মজিদ মাহমুদের কবিতা

মজিদ মাহমুদের কবিতা

এক গৌণ কবির বয়ান

আমি প্রকৃতই একজন গৌণ কবি
তুচ্ছ কবি
আমিও জানি
বন্ধুরাও জানে
শত্রুরা তো আগেই পেয়েছে টের
অহেতুক বড় হওয়ার জন্য করেছি লড়াই
এ একান্ত অস্তিত্বের সংকট
তর্কের খাতিরেও যদি ধরে নিই-
আমি একজন বড় কবি
তবু তো কথা থেকে যায়
কার চেয়ে বড়, কার চেয়ে ছোট
যারা কবিতা লিখে মরে গেছে
তারা আগেই হয়ে গেছে মহাকালের অংশ
তাদের কবিতার মমার্থগুলো
অক্ষর ও শব্দগুলো
দেবতারা ভাগাভাগি করে আজ করে পাঠ
আর যে সব মহান কবি এখনো জন্মাননি
তারা ঈশ্বরের পায়ের কাছে বসে
ফেরেশতাদের কাছে শোনে
মানব জন্মের কাহিনি
কারো মাতৃগর্ভে প্রবেশের সময় হলে
বলে, চলো এক দান খেলা হয়ে যাক
অনেকটা প্যারাসুট থেকে নামতে গেলে
শিশুরা যেভাবে গুটিয়ে থাকে মর্মে
আর এই সব দেখে অনাগত কবিরা
ফিক করে ওঠে হেসে
পৃথিবীর কবিদের মূর্খতার গল্প শুনতে শুনতে
আমারই মতো তারাও মূর্খ হয়ে ওঠে
যদিও সকলেই জানে
কবিতা খুবই সাময়িক
তবু জীবন নয় কালোত্তীর্ণ অধিক!

গতি

মানুষ বিজ্ঞান নিয়ে লড়াই করে
বড়াই করে- আমারই মতো
ভাবে বিজ্ঞানহীন মানুষ নিমজ্জিত মূর্খতার পাপে
তাদের পাপমুক্ত করা আমারই দায়িত্ব
ঈশ্বর বিশ্বাসী যেমন ভাবে অকৃতজ্ঞ নাস্তিক
অনন্তকাল থাকবে প্রজ্জ্বলিত আগুনে
আমিও দেখি অবাধ্য নক্ষত্রগুলো
প্রতিদিন নিক্ষিপ্ত হচ্ছে গহীন ব্ল্যেেহোলে
পৃথিবী ঘুরছে, চাঁদ ঘুরছে যে যার পথে
পানি থেকে হাইড্রোজেন আলাদা হয়ে ছুটছে অন্তরীক্ষে
শূন্যতায় ভাসমান নক্ষত্রের মতো
শুক্রাণুগুলো খুঁজে নিচ্ছে জরায়ুর মুখ
আপেল নিচে পড়ছে মহাকর্ষের টানে
অথচ বিজ্ঞান এই সব বস্তুর গুণাগুন জেনে
শিশুদের মতো হেসে উঠছে-
তর্কে লিপ্ত হচ্ছে বন্ধুদের সাথে
হারিয়ে ফেলছে বিষ্মিত হওয়ার ক্ষমতা
কুসুম ফুটবে বলেই তো মৌমাছিরা
পাহাড়ের কন্দর থেকে বেরিয়ে এসেছে গুঞ্জরণে
প্রতিটি ডানার ঝাপটায়
আমি কেবল কুরঙ্গের ভোজ হয়ে
চিতার পেশিতে করছি গতির সঞ্চারণ।

উল্টো রথে

সত্যিই একদিন আমার টাইম মেশিন উড়ে গেল বাতাসে
নবগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ল- দূর গ্রহে
আমি দৌড়তে থাকলাম- ঠিক যেভাবে সন্ধ্যা নামার আগে
শিশুরা খেলার মাঠ থেকে মায়ের কাছে ফিরে আসে
প্রথমে শাদা চুলগুলো কালো হয়ে গেলে
যে-সব শুক্রকণা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বিভিন্ন পাত্রে
তারাও ছত্রখান হয়ে ভেঙে গেল-
মায়ের জরায়ু যদিও আমার প্রথম পছন্দ, তবু
পিতারাও বুঝে নিল তার অর্ধেক অংশ
একটি কোষ, অথচ বিভক্ত ছিল দুইটি ভাণ্ডে
এখন ভাগাভাগি হয়ে ছুটছে কিঞ্চিৎ আনন্দে
অকস্মাৎ হারিয়ে গেল শব্দের মানে- কে কার জন্মদাতা
বুঝলাম, আমিই তো পিতাদের জন্ম দিয়েছি
আমিই তো বানিয়েছি মাতামহীর অপুষ্ট জননেন্দ্রীয়
প্রথম পেলাম টের, আমরা বস্তু নই- আলোর কণিকা
এতদিন জেনেছি- জগতে সম্ভব নয় আলোর অধিক গতি
আথচ আলোরাও অসীম অন্ধকারের অবাধ্য সন্তান
তারাও কারো গর্ভ থেকে বাইরে এসেছিল
তারাও ফিরে যেতে চায়- এই উল্টো রথের চাকায়
সময় ও শূণ্যতা সংকৃচিত হয়ে- অভিন্ন সত্তায়
আলো ও শব্দের কম্পনাঙ্কে মিশে যেতে থাকে-
এক অভূতপূর্ব নৃত্যের ছন্দে-
এক সূর্য থেকে আরেক সূর্যে
আপাত দৃষ্টিতে যদিও মনে হবে
ফানেলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে তরল
তবু সবারই আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে-
সবাই এ মহাবিশ্বে একাকী ঈশ্বরের সঙ্গী।

সমাগত আড়াল

এখনো কিছু কাজ আছে বাকি
পানি শুকিয়ে গেলেও
নৌকাগুলো ঠিক কিনারে এসে ভিড়বে
জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি দেখে যাচ্ছি
দেখে যাচ্ছি বস্তুর পুনরাবর্তন
একই সূর্য প্রতিদিন উঠছে
পুব থেকে পশ্চিমে নিচ্ছে আড়াল
একই সূর্য ফিরে আসছে প্রতিদিন
পর্বত থেকে সমুদ্রে যাচ্ছে ডুবে
অস্থির সমীরণ ঝড়ের সৃষ্টি করছে
পৃথিবী মূলত মা বাবা শিশুর সংসার
শিশুরা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে
আবার উঠে যাচ্ছে পর্বতে
বৃদ্ধরা সম্পন্ন করছে উত্তর-গোলার্ধে দৌড়
দক্ষিণ গোলার্ধে উঁকি দিচ্ছে লালিমা
এখন আমার সমাগত আড়াল
এখন নেমে আসছে রাত
সূর্য যেভাবে ডুবে যায় সমুদ্রে
আমারও বিশ্রাম ঠিক বিপুল জলরাশির নিচে
অশে^র পিঠ থেকে সোয়ারি পড়ে গেলে
ঘোড়াগুলো ফিরে আসে আস্তাবলে
পুনরায় ভরে ওঠে যুদ্ধের মাঠ
ধান ও তৃণভূমি, সহযোদ্ধারা নেয় কেটে
শিষের নিচ থেকে কোমর অব্দি
এখানে আবার জেগে উঠছে ফসল
কুরঙ্গ শিশুরা খেলছে ঘাসের জমিতে
একটি ব্যাঘ্র শুয়ে আছে আয়েশি ভঙ্গিতে
রাত শেষ হলে গরুগুলো নিয়ে
আমিই ফিরে আসব জল-সিঞ্চনে।

কিয়ামত

একদিন কিয়ামত আসবে ঠিক
তাঁর কিতাবে এমনই আছে লেখা
যিশু বলেছিলেন পিতার রাজ্যের কথা
বুদ্ধ শোনান জাতক দিনের গান
শিবের নৃত্য পৃথিবীর অবসান
সুর ভেসে আসে বংশিবাদক শ্রীকৃষ্ণের থান
কি বলে শোন মানুষের বিজ্ঞান
সূর্য একদিন হারিয়ে ফেলবে তেজ
হবে পৃথিবীর অবসান
আমাদের চাওয়া নয় ভিন্ন কিছু
গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসুক শিশু
শরীর থেকে পাখিগুলো উড়ে যাক
হোক মাটি পুড়ে তপ্ত সোনা খাক
পাহাড়গুলো তুলার মতো উড়ুক
পাপের রাজ্য সঞ্চিত ধন পুড়ুক
শোন ক্ষমতালোভী ধনিক মহাজন
ফুঁৎকারে দেখ উড়ছে তোমার ধন।