ভারতের অবিসংবাদিত মুসলিম জননেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা

ভারতের অবিসংবাদিত মুসলিম জননেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা
পাভেল আমান

ভরতীয় মহাদেশের মুসলিম সমাজের আপোষহীন, সত্যনিষ্ঠ ,চির সংগ্রামী জননেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা। আমরা অনেকেই এই মহান প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বশালী , আদর্শনিষ্ঠা মূর্ত প্রতীকের সম্পর্কে জানি আবার অনেকেই জানি না। আধুনিক প্রজন্মেরা তাঁর সম্পর্কে খুব একটা জানার চেষ্টা ও আগ্রহ দেখায়না।
সৈয়দ বদরুদ্দোজা সাহেব ছিলেন মুসলিম সমাজের এমনই একজন প্রতিনিধি যিনি মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পতাকাকে আজীবন বহন করেছেন। এই অসাধারণ বাগ্মী পুরুষ অকুতোভয়ে, দ্বিধাহীনচিত্তে মুসলমানদের স্বার্থ, অধিকার ও দাবী দাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন।সহজ ভাবে বললে আমরা অনেকেই বিখ্যাত মানুষটি চর্চার যথাযথ ক্ষেত্র তৈরি করিনি। জীবদ্দশাতেই এই মহানুভব, উদারচেতা, সদা ন্যায় নীতির পথে পরিচালিত মানুষটিকে তৎকালীন সমাজ যথাযথভাবে তাঁর অবদান নিরূপণ করতে পারেনি। আমৃত্যু সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের ভাগীদার ছিলেন বদরুদ্দোজা। তাদের চিন্তা চেতনায় ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।
এই অসাধারণ কর্মবীর ১৯০০ সালের ৪ই জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রদত্ত এক শাহী ফরমানবলে সৈয়দ বদরুদ্দোজার পূর্ব পুরুষগণকে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন নবাব ভারত-সম্রাটের ফরমান মোতাবেক যে গ্রামে সৈয়দ-পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন, আজও তা ‘সৈয়দ কুলুট’ নামে পরিচিত।
তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি দর্শন শাস্ত্রে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। একই সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রিও লাভ করেন। ছাত্র জীবন থেকেই অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। ১ম বর্ষ আই এ ক্লাসে অধ্যয়নকালেই একটি বিশাল জনসভায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা প্রদান করে তিনি রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। শুধুমাত্র তাঁর বাগ্মিতা তাঁকে সান্নিধ্য এনে দেয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের।
বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর অপূর্ব বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দাস, সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে সরাসরি কলকাতা কর্পোরেশনের এনটালী মার্কেটের সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়োগ করেন। সৈয়দ বদরুদ্দোজা নিজেই ১৯৪৩ সালে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। অবিভক্ত বাংলায় তিনিই ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের চতুর্থ এবং সর্বশেষ মুসলমান মেয়র।
পরিতাপের বিষয় ১৯৭৪ সালের ১৮ নভেম্বর তার যখন জীবনাবসান হয় তখন শুধুমাত্র ভারতের নয়, বাংলা পশ্চিমবাংলার বয়স্ক মুসলমানরাও তাকে চিনতেন। অধিকাংশই তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের তিনিই ছিলেন একমাত্র মুখপাত্র। সুখ-দুঃখের চিরায়ত সঙ্গী। এমনই বিশাল পরিধির মহীরুহ রুপে বিনির্মিত হয়েছিল সৈয়দ বদরুদ্দোজার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বিবিধ জনহিতৈষী কর্মকাণ্ড ও দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে ক্রমশই নিরবে নিভৃতে একাই তিনি হয়ে উঠে ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। সৈয়দ বদরুদ্দোজা ছিলেন নির্লোভ, সত্যনিষ্ঠ, প্রগতিশীল, আদর্শবাদী ,অসমসাহসিক পুরোদস্তুর মনুষ্যত্বের জননেতা।
ভারতের প্রেসিডেন্ট পদে বিচক্ষণ কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ প্রণব মুখোপাধ্যায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় পশ্চিম বঙ্গের বাংলাভাষীসহ পৃথিবীর সকল বাংলানুরাগীই আনন্দিত সম্মানিত হয়েছে। যারপরনাই গর্ববোধ করেছে। তথাপি আমরা বাঙালীরা একথা আদৌ জানিনা যে, আজ থেকে প্রায় ছয় দশক পূর্বেই ভারতের প্রেসিডেন্ট পদ অতি সহজেই লাভ করতে পারতেন পশ্চিমবঙ্গের এক বাংলাভাষী মুসলিম জননায়ক। ‘অন্যায়ের’ সাথে কিঞ্চিৎ আপোষ করলেই তিনি হতেন ভারতের প্রথম বাঙ্গালী ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ভারতের মর্যাদা সম্পন্ন প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হবার লোভনীয় প্রস্তাব দু-দুবার প্রাপ্ত হয়েও তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং হাসিমুখে নির্যাতন ও সাত-সাতবার দীর্ঘ কারাবাস স্বীকার করে নেন নির্দ্বিধায়। সৈয়দ বদরুদ্দোজা- ভারতের তদানীন্তন সাড়ে সাত কোটি নির্যাতীত, নিপীড়িত, অবহেলিত শোষিত ও বঞ্চিত মুসলমানদের , অকুতোভয় কাণ্ডারী হিসেবে নিজেকে বৃহত্তর ভাবে মেলে ধরতে কোন কসুর করেননি।
ভারত বর্ষকে সৈয়দ বদরুদ্দোজা মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। স্বভাবতই, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খাঁন, শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশেমসহ প্রথিতযশা মুসলমান নেতারা যখন একের পর এক ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি দেন সেই দুঃসময়ে নিদারুণ পরিস্থিতিতে ভারতের মুসলমানদের সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা, অধিকার-আধিপত্য রক্ষার আবশ্যিক স্বার্থ পূরণে সৈয়দ বদরুদ্দোজা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের (বিশেষত শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের) বিবিধ প্রলোভনীয় প্রস্তাব এক প্রকার উপেক্ষা করে ভারতেই স্থায়ীভাবে বাসিন্দা হয়ে থেকে যান। সকল ভয়-ভীতি, অত্যাচার-অবিচার উপেক্ষা করে নির্যাতীত সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার রক্ষার্থে অক্লান্ত নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন সারা জীবন। প্রকৃতপক্ষে ভারত বর্ষকে প্রাণভরে ভালোবাসলেও তার কাছে সব চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল তার ধর্ম, ইসলাম-ভিত্তিক চিন্তা ভাবনা, দর্শন ও সংস্কৃতি।
নিজেকে সর্বান্তকরণে ভারতীয় মনে করলেও ভারতের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হতে তিনি কোনক্রমেই সম্মত হননি। ভি.ভি. গিরির নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষে সিপিআইএম-এর সমর্থন পাইয়ে দিতে সৈয়দ বদরুদ্দোজার কঠোর প্রয়াসের স্বীকৃতি প্রদানে এবং ভারতীয় মুসলমাদের অধিকতর সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ষাটের দশকের শেষার্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে দু-দুবার প্রস্তাব দেন ভারতের প্রেসিডেন্টের মর্যাদাসম্পন্ন পদে সমাসীন হওয়ার জন্য। সেই সময়ের অশোক সেন, হুমায়ুন কবীর, ত্রিদিব চৌধুরী, ভূপেশ গুপ্ত, রেণু চক্রবর্তী, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, হীরেন মুখার্জি প্রমুখ বিখ্যাত ও স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাব সৈয়দ বদরুদ্দোজার কাছে দু-দুবার নিয়ে এলে প্রত্যেক বারই তিনি তা নিঃসংকোচে অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেন শুধুমাত্র একটি কারণে-ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন। ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি শঠতা, প্রবঞ্চনা, ধাপ্পা ও সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের অত্যাচার ও বঞ্চিত করার এক ঘৃণিত প্রক্রিয়া বলেই বিবেচনা করতেন।
প্রকৃতার্থেই অদম্য, আকুতোভয়, অসমসাহসিক ছিলেন সত্যনিষ্ঠ পথের দিশারী ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। পরিণতি যতই ভয়াবহ, কষ্টদায়ক, হোক না কেন, পরিবেশ-পরিস্থিতি যতই বন্ধুর বা প্রতিকূল হোক না কেন, সত্য বলতে, প্রকাশ্যে মিথ্যার বিরোধিতা করতে তিনি কোনদিনও ভয় পাননি। তিনি সর্বদাই এক অনন্য মানবীয় গুণের অধিকারী ব্যক্তিসত্তা ছিলেন। স্বভাবতই, ১৯৬২ সালে লোকসভায় তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করেন যে, ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে অন্ততঃপক্ষে দশ লক্ষ নিরীহ মুসলমান নিহত হয়েছে।
১৯৫০ সালে হাওড়ায় প্রায় আড়াই মাসব্যাপী বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহররাল নেহেরুর কাছে মুসলিম জাতির নেতা হিসেবে প্রতিবেদন উপস্থাপন করার সময় তিনি যখন প্রকাশ্যে দাবি করেন যে, শুধুমাত্র একটি জুট মিলেই অন্ততঃপক্ষে সতেরো শ’ মুসলমানকে হত্যা করা হয়, তখন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীও বিস্মিত ও বিহ্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু সৈয়দ বদরুদ্দোজার এই সৎ সাহসের জন্য তিনি সাম্প্রদায়িক হিসেবে শুধুমাত্র নির্যাতিতই হননি, একই সংগে বিনা বিচারে চার মাস তাকে কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছে।
১৯৫৩ সালে আলীগড়ে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনভেনশনের সভাপতি হিসেবে ভারতের তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস রূপ উন্মোচন করে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ইংরেজি ও উর্দুতে যে সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী অনলবর্ষী বক্তৃতা প্রদান করেন তা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং আজও তা’ ভারতে অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে। এই ঐতিহাসিক বক্তৃতার ফলে আলীগড় ও দিল্লীর মুসলমানরা তাকে ‘কায়েদে আকবর’ উপাধি প্রদান করেন।
সৈয়দ বদরুদ্দোজার সত্যভাষণ বন্ধ করতে পারে, মুসলিম বিরোধী ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরার তার অতুলনীয় ফল্গুধারার গতিরোধ করতে পারে এমন কোন শক্তি ভারতে তখন ছিল না। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে কলিকাতার শহরে সংঘঠিত মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যন্ত্রণাদায়ক বিবরণ যখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী গুলজারীলাল নন্দের উপস্থিতিতে সৈয়দ বদরুদ্দোজা বর্ণনা করেছিলেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। সৈয়দ বদরুদ্দোজার প্রচণ্ড ধমকে হতবাক প্রফুল্ল চন্দ্র সেন চেয়ারে বসে পড়েন এবং বদরুদ্দোজার অসাধারণ বাগ্মিতা উত্তাল সমুদ্রের মতই অধিকতর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বজ্রকন্ঠে তিনি প্রফুল্ল চন্দ্র সেন ও গুলজারীলাল নন্দকে জানিয়ে দেন।বলাবাহুল্য, সেই রাতেই সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে অন্তরীণ করা হয় সাম্প্রদায়িকতার অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগে। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় সৈয়দ বদরুদ্দোজাই ছিলেন একমাত্র লোকসভার (ভারতীয় পার্লামেন্টের) সদস্য যাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে প্রায় ছয় মাস বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।
১৯৭১ সালে ১ জুন ইন্দিরা গান্ধী সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। কলকাতা হাইকোর্ট এই নির্দেশ অবৈধ বলে রায় দেয়। কিন্তু হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়া মাত্র হাইকোর্টের গেট থেকেই পুনরায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিনা বিচারে আড়াই বছর কারারুদ্ধ রাখা হয়। জেলের অভ্যন্তরে অজ্ঞাত কারণে তার দু’বার সিরিয়াস স্ট্রোক হলে নয়টি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে লোকসভায় দাবি করেন সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে মুমূর্ষু সৈয়দ বদরুদ্দোজার ‘বেল’ মঞ্জুর করা হয়। ১৯৭৪ সালে সাংবাদিকদের তীব্র সমালোচনা ও জনতার চাপের মুখে ভারত সরকার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় মারফত অকস্মাৎ সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করেন।
ক্ষমতা ও খ্যাতি, উচ্চপদ ও অর্থ-বৈভব, কোনো কিছুর প্রতিই আসক্তি বা মোহ ছিল না বদরুদ্দোজার। ভারতের রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট মন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার স্পিকার, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রভৃতি বহু লোভনীয় পদ গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন সময় তাকে আহ্বান জানানো হলেও সব প্রস্তাবই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। মানব সেবাই ছিল তার একমাত্র আদর্শ। মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর অমর উক্তিকে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন : ‘খাইরুন্নাসি মাই-ইয়ানফাউন্নাস।’ সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন করে।’
শত প্রলোভন উপেক্ষা করে সৈয়দ বদরুদ্দোজা বেছে নিয়েছিলেন কষ্টসাধ্য, আরম্ভরহীন, একেবারে সহজ সরল সাদামাটা আটপৌরে সাধারণ জীবন। ভারতের নির্যাতীত মুসলমানদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন সাত-সাতবার যন্ত্রণাকর কারাগারেরজীবন। ৭৪ বৎসর বয়সেও বিনাবিচারে সুদীর্ঘ আড়াই বছর তাকে কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছে ভারতের মুসলমানদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দরুন। ব্রিটিশ ভারতে তিনি কোলকাতার মেয়র ছিলেন, সুদীর্ঘ ৩৫ বৎসর ভারতীয় পার্লামেন্ট (লোকসভা), পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ১৮ নভেম্বর যখন তিনি শাহাদাতবরণ করেন তখন কলিকাতা কিংবা পৃথিবীর অন্য কোথাও ছিল না তার কোন নিজস্ব ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তিও ছিল না লেশমাত্র। ছিল শুধু ৩১৭/- রুপির অতি ক্ষুদ্র একটি ব্যাংক ব্যালেন্স। একেই বলে প্রকৃত জনসেবা, নিঃস্বার্থ জন হিতৈষী। বর্তমান সংকটের মুহূর্তে হিন্দুত্ববাদী তথা উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি যখন আসমুদ্রহিমাচল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই সংখ্যালঘু মুসলিমদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করছে, সেই মুহূর্তে মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে যদি ঐক্যবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে দাবি দাওয়া আদায় করতে, নিরাপদে বেঁচে থাকতে গেলে অসীম সাহসী, আপোষহীন, সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব, কর্মবীর সৈয়দ বদরুদ্দোজার জীবন দর্শন, আদর্শ, চিন্তা-চেতনাকে পাথেয় করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেখানেই সমগ্র মুসলিম সমাজের সামগ্রিক উত্তরণ। এই মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী সৈয়দ বদরুদ্দোজা সাহেবের জন্মদিনে তার দেখানো আদর্শকেই আমরা সমগ্র মুসলিম সমাজ অনুসরণ করে, আমাদের জাতিসত্তার পাশাপাশি ভারতীয় নাগরিক সত্তাকে আরো বেশি প্রসারিত প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হবে।