গল্প: একটি জীবন

গল্প: একটি জীবন

একটি জীবন
সুধাংশুরঞ্জন সাহা

আচমকাই কারখানায় লক আউট ঘোষণার খবরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল নিমাই। নিমাই সামন্ত। বেহালা সরশুনায় ভাড়া বাড়িতে থাকে। চাকরি করে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, টায়ার কর্পরেশনে।সময়টা নয়ের দশক। দিশেহারা নিমাই। ঘরে তিন তিনটে পেট। ছেলেটা মাধ্যমিক দেবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কীভাবে চলবে সংসার, ছেলের পড়াশোনা, ভেবে ভেবেই দিশাহারা নিমাই । ছেলেবেলা থেকেই শরীরচর্চা করা সুঠাম দেহের অধিকারী নিমাইয়ের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বছর খানেক আগে মদনমোহনতলায় কুড়িয়ে বাড়িয়ে দু’কাঠার একটা নিচু জমির প্লট কিনেছিল।জলের দামে, মাত্র পাঁচ হাজার টাকায়। পাশেই পরিত্যক্ত ঝিল। মশার জন্মভূমি।তা যাই হোক।
সেখানে টালি, দর্মা দিয়ে একটা ঘর তুলে নিতে পারলে ঘর ভাড়াটা অন্ততঃ বেঁচে যায়। আর অবশিষ্ট জায়গায় সব্জি লাগালে বাজার থেকে সব্জিও কিনতে হবে না । সঙ্গে টুকটাক হাতের কাজ করলে সংসারটা মোটামুটি চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। বাড়িতে স্ত্রী ও ছেলে বাপ্পার সঙ্গে কথা বলায় তারাও সম্মতি জানাল। শুরু হল ভাবনার রূপায়ণ। মিস্ত্রি বাজেট দিল হাজার পাঁচেক টাকার। নয়ের দশকে সেটা অবশ্য কম নয়।

সংসার খরচার টাকা থেকেই শুরু হল কাজ। নিমাই দিনরাত এক করে ফেলল ঘর তোলার জন্য। এই মাসের মধ্যেই যা করার করতে হবে।নইলে আবার এক মাসের ঘরভাড়া গুনতে হবে। সেটা হলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আনুমানিক দিন দশেকের মধ্যে ঘর রেডি হয়ে গেল। বাড়তি জমিতে বেগুন,টমেটো, লাউ,কুমড়ো, পুঁই বীজ ছড়িয়ে দিল ।

চার,পাঁচ দিনের মধ্যে নিমাই ছেলে বউকে নিয়ে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে চলে এলো নিজের বাড়িতে। পাকা বাড়ি ছেড়ে প্রথম প্রথম খুব কষ্টকর ছিল টালির চাল আর দরমার বেড়া দেয়া ঘরে থাকতে। আস্তে আস্তে সব সয়ে গেল। বীজ থেকে বেগুন,টমেটো,লাউ, কুমড়ো পুঁই চারা ফুটল। নিমাই সব কষ্ট ভুলে গেল। চারা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে নানা রকম স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকল। হাতের কাজ শুরু করতে হবে। ছেলের ছিল শিল্পীর হাত। ছোটবেলা থেকেই বানাতে পারত নানা রকম পুতুল। শোলার মালা ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস। স্কুল থেকে, নানা প্রতিযোগিতা জিতে এনেছে কত পুরস্কার। ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই শুরু করে দিল পুতুল বানানো। ছেলে পুতুল বানায় আর নিমাই সাইকেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে বিভিন্ন দোকানে দিতে থাকল। প্রথম প্রথম দোকানদার রাখতে চাইত না। নিমাই বলত এখন টাকা দিতে হবে না। বিক্রি হলে দাম দিলেই হবে। সাত দিন যেতে না যেতেই দোকান থেকে ডিমান্ড আসতে থাকে। দাদা, আপনার পুতুল বিক্রি হয়ে গেছে। এই আপনার টাকা নিন। আরো কয়েকটা পুতুল দিয়ে যাবেন। বাবা-ছেলের যৌথ ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ডাল, সব্জির পরিবর্তে মাঝে মাঝে বাজার থেকে মাছ আসে। এখন অন্তত পঁচিশটা দোকানে পুতুল যায়। আবার নানা উৎসবের ঋতুতে শোলার তৈরি ফুল, মালা ও অন্যান্য জিনিস পুতুলের সঙ্গে দোকানে দোকানে যায়।

ইতিমধ্যে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাশ করল বাপ্পা। সবাই খুব খুশি। গড়িয়াহাটের আই টি আই-এ গ্রাফিক্স টেকনোলজি নিয়ে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হল। দেখতে দেখতে এক বছর শেষ হয়ে গেল। পাশ করল পরীক্ষা। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দেখে বিভিন্ন সংবাদপত্রে চাকরির আবেদন পাঠায় এখন বাপ্পা। এভাবেই সময় কাটছিল চাকরির আবেদন পাঠানো আর পুতুল তৈরির কাজে। একদিন স্পিড পোস্টে একটা চিঠি এলো পোস্ট অফিস থেকে। প্রেরক বর্তমান দৈনিক সংবাদপত্র । ইন্টারভিউতে ডেকেছে। খুশিতে ভরে উঠল বাপ্পার মন। সঠিক দিনে ইন্টারভিউ দিয়ে এলো। খুব ভালো হল ইন্টারভিউ। মনে মনে আশায় ছিল, অপেক্ষায় ছিল। সত্যি সত্যিই দিন পনেরো পর আবার স্পিড পোস্টে চিঠি এলো। খুলে দেখে তার স্বপ্নের চাকরিতে যোগদানের চিঠি। সারা বাড়ি আনন্দে ফেটে পড়লো। এতোদিনের প্রতীক্ষার অবসান। নিমাইয়ের মুখে হাসি ফুটেছে কত বছর পর। পরের দিনই বাইপাসের বর্তমান কাগজের অফিসে গিয়ে জয়েন করল বাপ্পা। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। দুবছরের মধ্যে বাপ্পা নিজের জমানো টাকা দিয়ে বাইক কিনেছে। এখন সে বাইকেই অফিস যাতায়াত করে । পুতুলের ব্যবসাও চলছে। দু’বছর পর অফিস থেকে পেয়েছে কনফার্মেশনের চিঠি। এসবিআই থেকে লোন নিয়ে শুরু করেছে পাকা বাড়ি। ছ’মাসের মধ্যে বাড়ি তৈরি হয়ে গেল।এই বাড়ির পেছনেও ওর বাবার অবদান ভোলার নয়। বহু কষ্টের জীবনের স্থায়ী ছেদ পড়ল। সাড়া বাড়ি বাপ্পার হাতের কাজে মুখরিত। নিমাই মনে মনে বাপ্পার কাছে কৃতজ্ঞ।

বাবার সাহায্য নিয়ে বাপ্পা নতুন ছাদে বাগান করেছে। তার ছাদ বাগানে লঙ্কা, বেগুন, টমেটো, লাউ কুমড়ো, পুঁই, ঝিঙে, পালং, লাল শাকের চাষ। কেউ বাড়িতে এলে গর্ব করে সবাইকে নিমাই দেখায় । অতিথিকে কিছু না কিছু সব্জি উপহার দেয়। এমনই এক আনন্দিত প্রাণ প্রতিদিনের মতো একদিন বিকেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল দোকানে পুতুল ডেলিভারি দিতে। মুচিপাড়ার মোড়ে রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে দ্রুতগামী এক বাস চাপা দিয়ে চলে যায়। তাড়াতাড়ি করে রাস্তার, দোকানের লোকেরা কাছের বাঙুর সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। বাড়িতে খবর দেয়। ছেলেকে জানায়। ছেলে আসতে আসতেই সব শেষ। নিমাই আর চোখ মেলে তাকায়নি। হাসপাতাল তখন স্থানীয় লোকে লোকারণ্য। এক পলক নিমাইকে দেখার জন্য। সবার বিষণ্ন মুখে একটাই আক্ষেপ, এতো লড়াকু মানুষ কিন্তু লড়াই করার কোনো সুযোগই পেল না।