গল্প: ভগ্নাংশ

গল্প: ভগ্নাংশ

ভগ্নাংশ
শামীমা সুলতানা

জমে যাওয়া আড্ডাটা খুব বেশিক্ষণ জমতে পারে নাই সেদিন।চৈত্রের খরতাপে গলে যেতে বাধ্য হল খানিক বাদেই।কারণটা না বলাই ভালো।হয়তো বলা যেতো,তবে এতো বছরের রুটিন বাঁধা জীবনে এটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। গোপন কথা গোপনই থাক পিঞ্জরে।

তবে এটুকু জানতে পারো,একটা তাজা কষ্ট সবসময় মোচড় দেয় বুকে। ঘাই দিয়ে চিনচিনে আওয়াজ হয় যখন তখন।

বহুবছর আগে বহুক্রোশ দূরে রেখে আসা কষ্ট এটা।এই যে এখনো বুঝতে পারছি যন্ত্রণার তীব্রতা। ঠিক বা পাশের রিব থেকে বেরিয়ে সর্বাঙ্গে কার্বনের কালো যন্ত্রনা ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্যুৎ গতিতে।
প্রথম যেদিন যন্ত্রনাটা বুঝতে পেরেছিলাম, ভেবেছিলাম শব্দটা বটফলের টুপ করে ঝরে পড়ার টুংটাং ক্ষণস্থায়ী আওয়াজ।এমন আচ্ছন্নতা আমার জীবনে এটাই প্রথম।তাই অভিজ্ঞতার অ–টুকু বুঝতেই পেরিয়ে গেল খানিকটা সময়।

তারপর হিংসের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকলো।পুড়লো সাইবেরিয়ান অরণ্য, জলজ বৃক্ষরাজিও পুড়লো,সমুদ্র শুকিয়ে গিয়ে মরুময় হল। সেইসাথে লণ্ডভণ্ড হল বন্ধুদের নিয়ে শুরু হওয়া পরিকল্পিত আড্ডা।

আমরা দশজন বাল্যকালের সখা-সখী।ন্যাংটাকাল থেকেই নরম রোদ গায়ে মেখে বিলঝিল দাঁপিয়ে বেড়ে উঠি একসাথে।কতো পুতুলের বিয়ে দিতে বর বধূ সেজেছিলাম আমরা! কতো ট্রেন বাস রিকশার টুংটাং শব্দ বাজিয়েছি কল্পনায়।বাঁশ পাতার টিকেট কেটে প্লেন জার্নি করে পাড়ি দিয়েছি কতো জানা অজানা পথ।

আমরা বড় হতে থাকি।

ছানা পাখিদের ডানা গজায়। উড়াল দেই যে যার গন্তব্যে।শুধু আমি আর আহনাফ যেন বৃন্তের জোড়ালো গিঁট খুলতে পারিনি।দুইজন একই বৃন্তে জোর লেগে থাকলাম। অ আ ক খ থেকে শেষাব্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সর্বদায় একসাথে ।ওর নোট বই,খাতা,ব্যাগ কিংবা আয়েশি সময়ের অধিকাংশই আমার।এ যেন জন্মসূত্রে পাওয়া ব্যক্তিগত সম্পদ।এমনো দিন ছিল পড়ার চাপে অগোছালো মাতাল চুলগুলো অহনাফ বেঁধে দিত রিবনে।আমার পোশাক আমার তৈজস সব ছিল আহনাফের চেনা।কতোদিন অভুক্ত এই আমাকে খাইয়ে দিয়েছে ক্যাম্পাসেই দাঁড়িয়ে।এই আমাকে সুশৃঙ্খল রাখতে মসৃণ সুতায় বেঁধে রাখতো নিত্যদিন।

তারপর এলো সেই দিন। পরীক্ষা শেষ।ক্যাম্পাস ছেড়ে যাব চিরতরে।শেষ বিকেলে বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে।চলে আসার পূর্বক্ষণে আহনাফ আবেগের শেষবিন্দুটা ঢেলে কুসুম কুসুম রোদ গায়ে মেখে ভালোবাসার অমৃত বাণী শোনায়।সেসব শুনে আমি হেসে লুটোপুটি খাই।সেই হাসি তাচ্ছিল্যের।

কী ফাজলামি আহনাফ!পাগল হয়েছিস? নাকি আমার পরীক্ষা নিচ্ছিস? তুই আমার প্রাণের দোস্ত জানেমন বন্ধু আমার। আজ হতে চাস প্রেমিক? তোর বুকে লেপ্টে লেপ্টে ভালোবাসার বীজ বুনবো? তবে প্রাণের কথা কে শুনবে বলতো আহনাফ!

আহনাফ তোতলাতে থাকে। ওর তোতলামি দেখে আমি আরো মজা পাই।ওকে টেনে হিচড়ে রিকশায় নিয়ে যাই।আজ মনে পড়ছে দীর্ঘ সময়ে পাশে বসা আহনাফ ছিল নিশ্চুপ।আমি অনর্গল বলে যাচ্ছি।তারপর বাসার সামনে এসে নেমে যাই।

সেই যে ছেদ পড়লো দুজনার গতিপথ।ছেদ বিন্দু থেকে দুটো রেখা দুইদিকে বেঁকে গেল,তবে এই দুই রেখার ছেদ বিন্দুতে কী কোণ তৈরী হল হিসেব রাখিনি জ্যামিতিক নিয়মে। মনে যে পড়তো না তা নয়। খুবই মনে পড়ত।টেলিফোনে কথা হত। তবুও সেই খামখেয়ালিপনায় কথা।ততদিনে আহনাফ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত। আমি সংসার চাকরি আরো কতো কী নিয়ে গড়ে তুলি আপন আলয়? ডালপালায় ছেয়ে গেল আমার বৃক্ষ জীবন। শুনেছি নিহান নামক অতীব সুন্দরীকে নিয়ে আহনাফ ভালো আছে। আমিও খুশি সে সংবাদ শুনে।

করোনাকালীন জটিলতা শেষে আমরা কয়জনে সিদ্ধান্ত নিলাম কয়েকটা দিন সবাই মিলে শৈশবে ফিরবো।মৃত্যুর মিছিলে সামিল হইনি আমরা কেউ-ই।করোনাদেবীর এই করুণাকে সেলিব্রেট করতে চাইছিলাম আমরা। আমরা যে যার ঘর গৃহস্থালি এবং কর্মব্যস্ত জীবনকে কয়দিনের জন্যে বন্দি করি ছুটে আসি শৈশবের ছোঁয়া পেতে।আমাদের মিলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নদীতীরের বট তলা।

তারপর,
কথা হল অনেক। হাসাহাসি লুটোপুটি।ধ্বজভাঙ্গা জীবনে ফিরে আসে একফালি প্রাণ।আমরা হাসি। কথায় কথায় ফিরে আসে আমাদের শৈশব কৈশোর।আমাদের খুনসুটি আর হাসির স্রোত নদীর স্রোতের গতি বাড়ায়।আমাদের মিলনমেলাকে ঘিরে নদীতে ঢেউ ওঠে । ফেনিল ঢেউয়ে কুলুকুলু মাতোয়ারা সুর। শীতল হাওয়ায় কী এক সুখ। সে সুখে উচ্ছল একদল শহুরে বনসাই প্রাণ। মাটির সোঁদা গন্ধে বনসাই প্রাণগুলোতে হঠাৎ শাখা বাড়ে, শিকড় ছুঁয়ে যায় মাটির বুকে।পত্রপল্লবে বেড়ে যায় সবুজের সতেজতা।

এবার তবে নৌভ্রমণ বাকি কেন?
একে একে নৌকায় উঠছি সবাই।আহনাফ উঠে দাঁড়ায় গলুইয়ের কাছে। আমি হাত বাড়াই।
আহনাফও হাত বাড়ায়।শুধু ছুঁয়ে যাওয়া বাকি। এই সেই হাত এই সেই দোস্ত, বন্ধু আমার।যে হাত শুধুই আমার।যার প্রাণের অলিখিত মালিকানা শুধুই আমার।আমার ঠোঁট হাসছে,আমার বুক দুরুদুরু কাঁপছে। আমার হৃদস্পন্দন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।আমি চোখ বুজে হাত বাড়িয়েই থাকি।কতোক্ষণ ছিলাম এভাবে খেয়াল নেই।

কী এক শব্দে চোখ খুলি। দেখি আমি নীচেই দাঁড়িয়ে আছি তখনো।আহনাফের উষ্ণ বুকে নিহান।
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নিহানের হাত ধরে তুলে নিয়েছে নৌকায়।সুঠাম পুরুষের সবল হাত এক ঝটকায় নিহানকে তুলে নেয়।যে হাত আমাকে আগলে ছিল দীর্ঘকাল, যে বুকে খোদাই করা আমি,যে ছিল আমার পৈতৃক ভিটার মতোই নিজস্ব সম্পত্তি।আজ যেন বেদখল হল নাকি প্রবল স্রোতে আমার সম্পত্তি বিলীন হল নদীগর্ভে।আমি তো অংশীদারিত্ব বেচিনি!আমি তো ভেবেছি নিহানের কাছে সুরক্ষিত আছে আমার ভূমি।

আমি জ্বলে গেলাম। পুড়ে গেলাম। দাউ দাউ আগুন।দাবানল ছড়িয়ে পরে নিমিষে।এরপর কী হল জানিনা।হাসপাতালের বেডে যখন চোখ খুলি, আবারো সেই লেপ্টে থাকা জুটি। আমার দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটেনি আজও।ভয়ঙ্কর ট্রমাগ্রস্ত।আমি কেবলই আহনাফের ছায়া দেখি, মায়াময় প্রেম দেখি, সুশীতল স্পর্শ খুঁজি,চওড়া বুকের ওম খুঁজি।এই ঘোর লাগা জগতে সুখ কুড়াতে থাকে আমার ভগ্ন জীবন