গল্প: সম্পর্কের অন্যভুবন

সম্পর্কের অন্যভুবন
ডঃ সুবীর মণ্ডল
বসিরহাট মহকুমা শহরের হরিমোহন দালাল গার্লস স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষিকা মালবিকা সরকার। সবাই রুমি বলে ডাকে। ডাক নাম রুমি। হাসনাবাদের টাকি শহর থেকে রোজ স্কুলে আসেন ট্রেনে, তারপর রাজুর রিকশা চেপে স্কুুুলে। প্যাডেলে একটা জোরে চাপ দিয়ে রাজু বললো , রুমি দিদি আজ কি স্কুল একটু তাড়াতাড়ি? নাকি কোনো পরীক্ষা আছে ! টোটো -অটোর বাড়বাড়ন্ত যতই হোক রাজুর রিকশা ছাড়া রুমির যে চলে না সেটা যেমন রুমি বোঝে তেমনি রিকশা চালক রাজুও জানে । তাই ৯.১৫র লোকালটা থামার পনেরো মিনিট আগে থেকেই সে আর অন্য প্যাসেঞ্জার তোলে না রিকশায়। তার জন্য রিকশা স্ট্যান্ডে এসে রুমি দিদি দাঁড়িয়ে থাকবে এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। কেউ দুটাকার জন্য দরাদরি করে আবার কেউ দু-টাকার চা খেতে দেয়, সে সম্পর্ক আলাদা কিন্তু রুমিদিদির সাথে ওর সম্পর্কটা যে ঠিক কি সেটা বোধহয় রাজুর মোটা বুদ্ধিতে ধরে না।
শুধু এটুকু বোঝে, রুমিদিদি না থাকলে তার এই বেঁচে থাকার লড়াই রিকশাটা হত না, আর তার মেয়ে সুমনা আজ উচ্চ মাধ্যমিক মাধ্যমিক পাশ দিতে পারতো না। সেই চোদ্দ বছরে যখন সুন্দরবনের কুমিরমারি গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের পূর্ণিমাকে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করেছিল তখন তো বোঝেনি সংসার কেমন জিনিস! রুমি দিদি বয়েসে হয়তো রাজুর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটই হবে কিন্তু সম্মানে ষাট বছরের বড়।এই বসিরহাট স্টেশনে নেমে মহকুমা শহরের নামকরা মেয়েদের স্কুল এইচ, এমডি হাই স্কুলে যেতে পায়ে হেঁটে সময় লাগে বড় জোর পনেরো- বিশ মিনিট। বেশির ভাগই শেয়ার টোটো করে নেয়। তাই রাজুদের মত রিক্সাওলাদের দেমাক দেখানোর দিন শেষ। আজ স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠান আছে তাই একটু আগে আসতে হলো।তোমাকে তো কাল বলে রেখেছিলাম রাজু। হন্তদন্ত হয়ে বলল রুমি। ঐ জন্যই তো আমি আগাম এই ট্রেনের পাসেঞ্জারদের মধ্যে তোমাকে খুঁজছিলাম দিদি। রুমির মুখে এক অমলিন স্মিত হাসি দেখা দিল।সরলার কি পরীক্ষা হয়ে গেছে বলে টিভি দেখে বেড়াচ্ছে, নাকি কলেজে প্রথম বর্ষের বই কিছু পড়ছে ?রাজু বললো , সন্ধেবেলা তো বই নিয়ে বসে দেখতে পাই। আমি বলে দিয়েছি ,রুমি দিদি এসে যদি খোঁজ নেয় তুই পড়েছিস কিনা ,তখন যদি পড়া দেখাতে না পারিস তোর পিঠের ছাল আমি তুলবো! রুমি বললো,তোমাকে বলেছি না অত বড় মেয়ের গায়ে হাত দিতে নেই। রাজু লজ্জা পেয়ে জিভ কামড়ালো।
রাজুর এই জিভ কামড়ানোটা বারবার দেখতে ইচ্ছে করে রুমির। এটা ঠিক বাবলুর মত। বাবলুও এমনি মাথা চুলকে জিভ কামড়াতো কোনো ভুল করে।ক্লাসে যখন ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল , বাবলু বড় হয়ে কি হতে চায় ?সে বুক ফুলিয়ে বলেছিলো , রিকশাওলা। স্কুল শিক্ষক সুবীর লাহিড়ী হাসতে হাসতে বলেছিলেন , বাংলার প্রফেসরের ছেলে রিক্সাওলা !! তা ভালো বাবা ….গণতান্ত্রিক দেশে,কেউ কারোর ইচ্ছেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাবলু তুমি আজ বাড়ি গিয়ে তোমার বাবাকে বলো তোমার ইচ্ছের কথা।
বাবলুও বাড়ি এসে শিক্ষক মহাশয়ের আদেশ মেনে কলজ থেকে ফেরার পর বাবলুুর অধ্যাপক বাবা সবে কফির মগে চুমুক দেবার সময়েই নিজের অ্যাম্বিশান সম্পর্কে বলতে শুরু করলো।
বাবা,ভেবে দেখলাম ,আমি বড় হয়ে রিক্সাওলা হবো। বিকাশ বাবু কফিতে চূড়ান্ত বিষম খেলেন। অদিতি দেবী ছুটে এসে স্বামীর মাথায় ফুঁ দিয়ে ষাট ষাট বলেছিলেন। সন্তানের এমত ইচ্ছে শুনে বাবার হৃৎপিন্ড হয়ত বন্ধই হয়ে যেত, যদি না বাবলু তার কথার পিঠে যোগ করতো ,রিকশার হর্ন বাজাতে তার বড্ড ভালোলাগে। তাই ক্লাস সিক্সেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বড় হয়ে রিক্সাওলা হবেই।
দিদি ডাক্তার বা শিক্ষিকা যাই হোক বাবলু রিকশা করে দিদিকে পৌঁছে দেবে।স্কুলের সামনে বেশ বড় করে একটা প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। কেয়াদি সাদা খোলার ওপর সবুজ কাজের একটা পিওরসিল্ক পরেই প্যান্ডেল সাজাতে ব্যস্ত। রুমিকে দেখে একবার হাত নেড়ে ডাকলো। রাজু জানতে চাইলো , সে কখন আসবে দিদিকে নিতে? রুমি বললো ,রাজুর মোবাইলে মিস কল দিয়ে দেবে। রাজুর মোবাইলটাও রুমির দেওয়া। অ্যান্ড্রয়েড ফোন কেনার পর ওর আগের ফোনটা রুমি ওকে দিয়ে দিয়েছে।
না , ভাড়ার টাকা রুমি রোজ মিটিয়ে দেয় না রাজুকে।মাসের শেষে রাজুর নামে বসিরহাট পোস্ট অফিসে যে বইটা খুলে দিয়েছে, সেটাতে ঢুকিয়ে দেয়। রিক্সাটা রুমিই কিনে দিয়েছে ওকে বছর পাঁচেক আগে। বসিরহাট স্টেশনের ধারে বসে ফালতু আড্ডা মারতো, সেই সঙ্গে একটু নেশাও করত তখন। মালগাড়ি দাঁড়ালে গিয়ে চুরি করতো। পকেটমারিও করেছে। অপরাধ জগতের অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল। দিশেহারা যাপিত জীবন । রুমির গলার হারটা ট্রেন থেকে নামার সময় আকস্মিক হামলা চালিয়ে কেউ ছিঁড়ে নেয়। রুমির চোখে জল চলে এসেছিল ,ঠাকুমার দেওয়া হার …ঠাকুমার শেষ স্মৃতি।
হঠাৎ চলন্ত ট্রেনে রাজু লাফিয়ে উঠে আবার চলন্ত ট্রেন থেকেই লাফ মেরেছিলো একজনের কলার ধরে। সেই ছেলেটিকে দু -এক ঘা মারতেই ফেরত দিয়েছিলো রুমির হারটা। রুমি কৃতজ্ঞতার বশে রাজুর হাতে টাকা দিতে যাচ্ছিলো ,কিন্তু রাজু টাকা নিতে চায়নি। রাজু বলেছিল ,কেড়ে নেবো দিদি কিন্তু ভিক্ষে নেবো না। রুমি ঠিক রাজুর এই ধরনের আচরণ মন থেকে মেনে নিতে পারে নি।
রুমি ঠোঁট কুঁচকে বলেছিলো , চুরি করতে লজ্জা করে না, ভিক্ষাতে যত অপমান! রাজু মাথা নিচু করেছিল সেদিন। মুখে কোন উত্তর ছিল না। রুমি রাজুকে নিয়ে ভাবে, জীবনের মূলেস্রাতে কিভাবে ফেরানো যায়। মন জুড়ে রাজু,অনেক ভাবার পর বেশ কিছু দিন পরই এককালীন কিছু টাকা দিয়ে রাজুকে রিক্সাটা কিনে দিয়েছিলো রুমি। ধীরে ধীরে লোনের টাকা রাজুই শোধ করেছে। অপরাধ জগতের অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া,উ রাজুর সুস্থ স্ববাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন। রুমির মন জুড়ে একটা ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে, ভালো পথ দেখানোও একজন শিক্ষিকার সামাজিক দায়বদ্ধতা।
সে অনেক বছর আগেকার কথা রুমি তখন নতুন নতুন স্কুলে জয়েন করেছে। তারপর থেকে , কিভাবে যেন রাজু আর রুমি একে অপরকে ভাই বোনের চোখে দেখতে শুরু করেছিল। রিক্সাওলাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করা দেখে স্কুলের অন্য শিক্ষিকারা অবশ্য রুমির আড়ালে হেসেছে, বিদ্রূপ করেছে । কিন্তু রাজুর ঐ মাথা চুলকে ঠোঁট কামড়ানোটাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে বাবলুুুর কথা। হোক না বাবলু ফর্সা ,সুন্দর ,মার্জিত আর রাজু অশিক্ষিত ,অপরিস্কার কিন্তু দুজনেই ওকে রুমি দিদি বলে ডাকে। না ভুল হলো , একজন ডাকতো ….আর ডাকবে না।
অন্যমনস্ক রুমি ফুলের তোড়াটা এনে কেয়াদির বদলে রমলাদিকে ধরিয়ে দিল ।
ভবিষ্যতে রিকশাওলা হবে ভেবেছিল যে ছেলেটা সে এটাও জানতো না তার ভবিষ্যৎটা মাত্র পনেরো বছরে এসে থেমে যাবে ।
দিদির পিছন থেকে চোখ ধরে সে বলতো , বলতো রুমি দি কে আছে তোর পিছনে? হ্যারিপটার না স্পাইডার ম্যান ?
রুমি বলতো ,দি গ্রেট ম্যান আমার ভাই বাবলু,
রেগে গিয়ে চোখে জল এনে বলতো ,তুই কি করে প্রত্যেকবার ধরে ফেলিস ! কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী রুমি ক্লাস সেভেনের হ্যারিপটারকে বোঝাতে পারতো না , তোর মিষ্টি গলাটাই বুঝিয়ে দেয় তুমি আমার সোনা ভাই । তোর হাতের ছোঁয়াই বুঝিয়ে দেয় তুই আমার পাগল ভাই।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে বাবলু ঠিক কি কি করবে তার একটা চার্ট বানিয়ে নিয়েছিল ও । রুমি বলেছিলো , তার আগে ভালো করে পরীক্ষাটা দে, নাহলে বাবা কিন্তু ….
হেসে বলেছিলো বাবলু , দিদিভাই তুই প্রফেসর সাহেবকে ম্যানেজ করবি কিন্তু। নিজের বাবাকে সে আড়ালে ঐ নামেই ডাকতো।
পরীক্ষাটা সে ভালোই দিচ্ছিল । শেষ পরীক্ষার দিন হল থেকে বেরিয়ে কোনোদিক না তাকিয়ে ছুটে পেরোতে চেয়েছিলো যানবাহন বহুল মেইন রোডটা।
মা চোখের সামনে দেখেছিল , একটা বালি ভর্তি গাড়ি পিষে দিয়েছিলো নিষ্পাপ স্বপ্নপূরণের বিভোর বাবলুুকে ।
ওর ঘরের দরজার পিছনে রুটিনের পাশে তখনো হাওয়ায় দুলছিল ওর তৈরি ছুটির খেলার চার্টটা।
দীর্ঘদিন মা একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি।শুধু বাবলুর ছবির দিকে তাকিয়ে গোঙানির মত একটা আওয়াজ করতো।
রুমি কলেজে গেছে ,পরীক্ষায় বসেছে ,ভালো রেজাল্টও করেছে শুধু ‘এই দিদি অত পড়ে কি হবে রে ?’বলে কেউ আর পরীক্ষার আগের দিন ওর বই বন্ধ করে দেয়নি।
কালের নিয়মে কেটে গেছে সময়। মৃত্যুশোকও ফিকে হয়ে গেছে ,কাছের মানুষের মনে।
রুমির জীবনে তমাল এসেছে ঠিক মাস্টার্সের সময়।
তমালের সাথে পরিচয়টা কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই। শীতের ছুটিতে রুমি ওর বাবা-মা মুুকুটমণিপুুরে বেড়াতে গিয়েছিলো। অম্বিকাদেবীর মন্দিরের পুজো দিতে গিয়ে রুমি খেয়াল করেছিল , একটা ফেডেড জিন্স আর ব্ল্যাক টি শার্ট পরা ছেলে বার কয়েক এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে নিজের পুজোর ডালাটা মন্দিরের সামনে নামিয়ে ঈশ্বরকে একবার প্রণাম করেই ছুট লাগলো।
মুখে একটা অপরাধী অপরাধী ভাব ছিল ছেলেটার ,সেই গোপনে কিছু করার উত্তেজনার মতন।
মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শুনলো ,ছেলেটি তার বন্ধুগ্রূপে বলছে , ওপরের দৃশ্য গুলোর ছবি তুলতে গিয়ে একটু দেরি হলো।
রুমির মাথায় দুষ্টুমি খেলে গিয়েছিলে , মন্দির থেকে ওনার পুজো হয়ে যাওয়া ডালাটা হাতে নিয়ে বলেছিল ,এই যে স্যার ! আপনাকে পুরোহিত খুঁজছিলো ….আপনার পুজোর প্রসাদীটা দেবার জন্য,এই নিন।
ছেলেটির মুখটা মুহূর্তে নিভে গিয়েছিলো।
ওর বন্ধুরা তখন ওর লেগপুলিং করতে ব্যস্ত।
রুমি কানের কাছে গিয়ে বলেছিলো , আস্তিক হওয়াটা অপরাধ নয়, সেটা লুকানোটা অপরাধ।
তারপর থেকে যে কদিন ওরা মুকুটমণিপুরে ছিল কোনো না কোনো কারণে দলছুট ছেলেটার সাথে বার বার চোখাচোখি হয়ে গেছে রুমির।
বাবা- মায়ের সাথে নিজেই এসে পরিচয় করেছে তমাল সরকার । অঙ্কে এম,এস,সি করে সবে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেছে ও । রুমির সিক্সথ সেন্স বলছিল ,তমালের সাথে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের সুতানে হঠাৎ দেখা হওয়াটা নেহাত কালতালীয় বোধহয় নয়। দুটো চোখ হয়তো সর্বক্ষণ খেয়াল রাখছে রুমিদের গতিপ্রকৃতি।
মুকুটমণিপুরের কংসাবতী জলাধারের বুকে সূর্যোদয় দেখতে যাবার লোভ বাঙালীদের চিরকালীন। সূর্যদেব কৃপা করলেও শীতের কুয়াশার জন্য হাসিমুখে
সূর্যটা তখনও ওঠেনি , চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। ১ লা, জানুয়ারি ভ্রমণ পিপাসু মানুষের শুধু দেখা যাচ্ছে । সূূর্য উঠবেকি, উঠবে না দুশ্চিন্তায় আর ঠান্ডার প্রকোপে চা খেতে যখন সবাই ব্যস্ত ,ঠিক তখন রুমি কানের খুব কাছে একটা নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেয়েছিল।
পাশ ফিরে তাকাতেই দেখেছিল তমাল। ” মুুকুটমণিপুুরের সবুজ উপত্যকাকে আর টলটলে অনন্ত জলরাশি- নীলদিগন্তকে সাক্ষী রেখে যদি
এই মুহূর্তে বলি , মুকুটমণিপুুরের নিসর্গ আমাকে পরিপূর্ন করতে চায় তাহলে বিশ্বাস করবে ? ” চুপি চুপি বলেছিলো তমাল।
রুমি বলেছিলো , পরিপূর্ন হবার মানুষের দেখা কি পেয়েছো ?
তমাল আলতো করে আঙুল তুলে রুমিকে নির্দেশ করেছিল।
উঠেছে !সূর্যদেব তার স্বমহিমায় দেখা দিয়েছে।না, সেবারের সূর্যোদয়ের মুহূর্তটা ওখানে উপস্থিত থেকেও দেখা হয়নি তমাল আর রুমির।ওদের গালে আবীর রাঙা সূর্যের প্রথম আলো পড়েছিল সবার অলক্ষ্যে। কলকাতায় ফিরে ভালোলাগা,প্রপোজ -এর গন্ডি ছাড়িয়ে ওরা একে অপরের অনেক কাছে চলে এসেছিল।
এখন দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। বিয়েও ঠিক হয়েই রয়েছে ওদের। শুধু তমালের শিলিগুড়ি থেকে বসিরহাটে ফিরে আসার অপেক্ষা।
নয়টার ট্রেনটা পেলে হয় ,ভাবতে ভাবতেই রাজুর মোবাইলে ডায়াল করলো রুমি।
তমালের ফোন …চিৎকার করছে ফোনে। কেন এত দেরি ? কিসের প্রোগ্রাম ? স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই ? এখন, এত রাতে কিভাবে ফিরবে ? লেডিসে যেন কোনোভাবেই না ওঠে রুমি। ফাঁকা হয়ে যাবে এই সময় কামরাটা।
এইসব বলে চলেছে তমাল । রুমি ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো। রাজু আসবে রিকশা নিয়ে …
তমাল বললো ,ঐ রিকশাওলা মাতাল লোকজন …রাতে মদ খাবে হয়তো ! খুব সাবধানে এসো রুমি। বেশির ভাগই লোকাল টিচার। বাইরের দুজন, বিকেল বিকেল পাস কাটিয়ে বেরিয়ে গেছে স্কুল থেকে। রুমি বেশী দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিল।
আনমনে স্কুলের গেটে এসে দাঁড়াতেই দেখলো রাজু রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাতে উঠতেই মদের কটু গন্ধটা নাকে এসে লাগলো রুমির।
তমালের কথাটা কানের ভিতর আরেকবার অনুরণন হলো।
“মাতাল রিকশাওয়ালাকে বেশি বিশ্বাস করতে যেও না। ”
অন্য দিনের মত বকবক করছে না রাজু। শুধু বললো ,বড্ড দেরি করে ফেললেন রুমিদি।
ট্রেনের খবর হচ্ছে। রাত প্রায় নটা বাজে তখন। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দশটা অবধারিত। মাকে কল করে জানিয়ে দিল রুমি ,অহেতুক চিন্তা করবে মা,বাবা।
রাজুর দিকে আর পিছন ফিরে তাকায় নি রুমি। রিকশা থেকে নেমে সোজা স্টেশনে উঠে গেছে।
ট্রেন ঢুকছে দেখে একটু শান্তি পেলো ও।
তমাল বলে দিয়েছে ,রাতের ট্রেনে কখনো যেন লেডিসে না ওঠে রুমি ।কিন্তু যে কম্পার্টমেন্টএ রুমি উঠলো সেখানেও হাতে গোনা গুটি কয়েক লোক। আসলে ছুটির দিনে হাসনাবাদ লাইনের এই ট্রেনগুলোতে যাত্রী সংখ্যা কমই থাকে। রুমির ঠিক সামনেই একটা ছেলে বসে ছিল ,মুখে শীষ দিয়ে চলেছে ,ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে মোবাইলে নানান ধরনের রগরগে ছবি সার্চ করে চলেছে। অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিল রুমি।
তিনটে স্টেশন পরই প্যাসেঞ্জার কমে কমে দশজনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী ,রুমি আর ঐ হাতে ট্যাটু আঁকা ছেলেটা। ঐধারেও আরেকজন আছে ,মুখটা গামছা মুড়ি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে। রুমির কেমন ভয় ভয় করছে।কেয়াদি বলেছিলো, রাতটা ওনার বাড়িতে থেকে যেতে। আগামীকাল রবিবার ,একবার বাড়ি ফিরেতে পারলে নিশ্চিন্তে ছুটির সকালে আটটা পর্যন্ত ঘুমুতে পারবে তাই ট্রেন ধরার সিদ্ধান্তই নিলো রুমি। আসলে এতদিন স্কুলে চাকরি করছে কোনোদিন এতো দেরি হয়নি ওর। শীতের রাতে এমনিই সন্ধে নামে তাড়াতাড়ি। ছাইপাশ ভাবতে ভাবতেই দেখলো , ছেলেটা নিজের লাল লাল দাঁত বের করে অশ্লীল ভাবে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা ঝিমুচ্ছেন।
ছেলেটি রুমির পাশে এসে বসেছে , রুমির বাঁ পাটার ওপর নিজের হাত রেখেছে। রুমি উঠে গিয়ে পাশে সরে বসতেই ছেলেটিও উঠে এলো। ফাঁকা ট্রেনে চড়-থাপ্পড় মেরে যে বিশেষ লাভ হবে না তা রুমি বেশ বুঝেছে।ছেলেটি রুমির হাত ধরতে যেতেই কেউ একটা ছেলেটির গালে সজোরে থাপ্পড় মারলো।ঘটনার আকস্মিকতায় রুমি হকচকিয়ে দেখলো ,গামছা মুড়ি দিয়ে দূরে বসে থাকা লোকটা ওর সামনে।রাজু তখন হিসহিসে গলায় বলল , রুমি দিদির গায়ে হাত ছুঁয়ে দ্যাখ শুয়োরের বাচ্চা ,হাত কেটে ঐ ট্রেনের লাইনে ফেলে দেব।ছেলেটা স্টেশন ঢোকার আগেই চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে গেল।রাজু রুমির দিকে তাকিয়ে বলল , আপনার স্টেশনটা এলে আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়েই চলে যাবো পরের ট্রেনে। আপনি বারণ করবেন বলে, কিছু না বলেই আমি রিকশা স্টান্ডএ রিক্সাটা ঢুকিয়ে দিয়ে আপনার সাথে ট্রেনে উঠলাম। আপনি দেখলে বকবেন বলে গামছাচাপা দিয়ে বসে ছিলাম… বলেই ঠিক বাবলুর মত মাথা চুলকে জিভ কাটলো রাজু।
রুমির চোখদুটো তখন জলে পূর্ণ, রুমি যদি সব বিভেদ ভুলে রাজুকে এখন বাবলুর মতো ভাই বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতো তাহলে বোধহয় সব থেকে মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি পেতো। রুমি, রাজুর মদ খাওয়া মুখের গন্ধকে উপেক্ষা করেই ওর বিবর্ণ চুলটাকে একটু ঘেঁটে দিয়ে আদর করলো।
কিছু কিছু সম্পর্ক মুকুটমণিপুরের মনোমুগ্ধকর মায়াবী পরিবেশে জন্মায় না ,রক্তের টানও থাকেনা সেখানে ,হয়তো স্টেশনের ডাস্টবিনের পাশেই জন্মানো সম্পর্ক থেকেও কখনো কখনো শিউলি কিংবা রজনীগন্ধার সুবাসও বের হয়। আর এই সম্পর্কগুলো সঠিক নাম না পেয়েও চিরন্তন জায়গা করে নেয় অন্তরের অন্তরস্থলে।