গল্প: হাত ঘড়ি

হাত ঘড়ি
অরূপ পালিত
সুজন সাহেবের অফিসে বেতন বন্ধ তিন মাস ধরে।মেয়েকে প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওযার সময় বলেন ,তোর কি কি লাগবে মা একটা লিষ্ট করে রাখবি।এসে মার্কেটে নিয়ে যাব। অনেক দিন ধরে সুজন সাহেব বড় মেয়ের জন্য একটি হাত ঘড়ি কিনে দিবেন বলেও কিনে দিতে পারছেন না।প্রতি মাসে একটা নয় একটা নতুন খরচ এসে হাজির হয়। ফলে বাজার না করে, বাসে না উঠে যে টাকা গুলো জমায় , একদিনে সব শেষ হয়ে যায় । যার কারণে আর বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য উনার থাকে না ।
এমনিতে স্ত্রীর জন্য প্রতি মাসে অনেকদিন ওভারটাইম করতে হয়। স্ত্রীর হাই প্রেসার, কোলেস্টেরল,ও ডায়াবেটিস সব রোগ যেন একত্রে বাসা বেঁধে বসে আছে।
সকালে মেয়ে কোচিং এ যাবার সময় , মায়ের সাথে ঘড়ির জন্য কেঁদে ফেলেছে । কোচিংয়ে পরিক্ষা দিতে হয় সময় দেখে। মেয়ের কান্না দেখে, সুজন সাহেবের বুকে ভেতরটা কষ্টে মোছড়ে উঠে। নিজের ভেতরে এক অসহায়ত্ব কষ্ট অনুভব করেন । বৌ-মেয়ের অগোচরে সুজন সাহেব , নিজের চোখের জল মুছে নিলেন।
সকালে রাস্তা ঘাট ফাঁকা , বাপ মেয়ে একা কোচিং যাবার জন্য বাহির হয়েছে। মেয়েকে সুজন সাহেব আদুরে গলায় বললো, মা আমার উপর রাগ করিস না। আজ অফিস থেকে আসার সময় ,লাকি প্লাজা থেকে তোর জন্য একটি সুন্দর দেখে ঘড়ি কিনে আনবো।
মেয়ে এখন বাবাকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না, অনেক বার একই কথা বলেছেন। অফিস থেকে এসে সবসময় বলেন ভুলে গেছি মা।
মেয়ে বাবাকে এনিয়ে কিছু বলেনি , কারণ মেয়েরও জানা আছে, বাবা কেন কিনে দিতে পারছেন না।
সকাল থেকে মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনমড়া সুজন সাহেব ,প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় ছোট মেয়েটি কে আদর করেন, আজ মেয়েটিকে আদর না করে অফিসে বেরিয়ে গেলেন। অফিসের বসের থেকে মেয়ের ঘড়ির কথা বলে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছেন, ওভারটাইম করে কাটিয়ে দিবেন।
অবশ্য বস ইব্রাহিম সাহেব সুজনকে খুবই পছন্দ করেন, অফিস থেকে নিজে সহ গিয়ে সুজনের মেয়ের জন্য একটা ঘড়ি কিনে দেন।
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে সুজন সাহেবের অফিসের বাসে আগুন লেগে যায়, বাসের সব লোক পুড়ে যায়, সেখানে সুজন সাহেবও ছিলেন, কোন লোককে চেনা যাচ্ছে না,
অফিস থেকে ইব্রাহিম সাহেবকে লাশ হস্তান্তরের দায়িত্ব দেন।
সুজন সাহেব কে হাতের মুঠোয় ঘড়ির পোড়া বেল্ট দেখে চিনতে পারেন,সবাই বলাবলি করছে, কি অদ্ভুত কান্ড, নিজে পুড়ে গেছেন, অথচ মেয়ের জন্য কেনা ঘড়িটি পুড়তে দেয়নি,হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
যে দিন ইব্রাহিম সাহেব মেয়েটির হাতে ঘড়িটি তুলে দিলেন , যত্ন করে রাখতে বলে নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলে আসেন যে কোন প্রয়োজনে দেখা করতে, কিন্ত সেটা হয়ে উঠেনি,এত বড় দুনিয়াতে কে রাথে কার খবর। সুজন সাহেবের স্ত্রী মেয়ে দুইটিকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।
জমানো টাকা না থাকায়, পরিবার টি মূহুর্তের মধ্যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়, ওদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। পাড়া পড়শী সবাই মিলে বড় মেয়ে সোহানাকে হোষ্টেলে দিয়ে আসেন, তখন সে সদ্য এইচএসসি পরীক্ষার্থী, সবাই বললো বড়ো মেয়েটি অন্ততপক্ষে এইচএসসি পরিক্ষা দিতে পারলে , গার্মেন্টসের চাকরি করে হলেও পরিবারটিকে রক্ষা করেতে পারবে।
সুজন সাহেবের মৃত্যুর মাস দুয়েক পরে হঠাৎ করে , উনার স্ত্রীও ষ্টোক করে মারা যান, শেষ পর্যন্ত্য ছোট মেয়েটির শেষ আশ্রয়স্থল হয় মামার বাড়িতে।
অনেক দিন পরে ইব্রাহিম সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে গায়নি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তারের কাছে সব মহিলা রোগী , উনার কাছে প্রয়োজন ছাড়া কোন পুরুষের় প্রবেশের অনুমতি নাই , সবাই বলে এই ডাক্তার খুবই ধার্মিক। অপারেশন রুমে ঢোকার আগে সবসময় নামাজ আদায় করে যান।
ইব্রাহিম সাহেবের স্ত্রীর জটিল রোগ দেখে , ইব্রাহিম সাহেবকে চেম্বারে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন, ইব্রাহিম সাহেব ডাক্তারের চেহারা দেখেন নি, এবং কথা হয়নি, ডাক্তার পাল্স চেক করার সময় ইব্রাহিম সাহেবের চোখে পড়ে ,ডাক্তারের হাত ঘড়ির একটি বেল্ট পোড়া, তখন মনে পরে গেল অফিস পিয়ন সুজনের কথা। ইব্রাহিম সাহেব স্ত্রীর সামনে চোখের জল ছেড়ে দিলেন, স্ত্রী মনে করলেন উনার এমন রোগের জন্য ইব্রাহিম সাহেব কান্না করছেন। অন্যান্য মহিলারা ইব্রাহিম সাহেবের বুড়ো বয়সে , স্ত্রীকে এমন ভালোবাসতে দেখে হতবাক।
ডাক্তার ইব্রাহিম সাহেবের স্ত্রী কে দেখার পর, সব রোগীর সামনে ইব্রাহিম সাহেবকে পায়ে ধরে সালাম করেন ,আংকেলে আমি আপনাকে চিনতে ভুল করিনি।
ইব্রাহিম সাহেব ”মারে” বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন, ডাক্তার স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
আংকেল আমি এখনও সেই বাবার ঘড়িটি ব্যবহার করি, এইটার মধ্যে আমি যেন বাবার গন্ধ পাই, মনে হয় বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
বাবা ঘড়িটির টাকা বোধহয় পরিশোধ করেনি , আমার চেয়ে আমার ছেলেকে বেশি কে চিনে?
বাবা আমাকে সবসময় বলতো আমি নাকি উনার মা, আর ছোট বোনটি শাশুড়ি, উনাকে বোন আদর করে ডাকতো বেবী।
উনি আমাদের সন্তান হয়ে থাকতো সবসময়।
ডাক্তার, ইব্রাহিম সাহেব কে ৫০০ টি টাকা হাতে দেন আর বলেন, আপনি বাবার হয়ে অফিসের টাকাটা পরিশোধ করে দিবেন।
ইব্রাহিম সাহেব নিজের কাছে, বিবেকের দংশনে টাকাটা নিতে না করেন নাই।
সুজন সাহেব কে ধার থেকে মুক্ত করতে টাকাটা নিলেন , আসার সময় ইব্রাহিম সাহেব, বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলেন , সুজনের পরিবারটির খবর একটি বারের জন্য হলেও কেন নিলেননি ?
আজকে অন্তত মেয়ের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হতো না।