গল্প: স্বপ্ন, বাস্তবতা এবং মস্তিষ্কে কবিতার হেঁটে চলা

স্বপ্ন, বাস্তবতা এবং মস্তিষ্কে কবিতার হেঁটে চলা
আতাউল হাকিম আরিফ
ছোটবেলায় আমি একবার নদীর ধারে হারিয়ে গিয়েছিলাম, এক চা দোকানী আমাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন, খুব নাকি কান্নাও করেছিলাম! সেদিন-ই দৈবক্রমে আমার আম্মাও দৃর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলো, এই পুরো বিষয়টা আমি শুনেছি আম্মার কাছে। এমনি কিছু ঘটনা আমার চিন্তার জগতে মাঝেমধ্যে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আসে কিংবা আলোড়িত হয়, আরো একটি ঘটনার কথা শুনুন আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র, আবু তোরাব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাবার চাকুরির সূত্রে আমাদের সেখানে থাকা, প্রাইমারী স্কুলে থাকাকালীন আমি খুব হাবাগোবা টাইপের ছিলাম, কারো সাথে খুব একটা মিশতে পারতাম না, কেউকিছু বললে কান্না করে দিতাম, তখনকার অধিকাংশ ছাত্র খুব ফাজি ধরণের ছিলো, আমার মতো একটু যারা সরল তাঁদের চেতানোর ( উস্কিয়ে দেয়া) মধ্যে ফাজি ছেলেপেলেগুলো আনন্দ খুঁজে পেতো, যাহোক ঐ প্রকৃতির একজন ছিলো রানা, (ঐ অঞ্চলের বিত্তবান মন্টু বাবুর ছেলে) সে একদিন আমার স্কুল ব্যাগে কলম ঢুকিয়ে আমাকে চোর সাবাস্ত করলো, আমার অসহায়ত্ব দেখে আমার ক্লাসের-ই একটি মেয়ে নাম সম্ভবত সুরমা সত্য কথাটা কবির স্যারকে গিয়ে বললো, আমার বেশ মনে আছে স্যার এসে রানাকে বেশ প্যাদানী দিয়েছিল , আশ্চর্য হলেও সত্য সেদিনের এই ছোট্ট ঘটনাও আমার মনে এখনো রেখাপাত করছে! ক্লাস ফোরে থাকাকালীন আমরা আবু তোরাব নামক এলাকাটি থেকে চলে আসি সাগরগিরি অপূর্ব সম্মিলন সীতাকুণ্ডে। রানা,সুরমা, কবির স্যার এই চরিত্রগুলোর কারো সাথে আর কখনোই যোগসূত্র তৈরি হয়নি, শুধু সেদিনকার ছোট্ট সুরমার মিষ্টি মুখখানা অবচেতনে আবছা আবছা ভেসে উঠে-এতটুকুই!
এমনি করে ছোটবেলার আরো কিছু স্মৃতি মনের চৌহদ্দিতে স্থান করে আছে, এই যেমন সীতাকুণ্ডে আমার প্রথম বন্ধু মতিন (এখন সে সীতাকুণ্ড কলেজ রোডে স্টেশনারী দোকান নিয়ে বেশ ভালো আছে ) তাঁর প্রতিবেশি ছিলাম, দুজনে একই স্কুলে পড়তাম, সেইসূত্র বন্ধুত্ব, তখন বিস্মিত হয়েছিলাম অন্য একটি কারণে আমার সে বন্ধু তাঁর টিন শেড এর ঘরের কার্নিসে বাঁশ, রশি, সাইকেলের চাকা লাগিয়ে বিভিন্ন ধরণের শারিরীক কসরত করতো, তাঁর ইচ্ছে ছিলো সার্কাসের জোঁকার হবে, কারণ সীতাকুণ্ডে শিবচতুদর্শী মেলায় প্রায় যাত্রা-সার্কাস হতো, ওর বাড়ীর নিকটবর্তী স্থানে, তাঁরই প্রভাবে এমন খেয়াল ছেপেছিল, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আমার জীবনে প্রথমবার সার্কাস দেখি মতিনের সাথে। সার্কাসের সাথে ফ্রী ছিলো জরিনা-সকিনার উদ্দাম নৃত্য, ভ্যারাইটি শো! আহা! ভ্যারাইটি শো!
কখনো কখনো অদ্ভুত কিছু বাসনা আমার মধ্যে দানা বাঁধতো, কখনোবা একেবারেই ভিন্ন কিছু করার খেয়াল ছাপতো, পড়ালেখা,বইয়ের পাতা মুখস্থ করা আমার একদম-ই ভালোলাগতো না! স্কুল তো বিষপীড়া ছিলো! যে কথা বলছিলাম প্রায়শই অবচেতনে অদ্ভুত কিছু ভাবতাম, ভাবনা এসে আমাকে ছেপে ধরতো, ছোটবেলায় একদিন কাগজের দলা বেঁধে ফুটবল খেলতে খেলতে একসময় কাগজ দিয়ে বিড়ি বানিয়েও ফুঁকেছিলাম, অদ্ভুত নেশায় মেতে উঠেছিলাম! আশ্চর্য হলেও সত্য যে বড় হয়ে বিড়ি সিগারেট আমাকে খুব একটা আসক্ত করেনি!
যে জিনিসটা আসক্ত করেছিলো, তা হলো সিনেমা, স্কুল পালিয়ে অনেকবার- সিনেমা হলে ঢু মেরেছি, (পরাগ সিনেমা হল) সেসময় সোহেল রানা, রুবেল,ড্যানি সিড্যাক, পাপড়ি, জুলিয়া, সুনেত্রা,অলিভয়া অনেককেই ভালোলাগতো! মনে পড়ে সিনেমার টিকেটের জন্য অনেকবার মারামারিও করেছি, সীতাকুণ্ড হাই স্কুলের ছাত্রদের সাথে বাড়বকুণ্ড স্কুলের ছাত্রদের মারামারি, হাতাহাতি প্রায় হতো, বিশেষ করে শনিবার, রবিবারের সকাল-দুপুরের শো তে।
এতকিছুর অবতাড়না কেন করছি জানিনা! মাঝেমধ্যে উল্টাপাল্টা ভাবা, জীবনের ছন্দে খেই হারিয়ে ফেলা আমার স্বভাবগত, ছোটবেলায় একবার বন্ধুদের খপ্পরে ফুটবেলা খেলা দেখতে ট্রাকে করে শহরে (দামপাড়া পুলিশ লাইন) চলে গিয়েছিলাম, তখন সম্ভরত ক্লাস সেভেনে পড়ি, আসার সময় বন্ধুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম, কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় মনে হলো আমি হতে পারি সিনেমার কোনো চরিত্র কিংবা মাসুদ রানা সিরিজের কোনো দস্যু ছেলে! ভাবনাগুলো এভাবেই এবড়োথেবড়ো ডানা মেলতো মনের জানালায়!
একটা সময় কবিতাও লিখতাম, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, সেসময় আমিও স্কুল পালিয়ে মিছিলে যেতাম, মনে পড়ে সাল ১৯৮৭, নভেম্বর মাসের কোন একদিন ঢাকা অবরোধ করার কর্মসূচিতে আমিও মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম, সেদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে জুতা জোড়া ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছিলাম, আমার প্রথম কবিতাটাও সে ঘটনার-ই বর্ণনা ছিলো! পরে স্কুল ম্যাগাজিনে দিয়েছিলাম, ছাপাইনি! একটা সময় কলেজে উঠলাম, মফস্বলের কলেজ, মনের জগতে ভীষণ উত্তেজনা, পার্শ্ববর্তী গার্লস স্কুলের একটি মেয়ের প্রতি কিছুটা দূর্বলতা ছিলো, সেও একই কলেজে ভর্তি হয়েছে! কলেজ জীবনে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব হলো, তখন আর প্রেম করার বাসনা জাগেনি, তবে ঐ মেয়েটিকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছিলাম, অনেকটাই খেয়ালীবসে! প্রায় দুইযুগ পর একদিন ঐ মেয়েটি সে কবিতার কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ায় আমি তাতে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি বৈকি! বুঝলাম মেয়েরা টিনএজ বয়সের অনেক কিছুই স্মৃতিপটে বেঁধে রাখে!
কলেজ জীবনের আরেকটি উজ্জ্বল মুহুর্ত ছিলো ছাত্র রাজনীতি, সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাজনীতির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতাম! মফস্বল রাজনীতির অনেক ঘটনা প্রবাহের নীরব স্বাক্ষী হয়ে রইলাম, এরমধ্যে আবার কবিতার প্রেমটাও ছিলো সাংঘাতিক রকমের, হাতের কাছে কাগজ পেলেই কবিতা লিখতে চেষ্টা করতাম এবং লিখতাম। তবে সে কবিতাগুলোর একটিও এখন আর আমার সংগ্রহে নেই, মাঝেমধ্যে এই দুঃখবোধে তাড়িত হই! পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে মিলে পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম, সেটিও একধরণের নেশায় পরিনত হলো!
এই সমস্ত সবকিছুই ঘটেছিলো পাঠ্য বইয়ের প্রতি আমার নিতান্তই অবহেলায়!ভীষণ মনেপড়ে একদিন রাত জাগা কাব্য উৎসবও করেছিলাম, চট্টগ্রাম, ফেনী, মিরসরাই থেকে অনেকেই এসেছিলো, অনেকটায় বিট আন্দোলনের চেতনায়! এলেন গীন্সবার্গ সুস্পষ্টত প্রভাব ফেলেছিলো আমাদের উপর।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাও কেটেছে একরকম রাজনীতি, সাহিত্য আড্ডা, শাটল ট্রেনের কোলাহল, মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সাথে এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া, তবে প্রেমের টানটা ছিলো মফস্বলে, তাই বলা চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি বছর (সেশন জট সহ) আমি একপ্রকার অনিয়মিতই ছিলাম!
এবার আসা যাক আসল গল্পে! শুরুতে বলেছিলাম আমার অবচেতন মনে মধ্যে মধ্যে অদ্ভুত কিছু ঘটনা সেঁটে থাকতো এবং ঘটে থাকে কারণে অকারণে ঘটনাগুলো আমার মধ্যে ঘুরপাক খেতো, মাঝেমধ্যে বাস্তবেও ঘটে যেতো, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কিনা আমার জানা নেই , অথচ আজগুবি অনেক কিছুই ঘটতো, যেমনটি স্বপ্নে এসে হাজির হতো মিখাইল গর্ভাচেভ, মার্গারেট থ্যাচার কিংবা তখনকার সময়ের বিদ্রোহী জাওহার দুদায়েভ প্রমূখ কিংবা কোন কোন দিন হু হু করে হাসতে হাসতে এসে হাজির হতো অড্রে হেপবার্ন, সোফিয়া লোরেন, শ্যারন স্টোনরা, ওরা যে কি বলতো, আমি কিছুই বুঝতাম না!
আরেক দিনের কথা বলছি প্লিজ শুনুন, একটি বারো কি তেরো বছরের মেয়ে একদিন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, জীর্ণ শীর্ণ চেহারা, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো কিছুক্ষণ, তারপর বিষন্ন কন্ঠে বললো স্যার আমার মাকে ফিরিয়ে দিন, আমার মাকে ফিরিয়ে দিন, ফিরিয়ে দিন! অদ্ভূতুরে ব্যাপার আমি কোত্থেকে মেয়েটির মাকে ফিরিয়ে দেবো, ভাবতে থাকলাম কেন এমনসব স্বপ্ন দেখছি! অনেক কথায় ভাবছি হঠাৎ-ই মনে পড়লো কিছুদিন এনজিও তে চাকুরী করার সুবাদে স্ট্রিট বেইজড সেক্স ওয়ার্কাদের নিয়ে কাজ করেছিলাম এইচআইভি/এইডস প্রিভেনশন পোগ্রামে, সেইসময় একটি মেয়ে তাঁর অবৈধ ওরসজাত সন্তানকে রাখবেনা, প্রয়োজনে মেরে ফেলবে বলেছিলো, সে কন্যা সন্তানটিকে বিক্রি করলো অন্য একটি মেয়ের কাছে, আমিই অনেকটা বাধ্য হয়ে দুই পক্ষের লিখিত দলিল তৈরি করে দিয়েছিলাম, এই মেয়ে কি সেই মেয়ে, হ্যাঁ আবচা আবচা মনে পড়ছে সেই মেয়েটির মায়ের চেহারা।
কয়েকদিন পর আরেকটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো একটি অপরিচিত গাছ আমাকে তাড়া করছে, আমি দৌড়াচ্ছি, অনেক জোরে জোরে দৌড়াচ্ছি, দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় ফিরলাম, পরদিন শুনলাম ঐদিন ঐ স্থানে আমি দৌড়ানোর কিছু পরের সময়টাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা কয়েকজন হামলাম শিকার হয়েছিলো, তবে কি গাছটি-ই আমাকে বাঁচিয়ে দিলো!।
মাঝেমধ্যে এমনি সব ঘটনা ঘটে আমার সাথে, স্বপ্নের পীড়ন যেমন আছে বাস্তবিকেও তেমনি, একবার এক বেশ্যাবাড়ি গিয়েছিলাম বন্ধুর প্রলোভনে, সুঠামদেহী বেশ্যার সুতীক্ষ্ম আহবান উপেক্ষা করে দৌড়ে পালিয়েছিলাম! সেই থেকে আমার সেই বন্ধুটি আমাকে আর কখনোই কোন ধরনের খারাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করেনি, এমনকি মদ পানেও আমাকে বিরত রেখেছিলো যদিও তাতে আমার আগ্রহ কিছুটা ছিলো বৈকি ! যাহোক ভালোই হলো যে আমার মদপানটাও অক্কা গেলো! তবে স্বপ্নে সেই বেশ্যা মেয়েটিও হি হি ক