প্রবন্ধ: বঙ্কিম আলোকে নারী-চেতনা

প্রবন্ধ: বঙ্কিম আলোকে নারী-চেতনা

বঙ্কিম আলোকে নারী-চেতনা
সৌম্য ঘোষ

বাঙালির জীবনকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের মিলনভূমিতে স্থাপন করে মননশীল সাহিত্য, কথাসাহিত্য, দেশ ও দশের কথা প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে বাঙালিকে যিনি ঊনবিংশ শতাব্দী জীবন রহস্য ও প্রাণবাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘বঙ্গদর্শন’ বাঙালি সমাজ আদর্শ ও আত্মদর্শনের বীজ মন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। তিনিই বাঙালি মনকে সুদৃঢ় করে, সংস্কারকে যুক্তি দিয়ে, প্রাচীন ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে, স্বদেশ মন্ত্র দীক্ষায় নতুন মানববোধের পন্থা নির্দেশ করেছিলেন। পাশ্চাত্য উপন্যাস ও রোমান্সের প্রভাবে সর্বপ্রথম বাংলা উপন্যাসের রূপরেখাটি সার্থকভাবে নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

তাঁর লিখিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৪ টি। যথা, দুর্গেশ নন্দিনী(১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা(১৮৬৬), মৃণালিনী(১৮৬৯), বিষবৃক্ষ(১৮৭৩), ইন্দিরা(১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয়(১৮৭৪), চন্দ্রশেখর(১৮৭৫), রজনী(১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল(১৮৭৮), রাজসিংহ(১৮৮২), আনন্দমঠ(১৮৮৪), দেবী চৌধুরানী(১৮৭৪), রাধারানী(১৮৮৬), সীতারাম(১৮৮৭)।
তাঁর উপন্যাসগুলির গঠনগত আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন,
(১) ইতিহাস ও রোমান্সধর্মী উপন্যাস;
(২) তত্ত্ব দেশাত্মবোধক উপন্যাস; (৩) সমাজ ও গার্হস্থ্য ধর্মী উপন্যাস।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে রেনেসাঁর অভিঘাতে বাংলার নারীচরিত্রে ক্রমশঃ ঘটে চলা জীবনবোধের পরিবর্তনের চিত্ররূপ লক্ষ্য করা
যায় ।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে আমাদের ইতিহাসে একটা রেনেসাঁর যুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। সাগরপার থেকে আসা নতুন মনন-চেতনার ঝঞ্ঝায় তখন হাজার বছরের ভারতীয় অচলায়তনে সাড়া জাগিয়ে বদলে দিচ্ছে এদেশের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মানচিত্রকে। আমূল বদলে যাচ্ছে আমাদের ভাবনাচিন্তা, জীবনধারণ ও জীবনদর্শনের মূল স্তম্ভগুলি।

গোটা সমাজটা যখন দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে একটা নতুন, অচেনা পথে ছুটে চলেছে তার নিয়তি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে, সেই সময়টাতে তার যেমন দরকার ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের, তেমনই দরকার ছিল কিছু দূরদর্শী মানুষের, যাঁরা কিনা জাতির নিজস্ব ভাষায় এই বিপুল পরিবর্তনের একটা নৈর্ব্যক্তিক দলিল রেখে যাবেন ভবিষ্যতের জন্য। এই ডকুমেন্টেশনের জন্য প্রয়োজন ছিল নবপ্রজন্মের শক্তিশালী সাহিত্যিকের, নব্য সমাজব্যবস্থার এই চিত্ররূপ রচনার জন্য যিনি গড়ে তুলতে পারবেন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের ভাষা ও সাহিত্যরীতি।
এই দায়িত্বটা পালন করতে যে ক’জন সে সময় এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। শখের সাহিত্যিক তিনি কোনোদিনই ছিলেন না। লেখাটা তাঁর কাছে ছিল এক সামাজিক গুরুদায়িত্ব পালন। এ প্রসঙ্গে ১২৯১ সালের ‘প্রচার’ পত্রিকাতে লেখকদের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশমালা স্মর্তব্য। যশ নয়, অর্থ নয়, দেশের বা মনুষ্যজাতির মঙ্গলসাধনের জন্যই কলম ধরার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি সেখানে। সে কাজটা সুষ্ঠুভাবে করতে গিয়ে, একটা সুপ্রাচীন সমাজের আমূল বদলের বহুমাত্রিক চরিত্রটির বিভিন্ন দিককে লিপিবদ্ধ করবার জন্য নতুন নতুন আঙ্গিক এবং ভাষারীতিও নিজেকেই গড়ে নিতে হয়েছিলো তাঁকে। ফলত: সৃষ্টি হয়েছিল কমলাকান্ত থেকে কৃষ্ণচরিত্র, দুর্গেশনন্দিনী থেকে সীতারাম অবধি বিস্তৃত এক বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক সাহিত্যসম্ভার।

১৮৬৫ থেকে ১৮৮৭ সাল–এই সময়টা, বলতে পারেন বাংলার নবজাগরণের তুঙ্গ মুহূর্ত। সেই উত্তুঙ্গ সময়ের মধ্যে বসে চোদ্দোটা উপন্যাস লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। এখানেও, বলা যায়, বাংলা ভাষায় এই নতুন সাহিত্যরীতির জন্ম হয়েছিল যাঁদের কলমে তাঁদের মধ্যে তিনিই পুরোধা ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এই উপন্যাস সম্ভারের মধ্যে দিয়ে, বিবিধ ঐতিহাসিক রঙ্গভূমির প্রেক্ষাপটকে ব্যবহার করে, সমসময়ের মানুষের ভাবজগতের বিবর্তনের লিপি রেখে গিয়েছেন তিনি। দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অবধি কালখণ্ডের পটভূমিতে তাঁর কাহিনীবিন্যাস, অথচ তাঁর চরিত্রদের মনোজগতের বিবর্তন ছিল নিপুণভাবে রেনেসাঁর অভিঘাতে টালমাটাল একটি জাতির পরিবর্তনশীল মনস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিকের ছবি, যার মধ্যে প্রধান একটা জায়গা নিয়েছিলো, অগ্রসরমান আধুনিকতার স্পর্শে মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের দিকটা।

একেবারে শুরুতে লেখা দুর্গেশনন্দিনী,ঔপন্যাসিকজীবনের মাঝামাঝি সময়ে লেখা বিষবৃক্ষ ও চন্দ্রশেখর এবং একেবারে শেষ উপন্যাস সীতারামকে নির্দিষ্ট করে বঙ্কিম আলোকে নারী চেতনার বিশ্লেষণ আমার মতো করে উপস্থাপন করলাম ।
রেনেসাঁর একটা প্রধান দিক ছিলো মেয়েদের জীবনদর্শনে এক আমূল পরিবর্তনের সূচনা; সমাজ ও সংসারে পুরুষের যৌনদাসী ও অন্তঃপুরের কর্মদাসী থেকে তার আত্মচেতনা সম্পন্ন ও দোষেগুণে পূর্ণ মানুষের ভূমিকায় উত্তরণ। এক বিচিত্র ও অননুকরণীয় ভঙ্গিতে এই উপন্যাসগুলির নারীচরিত্ররা সেই ক্রমপরিবর্তনের ধারাটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁদের জীবন, সিদ্ধান্ত ও ক্রমপরিণতির মাধ্যমে। মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনের ঘেরাটোপ থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে এসে চিনতে শিখেছেন নিজেদের শক্তিকে, পুরুষনির্ভর লতাজীবন ত্যাগ করে গড়তে শিখেছেন নিজস্ব জীবন, প্রয়োজনে পুরুষকে নিদারুণ শাস্তি দিয়ে অপমানের প্রতিশোধও নিতে শিখেছেন।

|| দুর্গেশনন্দিনী ||

৯৯৭ খৃষ্টাব্দের বাংলার পটভূমিতে এই উপন্যাসের বিস্তার। প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে। ইতিহাসের বীজ একটা যে রয়েছে এ উপন্যাসের মধ্যে, সে আমরা প্রায় সকলেই জানি। সেটা হল, গড় মান্দারণ জয় করে উড়িষ্যার পাঠানেরা জমিদার ও তাঁর মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় ও তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে বন্দী হন রাজপুত রাজপুত্র জগৎসিংহ।

কিন্তু উপন্যাসের পাতায় গল্প ছুটলো নিছক যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্রের ডংকারকে ছাপিয়ে তার কুশীলবদের অন্দরমহলে। রিয়েলিজমের গণ্ডিকে তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে লেখক যুদ্ধে আহত মরণোন্মুখ নায়ক জগৎসিংহকে নিয়ে আনলেন তাঁর পাঠান শত্রু কতলু খাঁয়ের দুর্গের অন্দরমহলে। জগৎসিংহ বাঁচলে পাঠানের বেশি সুবিধে, কারণ তাঁর জীবনের বিনিময়ে তাঁর বাবা মানসিংহের সঙ্গে দরকষাকষিতে অনেকটা ভালো অবস্থানে থাকবে পাঠানেরা। কিন্তু সেজন্য তো বন্দিশালা ও একজন হেকিমের উপস্থিতিই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তার বদলে, নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবানুগতার পথ ছেড়ে গল্প এগোল লেখকের নিজস্ব আবেগসংশ্লিষ্ট বাস্তবতা বা ইমোশনাল রিয়েলিটির পথ ধরে। বন্দী বিধর্মী শত্রুর রোগশয্যায় সেবা করতে এলেন কতলু খাঁয়ের মেয়ে রূপসী আয়েষা। আয়েষার প্রেমিক, কতলু খাঁর সেনাপতি ওসমানের আনুগত্য ত্রিধারায় ভাগ হয়ে বইতে লাগল পরস্পরবিরোধী পথে। আয়েষার প্রতি তার প্রেমজ আনুগত্য, জগৎসিংহের জন্য অসহায় মানুষের প্রতি কর্তব্যজাত আনুগত্য (ও তার পাশাপাশি প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য শত্রুতা) এবং কতলু খাঁয়ের প্রতি তার রাজকর্তব্যজনিত আনুগত্য। ওদিকে উপন্যাসের নায়ক জগৎসিংহের আবেগও তখন দুই ধারায় বইছে। তার একটি ধারা গিয়েছে বাঞ্ছিতা তিলোত্তমার দিকে আর অন্য ধারাটি, মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতার রসসিঞ্চিত হয়ে আয়েষার অভিমুখে বইছে। আর এইভাবেই বাস্তবকে তুচ্ছ করে ও অত্যুজ্জ্বল ধাক্কা দেওয়া নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়ে ইমোশনাল রিয়েলিটির জটিলতাকে গল্পশরীরে বুনে দিয়ে সমসময়ে পশ্চিমা শিল্পমাধ্যমে সদ্য গজিয়ে ওঠা এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পরীতির একটা দেশীকরণের আভাস গড়ে উঠল এই উপন্যাসে।

কিন্তু পরস্পরবিরোধী আবেগের সেই ঘূর্ণিপাকে ব্যতিক্রম শুধু আয়েষা। অভিভাবকের স্থির করে দেওয়া পুরুষের শয্যা ও রন্ধনশালার অংশীদার মধ্যযুগীয় নারীর বদলে তার চরিত্রে লেখক বুনে দিয়েছেন আধুনিক হয়ে উঠতে থাকা নারীর মানসিকতা। হৃদয়ের অধিকার সে কাকে দেবে সে ব্যাপারে সে নারী কারো মতামতের অপেক্ষা রাখে না। নিজের প্রিয় মানুষকে সে নিজেই নির্বাচন করবার ইচ্ছা ও শক্তি ধরে। ধর্ম, সমাজ, সংসারের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে জগৎসিংহকে ভালোবাসলো আয়েষা। আর তারপর, আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রিয় পুরুষের সুখের জন্য তাকে তার বাঞ্ছিতার হাতে তুলেও দিলো হাসিমুখে। চরিত্রের এই দৃঢ়তা আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতাই রেনেসাঁ-উত্তর নারীশক্তির চরিত্রচিহ্ন। নিজের শরীর, মন ও আত্মার ওপর কেবলমাত্র নিজের অধিকার দাবী ও ঘোষণা করে বিশ শতাব্দীর যে নারীবাদী আন্দোলনের জন্ম, নিজের মন ও আত্মার প্রতি একমাত্র নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রমাণ হিসেবে জগৎসিংহকে ভালোবাসা আয়েষার মধ্যে যেন সেই আন্দোলনের প্রথম ছায়াশরীরটি দেখিয়ে দিলেন দিগদর্শী সাহিত্যিক। পটভূমি ৯৯৭ সালের, কিন্তু দুর্গেশনন্দিনীর আয়েষা তাঁর প্রেমের ব্যাপারে তাই একেবারেই ঊনিশ শতকের রেনেসাঁর প্রতিভূ।

কিন্তু তবু, আয়েষা সম্পূর্ণ বন্ধনমুক্তা হতে পারেন নি। কাহিনীর একেবারে শেষে এসে, জগৎসিংহকে তিলোত্তমার হাতে তুলে দেওয়ার পর মৃত্যুচিন্তা তাঁর মাথায় এসেছিলো বটে, কিন্তু নিজের অস্তিত্বকে নিজের হাতেই বিনাশ করবার মতো সাহস তখনও তাঁর ভেতরে গড়ে ওঠেনি। তার কারণ, লেখকের সমসময়ের রেনেসাঁর মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকা বাঙালি-সমাজের মতোই তাঁর এক পা সামনের দিকে বাড়ানো থাকলেও অন্য পা তখনও প্রোথিত রয়ে গেছে অতীত যুগের বুকে। যন্ত্রণা সহ্যতেই নারীজন্মের সার্থকতা, অনিঃশেষ যন্ত্রণাতেও নিজেকে বিনষ্ট করবার অধিকার তার নেই, এই প্রাচীন সামাজিক বিধানকে শিরোধার্য করে নিজের অস্তিত্ব নিজে বিনষ্ট করবার অধিকারকে ত্যাগ করলেন আয়েষা। আর এই অধিকার ত্যাগের মাধ্যমে, নিজের অস্তিত্বের ওপরে সমাজ ও পরিবারের অধিকারকে মেনে নিয়ে তাঁর হাতের বিষে ভরা আংটি স্থান পেল দুর্গ পরিখার গভীর জলে।

|| বিষবৃক্ষ ||

দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশের আট বছর পরে, ১৮৭৩-এ প্রকাশিত বিষবৃক্ষ উপন্যাসের কুন্দনন্দিনীর ক্ষেত্রে লেখক নারীকে সে অধিকার এবং ক্ষমতাও দিলেন। সেই সঙ্গে, এই উপন্যাসের নারী চরিত্রদের মধ্যে গড়ে উঠলো পুরুষের মতোই জীবনকে নিজের পথে উপভোগ করবার সুতীব্র ইচ্ছার এক উজ্জ্বল, অলজ্জ বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক নারী হয়ে ওঠবার পথে আর এক ধাপ এগোল বঙ্কিম উপন্যাসের নারীচরিত্র।

অনাথিনী, বিধবা কুন্দনন্দিনীর প্রেমে উন্মাদ হয়ে লাজলজ্জা ও চরিত্র খুইয়েছিলো নগেন্দ্র। সতী, সচ্চরিত্রা ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মান করা আর দশটা হিন্দু বিধবা নারীর মতো এই ঘটনায় একেবারেই ধরণী দ্বিধা হয়ে পাতালে তলিয়ে গেলো না কুন্দনন্দিনী। অথচ সে কিন্তু কুলটা নয়। সে সুশীলা, সুচরিত্রা, সুন্দরী, সর্বগুণের আধার। তবু, মধ্যযুগীয় হিন্দু সতীত্বের সংজ্ঞায় সচ্চরিত্রা বিধবার যে আত্মসুখ বঞ্চনার ধর্ম, সেটিকে মানতে সে একেবারেই রাজি নয়। একান্তই আধুনিক এক মানসিকতার বশবর্তী হয়ে, নিজের সুখের উপকরণটি যখন তার হাতের কাছে আসে তখন, ন্যায়-অন্যায়, ধর্মাধর্ম, কোনো বিচারকেই সে তার সেই সুখটিকে হাত পেতে নেওয়ার পথে বাধা হয়ে আসতে দেয় না। অতএব সূর্যমুখী যখন তার স্বামী নগেন্দ্রের সাথে কুন্দর বিবাহের প্রস্তাব দেয় তখন সূর্যমুখীর তীব্র যন্ত্রণাকে বুঝতে পেরেও, সে-বিয়ের থেকে নিজেকে পিছিয়ে নেওয়ার কথা তার মনে আসে না। প্রেমিককে পাবার বিনিময়ে, যে সূর্যমুখী তার অনাথ অবস্থায় তাকে বুকে করে আশ্রয় দিয়েছিলো তার এতবড়ো সর্বনাশ করবার জন্যও পিছপা হয় না সে একেবারে। এরপর সূর্যমুখী যখন গৃহত্যাগ করল, তখন কুন্দনন্দিনী দুঃখ পেয়েছে বৈকি, কিন্তু বহিরঙ্গের সেই দুঃখের অন্তরালে তার দুঃখের আসল কারণটি ছিল তার প্রতি প্রেমিক তথা স্বামীর ক্রমবর্ধমান উপেক্ষা।
অন্যদিকে, সূর্যমুখীর চিরায়ত সংস্কারবদ্ধ সাধ্বী স্ত্রীর চরিত্রটির মধ্যেও কিন্তু ঘুমিয়েছিল স্বাধীনচেতা একটি আত্মসম্মানজ্ঞানযুক্তা নারীচরিত্র। সপত্নীকে মাথা পেতে মেনে নিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভাগ করে নেওয়ার মতন ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে আস্থা রাখবার বদলে, বহুগামী স্বামীকে ত্যাগ করে সে বেছে নিয়েছিল গৃহত্যাগের মতো সাহসী একটি পদক্ষেপ। হয়ত শেষরক্ষা সে করতে পারেনি, হার তাকে মানতে হয়েছে, কিন্তু নিজের দায়িত্ব নিজের ‘পরে নিয়ে এই যে ঘর ছেড়ে পথে একা একা পা বাড়ানো, এর মধ্যে দিয়ে উত্তর-রেনেসাঁ বাঙালি মেয়েদের মধ্যে স্বাধীনচেতা ও আপোষ না করা স্পিরিটটির জেগে ওঠবার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
নিজের ভালোবাসাকে সম্মান দিয়ে নিজের দেহমন, বর্তমান-ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু এক বিবাহিত পুরুষকে সমর্পণ করে, তাঁর প্রথমা স্ত্রীকে গৃহচ্যূত করে নগেন্দ্রর ঘরে এসে উঠলেও কুন্দনন্দিনী কিন্তু এক জায়গায় নিজের স্বাধীনতাকে অটুট রেখে দিয়েছিলো। আর সব কিছু প্রণয়ের হাতে সমর্পণ করলেও নিজের অস্তিত্বের ওপর অধিকার সে কারো হাতে ছাড়ে নি। আর এইখানেই এই আধুনিকা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল তার আট বছরের পূর্বসূরী আয়েষার থেকে। গৃহত্যাগিনী সূর্যমুখী ফিরে আসবার পরের দিনই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলো সে। পুরোনো কালের পলিগ্যামিস্ট সংস্কৃতির নারীদের মতন নিজের অধিকারের পুরুষকে কারো সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে বেঁচে থাকতে সে রাজি নয়। আধুনিকা নারীর মতোই প্রেমিকের ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপরে অখণ্ড অধিকারের দাবীও সে করে। আর তা না মিটলে প্রেমিকের শুভাশুভ, দুঃখ-সুখের পরোয়া না করে নিজের অস্তিত্বকে নিজের হাতে ধ্বংস করবার মতো মানসিক শক্তিরও অধিকারিণী হয়ে উঠেছে সে।
একই মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটেছে হীরার চরিত্রেও। হীরা নষ্টচরিত্র দেবেন্দ্রকে ভালোবেসেছিলো। তারপর একসময় তার কাছ থেকে সামান্য উৎসাহ পেতেই তার কাছে নিজের শরীর বিলিয়ে দিতে সে একমুহূর্ত দ্বিধা করে নি। আবার যখন সে দেখলো দেবেন্দ্র আসলে কুন্দনন্দিনীর প্রতি অনুরক্ত তখন প্রেমিকের হৃদয়ের ওপরে নিজের অধিকার বজায় রাখবার জন্য কুন্দনন্দিনীর জন্য বিষ জোগাড় করে এনে তাকে বিষ খেয়ে মরতে প্ররোচনা দিতেও তার বাধে নি।
তিনটি চরিত্র তিনরকম। সমাজের তিন বিভিন্ন স্তরে তাদের অবস্থান। অথচ কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির ভালোবাসায় একচ্ছত্র অধিকার পাবার জন্য তাদের আকুতি অপরিসীম, তার প্রকাশও মোটেই ব্রীড়াকুন্ঠিত কিংবা পুরুষশাসিত সমাজের পুরুষের তৈরি নীতিবোধের বইতে লেখা অনুশাসনের অনুগামী নয়। নিজেদের অনুভুতির বহিঃপ্রকাশের ব্যকরণ তাঁরা নিজেরাই গড়ে নিচ্ছেন। সেখানে ক্লাসিক্যাল ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্মের জায়গা নিচ্ছে নিজের ইনসটিংকট ও অনুভূতিকে পরিপূর্ণ সম্মান দেওয়া। তাতে প্রয়োজন হলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে চরম শাস্তি দিতেও পিছপা নয় নতুন যুগের মেয়ে।
এইজন্যেই হীরা দেবেন্দ্রকে সরাসরি বলতে পারে, “আমি আপনার ভালোবাসার তুলনায় কলংককে তৃণজ্ঞান করি। কিন্তু আপনি ভালোবাসেন না, সেখানে কি সুখের জন্য কলংক কিনিব?——-কিন্তু যেদিন আপনি আমাকে ভালোবাসিবেন, সেইদিন আপনার দাসী হইয়া চরণসেবা করিব।”
এইজন্যেই সূর্যমুখী তার বিদায়ী চিঠিতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে যায়, “আমার স্বামী কুন্দনন্দিনীর হইবেন ইহা চক্ষে দেখিতে পারিব না।” সূর্যমুখী জানত তার প্রতি নগেন্দ্র টান কত গভীর। বিচিত্রগামিনী এই নারীমনটি তাই নগেন্দ্রকে তার লালসা তৃপ্ত করবার উপকরণটি হাতে তুলে দিল বটে কিন্তু সেইসঙ্গে নিজে গৃহত্যাগ করে এমন মর্মান্তিক আঘাত করে গেল যাতে নগেন্দ্র ভোগের বস্তুটি হাতে পেয়েও সুখে ভোগ করতে না পেরে অন্তর্দাহে জর্জরিত হয়। জীয়ন্তে মেরে এমন ভয়ানক শাস্তি বোধ হয় মেয়েরাই দিতে পারে। সূর্যমুখী নিজের এই শক্তিকে চিনতে পেরেছিলো ও নিজের ভালোবাসার অবমাননার এহেন নির্দয় প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল অক্লেশে। আর কুন্দনন্দিনীর অধিকার বোধের কথা খানিক আগেই বলেছি। তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
নিজের চাওয়া পাওয়া পূর্ণ না হলে সুতীব্র, সর্বধ্বংসী হতাশা ও অসাধারণ ধ্বংসক্ষমতায় এই মেয়েরা একই চিরন্তন প্রকৃতির রুদ্রাণী মুখটির প্রকাশ। এ কথা ঠিক যে সমাজের সর্বস্তরে মেয়েদের মনস্তত্ত্বে ঘটতে থাকা পরিবর্তনের কোনো বিশেষ বহিঃপ্রকাশ তখনও খুব বেশি করে ঘটেনি। কিন্তু ভিশনারি সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পড়েছিলো এহেন পরিবর্তনের সূচনাটি।

মেয়েদের জীবনবোধের এই আগ্রাসী অগ্রগতিকে ফুটিয়ে তোলবার জন্য যে চিরায়ত শাশ্বত নারীচরিত্রটিকে প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র তিনি হলেন কমলমণি। রামায়ণের যুগ থেকে শুরু করে ঊনিশ শতক অবধি যেকোনো সময়ের ভারতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে খাপ খেয়ে যাওয়া এই মেয়েটি এ-উপন্যাসে যেন অন্যান্য মেয়েদের পরিবর্তন মাপবার জন্য একটি ধ্রুবক মানের মাপকাঠি। সচেতন পাঠক খেয়াল করে দেখবেন, কমলমণিকে কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র অন্য তিনজনের মতো অধিকারের ভাগাভাগির পরীক্ষায় একেবারেই ফেলেন নি। ফেললে হয়তো তারও শেষরক্ষা হত না। সেক্ষেত্রে এই ধ্রুব মাপকাঠিটি যেত হারিয়ে। ভয়ে ভয়ে তাকে একান্ত অনুরক্ত স্বামীর আদরের স্ত্রী বানিয়ে রেখে ক্লাসিক্যাল বাঙালি রমণী হয়ে থাকবার কাজটাকে অপেক্ষাকৃত সহজ করে নিয়েছেন।

তবে, এ-উপন্যাসেও কিন্তু জেগে ওঠা অপমানিতা নারী যে কী অপরিমেয় ধ্বংসক্ষমতা ধরে, তার পূর্ণ রূপ ফুটিয়ে তুলতে চাননি বঙ্কিমচন্দ্র। সূর্যমুখীকে ফিরিয়ে এনে, ক্লাসিকাল সুখী সংসারের পথের কাঁটা কুন্দনন্দিনীকে মেরে ফেলে এবং হীরা ও দেবেন্দ্রর মতো সুধীসমাজে একান্তই দুই বেমানানের প্রাণ নিয়ে পাপের পরাজয় ও পুণ্যের জয় ঘোষণা করে দিয়ে উপন্যাসে দাঁড়ি টানলেন তিনি। পরিবর্তনের তিক্ত বড়িটি সমসময়ের সুশীল সমাজকে গলঃধকরণ করাবার জন্য এই মিথ্যা মিষ্টত্বের আশ্রয় তাঁকে নিতে হয়েছে হয়তো। তাই হয়তো তেজের বশে গৃহত্যাগ করবার সাহস সূর্যমুখী ধরলেও অবশেষে ফের সে সেই স্বামীর ঘরেই ফিরে আসে সতীনের অস্তিত্বের অধিকারকে মেনে নিয়েই। নগেন্দ্রর সামান্য উৎসাহ দেখতেই ফের পা মেলে বসে যায় চুলে তেল দিতে। ক্লাসিক্যাল পুরোনো মূল্যবোধের বৃত্তেই ঘুরে ফিরে এসে শেষ হয়ে যায় স্বামীর বহুগামিত্বের বিরুদ্ধে তার ক্ষীণ প্রতিবাদ।
সূর্যমুখী, কুন্দনন্দিনী আর হীরা, বিষবৃক্ষের এই তিন কন্যা পা বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ শতকের আগামি আধুনিকত্বের দিকে। অন্যের আগে নিজের সুখকে রাখা ও নিজের অস্তিত্বের অধিকারের ওপরে নিজের সুস্পষ্ট অধিকারের দাবী নিয়ে আধুনিকা হয়ে ফুটে উঠেছে ভালোয় মন্দয় মেশা স্বাধীনচেতা, ভবিষ্যতের এই তিন নারীচরিত্র।

|| চন্দ্রশেখর ||

কুন্দনন্দিনীর চার বছর পরে সৃষ্টি হল শৈবলিনী। আশ্চর্য এই মেয়েটির ভালোবাসা হয়েছিল তার নিজের জ্ঞাতির সঙ্গে। ইনসেস্টুয়াস এই সম্পর্ক পরিণতিবিহীন হবার আশংকায় জ্ঞাতিপুত্র ও প্রেমিক প্রতাপ তাকে নিয়ে গেল ডুবে মরতে। কিন্তু মেয়েটি, যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো পৃথিবীতে, তাকে মৃত্যুর পথে এগিয়ে দিয়ে নিজে বেঁচে ফিরেছিলো অক্লেশে। বিবেক তাকে কোনো তাড়না করেনি। তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মহাপণ্ডিত চন্দ্রশেখর, কিন্তু শৈবলিনীর মনের খোরাক জোটাতে পারেনি তাঁর শুষ্ক পুঁথির পাতা। শৈবলিনী কিন্তু চারুলতার মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বৈদগ্ধ-আবৃত সূক্ষ্ম পরকীয়ায় এর প্রতিকার খোঁজেনি। তার বদলে সমাজ, সংসার, সামাজিক সত্য, ন্যায়–এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে আপন ভালোবাসার সত্য ও তাড়না তাকে এরপর চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল দয়িত মিলনের এক আশাহীন আলোহীন বন্ধুর পথে। সে পথে চলতে গিয়ে সে অবলীলায় খেলা করেছে চন্দ্রশেখরের মতো চরিত্রবলযুক্ত জ্ঞানী মানুষ থেকে শুরু করে লরেন্স ফস্টারের মতো রূপলোভী শ্বেতাঙ্গকে নিয়ে। তাদের অবলম্বন করে বেয়ে উঠে উঠে সে বারংবার তাদের পরিত্যাগ করে তার সর্বনেশে ভালোবাসার সন্ধানে গিয়েছে, আর বারংবার ভালোবাসার মানুষটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে সমাজ-সংসার-ভাগ্য সবকিছুকে নিষ্করুণ পরিহাস করে উন্মাদ নিয়তির চরিত্র নিয়েছে সে নিজে। কাহিনীর শেষে এসে দেখি, সেই অনিবার্য নিয়তিরূপিণী মেয়েটি অবশেষে তার শিকারকে, তার একান্ত ভালোবাসার জন প্রতাপকে চূড়ান্ত উত্তেজিত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে।

এই গল্পে বঙ্কিমচন্দ্রের নায়িকা সাধারণ সামাজিক যৌক্তিকতার সীমা ছাড়িয়ে অন্ধ প্রকৃতির আসনটি দখল করে বসেছে। ইন্সটিংক্‌টের প্রবল তাড়নায় সে কেবল যেকোনো মূল্যে এগিয়ে যেতে চায় তার ভালোবাসার মানুষের কাছে, আর তারপর কোনো গভীরতর ও আদিমতর ইন্সটিংক্‌টের তাড়নায় নিজেকেই তার সেই দয়িতের মৃত্যুর কারণ করে তোলে, বারবার। কাহিনীর প্রথম পর্বে দেখেছিলাম, প্রতাপকে মরতে দিয়ে কত অক্লেশে শৈবলিনী ফিরে এসেছিল। কাহিনীর শেষপর্বে এসে দেখছি, শৈবলিনীকে যখন ঘরে নিয়ে চলেছেন চন্দ্রশেখর, সেই মুহূর্তটিতেও ভালোবাসার শেষ বিষচুম্বনটি সে দিয়ে গেল প্রতাপের আত্মায়। মুহূর্তের জন্য উন্মত্ততার খোলশ ছেড়ে বের হয়ে এল তার চেতনা, তারপর নিষ্করুণ গলায় জানিয়ে দিল তাকে ভালোবাসবার অমোঘ দণ্ডটি—“আমি সুখী হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই–”

এরপর প্রতাপ সজ্ঞানে নিজের মৃত্যুদণ্ড দেয়, এক অসম যুদ্ধে নিজেকে বলি হিসেবে প্রদান করে। চন্দ্রশেখরের শুষ্ক পাণ্ডিত্যের সংসারে শৈবলিনী নিজে বেঁচে থাকবে হয়ত, কিন্তু তার প্রতাপকে সে নিজে না পেলে অন্য নারীর হাতেও তুলে দিতে পারবে না। এজন্য প্রতাপকে বলি দিতেও তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় নি।

অন্ধ প্রকৃতির মূর্তরূপ হিসেবে গড়ে তোলা এই অসাধারণ নারীচরিত্রটি কেবল বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেই নয়, সাহিত্যের বিস্তৃত আঙিনাতেও বিরল। কাহিনীটি সাহিত্য রচনারীতি ও বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে অতি আধুনিক ও দুঃসাহসী হলেও এই নারীচরিত্রটি কিন্তু কালনির্ভর নন। সভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন কালপর্বে এই সর্বনাশিনীরা এসেছেন। তার প্রমাণ রয়ে গেছে গ্রিক ট্র্যাজেডির পাতা থেকে শুরু করে তিষ্যারক্ষিতার গল্প কিংবা রাজতরঙ্গিণীর রানি কাহিনীতে।

|| সীতারাম ||

এবারে শ্রীর কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উপন্যাস সীতারাম প্রকাশিত হয় ১৮৮৬-৮৭ নাগাদ। এ উপন্যাসের নায়ক হিন্দু কুলপ্রদীপ মুসলমান ত্রাস সীতারামের ধর্মপত্নী ছিলেন শ্রী। জ্যোতিষীর নিদানে তাঁকে প্রিয়জনের প্রাণহন্ত্রী দুর্ভাগিনী এই বদনাম দিয়ে স্বামীকুল থেকে বিতাড়ন করা হয়েছিলো। যুবতী হবার পর এক বিচিত্র পরিস্থিতিতে সেই স্বামীর মুখোমুখি হয়ে তিনি সরাসরি ঘোষণা করেন, “আমি তোমার বিবাহিতা স্ত্রী, তোমার সর্বস্বের অধিকারিণী–আমি শুধু তোমার দয়া লইব কেন?”

তবু সীতারাম তাকে ফিরে গ্রহণ করলেন না। পুর্ণযুবতী রূপসী শ্রীকে দেখে ক্ষণিকের মোহে একবার তাকে ফিরে নেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারের ঠিক আগে মুসলমানের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীন শ্রীর বীরাঙ্গনামূর্তিটি পুরুষটিকে কামনাতুর করে তুলেছিল এই একদা পরিত্যক্ত স্ত্রীর প্রতি। সে প্রস্তাবের মধ্যে তাই তাৎক্ষণিক কামনার মোহ থাকলেও প্রকৃত ভালোবাসার আকুতি ছিলো না। সীতারামের ঘরে তখন আরও দুই স্ত্রী।
শ্রী রাজি হন নি সীতারামের প্রস্তাবে। অতএব শ্রী বিদায় হলেন, আর সীতারাম, কামনাতাড়িত আর দশটি পুরুষের মতনই চতুর্দিক তোলপাড় করে খুঁজতে শুরু করলেন প্রার্থিত কামনার বস্তুটিকে। কামনা চরিতার্থের বাসনা ছাড়াও শ্রীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য আরও একটা মোটিভেশন কাজ করছিল সীতারামের মনে। এটা অবশ্য নিতান্তই মানবিক চাতুরির লক্ষণ। সেটা হলো নিজের ক্ষমতাবৃদ্ধির লড়াইতে শ্রীর সদ্য দেখা ক্যারিসমাকে ব্যবহার করা।
বহু খুঁজে পেতেও শ্রীকে উদ্ধার করতে না পেরে সীতারাম আবার ফিরে গেলেন নিজের জীবনবৃত্তে। রজোগুণ সমৃদ্ধ পুরুষ তিনি। জীবনকে উপভোগ করতে জানেন। তুচ্ছ একটা স্মৃতি নিয়ে আঁকড়ে পড়ে থাকা তাঁর শোভা দেয় না। কিন্তু প্রকৃতির বিচিত্র লীলায়, তাঁর অবচেতনে এই অদেখা নারীটির প্রতি কামনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে এক বিস্ফোরণ মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল।

ওদিকে স্বামীর ঘর করতে না পেরে স্বামীর ওপর অধিকার অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও শ্রী কিন্তু আয়েষার মতন সেই না-পাওয়াকে নতশিরে মেনে নেন নি, সূর্যমুখীর মতো উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘর ছেড়ে ভিখারিণীও হন নি, অথবা কুন্দনন্দিনীর মতন আত্মঘাতীও হন নি। শৈবলিনীর মতো অন্ধ ইন্সটিঙ্কটের বশবর্তী হয়ে উন্মাদ হয়ে প্রিয় নিধনের রাস্তাও খোঁজেন নি বারংবার। যুক্তি-বুদ্ধির সোজা পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে। নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে সুতীব্র আবেগসর্বস্ব যে-সমস্ত প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন আগের উপন্যাসগুলির নায়িকারা, শ্রী চললেন তার বিপরীত পথে।
তাঁর দেখা আমরা ফের যখন পেলাম তখন উড়িষ্যার বৈতরণী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে পরিব্রাজিকা শ্রী সে-নদী পার হবার উদ্যোগ করছেন। অকারণ দুঃখের উচ্ছসিত বহিঃপ্রকাশ নেই, পতিহারা সতীর অসহায়তা কিংবা জীবনবিমুখতার কোনো চিহ্নই নেই তাঁর আচার আচরণে। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ যেন কেবলই আর একটি দুঃখের স্মৃতি, কিন্তু ‘পতিহারা এ জীবন আর রাখিয়া কী করিব’ মার্কা ঊনিশ শতকীয় নাটুকেপনার কোনো চিহ্নই নেই তাঁর মধ্যে। পতিবিচ্ছেদের ওপারেও যে একটা জীবন আছে, সেটাকে অনুভব করতে শিখেছেন শ্রী। ঔপন্যাসিক-জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে নিজের সৃষ্ট নারীচরিত্রকে এইবার হিন্দু বিবাহের কট্টর ক্যাথলিসিজমের শিকল ছিঁড়ে তার বাইরেও জীবনকে অন্যভাবে উপভোগ করবার মন্ত্র শেখাতে পেরেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। আগামী দিনের সমাজের প্রগতিশীল নারীচরিত্রের এই নির্যাসটুকুকে তুলে এনে শ্রীর চরিত্রে আরোপ করে তাকে উত্তর আধুনিক মানসিকতা দিয়েছেন তিনি। বিষবৃক্ষের নারীচরিত্রকে যদি বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট আধুনিক নারীচরিত্রের দ্বিতীয় প্রজন্ম বলে ধরি তাহলে তার দীর্ঘ চোদ্দ বছর পরের এই লেখায় এইভাবেই সৃষ্টি হল তার পরবর্তী প্রজন্মের উত্তর রেনেসাঁ মানসিকতার নারীচরিত্র, বাস্তবে যাঁদের আবির্ভাব দেখবার জন্য এ দেশের সমাজকে তখনও অপেক্ষা করতে হবে আরও বহুকাল।

ফিরে আসি গল্পে। আধ্যাত্মিক জগতে নিজে দীর্ঘ এক আনন্দময় জীবন কাটিয়ে শ্রী আবার ফিরে এলেন সীতারামের জীবনে, এক সর্বনাশিনী মহাসাধ্বীর রূপ ধরে। আপাতদৃষ্টিতে স্বামীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী সেই পরিণতবুদ্ধি নারী এইবারে সীতারামের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনকে এক বিচিত্র পথে ছারখার করে দেবার জন্য তাঁর নেমেসিস হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। দেশের ও দশের মঙ্গল তাঁর কাছে তুচ্ছ। ধীরে ধীরে, সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সুখী, সংসারী মানুষটির মহত্ত্বের খোলশ ছাড়িয়ে তাঁর ভেতরের সুপ্ত কামনাকে ফের জাগিয়ে তুললেন তিনি, আর তারপর ট্যান্টালাসের কাপের মতো সর্বক্ষণ তাঁর সান্নিধ্যে থেকেও নিজেকে অধরা রেখে রেখে, তিলে তিলে এক কর্তব্যজ্ঞানরহিত, চরিত্রবলহীন ইতরজীবের সমতুল্যে বদলে দিলেন তাঁকে। সীতারামের আত্মা ধ্বংস হলো প্রথমে। তারপর একে একে স্বপ্নের মতো ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে গেল তাঁর রাজত্ব, সম্মান ও পরিবার।

প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করলে সে বড় ভয়ংকরভাবে তার প্রতিশোধ নেয়। আজকের উন্নতির চূড়ায় থাকা সভ্যতা, তার সামান্য অঙ্গুলিহেলনে কাল বদলে যায় প্রাণহীন মরুভূমিতে। মানুষের ইতিহাসে বারে বারে আমরা তার উদাহরণ দেখেছি। অবজ্ঞায় অপমানিত প্রকৃতির মতোই নিষ্করুণভাবে শ্রী-ও সীতারামের ওপর তাঁর প্রতিশোধ নিলেন সেই একইভাবে, আর তারপর যেমন এক ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন, তেমনভাবেই ফের সীতারামের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়ে ফিরে গেলেন নিজের তৈরি করা আপন জীবনবৃত্তে। আর, এই উত্তর আধুনিক চরিত্রসৃজনটির মধ্যে দিয়েই সম্পূর্ণ হলো বঙ্কিমসৃষ্ট নারীচরিত্রদের বিবর্তন।

উপরের উপন্যাসগুলোর নারীচরিত্রদের আরো একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা কেউ কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত নারীচরিত্র নন। রোজকার আটপৌরে বাস্তবতার সুপরিচিত গন্ধ মাখানো নেই তাঁদের কারো শরীরেই। বিষবৃক্ষ বাদে বাকি তিনটে উপন্যাসের ঘটনাকাল স্থাপিত হয়েছে দূর অতীতে। বিষবৃক্ষের সূর্যমুখী বা কুন্দনন্দিনীকেও বঙ্কিমচন্দ্রের সমসময়ের কোনো সুধী পাঠক হলফ করে পাশের বাড়ির বউ-ঝি টি বলে দাবি করবেন না। এঁরা সকলেই সমসময়ে অ-তুলনীয়া। কেন? ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ প্রণিধানযোগ্য।

যে সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসগুলি লিখছেন ঊনিশ শতকের সেই দ্বিতীয়ার্ধে, বাঙালির অন্তঃপুরের দরজা তখনও সেভাবে সমাজের উঠোনের দিকে হাট করে খুলে যায়নি। চিকের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে পরপুরুষমহলে অন্তঃপুরিকাদের আনাগোনা শুরু হলেও সেটা তখনো ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়। অথচ আগামী অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের লক্ষণগুলো সে সময়েই তার সমাজশরীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। মেয়েরা আরো বেশি সংখ্যায় পড়াশোনা শিখছেন। ব্রতকথা ও গুরুজনস্থানীয়ার উপদেশ বাদেও যে শেখবার আরো কিছু উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে বাইরের দুনিয়াটাতে সেই বিষয়ে ক্রমশই আরো বেশি করে সচেতন হয়ে উঠছেন তাঁরা। শহরবাসী স্বামীর সংসার সামলানোর প্রয়োজনে পুরোনো পরিবারতন্ত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে স্ত্রীরা এসে উঠছেন স্বামীর শহরের বাসায়। সে সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে তখন। নিউক্লিয়ার পরিবারের নিভৃতে নারীপুরুষের মধ্যে সম্পর্কের নতুন রসায়ন সৃষ্টির সে কাজ এগিয়ে চলেছে প্রভূত সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে। তার ওপর, বৃটিশ প্রভুদের দৈনন্দিন জীবনের সংস্পর্শে আসা, ও পশ্চিমী সাহিত্য-দর্শনের স্পর্শ পাওয়া বাঙালি পুরুষ স্ত্রীকে তাঁর পরিবারের একটি সন্তান উৎপাদক যন্ত্রাংশের বাইরে এনে নিজের বান্ধবী ও প্রেমিকার রূপেও দেখতে চাইছেন।

পুরুষশাসিত সমাজ, এই পরিবর্তনের মুখোমুখি হবার জন্য শাসনের পাশাপাশি ছাপাখানাকেও একটা বড় হাতিয়ার করে ব্যবহার করতে শুরু করেছে তখন। অজস্র প্রবন্ধ ও পুস্তিকাতে, ব্যঙ্গ রচনায় তখন চলেছে নব্য সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা যাতে তাদের পরিচিত ভূমিকা ছেড়ে একেবারে ভেসে না যায় সেটা নিশ্চিত করবার চেষ্টা। মিস বিনো বিবি, বিধবাবিবাহ নাটক, বঙ্গগৃহ, মেজো বৌ, সুলোচনা, গৃহলক্ষ্মী ইত্যাদি অসংখ্য সাহিত্যকীর্তির নাম করা যায় এ প্রসঙ্গে। ক্রয়ক্ষমতা তখনও পুরোপুরি পুরুষের হাতে থাকা ও আসন্ন পরিবর্তনের পদধ্বনি শুনে পুরুষসমাজের এক ক্ষীণ নিরাপত্তাহীনতার বোধে ভোগা এই দুই কারণে সেসব বইয়ের বাজারও তখন বেশ ভালো।

এহেন পরিস্থিতিতে, রেনেসাঁ-উত্তর সমাজ ও সংসারে পুরুষের পোষ্য জীবের থেকে আত্মচেতনা সম্পন্ন ও দোষেগুণে মেশা পূর্ণ মানুষের ভূমিকায় মেয়েদের উত্তরণের গল্প শোনাতে বসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাতে সমসময়ের পরিচিত সাংসারিক পরিবেশ থেকে চেনা মেয়েদের বেছে নিতে গেলে একটা শক্ত বাধা আসা স্বাভাবিক ছিল। সেক্ষেত্রে লেখাগুলির গ্রহণীয়তা আঘাত পেতে পারত। শৈবলিনী যদি ১৮৭৫ সালে ‘বাগবাজারের সওদাগরি হৌসের কেরাণি বিপিনবাবুর কনিষ্ঠ কন্যা’ হতেন ও মেয়েস্কুলে পড়া শেষ করে তারপর আপন জ্ঞাতির সঙ্গে প্রেম করে আউটরাম ঘাটে ডুব দিয়ে মরতে যেতেন তাহলে দেশ জুড়ে যে ছিছিক্কারের বন্যা বইতো তার ধাক্কা সামলে চন্দ্রশেখর উপন্যাস হয়তো উঠে দাঁড়াতে পারত না সেই মুহূর্তের সমাজে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মৃত অতীতের নিরাপদ আশ্রয়ে (অথবা নাগরিক সভ্যতার থেকে দূরে গোবিন্দপুর নামের কোনো অজ্ঞাতকুলশীল দিকশূন্যপুরে) রঙ্গমঞ্চটি খাটিয়ে দৈনন্দিন ডালভাতের রিয়েলিজম থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে এ ধরনের চরিত্রগুলো তৈরি করাটাই একজন বুদ্ধিমান লেখকের উপযুক্ত কাজ। বঙ্কিমচন্দ্র সেই কাজটাই নিপুণভাবে করেছেন এই লেখাগুলোতে। তাঁর নারীচরিত্রগুলি তাই অতীতের আবরণে ভবিষ্যতের আধুনিক মেয়ের দল, যারা নিজের অধিকার বুঝে নিতে একবিন্দু কুন্ঠিত হয় না। শিক্ষায়-দীক্ষায়, আচারে, ব্যভিচারে যারা সর্বদাই পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার দাবী করে চলে। একই সঙ্গে প্রতিটি লেখায় রয়েছে আধুনিক হয়ে ওঠা বঙ্গসমাজের প্রতি তাঁর সাবধানবাণী। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের পুতুলখেলার দিন শেষ হয়েছে। নিজেদের অভাবনীয় শক্তি সম্পর্কে সচেতন ও প্রয়োজনে তা প্রয়োগে অকুন্ঠ নতুন যুগের যে মেয়েরা আসছে তারা আর পুরুষের হেলাফেলার খেলার সামগ্রী হয়ে বাঁচবে না। প্রয়োজনে শস্ত্রধারিণী হয়ে রুখে দাঁড়াতেও পারে সে। তাকে সাবধানে মানুষ করতে হবে এবং উপযুক্ত সম্মান দিয়ে চলতে হবে, নইলে ঘরে ঘরে বিষবৃক্ষের অংকুরোদ্‌গম হবে, বলশালী মহান পুরুষও কুঠারাহত মহীরুহের মতো ছিন্নমূল হয়ে লুটিয়ে পড়বেন কোমল দুটি হাতের বজ্রকঠিন আঘাতে। একটা উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গে ইতি টানবো। শৈবলিনীর যে ছবিটা বঙ্কিমচন্দ্র এঁকেছেন সেখানে দেখছি তার বড়ো হয়ে ওঠবার কালে পারিবারিক ট্র্যাডিশনাল বিধিনিষেধ বা শিক্ষাদীক্ষার বাধা ততটা ছিল না। কারণ, তা যদি থাকতো তাহলে জ্ঞাতিপুত্রের সঙ্গে প্রেমটা এভাবে তৈরি হয় উঠতে পারতো না। বিবাহিত জীবনেও উদাসীন স্বামীর সঙ্গে এক নিউক্লিয়ার পরিবারে বাস করায় তার সামাজিক জীবনধারণের সঠিক শিক্ষা হয় নি। মনস্তত্ত্বের ভাষায়, প্রবৃত্তি দমনকারী যে সুপার ইগো গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকে আরোপিত বিবিধ সামাজিক ও পারিবারিক বিধিনিষেধ ও মূল্যবোধের শিক্ষায়, সেই সুপার ইগো গড়ে তোলবার কোনো সুযোগ আসেনি তার জীবনে। ফলত: প্রবৃত্তির দাস হয়ে সে একাধিক জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনল। সমাজ সচেতন সতর্ক বঙ্কিমচন্দ্র এ উপন্যাসগুলিতে এহেন বিভিন্ন সাবধানবাণী দিয়ে গিয়েছেন তখনও গড়ে উঠতে থাকা এক নব্যবঙ্গীয় সমাজকে।