প্রবন্ধ: সমাজ-প্রতিমায় বাঁশি ব্যবহার হয়নি

সমাজ-প্রতিমায় বাঁশি ব্যবহার হয়নি
ভবেশ বসু
একটি কাচের গ্লাস।কতবার ভাঙা যায়?শিক্ষকের প্রশ্ন একটাই।ছোটবেলায় আমাকে করা হয়েছিল।বড় বেলায় আমি করি।আমার পৃথিবীতে আমি ছোট ছিলাম।তখন বুঝতাম না।এই গ্লাসটা কি!ভাঙা কিভাবে হয়।আর কে ভাঙে।কতবারই বা ভাঙা যায়।আর কত টুকরো হবে।বাড়িতে এসে মাকে অভিযোগ করতাম।প্রতিদিন একই প্রশ্ন।উত্তর দিতে পারতাম না।মার খেতাম।শিক্ষকের চাবুক ছিল শক্ত।শরীরের কোথায়,কখন পড়বে জানা যেত না।আজ এখানে।কাল ওখানে।শরীরটা কালশিটে হয়ে গেল।একদিন কান্না আর থামে না।ঘরে এসে খাই নি।মাকে বললাম,আগে উত্তর দাও।কাল আর মুখ কালো করবো না।উত্তরটা দিয়ে ফিরবো।মা উত্তরটা দিলেন।বললেন,কাচ টুকরো হয় তিন সত্ত্বাকে ঘিরে।এক,গ্লাসটা কতদূর হতে পড়বে।দুই,গ্লাস মালিকের ইচ্ছাশক্তি।তিন,গ্লাসের কাঠামো।স্কুলে যাও।প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করবে।সেটাই হয়ে যাবে উত্তর।
সূর্যের আলোয় শরীর শক্ত হয়।সূর্যের আলোয় শরীর নরমও হবে।কতক্ষণ তুমি রোদে থাকবে,তার উপর শক্ত ও নরম নির্ভর।আলো দিয়েই অন্ধকার দূর হয়।আলো দিয়েই আগুন তৈরি।কোলের তাপ খুব বেশি।দূধ এমনই গরম হয়ে থাকে।তাতে আগুন দিলে কোল ও দুধ দুই পুড়ে।কিছুই পড়ে থাকে না।এটা বুঝতে আমার অনেক জন্ম গেল।ঘুরেফিরে এলাম।নদী সাঁতরে ওপাড়ে।একবার এপাড়ে।নদীর জল মাপা হয়নি।আমার উদ্দেশ্য কি ছিল!শুধু স্নান ?বালি দেখা।ঝিনুক কুড়ানো।গর্ত করে জল বার করা।কখনো গর্তে পড়ে যাওয়া ?পুকুর কেটেছি।দীঘি গড়েছি।তারপর কুমির।ভয় বাসা বাঁধল।হাত পা কেটে নেওয়ার ভয়।রাতে ভয়।দিনে।সকালেও ভয় যায় না।বিকালে।এভাবে আজ সন্ধ্যা হয় হয়।
বাড়ির উঠানে ছোট এক মন্দির।মায়ের মন্দির।কেউ সমাধি বলে।কেউ বলে স্মৃতিশক্তি।স্মৃতিস্তম্ভ।বাবা বলতেন,চোখের জল জমাট।বরফ পাথর।এরকম মাইল মাইল বরফ পাথর আছে।পৃথিবীর এপ্রান্ত ওপ্রান্ত।তারই কিছু বরফ-তাল সমুদ্রে আছড়ে পড়ে।তখনই গেল গেল চিৎকার।পাড় উপছে জল লোকালয়ে।আসলে মায়ের চোখ আসে।মাঝে মাঝে মা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।আমার কাছে আসে।তার কাছে।এই সভ্যতার কাছে।সমাজকে বলে,এখনো কাচ টুকরো গোনা হয়নি ?আমি কতদিন এভাবে থাকবো!সমুদ্র আমার বাসভূমি নয় খোকা।আমাকে জায়গা দাও।
আলোকবর্ষ দূর।
একটি সভ্যতা।তার মস্তিষ্ক হল সমাজ।লোকে পায়ে হাত দেয়।কোমরে।গলা বুকে।মাথায় হাত রাখে না কেউ।যিনি দেবেন তাকে পিতা হতে হয়।নারী পুরুষের চোখ,চোখই দেখেছে।পিতা মাতা হয়েই মাথায় হাত।এই নাও আমার সব।জন,জীবন,যৌবন।দেহ,আত্মা ও অস্তি।কথা,সুর গান।সকাল দুপুর রাত্রি।জন্ম,সুখ ও দুঃখ।একটি প্রাণের যা দরকার,মাথাতে তাই আছে।এই মাথাই সভ্যতার নগর বন্দর।সভ্যতা ছিল না যখন,মাথাও নেই।সমাজও অমিল।মাটি কাটছে কিছু লোক।বড় করে গর্ত করছে।দিন রাত পরিশ্রম।
―কি হচ্ছে এখানে ?
―সভ্যতা গড়া হবে।
―তারপর কি হবে ?
―সভ্যতার মস্তিষ্ক।যে যার অংশ নিয়ে ফিরবো।
এক মানব মস্তিষ্ক।তার এক এক অংশ।সেই অংশই পাখি।কীট।পোকা মাকড়।সাপ।বাঘ ভালুক।তিন ভাগ জল।স্থল একভাগ।সেই ভাগের ভেতর বন জঙ্গল।ফুল ফল।চাষ জমি।মানুষের সংসার।যেখানটা ভাবি,সেই অংশই পৃথিবী।দেশ।ছোট এক সমাজও।দেশে যা আছে,সমাজেও তাই আছে।সমাজে আছে সম্পর্ক।তাই সংসারও সবুজ।এক মাদুরে দশ সন্তান।এক লণ্ঠনে মায়ের রান্না।পিতার মহাভারত।সন্তানদের শিক্ষা দান।প্রতিবেশি,তোমারও জায়গা আছে।একে বলে সমাজ বন্ধু।শশ্মান যাত্রী।ঘড়িটা সময় দেয়।আর হাসে।সুখে হাসে।উঠানে দাঁড়িয়ে নিজের ভাগের রুটি ছিঁড়ে দিচ্ছেন মা।পাখিরা বলতো আমার মা।আমি বলতাম আমার অধিকার।মা হাসতেন।তিনিই জানতেন তিনি কার।
আকাশে মেঘ থাকলে বৃষ্টি হয়।বৃষ্টি অর্থ প্রাণ,জীবন।প্রাণের শিক্ষা।প্রাণের সম্পর্ক।ভালোবাসা।সমাজ।এক প্রকৃতিও।বৃক্ষ লতা।ফুল ফল।জীব জগৎ।বন ছিল।বনের মানুষ।বনের ঝর্ণা।নদী বয়ে যায়।ক্ষুধা আছে।খাদ্য মজুত।কাম গড়িয়ে গেছে।প্রেম থেকে যায়।প্রকৃতি ধর্ষণ হওয়ার কথা নয়।বৃক্ষের অক্ষত থাকার কথা।বৃক্ষে থাকে এক পরিবার।বৃক্ষে অসংখ্য পাতা।মানে সন্তান-সন্ততি।যেন পিতা মাতা দাঁড়িয়ে আছে।তাদের কাপড় জড়ানো গোটা পরিবার।তাদের জন্ম।তাদের শৈশব।যৌবন।তাদের বয়ঃসন্ধিকাল।বিবাহ।তারপর মৃত্যু।জন্মক্ষণে এসেছে আর একটি বৃক্ষের পরিবার।একাধিক প্রতিবেশি।মৃত্যুতেও বইছে দেহ সেই বৃক্ষ।শোক আমার।একই শোক তোমার।তারও।আনন্দ সকলে জানে।শোকও পালন।এইখান থেকেই উন্নত মস্তিষ্ক।এই মস্তিষ্কই বিজ্ঞান।রাজনীতি।অর্থ।শ্রমিক কৃষক।রাজা প্রজা।তুলসি ও তুলসিবেদী।ঠাকুর দালান।আজান।প্রার্থনা।
মায়ের উঁইঢিপির সামনে আমি।প্রদীপ দিচ্ছি।মাকে প্রদীপ দিলাম,মানে পিতাও আলোকিত।পিতার পৃথক আলো লাগে না।মাতাই আলো।মাতাই গ্ৰহ নক্ষত্র।সেদিনই প্রথম বললাম
―মা মস্তিষ্কের এক টুকরো আমিও পেয়েছি।এবার তুমি ঘরে ফিরবে।
―তুমি পেয়েছ ?দেখাও তো।
সকলেই হাতড়াই।আঁতিপাঁতি খুঁজছি।সকলে এভাবেই।আমার মতো আরো অনেকে।এক মস্তিষ্ক থেকে আর এক মস্তিষ্ক।মস্তিষ্কের বয়স কত!কার মাথা তাও মনে নেই।তার রূপ রঙ।তার আকার।তার ভৈরব।ইমন কল্যান।কিছু মনে নেই।মনে পড়ল না।এতগুলি মানুষ।সকলে যে যার মতো বর্ণনা দিল।কেউ দেব।কেউ দেবী।কেউ কেউ অসুর।মস্তিষ্ক হয়ে গেছে নিজেরাই।শুরু হয় গেল মুসলপর্ব।আসল সভ্যতা থেকে অনেকদূর।সেই প্রশ্নের গ্লাস আছড়ে আছড়ে পড়ছে।আর ভাঙছে।এক এক টুকরো এক এক মানুষ।রক্তাক্ত।জল রঙ মিলমিশ।একটি মানুষ দিয়ে আর একটি মানুষ।না,আঁকা গেল না !মানব-সমাজ তৈরি হয়েও হল না।যেন মস্তিষ্কটা আছড়ে পড়েছিল আলোকর্ষ দূর হতে।খণ্ডগুলি খুঁজেই পাওয়া যায় নি!আসলে নিয়ে ছিলাম হাড়ের টুকরো।তাই দিয়েই এতদিন বাঁধা ছিল ঘর।সমাজ।সমাজের বৈশিষ্ট্য।
ইচ্ছাশক্তি:
শশ্মান শব্দটা এনেছিল এই সমাজ।কারণ তাদের হাতে মস্তিষ্কের অংশ ছিল না।মায়ের হাডও অনেক কাজ দেয়।সেই কাজেই বিশ্বকর্মা হয় মানুষ।বিশ্বকর্মার মতো দেখতে।কাঠামো নয়।যারা বলেন অতীত ছিল।কৈশোর ছিল।বাল্য ছিল।তারা ভুল বলেছে।বাল্য ও কৈশোরের মতো দেখতে ছিল।তাই অদৃশ্য হয়েছে।এর কারণ আমাদের যাপন।দুজন নারী পুরুষ।প্রথমে ভালোবাসা।তারপর কামদেব আহ্বান।ভালোবাসা হল ব্রাহ্মণ।মন্ত্র উচ্চারণ করবে ব্রাহ্মণ।সেই সুযোগে ভোগের থালা এগিয়ে দেবে গৃহস্থ।আমরা আদি অন্ত বিপরীত কিছু করেছি।
―মা এতগুলি সন্তান,তুমি সহ্য করলে কিভাবে ?
―যেভাবে ধর্ষণ সহ্য করে নেয় নারী।
―প্রতিবাদ তো থাকবে!
―প্রতিবাদ ?সমাজে নারী পুরুষ সমান হলে ওজন সঠিক হয়।সব সময় নারী কম দামে বিক্রি হয়েছে।
―তাহলে সন্তান ?
―সন্তান মায়েরই মাংসখণ্ড।নারী কেটে টুকরো করা।
―,আর পিতা –
―পিতা সেই বলী রান্নায় সন্তুষ্ট হয়েছে।বলীর প্রতিবাদ হয় নি।
―কি বলছো মা ?
―তাই মাতা একদিন খড়্গ নেয় হাতে।পিতা শব হয়ে যায়।
―তারপর মা ?
―এখানেও পালটা অবিচার।মাতার ওজন পিতার থেকে বেশি হয়ে পড়ে!
―তাহলে কিভাবে পৃথিবী বাঁচবে ?
―যেদিন ওজন দাড়ি থাকবে না।
“ওজন দাঁড়ি”!মানে লোভমুক্ত সমাজ।মানুষ মানুষ রক্ত।সম্পর্ক নয়।নদী ভাঙবে মাঠে পলি রাখার জন্য।চাষীর লাঙলে কীট পতঙ্গের চাষও হবে।মৃত্যু নয়।
সেদিনটা মনে আছে আমার।অনেক লোক মাকে শশ্মানে নিয়ে গেল।পোড়ানো হল।জল ঢালা।তারপর সকলে কি একটা খুঁজছে।
―কি খুজছো তোমরা ?
―মায়ের অস্তি।
―অস্তিই যদি দরকার,মাকে দাহ করলে কেন ?
কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এসেছি।এ আমরা কি করলাম!মায়ের কাছে মা ছিল।মায়ের প্রাণ ছিল।মায়ের আদর অভ্যর্থনা ছিল।মায়ের মন্ত্র।মায়ের ইচ্ছা।মায়ের আলপনা।পূজা,প্রদীপ।প্রার্থনা সবই ছিল।আমরা দেখিনি ?আসলে অন্ধ সমাজ।শক্তিতে সময়কে বহন করেছি।পাহাড় কাঁধে।ঔষধ জানা ছিল না।রামায়ণে লক্ষণ হত্যা স্পষ্ট।কিন্তু অস্বীকার করেছি।হনুমান বুক চিরে রাম সীতা দেখাল।কেউ হনুমানের অস্তি দেখতে চায় নি।কারণ সকলেই দেহ চায়।কাম চায়।কামের ভক্তি।কাম সংসারের আনন্দ।সুখ।দুঃখ।সন্ন্যাসেও নিজের মুক্তির লালসা।একেই বলেছি সমাজ।এরাই প্রতিবেশি।পরিবার পরিজন।আজ অতীত ভুলতে চাইছি।অতীতে ছিল কি।মায়ের শরীর ছিল।মায়ের হাড় মজ্জা।পিতার বলিষ্ঠ শব্দ ছিল।সেই শব্দে বজ্র হয়েছে।জ্যোৎনা নামে নি।কলঙ্কটুকুই সম্বল করে রাধা এসেছে।বারবার পুনঃরাবৃত্তি।প্রেম ব্যাখ্যায় খোল বাজল।কৃষ্ণ নাম উচ্চারিত হয় পাঁচবার।রাধা এক।এমন অসমতল সমাজই শক্তির প্রশ্রয়ে নির্মিত।
ইচ্ছা যুক্ত শক্তি।ইচ্ছায় হয় ভোর।শুকতারা।পাখি ডাকে।পাখি খায়।পাখি ধান খায়।জীবাণু খায়।ফলে ফুল ফোটে।শক্তিতে ফল ছেঁড়া হয়।ফল কামড়ে ফেলে দিই।সবশেষে বৃক্ষ কাটা পড়ে।যে লোকটি বৃক্ষ কাটছে,সে ভাঙন কাঁধে নিল।রোজগার হল।বাড়ি ফিরে দেখল,কেউ বাড়ি নেই।লোকটা হাউমাউ করে কাঁদছে।সম্পর্ক সে নিজ হাতে বিক্রি করেছে।তার স্ত্রী সন্তানও একই কাজে।মেঘ জমলে খুশি হয় শিশু।জলে হাত ভেজায়।ঝড় বিদ্যুৎ হলে কাঁথা মুড়ে ঘুমায়।ভয়ে মুখ কালো।একজন সন্তানও খুঁজে পাওয়া গেল না,যার বাল্য দেখা যায়।শৈশব আছে।যৌবনে সবুজ।ইচ্ছা ও শক্তির সংযোগ না থাকায়,কাঁচখণ্ড বালির ন্যায় স্তুপিকৃত হল।আজ বস্তুত খরা।মরুভূমি সমাজ।জল নেই।শস্য নেই।ধুলা ঝড় বয়ে যায়।
গ্লাসের কাঠামো:
পাকা বাড়ি।ভালো ইঁট।সিমেণ্ট।মোটা বালি।একটা লোক বাড়ি তৈরি করছে।দিন রাত দাঁড়িয়ে আছে একভাবে।কোথাও যেন ফাঁক না থাকে।মিস্ত্রী ফাঁকি না দেয়।তার কাছে চুপিচুপি দাঁড়ালাম।ঘামে ভেজা শরীর।কালশিটে চোখ।স্নান হয় নি।খাওয়া নেই।ওজন কমেছে।দেখে খুব কষ্ট হল আমার।তবু সরাসরি প্রশ্ন।
―আপনার এই ইঁট বালিতে সমাজ গড়লেন না কেন?
―তাতে আমার লাভ ?
―আপনার বাড়ি চিরস্থায়ী হতো।
―যেভাবে রড ব্যবহার করেছি,আগামী একশো বছর–
―কিন্তু এই সমাজের পরমায়ু আর মাত্র পাঁচ বছর।
―ঠিক বুঝলাম না
―মানে সমাজ গড়েছেন জল দিয়ে।বাড়ি গড়লেন পাথর দিয়ে।জলে তো সবই ভাসে !
লোকটা সরে দাঁড়াল।আমি জানি তার মাথা আছে।একমাথা চুল।কিন্তু ভেতর ফাঁপা।লোকটা উত্তরাধিকার সূত্রে খেলনা বন্ধুক উপহার পেয়েছে।এখন তা দিয়েই বাঘ শিকার করবে।আলো দিয়ে।শব্দে।অর্থে।নকল ঘি।তাতেই জাগযজ্ঞ।অহংকার দিয়ে পূজা হয় ?
লোকটা সামান্য নয়।এই লোকই নাগরিক।এক বৃহত্তম সংসার তার।তার বীর্যেই ছেলে মেয়ে।সমাজ।রাজা।রাণী।শ্রমিক কৃষক তৈরি হচ্ছে।এই উৎসব প্রাঙ্গণ।অফিস আদালত।ছাত্র শিক্ষক।বিজ্ঞানও ভয়ংকর।লোকটা যতদিন বাঁচবে,ততদিন নদী বাঁধে মাটি পড়বে না।আর মায়ের নদী স্নানও হবে না।
বটের ঝুরি বট নয়।কিন্তু বৃক্ষটি দাঁড়িয়ে থাকার পিলার।এটি বাজারের দোলনা নয়।প্রকৃতির দোলনা।এমন একটি বৃক্ষে অসংখ্য পিলার আছে।দোলনা আছে।শৈশবে এই দোলনাই ছিল সকলের বসতবাড়ি।বৃষ্টির ছাতা।রোদের ছায়া।কিন্তু এই লোকটা একদিন করাত নিয়ে এল।সমাজের গোড়া কেটে দিল।সব বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে বলল,মাস্টার এদের রোদ বৃষ্টি রপ্তানি করতে শেখাবে।শুধু অংক।
―যদি পিতার নাম জানতে চায় ?
―আমার নাম বলবে।
―মাতার কাছে যেতে চাইলে ?
―আমি আছি।
―তার কর্মক্ষেত্র ?
―মাস্টার,তোমারও আমার কারখানায় কাজ।
―শেষ প্রশ্ন,কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলে ?
―তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাস্টার ভয়ে জবুথবু।হাতের বেত ফেলে দিয়েছে।খোকাকে আদর করে।ভালো মন্দ খেতে দেয়।শোওয়ার বিছানা।পোশাক।প্রসাধন।কিন্তু শর্ত একটাই।কেউ শব্দ করবে না।শব্দ শিখবে না।শূন্যস্থান পূরণ নেই।সব লিখে দেওয়া আছে।
―মাস্টার, আমার বড় কবিতা লেখার ইচ্ছা।
―সেই কবিতার মন্ত্র কি ?
―বাঁশির ব্যবহার।
শিক্ষক তাচ্ছিল্য করে বলল,এখনই বাড়ি যাও।
বাড়ি ফিরছে ছেলে।সর্বত্র কা কা রব।খাঁ খাঁ দুপুর।নল খুলে দেখল এতটুকু জল নেই।এত মেঘ তবু বৃষ্টি হয়নি!মেঘের গর্জন প্রতিদিন।আজ হবে।না হলে কাল।তারই উপর পথ।পথের উপর শান্ত ছেলে।কাঁধে এক ব্যাগ বই।কত অক্ষর।কত শব্দ।কত কণ্ঠ।মাস্টার কিছুই পড়ায় না।একদিন দুদিন চিৎকার করেছে।মাস্টার নির্বিকার।চোখ দুটি জলে টলমল।
চলার পথে এক ঠাকুর মণ্ডব।কি সুন্দর ঠাকুর হয়েছিল।মা এসেছিল।বাবা।একসাথে অঞ্জলি হয়েছে।পদ্ম ফুটেছিল।
―আবার ঠাকুর হবে মিস্ত্রী ?সেই ঠাকুর রাখলে না কেন ?
―ঐ ঠাকুর তো বিসর্জন হয়ে গেছে।
―কি দিয়ে ঠাকুর তৈরি!প্রতিবার বিসর্জন দিতে হয়।এবার দেখবো আমি।আমাকে দেখাও মিস্ত্রী।
ছেলে নাছোড়।বসে টড়ল ধুলায়।ছুঁড়ে ফেলে দিল ব্যাগ।ছড়িয়ে গেছে খাতা পেনসিল।কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলের।প্রতিমার ভেতর দেখছে।কিছু খড়।কিছু মাটি।নরম দড়ি।আর বাঁশ টুকরো কয়েকটি।প্রতিমা তিনদিনের বেশি থাকবে না।সেইমতো সব ব্যবহার।
―আর কিছু নেই মিস্ত্রী ?
―আর কিছু লাগবে না।রঙ করে দিলেই লোকে দেখবে।লাইন দিয়ে দেখবে।
ছেলে ছুটছে।বই খাতা ফেলে ছুটছে।জুতা ফেলে।পোশাক খুলে।চুল উড়িয়ে।পাখির চেয়ে আগে উড়ছে।সেই উঁচু বেদীটার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
―মা,পড়া শেষ হয়ে গেছে।আমার ছুটি।
―এত পড়া কিভাবে শেষ হল!কি শিখলে ?
―মাগো কাঠামোয় বাঁশ।কোনো প্রতিমায় বাঁশি ব্যবহার হয়নি।
মা হাসছে।খলখল করে হাসছে।ছেলে শিখে ফেলেছে সব।কলসিতে জল নেই।কোমর থেকে ছিটকে পড়ল কলশি।আর টুকরো ?ছড়িয়ে পড়েছে কৃষ্ণঘাট অবধি।মা কাঁদছে।সমাধি ফাটিয়ে কান্না।আকাশে কান্না।বাতাসে কান্না।কান্নার বৃষ্টিতে পুকুরে জল।ডোবা ভর্তি।নদী বেড়ে গেল। গঙ্গা নেমেছে।হাঁ করে তাকিয়ে আছে ছেলে।এই ভূমি।এই সমুদ্র।তার চোখ।শরীর।নকল মাথা।সমাজের অদ্ভুত মস্তিষ্ক ছেলের হাতে।এই প্রথম তার হাতে।মহা বিপর্যয়।কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে।বাঁশ খড় বোঝাই মস্তিষ্ক।কলঙ্ক বোঝাই বৈষ্ণব।চার যুগের ছলাকলা।খুব জোরে ছুঁড়ে দিল।এক লহমায় দূরে।ভেসে যাচ্ছে সব।
গঙ্গা,তুমি এই পথে এসো।আমাকে দেখতে দেখতে এসো।বাঁশি শুনতে শুনতে।মৃতদের জীবন দিতে দিতে।গঙ্গা আমার।নদী আমার।আমার মা।জটা থেকে নেমে এসো আজ।
ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে।মস্ত বড়।এক দীর্ঘ সুপুরুষ।কবি-ভগীরথ।