প্রবন্ধ: উৎপলকুমার বসু, ছন্দে-নির্ছন্দে

প্রবন্ধ: উৎপলকুমার বসু, ছন্দে-নির্ছন্দে

উৎপলকুমার বসু, ছন্দে-নির্ছন্দে
সৌম্য ঘোষ

“দয়িতা, তোমার প্রেম আমাদের সাক্ষ্য মানে নাকি?
সূর্য-ডোবা শেষ হল কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর।
নক্ষত্র ফোটার আগে আমি একা মৃত্তিকার পরিত্যক্ত,বাকি
আঙুর, ফলের ঘ্রাণ, গম, যব, তরল মধু-র
রৌদ্রসমুজ্জল স্নান শেষ করি। এখন আকাশতলে সিন্ধুসমাজের
ভাঙা উতরোল স্বর শোনা যায় গুঞ্জনের মতো-
দয়িতা, তোমার প্রেম অন্ধকারে শুধু প্রবাসের
আরেক সমাজযাত্রা। আমাদেরই বাহুবল বিচূর্ণ, আহত
সেই সব সাক্ষ্যগুলি জেগে ওঠে। মনে হল
প্রতিশ্রুত দিন হতে ক্রমাগত, ধীরে ধীরে, গোধুলিনির্ভর
সূর্যের যাত্রার পথ। তবু কেন ষোলো
অথবা সতের-এই খেতের উৎসব শেষে, ফল হাতে, শস্যের বাজারে
আমাদের ডেকেছিলে সাক্ষ্য দিতে? তুমুল, সত্বর,
পরস্পরাহীন সাক্ষ্য সমাপন হতে হতে ক্রমান্বয়ে বাড়ে ।” ( উৎসর্গ )

এমন নব ধারাজলের অঙ্গীকার নিয়ে বাংলা কবিতায় উৎপলকুমার বসুর রাজসিক আবির্ভাব। জন্মেছিলেন কলকাতার ভবানীপুরে, পৈতৃক বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মালখানগরে। চৈত্রে রচিত কবিতা, পুরী সিরিজ, আবার পুরী সিরিজ, লোচনদাস কারিগর, খ-বৈচিত্র্যের দিন, সলমা-জরির কাজ, সুখ-দুঃখের সাথী, কহবতীর নাচ, নাইটস্কুল, মীনযুদ্ধ, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে, পিয়া মন ভাবে, বেলা এগারোটার রোদ, অন্নদাতা যোসেফ, হাঁসচলার পথ ইত্যাদি বিভিন্ন বইয়ে, পুস্তিকায় ও সংগ্রহে বিস্তীর্ণ কবিতাগুচ্ছে দৃশ্যমান বস্ত্তপুঞ্জের মর্মে নিহিত শ্বাসমহলকে যেন অক্ষরের অবয়ব দিয়েছেন তিনি। প্রথা জর্জর নন্দনের নিকুচি করে, প্রচল প্রকরণের সীমানা ভেঙে উৎপলকুমার বসু মানবীয় অভিজ্ঞতার অতিচেনা সত্তাকে এক অভাবিত রূপ কুশলতায় কবিতা করে তুলেছেন। ধাতুফলক থেকে আকাশশিখর সবই তাঁর কাছে ছিল অনিবার্য কবিতা।

তিনি এমনই একজন কবি ব্যক্তিত্ব। পঞ্চাশ দশকের উজ্জ্বল নক্ষত্র উৎপলকুমার বসু। বাংলা কবিতায় বিষয় ও আঙ্গিকের ব্যাপার নিয়ে যেসব কাব্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের গোষ্ঠী সেগুলোর মধ্যে স্মরণীয়। এই গোষ্ঠী কবিতার মাধ্যমে জীবনের অর্থ বের করবার গতানুগতিক প্রয়াসের ইতি টেনে কবিতাকে অনর্থ বের করবার কাজে ব্যবহার করতে চাইলেন ।তাই তাঁদের কবিতায় ফুটে ওঠে মানবিক, দৈহিক ,শারীরিক ক্ষুধার কথা ।এই ধারায় প্রথমদিকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায়চৌধুরী ,সমীর রায় চৌধুরী, অরুণেশ ঘোষ ও অন্যান্য অনেকেই ছিলেন। কৃত্তিবাস-এর সঙ্গে থেকেও উৎপল কুমার বসু এঁদের আদর্শকে ভালবেসে যোগদান করেন। যদিও পরবর্তীকালে মামলায় জড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের কথা ঘোষণা করেন উৎপল কুমার বসু—‘I feel that their literary movement degenerated into depravity and I have disassociated myself from hungry generation.’

উৎপলকুমার বসুর জন্ম ১৯৩৭ সালের ৩রা আগস্ট কলকাতায়। কিন্তু তাঁর ছেলেবেলার বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে কোচবিহারের দিনহাটায়। মা অসুস্থ হওয়ায় মাসি তাঁকে দিনহাটায় নিয়ে আসেন ।কয়েক মাস পরেই কবির মা মারা যান। তারপর দিনহাটায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাঁকে ।সময়টা ছিল বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ।তখনকার দিনহাটা আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। বৈদ্যুতিক আলো পৌঁছয়নি তখনও। দিনহাটার রূপকার কমল গুহ মহাশয়কে তিনি শিক্ষক হিসাবে পান । তাঁর বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন দিনহাটার আর একজন বিখ্যাত ছেলে পেয়ারাদা-কে। যাঁর ভালো নাম এরশাদ। পরে তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর উৎপল আবার কলকাতায় চলে যান। সেখানে তাঁর বাবা তাকে স্কটিশ চার্চ -এ ভর্তি করে দেন। তারপর আশুতোষ কলেজ থেকে বিএসসি ও প্রেসিডেন্সি থেকে এমএসসি করেন। পড়বার সময় থেকেই লেখালেখিতে আত্মপ্রকাশ। সেই সময় পুজো সংখ্যার দেশ এ লেখা প্রকাশিত হয় তাঁর। ওঠা বসা ছিল আনন্দ বাগচী, দীপক মজুমদার ,দীপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের সঙ্গে। ক্রমশ কৃত্তিবাস পত্রিকার ঘরের লোক হয়ে উঠলেন তিনি। যোগাযোগ হয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে। বোনের বিয়ে হয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে।
‘কৃত্তিবাস’ -এর বিপ্লবী মানসিকতা আর হাংরি জেনারেশনের অতিবিপ্লবী ও পোস্টমডার্ন মানসিকতাকে সামনে রেখে নতুন করে জীবন শুরু হয় তাঁর। কবি হিসাবে উৎপলকুমার বসুর প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা একই সময়ে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা ‘(১৯৬১)র ভাষা প্রচলিত বাকরীতি এবং কাব্যিক মুদ্রাগুলিকে এক ধাক্কায় নস্যাৎ করে দিয়েছিল ।গতানুগতিক আখ্যানধর্মী চলনকে বদলে নিলেন অসমাপ্ত কথার মতো পরিমিত প্রতীক আর সংকতে। তাঁর কবিতায় ছিল রূপকথা আর যাদুবিদ্যার পরম্পরা’। চৈত্রে রচিত কবিতা’য় বিশেষ্য ,বিশেষণ ও ক্রিয়াপদগুলি নির্দিষ্ট ভূমিকা বদলে আধুনিকতার ভিন্ন এক সম্ভাবনা যোগ করেছে বাংলা কাব্য সাহিত্যে। তাই তিনি ও তাঁর কবিতা তরুণ কবিদের কাছে হয়ে উঠেছিল অনুসরণ ও অনুশীলনের ক্ষেত্র।

বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান প্যারিসে। সেখান থেকে লন্ডন। লন্ডনে এডুকেশন অথরিটি তাঁকে পড়াতে বলেন। সেখানে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট ও আরও বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন । তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ‘ব্যান্ডিট কুইন’ -এর লেখিকা মালা সেনের সঙ্গে। লন্ডন আর প্যারিসে থাকার সময় ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। প্রায় এক যুগ কাটিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। যোগদান করেন মেঘমল্লার-এ। শুরু হল পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে নতুন করে সাহিত্য আড্ডা ও সাহিত্য চর্চা। পরবর্তীকালে নব্বই দশকের শুরুতে এই উদ্দেশ্যেই তাঁর প্রস্তাব ও পরিকল্পনা শুরু হয় নির্ভেজাল বৌদ্ধিক আড্ডা ‘কলোসিয়াম’।

কবিতাজীবনের প্রারম্ভপর্বেই জীর্ণ-পুরনোর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। হাংরি প্রজন্ম আন্দোলনের আভায় নিকষিত ছিল তাঁর কবিতা ও প্রকাশভঙ্গি। এই আন্দোলনসূত্রে ১৯৬৪-তে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি হয়; ফলে যোগমায়া কলেজের অধ্যাপনা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয় তাঁকে। কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন বটে কিন্তু কবিতার জন্য কোনো আপসরফায় স্বাক্ষর করেননি। ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের বিষয়। দেশে-বিদেশে এই বিষয়ে নিবিড় অধ্যয়ন তাঁকে উপহার দিয়েছে কবিতাভিজ্ঞতার নতুনতর বলয়। বলা হয় – কবির জন্য কোনো অভিজ্ঞতাই ঊন বা গুরুত্বহীন নয়; উৎপল ভূতাত্ত্বিক জরিপের কল কাঠামো অনুধাবনের গোপন-গহন গভীর নির্জনপথে নিক্ষেপ করলেন তাঁর প্রখর কবিতাদৃষ্টির রঞ্জন। তাই সমসাময়িকের সহস্র ভিড়ে শুরু থেকেই তাঁকে আমরা পাই যেন এক নিরালা-নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো। যুগপৎ আপন অভিশাপে ও মহিমায় যেন ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন তিনি।
১৯৬৪-তে তিনি সমুপস্থিত তাঁর বিধ্বংসী-স্বর্ণালি পুরী সিরিজ (১৯৭৮-এ প্রকাশিত হয় এর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ আবার পুরী সিরিজ) নিয়ে। বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে মুদ্রিত বিজ্ঞাপন-ভাষ্যের মতে, এতে ‘সমুদ্র, বামন, তাঁতকল, শিকারি, সতী, নপুংসক, মিসিবাবা, এয়ারোড্রোম, সূঁচ ও আত্মা, রণরক্ত ও সন্ধ্যাবাতাস, কৈবল্য ও ঈশ্বরোপাসনার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পাঠকের ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য এক নিষিদ্ধ পারমাণবিক চুল্লি খুলে দেখানো হল এই গ্রন্থে।’ না, কোনো আলংকারিক বচন নয়, প্রকৃতই এক পারমাণবিক চুল্লি র প্রস্তাবনা যেন পুরী সিরিজের এসব কবিতা। এই একটি বইয়েই যেন এক অনন্য প্রভাবরেখা তৈরি হলো বাংলা কবিতায়। কোনো ধারাবাহিকতার ফসল হিসেবে সীমাবদ্ধ করা যাবে না পুরী সিরিজের তাৎপর্য; কারণ পুরী সিরিজ নিজেই হয়ে উঠল এক বলবান ধারা।

তিনি মনে করতেন কবিতার বাস্তবতা যেন ভেঙে পড়ার জন্যই সৃষ্টি হয়। আবার প্রতিফলনেই সে নিজেকে পুনর্গঠিত করে। তাই দৈনন্দিন জীবনে চলা ফেরার পথে ক্ষেত-খামার অনাবৃষ্টি ,বেকারি ,বিপ্লব, হরীতকী কিংবা কার্পাস তুলোর গাছ ,ধর্মীয় কুসংস্কার কিংবা গাছপালা নদী পাখি কিংবা বিড়াল কুকুর ,নিরক্ষর বেশ্যা কিংবা হোটেল বয় রাজু ,সজল ও সজলের বউ কোনও কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই তিনি লিখতে পারেন—

১) “এখানে তুলা ও রমণী একত্রে ওজনে ওঠে। এইখানে সর্প ও বৃশ্চিক একত্রে অপেক্ষা করে খদ্দের আসার। মরে গেলে হবে ? তারও পরে খরচাপাতি আছে।”

২)” জ্যোৎস্না এখানে নেই ।তাকে কাল হাই স্কুলের/ পোড়ো বারান্দার পাশে দেখা গেছে/ সে তার পুরনো আধুনিক শাড়িটি বিছিয়ে ওইখানে শুয়ে ছিল।”

৩) “মোহান্ত মেঘের দল যজ্ঞিডুমুর গাছ আড়ালে কিংশুক,/রৌদ্রে বেরিয়ে পড়েছে ভাম, সাঁঝপাখি ,বাদুড় ,নেউল /চায়ের দোকান ফাঁকা/ চুনভাঁটি জনহীন”-” জঙ্গল দেখার আগে বৃষ্টি দেখা ভালো “–এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।আসলে কবিতায় তার ভূমিকা একজন উদাসীন দূরত্বসঞ্চারী স্বগতোক্তিময় নিরপেক্ষ দর্শকের।

১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘পুরী সিরিজ ‘ বইটি আকারে চটি হলেও প্রকাশে এ যুগের নিদর্শন। অসামান্য বাক্যবিন্যাস,স্মৃতি-বিস্মৃতি ও যৌথ অবচেতন সংকেতে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে রহস্যময় এবং পুনর্নির্মাণ প্রত্যাশী। এক কথায় কবি ও পাঠকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী এক বিশেষ পদ্ধতি ।যেখানে পাঠককেই কবি দায়িত্ব দেন বহুস্তরিক উন্মোচনের ও পূনর্গঠনের।১৯৭৮ -এ দীর্ঘ প্রবাস থেকে ফিরেও মেধাবী কণ্ঠস্বরে নির্মাণ করলেন ‘আবার পুরী সিরিজ’। এখানেও ফুটে ওঠে সেই জনপদেরই কথকতা। আর অতল অভিজ্ঞতায় ডুবে যাওয়ার ইঙ্গিত।
উৎপলকুমার বসু ছন্দে-নির্ছন্দে কবিতাকে সৃজনশ্রী দিয়ে প্রমাণ করেছেন প্রথামান্য প্রকরণসমূহেই বাংলা কবিতার সম্ভাবনা নিঃশেষ হতে পারে না। কবিতা বরং ইতিহাস-ভূগোল-শব্দ-কল্পনা-রক্ত-
ঘাম-উল্লাস আর রোদনের হ্রদমাখা পূর্বোক্ত সেই পারমাণবিক চুল্লি।

তমসা নদীর তীরে বসে কবিতার আলো জ্বালতে গিয়ে কবি দেখেছেন চারপাশে ধুধু মহাভারতের মাঠ, হোমারের উপকূল। এমন রণক্ষেত্র-বাস্তবতায় এক জীবন যাপন করে কবির কণ্ঠে যেন সমকালীন মানুষেরই স্বর উপলব্ধ –

“মরে গেলে হবে? তারও পরে খরচাপাতি আছে।”

উৎপলকুমার বসু অর্ধশতকের অধিককাল ধরে কবিতাভাবনা-ভাষা ও ভঙ্গিতে নবীনতাকে স্বভাবমুদ্রা করে নিয়েছিলেন। কবি জয় গোস্বামী উৎপল মূল্যায়নমূলক গ্রন্থ পুরী সিরিজের কবির (দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০১৪)-এর ছয়টি লেখায় নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিষয়টি। ‘সময় থেকে এগিয়ে’, ‘আশ্চর্যের মুখোমুখি’, ‘ঘুম আর অনমত্ম সকাল’, ‘শিল্প, প্রাণী, বৃক্ষ’, ‘দিন আর জ্যোৎস্না’ শীর্ষক প্রবন্ধগুচ্ছে জয় দেখাচ্ছেন সময় থেকে অগ্রগামী কবির বিজয়ী কেশরেখার নিশানা কবিতার আকাশে কেমন পতপত করে। দেখান, বহির্পৃথিবীতে বসবাসের তাপ ও হিম কী করে অনায়াসে উৎপলকুমার বসুর কবিতা হয়ে যায়। কিংবা কোন প্রক্রিয়ায় শিল্প, প্রাণী, বৃক্ষ কথা কয়ে ওঠে উৎপলীয় ভুবনে। উৎপলের অব্যর্থ হাতে। উৎপল বসুর সত্তর পেরোনো মুহূর্তে জয় গোস্বামীর কবিমূল্যায়ন বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য –

“এ হল সেই বয়েস, যেখানে পৌঁছে কবিরা অবসন্ন হয়ে পড়েন, নতুনত্বের অভাব জীর্ণ করে তাঁদের লেখাকে, কেবলই পুরাতন খ্যাতি নির্ভর করে বাঁচতে হয় তাঁদের। অথচ উৎপল, তাঁর কবিতায় কেবলই, একের পর এক আশ্চর্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন আমাদের।”

আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশ কর্মকার এবং ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে যুক্তভাবে উৎপলকুমার বসু এক সময় সম্পাদনা করেছেন কবিতা ও কবিতাবিষয়ক ভাবনার পত্রিকা দরগা রোড। মার্চ ১৯৯৫-এ প্রকাশিত চতুর্থ সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখা যায়, কবিতা বিষয়ে নবীন-প্রবীণ কবিদের নতুনতর কণ্ঠস্বরকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল কবিতা কেন্দ্রিক ওই লিটলম্যাগে।

সব মিলে কুড়িটি কাব্যগ্রন্থ, প্রচুর গদ্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। কবিতার মতোই গদ্যের ভাষাও ছিল বহুকৌণিক, বহু স্তরীয় ও রহস্যময়। তাঁর প্রায় সব লেখাই ঘুরে ফিরে কবিতা বা কবিতার জন্য ।তাই কবিতা রচনার নেপথ্য কাহিনীও কবিতা হয়ে উঠেছে। চিরচেনা এক টুকরো জীবন কিংবা ঘটনাকে রহস্যে আবৃত করে সেই রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন পাঠকের উপর। এভাবেই তাঁর কবিতায় কবির পাশাপাশি পাঠকেরও এক সম্মানীয় স্থান প্রাপ্তি ঘটে। সেতুবন্ধন ঘটে কবি ও পাঠকের মধ্যে। আর তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা কবিতার কয়েক দশকের শাসক।’টুসু আমার চিন্তা মণি’ ,’সলমাজরির কাজ’ ,’হাঁস চলার পথ’, ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মা পাড়ে’ সুখ-দুঃখের সাথী(আনন্দ পুরস্কার,২০১৬)- এমন অনেক গ্রন্থের স্রষ্টা উৎপল কুমার বসু ২০১৫ এর ৩রা আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে
না-ফেরার দেশে চলে যান। আমরা তাঁকে স্মরণে রাখব চিরদিন। তাঁর সৃষ্টি সোনার তরীতে করে ভেসে বেড়াবে মহাকালের ঘাটে ঘাটে।

____________________
ঋণ স্বীকার:
(১) ‘প্রান্তিক দৃশ্যের পথে’- পঙ্কজ চক্রবর্তী
(২) ‘নক্ষত্রের সাজানো ডানা’ — কালীকৃষ্ণ গুহ
(৩) ‘গদ্য সংগ্রহ’ — শঙ্খ ঘোষ
(৪) ‘হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’– উত্তম দাস