গল্প: ত্রসরেণু

গল্প: ত্রসরেণু

ত্রসরেণু
দীলতাজ রহমান

সন্ধ্যারাতের সামান্য জ্বর গণগণিয়ে বেড়ে মাঝরাতে অনেক হলো। অমন জ্বর যার হয়, সে নিজে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারে না। তার ওপর শিহাবের পাশে কেউ নেই। সাতদিন হয় নদী রাগ করে তার বাবার বাড়ি চলে গেছে।

মা-বাবার একমাত্র সন্তান নদী। তাই শিহাবও তাকে প্রথম প্রথম অনেক প্রশ্রয় দিয়েছে। তার অনেক আব্দার মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাড়ির মেয়েমানুষের অন্যায় আব্দার সে মেনে নেবে না, এ রকম একটি ইগো সে তার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে জোরালোভাবে পেয়েছে। যদিও বাপ-দাদার ইগোর খনিকটা সে বর্জন করেছে। পুরোটুকু কখনোই পারবে না। একটি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাকে পর্যন্ত দেখেছে বাবার কথার বাইরে কোনোদিন যাননি। কোনো ধরনের অন্যায় আব্দার করা দূরে থাক। বরং তার বাবার সব কাজে-কথায় তার মা-ই প্রথম সাপোর্ট দিয়েছেন। স্বামী মনে কষ্ট পাবেন এমন সব কাজ ও কথা থেকে তিনি ছেলেমেয়েদেরও বুঝিয়ে নিবৃত্ত রেখেছেন। সংসার-পরিবার টিকিয়ে রাখতে হলে একজনকে তো নমনীয় হতে হয়! শিহাব তার মা-বাবাকে দেখে বুঝেছে, স্বভাবত নমনীয় হওয়াটা নারীকেই মানায়, যদি সে পরিবারের পুরুষটি দুর্বিনীত স্বেচ্চাচারী না হন। নারী একটুখানি আনুগত্য দেখালেই পুরুষ তার পুরোটা অর্জন তার কাছেই বিসর্জন দিচ্ছে। দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সমাজে তাই তো প্রমাণিত হচ্ছে অহরহ।
সময় পাল্টেছে এটা শিহাব বোঝে। নারী হোক বা পুরুষ, যে কোনো অগ্রসর মানুষের কথা মাথা পেতে নেয়াই যায়। কিন্তু যে নিজেরই কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না, শিহাব ভাবে, আমি কেন তার একরোখা আব্দার মানতে যাবো!
নদী হয়ত ভেবেছিলো সে রাগ করে চলে গেলে শিহাব সেদিনই তাকে আনতে যাবে! কিন্তু শিহাব সাতদিনেও সে কাজটি করেনি।
কলহের সূত্রপাতটা ঘটেছিলো এভাবে; নদী বলেছিলো, গুলশানে তার মামার নির্মিত ভবন থেকে একটা ফ্ল্যাটের বুকিং দিতে। মামা মোট মূল্য থেকে তাদের জন্য নাকি অনেক কমিয়ে দেবেন!
শিহাব বলেছে, কমালেও কত কমাবেন? আর আমি কারো দয়া বা সুযোগ নিতেই যাবো কেন? আমাদের জীবন পড়ে আছে। মাত্র দু’বছর হয় আমাদের বিয়ে হয়েছে। চাকরির বয়স তিন। ওসব ফ্ল্যাট-ট্যালাট এমনি সময় মতো হবে!
কিন্তু নদী তা মানতে নারাজ। সে তার আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব কে কোথায় জমি-ফ্ল্যাট কিনছে, কে কোথায় বুকিং দিয়েছে সেইসব উদাহরণ টেনে টেনে উচ্চস্বরে শিহাবের সাথে কথা বলেছে। আর এতেই চরমভাবে দমে গেছে শিহাব। তার আর নদীর দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করেনি! আগেও যে একআধটু বচসা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দু’জনের হয়নি, তা নয়। কিন্তু প্রতিবার শিহাবই থেমে গেছে। সে ভেবেছে, এখনো হানিমুনের রেশ কাটেনি, এখনি
কারো বিষদাঁত দেখে ফেললে তাকে নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকাটা খুব ন্যাক্কারজনক। তাই যতদিন তা দেখা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তবু তারা পাশাপাশি দু’দিকে ফিরে শুয়ে দু’রাত পার করেছে। শিহাব কেবলি ভাবছিলো, যে স্ত্রী তার স্বামীর সামর্থের ওপর আঘাত করে, সে আঘাত শারিরীক আঘাতের চেয়েও অধিক। বাকি জীবন তাকে এই লাঞ্ছনার ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং নদীর মতো নারীর পেটে তাকে বাচ্চার নামে বিষফল জন্ম দিতে হবে, এসব ভেবে সে শঙ্কিতও হচ্ছিলো। পৃথিবীতে কত কত বিষয় আছে আলাপের, কিন্তু ঘরে ঢুকলেই মনে হয় ড্রাইভার দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার মাথায় স্ক্রু ঢোকাচ্ছে নদী। তার চিন্তা-ভাবনা প্রবলভাবে ব্যাহত হচ্ছিলো। অন্যেরা তাদের স্ত্রী’র এইসব বিষয় কীভাবে মেনে নেয় এটাই শিহাব ভেবে পাচ্ছিলো না।

অযথা বিলাসদ্রব্য কিনতে, বা ঘরের ফার্নিচার পাল্টাতে নিষেধ করলেই নদী বলে ওঠে, অন্যেরা পারলে তুমি পারবে না কেন?
: অন্যেরা কীভাবে পারে এটা তাদের বিষয়। আমি শুধু আমারটুকু জানি। আমি ব্যাংকে যে পোস্টে চাকরি করি, সেই হিসাবে আমার মোটামুটি ধারণা আছে আমি কবে নাগাদ কোথায় পৌঁছাবো। কবে আমার কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত! তাছাড়া আমি ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যতিক্রম কিছু কাজ করতে উচ্চশিক্ষার জন্য একবার হলেও উন্নত কোনো দেশে যেতে চাই। কানাডা আমার লক্ষ্য। যেহেতু সৌরভ সেখানে সেটেলড। তোমাকেও বলে রেখেছি আমার সাথে যেতে চাইলে তুমিও একটা উপায় বের করো। সৌরভ আমার ছোটভাই। ওর ওখানে গেলে আমাদের অসুবিধা হবে না। তবে যাওয়াটা কাজে লাগাতে হবে। তখন বেশ কিছু টাকার দরকার হবে। আর আমার মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, আমি এমন কোনো কাজ আপাতত করতে চাচ্ছি না, এসব কথা বারবার তোমাকে বোঝাচ্ছি…।
: এত যদি গায়ে বাতাস লাগিয়ে জীবন কাটাতে চাও, তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?
: বিয়ে করেছি কি আমার বুদ্ধি-বিবেক বিসর্জন দিয়ে তোমার কথামতো চলতে? বিয়ে মানুষ যে জন্য করে আমিও সেজন্য করেছি! তুমি কি ভেবেছিলে, যাকেই বিয়ে করো সে তোমার কথা মতো চলবে?
: তুমি কখনো আমার কোনো কথা রাখো না!
: রাখার মতো কথা তুমি আজ পর্যন্ত কোনটা বলেছো? শোনো নদী, দুই পক্ষের গার্জিয়ান যখন পাকা কথার আগে আমাদের দু’জনকে সুযোগ দিয়েছিলেন আলাদা করে কথা বলতে, তখনই কিন্তু আমি তোমাকে আমার এইসব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলাম!
: তাই বলে নিজেদের জন্য আরো ভালো পরিবেশে স্থায়ী একটা থাকার জায়গা করবে না?
: ভাল পরিবেশ-টেশ কিছু না। ভালো পরিবেশ বলতে তুমি বোঝোটা কি? তোমার হলো অসুস্থ মানসিকতার মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার সাধ জন্মগত। বেসিক বিষয়গুলো তোমাদের কারো জানা নেই। জানা থাকলে তোমার ভেতরও ছিঁটেফোটা আসতো! তোমার রেজাল্ট যা হোক, ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি তুমি অর্জন করেছ, মানছি। কিন্তু তুমি একটা স্কুলেও চাকরি করার যোগ্যতা অর্জন করোনি। আর তা নিয়ে তোমার কোনো গ্লানিও নেই! তোমার বন্ধুদের কাছে এই বিষয়টা নিয়ে তোমার লজ্জা হয় না? নাকি স্বামীর গলায় রক্ত তোলা টাকায় বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনে সবাইকে দেখিয়ে সেই খামতিটাই পুষিয়ে নিতে চাও?

: সমাজে থাকতে হলে সবার মতো হয়েই তো থাকতে হবে। নাকি?
: তাহলে জেনে রাখো, তোমার সমাজ আর আমার সমাজ আলাদা। ঢাকাতে আমাদের নিজেদের যেখানে বাড়ি আছে, সেখানে তোমার এত হতাশ হওয়ার কারণ কি? বাড়ি কিনে আম্মা-আব্বাকে আমি যত কষ্ট
করতে দেখেছি, ওই কষ্ট আমি করার দরকার মনে করি না! আর আব্বা চাইলে ওখানেই আধুনিক ফ্ল্যাট হতে পারে!
: তা তিনি কখনো করবেন না!
: বাড়ি তার। না করলে না-ই করুন। তবু আমি কেন গুলশানের মতো জায়গায় একটা ফ্ল্যাটের পেছনে এখনি আমার সবটুকু নিংড়ে দেবো এবং সেখানেই আমার নিয়তি ঠেকিয়ে রাখবো? আমার স্বপ্নগুলো অন্যরকম।
: তোমাদের বাড়ি থেকে আর কতটুকু পাবে তুমি? একগাদা ভাইবোন তোমরা!
: এক পরিবারের জন্য কয়টা ফ্ল্যাট লাগে? আর তুমি তো একা!
: ও, তাহলে আমার বাবার সম্পত্তির দিকে তাহলে তোমার নজর আছে!
: আমার খুব ঘেন্না হচ্ছে তোমার জন্য আমি আমার মা-বাবা ভাইবোনদের ছেড়ে আলাদা ফ্ল্যাটে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম তুমি একা বড় হয়েছো, অনেক মানুষের হৈচৈ তোমার সবসময় ভালো লাগে না।
তাই মন খারাপ করে থাকো। আর স্বামী হিসাবে সেটুকু দেখা বা বোঝার আমি দায়িত্ব মনে করেছিলাম। তবে বড় সন্তান হিসাবে আমার যে দায় মা-বাবার প্রতি, তার থেকেও আমি সরবো না!
: তুমি আমার জন্য আসোনি! তোমার অফিস বনানী, তাই বনানীতে বাসা ভাড়া নিয়েছো।
: আমি কি আগে আমাদের বাড়ি থেকে এসে এখানে অফিস করিনি? আম্মা নিজের টাকায় আমার স্ত্রী’র জন্য বাড়িঘর নতুন করে সাজিয়েছেন, তারা নতুন বৌ নিয়ে থাকবেন বলে। তবু আমি আব্বা-আম্মাকে বুঝিয়ে তোমাকে নিয়ে চলে এসেছি।
: ঠিকাছে, ভুল করে থাকলে ফিরে যাও!
: সেটা সময়ই বলবে!
দু’রাত গুমোট কাটিয়ে তার পরদিন শিহাব অফিস থেকে ফিরে এলে দরজা খুলতে খুলতে সাহারা বললো, নদী বাসায় নেই। সুটকেস ভর্তি কাপড়চোপড় আর খুঁটে খুঁটে সব গহনা নিয়ে চলে গেছে। তোমাকে তা জানিয়ে সারাদিনের জন্য মাথা ভারী করে দিতে চাইনি! কারণ তুমি অফিস থেকে চলে আসতে আসতে ওকে ঘরে পেতে না!
নদীকে শিহাব ফোন করলে নদী লাইন কেটে দিলো। তারপর সে নদীর বাবাকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো, নদী তাকে না বলে চলে গেছে! শিহাব সে রাতে অফিসের পোশাক না ছেড়েই শুয়ে পড়লো। রাতে উঠে আর খায়ওনি।
তারপরের ক’দিনে নদীর মা-বাবা ক’বারই শিহাবকে ফোনে বলেছেন, হয় নদীকে তুমি নিজে এসে নিয়ে যাও, না হয় তুমি এসে আমাদের এখানে ক’দিন থাকো। এখান থেকে অফিস করবে। শিহাব বলেছে, টানা দুই বছর তো আমরা একসাথেই আছি। এখন ও ক’দিন একা আপনাদের ওখানে বেড়াতে চাইলে বেড়াক। যখন তার ফিরতে ইচ্ছে করবে, তখনই যেন ফেরে!
জামাইয়ের কাটা কাটা উত্তর নদীর মা-বাবা কারোই ভালো লাগেনি। তাই তারা ধরে নিয়েছেন, জামাইয়েরই দোষ। জামাইয়ের একরোখা স্বভাবের জন্য তাদের মেয়ের কোনো কথাই সংসারে মূল্য পায় না!

নদীর মা-বাবা বিষয়টি শিহাবের মা-বাবাকে জানালে তা শিহাবকে আরো বিব্রত করে তোলে। কারণ সবার অযথা প্রশ্নের কোনো উত্তর শিহাবের জানা নেই। তা ছাড়া উটকো একটি বিষয়ের জন্য অযথা মা-বাবাও কষ্ট পাচ্ছেন, সে জন্যও জীবনে এই প্রথম নিজেকে তার খুব অনর্থ মনে হয়। সে ভাবে, মানুষ কেন বিয়ে করে! একজন সঙ্গী এসে জীবনের ভারগুলোর ভাগ নিয়ে আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে সব সময় তাকে উৎকর্ণ হয়ে থাকতে হয় কিসে স্ত্রী’র মন ভালো থাকবে। সব খারাপ অবস্থা মানে, তার যে সব পছন্দ নয় তার থেকে তাকে সরিয়ে রাখা। তার জন্যও শিহাবের কোনো দুঃখ ছিলো না! কিন্তু যে নারীর নিজেকে তৈরি করতে, কোনো কিছুর সাথে যুক্ত থাকতে, বই পড়তে বা ভালো কোনো বিষয়েই যার আগ্রহ নেই, সেই তার জন্য তার মা-বাবা, ভাইবোন ফেলে, নিজের উচ্চাকাক্সক্ষা বিসর্জন দিয়ে তার নিজেকে গার্ড হয়ে থাকতে হবে!
শিহাব ক’দিনই নদীকে বলেছে, মাস্টার্স করে কোনো মেয়ে অকর্মা বসে থাকে এটা তোমাকে ছাড়া এসময়ের কোনো নারীকে দেখিনি!
নদী ঝামটা মেরে বললো, কটা মেয়েকে তুমি দেখেছ?
আমার আফিসে প্রায় অর্ধেকই মেয়ে! এ ছাড়াও বুঝি মেয়ে দেখিনি! আর বাজার করা থেকে সংসারের সব দায়িত্বই তো সাহারা আপা পালন করেন। সেই আমাদের ছোটবেলা থেকে সাহারা আপা আমাদের সংসারের হাল ধরে ছিলেন। এর ভেতরও তিনি কতকিছু শিখেছেন। শুধু আমাদের ভালো থাকার জন্য আম্মা তাকেও আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তার থেকেও তোমার শেখার অনেক কিছু ছিলো। এবার তুমি যা হোক, তোমার নিজের জন্যই একটা কিছুর চেষ্টা করো।

নদী ক’বার অবশ্য ইন্টারভিউ দিয়েছে কয়েক জায়গায়। কিন্তু হয়নি। দু’বার বিসিএস দিয়েছে, একবারও টেকেনি। আর কোনোটাই হয়নি বলে তার সব চেষ্টা থেমে গেছে।
শিহাব ভাবে, নদী ফিরে আসতে চাইলে তাকে একাই আসতে হবে! না হলে সেধে আনতে গেলে সেই পুরনো বিষয়ের পূনরাবৃত্তি জোরেসোরে ঘটাতে থাকবে। এই জের জীবনভর টানা যাবে না! নীতিগর্হিত বা অর্থহীন কোনো কাজই সে কারো জন্য করবে না।
কারণ পৃথিবীতে মানুষের ভাববার ও করবার মতো অনেক মহৎ বিষয় আছে!

সাতদিন পার হয়ে গেছে নদী আসেনি। শিহাবের বাবা-মাও প্রতিদিন ফোন করে একই প্রশ্ন করছেন, ‘বউমা এসেছে? না এলে আমরা গিয়ে বুঝিয়ে আনবো কি না…।’ সব মিলিয়ে তার মানসিক চাপ হুহু করে বাড়তে থাকে।
সেদিন রাত দশটা নাগাদ শিহাবের কোঁকানোর শব্দে পাশের রুম থেকে চলে আসে সাহারা।

সে শিহাবের কপাল স্পর্শ করে আঁতকে ওঠে। সাহারা থার্মোমিটারে জ্বর মেপে সময় নষ্ট না করে, দ্রুত একটি পলি কাগজ এনে শিহাবের মাথার নিচে গুঁজে দিয়ে, ছুটে গিয়ে বালতিতে করে পানি আনে। সাহারা মগ দিয়ে
শিহাবের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো, আর বলতে লাগলো, আরো মানুষের বউও রাগ করে চলে যায়। তাই বলে তার মান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনবে না! পুরুষমানুষ একটু বেহায়া না হলে সংসারে সৌন্দর্য থাকে না!
সাহারা শিহাবের মাথায় ক্রমাগত পানি ঢালছে আর স্বগোক্তি করেই যাচ্ছে। কতক্ষণ ধরে সে পানি ঢালছে, নিজেও জানে না! কিন্তু জ্বরের ঘোরে তা শিহাবের কানে ঢুকছে না। একসময় সে পানি ঢালা বন্ধ করে মাথা মুছতে গিয়ে দেখে শিহাবের পিঠ পর্যন্ত ভিজে গেছে। পিঠের নিচে বিছানা জবজব করছে।

সাহারা শিহাবকে তুলে সোজা করে তার গেঞ্জি খুলে ঘাড়-গলাসহ বুক-পিঠের পুরো অনাবৃত অংশ সব ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিলো। বিছানার ভেজা অংশে আরেকটা চাদর পুরু করে বিছিয়ে শিহাবকে ঠেলে ভেজা স্থান থেকে সরিয়েও দিলো। তার আগে শিহাবের গেঞ্জি পাল্টে নিজের ঘর থেকে জ্বর কমার দুটো ট্যাবলেট এনে খাইয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলো।
আর নিজে পাশের বেতের সোফায় বসে ঝিমোতে লাগলো। একসময় তারও ঘুম চলে আসে।
এর ভেতর শিহাব উঠে বসে হকচকিয়ে বললো, আরে সাহারা আপা, তুমি এখানে কেন?
: ও, তুমি উঠে বসতে পারছো? তোমার ভীষণ জ্বর উঠেছিলো। আমি তোমার মাথায় পানি দিয়েছি। জ্বরের ওষুধ দিয়েছি তাই তো জ্বর কমলো।
: তুমি জানলে কি করে যে আমার জ্বর? আমি তো তোমাকে ডাকিনি। অফিস থেকে এসেই অফিসের পোশাক না পাল্টে শুয়ে পড়েছি! তারপর কখন ঘুম চলে এলো টের পাইনি!
: তুমি কোঁকাচ্ছিলে, তাই শুনে ছুটে এসেছিলাম! আগে ভেবেছিলাম অফিস থেকে এসে তুমি একাই খাবার নিয়ে খেয়েছো। আজ হয়েছে কি, পাশের ফ্ল্যাটের ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এক ছেলে পুরনো খবরের কাগজের সাথে নতুন একখানা বিষাদসিন্ধু বিক্রি করে দিচ্ছিলো।

আমি তাকে বইটা বিক্রি করতে নিষেধ করতেই সে বললো, সময় খরচ করে মিথ্যে কাহিনী পড়বার সময় আমাদের নেই। আধুনিক বই রাখারই জায়গা নেই সেলফে। আর ঐতিহাসিক কোনো বিষয়ে এত খাঁদ থাকলে তা না পড়াই ভালো। আমরা তো আর লেখক নই, যে কে কি লিখলেন, চেখে দেখতে হবে। আপনাদের সময় ছিলো আপনারা পড়েছেন। কেঁদেছেন।
পারলে আরো কাঁদুন। আপনি নিয়ে যান এটা…।’ শেষে আমি কিনে আনতে চাইলে ওরা আমাকে বইটা এমনি দিলো। জোর করলেও টাকা নিলো না!
: বাহ্, বেশ খাতির করেছে তো তোমাকে!
: এটা আমি দ্বিতীয়বার পড়ছি, কিন্তু ওদের কথা শুনে এবার আর কান্না আসছে না। শুকনো চোখেই পড়তে পারছি। ও তুমি তো পড়োনি বুঝবে না ওর ভেতর কতটা কল্পনা-আবেগ-দরদ মেলানো।
: জানি!
: না পড়ে কী করে জানো?
: আমি পড়িনি তা যেমন করে তুমি জানো!
: শোনো দেখি কথা! আমার সামনে দিয়েই তো তোমরা বড় হলে। কখন কী দেখলে, পড়লে এসব নিয়ে তোমরা খাবার টেবিলে হৈচৈ তুলে সবাই আলাপ করতে। মামাও তখন তোমাদের মতো একজন হয়ে যেতেন। আমার এখনো সব মনে আছে। কিন্তু বিষাদসিন্ধু নিয়ে তোমরা কোনদিন কথা বলোনি!

: শোনো, আসল কাহিনী তো এমনি পড়ে জানতে হয়। তাই জানি। কিন্তু বিষাদসিন্ধুতে কল্পনার রং কতখানি, আরো কী আছে, তা আমার দাদা-দাদী এত বেশি বলতেন, তারা ওটাকে আরেকখানা ধর্মগ্রন্থই মনে করতেন। এমনও দেখেছি, দাদাভাই পড়ছেন দাদী শুনছেন। আবার অন্য সময়ে দাদী পড়ছেন, দাদা শুনছেন। আর তাদের পাশে একে একে যেই এসে দাঁড়াতো, সেও গালে হাত দিয়ে বসে পড়তো। তাই বাড়িতে যাওয়ার পর তাদের আশপাশে থেকে অন্য আরো অনেকের মতো শুনেই আমার পড়ার অধিক হয়ে গেছে! আর তা শুধু বিষাদসিন্ধুই নয়। তাঁর আমলের অনেক বই। আনোয়ারা, মনোয়ারা, আছিয়া। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ও দাদাভাইকে পড়তে শুনেছি। এখনো মনে পড়ে হাসি পায়, দাদাভাই জোরে জোরে বই পড়তেন।

: তোমার দাদাভাই ঢাকায় এলে তোমাদের স্কুলের পুরনো বইও বোঝা বেঁধে নিয়ে যেত বাড়িতে নিয়ে পড়তে। মনে আছে? এইটা নিয়ে আমরা কত হেসেছি!
: দাদাভাই বলতেন, ছোটবেলা তো আমিও ফাঁকি দিয়েছি সব না পড়ে। তাই তোমাদের বই পড়ে পুরনো বিদ্যা ঝালাই করি আর দেখি, তোমাদের সময় এসে তোমরা কী শিখছো! তোমাদের জন্য কী লেখা হয়েছে। আমার দাদাই কিন্তু আমাকে কবিতা আবৃত্তি করতে উৎসাহিত করেছেন। আর আমি তাকে পুথি পড়তে শিখিয়েছি! উল্টো না বিষয়টা?
: আসলে তোমাদের সবার ভেতরের এই বন্ধনটুকু আমার খুব ভালোলাগে! স্বপ্ন দেখতাম আমার পরিবারটিও আমি এভাবে গড়বো! তোমার দাদা-দাদীর, মা-বাবারও সম্পর্কের যে রসায়ন, তোমাদেরও তেমনটি হলে ভালো লাগতো। যাকগে, ভাসা ভাসা শোনা আর পড়ার ভেতর বিস্তর ফারাক। বুঝেছো! সিনেমা দেখতে গেলে যখন কাহিনিটা চেনা মনে হয়, আর যখন মনে পড়ে যায়, এটা ওই বইয়ের কাহিনি, তখনই কেবল বোঝা যায়, বইয়ের পটভূমির বিস্তৃতি থেকে পরিচালক খুব বেশি দৃশ্যমান করতে পারেননি। আর যে সিনেমার বই তুমি আগে পড়োনি, তাতে তুমি যেটুকু দেখবে, তার বেশি ভাবতে পারবে না! মানে মনে হবে না, কিছু বাদ গেলো।

শিহাব নিজের দিকে তাকিয়ে বললো, এমা, সাহারা আপা, তুমি আমার গেঞ্জিও পাল্টে দিয়েছ? আমি কিন্তু এখন লজ্জা পাচ্ছি।
: শুধু গেঞ্জি পাল্টেছি? গা-মাথা মোছাইনি? আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ওই জ্বর না নামালে কী হতো বলো তো! কিন্তু জ্বরটা বাঁধালে কী করে?
: আসলে প্রতিদিনের একটু একটু মানসিক চাপ এখন আমার মগজে প্রচ- ধাক্কা দিয়েছে। অফিসের কাজ-কর্মেও ভুল হয়ে যাচ্ছে। একসাথে ঘর করা দু’জন মানুষের যদি প্রতিটি বিষয় নিয়ে মতে অমিল থাকে, কতদিন তা হজম করা যায়! প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি। সব ঠিকমতো করতে না পারলে যখন তখন খালি হাতে বেরিয়ে আসতে হবে। নদীর বাবার তো নিজের ব্যবসা। এজন্য এসব বোঝে না। আমি বাড়ির বড় ছেলে। নিজের বিষয় দিয়ে মা-বাবাকে ভারাক্রান্ত যেমন করতে পারি না, দূরে থাকলেও পরিবারের প্রতি দায়িত্বও এড়াতে পারি না। আমার হেল্প তাদের লাগুক আর না লাগুক। এসব তো নদীকে বুঝতে হবে!
: তোমার অফিসে ওকে একটা চাকরি দাও!
: চাকরি দেবো মানে? ব্যাংক কি আমার নাকি? আব্বাই তো আমাদের ব্যাংকের জিএম ছিলেন তা তো জানোই। কিন্তু আমি কখনো তার পরিচয় কাজে লাগাই না! আব্বাও কাউকে কোনদিন সুপারিশ করতে পছন্দ করেন না!
: তুমি তোমার বাবার পরিচয় কাজে না লাগাও। তবু তুমি নিজে ম্যানেজার পদে যখন আছো…।
: ম্যানেজার পদটা খুব বড় নয় বুঝলে সাহারা আপা! তুমি বরং ওকে বলো চাকরির জন্য লেখাপড়া করতে আর সেই সাথে বাচ্চা নিতে!
যদিও তার দিকে আমি বহুদিন ফিরতে পারি না। তবু যদি সে আমার সাথে টিকে থাকতে চায়। আচ্ছা বলো তো, কতজন চাকরি ছেড়ে দিয়েও নিজের মতো কতো কিছু করে। ও তো তোমাকে নিয়ে একটা বুটিক হাউস করার কথা ভাবতে পারতো! নিজে পরিশ্রম করলে অন্যের শ্রমের মূল্য বোঝা যায়! ও আম্মার থেকেও কিছু নিতে পারেনি। তোমার থেকেও না!

শিহাবের নদীর দিকে না ফিরতে পারার কথায় সাহারা বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে দ্রুত বলল: আমার কথা বরদাস্ত করবে কেন? তোমরা যেভাবে আমাকে দেখো, ও আমাকে সেভাবে দেখে না! আমি যে রোজ ইস্ত্রি করা কাপড় পরি, এটা নিয়ে তার মা’র সাথে তাকে আমি আলোচনা করতে শুনেছি। সারাদিন যার সাথেই কথা বলে, তার অনেকটা সময়জুড়ে আমার কথাই থাকে। যা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। আসলে ব্যক্তিগত দুঃখ আমাকে দগ্ধ করলেও, নিজের মানুষদের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হলেও, তোমাদের উছিলায় অন্য মানুষের ভালবাসা-প্রশংসা আমি এত পেয়েছি, যে তোমাদের যে কারো জন্য এটুকু ছাড় আমি দিতেই পারি! তাই এখানে আসার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে ঢোক গিলি। এটা তোমাকে অন্তত কখনো বলতাম না তুমি কথা না তুললে।
: বলো কি? তোমার কথা বরদাস্ত করবে না মানে? আমরা তোমাকে মান্য করি! আমাদের পরিবারে যে কোনো সিদ্ধান্তে তোমাকেও কথা বলতে দেখেছি। আমাদের অমন বাঘের মতো রাগী বাবাও তো তার জন্য তখন তোমাকে থামিয়ে দেননি! মা’র জন্য বাবা কিছু আনলে মাকে দেখেছি সব সময় তোমাকে তার থেকে ভাগ দিয়েছেন। অচেনা মানুষের সাথে পরিচয় করাতে বাবা বলেন, আমার বোনের মেয়ে। আমরা ভাইবোনেরাও তোমাকে সেভাবেই জানি!
: হ্যাঁ কখনো তো আমাকে কিছু চাইতে হয়নি তাদের কাছে। আমার মেয়ের বিয়ের সময় দুই ভরি সোনার হার দিলেন মামা। ছেলেকে মোটর সাইকেল, বউকে কানের দুল কিনে দিলেন। শেষ বয়সে যেন আমাকে নিঃসম্বল থাকতে না হয়, তার জন্য মামীই প্রতিমাসে আমার নামে ব্যাংকে টাকা রাখেন। অথচ আমি বেতন নিলে তা আর ক’টাকা হতো! আর টাকার কথা আমার কখনো মনেই আসেনি! নিজেকে তোমাদের পরিবারের একজন ভাবতে পারি, এটার মূল্য অপরিসীম। এর বাইরে আমি কিছু না!
: তুমিও আমাদের সবার জন্য অনেক করেছ। মা তোমাকে দিয়ে কখনো ঘর মোছা, থালাবাসন ধোয়ার কাজ করাননি। অথচ তুমি এখানে একা সব করছ!
: এখন সময় পাল্টে গেছে। জীবন যখন যেমন। ছোট্ট একটা সংসারে আরেকটা কাউকে ঢোকালে আরো সমস্যা। তোমরা সবাই আমার আন্তরিকতাটুকু বোঝো বলেই বোধহয় দুই যুগের বেশি তোমাদের সাথে পার করে দিলাম! যাকগে, নদীকে কাল গিয়ে নিয়ে এসো!

: তুমি তো জানো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিসেব করে চলা আমার মা-বাবা আমাদের কীভাবে মানুষ করেছেন। এখন একজন জীবনের সাথে জড়িয়েছে বলে তার ইচ্ছে মতো আমাকে আমূল বদলে যেতে হবে, যে বদলে বিবেক ও মনুষ্যত্বের কোনো উৎকর্ষই নেই! তাহলে পরিবার থেকে এতদিন কী শিখলাম?

: কিছুটা তো বদলাতে হবে।
: সেটুকু আমি বদলেছি সাহারা আপা! তার মতামতের দাম দিতে গিয়েই আমার বেতনের অর্ধেক টাকা বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে। অথচ রামপুরা গলির ভেতর পুরনো আমলের বাড়ি হলেও আমাদের মতো মানুষেরা সবাই সেখানে থাকছে না, বলো?
: ঢাকার যেখানেই হোক, একটা বাড়ি থাকাই সৌভাগ্যের। আমার কাছে তো সেখানেই ভালো লাগতো। গুলশান গিয়ে তারাই উঁচুশ্রেণির হতে চায়, যাদের নিজের কোনো সমাজ নেই। সমাজের সাথে সংযুক্ত থাকার যোগসূত্র নেই। সত্যিই এখানেও আমার বড় একা লাগে। মানুষের সাথে না মিশলে অবচেতনে মানুষের চেতনা মরে আসে। একটা উঠোন দীর্ঘদিন না ঝাড়ু দিলে চারপাশ থেকে আগাছা যেমন তার পরিধি কমিয়ে আনে।
: দেখো, সেই তুমিও কিন্তু আমাদের জন্য এভাবে ত্যাগ স্বীকার করছো। নদী রান্নাবান্না করতে পছন্দ করে না বলে আম্মা তোমাকে আমাদের কাছে পরে পাঠালেন! তুমিও আসতে আপত্তি করোনি! কিন্তু আম্মার কথা ভাবো, এখন কী কষ্ট করছেন! কিন্তু ও আব্বা-আম্মাকেও সম্মান দিয়ে কথা বলে না।

নিজের দুর্ভাগ্যের কথা মনে হয়ে সাহারার মন খারাপ হতে থাকে। বিয়ের চার বছরের ভেতর দুটো ছেলে হওয়ার পর হঠাৎই তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে আনে। তারপর শ্বশুর-শাশুড়ির বারণ সত্ত্বেও তখনই সে ছেলেমেয়ে দুটি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। কিন্তু তার নিজের বাবা-মা না থাকায়, একসময় সে ছেলেমেয়ে দুটিকে আবার তাদের বাবার কাছে ফিরিয়ে দেয়। তারা সেখানেই বড় হয়, লেখাপড়া শেখে। বিয়ে করে এখন দুজনই যে যার মতো সংসার করছে। সাহারার ছোটবেলাতে তার মা-বাবা মারা গিয়েছিলো। দুটি বড় ভাই থাকলেও ভাই ও ভাইয়ের বউদের মুখ ঝামটা থেকে বাঁচতে কাঁচা বয়সেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা নিয়ে যখন শিহাবদের সংসারে এসে ওঠে, তখন শিহাবের বয়স ছয়-সাত হবে। শিহাবের বয়স এখন বত্রিশ। সাহারার বয়সও পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে দু’তিন বছর আগে।
পুরনো কাসুন্দির মতো নিজের অতীত স্মৃতি ঘাটতে ঘাটতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সাহারা বললো, এবার ঘুমাও। আবার শরীর খারাপ লাগলে ডেকো! বা ফোন করো। আমি জেগে থাকবো।
সাহারা শিহাবের রুমের বাতি নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে থেকে দরজা টেনে বন্ধ করতেই শিহাব ডেকে উঠলো, সাহারা আপা!
সাহারা আধো-আলোতে ফিরে এসে শিহাবের পাশে দাঁড়ালো। বললো, বলো?
শিহাব মুখ তুলে সাহারার দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু ওইটুকু আলোতে সে শিহাবের চোখের ভাষা বোঝে না! সাহারা বলে, কিছু খাবে? দুধ গরম করে আনি? এতক্ষণে সাহারার মনে পড়লো, শিহাব কিছু খায়নি। শিহাবের অসম্মতি সত্ত্বেও সে দুধ পাউরুটি এনে শিহাবকে জোর করে খাওয়ালো। ডিম লাইটের আলোতেই খেতে খেতে শিহাব বললো: তোমার মনে আছে, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। একবার আমি বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়ে স্কুল কামাই করেছিলাম এবং অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম বলে আব্বা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেননি। তারপর কি হয়েছিলো মনে আছে তোমার?
শিহাবের কথায় সাহারারও পুরনো দিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি আর খুব শীত ছিলো। তার ওপর মাঘমাস। বৃষ্টি বেগে আসতেই শিহাব বাড়ি ঢুকতে গেটে নক করেছিলো। আর মামা একটা বেত নিয়ে ছুটে গিয়ে শিহাবকে শাসিয়ে বাইরে রেখেই আবার গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অল্পক্ষণের ভেতর সাহারা মামার সতর্ক দৃষ্টি বাঁচিয়ে পিছনের দরজা খুলে চুপিচুপি গেটের বাইরে থেকে শিহাবকে ছোঁ দেয়ার মতো টেনে নিয়ে নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছিলো।

শীতের তীব্রতায় দু’জনের কারোই লেপের বাইরে থাকার উপায় ছিল না। তারপর ওরা দু’জন সারারাত ওই একজনের লেপের নিচে ছিলো।
এত বছর পর শিহাবের আচমকা তোলা প্রসঙ্গে সাহারাকে কি এক আচ্ছন্নতায় পেয়ে বসলো। তার সারা শরীরের ভেতর তিরতির করে একটা হারিয়ে যাওয়া নদী প্রবলভাবে জেগে ওঠে। সাহারা নিজের অজান্তে আবেশ জড়ানো কণ্ঠে শিহাবকে পাল্টা প্রশ্ন করলো-
: এখনো তোমার সবকিছু মনে আছে?
: সে সব ভোলা যায়? সেদিন তোমার একার বিছানার ভাগ নিয়ে আমি ঝড়জলে ভেজা শরীরে তোমার সমস্ত উষ্ণতা শুষে নিতে উদ্যত হলাম। কিন্তু তুমিও তো আমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলে। শাড়ি পাল্টে এলেও শরীরের ভেজাভাব তখনো ছিলো। আমার ঘর থেকে একটা জামা, একটা প্যান্ট তুমি খুব সাবধানে আব্বার নজর বাঁচিয়ে এনেছিলে। আব্বা তখনো বারান্দায় পায়চারি করে পাহারা দিচ্ছিলেন আমি যেন ঢুকতে না পারি! এখন ভেবে দেখো, একজন পিতার তার সন্তানের প্রতি কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা?

: সত্যিই ওটা মামার মারাত্মক নিষ্ঠুরতা ছিলো। আমি লুকিয়ে না নিয়ে এলে সে রাতে কি যে হতো! কোথাও যাওয়ারও তো তখন জায়গা ছিলো না!
: শীতে সমানভাবে আমরা সে রাতে একসাথে তোমার লেপের নিচে কাঁপছিলাম। কিন্তু আমি যখন তোমার বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিলাম, তুমি কিন্তু আমাকে নিবৃত্ত করোনি। বরং নিজেকে সমর্পণ করেছিলে!
: ক্ষুধার্ত বাঘিনীর কাছে হরিণ এলে বাঘিনী কি তাকে ফিরে যেতে দিতে পারে?
: তুমি বিশ্বাস করো, স্ত্রী’র বাইরেও বিয়ের আগে আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া আরো দু’জন নারী এসেছে। তারা অনেক শিক্ষিত। সুন্দরী। দু’জনের সাথেই ঠিক সেই ঝড়-জলের শীতের রাতের মতো তেমনি স্বেচ্ছায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু সেই রাতের মতো ভয়ঙ্কর মধুর প্রশান্তি আমাকে কেউ দিতে পারেনি এবং আমার কী হয় জানো?

বোঁজা কণ্ঠে সাহারা জানতে চায় : কী?
: অমন স্তন আর কারো নয়! … ওইসব মুহূর্তে নারীদের মুখে আমি তোমার মুখ কল্পনা করেছি! যদিও কোনোদিন তোমাকে তা বলা হয়নি!
: না বলে ভালো করেছো! তাহলে তো আর এখানে থাকা হতো না!
: কিন্তু তখন তো তুমি চলে যাওনি!
: তখন বিষয়টি অনারোপিত ছিলো। যেভাবে ঘটেছে আমার নিজেকে অসম্মানীত মনে হয়নি!
: সত্যি বলতে কি, নরের বিপরীতে নারীর যে সংজ্ঞা, তা আমি তোমার ভেতর সবটুকুই দেখি! পারবো না বলে তোমাকে কখনো কোনো কাজ থেকে পিছিয়ে আসতে দেখিনি। তুমি কিছুই করছো না এমন শূন্য প্রহর আমি তোমার কখনো দেখিনি!
: কারো দেখা শূন্য প্রহরও যে কারো কত যে পূর্ণ-ভরাট হতে পারে, জীবন আমাকে সে ঐশ্বর্য দিলো কই, যে শূন্যতার ভিন্ন মানে বুঝবো? আর তুমি যে সব কাজে ব্যস্ত দেখো, তার মূল্যই বা কতটুকু!

: সাহারা আপা, তুমি আর বিয়ে করলে না কেন?
: সেই কাঁচা বয়সে মনে হতো, যার কাছে সমস্ত লজ্জা-দ্বিধা বিসর্জন দিয়ে শরীরটাকে সমর্পণ করবো তার সাথে মিলনের সময় ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাসের শব্দ আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ শুনতে পারবে না। তার শরীরের স্পন্দন, গোপনীয়তার সমস্ত ভাষা আমি ছাড়া আর কেউই জানবে না! আর সেই পুরুষই যখন আমাকে অবজ্ঞা করে আরেকজনকে ঘরে এনে তার সাথেও যা করবে, আমার সাথেও ফিরে এসে তাই করবে। আর আমি আবার তাই তাকে করতে দেবো, এ যেন গ্লাসে তুলে বানের জল খাওয়া! শরীরটাকে আমার কাছে মন্দিরের মতো মনে হয়, জানো! যে তার নিজের মতো করে কোনো পরম পুরুষের জন্যই আপনা থেকে পোড়ে! মানুষের অতৃপ্তি কখনো তাকে ছেড়ে যায় না! না হলে আমিই বা কেন আজো তেমন কারো স্বপ্ন দেখি, সে আসবেই, শরীর এবং মন একসাথে যাকে চায়!
: আমাকেও কি তোমার রোগে পেয়ে বসলো?
: তোমার কথা বলতে পারবো না। তবে নারীর হৃদয় তার ভালবাসার পুরুষের জন্য চাতক হয়ে থাকে। চাতক যেমন বৃষ্টির জল ছাড়া আর কিছু খায় না!
: ক’জন নারীকে তুমি জানো!
: আমি না হয় আমার কথাই বললাম! জানো, রুমুর সাথে যখন শুটিংস্পটে যেতাম, একদিন এক সহশিল্পীর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে পরিচালক তাকে ফোনে খুব বকছিলেন। পথেই ছিলেন তিনি। জ্যামে আটকে ছিলেন। হঠাৎ তারপর আমার দিকে নজর পড়ে পরিচালক বললেন, ‘আপনাকে দিয়েও হবে ওই চরিত্রটা। আপনি পারবেন। না হয় সংলাপ-দৃশ্য সংক্ষিপ্ত করে ফেলবো।’ আমি লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। তিনি তখনই ক্যামেরার সামনে আমার টেস্ট নিলেন। সন্তুষ্টও হলেন। সবাই হাততালি দিলো। রুমু তো জড়িয়েই ধরলো আমাকে। বললো, ‘একবাড়িতে দু’জন অভিনেত্রী!’ কিন্তু ঠিক তোমার বয়সী মেকাপম্যান আমাকে মেকাপ করাতে গিয়ে ব্লাউজের গলা পেরিয়ে যেখানে দরকার নেই সেখানেও সে মেকাপের উছিলায় হাত ঢুকিয়ে দিলো এবং ওইটুকু স্পর্শ’র ভাষাই বলছিলো, বিষয়টা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মনটা এত খারাপ হলো, যে উদ্দীপনাটা নষ্ট হয়ে গেলো। দ্বিতীয়বার ক্যামেরা অন করার পরে আমার কাজটা উত্তীর্ণ হতে পারলো না।

রুমু শিহাবের পিঠাপিঠি ছোটবোন। সে একজন পেশাদার অভিনয় শিল্পী। সে নাটকে অভিনয় শুরু করলে সাহারাই তার সাথে যেত। নাহলে তাদের মা’র স্কুল বন্ধ থাকলে মা সাথে যেতেন।
সাহারার কথা শেষ হতে নিজের অজান্তে বিস্মিত চোখ তুলে শিহাব বললো,
: তাহলে রুমুর সাথেও ওই একইরকম আচরণ করে?
: আমি তা জানি না। আমার সাথে যা ঘটেছে, আমি তাও রুমুকে কখনো বলিনি!
: তুমি এত দেখেও কি আজো পুরনো ধারণায় বন্দি আছো?
: সেই পুরনো ধারণা নিয়ে না থাকলে তো এমন উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপন করতাম না। সাধারণ একটা বিয়ে করে ঘরকন্না শুরু করতাম। মানুষ যাকে বলে নিজের ঘর! জানো, কতবার ভেবেছি, আবার বিয়ে করবো। বিশেষ করে রাতগুলো বড় দুঃসহ ঠেকে। কিন্তু কেউ তো আমার জন্য এই বয়সে কুমার অবস্থায় নেই। সেই হয়ত কারো স্ত্রী মরে গেছে। না হয় ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ওরকম বিয়ে আসলে একঘরে বসবাস করেও কেউ কারো নয়!
: বিয়ে হয়নি তুমি সেরকম কাউকেই দেখতে!
: শুধু বিয়ে হয়নি সেরকম হলেও তাকে আমার জানতে হবে তো! সেটা সম্ভব যদি আমার সাথে তেমন কারো সাথে পরিচয় হতো। কিন্তু তেমনটি হয়নি তো! সবাই সবকিছু পারে না। যা আমিও পারিনি। তুমি ভেবে দেখো, আমি কিন্তু শুদ্ধর বাবার সাথে স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমি তখন এইটে পড়ি।
: হ্যাঁ জানি তো! গ্রামে গেলে কেউ কেউ বলতো, সাহারা আর তাহেরের প্রেম লাইলী-মজনুকেও হার মানিয়েছে! সেই প্রেম ভুলে তাহের ভাই আবার যাকে বিয়ে করলো, নারীটি সব নিয়ে খুব শিক্ষা দিয়ে গেছে। এরপর তাহের ভাই তোমাকে নিতে চায়নি কেন?
: নিতে না চাওয়ার মতো সেইটুকু ভয় তার আছে বলেই তাকে আমার লিখিতভাবে ছাড়া হয়নি!
সাহারার কথায় শিহাব উচ্চস্বরে হেসে বললো: তবে তুমি মা’র সাথে পাল্লা দিয়ে যতো বই পড়েছো, তুমি কিন্তু এখন আর এইটের ছাত্রীটি নেই সাহারা আপা! অতএব তাহের ভাইয়ের থেকেও তোমার যোগ্য কারো দরকার। না, বলছিলাম কি, যদি কখনো ফেরো, তাই বলা!
: কিছু যোগ্যতা তো তাহেরের আমার থেকে বেশিই ছিলো। আর তখন তো আমার কোনো যোগ্যতাই ছিলো না! পাড়ার ছেলেরা যখন নাটক করতো, বরাবর নায়কের চরিত্রটা তাহেরকেই করতে দেয়া হতো। আর সেটাই বুঝি আমার কাল হয়েছিলো। অনেক মেয়েরই তার দিকে নজর ছিলো। কিন্তু তার নজর ছিলো আমার দিকে। বিয়ের পর আমি লেখাপড়া না করলেও সে তো ডিগ্রি পাশ করেছিলো। জানো, দুইপক্ষের কেউই তখন আমাদের বিয়ে মানেনি। অনেক চড়াই উৎরাইয়ে ভেতর দিয়ে যখন থিতু হলাম। ছেলেমেয়ের মা হলাম, সবাই মানতেও বাধ্য হলো, শ্বশুরের টাকা এবং আমার ভাইয়েরাও আমার যেটুকু পাওনা ছিলো, বাবার সম্পত্তির, তারা তার ন্যায্য মূল্য দিয়েছিলো। ঠকায়নি। সব মিলিয়ে তাহের বাজারে একটা শাড়ির দোকান দিলো। কর্মচারিই চালাতো। চলছিলও ভালো। আর ঠিক তখনই আমাকে ঘর ছাড়তে হলো। বুক থেকে সন্তান ছাড়তে হলো।

: তুমি তোমার টাকাগুলো চেয়ে নিয়ে আসতে!
: তুমি ব্যাংকার মানুষ তো। টাকার হিসাব বোঝো। অভিমান-ক্ষোভ এগুলোর মূল্য বোধহয় বোঝো না! টাকা চাওয়ার মতো সময় ওখানে ক্ষেপণ করতে হলে তো মুড়ো ঝাটার মতো আরো ক’দিন তার সাথে বাহাস করতে হতো। অন্তত তাকে এটুকু তো দেখাতে পারলাম, আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে সব ছাড়তে পারি! যেখানে আমি বুক থেকে দুধের সন্তান ছেড়ে দিয়ে আসছি! যা হোক, তখন মামী তোমাদের নিয়ে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমার উ™£ান্ত অবস্থা দেখে এবং সব শুনে আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। তারপর সেবারই ঢাকায় নিয়ে এলেন। তখন আমার মন ভালো রাখার জন্য মামী কতো কি করতেন! যে গল্পটা পড়ে তার ভালো লাগতো, মামী সেটাই আমাকে পড়তে বলতেন। তারপর ধীরে ধীরে আমি তোমাদের একজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি শুধু।
: তাহের ভাইয়ের বিরুদ্ধে তুমি আইনি ব্যবস্থা নিলে না কেন তখন?
: তাতে কী হতো? তাহেরের তিনমাস জেল হতো। বিয়েটা তো বাতিল হতো না! আরো পোক্ত হতো। আর ছেলেমেয়েদের আমি ছেড়েছিলাম ওদের দাদা-দাদীর ভরসায়। তারা নিশ্চয় নিজের উত্তরসূরির যতœ করবেন ভেবে। কারণ তাহের তাদের একমাত্র সন্তান। তাই তারা তা করেছেনও! না হলে দু’জন লেখাপড়া শিখতে পারতো না। এত ভালো বিয়েও হতো না। আর আমি তাদের কোথায়ই বা রাখতাম, বলো তো?
: এটাও তোমার একটা বড় ত্যাগ। তুমি মাতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে যাওনি। তুমি এখন চাইলে সন্তানদের কাছে ফিরতে পারো না?
: যাদেরকে আমি নিজে ধরে রাখতে পারিনি, যাদের মানুষ করার পিছনে আমার কোনো ভূমিকা নেই, তাদের কাছে আশ্রয় চাই কোন মুখে! এমনিতে ওরা এলে তো দেখা হয়ই। তার ওপর তোমার মা যে আদর-যতœ করেন। এটা ওটা হাতে তুলে দেন। সেটুকুই আমার যথেষ্ট!
: কিন্তু তুমি তাদেরকে পেটে ধরেছো, তাদের কাছে সেই দাবি তোমার আছে!
: কোনো কোনো মানুষের তাদের আপনজনদের ভেতরে বেঁচে থাকার চেয়ে, তাদের দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকা মর্যাদার।

সাহারার এই কথার পরে শিহাব গম্ভীর হয়ে যায়। সে বলে: তাই বুঝি কাদম্বরী দেবী মরে গিয়ে তার ঠাকুরপো’র কাছে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন!
: তা ছাড়া আর কি! আর আমিও তো ছেলেমেয়ে পেটে ধরার জন্য ওদের বাবার সাথে ঘর পালাইনি! ঘর তো পালিয়েছিলাম নিজের তাড়নায়!
: চমৎকার কথা বলেছো। তবে একটা সাধ তোমার পুরোই মিটেছে!
: কী?
: ওই যে অনিশ্চিত কারো হাত ধরে ঘর পালানো! তবে ছেলেমেয়ের বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষই যা বোঝেন না, তুমি তা বুঝেছো!
: কী, বলো তো?
: সবাই জন্ম দেয়ার সুবাদেই সন্তানকে মনে করে নিজস্ব সম্পত্তি! তুমি তা মনে করোনি।
: যাই আমি। তুমি শুয়ে পড়ো বলে সাহারা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। শিহাব এক ঝটকায় খাট থেকে নেমে সাহারার পথ আটকায়। বলে সেই ঝড়-জলের রাতের মতো আজ আরেকটি বার আমাকে তোমার বুকে আশ্রয় দাও!
সাহারা শান্ত, নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললো: সেই ঝড়জলের রাতে তোমার সত্যিকার আশ্রয় দরকার ছিলো। কিন্তু আজ যদি তেমন কিছু হয়, সেটা হবে সুযোগ নেয়া এবং দু’জনেরই সুযোগ নেয়া হবে। আমি তো এই বয়সে এসে আমার নারীসত্তাকে লাঞ্ছিত করতে দিতে পারি না!
সাহারার এই কথায় শিহাব সমস্ত শরীর ঝাড়া দিয়ে একটু পিছিয়ে যায়। বলে ওঠে, ‘না! তুমি অত নীচ আমাকে ভেবো না! নদী তো এমনি কতবার এক দু’রাত করে তার বাবার বাড়ি গিয়ে থেকেছে। আমি কখনো তোমাকে বলেছি এসব কথা? আমার বিবেক কখনো সে সায় দেয়নি। আমি মানুষ হিসাবে তেমনটি হলে বোধহয় নদীর সাথে আমার সুখেই সংসার করা হতো!’
: তাহলে আজই বা আমাকে কেন বলছো?
: আসলে পরিস্থিতিই আজ তৈরি হয়েছে এই কথা বলার জন্য। আমার মনে হয়েছিলো আমি আমার পৌরুষ হারিয়েছি! নিজেকে আমি কিছুতেই নদীর দিকে ফেরাতে পারছিলাম না। কিন্তু আজ আমি শুধু তোমার স্পর্শে আবার জেগেছি! আমার বোধহয় আবার জ্বর আসছে…। আমি শুয়ে পড়ি। তুমি অন্তত আমার কাছে বসে থাকো!
: তা থাকতে পারি। আমি এখানে সোফায় বসি। তুমি শুয়ে থাকো!

সোবেহসাদিকের আলো ক্রমে প্রস্ফুটিত হতে হতে সাহারা শিহাব নিজেদের আবিষ্কার করে একজনের উন্মত্ত শরীরের নিচে আরেকজনের উন্মত্ত অবস্থান। শিহাব ভুলে যায় তার শরীরের নিচে কে পিষ্ট হচ্ছে। যেন নদী নয়, ইলোরা নয়, মুনমুন নয়, সে সেই বালকবেলার শুধু পুরনো এক স্বাদ খুঁজে আরো অতলে নামতে চাইছে আর শীৎকারে শীৎকারে আরো শিহরিত করছে ভাটার টানধরা সাহারার বুভুক্ষ শরীর। যা সে এ যাবত কখনো কারো সাথে কোনো মিলনে করেনি!
পুরুষ্ট বুকের দু’পাশের বোঁটা দু’টি গড়িয়ে ওষ্ঠসুধায় ভরে যায় সাহারার পুরো স্তন। সাহারা নিজেই টের পায়, তার শিথিল স্তন যুগলের টানটান হয়ে ওঠা ভাব। সেই স্কুলের শেষের ক্লাসে পড়া শিহাবকে সে অত বছর আগে সেদিন এতটা আঁকড়ে ধরেনি, যেভাবে ধরেছে আজ। কারণ তখন একটা ক্ষীণ ভয়ও কাঁটার মতো বিঁধছিল। যদি সে কনসিভ করে! তার ওপর ছিলো শিহাবের বালক বয়স। কিন্তু আজ সাহারা নির্ভয় এবং পুরুষ হিসাবে আজকের শিহাব চৌধুরী যে কোনো নারীর স্বপ্নের পুরুষ। সাহারা বোঝে, তখন দুই সন্তানের মা হলেও পূর্ণ তারুণ্য আসার আগেই সে স্বামীকে ছেড়ে এসেছে। অতএব যৌবনের এইরকম পরিপূর্ণ স্বাদ আগে তার কখনো পাওয়া হয়নি। এখন তার পিপাসা আগের চেয়ে আরো গাঢ় হয়েছে। তারও চেয়ে বড় কথা ফুরিয়ে যে সে যায়নি, এই ধারণা তাকে মানসিক প্রশান্তি যুক্ত করে দেয় দৈহিক আনন্দের সাথে। এতদিন ফল্গু হয়ে থাকা আনন্দধারা ভেতরে ঝর্নার মতো বইতে থাকে।
মেরুণ রঙের ভারী পর্দা ভেদ করে নদী ও শিহাবের শয়নরুমের ভেতরে কখনো আলো প্রবেশ করতে পারে না। বাইরে সূর্য উঠে গেলেও ঘরের ভেতর নিবিড় রাত। ডিমলাইটও নিভানো। জমাট অন্ধকারে দু’জন নর-নারী দু’জনকে যেন নতুন করে চিনছে। পর্দাঘেরা এই অনন্ত আঁধারই যেন দু’জন দু’জনকে চেনার মোক্ষম আয়না! দু’জনের ভেতরের দু’জন পরস্পরের ভীষণ অচেনা! এর আগে তারা কেউ কাউকে দেখেনি। চেনে না! তবে যেন তাদের জন্মই হয়েছিল এটুকু সময়ে জন্য একজন আরেকজনকে পরম তৃপ্তিতে ভরিয়ে জীবনের চরম অতৃপ্তিকে ঘুচিয়ে দিতে।

প্রথমবারের ঘোর কাটতে না কাটতে শিহাব দ্বিতীয়বারের জন্য যখন আবার সাহারার অবশিষ্ট আবরণ খুলে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিচ্ছিলো আর বলছিল, আমি পুরুষত্বহীন হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেকদিন থেকে আমি পারছিলাম না। নদী আমার বুকে যতবার হাত রেখেছে, আমি নিজের অজান্তে সরিয়ে দিয়েছি। আজ তোমার স্পর্শে আমি নিজেকে ফিরে পেলাম সাহারা…।
থ্যাঙ্কস্ গড! আমার এই জ্বরের দরকার ছিল, নাহলে তুমি আমার কাছে আসতে না। আমারও কোনোদিন তোমাকে বলার সাহস হতো না! এই যে যা ঘটছে তুমি কি রাগ করলে? সাহারা যেন গভীর খাদ থেকে ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল : জানি না!

শিহাব অবিরাম সাহারাকে বিদ্ধ করতে করতে বললো : তোমার খুব ক্ষতি করলাম…!
সাহারা এবার উত্তর দিলো : করলেই তো!
যদিও বাইরে সেই বৃষ্টি নেই। তবু সেই তেমনি শীতকাল। কিন্তু শিহাবের কপাল চুঁইয়েপড়া দরদরে ঘামে সাহারার মুখ-কণ্ঠ-বুক ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে। এমনিতে শিহাবের জ্বরের তাপে তারও শরীর পুড়ছে। তবু সে তাপ ও ঘামের গন্ধ তাকে মাতাল করে তুলছে। তার শরীর বুভুক্ষু বাঘিনীর মতো শিহাবকে আঁকড়ে রেখেছে। নারীর এমনি সমর্পণ বুঝি পুরুষকে আরো পুরুষ করে তোলে। এমন দোলাচলের ভেতরও শিহাবের একবার মনে পড়ে গেলো, নদী কখনো তার কাছে নিজেকে এভাবে সঁপে দেয়নি! এভাবে আঁকড়ে ধরেনি! তার স্পর্শে এমনি কামনায় উন্মত্ত হতে পারেনি! তপ্ত মাটি যেভাবে বৃষ্টির ফোটায় গলে যায়, নদী গলেনি তার ভালবাসায়। সব সময় একটা ভয় শিহাবের ভেতর জেগে থাকে, এই বুঝি তার দিকে তাচ্ছিল্য বা কটাক্ষের দৃষ্টিতে তাকাবে নদী। নিজেকে তার কাছে সতর্ক রাখতে রাখতে প্রতিরাতে বিছানা তার কাছে কণ্টক শয্যা মনে হচ্ছিলো। রাত মানেই তার নিজের ভেতরে নিজের গুটিয়ে থাকা!
শিহাব সাহারাকে জাপটে ধরে রেখে বললো, জ্বর থাকাতে আমার সময় বেশি লাগলো, তোমাকে বোধ হয় আমি কষ্টই দিলাম দ্বিতীয়বার!

সাহারা কিছুই বলে না। সে মনে মনে ভাবে, সমস্ত জীবনই তো মনে হয়েছে, কখনো না কখনো এমনি কেউ আমার জীবনে আসবে! যে আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। মনে হয় আমি সেই তার জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে নির্মাণ করে চলেছি। কিন্তু আমার সব প্রার্থনা অবশেষে ক্ষণিকের অতিথি তোমার কাছে এসে ঠেকলো! যার সাথে জীবন শুরু করেছিলাম, যখন বুঝলাম, শারিরীক সৌন্দর্যের সাথে ভালবাসা তার কাছে ফিকে হওয়ার বিষয়। নাহলে সে রূপবতী একজনের হাতছানি পেয়ে আমাকে গৌণ করে দিলো কী করে! নাকি সে ভেবেছিলো, ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে বলে আমি ওই নিগৃহীত অবস্থায়ই শুধু তার ছেলেমেয়ের মা হয়ে পড়ে থাকবো! মাত্র কটা বছরে ঘর যখন খোঁয়াড় হয়ে উঠলো, আমি পথে নয়, একেবারে প্রান্তরে নেমে এলাম। এর পর থেকে মানুষ সম্পর্কে আমি আরো সতর্ক হয়েছি। আর তোমাদের ভেতর ঠাঁই পেয়েই বুঝেছি, যে মানুষ আমি কল্পনা করি, সেই মানুষ এই ধূলির ধরাতেই আছে। তবে এক প্রজন্মের শিক্ষায় এটা হয় না!

সাহারা অনেকক্ষণ কথা বলছে না। সারাজীবন সাহারাকে শিহাবরা ক’ভাইবোন একজন অভিভাবক হিসাবে দেখে আসছে। কিন্তু এই এখন একেবারে বাহুলগ্ন অবস্থায় তার মগ্নতা এবং শরীরের বাক্সময় সঞ্চালন শিহাবকে প্রচ- আবিষ্ট করে। সে বলে তোমাকে যে বুঝবে, তার একজনমে তোমাকে ভালবেসে সাধ মিটবে না!
: তেমন কিছু যদি থেকেই থাকে আমার, সেটা সেই সমস্ত কিছু না পাওয়ারই লাবণ্য!
: কী চমৎকার কথা তুমি বলতে পারো। তবু তোমাকে আমি বেঁধে রাখতে পারি না!
: জানো, আমার এই এখন তোমার এই কথার পরে মনে হচ্ছে, তুমি আমার থেকে কত বছরের ছোট সেটা কোনো বিষয় নয়। বিষয়, তুমি একজন পুরুষ আর আমি একজন নারী।
পৃথিবীতে আমরা দু’জন দুই সময়ে এসেছি এই যা! দু’জন মানুষের শারিরীক সম্পর্ক হতে বয়স কোনো বাঁধা নয়। তবে সামাজিক সম্পর্ক হতে গেলে, যা আমাদের চিরাচরিত নিয়ম, সেই চক্রই মানতে হয়।

আমরা বাবাকে বয়স-শিক্ষা-দীক্ষায় বড় দেখি, মাকে ছোট। বাবা ধমক দেবেন আর মা ঘোমটাটা আরেকটু টেনে ঘরে ঢুকবেন। আমাদের চোখ যা দেখে অভ্যস্ত আমাদের জীবনে তেমন আচরণ ও সম্পর্ক’র প্রতিষ্ঠা আমরা চাই!
: সব থেকে ভাল হয় সমাজ ছেড়ে যারা নিজের মতো বসবাস করে। তাই বলে তারা অন্যের খারাপ হয় এমন কিছু কিন্তু করে না! এমন কি তারা একটা মিথ্যে কথাও বলে না। তাদেরকে যারা অপছন্দ করে, তারাও তাদেরকে নিঃশব্দে এড়িয়ে চলে!
: আহা, আমি অমন কাউকে পেলে এই সমাজ ছেড়ে চলে যেতাম!
: কেন, সমাজ তোমাকে আর টানছে না বুঝি!
: সমাজের থেকে যা পাওয়ার, তা আমি পেয়ে গেছি। যা পাইনি, তার জন্য সমাজের বাইরে যেতে চাই! ওই যে যারা একতারা বাজিয়ে গান করে আমার ওইরকম বোষ্টমী হওয়ার কতবার সাধ হয়েছে। কিন্তু দেখলাম বোষ্টমী হতে গেলে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন অনিবার্য!

এলোমেলো শাড়িখানা শিহাবের পিঠের নিচ থেকে টেনে নিয়ে সাহারা যখন দৌড়ে সরে যাওয়ার কথা ভাবছিল, শিহাব তার হাত টেনে ধরে বললো, এই আগুন তুমি চেপে রাখো কীভাবে?
সাহারা বললো, বারুদও তো পুষে রাখে দাউ দাউ আগুনকে!
: আজ আমার বড় উপকার করলে সাহারা আপা!
সাহারা শিহাবের শক্ত করে ধরে থাকা হাতের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করেই বলে, কি উপকার করলাম?
: ভেবেছিলাম, নারীরা পঞ্চাশের আগেই ফুরিয়ে যায়। কারণ পুরুষমাত্রেই তাই বলে বেড়ায়। কিন্তু বিষয়টা এত সংবেদনশীল, এটা নিয়ে তো কোনো নারী চ্যালেঞ্জ করতে আসে না। তাই পুরুষের বলার অধিকারটি দিনে দিনে ব্যাপ্তই হয়েছে! আর চল্লিশ না পেরোতেই নারীরা কোণঠাসা হয়েছে। এখনো যে এই অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে, তা কিন্তু নয়! কিন্তু আজ আমার ধারণা ভেঙে গেলো!
: শোনো দুইরকমের বিষয় আছে। এটা তো চর্চার বিষয়। দু’জন মানুষের সম্পর্কের ভেতর যদি ভক্তি ও আবেগ থাকে, তাদের যৌবন কখনো শেষ হয় না! শেষ তখনই হয়, অভক্তি ঢুকে গেলে। অতএব আমার মনে হয়, জীবনে এটাই জরুরি, সবাই যেন নিজেদের সম্পর্কটা যে কোনো মূল্যে ভালো রাখে।
: নিজেকে দিয়ে আমি তা বুঝতে পারছি!
: আর বউ মরে গেলে কাজের দোহাই দিয়ে পুরুষরা ঘরের কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। অথবা হতদরিদ্র পরিবারে টাকাপয়সা টোপ দিয়ে একটা কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করে আনে। মানে একটা কম বয়সী মেয়ের টাইট শরীর তাদের চাই। কিন্তু নারীরা তো কম বয়সী ড্রাইভার-বাবুর্চি বিয়ে করবে না। গোপনে ভোগও করবে না। যদি কেউ সেটা করে তা ব্যতিক্রম। কিন্তু গড়পরতা নারীর সেটা স্বভাববিরুদ্ধ। তা কেবল একচেটিয়া পুরুষরা করে। আর বুড়োদের মুরোদও বয়স্ক নারীদের জানা আছে। কারণ ততদিনে তারা চোখের চামড়া খুলে সব বুঝতে শিখেছে।

: কীভাবে শিখেছে?
: আচ্ছা, একটা সহজ উদাহরণ দেখাই। একটা মেয়েকে পাঁচজন-দশজন পুরুষ ভাড়া করে এরকম খবর তো প্রায় দেখো, শোনো। নাকি?
: হ্যাঁ!
: কিন্তু কখনো শুনেছো, দু’জন মেয়ে একটা ছেলেকে নিয়ে ডেটিং করছে?
: না তো!
: তবে আবার ব্লু-ফিল্মে দেখা গ্রুপ সেক্সের আজগুবি উদাহরণ টানতে যেও না! মনে রেখো, মেয়েদের সিক্সথ সেন্স বড় প্রখর। সবকিছু নিজের জীবনে না ঘটলেও অন্যের অবস্থা দেখে টের পায়। তাই ভাত-কাপড়, আশ্রয়ের অভাব না হলে কোনো নারী ‘নারী প্রগতি’র জোয়ারে ভাসা এই সময়ে এসে কোনো বুড়োকে অন্তত বিয়ে করবে না। বুড়োদের বিয়ে করবে নিঃসম্বল যুবতীরা, যারা বুড়োদের মরার পর একটা কিছু পাবে।
: ‘নারী প্রগতি’ যদি বোঝোই, তুমিও তো আমাদের চার দেয়ালে এসে আটকেই থাকলে!
: দেয়াল স্বাধীনতা হরণ করে না। বরং সব সুশৃঙ্খল কাজের জন্য পোক্ত দেয়ালেরই দরকার। তোমাদেরকে আপনজন হিসাবে পেয়েছি। স্বাধীনতাও পেয়েছি। কত কাজ শিখেছি। কথা শিখেছি। জীবনের কত কত স্তর দেখা হলো। অন্তত নিজের দহনের ভাষাটা তো বুঝতে শিখেছি! এখানে না এলে সে ভাষাই তো জানা হতো না! মামী আমাকে রান্নার স্কুলে ভর্তি করে রান্না শিখিয়েছেন। দর্জিবিদ্যা শিখিয়েছেন। একটা সময় থেকে আমি তোমাদের ছেড়ে নিজের মতো কিছু করতেই পারতাম, কিন্তু অসময়ে এসে অত সংগ্রামী হতে আমার ভালো লাগলো না। তার চেয়ে তোমাদের যার জন্য যখনই কিছু করি, তোমরা তাতেই মুগ্ধ হও, সেই মুগ্ধতাও আমাকে একধরনের প্রশান্তি দেয়।
: এই যে তুমি এত কথা বললে, এর ভেতর বস্তুগত কোনো কথা নেই। নেই আরোপিত কোনো বিষয়। সারাজীবন মুখোমুখি বসে একটা মানুষের সাথে কাটিয়ে দেয়া যায় এই মুগ্ধতাকে ভর করে!
: তাও তো করছে মানুষ। হয়ত তার সংখ্যাটা কম। ওই যে তুমি তোমার দাদা-দাদীকে দেখেছ, একজন বই পড়ে আরেকজন শোনে। তাদের জীবনেও প্রাচুর্য ছিল না। তাদের মরচে ধরা একখানা মাত্র টিনের ঘর ছিলো। সে ঘর আমিও দেখেছি। কিন্ত পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে তাদের জীবন তো কেটে গেছে। উত্তরসূরি হিসাবে সেই রেশই তো বয়ে চলেছো। তাই তো নদীর সাথে তোমার বনছে না। অথচ নদীদের সংখ্যাই সব সময় বেশি। শুধু অবস্থার রকমফের এই যা।
: আমিও তাই ভাবি, এদের স্বামীরা কী করে এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলে!
: চলে আর কই! যাদের মনোবৃত্তি স্ত্রী’র মতো একই রকম, যাদের আদর্শ হিসাবে কেউ সামনে নেই তারাই সংসার বাঁচানোর নামে সহজে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যায়! তুমি পরোয়া করছো না বলেই সাড়াশব্দ উঠছে। মেনে নিলেই স্রোতে গা ভাসানো হতো!
: আর পারে না যারা?
: যারা পারে না তাদের ভেতর দূরত্ব নেমে আসে। স্ত্রী’র প্রতি আকর্ষণ হারায়। আর ওই জায়গাটা দখল করে অন্য কেউ। আর অন্য কেউও যদি শুধু প্রেমিকা হয়ে না থাকে, তারও প্রেম বা সঙ্গদানের বিনিময় প্রত্যাশা দীর্ঘ হয়, তখন পুরুষ আবার আরেক অন্যজনকে খোঁজে! এই খোঁজাটা আসলে বিনিপয়সার প্রেমের জন্য নয়, তাকে নিখাঁদ প্রেম খোঁজার নেশায় পেয়ে বসে।
: তুমি সত্যি জানো?
: আচ্ছা, তুমি কখনো প্রেম করোনি?
: করেছি, তবে গভীর প্রেম করিনি! আমার মনে হয় প্রেম কেউ করে না হয়ে যায়! আমার হয়নি! কারণ আমাকে কেউ দীর্ঘদিন পছন্দ করেনি। তাদের সন্দেহ ছিলো, শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা টিকবে কি না! একসময় আমাকে দিয়ে শুরু করে দেখা গেছে পরে আমি যাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি তাদের সাথে আমার চেয়ে বেশি ভাব!
: প্রেম ছাড়া জীবন চলে না। ভাত-কাপড়-বাসস্থানের প্রয়োজন মিটলেই, অই অপ্রয়োজনীয় বিষয়টা ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তোমাদেরকে আমিও তো স্কুলে, কোচিংয়ে নিয়ে গেছি। মানুষের আড্ডার কত রকম বিষয়বস্তু শুনেছি। দেখেছি।
: মেয়েদের তুমি কী জানো?
: একসময় রুমুর সাথে সাংস্কৃতিক পরিম-লে ঘুরে, কোনো কোনোদিন, সারাদিন নানান রকম মানুষের ভিড়ে মিলে থেকে কতকিছু যে বুঝতে পারতাম! তখন ভাবতাম, বিধাতা, এতকিছু উপলব্ধি করার সুযোগ দেবে বলেই কি আপনজন ছাড়া করে আমাকে পরের ভেতর এনে ফেললেন! এত অভিজ্ঞতা আমি কোন কাজে লাগাবো!
: তুমি এত কিছু আত্মস্থ করে ফেলেছো, অথচ কত উচ্চশিক্ষিত মানুষও সারাজীবন কতকিছু দেখেও তার কোনোকিছু বোঝে না!
: আমি আরো কি বুঝেছি, জানো?
: বলো!
: এই যে পুরুষগুলো স্ত্রীবিমুখ হয়ে অন্যত্র বিকল্প সুখ খুঁজে বেড়ায়। অধিকাংশ স্ত্রী’দের হাতেই অর্থের প্রাচুর্য থাকে। কারণ পুরুষরা অন্যের সাথে যা-ই করুক, কিন্ত বৈধ অবৈধ যা-ই কামাই করুক, তা বউয়ের হাতেই সব তুলে দেয়। আর বউরা তা দিয়ে নিজেদের ঘষামাজা করে এবং অনেকেই তরুণদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর এর পরিণতি কী হয় জানো?
: কী?
: একজন পুরুষকে একটি মেয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়তে হলে তাকে জায়গা খুঁজতে হয়। বিষয়টা তার জন্য সত্যি কঠিনই। কিন্তু একজন নারীর যদি কারো সাথে সম্পর্ক হয়, তার কিন্তু জায়গা খুঁজতে হয় না! আর একটা বয়সে এসে স্বাধীনতারও অভাব হয় না! তার লজ্জা ভয়, নিরাপত্তার অভাববোধ সব কেটে যায়। নারী কোনোভাবে ধরা পড়ে গেলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সব যুক্তি-অজুহাত সে খাপের খাপ মিলিয়ে দেখাতে পারে!
: আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছো কিন্তু!
: যে সব পুরুষ যা খুশি করে বেড়ায়, আর মনে করে তার ফুরিয়ে যাওয়া নারীটি এমনিই থাকে! আসল কথা কি জানো, ঠিক তোমার আর নদীর বেলায় যা ঘটেছে, কমবেশি এই তো পরিবারগুলোর ভেতরের চিত্র। এইরকম খেয়োখেয়ি করতে করতে পরস্পরের থেকে পরস্পরের রুচি উঠে যায়। কিন্তু সেই তৃষ্ণা অন্য কাউকে দেখলে আবার উসকে ওঠে! তার প্রমাণ তো তুমিই!

শিহাব চুপ হয়ে অবসন্ন শরীরে পড়ে থাকে। তার মন খারাপ হয়েছে ভেবে সাহারা তার মাথার চুলে বিলি কেটে দেয়। তারপর ঠোঁটের পরে ঠোঁট রাখে। ধীরে ধীরে বলে এত কথা বলা আমার ঠিক হয়নি!
: মিথ্যে তো কিছু বলোনি! আর তোমার কথা বলবার জায়গাই বা কই!
: সেক্সডল দেখেছো?
: কেন বলো তো?
: এত নিপুণ ও পারঙ্গম করে তা বানানো হয়, তবু একজন নারী বা পুরুষ তার বিপরীত লিঙ্গের কারো কাছেই উজাড় হতে চায়। তার ঘনিয়ে ওঠা শিহরণটুকু আরেকজনকে আন্দোলিত করছে, ‘চরম সুখ’এর পরেও যেন অতিয়েন্দ্রীয় আরেকটি সুখের পর্ব সেটা!
সাহারার কথা শেষ না হতেই শিহাব আরেকবার সাহারার শরীরটাকে টেনে নিজের দিকে আনতে চায়। সাহারা ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি অসুস্থ। তাহলে এবার আমি…।
শিহাব কাত হয়ে শুয়েছিল। সাহারার কথায় সে চিৎ হয়ে টানটান হলো। সাহারা তার ওপরে বসলো এবং এই তৃতীয়বার দীর্ঘক্ষণ তারা আসন পাল্টাপাল্টি করে একেবারে শিহাবের অফিসে যাওয়ার টায়টায় সময় পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে খেলাটা চালিয়েছিল।
বাথরুম থেকে বেরিয়েই সাহারার সেই মুহূর্তে একটি রবীন্দ্রসংগীতের কথা মনে পড়ে ঝড়ের মতো তার মন এলোমেলো করে দিলো। সে দ্রুত হাতে মোবাইলে সার্চ দিয়ে গানটি খুঁজে বের করলো। জীবনে এই প্রথম যেন তার নিজের জন্য একটু বিলাসিতা। গান বাজছে, ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।/ আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে ॥/ আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমনির হারে,/ বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে…॥’
অফিসের যাওয়ার সময় আসন্ন। শিহাব দ্রুত নাস্তা সেরে আরো দ্রুত চুমুকে চা খেতে খেতে বললো, ‘দেখো, রবীন্দ্রনাথ কারো কথা বাদ রেখে যাননি লিখতে! তুমিও তার মনে ছিলে।’ সাহারা এবার দৃষ্টি গাঢ় করে আড়চোখে শিহাবের দিকে তাকালো। কিন্তু সে দৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থির করে রাখলো না! মনে মনে মৃদু ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, তোমার এত এত যোগ্যতা থাকার পরেও রবীন্দ্রনাথের হাজার হাজার গানের থেকে একটাও তোমার নিজের বলে মনে হবে না। আর সে অপ্রাপ্তিটাও তোমার কম নয় শিহাব চৌধুরী!

সাহারার চেহারাতে তারুণ্যের আলগা লাবণ্য না থাকলেও দহনের একটা ছাপ সুস্পষ্ট। তাই যেন তাকে অলঙ্কারের আভা দিয়ে রেখেছে। শরীরের বাঁকগুলো বয়সের দাপটে মিলিয়ে না গিয়ে স্বাভাবিকভাবে তা স্পষ্ট হয়ে আছে। কারণ চিকন গড়ন শরীর তার। যা আধুনিক নারীদের কাক্সিক্ষত। সাজ-সজ্জার ভেতর অতি সচেতনা নেই। তবে সচেতনভাবেই সে পরিপাটি থাকে। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী নারীদের সাথে নদীর চেয়ে সাহারার খাতিরটা জম্পেশ। সেলাই-ফোঁড়াই থেকে শুরু করে অনেকে রান্নার বিষয়েও সাহারার থেকে শিখে যায়। কারো ভারী কেনাকাটা থাকলেও সাহারাকে তারা সাথে পেলে বর্তে যায়।

বহুদিন সাহারা ভালো কিছু রান্না, বা পিঠা বানানোর সময়ে নদীকে ডেকেছে, দেখে শিখে রাখতে। বলেছে, আমাকে তো কখনো যেতে হবে। তখন যেন করতে পারো। আর যে কোনো শেখা কাজ কখনো কঠিন মনে হয় না।
নদীর প্রতি সাহারার এইরকম কত আগ্রহ নদী নীরব অবহেলায় দমিয়ে দিয়েছে। কখনো তার কোনো ডাক শুনতে পেলেও সাড়া দেয়নি। সাহারাকে ওর কাছে গিয়ে বলে আসতে হয়েছে। সাহারা পারতো নদীর কাছে না গিয়ে থাকতে। সে এখতিয়ার সে ওই পুরো পরিবারের ভেতরে দিনে দিনে অর্জন করেছে। কিন্তু সে সব সময় চেয়েছে কারো সম্পর্কের ভেতর কোনো কলহের সেতু না হয়ে উঠতে। কিন্তু আজ যা ঘটেছে, তাতে তার মনে হয়েছে নদীকে নিঃস্ব করে সে জয়ী হয়ে গেছে। যেন সাপ থেকে মণিটা সে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আর যে প্রাণ সে রেখে যাচ্ছে, তাতে সাহারাই ঢেউ হয়ে দু’কূল উপচে পড়বে। চিরদিনের জন্য নদী সাহারাতে বিলীন হয়ে গেলো। যদিও এমন জয়ের আকাক্সক্ষা সে কখনো করেনি! শিহাবের মনের কোথাও নদীর জায়গা নেই এই খবর সাহারাকে আজ ব্যথিত করেনি। সে ভেবেছে এটাই হওয়ার কথা! কিন্তু তাই বলে কি নিজের জন্য সে এখান থেকে সুখের বীজ হৃদয়ে বপন করে নিয়ে যেতে পারছে!
সকাল বেলা শিহাবের সাথে একসাথে বিছানা ছাড়তে ছাড়তে সেই তখন থেকে নিজের ভেতর টের পাচ্ছে চন্দনকাঠে সাজানো চিতা। যাতে আগুন লেগে গেছে। যার সুবাস ম ম করলেও পুড়ে যাচ্ছে তার মনভূমি!
দিনভর সে ওই একই গান বারবার টেনে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে শুনতে শুনতে ঘরের রান্নাসহ কাজগুলো গুছিয়ে ফেললো। সে চলে যেতো আগেই।
কিন্তু গতরাতে শিহাবের মাথায় পানি ঢালতে ভিজিয়ে ফেলা সমস্ত বিছানা তুলে সে ছাদে শুকাতে দিয়েছে। ভেজা তোষকের এপিঠ-ওপিঠ শুকাতে হয়েছে তাকে। এর ভেতর কিছু লেখার জন্য কলম ও রাইটিং প্যাড এনে টেবিলে রাখলো।
এক সময় কিছুদূর লেখার পর কী মনে করে পাতাটা ছিঁড়ে সে পুড়িয়ে ফেললো। তারপর মোবাইলেই লিখতে শুরু করলো। মোবাইলে লিখতে তার বেশি সময় লাগে না। কিন্তু লেখার পর সব কেমন অপ্রয়োজনীয়, হাবড়া জাবড়া ঠেকে। প্রাণোৎসারিত হয়ে বেরিয়ে আসা তার সে কথাগুলো তার কাছে দামি মনে হলেও সে বোঝে, এগুলো পৃথিবীর আর কারো জানার জন্য জরুরি নয়! তাই ডিলিট করে করে বাক্যগুলো আবার সমন্বয় করতে তার অনেকটা সময় লেগে গেলো।
সাহারা বাসা থেকে বেরিয়ে যখন গেলো, তখন ভরা সন্ধ্যা। তাতে অবশ্য তার কোনো অসুবিধা নেই। রাতের যে কোনো একটা বাসে উঠলেই হবে। সে ভেবে রেখেছে, যতো রাতই হোক, সে তাহেরকে বলবে তাকে বাসস্ট্যা- থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বাস ফেনীর কাছাকাছি গেলেই তবে এতবছর পর তাকে ফোনটা করবে। নাম্বারটা সে কিছুক্ষণ আগে জোগাড় করেছে। ছেলেমেয়েকেও বলেনি, যে আমি একেবারে ফিরে আসছি!

ভাইদেরও বলবে না। সেদিন তারা তার মনের অবস্থা বুঝে সম্মানের সাথে তাকে আশ্রয় দেয়নি। বোঝেনি, ভুল তো ভুলই। তারা দেখেশুনে বিয়ে দিলে সেখানেও কি এমনটা হতে পারতো না! দু’ভাই মিলে তাকে একটু আগলে রাখলে এই বেদনাকে বরণ করে নিতে তাকে এতদূর আসতে হতো না। সাহারা হঠাৎই টের পেলো তার বুকে জগদ্দল পাথর চাপানো। যে ভার নিয়ে সে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে টলতে টলতে অন্যের সংসারে এসেছিলো, সে ভারও তো এতভার ছিলো না! তারপর দিনে দিনে সে কুয়াশার মতো সব কাটিয়ে উঠেছিলো। জীবনটাকে সে টবের লতার মতো চর্চা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মাত্র একটা রাত বালির বাঁধের মতো স-ব গুঁড়িয়ে দিলো! কিন্তু এখানে থাকা তো যাবে না আর!
এই আলগোছে সরে যাওয়ার ইচ্ছেয় এত বছর পরে পথে নেমে, গন্তব্য একটাই অনিবার্য করে রাখে সে। তাহেরের নাম্বারটা আবারো বের করে দেখলো। নাস্তা খাওয়ার পর সাহারা আবার মনে করে শিহাবকে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলো। পকেটে পুরেও দিয়েছিল আরো দুটো এবং সাবধান করে দিয়েছিলো, পরবর্তী ছয় ঘণ্টার আগে যেন এ ওষুধ আর না খায়। বলেছিলো, বেশি করে পানি খেও!
তখন অফিসে যেতে ব্যস্তসমস্ত শিহাবের কথা বলার সময় ছিলো না। সে বরাবরের মতো সাহারার কথা শুনছিলো আর মাথা নাড়ছিলো। অফিসে গিয়ে সাতদিন পর আজই প্রথম তার মনে হলো, নদীকে একটা ফোন দিই। বাসায় চলে আসতে বলি। বললেই আসবে না জানি। তবু ফোনটা তো করি।

প্রতিদিন সন্ধ্যা পার করেই শিহাব বাসায় আসে। আজো আগের মতো সময়ে সে বাসায় ফিরলো। কলিংবেল টিপে কিছুক্ষণ দরজার এপাশে অপেক্ষা করলো। ভেতর থেকে দরজা খোলার আভাস না পেয়ে তার কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো টেবিলে তার খাবার সাজানো। এমনটি কখনো তো থাকে না। সে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত কখনো খাবার বাড়া হয় না। তবু সে ভেবেছিলো, সাহারা বাথরুমে আছে। অথবা কোথাও গেছে। সে-ই তো কেনাকাটাও সব করে।

শিহাব ফুরফুরে মেজাজে অফিসের পোশাক পাল্টে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলো। অনেকদিন তার নিজের এমন মেজাজের কথা সে ভুলে গিয়েছিলো। গতরাতে, মানে আজ ভোর পর্যন্ত যা তার জীবনে ঘটলো, বাস্তবিকই সাহারা তার অস্তিত্ব ও বোধের ডালপালা নাড়িয়ে দিয়েছে। খবরের কাগজ তাকে টানছে না। টিভিও না। বরং গতরাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত যা ঘটেছে, তারই পুনরাবৃত্তি চলছে তার ভেতরে। সে ভাবছে, সাহারা আপার ভেতর আসলে যৌবন যা আছে, তার থেকে তৃষ্ণাই তাকে এমন ক্রেজি করে রেখেছে। বাস্তব জীবন শিখিয়েছে পরিশীলিত হতে। সবকিছু না চাইতেই পেলে মানুষের যে পরিমিতিবোধ আসে না। প্রেমেন্দ্র মিত্র’র দুখানা চরণ শিহাবের মনে পড়ে যায়, ‘মেটার যা নয়, সেই তৃষ্ণাই প্রাণের গহন উৎস চেনায়।’ আজ অফিসেও তার মেজাজ ভালো ছিলো বুঝতে পারে। আজ সে কারো সাথে নিজের চড়াস্বর শোনেনি।

সাহারা গেলো কোথায়, ভেবে একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো শিহাব। অস্থির হাতে সে টিভি ছাড়লো। খবরের কাগজও টেনে কাছে আনবে এমন সময় মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ পেলো। সাহারার মেসেজ। ‘তোমার এখানে আর আমার থাকা ঠিক হবে না! জীবনটা একভাবে কেটেই যাচ্ছিল। কিন্তু আজকের পর থাকলে নিজের আত্মার প্রতি সীমাহীন লাঞ্ছনা প্রয়োগ করা হবে। এখন আমি ফিরে যাচ্ছি পুরনো সেই মানুষের কাছে। যাকে ডিভোর্স দিতেও ঘেন্না হয়েছিলো। মনে হতো আসল ডিভোর্স তো হয়েই গেছে। লোক দেখানো ডিভোর্স দিয়ে আর কী হবে!
আজ তুমি অফিসে চলে যাওয়ার পরপরই আমার মনে হলো, আমিও তো আমার সমস্তর ভাষা আরেকজনকে উপলব্ধি করতে দিয়েছি এবং এটাকেই আমি প্রতিশোধ মানছি। আর সেই স্পৃহায় শুধু শরীরের ক্ষুধা নিয়ে তার কাছে যাওয়া। মন তো রেখে গেলাম তোমার কাছেই, বাস্তবতার বাইরে যার মন নিয়ে খেলার কোনো সময় নেই জেনেও।

আজ মনে হচ্ছে কি জানো, আজ যা তোমার কাছে পেলাম, তা আমার সমস্ত হারানোর অধিক! এ এক অন্যরকম স্বাদ। অন্যরকম আনন্দ। এ এক অন্যরকম বোধ। যেন সবকিছু ভেঙে আবার আমাকে নতুন করে কেউ গড়ে দিল। অথচ এই বোধের মিশ্র লাবণ্য আমাকে আর রাতে ঘুমোতে দেবে না। সুখি হতে দেবে না কাউকে নিয়ে! তবু আলগোছে এইটুকু প্রাপ্তি এবং তুমি যে আমার শরীর-মনকে ভালবাসো, এই মহার্ঘ্য বিশ্বাসটুকু নিয়ে জোড়াতালির নিস্তরঙ্গ-মরা নদীর মতো ব্যুহে ঢুকে পড়তে এখন আর আমার কোনো কষ্টই লাগছে না।

ভেবেছিলাম এসব তোমাকে লিখে রেখে আসবো। কিন্তু নদী আগে এসে ঘরে ঢোকে যদি! মনে রেখো, সাহারা মানে শুধু মরুভূমি নয় কিন্তু। উপবনও!’