গল্প: দ্বিতীয় ইণ্ডিয়া

দ্বিতীয় ইণ্ডিয়া
অর্পণ রায়চৌধুরী
মিরাজুল গনি চৌধুরী। আম্মু, ভাই, বউ আর চাষী আব্বুর পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সন্তান। পক্ষাঘাত মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে চিরতরে। প্রবল অনিচ্ছায় বিছানায় হেগে-মুতে ফেলেন বাধ্য হয়েই। সাফসুতরো করতে হয় ভাই সিরাজুল আর বুড়ো আব্বুকে। বউ বিরক্ত হয় মাঝে মাঝে। কাঁহাতক আর একা সব করা যায় ! তবুও সবাই সুস্থ। সুযোগ পেলে গোলমাল করে পেট। ডাক্তার দেখেশুনে বলেছেন, দোষটা জলের। খুব ইচ্ছে করে ঘরেও একটা বসিয়ে দেয় ওয়াটার পিউরিফায়ার। সেটা সম্ভব না। ইনকামের জোয়াল তো তার কাঁধে। বয়স চব্বিশ। বছর দুয়েক আগে বিয়ে। বউ কবিতা। কবিতাই তো প্রথম প্রেম তার জীবনে। এখন কবিতার গর্ভে কোন্ কবিতা লুকিয়ে আছে কে জানে !
এক.
ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা দশ। রোদে পুড়ে মিরাজুল যখন কাঁটাতারের সামনে, তখন চোখে আঙুল দিচ্ছে উজ্জ্বল প্রকাণ্ড এক তালা। এখন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না নিউরোন। হঠাৎ চোখে পড়লো পাশে ঘন্টা চিহ্নের সুইচটা। তর্জনী চাপ দিল একটু। খানিক পরে বেরিয়ে এলেন বাড়ির ভদ্রলোক। গায়ে জামা, পায়ে জুতো আর মুখে একঝুড়ি বিরক্তি।
– কী চাই ?
– স্যার, একটা ভালো কোম্পানির ওয়াটার পিউরিফায়ার আছে। এতে জলের অবাঞ্ছিত আয়রন পুরোপুরি ফিল্টারাইড হয়ে যায়। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ধাতু বা অন্য কোনো পদর্থ থেকে জলকে মুক্ত করে। প্রয়োজনীয় মিনারেলস অ্যাড করতে পারে। স্যার, এতে ওভারফ্লো –
– বাঃ ভালো ! লাগলে জানাবো আপনাকে। আসুন এখন।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জবাব দিলেন ভদ্রলোক। তারপর চলে গেলেন রাগে গজগজ করতে করতে। গালি দিলেন কি ?
ডট আটটায় নেমেছে রাস্তায়। অথচ সেল হয়নি একটাও। অন্যান্য দিন কম করে তিনটে হয়। কপাল পুড়েছে মনে হয় আজ। হাঁটতে হাঁটতে কি একটা কারণে পেছনে তাকাল মিরাজুল। প্রাচীরে কাঁটাতার দেখে কী ভাবলো কে জানে ! কবিতার কথা ? দেশের কথা ?
হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…
পকেটের ফোনটায় বেজে উঠল কবিতা। আব্বুর কল। ধড়াস করে উঠলো বুকের বামপাশে। – বলেন আব্বু –
– তুই কেমন আছস বাপ ?
– ভালো। আম্মু, কবিতা, ভাই ভালো আছে ?
– আছে। কবিতারে নিয়া একটু সিন্তায় আছি।
টুপ করে চিন্তাটা আছড়ে পড়ে আব্বুর গাছ থেকে মিরাজুলের কোলে। ক্যান, কী হইসে ?
– কাইল বারক’য় যা খাইসে দিইসে সব ওগরাইয়া। আর আইজ ডাক্তারে কয় বউয়ের নাকি সময় হইসে। আর কইসে –
ডাক্তারবাবু আর কী বলেছেন সে কথা যায় না কানে। কেউ যেন সিল করে দিয়েছে দুখানা ছিদ্রপথ। অসুস্থ মা ঘরে, বাবা হাঁপানির গলা টিপে দিনমজুরের কাজ করে মাঝেমধ্যে, ভাই ক্লাস টুয়েলভ, এতে আবার নতুন করে আর একজন ! আনন্দে আত্মহারা হবে নাকি মাথার চুল ছিঁড়বে, বুঝতে পারে না। কবিতাকে এখন শত্রু মনে হয় তার। কবিতাই কি শত্রু ? নাকি অন্য কেউ ?
দুই.
সালটা ২০১৭। সবে কলেজ পাশ করেছে মিরাজুল। কোচবিহারের একটা কলেজে ওকে ভর্তি করার দুদিন পর আব্বু আম্মুকে বলেছিল, পড়ুক। আল্লা-ভগবান মুখ তুইল্যা চাইব একদিন। আড়াল থেকে সে সব শুনেছিল। বুকের পাটায় এক-একটা পেরেক গেঁথে দিয়েছিল কথাগুলো। সময় আর পরিস্থিতি মরচে ধরিয়েছে তাতে। বেরিয়ে এসেছে ধুকধুকি যন্ত্রটা। রোদ জলের আঘাতে কতক্ষন টিকে থাকবে বলা যায় না সেকথা।
ঠিকা মজুরের কাজ সেরে একদিন ওপার থেকে এপারে এসে মা জুবেদা বিবি জানায় চিনচিন করছে বুকের বাঁদিকটা। সন্ধ্যার কোলে সূর্য ঘুমিয়ে পড়ার পর পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ব্যথা। একটু ওষুধের জন্য চোখের সামনে কেমন করতে থাকে আম্মু। উপশমের রাস্তায় কাঁটাতারের বেড়া। এতরাতে কোথায় পাবে ডাক্তার ? যাবে কার কাছে ? প্রশ্নের ঝাঁক হাজার জোনাকি হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে মিরাজুলের মাথায়। ফোনে ধরার চেষ্টা করে ওপারের ডাক্তারকে। অভাগার কপালের নেটওয়ার্ক কেড়ে নিয়েছেন বোধহয় ওপরওয়ালা।
– আব্বু, ওদের একবার বলে দেখলে হয় না ? বড্ড বোকার মতো বলে ফেলে কথাটা। বুঝতে পারে মিরাজুল নিজেও।
– এ তুই কী কস বাপ ! জানস ত নাকি উয়াদের ? হালা উয়ারা কি আমাগো মাইনষের মতো পায় ? রাগের রক্ত চলকে ওঠে মাথায়।
কথাটা তো সত্যিই। ফিরোজপু্র, ওয়ালিপুরের মতো ছোটো ছোটো নকুলদানা গ্রামগুলোর অস্তিত্ব আছে কেবল ভারতের মানচিত্রে। সত্যি আছে তো ? আসলে গ্রামগুলো কাঁটাতারের ওপারের। না না, বিদেশে নয়, দেশেই। তবু তারা দেশের নয়। ভোটাধিকার দিয়ে সম্মান করে দেশ, কিন্তু ভালোবাসে না। শাসন করে, আদর করে না। জন্ম দেয়, চলতে শেখায় না আঙুল ধরে। পরিচয় দেয় অথচ রক্ষা করে না অস্তিত্ব। ঘরে আমন্ত্রণ জানায়, আতিথেয়তা করে না। তাকিয়ে দেখে কিন্তু পারে না চিনতে। এতো ‘না’-এর মাঝে বাস। কেননা তারা না মানুষের দেশের বাসিন্দা। চিত্রগুপ্তের খাতায় ওদের নাম পরিচয় থাকলেও, ভারত রাষ্ট্রের খেরোখাতায় ওরা এক একটা সংখ্যামাত্র।
যাক গে সে কথা। মিরাজুলের আম্মুর সামনে এখন দুটি পথ খোলা। এক, অসুস্থতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে দেওয়ালে ছবি হয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। দুই, অসুস্থতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে জীবন ইনিংসের রুক্ষ্ম মাটিতে টিকে থাকা। আম্মু কোনটা বেছে নেবেন কে জানে ! তবে ওএমআরে যদি অপশন দুই নেন, তবে শেষ চেষ্টা করে সাপোর্ট দিতে পারে কাল সকাল ছ’টায় গেট খোলার পর। তেলের কুপিতে আরো একটু তেল ঢালে কবিতা। বিদ্যুৎ সন্ধ্যে থেকেই খামখেয়ালি। আকাশের ঝিলিকে নিয়মিত। অনিয়ম কেবল ঘরের বারো-চোদ্দ গজের তারে। রাত কি পেরোবে আলোয় ভালোয় ? নাকি শোঁ শোঁ বাতাসেই নিভে যাবে বাতি ? দাওয়ায় বসে কালো আকাশে ধ্রুবতারা খোঁজে মিরাজুলরা। আচ্ছা, ধ্রুবতারা কি চেনে ওরা ?
একটা ভালো উড়িয়ে আনে ভোরের বাতাস। আর একটা মন্দ খবর সূর্যের প্রথম কিরণে আছড়ে পড়ে উঠোনে। মৃত্যু ছিনিয়ে নিতে পারেনি আম্মুকে, কেবল ঘুমিয়ে পড়েছে ডানদিকের অংশটা। এটুকুই লাভ লোকসান হয়েছে মিরাজুলের। গতকাল রাতে দুটো নিউরোস্পিন ট্যাবলেট পড়লে এতটা গুরুতর হয় না তোমার মায়ের অবস্থা, ডাক্তারবাবু বলেছিলেন নাড়ী টিপে। এখন তো আর করার নেই কিছু। তবুও কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খাওয়াবে নিয়মিত। টেবিলের সাদা কাগজের ওপর খসখস করে এগিয়ে যায় কলম। আম্মুও কি এভাবে এগোতে পারবে নিজের উইকেট বাঁচিয়ে ?
তারপরই তো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল জীবনটা। ছন্দ হারিয়ে যেতে থাকে কবিতা থেকে, মন থেকে। খুব ভালো কবিতা লিখতো মিরাজুল। পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল কয়েকবার। সেইসব দিন এখন ঠাণ্ডা ঘরের লাশের মতো অতীত। চেষ্টা করলে ফিরবে কি ? ফেরাবেই। যেমন করে হোক ! গ্রানিটের মতো নিরেট প্রতিজ্ঞা করে সে।
তিন.
ফিরোজপুর জেগে উঠছে একটু একটু করে। সামনেই লোকসভা ভোট। নানা দলের লোকজন আসছেন সপ্তাহে এক-আধবার। সমস্যার কথা শুনছেন। লিখেও নিচ্ছেন কেউ কেউ। শাসকদলের শ্যামাপদবাবু তো একদিন ঢকঢক করে জল খেলেন মিরাজুলদের বাড়িতে। ও ছিল না অবশ্য। বলেছিল ভাই। এসেই বলেন, – ও জামিরচাচা আছেন নাকি বাড়িতে ? একটু জল খাওয়ান দেখি !
সবাই তো এক্কেবারে হতবাক। কম করে আট-দশজন লোক। একজনের হাতে খাতা-কলম, একজনের হাতে পাপড়ি মেলা পদ্মের মতো ছাতা।একজনের হাতে লতপত করছে কয়েকটি গাঁদার মালা। একজনের হাতে উনুনে ফুঁ দেওয়ার মতো কালো নলওয়ালা যন্ত্র। সেটা আবার লাইটের মতো ঝিলিক মারে ! একজনের হাতে নতুন শাড়ি দু’খান।
বাড়িতে সবাই অনাহুত অতিথি সৎকারে হঠাৎই কর্মব্যস্ত। আসন কই ? চেয়ার কি ? যে ঘরে রাতের বিছানা পৃথিবীর ওপর মাদুরের প্রলেপ বিছিয়ে হয়, সেখানে চেয়ার তো ইন্দ্রের সিংহাসন !
– হেই বেটি, মাদুরখান দে পাতি। উহারা বইবেন। কিন্তু গোটা উঠোন জুড়ে রোদ নাচতে থাকে ধেই ধেই করে। হালার রোদের পুঙ্গি মারি – বলেই এক চিলতে ছায়া খোঁজে জামিরচাচা।
– ও চাচা, করো কি ! আজ একেবারে বসবো না। অনেক কাজ বাকি পড়ে এখনও। অন্য একদিন বসে গল্প করবো। আতিথেয়তায় আপ্লুত শ্যামাপদবাবুর গলার স্বর যেন গলে যাওয়া আইসক্রিম।
– তা হয় ? আইসছেন গরীবের বাড়ি তা –
কী বলবে, না বলবে ভাবতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে গৃহকর্তা।
– জামিরচাচা, তোমার ছেলের বিয়েতে তো পারিনি আসতে, তাই নতুন বউমার জন্য একটা, আর চাচির জন্য একটা। ধরো ধরো –
চাচার শূণ্য হাতে কাপড়ের প্যাকেটটা গুঁজে দেয় শ্যামাপদবাবু। লজ্জায় আড়ষ্ট হাতে গড়িয়ে পড়ে উপচে পড়া ভালোবাসার প্যাকেট।
– লজ্জা পেতে হবে না। আসবো আবার। আরে, আমি তো তোমাদের লোক নাকি ? ভোটে জিতে যাওয়ার পর একটা পার্টি অফিস বসাবো এখানে। শুনতে হবে তো সকলের কথা ! চাচা, আসফাক আছে তোমাদের সাথে। জানিয়ে দিও কোনো সমস্যা হলে, দেখে নেবো।
জামিরুল গনি চৌধুরী উর্ফ জামির চাচার ঘোর কাটে ভরা হাট ভেঙ্গে যাওয়ার পর। কাউকেই তো বুলাওবা দেয়নি মিরাজুলের বিয়ের সময়। মাইল তিনেক দূরের পরাণ মণ্ডলের মেয়ে কবিতাকে ঘরে তুলেছিল গোধূলির মৃতপ্রায় আলোয়। দুয়েকটা কাকপক্ষী টের পেয়েছিল হয়তো ! আর জানতো দুটো ঘরের লোকজন। তবে নেমন্তন্ন দেওয়ার কথা এল কোত্থেকে ? যাক গে, ভাগ্যিস বসেননি উনি। বসলে মাথা কাটা যেত জামির চাচার। রাতের মাদুরে মাখামাখি রক্ত জল করা ঘামের গন্ধ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বুড়ো আব্বু। ঘোর কাটে এখন। ফিরতি আসফাকের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আসফাক, একডা কথা ক’ ত দেহি, উনি ছিলেন কেডা ? অ্যাঁরে ত আগে দেহি নাই ! কুন দ্যাশের ? মন্তির-টন্তির ?
ওয়াটার্লুর পরাজিত নেপোলিয়নের সামনে বীরের মতো একফালি হেসে আসফাক জানায় – জামির চাচা, উনি শ্যামাপদ বাবু। মন্ত্রী হবেন বলে দাঁড়িয়েছেন ভোটে। জিতলেই ফিরোজপুরের হয় ঘর হবে পাকার। মসজিদ হবে ফিরোজপুর আর ওয়ালিপুরের মাঝে। ভাঙা ঘরে আর থাকতে হবে না তোমাদের।
কথাগুলো উজ্জ্বল আলোর মতো ঝিলিক মারে বাদলা দিনের মধ্যরাতের বাজ পড়ার মতো। বে-বাক হয়ে যায় মুখ। হাঁ ধীরে ধীরে ছোটো হয়ে আসে। – হইব এসব আসফাক ? সত্যিই কি হইব ?
– হবে চাচা হবে। সব হবে। বাবু এক কথার মানুষ। মান রাখতে জানে কবুল করতেও রাজি।
– বলি কি আসফাক, বাবুরে কইয়ে ফিরোজপুর আর ওয়ালিপুরের মাঝে একটা ইস্কুল আর একটা হাসপাতাল হইল্যে ভালো হয়। তাইলে দুইডা অক্ষর চিনতে পারে পোলাপান। মসজিদে আর কাম কি কও ? ঘরে বইস্যা খোদাতালার কাছে দিমু হিসাব। ওইডা পরে হইলেও চলবো। জলের একটা কল হইবো ? কি কস ?
চোখ দুটো ছোটো করে দুপাশে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় বাবুর চর। – আপনারা ভোট দিন। আপনাদের ইচ্ছা সব পূরণ হবে।
আসফাককে হঠাৎ ফারিস্তা মনে হয় জামিরের। – হ বাপ, তোমারাই জিতব। দোয়া করব আল্লাভগবানের কাছে। জিতব, তোমরাই জিতব।
কে জিতবে ? জামিরুল গনি চৌধুরী নাকি আসফাক রহমান ? কে ?
চার.
বাধ্য হয়েই বিয়ে করে মিরাজুল। দুবেলা দুমুঠো ভাত ফোটাবার লোক চাই তো ! আম্মুর ঔষধটা শেষ হয়ে গেছে আজ কদিন হল।
– আম্মু, কাইল ওপার থেইক্যা আনুম ওষুধখান। অনেক দিন পর আম্মুকে নিজের হাতে খাইয়ে, মুখটা মুছিয়ে দেওয়ার সময় বলে কথাগুলো।
– ওষুধে কী কাম ক ত ? সেই কবে থেইক্যা খাইতাছি কমন বাড়নের কুনো কথা নাই। শুধু ত শুইয়্যা থাকি। ইহার চাইয়ে কোবতির লাইগ্যা দুগা ফলডল আনিস বাপ্। ক’দিন পর বিয়াইবো। শক্তি লাগবো শরীলে। উয়ার ওষুধ চাই। বুঝলি বাপ্ ?
অমলিন হাসি হেসে মিরাজুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আম্মু। কী ঠাণ্ডা ! কী শান্তি ! অথচ চোখের কোণে চিকচিক করে নোনা জলের স্রোত। বাষ্পে আবছা হয়ে আসে সব। এমন একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করছিল সে ? শপথে গ্রানিট টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকে জীবনের রেললাইনের ধারে। আর ট্রেন তো ওই ভারতে চলে ! এই ভারতে ট্রেন কি আসবে ?
সেদিন ফোন পেয়েই ফিরে আসে মিরাজুল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নামে কাঁটাতারের পেরিয়ে। তাই বৃথা অনুরোধ, স্ত্রীর-মায়ের অসুস্থতার কথা অকপটে স্বীকার করে ওপারে যাওয়ার অনুমতি চায় সে। বিএসএফের জওয়ানকে সহৃদয় মনে হয় তার। জওয়ান জানান – ঘর মে কোঈ মর রাহা হ্যায় তো মরনে দো না। তকলিফ কিঁউ করতে হো ? পাতা হ্যায়, থোড়া আবাদি কম কম হোক যায়েগা। হালকা হো যায়েগা পৃথবী কা বোঝ অউর হামারা ইণ্ডিয়া কা ভি।
কী নিষ্ঠুর অথচ শান্ত গলায় স্বর। খুব জানতে ইচ্ছে করেছিল, ‘ আমরা কি তবে ইণ্ডিয়ার বাইরের লোক ? আমাদের দেশ কি ইণ্ডিয়া নয় ? তেরঙ্গা ওড়াই না স্বাধীনতা দিবসে ?’ বলতে পারেনি কিছুই। চাইলেই পারতো। সেক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা এক নারীর বিধবা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তো, শয্যাশায়ী আম্মু উন্মাদ হয়ে যেতে পারতেন তাঁর বড়ো ছেলেকে হারিয়ে। পরিবার ভেসে যেত হয়তো। তাতে অবশ্য ওপারের ইণ্ডিয়ার কোনো আগুন জ্বলতো না বিদ্রোহের। জ্বলার কথাও নয়। তাকে আটকে দিল পরিবার। সারারাত এপারে খোলা আকাশে মেঘের ওজন মাপতে মাপতে কাটিয়ে পরদিন জন্মভিটায় পা ফেলে মিরাজুল। তাদের ইণ্ডিয়ায়।
সন্ধ্যের পর থেকে বাড়তে থাকে কবিতার প্রসববেদনা। কঁকিয়ে উঠছে থাকতে থাকতে। ভাই এক ছুটে গিয়ে খবর দেয় পাশের গ্রামের ধাইমা নারানিকে। সন্ধ্যার সাথে অন্ধকার নামে ঝুপ করে। টের পায় না ঘরের লোকেরা।
ধাইমা আসার পর থেকেই শুরু করে দিয়েছে নিজের কাজ। শত চেষ্টার পরও অধরাই থেকে যায় আসমানের চাঁদ। এদিকে অচৈতন্য কবিতা। দুপাশের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। বারবার খবর নেয় মিরাজুল। জল ভেঙেছে অনেকক্ষণ আগেই। অথচ খোকা-খুকির দেখা নেই। বোধশক্তি লোপ পেতে থাকে তার। কর্তব্য অস্থির করে তোলে তাকে। দুটো বাঁশের মাঝে কাঁথা দিয়ে শুইয়ে দেয় কবিতাকে। ঠিক-ভুল, সম্ভব-অসম্ভব বাছবিচার না করেই কাঁটাতারের বেড়ায় উপস্থিত হয় তারা।
অনেক হাঁকাহাঁকির পর এসে পৌঁছান বিএসএফের দুজন জওয়ান। – ইতনা শোর মাচাতে হো কিঁউ ? আসমান ফাড়না হ্যায় ক্যায়া ?
– স্যার, বউটা আমার প্রসব করতে পারছেনা। কষ্ট পাচ্ছে ভীষণ। ডাক্তার দরকার স্যার। না হলে বউ-বাচ্চা মরে যাবে সব। কাঁটাতারের ওপারে হাঁটু মুড়ে এপারে আসার আর্জি জানায় মিরাজুল। কাকুতি ভেজা সোঁদা গন্ধে দুমড়ে যেতে থাকে তার আসন্ন পিতৃ-হৃদয়। নোনাজলের বাঁধ আলগা হয়ে আসে নিমেষে।
– অব তো কুছ হোগা নেহি। হো নে দো সুবা। ফির দেখুঙ্গা। শীতল স্বর শীতল স্রোত বইয়ে দেয় মিরাজুলের শিরদাঁড়া দিয়ে। চলে যেতে তারা উদ্যত।
– স্যার, একটু রেহেম করুন। সব শেষ হয়ে যাবে আমার – বলত বলতে কাঁটাতারের ওপারে হাত বাড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে অসহায়ভাবে।
মুহুর্তে সুর সপ্তমে চড়ে জওয়ানদের। – শালো, তুমলোগোকো সিধে বাত সমঝ নেহি আতা ? নিকালো হাথ। নেহি তো তোড় ডালেঙ্গে। বলেই বুটশুদ্ধ পা ওপরের দিকে তোলে এক জওয়ান।
– স্যার, স্যার –
আকুতির গলা মাড়িয়ে ভারী বুটের খটখট শব্দ দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যায় নারানি। রক্ত মেখে দুহাতের রঙ লাল। রক্তে ভেসে যায় ওপারের ইণ্ডিয়া। সন্তানকে স্বাধীনতা দিতে চেয়ে রক্তাক্ত মা।
– আসছে আসছে –
নারানির গলায় উছলে ওঠে উচ্ছ্বাস। – এ যে পা আসছে বেরিয়ে –
দুশ্চিন্তার কালো মেঘে ভারী হয়ে আসে গলা। কথায় অগোছালো ভয়ের ছাপ।
– এক টুকরো কাপড় দে বাপ্ মিরাজুল। জল লাগব জামির ভাই।
না মানুষের ভূমিতে জন্ম নেয় ইণ্ডিয়ার সন্তান। সে কোন ইণ্ডিয়ার, সে প্রশ্ন পরে করবে মিরাজুল। নাড়ী কেটে মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করে নারানি। অসাড় শিশুর মুখ থেকে আসে না কান্নার শব্দ। সদ্যোজাতের বুকে পিঠে হাত ঘষতে থাকে ধাই। কাঁদি কেটে নেওয়া কলা গাছের মতো মুষড়ে পড়তে থাকে কবিতা। রিখটার স্কেলকে তুচ্ছ করে তাকে নাড়াতে থাকে মিরাজুল।
শরীর দুটোতে প্রাণের স্পন্দন কখন আসবে বলতে পারে না কেউই। সন্তানের কাছে গিয়ে দেখে, সে বাবা হয়েছে খুকুমণির। রা কাড়েনা কেউ। এখন একফালি সূর্যের জন্য অনন্ত অপেক্ষা। অনন্ত প্রতীক্ষা ওপার ইণ্ডিয়া থেকে এপার ইণ্ডিয়ায় আসার। তার আগে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে অনেক বিভীষণের কাছে পরাজিত হতে হবে একালের ইন্দ্রজিৎ-দের।
চাঁদের জোছনা আলোর টুকরি সমানভাবে খুলে দিয়েছে এপার ইণ্ডিয়ায়, ওপার ইণ্ডিয়ায়। কাঁটাতারে উপচে পড়ছে আলো। এমন মায়াবী রাত কোনো কালের কোনো সাহিত্যে আছে কিনা কে জানে ! কী একটা পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল দূরে। এমন জোছনা রাতেই বোধহয় হাতি, ঘোড়া নাচে আর বিয়ে হয় খুকুমণির !