অরুণ কুমার সরকারের গল্প

গণেশ
ছোটবেলার কষ্টকর জীবনের কথা বললেও আর বিশ্বাস করে না গণেশের ছেলেরা। বিশ্বাস করার কথাও নয়। তারা যে অনুভবও করতে পারে না সে সময়কার সামাজিক অবস্থার কথা।
পাঁচ পাঁচ দশ কিলোমিটার গ্রামের কাঁচারাস্তা হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়েছে গণেশকে। বর্ষার চিত্র তো ছিল একেবারে ভয়ংকর। নদীর গা ঘেঁষে স্কুল যাওয়ার রাস্তাটার ওপর দিয়ে সে সময় জলের স্রোত বইত। খুঁজে পাওয়া যেত না পায়ে হাঁটা রাস্তাটা। জল সরে গেলে, পড়ে থাকত হাঁটুসমান কাদা। সেই কাদা খচে স্কুল করতে গণেশের পায়ের নিচটায় দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে যেত।
এমন কষ্টেও লেখাপড়াটা ছাড়েনি গণেশ।
সেবার মাধ্যমিকটা ভালোভাবেই পাশ করল সে। মাধ্যমিকটা পাশ করতে না করতেই মনের মধ্যে যেন ছোট্ট এক স্বপ্ন জাগল। এ যেন, কবিগুরুর সেই ছোট প্রাণ, ছোট আশা।
গণেশ এর তার কাছে শুনেছে, বেসিকট্রেনিংটা করতে পারলে, প্রাইমারীতে চাকরি নাকি অবধারিত। আজ না হোক কাল চাকরিটা হবেই হবে।
গণেশ সেই স্বপ্নটাই দেখল।
বাস্তবটাকে অনুভব করে, গণেশ এর থেকে বড়কিছু আর ভাবতে পারল না। সামান্য এক মহুরির কাজ করে ওর বাবার পক্ষে ছেলেকে বড় কোনও স্বপ্ন দেখানোর সামর্থ্যও ছিল না।
গণেশ শেষপর্যন্ত বেসিকট্রেনিংটা করেই প্রাইমারীতে চাকরিটা পেল। মাধ্যমিকের রেজাল্টটা ভালো ছিল বলে, ওকে আর বসে থাকতে হল না বেশিদিন।
গ্রামে সে সময় গণেশকে চেনে না, এমন মানুষ বুঝি নেই।
গণেশ তখন গ্রামের মানুষের কাছে গণেশমাষ্টার নামে পরিচিত। চাকরি পাওয়ার বছর পাঁচেক কাটতে না কাটতেই গণেশ নতুন এক স্বপ্ন দেখল। সে তখন সবে বাবা হয়েছে।
সদ্য সন্তানের পিতা হওয়া গণেশ গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখল।
করলও ঠিক তাই।
সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, গণেশ গ্রামে আর পড়ে থাকতে চাইল না। লেখাপড়া শিখতে সে নিজে যে কষ্টটা করেছে, সন্তানকে সেই কষ্টের মুখোমুখি হতে দিতে চায় না সে। তাছাড়া, যে স্কুলে সে চাকরিটা পেল, সে স্কুলেও যেতে হল অনেকটা কাচারাস্তা পার করে। ফলে, বর্ষার দুর্ভোগটা আর গেলই না ওর জীবন থেকে।
গণেশ সন্তানকে ভালো লেখাপড়া শেখাতে চায়। অনেক অনেক লেখাপড়া শেখাতে চায়। সন্তানকে সে অনেক বড় মানুষ করতে চায়।
সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে, সেবার গ্রামের সমস্ত জমিজায়গা বাড়িঘর বেঁচে, বাবা-মা বোনদের নিয়ে গণেশ উঠে এল শহরে।
এই বয়সে শহরে এসে, ললিত বর্মণের কাজের খানিকটা সুবিধাই হল।
কোর্টটা কাছে হল তাঁর।
কোর্টটা কাছে হল বলে, মহুরির কাজ করতে তাঁর সুবিধাই হল। আগের মতো তাঁকে আর দশ দশ বিশ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল চালিয়ে কোর্টে যাতায়াত করতে হয় না। শহরে চলে আসার পর, যেতে আসতে বড়জোর তাঁকে এক কিলোমিটার মতো রাস্তা সাইকেলে যেতে হয়। কোনও কোনও দিন হেঁটেই যাওয়া আসা করেন কোর্ট-কাছারি। এই বয়সে তাঁর পক্ষে এটা ভালো বই মন্দ হল না।
গ্রামের জমি, গাছগাছালি পুকুরসহ খোলামেলা বাড়িটা বিক্রি করে গণেশদের এখন শহরের ছোট্ট এক বাড়ির পরিসরে অনেকটা যেন চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের মতো বসবাস করতে হয়। এক সময় ভোরের পাখিদের কলকাকলিতে যাদের ঘুম ভেঙে যেত, ভোরের নরম বাতাস যাদের গা ছুঁয়ে যেত, পুকুরের মাছেদের সাঁতারকাটা দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে আসত, শহরে এসে সেসব তাঁদের কাছে একেবারে অতীত হয়ে গেল।
গণেশ সেবার পিতৃহারা হলে, সংসার আর বোনদের সমস্ত দায়দায়িত্ব এসে পড়ল তার ঘাড়ে। সামান্য এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি করে গণেশকে তিন তিনটি বোনের বিয়ে দিতে হল। শহরে এসে বাড়ির জমির ভাতও খেতে পারল না, পুকুরের মাছও খেতে পারল না। সব কিনে খেতে সংসারে আর অবিশিষ্ট বলে তেমন কিছু আর থাকল না।
কানন বর্মণও স্বামীকে হারিয়ে খুব বেশিদিন আর বাঁচলেন না।
গ্রামের খোলামেলা জায়গা ছেড়ে এসে শহরে তিনি যেন ঠিকমতো নিঃশ্বাসটাও নিতে পারলেন না। এক দমবন্ধকর পরিবেশকে মানিয়ে নিতে পারলেন না কিছুতেই। ফাঁপরে পড়ে গেলেন যেন। তাঁর মন সারাক্ষণ পড়ে থেকেছে কেবল ফেলে আসা গ্রামের সবুজ মাঠ, নদী, পুকুর, হাঁস, গরু, ছাগল, পাখপাখালিদের ওপর। শহরে এসেও সেসবকে ভুলতে পারলেন না কিছুতেই।
সংসারের মস্ত এক বোঝা মাথায় নিয়েও গণেশ দ্বিতীয়বার সন্তানের বাবা হয়েছে।
দুই ছেলের বাবা হয়ে গণেশের দায়দায়িত্বটাও বেড়ে যায় অনেকখানি। গ্রামের সমস্তকিছু ফেলে যে জন্য ওর শহরে আসা, নিজের সাধ্যমত সে চেষ্টাটা করে গেল সে। হাজারো প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সন্তানদের সমস্ত চাহিদা মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল।
অজয় গণেশের বড় ছেলে।
মেধা আছে ছেলেটার।
সেও বাবার মতো মাধ্যমিক পাশের পর বেসিকট্রেনিংটা করে ফেলল। চাকরিটাও পেয়ে গেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অল্প বয়সেই চাকরিটা পেয়ে, সে যেন অনেক বড় হয়ে গেল। নিজেই নিজের সিধান্ত নিতে শিখে গেল।
অজয় সেবার কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা বউ তুলল ঘরে।
ছেলের এমন এক কাজে গণেশ মনে আঘাত পেলেও শেষে মেনে নিল সব।
গণেশের যত ভাবনা চিন্তা এখন বিজয়কে নিয়ে।
সরস্বতীর আশীর্বাদ যেন ওদের বাপ ছেলে সবার ওপর। বিজয়ও মেধাবী। ক্লাস ওয়ান থেকেই সে প্রথম হয়ে আসছে। ছোট এই ছেলের প্রতি গণেশের তাই বাড়তি নজর।
সেবার কী এক গোপন খবর নিয়ে এল অজয়।
প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ নাকি শুরু হবে খুব শিগগিরই। কেবলমাত্র ভালো রেজাল্ট থাকলেই যে আজকাল চাকরি হয়, এমনটা নয়। অজয় কোথা থেকে এক গোপন খবর পেল, কোনও এক রাজনৈতিক নেতার পকেটে মোটা টাকা দিতে পারলে নাকি, প্রাইমারীতে চাকরি একেবারে নিশ্চিত।
অজয়, জয়ন্তীর জন্য দৌড়ঝাঁপ করল।
জয়ন্তী, অজয়ের ভালোবেসে গোপনে বিয়ে করা বউ।
অজয় বউয়ের চাকরির কথা ভাবল ঠিকই, কিন্তু উপায়? সে তো চাকরি করে এতদিনে দু’পয়সাও জমাতে পারেনি হাতে। তাহলে? টাকাও তো নেহাত কম নয়। কী করবে সে ভেবে পায় না। অবশেষে বাবাকেই ধরল সে।
কোনও উপায় না দেখে, গণেশকে অবশেষে ধার লোণ করে টাকাপয়সা সংগ্রহ করতে হল ছেলের বউয়ের চাকরিটার জন্য। যদিও শেষপর্যন্ত, সে কেবল নিঃস্বই হল, ছেলের বউয়ের চাকরিটা আর হল না।
সেবার বিজয় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেল।
বছর দুই পড়তে মোটা টাকার প্রয়োজন। গণেশের সে সামর্থ্য আর নেই। আগেরই ধারদেনা পড়ে আছে। শোধ করতে পারেনি। নিরুপায় সে।
গণেশ নিরুপায় হয়েও ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দিতে চায় না।
ছেলেকে একবার ভর্তি করাতে পারলে, আর কোনও চিন্তা থাকত না। কিন্তু এক সঙ্গে প্রায় দশ বারো লাখ টাকা সে পাবে কোথায়? সে চিন্তায় গণেশের রাতে যেন ঘুমই আসে না।
নিরুপায়ে গণেশ শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল।
গণেশ ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, একমাত্র সম্বল বাড়িটাকেই বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। গণেশের আর কোনও উপায় নেই। বাড়িটাকে বিক্রি করেই সে ছেলের স্বপ্ন পুরন করতে চায়।
গ্রামের সমস্ত সয়সম্পত্তি বিক্রি করে, এক সময় শহরের যে ছোট্ট বাড়িটায় উঠে এসেছিল গণেশ, যে বাড়িটাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল অনেক স্বপ্ন, সে বাড়িটাকেও শেষপর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হল সে।
গণেশ যেন পুরোপুরি নিঃস্ব হল। মাথাগোঁজার নিশ্চিত আশ্রয়টুকুও তার আর থাকল না।
মাথাগোঁজার নিশ্চিত আশ্রয়টুকু হারিয়ে গণেশ সপরিবারে ভেসে বেড়াতে লাগল আজ এ বাড়ি, তো কাল সে বাড়ি। এক সময় যার দু’দুটি বাড়ি ছিল, পুকুর ছিল, জমি ছিল, সে হল কিনা গৃহহীন। গণেশের এখন ভাড়াটে জীবন। বউ ছেলের মাথার ওপর ছাদ দিতে তাকে এখন ছাদ ভাড়া নিতে হয়। স্বপ্নেও সে ভাবতে পারেনি এমন এক জীবনের কথা। সামান্য চাকরিটুকু ছিল বলে, কোনমতে টিকে থাকতে পারল সে।
বিজয়ের চোখে বড় স্বপ্ন।
ছেলের সে স্বপ্ন নষ্ট হতে দিতে চায়নি গণেশ। বিজয় স্বপ্ন দেখে নোনা নীল জলের। বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে সে ভেসে বেড়াতে চায় সীমাহীন সমুদ্রের বুকে। ছুঁয়ে আসতে চায় সমুদ্রের তলদেশ। শক্ত করতে চায় সে দেশীয় জলশক্তিকে।
ছেলের এমন সব স্বপ্নগুলোই যেন গণেশের চোখে ধরা দেয়। ভাড়াটে জীবনে ভেসে ভেসে ছেলের দেখা স্বপ্নগুলোকে সেও দেখতে চায় শক্ত এক মাটির ওপর দাঁড়িয়ে। যেখানে নোনা জল নেই, ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস নেই, হৃদয় খোয়ানো মায়াবী সৌন্দর্য নেই। আছে কেবল কঠিন এক বাস্তব। সেই বাস্তবের মাটির ওপর দাঁড়িয়ে গৃহহীন এক পিতা সেজে, গণেশ কেবল সন্তানের সুখটুকুই খোঁজে।