মনোজ কুমার মণ্ডলের কবিতা

ভাঙন
বুকের মাঝে এখনো ভাঙনের শব্দ শুনি
কেঁপে কেঁপে উঠি দারুণ দুঃস্বপ্নে।
সেই দৃশ্য মনে হলে এখনও –
প্রতিবার ভেঙেচুরে ক্ষয়ে যাই আমি।
রাজেনদার হাঁক শুনেছিলাম বেড়িবাঁধ থেকে
“ভাঙন লেগেছে! ভাঙন! বাঁধ ভেঙে ঢুকছে জল,”
তারপর অগণিত মানুষের সমস্বর কোলাহল
“বাঁধ ভেঙে জল ঢুকছে! জল! ”
চোখের সামনে চেয়ে চেয়ে দেখলাম
কপোতাক্ষ রাক্ষসী হয়ে গিলে ফেলছে মানুষের স্বপ্ন ।
ঢুকছে জল, ডুবছে মাঠ, সমতল,
ডুবছে সবুজ শস্যক্ষেত, নিকানো উঠোন
খাল বিল, পথঘাট, পুকুরের পাড়
মুরগির ঘর, গরুর গোয়াল।
অসহায় আমি তাকিয়ে আছি-
ভাঙছে চর, ভাঙছে পাড়, ভাঙছে বাড়ি
ভাঙছে জমি, শস্যক্ষেত, মানুষের মন
স্বপ্ন সবার ভেঙে চুরমার, শুধু আর্তনাদ, হাহাকার।
ভাঙনের শব্দ শুনি আমি জলমগ্ন মানুষের বুকে,
রিক্ত জনপদের হাহাকারে আর অগণিত দৃষ্টিশূণ্য চোখে ।
বিধ্বস্ত, আশাহত চেয়ে আছি আমি-
স্রোতে ভেসে যাচ্ছে গাছ, নৌকা
ধসে পড়ছে দেয়াল, ভেসে যাচ্ছে ঘরের চাল।
জীবন তবু থামতে জানেনা
আমি মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের রূপ দেখি
স্রোতের বিপরীতে গরুগুলো সাঁতরে খুঁজছে ডাঙা
ঠাঁই খুঁজছে ছাগলের পাল, হাঁসের দল।
গাছের মগডালে আশ্রয় খুঁজছে একটা মোরগ।
পিলপিল করে মানুষ ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে
শিশুকে বুকে জড়িয়ে ছুটছে মা।
অসহায় বৃদ্ধ ভেলায় ভেসে ভেসে খোঁজে আশ্রয়
আশার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে দূরন্ত কিশোর ।
ত্রিশ বছর আগের ভাঙণ আজও সুতীব্র বুকের গভীরে।
আজও সেই ভাঙনের শব্দ শুনি আমি
ভাঙনের ক্ষতচিহ্ন নিরন্তর বয়ে চলি দীর্ঘশ্বাসে।
করুণ চোখে ভেসে ওঠে সে বিরান ভূমি,
ভাঙনে ভাঙনে বিলীন মুখর জনপদ
আর ভেঙেচুরে হেরে যাওয়া মানুষের মুখ।
আমি ভাঙনের শব্দ শুনি জমিনের
আমি ভাঙনের শব্দ শুনি জীবনের।
তারই মাঝে স্বপ্ন দেখি আগামীর নতুন জমিন
গড়ে ওঠা নতুন জনপদ
ভাঙন থেকেই জাগা ভবিষ্যতের নতুন জীবন।