জয়ন্ত দত্তের অণুগল্প

জয়ন্ত দত্তের অণুগল্প

জয়ন্ত দত্তের অণুগল্প

ক্যাকটাস

বাগানের সব ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে।নতুন কিছু কুঁড়িও ফুটছে না।সকলেই ভীষণ বিমর্ষ ।লিলি ভেঙে পড়েছে,ওর জীবন ভীষণ একঘেঁয়ে হয়ে গেছে।কারণ ও তো গাঁদা ফুলের মত ঝকঝকে নয়।ওদিকে গাঁদা ফুলও নিজের ওপর বিরক্তিতে নেতিয়ে পড়েছে।কারণ জুঁইফুলের মত গন্ধ ওর নেই।জুঁই ফুল আবার ঈর্ষায় জ্বলছে।সুগন্ধ থাকলে কি হবে,গোলাপের মত ও জনপ্রিয় নয়।
কেবল ক্যাকটাসই বেশ আনন্দে আছে।একটি ছোট ফুল শরীরে ফুটে রয়েছে।তাতেই সে খুশি!!

লাশ

স্বাভাবিক ভাবেই আমরা যে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চাই, ভুলে থাকতে চাই –সেই মৃত্যুকে নিয়েই লোকটি ঘর করে।সকাল বেলা স্নান করে ।মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে অফিসে যায়।আমাদের মতই বাসে-ট্রামে ঘেমে নেয়ে অফিসে পৌঁছয়।খাতায় সই করে কাজ শুরু করে।বডি কাটবার জন্য টেবিলে তোলে।নামায়।পরিষ্কার করে।কখনো ডাক্তার বাবুর সাথে সেলাই করে।কখনো মাথার খুলিটাকে খুলে ফেলার কাজে হাত লাগায়।

এই তো সেদিন –জ্ঞানেশ্বরী কান্ড বা পোস্তা ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর,দলা পাকানো মৃতদেহগুলো এখানেই আনা হয়েছিল।লোকটির সামনেই বডিগুলো ব্যাকরণ মেনে পোস্টমর্টেম করে রিপোর্ট দেওয়া হয়।তবু চব্বিশ ঘন্টা বডি নিয়ে ঘর করা মানুষটার সব গুলিয়ে গিয়েছিল।বুঝতে পারছিলেন না –কোনটা হাত,পা,বুক কিংবা চোয়াল!

তবে আজ চার বছরের বাচ্চার নিথর শরীরটাকে পোস্টমর্টেমের জন্য টেবিলে তুলতে গিয়ে লোকটার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।কোন কালে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল সবার অলক্ষ্যে বাঁধ ভাঙে।তখনকার মত মুছে নিলেও যন্ত্রণাটা বুকের ভেতর থেকে যায়।তাকে চেপে রেখেই ব্যস্ত শহরের সব ভিড় অগ্রাহ্য করে লোকটি বাড়ি ফেরে।

বাবার বাড়ি ফেরার শব্দ পেয়ে চার বছরের ছোট মেয়েটি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।লোকটি অনুভব করে তাঁর শরীরটা তখনও শরীর –বডি নয়!!

শিকড়ের খোঁজে

আমার দাদু শেষ বয়সে গঙ্গার ঘাটে চুপটি করে বসে থাকতেন।কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাইতেন না।দুপুরবেলা ঘাটে বসে থাকাটা ছিল তাঁর কাছে নেশার মতন।বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়তেন।প্রায়শই আমি সে দৃশ্য দেখতাম।ঘন বর্ষায় ভরা নদীর দিকে চেয়ে তাঁর পলক পড়ে না।মাঝে মাঝে জেলে ডিঙি ভেসে যায়।লঞ্চ ছুটছে গন্তব্যে।ওপারের কোনো চিমনি চুপচাপ আকাশে কিছু খুঁজে চলেছে…।

এপারে ঘাটে স্নান সেরে গামছায় এলোচুল মুছছে ফুটপাথবাসিনী মা।পাশে বসে জিজ্ঞেস করতাম দাদুকে,’কি দ্যাখেন এতো?’
অনেকক্ষন পর মৃদু শান্ত উত্তর আসতো, ‘শি-ক-ড়’।

দাদু চলে গেছেন।বাবাও নেই বহুকাল।আজকাল আমাকেও ঐ এক রোগ গ্রাস করেছে।চুপচাপ ঘাটে গিয়ে বসে থাকি।মনে হয় শুনতে পাই দাদুর গলা— ‘দ্যাখরে পোলা, চোখ মেইল্যা দ্যাখ,আমাগো মারে…।’

আমি চেয়ে থাকি।দৃষ্টি চলে যায় বহুদূর।এপার বাংলার দামোদর-রূপনারায়ন-গঙ্গা হয়ে ওপারের মেঘনা-মধুমতী-যমুনা পেরিয়ে বহুদূরে।যেসব নদীর গন্ধ মস্তিষ্কে পৌঁছয়নি,সেসব নদীর স্বপ্ন দেখতেন দাদু।এখন আমিও মাঝে মধ্যে ভাবি,একবার যদি পারতাম লোহাগড়ার পাশে মধুমতী নদীর পাড়ে রাত কাটাতে!যেমন করে আমার মা নৌকো করে তাঁর বাপের বাড়ি ফরিদপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ছোট্ট কনে বউ সেজে…।