প্রবন্ধ: মুড়ির সাতকাহন এবং…

মুড়ির সাতকাহন এবং…
রেখা রায়
সকাল বেলা চোখ খুলে বিছানায় মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে ভাবছি…আজ উঠে দাঁত ঘষে কী খাব আগে। সেটা ঠিক হলে তবে ওঠাউঠির তোড়জোড় সেইমত হবে। ছেলেবেলায় তখন তো বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা আমাদের। তিনশো ষাটদিন মুড়িই ছিল দিনের প্রথম খাবার। বাকি ক-টা দিন পিঠে বা ছাতু। একটু বেলায় কাকির গোবর ছড়া দেয়া, ঘরে দোরে ছঁচ দেয়া (গোবর মাটি দিয়ে নিকোনো) ইত্যাদি বাসিকাজ শেষ হলে খিড়কি গেড়িয়ায়(পুকুরে) স্নান সেরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই এক গামলা আমানি পান্তা আর পাথরবাটিতে একটু চুনোমাছের টক বা কাঁসার বাটিতে কাঁচালঙ্কা মড়িপেঁয়াজ, সর্ষেতেল দিয়ে মাখা মাছমলা একটুখানি, সামনে ধরবে। একেই শহরে বা ওপার বাংলায় বলে মাছের ভর্তা। আমরা উবু হয়ে বসে বা তালপাতার চাটাইতে বাবু হয়ে বসে পান্তায় কাঁচালঙ্কা ডলে নুন মেখে নেব। আমার মা উবু হয়ে বসে খেতে দেখলেই চুল টেনে এক কানচাপাটি দিত। তাই বাবু হয়ে বসতাম সব সময়, আসন থাক বা না থাক। তারপর হাপুসহুপুস শব্দে সাবড়ে দেব এক গামলা পান্তা। কখনো টকেও কাঁচালঙ্কা কাঁচাতেল মাখতাম। টক মানে অনেক রকম টক। আমসি দিয়ে টক, পাকা তেঁতুলের টক বা লেবুর রস দিয়ে টক, কাঁচা আমের দিনে আমের টক, আমড়ার টক, করভাঙার(কামরাঙা) টক। আমসি আর লেবুর টকে লঙ্কাবাটা পড়তো। সেসব টাকনা দেয়া অতি সুস্বাদু পান্তাটি দিনের দ্বিতীয় কিস্তি।
পূর্ব মেদিনীপুরের এক গ্রামে জন্মেছি আমি। তখন অবশ্য জেলা ভাগ হয়নি। সপ্তাহে একদিন মুড়ি ভেজে চালনায় চেলে বালি ঝেড়েঝুড়ে ব্রিটানিয়া বিস্কুটের বড় বড় টিনে গুছিয়ে তুলে রাখত মা, কাকি বা ঠাকুমা। তখন ওরকম বিস্কুটের টিন কিনতে পাওয়া যেত। এখনো হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু কম জায়গার ছোট ছোট ঘরে তাদের জায়গা হবে কেন? তাই তো এখন সব প্যাকেটবন্দি। কিছুদিন আগেও পায়ার তলায় দুটো দুটো করে ইট দিয়ে উঁচু করা খাটের তলায় তাদের জায়গা ছিল। এখন তো বাক্সো খাট বা নীচু ইংলিশ খাট । জায়গা নেই খাটের তলায়।
এখন যেরকম ভাবে মুড়ি ভাজা হয় শহর, শহরতলি বা গ্রামে, সেরকম ভাবে ভাজা হত না তখন। দু তিন কিলো মুড়ির চাল টঁকায় (ধুচুনি)ধুয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে নুন মাখানো থাকত টঁকাতেই। জল ঝরানো ভেজা মুড়ির চাল খাঁপরিতে (কানা উঁচু মাটির বিরাট পাত্র) কাঠের বড় চাটু (হাতা) দিয়ে নেড়ে নেড়ে খটখটে শুকনো করে তুলতে হয়। শেষের দিকে মাঝে মাঝে মুখে ফেলে দাঁত দিয়ে চিপে চাল ভেঙে দেখতে হয় নাড়তে নাড়তে খটখটে শুকনো হল কিনা। দক্ষ ভাজুনিরা জানে কতটা নাড়তে হবে। নাড়তে নাড়তে হাত ভেরে আসে। থামলে চলবে না। চাল পুড়ে যাবে। মুড়ি ভালো হবে না। তারপর খাঁপরি নামিয়ে রেখে মুড়ি টানার বালিখোলায় বালি গরম হলে তাতে একমুঠো একমুঠো করে চাল ফেলে কুঁচি (নারকেল পাতার শির একগোছা, এককথায় ঝাঁটাকাঠি) দিয়ে এদিক ওদিক নাড়লেই ফট ফটাফট চড়বড় চড়বড় শব্দে চাল ফুটে উঠে ধবধবে সাদা মুড়িতে খোলা ভর্তি হয়ে ওঠে। ঠিক সময়ে হাতের কায়দায় ময়ূরের পেখমের মত কুঁচি ছড়িয়ে মুড়ি টেনে নিকোনো শুকনো মেঝেতে ফেলতে হয়। তাতে বালি কিন্তু একটুও উঠবে না। দেরি হলেই মুড়ি লাল হয়ে পড়বে বা চুঁয়ে আঙরা হয়ে যাবে। মুড়ির কাঁড়ি জমা হবে একপাশে।
তারপর মুড়ি চালনা-য় চেলে বড় মুখ টিনে ভরে রাখতে হয় মুড়ি। চালার কারণ হল…যদি বালি কিছু থেকে থাকে তো ঝরে পড়ে যাবে। চুঁয়ে যাওয়া পোড়া মুড়ি বেছে বাতিল করতে হবে। ওস্তাদ মুড়িভাজিয়েদের মুড়ি একটাও পুড়ত না। প্রতি সপ্তাহে এমন পাঁচ ছ-টা করে টিন ভর্তি মুড়ি ভাজা হত দুপুরে খাওয়ার পর, কাঠের জ্বালে। আগুন ঠিকঠাক না হলে মুড়ি ভালো হবে না। বেশ শ্রমসাধ্য মুড়ি ভাজার কাজ।
ঐ ভাবে চালভাজাও তৈরি হত। চালভাজার জন্য কিন্তু চাল অতক্ষণ নাড়তে হত না। আলুনি চালভাজার জন্য ভাতের চাল লাগে। চালভাজার চালে নুন, হলুদ, লঙ্কাবাটা মাখিয়ে ভাজত পাশের বাড়ির কাকি। বেশ লাগত খেতে। প্রথম চটকায় লঙ্কার ঝাঁঝে একটু কাশি উঠত বটে, পরে সয়ে যেত। খুদভাজাও খেতে খারাপ না। ভালো করে ধোয়া পরিষ্কার খেসারিকড়াই নুন দিয়ে কড়াতেই নাড়ত কাকি নোড়া গড়িয়ে গড়িয়ে। তারপর ঐ মুড়ির কায়দায় ভাজা। কী নরম যে হত! ভাজা কড়াই চিনি বা গুড়ের সিরায় ফেলে শুকনো করে নিলে ভারি মিষ্টি তার স্বাদ। এখন শহর বা শহরতলিতে যে ফুটকড়াই পাওয়া যায়, তার স্বাদ কিছুই না ওর কাছে। শহরের ফুটকড়াইতে দাঁত ভেঙে যাবার জোগাড়। ভাজা খেসারি কড়াই মেশানো চালভাজা ভালো লাগত চিবোতে। ছোলা মটর বাদাম ক্বচিৎ দেখেছি শৌখিন বাড়িতে। আদৌ দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমাদের বাড়িতে সেসব ছিলই না।
বালিখোলায় ধান ফেলে মুচমুচে খই ভাজা হত। ভাজা খই চালায় চেলে নেবার পরেও মাদুরে ফেলে এক মাদুর খই থেকে ধান বাছতে হত দু তিনজনকে। তারপর গুড় গলিয়ে এক ডাবু, এক ডাবু করে খই-এর ওপর ছড়িয়ে দু জন মাদুরের চারটি কোনা ধরে একটু নাড়াচাড়া করে মিশিয়ে নিলেই উখড়া। গ্রামের যে কোনো উৎসব মানে উখড়া হবেই। শহুরে মুড়কি নয় কিন্তু। শহুরে মুড়কি আর গাঁয়ের উখড়ায় আকাশপাতাল তফাৎ। উখড়ার স্বাদ গন্ধই আলাদা। ঐ ভাবে ঢেঁকিছাঁটা মোটা মোটা লাল লাল চিড়েও ভাজা হত খই ভাজার মত করে। চিড়ে ভাজা সদ্যপ্রসূতিকে দেয়া হত ঘি মাখিয়ে। গা শুকোবে। হাম বসন্তের রুগীও গায়ের রস মারতে ওটি পেত।
মুড়িভাজার দিন আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম সব ভাজা শেষ হলে তেঁতুল বীচি ভাজার জন্য। সেও ঐ বালিখোলায় ফেলে নেড়ে নেড়ে ভাজা। বীজের মেরুনরঙা খোলা ছাড়িয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে সারাদিন কটরমটর কটরমটর করে চিবিয়ে চলতাম। প্যান্টে পকেট না থাকলে চলত না তখন। খুব লোভনীয় ছিল তেঁতুলবীচি ভাজা। খুব শক্ত কিন্তু। চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতের ব্যায়াম হয়ে গেছে কত! তাই বোধহয় আজও দাঁতগুলো অক্ষত আছে। সদ্য নড়ে ওঠা দাঁত ভাঙতে ভাজা তেঁতুলবীচি তুলনাহীন। রক্তারক্তিকাণ্ড কত ঘটেছে আমাদের!
কেউ কেউ স্কুলেও নিয়ে যেত। কটরমটর শব্দ কানে গেলে দিদিমণি বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতেন। একজন শাস্তি পেলে অন্যরা মুখনাড়া বন্ধ করে মুখে অনেকক্ষণ রেখে দিত চুপচাপ। যেন মুখে কিছু নেই। তারপর মুখে থাকতে থাকতে ভিজে নরম হয়ে গেলে সেটাও বেশ লাগত চিবিয়ে খেতে।
গ্রামের অনেক অভাবী লোক ভাজা তেঁতুলবীচি ছাড়িয়ে সেদ্ধ করে খেয়ে পেট চালাত…শুনেছি।
ঐ ভাজাবীজ সেদ্ধ করে সেই জলে মাটির ঠাকুরের রঙের ওপর ফিনিসিং টাচ দিলে ঠাকুরের গা চকচকে হয়ে উঠত।
ভাতের চাল যেভাবে তৈরি হয় ধান থেকে, মুড়ির চাল সেভাবে হয় না। আলাদা ভাবে তৈরি করতে হত মুড়ির চাল। সব ধানেও মুড়ি ভাল হয় না।কোনো ধান মুড়ির জন্য তো কোনোটা ভাতের জন্য। কোনো ধান আবার আলো চালের জন্য তো কোনো ধান পায়েসের চালের জোগানদার। কোমর সমান উঁচু জালার জলে মুড়ির জন্য নির্দিষ্ট ধান ভিজিয়ে দু দিন রেখে জল থেকে ছেঁকে তুলে একবার সেদ্ধ করে আবার ভেজাতে হত দেড় দু দিন। আর একবার সেদ্ধ করে মানে দু সেদ্ধ ধান উঠোনে হেঁশের ওপর মেলে, উলটেপালটে রোদে দিন দুই শুকিয়ে কলে ভাঙাতে হত। দু চারটে ধানের ওপর গোড়ালি চেপে দাঁড়িয়ে গোড়ালি ঘুরিয়ে চাল বের করে দাঁতে ফেলে দেখতে হত ঠিকঠাক শুকনো হল কিনা। ভাতের চাল কিন্তু একসেদ্ধ হত। একসিদ্ধ চালে পিঠে ভালো হয়। চিট ভালো থাকে তাতে। খইয়ের ধান আর আলো চালের ধান সিদ্ধ করতে হয় না।
মুড়ি ভাজার জন্য বালিখোলা তৈরি হত কুমোর বাড়ি থেকে আনা পোড়া মাটির হাঁড়ির পেটের একপাশ ভেঙে ভেঙে। জলে হাঁড়ি ভিজিয়ে সাঁড়াশি দিয়ে টুক টুক করে ধীরে ধীরে একটু একটু ভাঙা শুরু হত হাঁড়ির মুখ থেকে। হাঁড়ি ভেঙে খোলা তৈরি করা ছিল কাকার কাজ। খোলামকুচি দিয়ে আগে দাগ টেনে নিয়ে ভাঙার কাজ শুরু। না ভেজালে হাঁড়ি ভেঙে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। বেশ ধৈর্যের কাজ। হাঁড়ি ভাঙা হয়ে গেলে মাথা থেকে নীচের ভাঙা লাইন বরাবর খোলামকুচি দিয়ে ঘষে ঘষে সমান বা মসৃণ করে নিত। তখন গ্রামে শিরিষ-কাগজ হয়তো পাওয়া যেত, কিন্তু মুড়ির খোলার মত অপাঙতেয় একটা জিনিসের জন্য পয়সা খরচ করে শিরিষ-কাগজ কেনার কথা কারুর মাথাতেই আসত না। মোটামুটি তৈরি হয়ে গেলে ঘরে যারা মুড়ি ভাজে সেই মা ঠাকুমা কাকিকে ডেকে দেখিয়ে তবে শেষ হত কাজ। জলে না ভেজালে খোলা তৈরি করা যাবে না। হাঁড়ি ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে প্রথম চেষ্টাতেই।
এবার মুড়ির রকমফেরের কথা বলি…
তাও হয় নাকি? হয় তো। সরু মুড়ি, মোটা মুড়ি, গোল মুড়ি। লাল মুড়ি, সাদা মুড়ি,ধবধবে সাদা লম্বা চওড়া মুড়ি ইত্যাদি। বিশ্বে মুড়ির অনেক নাম…সংস্কৃত লাজা, হিন্দি কুড়মুড়া, ইংরেজি পাফড রাইস, এ ছাড়া মুধি, মুরাই, মুঢঢি, মালারু, ভুজিয়া, হুড়ুম, ওরুম, লাইয়্যা, মুড়মুড়ে, পারমাল, ফুলিয়ান, পিপুজে ওরেজ, রাইজো সফিত্তো ইত্যাদি।
আমাদের গাঁয়ে ওটি ভুজা। লঙ্কা পিঁয়াজ দিয়ে মুড়ি খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি গ্রামে। তাই নুন বেশি পড়ত চালে। মুড়ি হত দেশি গাই গরুর মত বেঁটেখাটো। সাইজ তেমন বড় নয়। দুধ দিয়ে খাবার সময় চিনি জুটত না। ফলে নোনতা স্বাদ জিভে ভালো লাগত। শুকনো শুকনো খাবার সময় একটু শক্ত লাগত দাঁতে। তা আমাদের আখ, তেঁতুলবীচি চিবোনো দাঁত। ঐ মুড়ি তো নস্যি সেখানে। সর্ষে তেল মেখে খেতে ভালোই লাগত। মোটা মুড়ি তুলনায় নরম খানিকটা।
মুড়ির রঙ একটু লালচে হত তখন। যেদিন থেকে দোকানে মুড়ি বিকোতে শুরু হল, সেদিন থেকে চালে ইউরিয়া, কেরোসিন ইত্যাদির মিশেল দেয়া শুরু হল। তাতে মুড়ির আকার আকৃতি ভালো হল, সাদা ধবধবে হল। কিন্তু আমাদের শরীরে তার বিষক্রিয়া শুরু হল ধীরে ধীরে।
জার্সি গরুর মত আকার আকৃতির মুড়ি পাহাড়ে দেবতার প্রসাদ হয় নকুল দানার সঙ্গে। গোল গোল ফুলো ফুলো মুড়িও তাই, প্রসাদে থাকে। পাঞ্জাবিরা গানের অনুষ্ঠানে, যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আর গুরদুয়ারের ভোগে মুড়ি ব্যবহার করে। তেলেগু ছবিতে নায়ক তার ভালোবাসা প্রকাশ করে নায়িকার কাছে যেসব বলে, তার মধ্যে একটি হল…Your love is crispy like puffed rice. মাছের খাবার হিসেবে এই মুড়ি অনবদ্য।
জমিতে মুনিষ লাগলে, ঘর ছাইতে ঘরামি লাগলে বা যে কোনো কাজে উপরি লোকের জন্য ঘন ঘন মুড়ির খোলা বসত উনুনে।
ফাল্গুন চৈত্র মাসে ঢেঁকিশালের ঢেঁকিতে মুড়ি কুটে গুঁড়িচালুনিতে চেলে ছাতু করা হত টিন টিন। দুই টিন মুড়িতে ছাতু হত এক টিনের অর্ধেক বা তারও কম। খেজুর গুড় বা এখো গুড় আর দুধ দিয়ে মেখে যা লাগত না খেতে…অপূর্ব!
এখন সেই গ্রামের অবস্থা বদলে গেছে। মেশিনে ভাজা হচ্ছে মুড়ি। সেদ্ধ চালে নুন মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে চাল নিয়ে দূরের মেশিনে যায় গেরস্থ, মুড়ি ভাজাতে। সপ্তাহে একদিন বা দু দিন গ্রামে মুড়িভাজার মেশিন চলে। লাইন পড়ে সেখানে। কিলো প্রতি তিনটাকা বা তার বেশি। স্বস্তি হল বটে। বড় খাটুনি ছিল। তবে চালভাজা, খেসারিকড়াই ভাজা, তেঁতুলবীচি ভাজা আর নেই এখন।
শীতে খেজুর রস বা গ্রীষ্মে আখের রসের ভিয়েন বসে না। গুড় তৈরিও হয় না। বাঁকে করে কলসী ঝুলিয়ে খেজুর রস বিক্রি করতে আসে না শিউলি আর। কুয়াশা মোড়া উঠোনে শীতের হিমেল ভোরে কলসী নামে না এখন।
চাল নাড়ার খাঁপরিতে প্রতি ঋতুতে তালের রস, খেজুরের রস কিংবা আখের রসের পোড়া পিঠেও হয় না। কেবল তিন তিনবার করে ধান চাষে ব্যস্ত থাকে মানুষ। অবসর যাপনে স্কুলবাড়ি থেকে যাত্রার মহড়ার সুরও শোনা যায় না আর। ঘরে ঘরে এখন টি ভি চলে গাঁক গাঁক শব্দে। হায় গ্রাম, তোমার জাত গিয়েছে আজ।
এতক্ষণ পড়ে জানতে ইচ্ছে করতেই পারে যে…কবে থেকে আমরা মুড়ি খাওয়া শিখলাম। আমরা তো আজন্মই খাচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা বলি…একসময় তারা ছিল অরণ্যচারী। তখন তাদের ছিল খাদ্যসংগ্রাহকের ভূমিকা। পরবর্তীতে তার খাদ্যউৎপাদক। নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শস্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে শস্য কণাকে তারা খাদ্যরূপে গ্রহণ করতে শিখল। মনে করা হয় তখন থেকেই মাংস ঝলসানোর মৃৎপাত্রগুলিকে তারা ব্যবহার করতে লাগল মুড়ি ভাজার জন্য। অনেকে মনে করেন…বৈদিক যুগে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত নৈবেদ্যতে চালভাজার স্থান ছিল।
যাযাবর হিব্রুরা বিভিন্ন জাতির তাড়া খেয়ে পালাত বিভিন্ন দেশে। তখন তারা কিসমিস আর শুকনো মাংসের সঙ্গে মুড়িও রাখত চটজলদি খাবার হিসেবে। গণতান্ত্রিক গ্রীসে মুড়ির ব্যবহার ছিল সহজপাচ্য খাবার হিসেবে। দক্ষিণ ভারতে ছত্রপতি শিবাজী চাক চাক গুড় অর্থাৎ পাটালি সম্ভবত আর মুড়ি দিতেন সৈনিকদের খাদ্য হিসেবে।
ঝালমুড়ি এল সম্ভবত মোগলাইখানার হাত ধরে। অমন মশলাদার স্বাদ ওদের আগে আমরা পেয়েছি কী?
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল,কোরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র মুড়ি সুলভ। সংরক্ষণের সুবিধে বলে সময়ে অসময়ে কাজ দেয় বেশ।
(উৎপত্তির তথ্য গুগুল থেকে পাওয়া)
আলুর দম আর মুড়ি মেখে খেতে কী ভালো যে লাগে! ভারতের সর্বত্র মুড়ি সুলভ। বর্ধমান, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা প্রভৃতি জেলায় আলুর তরকারি দিয়ে মুড়ি মেখে খাওয়ার রেওয়াজ আছে। বাঁধাকপির তরকারি দিয়ে মুড়ি মেখে একটু কাঁচা সর্ষেতেল ছড়িয়ে কাঁচালঙ্কা, কাঁচাপেঁয়াজ কামড়ে খেতে দেখেছি আমার বড় জা-কে। দুর্গা পূজার মহাঅষ্টমীতে লুচির পাতে দিদির মুড়ি না হলে চলবেই না। রাতে রুটির সঙ্গেও মুড়ি এক মুঠো না হলেই নয়। দুপুরে ভাত কম পড়েছে? আরে বাবা, মুড়ি তো আছে হাতের কাছে। ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে ঝোল ঝাল তরকারি দিয়ে মেখে নিলে অপূর্ব তার স্বাদ আর গন্ধ। পান্তাভাতের আমানিতে মুড়ি মেশালে সুন্দর একটা গন্ধ ওঠে।
বিকেল বেলা পেঁয়াজ, লঙ্কা, গাজর, শশা, ধনে পাতা, টমেটো কুচিয়ে একটু আমতেল দিয়ে বাদাম ছড়িয়ে মেখে নিলে দেবতাও মুড়ির গন্ধে নেমে আসবে স্বর্গ থেকে। তারপর গরম চা। ওহ্, জিভে জল এসে গেল। মুড়ি আর গরম সিঙাড়া বা গরম গরম তেলেভাজা পিঁয়াজি, ফুলুরি, আলুর চপ, বোমা বা বেগুনি…যাই হোক না কেন ,তার স্বাদ তো আজন্ম জিভে লেগে থাকে।
যে কোনো আড্ডার মধ্যমণি চানাচুর , পেঁয়াজ, লঙ্কা, তেল মাখা মুড়ি আর সিঙাড়া বা তেলেভাজা। খবরের কাগজের ওপর পাহাড়প্রমাণ চূড়ো করা মুড়িমাখা আর তাকে ঘিরে বাঁ হাতে কাঁচালঙ্কার বোঁটা ধরা গোল হয়ে বসা আট দশজন মানুষ গল্পে মশগুল…এ ছবি গেরস্তের বৈঠকখানা, রেলের প্লাটফর্ম, ক্লাব ঘর, রাস্তার ফুটপাথ, তাসের আড্ডা, এক কথায় গরীবের কুঁড়েঘর থেকে বড়লোকের প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্র সুলভ।
বৈদিক যুগে মধুর সঙ্গে মুড়ি মেখে খাওয়ার চল ছিল। এই সেদিন ভিয়েতনামে গিয়ে দেখলাম…রেলগাড়িতে মহিলা হকার মুড়ির চাক বিক্রি করছে।
আমি বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এসে কালরাত্রির সন্ধ্যায় খেলাম পটলভাজা, বেগুনভাজা, কুমড়োভাজা দিয়ে ভাতের চ্যাটানো থালায় মুড়ি। একটু অবাকই হয়েছিলাম। কেননা, আমাদের গ্রামে মুড়ি খাবার জন্য কাঁসার কাঁসি ব্যবহার হয়।
হালকা করে আলুর চচ্চড়ি দিয়ে মুড়ি মেখে খাওয়া বেশ জনপ্রিয় দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। শীতের দিনে মটরশুঁটি ছাড়িয়ে তেল নুন দিয়ে কড়ায় একটু নেড়ে নিয়ে ঐ তেলকড়াই মুড়ির সঙ্গে অনবদ্য। পরে এক কাপ গরম চা…আঃ…
মেদিনীপুরে মুড়িতে জল ঢেলে, মড়ি পেঁয়াজ কামড়ে, লঙ্কা ডলে নিয়ে মুড়ি খেতাম। খাওয়া হয়ে গেলে জলটা চুমুক দিয়ে খাওয়া। গুড় মুড়িও খারাপ লাগত না। কুটুম এলে ডিমভাজা, জিলিপি বা নকশা বড়িভাজা দিয়ে মুড়ি দেয়া হত। শুকনো মুড়িতে সর্ষেতেল স্বাদ আর গন্ধ বাড়ায়। পান্তাভাতের গন্ধ বাড়ে একমুঠো মুড়ি মেখে নিলে…আগেই বলেছি। চানাচুর বা ছোলা সেদ্ধ দিয়ে মুড়ি মেখে খেতাম রথের মেলায় গিয়ে। তখন গামছাতেই মুড়ি মাখা চলত। হস্টেলে গোটা অঘ্রাণমাস রাতে ছোলাসেদ্ধ আর মুড়ি খাওয়া হত প্রতি বেস্পতিবার করে।
মাঠে ক্ষেত মজুরদের মুড়ি খাওয়া অন্যরকম। গামছায় মুড়ি নিয়ে গামছার দু দিক ধরে ডান বাঁ করে দুলিয়ে নিলে মুড়ি ভিজে চুপসে গেল। ভিজবে কী করে? একজনতো গেলাসে করে জল নিয়ে ওপর থেকে সরু করে ঢালছে মুড়িতে। একটু আধটু তো নয়, কমপক্ষে পাঁচশো গ্রাম মুড়ি এক একজনের জন্য। কাজের তাড়া। বিলাসিতা চলবে কেন। চুপসানো মুড়ি মুঠো মুঠো মুখে পুরে নুনের টাকনা দেয়া লঙ্কা আর পেঁয়াজ কামড়ে গেলা যাকে বলে। কত খেয়েছি ওরকম ! হাইজিন হাইজিন করে হেদিয়ে পড়িনি। শব্দটা তো জানতামই না। কিচ্ছুটি হত না।
দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এসে খেলাম অন্য আর এক রকম মুড়ি মাখা। এক কাঁসি মুড়িতে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচিয়ে বোমা(মশলার মিশেল দেয়া আলুর ডেলা ব্যাসনে ডুবিয়ে ভাজা) বা ফুলুরি বা আলুর চপ চটকে মেখে তেল ছড়িয়ে জলের ছিটে দিয়ে হাফ কাঁসি করে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া। ঝালের চোটে সো সো শব্দ হবে মুখে। নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে জল গড়াবে। রুমাল হাতে রেখে একই সঙ্গে গরম গরম চায়ে চুমুক। আহা, সে স্বাদ আমৃত্যু জিভ বাঁচিয়ে রেখেছে। তারপর গ্যাস অম্বল হলে এক বেলার খাওয়া বেঁচে গেল। ঐ ভয়ে এখন তেলেভাজা খাওয়া ছেড়েছি। অল্প সময়ের যে কোনো মিটিং-এ মুড়ি তেলেভাজা অত্যাবশ্যক।
কড়ায় সামান্য তেল দিয়ে জিরে শুকনো লঙ্কার ফোড়ন দিয়ে ভাজা বাদাম ফেলে একটু নুন ছড়িয়ে গ্যাস সিম করে কড়াতে মুড়ি তুলে দিয়ে নেড়ে নিয়ে খেতে বেশ লাগে। আমি তো ওরম করে মুড়ি ভেজে রেখে দিই কৌটোয়। সময়ে অসময়ে চিবোই।
মুড়ি চিড়ে হল গিয়ে আমাদের ফাস্টফুড। নারকেল কুরো আর চিনি বা বাড়িতে তৈরি গাওয়া ঘি আর চিনি দিয়ে মুড়ি বা চিড়ে মেখে যে খায়নি কখনো, তার জীবন বৃথা। এক কাঁসি মুড়িতে দুধ আর ঘরে জাঁক দিয়ে পাকানো কলা চটকে খেতে ভালো লাগত।
হস্টেলে থাকাকালীন আমরা হরলিকস-এর খালি জারে সর্ষে তেল, শুকনো লঙ্কা ভেজে, জিরে ভেজে গুঁড়ো করে একসঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে যেতাম। মুড়িতে মেখে দিব্যি লাগত। আচার আচার গন্ধে ঘর মাতোয়ারা, অন্যদের জিভে তখন জল। তখন নারকেল তেলের কৌটো কিনে সদ্য কেটে ঐ তেল মেখে মুড়ি খেয়েছি অনেক দিন। সেও বেশ সুস্বাদু।
পুরুলিয়ায় তেলেভাজা আর মুড়িই হল প্রধান টিফিন। সব জেলাতেই চপ মুড়ি গরীবের দুটি বেলা বড় টিফিন।
মুড়ি সহজপাচ্য বলে শিশুর এবং রোগীর পথ্য। গ্রামে জ্বরজাড়ি, আমাশা বা বদহজম হলে মুড়ির জল উপকারী পথ্য হিসেবে গণ্য হত। জ্বর হলে শুধু জল খেতে হবে, মুড়ি নয়। অথচ পেটে ক্ষিদে পাহাড় প্রমাণ। লুকিয়ে জলের সঙ্গে মুড়িও খেয়ে ফেলতাম।
আমার ছোট ননদ থাকত লন্ডনে। এদেশে আসার সময় প্যাকেট প্যাকেট মুড়ি আনত। ছোট ছোট মুড়ি, অন্যরকম স্বাদের। কড়াতে চকোলেট গলিয়ে ঐ মুড়ি দিয়ে নেড়ে মোয়া বানাত গোল গোল করে। সেও ছিল বেশ লোভনীয়। এখন তো দোকানে দোকানে মুড়ির মোয়া কিনতে পাওয়া যায়। তখন আমরা ঘরে তৈরি করে জারে ভর্তি করে রাখতাম।
শহরাঞ্চলে ছোট ছোট বাটিতে মুড়ি খাওয়া চলে। এক গামলা মুড়ি চিবোনো আমি এত কম মুড়িতে লোকের পেট আর মন ভরে কিভাবে বুঝি না আজও। এখন তো বাজারি ফাস্ট ফুডে দুনিয়া মজে আছে। মুড়ি, চিড়ে চিবোতে চায় না কী বড়, কী ছোট । ফলে অসুখ বিসুখ লেগেই আছে ঘরে ঘরে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। মুড়ি, চিড়ের মোয়া, ছোলা বাদাম মটর ভাজা শরীর এবং দাঁতের পক্ষে উপকারী। বন্যাত্রাণে মুড়ির প্যাকেট দেয়া হয় আজও।
মুড়ির পুষ্টগুণ কিন্তু খুব বেশি না। বেশ কমই। ১০০ গ্রাম মুড়িতে মুড়িতে কী কী পাই…
ক্যালোরি…৪০২ গ্রাম
চর্বি…০ : ৫ গ্রাম
কোলেস্টরল…নেই
শর্করা…৮৯ : ৮ গ্রাম
প্রোটিন…৬ : ৩ গ্রাম
ক্যালসিয়াম…৬ মি গ্রা
ফসফরাস…৬ মি গ্রা
সোডিয়াম…৩ গ্রাম
(এই তথ্যটি গুগুল থেকে পাওয়াএবার মনে হচ্ছে না যে স্থূলতা কমাতে মুড়িই খাই সারাদিন?
মুড়ির মেলা বসে কোথাও কোথাও। মুড়ি খাওয়ার প্রতিযোগিতা হয় সেখানে। আমাদের দাদা বিমল পন্ডিত বললেন…দক্ষিণ ২৪ পরগণার চড়িয়ালের ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় মানে আমার বাড়ির কাছাকাছি সবুজ সংঘ ক্লাব মুড়ি ভাজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করত পাড়ার মাঠে, বছর কুড়ি আগে। বাড়ির গিন্নি তাদের নতুন বউকে পাশে নিয়ে মুড়ি ভাজতে বসত। অনেকে প্রতিযোগী জমা হত। পুরস্কার দেয়া হত। সে দৃশ্য দেখার মত। মানুষের বেশ উৎসাহ ছিল এসবে।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল বসিরহাট মহকুমার হাড়োয়ার গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১ নং ব্লকে অঘ্রাণের শেষ বুধবার থেকে তিন দিন ধরে প্রাচীন বটগাছের নীচে বনবিবির থানে মুড়ির মেলা বসে। এ মেলা সম্প্রীতির মেলা। খাদ্য হিসেবে মুড়ির ব্যবহার করা হয়।
বাঁকুড়া জেলার কেঞ্জাকুড়া গ্রাম সংলগ্ন দারকেশ্বর নদীর চরে প্রতি বছর মাঘ মাসের চার তারিখে মুড়ির মেলা বসে। শীতের নরম রোদে ৪০/৫০ টি গ্রামের লোক জড়ো হয়। দিনভর মুড়ি খাওয়া আর হৈ হুল্লোড়ই প্রধান। এটি অত্যন্ত প্রাচীন মেলা। জনশ্রুতি হল… একদা নদীর ধারে এক সাধুর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে রাভর নামগান শুনে ফেরার পথে ভক্তরা নদীর চরে বসে মুড়ি খেত। সেখান থেকেই মেলার শুরু। এখন বাড়ি থেকে চপ, মুড়ি, ঘুগনি নিয়ে মেলায় যায় লোকে। গোল হয়ে বসে মুড়ি মেখে খায়। দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এ মেলার জনপ্রিয়তা।
এতক্ষণ পড়ে মনে হল নাকি যে জয় হোক মুড়ির? আমার তো বেশ লাগে মুড়ি। রাত বিরেতে ঘরে ফিরে খিদের চোটে এদিক ওদিক হাতড়াতে হয় না মুড়ি থাকলে। এখন তো নলেনগুড় মেখে অমৃতটি মাঝেমধ্যেই খাই। একটু দুধ মেশাই অবশ্য। শুধুও খাই কখনো। আমাদের ফাস্টফুড মুড়ি বেঁচে থাক আজীবন।