প্রবন্ধ: পৃথিবীর মুদ্রিত প্রথম বই

প্রবন্ধ: পৃথিবীর মুদ্রিত প্রথম বই

পৃথিবীর মুদ্রিত প্রথম বই
ড. শাহনাজ পারভীন

‘তোমার জন্য কবি
সব কিছু এক ছবি
সময় শেষে সব হারালেও যায় থেকে যায় সব
তোমার জন্যই পৃথিবীময় জমকালো উৎসব।’

চেতনা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ পড়হংপরড়ঁপহবংং. চেতনা বলতে বুঝি মনের একটি ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য যাকে আরও অনেকগুলি মানসিক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন আত্মমাত্রিকতা, আত্মচেতনা, অনু ভূতিশীলতা, পৃথকীকরণ ক্ষমতা এবং নিজের সত্ত্বা ও আশেপাশের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষমতা। মনের দর্শন মনোবিজ্ঞান স্নায়ু বিজ্ঞান ও বোধ বিজ্ঞানে চেতনা অনস্বীকার্য।
জাগরণ শব্দটিতে জেগে ওঠা বুঝি। জেগে ওঠা অর্থাৎ ফুটন্ত, বিকশিত, কর্ষিত এবং একই সাথে নান্দনিক অর্থকেও বুঝি। একটি গোলাপ কুঁড়িকে পরিপূর্ণভাবে ফুটতে যেমন টবের মাটিতে পানি, সার এবং যত্নের প্রয়োজন, জাগরণের জন্যও প্রয়োজন ক্রমান্বিক চর্চা এবং অনুশীলন। পরিপূর্ণ চর্চা এবং অনুশীলণের মাধ্যমেই মেধার বিকাশ, প্রকাশ এবং জাগরণ সম্ভব।

উইকিপিডিয়াতে লাতিন ভাষায় লেখা অভিধানে বই। বই বলতে লেখা ছাপানো অক্ষর বা ছবি বিশিষ্ট কাগজ বা অন্য কোন মাধ্যমের তৈরি পাতলা শীটের সমষ্টি বোঝায়। যা একধারে বাঁধা এবং রক্ষামূলক মলাটের ভেতর আবদ্ধ থাকে।
পৃথিবীর প্রথম বইটি ৮৮৬ সালে ১১ মে চিন দেশে (বর্তমান ধারার) প্রকাশিত হয়। জাপানের সম্রাজ্ঞী “ মোবতকুর” প্রায় দশ লক্ষ বাণীসহ “হীরক সূত্র” শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রচারের পরিকল্পনা করেন। তখনকার দিনে এ কালের মত কোন ছাপার মেশিন আবিষ্কৃত হয় নি। তাই কাঠের ব্লক তৈরি করে হস্তচালিত মেশিনের সাহায্যেই “হীরকসূত্র” বইটি ছাপা হয়েছিল। বইটি ছেপেছিলেন ওয়াং চি। পৃথিবীর মুদ্রণের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। পরবর্তীতে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে চিনের কংসু শহর থেকে এই বইটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। যা আমেরিকার ধনকুব বিল গেট্স ১৯৯৪ সালে প্রায় ৩১ কোটি ডলার দিয়ে এটি ক্রয় করেন। বইটি ক্রয় করবার তিন বছর পর তিনি বইটি স্কান্ড কপি প্রকাশ করেন। পৃথিবীর প্রথম মূদ্রিত বাংলা বইটি ১৬৮২ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে বইটির পুরো অংশ পাওয়া যায় নি। বইটির কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। ১৭৫২ সালে জার্মানীতে আর একটি বই ছাপা হয়েছিল। সেই বইটিও পরবর্তীতে পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত হয়নি। বইটির শেষের দিককার কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। তাই বই দুটির শিরোনাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয় নি।
বাংলায় লেখা সবচেয়ে পুরনো মুদ্রিত যে বইটি পাওয়া গিয়েছে তার নাম “কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ”। তবে বাংলা বর্ণে নয়, বইটি ছাপা হয়েছিল রোমান হরফে। এই বইগুলি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা ভাষার প্রথম মূদ্রিত বই হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় A grammer of the Bengali Language. বইটি লিখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী ব্রাসি হ্যালহেড। ১৭৭৮ সালে পশ্চিম বাংলার হুগলি শহর থেকে কাঠের হরফে ছাপা হয়। কাঠের হরফগুলি তৈরি করেছিলেন ইংরেজ পন্ডিত গ্রন্থকার চার্লস উইলকিন্স। বাংলা অক্ষরের জন্য সহায়তা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার।

বই মূলত দুই রকম। ঐশী গ্রন্থসমূহ এবং মানব রচিত গ্রন্থসমূহ। ঐশীগ্রন্থসমূহকে সহীফা বলা হয়। সহীফা দুই রকম। বড় এবং ছোট। ছোট সহীফা একশ খানা এবং বড় সহীফা মোট চার খানা। তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল এবং পবিত্র কোরআন শরীফ। পবিত্র কোরআন শরীফ মহান আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ। আমাদের চেতনার জাগরণে এই সমস্ত মহান গ্রন্থসমূহ আমাদের চলার পথের প্রতিটি বাঁকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অনস্বীকার্য। মানব রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকার আছে। তারমধ্যে ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, গবেষনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, গল্প, নাটক, কিশোর রচনা, শিশুতোষ লেখা, ভ্রমণকাহিনী, রম্য রচনা, কৌতুকসহ নানান প্রকারের বই চেতনার নানামুখী জাগরণ ঘটায়।

এই মূদ্রিত গ্রন্থের কল্যাণে পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের নানান কাহিনী এখনো স্পষ্টভাবে জানতে পারি। কালের ধুলো তাকে কিছুতেই ঢেকে দিতে পারে না। যতই কাল অতিক্রম করুক না কেন, তা তার নিজের ঔজ্¦্যল্যে ঝকমক করছে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর। এই মূদ্রিত গ্রন্থ সমূহ আমাদেরকে মহাকালের ইতিহাস পারদের আয়নার মত স্বচ্ছ আবরনের ছবি আমাদেরকে জানিয়ে দেয়, দেখতে দেয় নিরন্তর। পৃথিবীর শুরুতে এই পৃথিবী কিভাবে কোটি কোটি বছর জলপূর্ণ আবরণে ঢাকা ছিল, এবং ধীরে ধীরে সেখানে সবুজের, প্রাণের সঞ্চার হয় তা আমরা ইতিহাসবিদ হিরোডাটাসের রচনা থেকে জানতে পারি। জানতে পারি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-১৯৯ অব্দে প্রাচিন গ্রীসের সর্বজন স্বীকৃত সক্রেটিস সত্য ও সুন্দরের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁকে এথেন্সের যুবকদের দর্শন শেখানোর দায়ে হেমলক বিষপানে দন্ডাদেশ দেওয়া হয়। তিনি যুবকদের সত্য, সুন্দর ও যুক্তির আলোকে জগৎ ও জীবনকে বিশ্লেষণ শেখাতেন। মানবতার মুক্তির জন্য সক্রেটিসের সত্যাচার ও মানবতাবাদী আদর্শের জন্য তিনি সর্বমহলে প্রশংসনীয় হন। কিন্তু তৎকালীন আধিপত্যবাদী গ্রিক সমাজ তাঁর এ মহান আদর্শকে মেনে নেয় নি। শাসকমহল শঙ্কিত হন তাঁর এ ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায়, তাদের সন্দেহ ছিল সক্রেটিস শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার নিয়ে কথা তুলবেন। তারা তাঁকে এক প্রহসনমূলক বিচারে দন্ডিত করে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অকাতরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। পৃথিবীর এই বিখ্যাত কাহিনী আজও আমাদেরকে উচ্চকিত করে সাহিত্যিকের লেখনির মাধ্যমে, তাদের রচিত বইয়ের মাধ্যমে। তাঁদের লেখনির জন্য পৃথিবী থেকে এই কাহিনী আজও হারিয়ে যায় নি এবং পৃথিবী যতদিন থাকবে এ কাহিনী ততদিনই হীরকখন্ডের মত জ্বলজ্বল করে অনাগত মানুষকে সাহসী করে তুলবে, সুন্দর করে তুলবে, সৌন্দর্যময়ী করবে।

বই না থাকলে কি আমরা একাদশ শতকের শ্রেষ্ট কবি মহাকবি ফেরদৌসীকে পেতাম?
একাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ট কবি মহাকবি ফেরদৌসীর কথা আমরা সকলেই জানি। সুলতান মাহমুদ তাকে শাহনামা র প্রতিটি শ্লোক রচনার জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মহাকবি ফেরদৌসী কঠিন সাধনার মাধ্যমে ৩০ বছরে ৬০ হাজার শ্লোকের সমন্বয়ে ‘মহাকাব্য শাহনামা’ রচনা করলেন। ইহা সাতটি বৃহৎ খন্ডে বিভক্ত। কাব্যের কোথাও অশ্লীল বাক্য বা স্লাং কোন উপমার প্রয়োগ নেই। কবি আশা করেছিলেন তার কষ্টার্জিত সাধনার ফসল দিয়ে অসহায়, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগণের এবং তার কন্যা সন্তানদের কাজে লাগাবেন। কিন্তু সুলতান মাহমুদ শেষ পর্যন্ত একজন কবির কাছে তার প্রতিশশ্রুতি রক্ষা করেন নি। তার কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ ও ষড়যন্ত্রকারীদের কুমন্ত্রণা শুনে তাঁর প্রতিশ্রুত হাজার সোনার মুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রোপ্য মুদ্রা উপহার দিলেন। এতে কবি ক্রোধে রাগে অপমানে সমুদয় অর্থ গরীব দুঃখী এবং রাজভৃত্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে কয়েকটা শ্লোক লিখে রাতের অন্ধকারে রাজদরবারে লটকিয়ে গজনী ত্যাগ করেন। তিনি লিখেছিলেন:
‘রাজবংশে হত জন্ম তোমার,
বখশিতে স্বর্ণমুদ্রা মুকুট সোনার।
উচ্চামান নাহি যার বংশের ভিতর,
কেমনে সহিবে সে মানীর আদর?’

এ শ্লোক পাঠ করে বাদশা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। পরক্ষণেই সুলতান তার ভুল বুঝতে পেরে যখন স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন তখন কবিব মৃত্যুৎসব চলছে। এই হচ্ছে পৃথিবীতে কবি, সাহিত্যিক, খ্যাতিমানদের সম্মান পাওয়ার উপমা। তারা জীবিত অবস্থায় পায় না, সব আসে কিন্তু তাহা মৃত্যূর পর। দেখে যেতে পারেন না তাঁরা, রেখে যান শুধু বই আর এই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চাবুকাঘাত।

লেখক: কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ।