গল্প: যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে

যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে
সৈয়দা কানিজ রাসুল
ওমা মাগো তুমি কই মা? আমি তোমার কাছে যামু। তুমি আমার কাছে আহনা ক্যান। আমার শরীলটা জইল্যা গেল মা। ওমা আমার ক্ষিদা লাগছে। আমার দুই হাত পা পুইড়া গেছে মা। আমি কেমনে খামু? তুমি আমার কাছে আহনা ক্যান। আমি তোমার বকুল মা। ও বাবা বাবাগো কেমনে আমাগো গাড়িতে আগুন লাগছে? মায়ে কই? ভাই কই? আমার শরীলটা জইল্যা যাইতাছে……
বারো বছরের বকুল ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। পাশে তার অগ্নিদগ্ধ বাবা অসহায় ভাবে মেয়ের বিলাপ শুনতে শুনতে তার পুড়ে যাওয়া দুইহাত বাড়িয়ে রেখে অপলক তাকিয়ে আছে । বোবা কান্না আঁটকে আছে গলার কাছে। চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ। মুখে মাথায় ব্যান্ডেজ। নিজের পুড়ে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণা এখন আর অনুভূত হয়না। মেয়ের শরীরের যন্ত্রণা পুড়িয়ে দিচ্ছে তার প্রাণটাকে। কি অসহায়! চোখের সামনে সন্তান যন্ত্রণায় ছটফট করছে, অথচ পিতা হয়ে নিতে পারছে না সেই যন্ত্রণার ভাগ। তমিজুদ্দিন ভাবে এ কোন পাপের শাস্তি সে পাচ্ছে। বকুল কাঁদতে কাঁদতে একসময় নিস্তেজ হয়ে যায়। তমিজুদ্দিন ভাবতে থাকে সে কোন পাপ করেছে কিনা। যদি না জেনে করেও থাকে তাহলে সে শাস্তি কেন পাচ্ছে তার অবুঝ সন্তান? তমিজুদ্দিন আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। সে সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর। দিন আনে দিন খায়। তবু মেয়ে বকুল, ছেলে টগর, স্ত্রী সখিনা এবং বৃদ্ধা মা মরিয়ম বিবিকে নিয়ে তমিজুদ্দিনের সুখের সংসার ।কারো সাথে প্যাঁচে থাকেনা সে।ভোর বেলা তমিজুদ্দিন কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে । তখন বকুল ও টগর ঘুমিয়ে থাকে । ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ।বকুল টগর অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে । বাবার আগমনে উচ্ছ্বসিত হয় তারা ।বাবা আদরে আহ্লাদে ভরিয়ে তোলে ওদের । মরিয়ম বিবির চোখ বেয়ে পানি গড়ায় । আনন্দের পানি । স্ত্রী সখিনার চাহিদাও বেশি নয় । বরং সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়ার কাজ নিয়েছে ।বাড়ীর একচিলতে উঠোনে ভালই সবজি ফলিয়েছে । যা বিক্রি করে দু পয়সা আয় হয় নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে।মরিয়ম বিবিও ছেলের বৌ এর সঙ্গে গাছের যত্নে সহযোগিতা করে। মায়ের কথা আজ বড় বেশি মনে পড়ছে তমিজুদ্দিনের। তিনদিন হয়ে গেল মায়ের কোন খবর পায়নি সে। মা কেমন আছে কে জানে? মা কি জানতে পেরেছে তার আদরের ধন বুকের মানিক তমিজুদ্দিন এবং চোখের মণি বকুল মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ? আর তার আরেক চোখের মণি টগর এবং ওদের মা সখিনা পেট্রোল বোমার আঘাতে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে ? মা মাগো তুই কেমনে জানবি মা আমাগোর কি হইছে ? তুই কেমনে জানবি তোর সব হারাইছে মা ।টগর……রে …… বাপজান আমার, তোরে আমি বাঁচাইবার পারলাম না…রে আমারে তুই মাফ কইরা দিস বাপ ।ও সখিনা … আমারে তুমি মাফ কইরা দিওগো…… তমিজুদ্দিন ঘড়ঘড়ে গলায় বিলাপ করতে থাকে। ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে পোড়া মাংসের গন্ধ । প্রতিটি বেডেই এরকম মৃত্যু যন্ত্রণাকাতর রোগীদের বিলাপ। স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য নিরীহ জনগণকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে নিরীহ জনগণের দুর্ভোগ ক্রমশ বাড়তেই থাকে ।
বকুলের দুই পা পুড়ে গেছে। কোমর থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা ।তমিজুদ্দিন মেয়ের ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বিকার ।গত পরশুদিনও ওরা ছিল সুস্থ সবল স্বভাবিক মানুষ ।আজ বকুল এবং নিজের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে তমজুদ্দিন । তার মেয়ে কি ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবন ?সে নিজে কি পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকবে ? কে জোগাবে তাদের ভরণপোষণ ? এমন হাজারো প্রশ্ন এসে ঘুরপাক খায় মাথায় । সখিনার মা মারা যাবার খবর শুনে সখিনাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার মনস্থ করে তমিজুদ্দিন । কিন্তু বকুল এবং টগর নানিবুর মরা মুখটা একবার দেখার জন্য বায়না ধরে । মরিয়ম বিবি ছেলেকে বলেছে , ‘ও তমিজ ওগো লইয়া যা না বাজান। ওগো নানিবুর মুখখান একবার শ্যাষ দেখা দেইখ্যা আহুক ।’
‘না মা রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালা না । অবরোধের মধ্যি ওগো গিয়া কাম নাই । কখন কোন বিপদ আয়া পড়ে তার ঠিক নাই ।’
‘বাবা আমি নানিবুরে দেখুম না ? আর তো কোনদিনও দেখতে পামুনা ।নানিবু আমাগোরে কত্ত আদর করতো ।নিয়া চল না বা…বা…বকুল কাঁদতে থাকে ।
‘হ বাবা আমিও যামু । নানিবুরে দেখুম……টগর কাঁদতে থাকে ।
সখিনা মায়ের জন্য বিলাপ করতে করতে ছেলেমেয়ের দু একটা জামাকাপড় গুছিয়ে নেয় । মরিয়ম বিবির কাছে বিদায় নিয়ে তমজুদ্দিন তার পরিবার নিয়ে শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় । নাইট কোচের সীটে টগর ওর বাবার সাথে বসে এবং বকুল মায়ের সাথে । কিছুদুর গেলে টগরের ঘুম পায় । সে মায়ের কাছে গিয়ে কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে । বকুল বাবার পাশে এসে বসে । সখিনা কাঁদতে কাঁদতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে । কাঁচের জানালা খুলে দিলে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা ভালো লাগে সখিনার । একসময় সখিনাও ঘুমিয়ে পড়ে । বকুল নানিবুর কথা বাবার সাথে আলাপ করে । নাইট কোচ হর্ণ বাজিয়ে অন্ধকার ফুঁড়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে । বাসে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে । হঠাৎ বাসের জানালায় কিছু ছুড়ে মারার শব্দ হয় ।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সারা গাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে । তমিজুদ্দিন ঘুরে তাকায় সখিনার দিকে । সারা গাড়িতে ধোঁয়া এবং আগুনে কিছু দেখা যায়না । তাড়াতাড়ি বকুলকে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায় । ততোক্ষণে বকুলের সালোয়ারে আগুন ধরে গেছে ।তমিজুদ্দিন দুহাত দিয়ে বকুলের পায়ের আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ।বকুলকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আগুন নেভাতে নেভাতে দেরি হয়ে যায় সখিনা এবং টগরকে উদ্ধার করতে ।ততোক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা পুরো গাড়িকে গ্রাস করে ফেলেছে ।তমিজুদ্দিন দেখতে পাচ্ছে শরীরে আগুন নিয়ে মানুষ জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ছে ,আর তারা চিৎকার করে গড়াগড়ি খাচ্ছে । কিন্তু বেয়াড়া আগুন ততোক্ষণে শরীরের ত্রিশ শতাংশ কারো বা সত্তর শতাংশ গ্রাস করে ফেলেছে । ভিতরে আটকে পড়া লোকজনের আর কোন সাড়া নেই । তমিজুদ্দিন দুই পা পুড়ে যাওয়া অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মেয়েকে রাস্তায় ফেলে রেখে সখিনা এবং টগরের জন্য আহাজারি করতে থাকে । তমিজুদ্দিনের দুই হাতের আঙুল পুড়ে কুঁকড়ে গেছে । সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । পোড়া হাত নিয়েই স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আগুন নেভানোর চেষ্টায় হাত লাগায় । কিন্তু সে তখনও জানেনা তার জীবনের সবচেয়ে নিঃসংশতম ঘটনাটি ঘটে গেছে। কি দেখবে তমিজুদ্দিন আগুন নিভে গেলে ? কিভাবে ফিরে পাবে প্রিয়তমা স্ত্রী সখিনাকে এবং বুকের মানিক ছেলে টগরকে ? পুলিশের পিকআপ ভ্যান আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে । তমিজুদ্দিন কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে সে তাদের অনুরোধ করে একটিবার তার স্ত্রী পুত্রের অবস্থা দেখে যাবে। কিন্ত র্যাব পুলিশ পুরো জায়গাটি বেরিকেড দিয়ে রেখেছে ।কাউকে সেখানে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা । তমিজুদ্দিন যেতে চাইলে একজন পুলিশ সদস্য তাকে যেতে বাধা দিয়ে বলে, ‘আপনার এখন হাসপাতালে যাওয়া দরকার। আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন। ইস! হাত দুটো একেবারে পুড়ে গেছে।’
–না স্যার, আমার কিচ্ছু হয় নাই। আমারে একবার যাইতে দেন স্যার। আমার বৌ, আমার ছেলের লাশটা আমি নিয়া যামু স্যার ।
–লাশ ? লাশ কিভাবে নিবেন ? সব তো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে ।
–কি কইলেন স্যার ? অঙ্গার ?
পোড়া দুই হাত জোড় করে তমিজুদ্দিন তার পায়ের কাছে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে
–আমারে একবার যাইতে দেন স্যার ।আমি শুধু একবার চোক্ষের দেখা দেখতে চা…ই ।
পুলিশ সদস্য তমিজুদ্দিন কে ধরে ধরে পোড়া গাড়িটার কাছে নিয়ে যায় ।সখিনা যে সীটে বসে ছিল সরাসরি সেই সীটে তমিজুদ্দিনের দৃষ্টি আটকে যায় । মায়ের কোলে টগর ঘুমিয়ে ছিল ।ঘুমন্ত অবস্থায় আগুন গ্রাস করে ওদের ।সীটে পুড়ে যাওয়া কালো কঙ্কালের কোলে শুয়ে আছে ছ’ বছরের ছোট্ট টগরের কঙ্কাল । এ দৃশ্য দেখে তমিজুদ্দিন টগ….র…..রে বলে আর্তচিৎকার দিয়ে মূর্ছা যায়।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে তমিজুদ্দিনকে রাখা হয়েছে তার মেয়ে বকুলের পাশের বেডে। বকুল যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় থেমে যায়। বার্ণ ইউনিটে রোগীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওদের যন্ত্রণা দেখে ভুলে যায় নিজের যন্ত্রণার কথা। বকুল ভাবে বাইরে নিশ্চয় যুদ্ধ চলছে । তা না হলে এত মানুষ প্রতিদিন বোমার আঘাতে পুড়ে কি করে ?
ওর দাদিবু দু’ভাইবোন কে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতো ।ওদের বড়চাচা রমিজুদ্দিন দশ বছর বয়সে ইটের টুকরো মেরে দুজন পাঞ্জাবীকে খতম করেছিলো । সে জন্য তাকে পুকুর পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল অন্য দুজন পাঞ্জাবী । তারপর ওদের ঘরবাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল পাক বাহিনী। বকুল নিস্তেজ হয়ে ভাবতে থাকে দাদিবুর কথা । দাদিবু ওদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতো ।সত্যিকারের গল্প ।
“তখন ৭১ সাল। শীত সবে শ্যাষ হইছে ।ইংরেজী মার্চ মাসের ২৫ তারিখে অনেক বড় যুদ্ধ হইছিলো ।সে সময় পাঞ্জাবীরা ঢাকা শহরে অনেক মানুষ মাইরা ফালাইছে ।এই খবর গ্রামের লোকজন রেডিওতে হুনসে ।গেরাম দ্যাশে তখনও লোকজন তেমন কিছু জানেনা । তোগো দাদায় একদিন বাজার থেক্যা খবর শুইন্যা দৌড় মাইর্যা আইস্যা পড়ছে ।তোগো জেঠা আর তোর বাপে তখন ছুটো পোলাপান ।বাড়িত আইস্যা দুই পোলারে বুকের কাছে নিয়া দুই হাত দিয়া আকড়াইয়া ধরলো ।আমারে কইলো ,
–ও মরি আমার পোলা দুইটারে কেমনে বাচামু ?এহানেও যদি মিলিটারি আহে ?
–কি কন ?এহানে মিলিটারি আইবো কেমনে ?এই গেরাম দ্যাশে কি আছে । তাছাড়া হেরা তো দুধের শিশু ,অদের কি হইবো?
–ঢাকার শহর থেইক্যা লোকজন সব গেরামের দিকে আইয়া পড়তাছে ।ঢাকার খবর ভালা না ।রাস্তাঘাটে মানুষ মাইর্যা স্তুপ কইর্যা রাখছে ।
–হায় আল্লাহ! এহন কি হইবো ? আমরা কোনে যামু ?
–এহনো ডরের কিছু নাই ।আমাগো ভিতরের গেরামে মিলিটারি সহজে আইবো না ।তয় যদি আহে তাদের ঠেকাইতে হইবো ।আর তাগো ঠেকানোর লাইগ্যা আমাগো প্রস্তুত থাকতে হইবো ।বড়ো মামুসাব কইছে পশ্চিম মুড়ার মাঠে যাইতে ।সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্প হইবো ।গেরামের জোয়ান পোলাপান রাইফেল চালান শিখবো ।মরি তুই কইল্যাম ডরাস না ।আমি ট্রেনিং লমু । তুই আমার পোলা দুইটারে চোক্ষে চোক্ষে রাখবি । পাশের গেরাম থেইক্যা দুইজন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আইছে ।তারাই আমাগোরে ট্রেনিং দিব ।
টগর এবং বকুল অপলক তাকিয়ে থাকে দাদিবুর দিকে। কাহিনী বর্ণনা করার সময় দাদিবুর চোখেমুখে ভীতির ছাপ লক্ষ্য করে ওরা ।বকুল হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে ।মাথাটা অন্য পাশে ফিরিয়ে আবার চিন্তার গভীরে প্রবেশ করে ।মরিয়ম বিবি তার স্বামী কলিমুদ্দিনের যুদ্ধে যাবার কাহিনী শোনায় নাতি নাত্নিকে ।গ্রামের সৈয়দ বাড়ির সৈয়দ কামরুল হাসান সাহেব গ্রামের লোকজনকে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য বিশেষ ট্রেনিং এর প্রয়োজন আছে তা বোঝানোর চেষ্টা করেন ।কলিমুদ্দিনের মত আরো অনেকেই তাঁকে মামুসাব বলে সম্বোধন করে । সময়ে সময়ে রেডিওতে খবর শোনার জন্য কলিমুদ্দিনের মতো অনেকেই সমবেত হতো তাঁর বাড়িতে । কামরুল সাহেব তাঁর বাড়ির পেছনে খোলা মাঠে ট্রেনিং-এর ব্যাবস্থা করেছেন। ব্যবস্থা করেছেন কমান্ডারদের থাকা খাওয়ার। গ্রামের পুরুষেরা ক্যাম্পে লম্ফঝম্প করছে , কখনও লেফট রাইট করছে ,কখনও বুক ছেঁচড়ে সামনে এগুচ্ছে আবার পেছনে যাচ্ছে । কখনও ডিগবাজি খাচ্ছে ,কখনও বা মেশিন গান রুপী এক হাত লম্বা লাঠির উপর একচোখে লক্ষ্যস্থির করছে । এসব মরিয়ম বিবি তার দুই নাবালক ছেলেকে নিয়ে দূর থেকে পর্যবেক্ষন করে । রমিজুদ্দিন এবং তমিজুদ্দিন বয়সে ছোট । ওরা বড়োদের এধরনের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে কখনো খিলখিল করে হেসে ওঠে ,আবার কখনো ভাবে ,যে গ্রামে এত মুক্তিযোদ্ধা সে গ্রামে কখনো মিলিটারি আক্রমণ করতে পারে ? রমিজুদ্দিনের বয়স দশ বছর । বাড়ির উঠানে গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গি প্র্যাকটিস করে । হাতের মুঠোয় ইটের টুকরো নিয়ে দাঁত দিয়ে কাটার ভঙ্গি করে দূরে ছুড়ে মারে । তারপরেই মাটিতে শুয়ে পড়ে ।ওর কান্ড দেখে মরিয়ম বিবির ঠোঁটে হাসির আভা দেখা গেলেও বুকের অতলে থির থির কাঁপন ফিরাতে পারেনা ।কলিমুদ্দিন কে জিজ্ঞেস করে ,
–হাছায় কি আমাগো দ্যাশে যুদ্ধ শুরু হইছে রমিজের বাপ ?
–হ ,মরি যুদ্ধ তো ভালা মতই শুরু হইছে । শেখ মুজিব সাব যুদ্ধের ডাক দিছে । কইছে যার যা কিছু আছে তাই নিয়া তাগো উপরে ঝাঁপাই পড়তে হইব । আমাগো আর বইস্যা থাকলে চলবো না ।আমরা রাইতেই গেরামের রাস্তা খান ভ্যাইঙ্গা ফালামু । যাতে মিলিটারির গাড়ি এই গেরামে ঢুকবার না পারে । আমরা যে কুনোদিন গেরাম ছ্যাইড়া যুদ্ধে যাইতে পারি । তুই কালই কইলাম রমিজ তমিজরে নিয়া তোর বাপের বাড়িতে চইল্যা যাবি ।
–ও কলিমুদ্দিন ভাই, ঘরে আছ নি? তাড়াতাড়ি বাইরে আহো। বড় মামুসাব জরুরি তলব করছে —গফুর শেখ কলিমুদ্দিনের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল। কলিমুদ্দিন গফুর শেখের সঙ্গে সৈয়দ বাড়িতে গেল। সেখানে কমান্ডার হাফিজুর রহমান উপস্থিত সকলকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। গ্রামের মুক্তিকামী জনতা সেখানে সমবেত হয়েছে। ব্রীজের ওপারে হানাদার বাহিনীর প্রায় শ’খানেক গাড়ি জমায়েত হয়েছে। যে কোন মূহুর্তে ওরা এই গ্রাম আক্রমণ করবে। এমন সময় ওসমান ঢালি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল, সর্বনাশ হইছে মামুসাব, মনে লয় আমরা আর রাস্তা খান ভাঙার সুযোগ পামু না। ব্রীজের ওপারে গাড়ি থেইক্যা ঝাঁকে ঝাঁকে মিলিটারি নামতেছে। ’
এই খবর শোনা মাত্র কমান্ডারের নির্দেশে যার যার মতো সবাই পজিশন নিয়ে নিয়েছে। মরিয়ম বিবি এবং গ্রামের অন্যান্য নারী ও শিশুরা গ্রাম ছেড়ে বাইরে যাবার আর সুযোগ পেল না। গ্রামের জনতার সঙ্গে পাক বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। গ্রামের বেশির ভাগ জনগণ নিরস্ত্র থাকায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হল। নারী পুরুষ শিশু দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলো। কেউ কেউ মিলিটারির গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কেউ বা প্রাণ ভয়ে খড়ের গাদায়, ধানের ডোল, পুকুরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে সটকে পড়লো। সেই যুদ্ধে কলিমুদ্দিন সহ আরও অনেক গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিল।
বকুল দাদিবুর বর্ণিত কাহিনী ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে বার্ণ ইউনিটে নতুন আগত আহত রোগীদের চিৎকারে বকুলের তন্দ্রা কেটে যায়। রোগীদের বুকফাটা আর্তনাদে সে ভীত হয়ে পড়ে। বিস্ফারিত নেত্রে বকুল তাকিয়ে থাকে আহত রোগীদের যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে। ও ভাবে বাইরে অনেক বড় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধে বুঝি সব ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। দাদিবু বলেছিল যুদ্ধের পর পাঞ্জাবীরা তাদের গ্রামের প্রতিটি বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়ালের গোরু ছাগল, হাঁস মুরগী সব পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল। এক সময় পোড়া রোগীতে পূর্ণ হয়ে যায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিট। বকুল কাঁদতে কাঁদতে মাকে ডাকে, টগরকে ডাকে, ডাকে দাদিবুকে। বাবাকে ডেকে বলে, ও বাবা, বাবাগো কে দিসে আমাগো গাড়িতে আগুন? ও বাবা আমাগো দ্যাশে কি অহনো যুদ্ধ শ্যাষ হয় নাই বাবা? দাদিবু যে কইছিল যুদ্ধ শ্যাষে পাঞ্জাবীরা তাগো দ্যাশে ফিরা গেছে। আমাগো দ্যাশ স্বাধীন হইয়া গেছে। অহন তো দ্যাশে পাঞ্জাবী নাই, তাইলে কারা বোমা মারতাছে, কারা আগুন দিতাছে, ক্যান মানুষ মারতাছে বাবা? —তমিজুদ্দিন কোন উত্তর দিতে পারেনা। বার্ণ ইউনিটে ডাক্তার, নার্স, রোগী সবাই খোঁজে বকুলের প্রশ্নের উত্তর। সবার আনত চোখের কোণে পানি গড়ায়। তমিজুদ্দিনের দু’চোখের গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজে উঠেছে বালিশ।