বিকল্প

বিকল্প
সোমনাথ রায়
চিটেগুড়ের হাঁড়িতে হাত ডুবিয়েই মনটা মুষড়ে ওঠে বিকল্পের। বিচুলি ভরা মরা বাছুরের খোলসে এই গুড় মাখিয়ে শাবকহারা গাইয়ের মুখের সামনে ফেলে রাখতে হবে। অবোধ মা তার গা চেটে আদর করার ফাঁকে দুধ দুইয়ে নেবে বিকল্প। আজ যেন এই ধোঁকা দেয়ার ব্যাপারটাই মন সায় দিতে চাইছে না কিছুতেই। বিচুলির পালা থেকে এক আঁটি বিচুলি টেনে এনে সে তাতেই গুড় মাখিয়ে গোঁজে বাঁধা গাইয়ের মুখের সামনে ছড়িয়ে দিল।
গুড়ের গন্ধ পেয়ে গাই এপাশ ওপাশ তাকিয়ে তার শাবককে খুঁজছে। না পেয়ে গলা তুলে ‘হাম্বা’ ডাক ছাড়ল। গাইয়ের গলায় হাত বুলিয়ে বিকল্প মুখের কাছে এগিয়ে দিল সেই গুড়মাখা বিচুলি। গাই একটু একটু করে খাওয়া শুরু করেছে। ছাঁদনদড়ি দিয়ে বিকল্প গাইয়ের পেছনের দু’পা বাংলার ‘চার’ সংখ্যার আকৃতিতে বেঁধে নিল। হাঁটু ভেঙে বসে দু’পায়ের ফাঁকে বালতি চেপে রেখেছে। গাইয়ের পালান ভরে রয়েছে দুধে। চারটে বোঁটা জলবেলুনের মতো ঝুলে আছে। সরষে তেলের বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে বিকল্প গাইয়ের চারবাঁটে ভালো করে মাখিয়ে নিয়ে দু’হাত দিয়ে দুধ দোয়ানো শুরু করেছে।
গৃহপালিত গো-জীবনে কোনদিনই মায়ের দুধ সবটুকু সন্তানের কপালে জোটে না। তবে আর গৃহপালিত কেন! গৃহপালক নিংড়ে নেয়ার পরে শাবক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেটুকু চুষে নিতে পারে সেটুকুই তার বরাদ্দ। প্রথমে কিছুক্ষণ গাই চুপ করেই দাঁড়িয়েছিল। বাঁটগুলোও দুধের ভারে টাটিয়ে ছিল। বিকল্পের আঙুলের চাপে কিছুটা আরামও লাগছিল বোধ করি গাইয়ের! পালানে দুধের ভার হাল্কা হতে শরীরে স্বস্তি আসে। লেজ নাড়িয়ে পিঠের মাছি তাড়ায় সে। চ্যাঁই চুঁই শব্দে সের দুয়েক দুধে ভরে গিয়েছে বালতি। ধীরে ধীরে পা নড়াতে চেষ্টা করে গাই। দড়ির বাঁধুনিতে জুত করতে পারে না। বিকল্পও সজাগ হয় গাইয়ের উশখুসুনিতে। মাথার শিং বেঁকিয়ে লাফঝাঁপ আরম্ভ করলে বিকল্প বোঝে আর বসে থাকা যাবে না। সে তাড়াতাড়ি দুধের বালতি নিয়ে উঠে ছাঁদনদড়ি খুলে দেয়। গলার দড়ি বাঁধা গোঁজ ঘিরে পাক খেতে থাকে শোকতপ্ত গাই। মাঝেমাঝেই ‘হাম্বা’ ডাক ছাড়ে আর অস্থির হয়ে খোঁজে তার হারানো শাবককে। এখন তার কাছে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবার উপায় নেই। অগত্যা বিকল্প সেই মরা বাছুরের খোলসে গুড় মাখিয়ে গাইয়ের কাছে এগিয়ে দেয়। আদরের জিভ দিয়ে সন্তানের খোলস চাটতে চাটতে স্থির হয় গাই।
রোজই সকালে তিন-সাড়েতিন আর বিকেলে সের দেড়-দুই দুধ দেয় এই গাই। সেই দুধের বেশি অংশটাই বিক্রি করে দিতে হয় বিকল্পদের। এই বামুনবাড়িতেই কেবল জল মেশানো ছাড়া একটু খাঁটি দুধ পাওয়া যায় বলে গরু গাভিন হলেই পাড়া-প্রতিবেশিরা খোঁজ নিতে শুরু করে। কবে গাই বিয়োবে? দুধ, ঘুঁটে না বেচেও উপায় নেই ঘোষাল বাড়িতে। বিকল্পর বাবা তিন সন্তান রেখে মারা গিয়েছে বছর চারেক হলো। বিকল্পই বড়। সে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে এবছর। দুটো ছোটো বোন এখনও স্কুলে পড়ছে। প্রতিবছর পৈত্রিক জমি থেকে ধান বিচুলি আলু আসে। সারাবছর খাইখরচ চলার মতো রেখে তারও কিছুটা বেচে সংসার চালাতে হয়। তার বিধবা মা সামান্য টাকা পেনশন পায়। সুখে শোকে দিন চলে যায় তাদের।
খুব হিসেব করে সংসার চালায় বিকল্পর মা মালবিকা। দুধ বিক্রির টাকাটা তুলে রাখে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খাতে আর ঘুঁটে বিক্রির টাকাটা রাখে খোল-ভুসি কেনার জন্য। বিচুলির সঙ্গে খোল যেমন বারোমাস থাকে, গরু গাভিন হলে জাবনায় কিছুটা ভুসি ছড়িয়ে মেখে দেয় মালবিকা। এটা সে শিখেছে তার শাশুড়ির কাছে। তাঁর পরামর্শেই গাইয়ের পনেরোদিনের বাছুরটা হঠাৎ মরে গেলে মুচিপাড়া থেকে ওই বাছুরের চামড়া দিয়ে নকল বাছুর গড়িয়ে এনেছে বিকল্প।
বিকল্পর বাবা বেঁচে থাকতেই জ্যেঠুদের সঙ্গে তাদের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গেছে। বাড়িতে পার্টিশনের পাঁচিল পড়েছে। বাবা চাকরি করতেন বলে চাষের জমি দেখাশোনা করার সময় পেতেন না তিনি। জ্যেঠু জন খাটিয়ে আবাদ করান। ফসলের ভাগ বুঝিয়ে দেন। যেহেতু বিকল্পর ঠাকমা থাকে জ্যেঠুর কাছে, তাই ফসলের দু’ভাগ তিনি নিয়ে এক ভাগ দেন বিকল্পদের। তার থেকে তাদের খোরাকির বাকিটাও তিনিই বাজারে বেচে নগদ টাকা তুলে দেন মালবিকার হাতে।
অর্ধেক দুধ দুইয়ে এনে বারান্দায় বালতি নামিয়ে রাখে বিকল্প। সেখানে বাটি, গ্লাস, ঘটি রেখে গেছে যারা রোজ দুধ কিনে নিয়ে যায়। মালবিকা পোয়া মাপের গ্লাসে করে মেপে দিলে তারা নিয়ে যায়। আজ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দুধের বালতি দেখে বিকল্পকে জিজ্ঞাসা করে— হ্যাঁরে খোকা, আজ দুধ এত কম হলো কেন?
বিকল্প গলায় সুর লাগিয়ে উত্তর দেয়— ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়….’।
মালবিকা কপাল কুঁচকে বলে— হেঁয়ালি করিস না। তোর আঙুলে ব্যথা হয়েছে? টানতে পারিসনি?
—না না, সে সব কিছু নয়। আজ একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলাম, অনুমান বড় না বর্তমান বড়!
—মানে?
—আজ মনে হলো রোজই তো গাইকে ধোঁকা দিই। আজ তা না করে দেখতে চেয়েছিলাম গাইয়ের কীসের ওপর টান। বাছুরের ওপর, নাকি গুড়ের ওপর। এই ভেবে, আজ বাছুরের খোলসে না মাখিয়ে বিচুলিতে গুড় মাখিয়ে তার মুখের সামনে দিয়েছিলাম। তা দেখলাম, বর্তমান বড় হলেও অনুমান ফ্যালনা নয়। প্রথমে খানিক গুড়ের স্বাদে বিচুলি খেয়ে যাচ্ছিল, আমিও টইটম্বুর বাঁটে তেল মাখিয়ে দুধ দুইয়ে নিচ্ছিলাম। পালান কিছুটা চুপসে যেতেই তার টনক নড়ে। বাছুরের জন্য শোক চাগাড় দেয়। অমনি লাফঝাঁপ দেয়ার তাল করে। আমিও বেগতিক বুঝে উঠে পড়ি। ছাঁদনদড়ি খুলে দিতেই সে উন্মাদের মতো পাক খেতে থাকে। তারপরে বাছুরের খোলসে গুড় মাখিয়ে মুখের কাছে এগিয়ে দিতে শান্ত হয়।
ছেলের মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে মালবিকার ফরসা মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সে যেন তার নিজের জীবনের পুরনো দিনের স্মৃতিতে অসহায় বোধ করে। বিকল্প মায়ের মুখের দিকে খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। সে সংকোচের শিহরণ অনুভব করে। তারও মনে পড়ে যায় মায়ের মুখ লাল হয়ে ওঠার কারণ।
মালবিকা এগিয়ে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে— কত বড় হয়ে গ্যাছে আমার খোকা! কত কিছু বুঝতে শিখেছে! তারপর মাথা থেকে হাত নামিয়ে এনে বিকল্পর পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে— যা, কলতলা থেকে হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমি এখন বুঝতে পারছি না এই দুধের থেকে কাকে কতটুকু দেবো।
বিকল্প দ্রুত পায়ে সরে আসে বাড়ির পেছন দিকের কলতলায়। এদিকে এখন রোদের ছায়া পড়েছে। ঘরের ভেতর থেকে ছোটো দুই বোন তনু আর মনুর খুনসুটির শব্দ ভেসে আসছে। বিকল্পর সাত বছর বয়সে তনুর জন্ম হয়, আর তার দু’বছর পরে জন্মায় মনু। বাবার অফিসের ভাত দিতে মাকে সকালবেলায় রান্না চাপাতে হতো। বিকল্পই তখন মায়ের ভরসা ছিল। মাকে সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো বলে দাদার কোলেই বড় হয়েছে দুই বোন। মনুর জন্ম থেকেই হজমের সমস্যা। হাগা আর বমি লেগেই থাকত। তার খাওয়ার অনীহায় মায়ের জামা ভিজে যেত বুকের দুধে। সেই দৃশ্য মনে পড়ে বিকল্পর। আজ গাইয়ের পালান আর সেদিনের মায়ের স্তন পাশাপাশি চোখে ভাসছে বিকল্পর। মগে করে কল থেকে জল নিয়ে চোখে মুখে দিতে তার শরীরের উষ্ণতা প্রশমিত হয়।
দুধের বালতিতে থালা ঢাকা দিয়ে মালবিকা রান্নাঘরে ঢুকে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকটায় বিচুলিপালার পাশে বড় বড় মানগাছ হয়েছে। মানের চওড়া পাতায় রোদ পড়ে জ্বলজ্বল করছে। মালবিকার বুকের ভেতরটাও হুহু করে জ্বলে ওঠে। খোকার মুখে গাইয়ের পালানের বোঁটা টাটানোর কথা শোনার পরে তার নিজের জীবনে কষ্টের দিনগুলো ঝলসে ওঠে। মনুকে খাওয়াতে না পেরে কতদিন তাকে মাই টিপে দুধ ফেলে দিতে হয়েছে। চাপ দিতেই ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বাথরুমের দেয়ালে পড়েছে। শরীরের স্বস্তি হলেও রুগ্ন মেয়ের খেতে না পারার যন্ত্রণায় চোখ ফেটে জল ঝরেছে। সন্তানের মুখের ওই ক্ষুধার্ত নিষ্পেষণের অনুভূতিই আলাদা। মনুর তুলনায় খোকার সব থেকে বেশিদিন বুকের দুধে নেশা ছিল। বুকের দুধ ফুরিয়ে গেলেও তার মুখে মাই না দিয়ে ঘুম পাড়ানো যেত না। শেষকালে বুকে নিমপাতা থেঁতো করে মাখিয়ে তার নেশা কাটাতে হয়েছে। এইসব কথা মনে পড়তে আজও অবচেতনে মালবিকার গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে নামে।
গাইয়ের ‘হাম্বা’ ডাকে মালবিকার সম্বিত ফেরে। তাকে এখন পুকুরের পাড়ে বড় দড়িতে বেঁধে দিয়ে আসতে হবে। সেখানে সে ঘাস খুঁটে খাবে। চরে বেড়াবে। উনুনের হাঁড়িতে ভাতের চাল ছেড়ে দিয়ে মালবিকা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকলে গাই চঞ্চল হয়ে ওঠে। মালবিকা তার ঘাড়ে গলায় হাত বুলিয়ে আদর করে। তারপর গোঁজ থেকে দড়ি খুলে দিলে গাই পুকুর পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে। মালবিকা বড় দড়ি হাতে নিতে গিয়ে তাকে পুকুরপাড়ের গোঁজে বেঁধে দিয়ে আসে।
প্রতিবেশি শিবেনঠাকুরপোর বৌ দুধ নিতে এসেছে। সে প্রতিদিন একসের দুধ নেয়। মালবিকা তাকে বলে— তোমাদের এখন পুরো দুধ দিতে পারব না। এবেলা আধসের নিয়ে যাও। ওবেলা হলে বাকি আধসের নিয়ে যেও।
–কেন দিদি আজ কি অন্য কাউকে বেশি দিতে হবে?
—না না বোন, আজ দুধ হয়নি। যেটুকু হয়েছে সকলকেই অল্প অল্প করে দিতে হবে। গাইয়ের মর্জি!
—তা আর কী করা যাবে, ও তো যন্ত্র নয়, অবলা জীব, তার ওপর অমন বাছুরটা মরে গেল! তা দিদি আমি তোমাকে অন্য একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
–কী কথা, দুধ আর নেবে না? সে তো আজ নয় কাল ছাড়তেই হবে।
—না গো, এই খাঁটি দুধ যতদিন যেটুকু পাবো, তাই নেবো। আমি বলছিলাম বিকল্পর কথা। আমার বাবুসোনার তো এবছর ফোর থেকে ফাইভ হলো। তা ওকে যদি বিকল্প পড়াতে নেয়, সেই কথা বলছিলাম।
মালবিকার চোখের সামনে এক ঝলকে বিকল্প আরও একটু বড় হয়ে যায়। খোকা ছাত্র পড়াবে! সে চিরদিনই পড়াশোনায় ভালো। এখন কলেজে পড়ছে, নিচু ক্লাসের ছাত্র পড়াতেই পারে। বোনেদের তো সেই পড়ায়। কিন্তু বাইরের কাউকে পড়ানো মানেই কিছু রোজগার হওয়া। খোকা রোজগার করবে! আয় করবে! মালবিকা নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে— আচ্ছা, আমি খোকাকে বলব। তুমি ওবেলা এসে ওর সঙ্গেই সরাসরি কথা বোলো।
যাদের যেটুকু না দিলে নয়, তাদের সেটুকু করে দিয়ে বালতিতে জল ঢেলে জ্বাল দেয়ার জন্য তলানি দুধটুকু বাটিতে রেখেছে মালবিকা। আজ কারও স্কুল কলেজ যাওয়া নেই। না যাওয়া থাকলেও এই সময় প্রতিদিনের মতো ফেনাভাতে আলুসেদ্ধ মাখা দিয়ে তিন ছেলে মেয়েকে খেতে ডেকেছে সে। পড়ার সময়, খাওয়ার সময় বিকল্প দুই বোনকে তার দুই পাশে বসায়। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। অথচ সব সময় তাদের ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে। তাদের খেতে দিয়ে মালবিকা বলে— খোকা, শিবেনঠাকুরপোর ছেলে বাবুসোনাকে পড়ানোর জন্য ওর মা দুধ নিতে এসে বলে গেলো।
বিকল্প মুখ তুলে জানতে চায়— টাকা দেবে, না মাগনা?
মালবিকা ধমকে ওঠে— এ কী ভাষা খোকা! এটা কি মাস্টারমশাইয়ের ভাষা! তোর পাশে থেকে বোনদুটো কী শিখবে রে! ওদের কী টাকা পয়সা কম আছে যে ওরা টাকা না দিয়ে ছেলে পড়াতে পাঠাবে?
বিকল্প মুখের ভাত গিলে বলে— তা কম নেই। আর কম নেই বলেই দুধের দাম দেবার সময় গতমাসের হিসেবে দু’সের দুধ বারতি নিয়ে ভুলে গিয়েছিল! আমি সকালে এক ব্যাচ পড়াব ভাবছি। আমাদের ব্যাচের সায়নও পড়াচ্ছে। মধুকাকা বলছিলেন ওঁর মেয়েকে পড়ানোর জন্য। ওঁর মেয়ে সিক্সে পড়ে। সপ্তাহে তিনদিন অঙ্ক আর ইংরাজি পড়াতে হবে, মাসে পাঁচশ দেবে। ওই ক’দিন একসঙ্গে বাবুসোনাকেও পড়াতে পারি।
মালবিকা বলে— বিকেলে তোর সঙ্গে কথা বলতে আসবে। টাকার কথা তুই আগে কিছু বলিস না, ও কী বলে শোন। তোর বাবাকে ওরা সকলেই খুব ভালবাসত।
–বাবাকে ভালবাসার সঙ্গে ছেলেকে পড়ানোর কী সম্পর্ক আমি বুঝলাম না। গরুর দুধের ওপর ভরসা করে আমার প্রোফেসরের মাইনে, কলেজের ফিস, বোনেদের স্কুলের ফিস হবে না। তাই আমাকেও টাকা রোজগার করতে হবে।
মালবিকা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকে যায় খাবার জল আনতে। সে ফিরে এলে বিকল্প বলে— মা, ভাবছি পুকুরপাড়ে বড় একটা গর্ত করে বাছুরের খোলসটা এবার পুঁতে দেবো। বাবা মরে গেছে, ঠাকমা তো ভুলেই গেছে। আগের মতো তো আর কান্নাকাটি করে না। চোখের সামনে মরা বাছুর রেখে দিয়ে গাইকে আর কষ্ট দেবো না। যে ক’দিন যেটুকু দুধ দিতে চায় দিক, তারপর না দেয় না দেবে।
মালবিকা বলে— দেখ, যা ভালো বুঝিস।
গোয়ালঘরের কোণ থেকে বিকল্প বাছুরের খোলসটা পুকুরপাড়ে নিয়ে গিয়ে রাখে। গাই দূর থেকে দেখে দাঁড়িয়ে থাকে। মালবিকা আর দুই মেয়ে এসে দাঁড়িয়ে কাণ্ড দেখছে। ভেবেছিল গাই ছুটে আসবে তার শাবকের কাছে। না, এলো না। দূর থেকে সে শুধু তাকিয়েই আছে এই দিকে। বিকল্প কোদাল দিয়ে একটা বড় গর্ত খোঁড়ে। সেখানে কিছু বিচুলি ছড়িয়ে খোলসটা শুইয়ে দেয়। ওপরের মাটি কোদাল দিয়ে টেনে নামিয়ে গর্ত ভরাট করে দেয়। মালবিকা পায়ে পায়ে এসে গাইয়ের পিঠে হাত রাখে। তার চোখ ভিজে উঠছে। একটা ‘হাম্বা’ ডাক দিয়ে গাই পুকুরের দিকে সরে যায়। বিকল্প পুকুরের জলে কোদাল ধুয়ে উঠে আসে।