নিবন্ধ: দু’বাংলার সাহিত্যে মহামারি- অতিমারিঃ আগামী প্রজন্মের মেধাবী পাঠ

দু’বাংলার সাহিত্যে মহামারি- অতিমারিঃ আগামী প্রজন্মের মেধাবী পাঠ
ডঃ সুবীর মণ্ডল
কথা মুখঃ দীর্ঘ দশ মাস অতিক্রান্ত। চরম হতাশার,চরম দুঃখ- বেদনা ও বিষের বিশ সাল পেরিয়ে আশার একুশে গোটা বিশ্ব ।অবাক হবো না, হয়তো এ-বছরেরও কিছু দিনও হয়ত পেরিয়ে যাবে। বিশ্বজুড়ে শুধু মৃত্যুর মিছিল। থমকে গোটা দুনিয়া ও মানব সভ্যতা। এক অভূতপূর্ব অতিমারি এসে রুদ্ধ করে দিয়েছে জনজীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ। মানুষ হয়েছে গৃহবন্দি আর অবাধে মুক্ত এতদিনকার খাঁচায় বন্দি থাকা প্রাণীকুল। দূষিত পৃথিবী আরো নির্মল হয়ে উঠেছে।পালটে গেছে জীবনধারা ও জীববৈচিত্র্য। বেড়েছে কাজহারা মানুষের সংখ্যা। আহত শৈশব ও কৈশোর। জীবন দীপ নিভে গেছে বহুজনের।মানবকুল আতঙ্কগ্রস্ত। পরিযায়ী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অভিশাপ। মনোজগতে ভাঙাগড়ার খেলা শুরু হয়েছে।যাপিত জীবনের ছন্দপতন। কর্ম ও শিক্ষা জগৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।অনেকটাই ভূতনেই, ভবিষ্যৎ নেই, শুধুই অন্ধকারময় বর্তমান ।এক স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। মোহময় দু্ঃসময়ে একটা নেই রাজ্যের -দেশের বাসিন্দা আমরা।তবু এত সব কিছুর মাঝেই চলছে দুটো জিনিস। ঘড়ির কাঁটা আর হৃদয়ের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে ধিক দিক করে।যেন প্রাণ হাতে করে এই কালোময় দিন পেরোনোর অনন্ত অপেক্ষা। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যেমন অসময়ের কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, তেমনি অস্তাচলে গেছে শত শত বর্ণময় নক্ষত্র ব্যক্তিত্ব। শুধুই হাঁটতে হাঁটতে কত মানুষ হয়ে গেছে পরিযায়ী, শুকনো রুটি হয়ে দাঁড়াল ভারতবর্ষের মানচিত্র! সমস্ত কিছুর মধ্যেই রাষ্ট্র ও তার ভূমিকা নিয়ে নানান প্রশ্ন, তর্ক, বাদানুবাদ তো রইলই ।আর যারা এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে একেবারেই সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে জীবন বাজি রেখে প্রতিনিয়ত লড়ছেন, তাদের কথা বা না বলে থাকা যায় কীভাবে? আঁধার রাতের পরে সূর্যোদয়ের স্বপ্নে বিভোর গোটা বিশ্বের মানুষ। সেই আশার দিনে চোখ রেখে আমরা এগোচ্ছি।তবু যেন ভুলে না যাই আজকের দিনগুলো,যা কালের নিয়মে রচনা করে চলেছে ইতিহাস।যা আগামী প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস।
(১) “মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি,
বাঁচিয়া হয় গিয়েছি বিধির আশিসে অমৃতের টীকা পরি।”(আমরা/ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত) কথাগুলো কবি কল্পনা নয়, একেবারে বাস্তবের কঠিন কঠোর সত্যভাষণ। আজো মারি নিয়ে ঘর করছি আমরা। কতদিন? করতে হবে তার উত্তর কারোর জানা নেই। পৃথিবীর মানবকুলের গভীর, গভীরতর অসুখ। এক অদ্ভূত আঁধারে আমাদের প্রাত্যহিক যাপিত জীবন। বিশ্বজুড়ে করোনাতঙ্ক আর মৃত্যু মিছিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন পিছন ফিরে তাকাই,দেখতে পাই এই মহামারি-অতিমারি নতুন কিছু নয়। চিরকাল আমাদের সমাজে সংক্রামক ব্যাধি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে নানা সময়ে। কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া,কলেরা,প্লেগ, ওলাওঠা,ইবোলা, ডেঙ্গু,চিকোনগুনিয়া এই রকম বহু মারাত্মক, সংক্রামক ব্যাধি মানুষকে যুগে যুগে সংক্রামিত ও হত্যা করেছে নিষ্ঠুর ভাবে। মহামারি থেকে অতিমারি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অকালে, মহাযুদ্ধ বা দাঙ্গার, প্রাকৃতিক বিপর্যযের থেকে এর প্রকোপ কোনভাবেই কম নয়। প্রকৃতির কাছে অসহায় মানুষের ছবিই এই মহামারির সময়ে আমাদের সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে বারবার, ইতিহাস তার নীরব সাক্ষী। বিশ্বসাহিত্যে এই মহামারির ছায়া পড়েছে বারংবার, আর সেই তালিকায়, শীর্ষে রয়েছে আলব্যের কাম্যুর’প্লেগ'(১৯৪৭), জনপ্রিয়তা পেয়েছে মার্কেজের’ লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা'(১৯৮৫) কিংবা হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস'(১৯৯৫) ইত্যাদি। মহামারি নিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশি চলচ্চিত্রও। এতখানি বিস্তার না থাকলেও দু’বাংলার সাহিত্যে মহামারি-অতিমারি প্রসঙ্গ একেবারে উপেক্ষিত হয়নি। বাংলা কথাসাহিত্যের আঙিনায় সেকাল থেকে একালে মহামারি নানা অনুসঙ্গ নিয়ে কীভাবে উন্মোচিত হয়েছে সেটাই তুলে ধরা এই নিবন্ধটির অবতারণা।বহু কালজয়ী উপন্যাস ও ছোটগল্পে এবং কবিতায় মহামারির ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক থেকে কবি কুলেরা । তাঁর বর্ণময় চালচিত্র আলোচনা করা যেতে পারে,তাহলে মহামারির একটা চেহারা উন্মোচিত হবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস।
(২) বিংশ শতাব্দীর মধ্যলগ্নে আ্যন্টিবায়োটিক আবিষ্কার মৃত্যুর হারকে অনেক খানি রোধ করেছিল।এক সময়ে শুধুমাত্র আ্যন্টিবায়োটিকের অভাবেই সফল শল্যচিকিৎসার পরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুকে ঠেকান যায় নি। কিন্তু প্রাক আ্যন্টিবায়োটিক সময়ের নানা চিহ্ন বাংলা সাহিত্যের আঙিনা জুড়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সবচাইতে নাড়া দিয়েছিল প্লেগ। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী প্লেগ এক সময়ে মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি হিসাবেই বিবেচিত হতে। হু-য়ের ওয়েবসাইটে প্লেগের মৃত্যু হারের বিশদ বিবরণ রয়েছে। চতুর্দশ শতকে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে কুখ্যাত ঘটনায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। ভারত তথা বঙ্গদেশেও এই প্লেগের আনাগোনা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলিতে বারবার দেখতে পাওয়া গেছে। যেমন,’চতুরঙ্গ'(১৯১৬)। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ, অর্থাৎ ‘শচীশ’ অংশে পরোপকারী জ্যাঠামশাই জগমোহনের যে মৃত্যু-বিবরণ পাওয়া যায়,তা প্লেগের কারণেই,’ পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন,ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই– আমাদের হাসপাতালে প্রথম রোগী জুটিল একজন মুসলমান,সে মরিল। দ্বিতীয় রোগী স্বয়ং জগমোহন,তিনিও বাঁচিলেন না।’
বাস্তবে বিশ শতকের সূচনালগ্নে কলকাতা- সহ নানান জায়গায় প্লেগের কারণেই মানুষ দিশেহারা হয়েছিল, শহর ছেড়ে অনেকেই নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। তেমনি বর্তমানে অতিমারি করোনায় আজ গোটা বিশ্বের মানুষ শিহরিত ও দিশেহারা। পালিয়ে বাঁচার উপায় নেই কারণ সমস্ত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। সেই সময়ে বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি এতটা ঘটেনি, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, ভগিনী নিবেদিতা ও বিবেকানন্দ এবং ডাক্তার-নার্সদের সহযোগিতায় প্লেগের হাসপাতাল তৈরির কাজে লেগে পড়েন। তাঁদের এই মহতী উদ্যোগ সত্ত্বেও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট্ট মেয়েটিও মারা যায়। প্রতিটি বাড়িতে প্লেগের দগদগে ক্ষত চিহ্ন। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু প্রবন্ধে এই প্লেগের কথা অনুসঙ্গ হিসাবে এসেছে–‘ম্যালেরিয়া-প্লেগ–দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষ্যমাত্র,তাহারা বাহ্যলক্ষণ মাত্র– মূলব্যাধি
দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে— পৃথিবীতে যে-সকল জাতি মরিয়াছে তাহারা এমনি করিয়াই মরিয়াছে।'(দেশনায়ক)
এই প্লেগের বর্ণনা আমরা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প–‘মাল্যদান,’এ-ও পাই, সেখানে কুড়ানি- পটলের রসিকতাকে সত্য ভেবে যতীনকে স্বামীরূপে বরণ করে মনে মনে।এই কুড়ানি পলাতক হবে, তাঁকে খুঁজতে গিয়ে জানা যায় প্লেগের ভয়ে লোকে পালাচ্ছে চারিদিকে। একটি প্লেগ -হাসপাতালের ডাক্তার হিসাবে কাজ নেয় যতীন—‘
(৩) শরৎ-সাহিত্যে , কলেরা এবং বসন্তকে আমরা মহামারি হয়ে উঠতে দেখি ‘শ্রীকান্ত'( ১ম,২য়,৩পর্ব ১৯১৭,১৯১৮,১৯২৭),’গৃহদাহ'(১৯২০),’পণ্ডিত মশাই,’ ইত্যাদি উপন্যাসে। শরৎ চন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাস’শ্রীকান্তে’-র দ্বিতীয় পর্বে ,এই প্লেগাতঙ্ক বিশেষ ভাবে দেখা যায়। সেখানে জাহাজে করে ভবঘুরে শ্রীকান্ত বার্মা যেতে চান, কাজের সন্ধান যদিও উপলক্ষ্য, লক্ষ্য নিত্য-নতুন দেশে যাওয়া, মানুষ দেখা। রাজলক্ষ্মীর ভালোবাসাকে স্বীকার করেও সামাজিক বন্ধনে পড়তে চায় না তাঁর মন। জাহাজে ওঠার আগেই শ্রীকান্ত জানতে পারেন এখান থেকে প্লেগ রোগে আক্রান্ত কাউকে নিয়ে যাওয়া হবে না তাই একটা পরীক্ষা হয়, হিন্দুস্তানিদের ভাষায় ‘ পিলেগকা ডগদরি’— বার্মাতে এখনও প্লেগাক্রান্ত যায়নি, তাই রেঙ্গুনগামী যাত্রীদের ডাক্তারি পরীক্ষা করে জাহাজে তোলা হবে। সেই পরীক্ষায় পাশ করে শ্রীকান্ত ওঠেন। যদিও সেখানেই শেষ নয়, রেঙ্গুনে নেমেই শহরে প্রবেশ করা যায় না। শহর থেকে আট-দশ মাইল দূরে অনেকগুলি কুঁড়েঘরে ডেকের যাত্রীদের পক্ষে দিন দশ কাটিয়ে তবে শহরে ঢোকার ব্যবস্থা। মহামারি রোধ করার জন্য এই বাধ্যতামূলক নির্বাসন– ব্যবস্থাকে বলে কোয়ারাণ্টিন, কুুুলিদের ভাষায় ‘কেরোন্টিন’। শরৎ-সাহিত্যে আর একবার প্লেগের হাত ধরে মৃত্যু উপন্যাসের প্রতিনায়ককে মুক্তি দিয়েছে, সে উপন্যাসের নাম ‘গৃহদাহ’। প্লেগাক্রান্ত অঞ্চলের বর্ণনা শরৎচন্দ্রের কলমে এই রকমই ভাবে আমরা দেখতে পাই ‘- -সাত-আট ক্রোশ দূরে কতকগুলো গ্রাম যে সত্যই এ- বৎসরে প্লেগে শ্মশান হইয়া যাইতেছে, এ খবর সে শুনিয়াছিল।—-‘ প্লেগাক্রান্ত হয়ে সুরেশ অচলা ও মহিমের সামনে প্রাণত্যাগ করে। পরের ঘটনা বাঙালি পাঠকের সকলেরই জানা। ( ৪)আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদিপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের আনন্দমঠ উপন্যাসে আমরা ছিয়াত্তরের ‘মন্বন্তর ‘কালীন মহামারির বর্ণনা পাই।”বিশেষত বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল।গৃৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল— —যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পালায়।’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসেও এসেছে মহামারির বর্ণনা। ‘আরণ্যক ‘উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণের মুখে সেই বিবরণ আমরা শুনেছি। অন্যদিকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসের নায়ক শিবনাথকেও কলেরা আক্রান্তের সেবা করতে গিয়ে নানান ধরনের বিরুদ্ধতার শিকার হতে হয়।তিনি ‘গণদেবতা ‘উপন্যাসে কলেরার বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন।তাঁর উপন্যাসের নায়ক দেবনাথ যুবক সঙ্গীদের নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছিলেন, গ্রামে ছড়িয়ে পড়া কলেরা রুখতে।তার ছোট ছেলেও কলেরায় আক্রান্ত হয়।সে খবর দেবনাথ পায় প্রতিবেশিনী দুর্গার কাছে। লেখকের ভাষায়” হ্যাঁ দুর্গাই,অন্ধকার পথের উপর আলো হাতে দুর্গাই দাঁড়াইল ,” ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে আমরা অন্য ছবি দেখতে পাই, লেখকের বর্ণনায়—“শিক্ষিত ছেলেরা বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করে কলেরায় মৃত্যু আটকাতে চাইছে। কুয়ো খুঁড়তে কোদাল ঘাড়ে নিয়েছে,তাদের নাম হয়েছে “কোদালি ব্রিগেড,” (৫)ওপার বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের,’ হাজার বছর ধরে’ ‘উপন্যাসে কলেরার মড়ক বর্ণিত হয়েছে ” অবশেষে আরও আট-দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলাবিবি,’ অন্যদিকে ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক লিখেছেন—‘এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে,ডাক্তার, বদ্যিও ছিলনা তেমন।মরার আগে মুখে যদি ওষুধ পড়ত,তাই কত!’ ‘প্লেগ’ নামে শাহজাদা ফিরদাউস একটি উপন্যাস লেখেন, যে উপন্যাস ছিল পুরোপুরি সামাজিক। সেখানে প্লেগের প্রসঙ্গ এলেও, তা কখনো বা সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রতীক হিসেবে আসে, কখনও তা হয়ে ওঠে স্বার্থপরতার চিহ্নায়ক।তিনি লিখেছেন—‘ আমাদের দৃষ্টিকে ভয়াবহ প্লেগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে, অন্তত আমাদের শিশুদের এই কালান্তক অসুখের কবল থেকে বাঁচাতে হবে। ‘ প্রসঙ্গত , মানুষের বাণিজ্য- বিস্তারের লোভ কীভাবে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে তার দৃৃৃষ্টান্ত আধুনিক কালের ঔপন্যাসিক রূপক সাহার উপন্যাস ‘বীজাণু ‘, সেখানে মারণ বীজাণু ইচ্ছাকৃতভাবে প্যাকিং করা বোতলে মিশিয়ে মহামারি সৃষ্টি করার প্ল্যান নেওয়া হয়েছিল। আবার স্মরণজিৎ চক্রবর্তী ‘অদম্য ‘ সিরিজের কাহিনীতেও প্যাকিং করা জলে জীবাণু ব্যবহার করা হয়েছে। (৬)’ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শশী ও রিউ’ প্রবন্ধে লেখিকা নবনীতা দেবসেন লক্ষ্য করেছেন ‘প্লেগ’উপন্যাসের নায়ক রিউ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুুুতুলনাচের ইতিকথা ‘(১৯৬৩)-এর আশ্চর্য কিছু মিল। যদিও কাম্যুর প্লেগ’ মহামারির ইতিকথা, ‘ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে রয়েছে গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব, ছদ্ম-নিয়তি আর নিঃসঙ্গ নায়ক শশীর ক্রমপরাজয়। দুুুজনেই
ডাক্তার এবং দুজনেই অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির কবিতাকে সুস্বাস্থ্য সুবাতাসে ভরে দিতে চান,মৃত্যু র সঙ্গে দুজনেই পাঞ্জা লড়েন।কিন্তু রিউ তাঁর আত্মজ্ঞানের জন্য যে জয় পান,শশী সেখানে পুতুলে পরিণত হন।বিবেকানন্দর ‘সুয়েজখালে হাঙ্গার শিকার’ প্রবন্ধে প্লেগাতঙ্কের উল্লেখ পাওয়া যায়(পরিব্রাজক,গ্রন্থ১৯০৬)। প্রবন্ধের বিষয় ভাবনা এই রকম–সুয়েজ বন্দরে জাহাজ থেকে মাল নামাবার দরকার। কিন্তু সেখানে কড়া নিরাপত্তা। কারণ,একদিকে মিশরে প্লেগ,অন্যদিকে ভারতীয় প্লেগের জীবাণু বহনকারী যাত্রীদের ইউরোপে নামতেই দেবে না যাবতীয় পরীক্ষা ছাড়া। জাহাজে কেউ মাল নামাতে বন্দর থেকে উঠবে না।
(৭) কলেরা, বসন্ত, ওলাওঠার মতো রোগ ও একদা বঙ্গদেশে মহামারির রূপ ধারণ করেছিল ।
বাংলা সাহিত্যে সেসব প্রসঙ্গ উপেক্ষিত থাকেনি।
রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার ‘ অথবা ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতা আমাদের সকলেরই কম-বেশি পড়া, ওই দুই কবিতার কয়েকটি লাইন এই প্রসঙ্গে আলোচনার দাবি রাখা যেতে পারে–(১)’নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায়/ভরে গেছে তার অঙ্গ–‘
(২)’কোথা হা হন্ত,চিরবসন্ত।আমি বসন্তে মরি ।বন্ধু যে যত স্বপ্নিল মতো বাসা ছাড়ি দিল ভঙ্গ।’বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দুটি কবিতাতেও সংক্রামক বসন্ত রোগের প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে।গুটি বসন্ত বা স্মল পক্সের মতো সবচাইতে মারাত্মক অসুখ,যা দেহবিকৃতিরও কারণ হয়। (৮) কলেরারই আর এক নাম আয়ুর্বেদের ভাষায় বিসূচিকা রোগ, যার উল্লেখ শরৎচন্দ্র আবার করেছেন তাঁর ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসে।সেখানেও পণ্ডিতমশাই বৃন্দাবনের সন্তান চরণের মৃত্যু ঘটে জলবাহিত বিসূচিকারোগে। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ ‘ ছোটগল্পে চারুর প্রাণ নিয়েছে তারকেশ্বর থেকে ফেরার পর। যদিও চারু চেয়েছিল বনমালীকে নিজের করে রাখার জন্য পরীকে কলেরা আক্রান্ত মহিলার বাটিতে প্রসাদ খাইয়ে মেরে ফেলতে, কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে। সে নিজেই বমি করে মারা গেছে।যদিও এই মৃত্যু কলেরার কারণে নাকি অপরাধবোধে তার উল্লেখ গল্পে নেই।সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের’গোলোক রহস্য’তেও এই অজানা ভাইরাস টেরাটম গ্রহ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চায়,শঙ্কু তা হতে দেননি।সেই গল্প যদিও কল্পবিজ্ঞানের। এছাড়াও বাংলায় প্রচলিত ভূতের গল্পগুলোতে কলেরা বা ওলাওঠা রাজনীতি মড়ক লাগা একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। ছোট বেলায় এই ধরণের বহু গল্প আমরা শুনেছি। বঙ্গদেশে মড়ক একদা যে গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে দিত,তার ছবি লোকমুখে বাহিত অলৌকিক গল্পে আজো জীবন্ত হয়ে আছে। ( ৯)হোম-কোয়ারান্টিন দশায় থেকে এখন করোনা-সাহিত্যের জন্ম হচ্ছে ফেসবুকে এবং অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায়।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সহ, বহু সঙ্গীত শিল্পী ও ডাক্তারও এবং নানান পেশার মানুষ গান,কবিতা, নিবন্ধ, অণুগল্প, ছোটগল্প লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন । শিল্পী ইন্দ্রনীল সেন গেয়েছেন ‘ স্তব্ধ করো,জব্দ করো/ করোনাকে ভয় পেয়ো না/ ভীড় থেকে সব্বাই দূরে থাকো/ করোনাকে ছুঁতে দেব না। ‘ আমরা সবাই জানি, ইতিমধ্যেই করোনাকে কেবল মহামারি নয়,অতিমারি হিসাবে বর্ণিত হয়েছে (WHO )-এর ঘোষণায়। ডাঃঅনির্বান দত্ত গেয়েছেন–‘আমি ডাক্তার, আমি ডাক্তার ‘।সঙ্গীত শিল্পী নচিকেতা গেয়েছেন–‘ও ডাক্তার ও ডাত্তার–অর্ধেক দালালি নেবেন ডাক্তার ‘। আর একজন ডাক্তার বাবু গান লিখেছেন এবং নিজে গেয়েছেন–‘নাম তার ভাইরাস করোনা, ছেলে-বুড়ো কাউকে যে ছাড়েনা’। অনুরূপ ভাবে আর একটি গান, ‘ ভাইরাস টা যে অজানা, ও দাদা বিশ্বব্যাপী মৃত্যু মিছিল থামতেই চায়না/খুব দরকার না হলে বাইরে যেওনা/তুমি ঘরেই থাকো,তুমি ঘরেই থাকো। ‘এ লড়াই সবার লড়াই/দিদি আর নরেন মুদি লড়ছে কেমন?’ হিন্দি জনপ্রিয় একটি গান ‘করোনা কি আয়া,চিন থেকে আয়া ‘। আর একটি জনপ্রিয় গান-‘এই সময় আলোটা জ্বালিয়ে রেখ/হাতটা ছেড়ে দিওনা,মহামারি চিরদিন রবে না/হাত বাড়াতে ছেড়ে যেওনা। ‘ Dorag Hussain লিখেছেন এবং নিজে গেয়েছেন ‘করোনার হাত ধরে চলা/গৃহবন্দি হয়ে থাকা/মহামারি রবে না/তুমি আর আমি কখনোই হব না আলাদা ‘অনুরূপ ‘এ নবেল করোনা/ ভাইরাসটা অজানা/ জমায়েত দূরে রাখ/ বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেল।’ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী তনুময় বাবু গান লিখেছেন এবং নিজে গেয়েছেন ‘চাওয়া পাওয়া গুলো না হয় /এই কটা দিন একটু থাকুক/বাড়িতে বসে একটু না হয় দিন বদলের গান গাও যাক/ভাইরাস যার নাম করোনা/ছেলে বুড়ো কাউকে যে ছাড়েনা, ।বাংলা সাহিত্যে মহামারি-অতিমারি -প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি আমরা কিছু লিমেরিক, কবিতা, প্যারডি ও অণুগল্পের আলোচনা করতে পারি।লিমেরিক গুলির লেখক শিক্ষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকার, প্রাক্তন উপাচার্য। (১)’ মানুষের মুখ দেখে পুরোনো না বিস্ময়; সাময়িক যবনিকা পড়েছে সে দৃশ্য। মুখ ঢাকা সকলের–
আসলের নকলের
মানুষ-এ ওর কাছে হল অস্পৃশ্য। ‘( মানুষের মুখ)
(২) আমাদের দেখা হোক মহামারি শেষে,
আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে।
আমাদের দেখা হোক জীবাণু ঘুমালে,
আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে
(শঙ্খচিল)/লেখক অজ্ঞাত
(৩) তবুও আশায় আছি–
আবার আসবে ছন্দ
স্ববির এজীবনে।(তবুও আশায় আছি) অশোক মুখপাধ্যায়।করোনাকে সামনে রেখেই লেখা হয়েছে একাধিক প্যারডি, মধুসূদন- শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে জয় গোস্বামী কেউই বাদ পড়েননি।
নমুনা–(১)’হে বঙ্গভূমিতে এলো করোনা এমন,তা সবে অবোধ তুমি অবহেলা করি,—‘
(২)দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে সব,/মাঝে শুনি কিসের কলরব,/ স্যানিটাইজার স্টিকে আছে? এবার কিছু অণুগল্প আলোচনা করা যেতে পারে, যেমন সরোজ কর্মকারের একটি অসাধারণ অণুগল্প ‘ জানি না ‘ করোনার লক ডাউনে বাবা-মেয়ের জি,কে,নিয়ে খেলা চলে,যদিও শেষে বাবা নীরব হয়ে যান এই প্রশ্নের উত্তরে’ আমি আবার কবে খেলতে যেতে পারব?’–করোনার এই বিধিনিষেধের বাজারে বন্দি–শৈশবের কাছে এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ আজ নেই। ‘করোনা’ নাম দিয়েই তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন-এক ব্রাক্ষণ পূজারি অন্ধ বিশ্বাসের গল্প,ধ্যানেশবাবুর বিশ্বাস গোমূত্র,গোময় আর গঙ্গাজল ও দুধের
মিশ্রণ খেলেই করোনামুক্তি ঘটে;যদিও নিজেই করোনাক্রান্ত হয়ে তিনি ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন।এছাড়া অসংখ্য অণুগল্প ও ছোটগল্পের জন্ম হয়েছে এই মোহময় দুঃসময়ে। মালবিকা হাজরার’ লকডাউন শেষ হলে ‘, অণুগল্পের শেষ অংশ এই রকম–‘জীবাণু মুক্ত পৃথিবীর চোখ।আর মানুষও একেবারেই অন্য পৃথিবীর লোক—‘অনুরূপ পিনাকী বসুর ‘বিনি সুতোর গাঁথা ‘ সুমন দের’ পরিযায়ী, ‘শুভদীপ চক্রবর্তীর ‘করোনার দিনগুলি, ‘প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথের ‘ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রামক ব্যাধি, ‘রূপকথার আগামী, ডেলিভারি বয়,ঘাসফুলেদের কথা, আকাশি রঙের পথ ইত্যাদি।
শেষ কথা: এইভাবেই মহামারি-অতিমারি নিয়ে নিদারুণ ভয়–শঙ্কা সেত্ত্বও দু ‘বাংলার সাহিত্য যেমন তার ছায়া পড়েছে ঐতিহাসিক ভাবে, তেমনই সমকালের অতিমারিও দুঃখ-বেদনায়-কৌতূকে সাহিত্যের আয়নায় নিজের মুখশ্রী দর্শন করেছে। গোটা বিশ্ব করোনার ভয়াবহ দুর্যোগ অতিক্রম করে চলেছে। এক-দুঃসহ হাড়হিম করা সময় পার করে চলেছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বের মানবকুলের কাছে এই ধরণের অভিজ্ঞতা মনে হয় প্রথম।করোনা- আবহকালে পৃথিবীর মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল অনেক খানি। বিশ্বের ইতিহাসে এই অতিমারি কোন নজির নেই। মানব সভ্যতা অস্তিত্বের মুখোমুখি আজ, এই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে গোটা বিশ্ব। নিজেদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সাহিত্যের পাতায় পাতায় তাদের মানবিক প্রচেষ্টা হয়ত অমর হয়ে থাকবে,ভবিষ্যতের মানুষের জন্য। আজ করনায় আক্রান্ত কিংবা আক্রান্ত না হয়েও কোয়ারেন্টিনে থাকা সৃজনশীল মানুষজন নিভৃতে সৃষ্টি করে চলেছেন ভবিষ্যতের সাহিত্য।অনেকই ভবিষ্যতেও সৃষ্টি করে যাবেন বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য,যা আগামী প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। তথ্যসূত্র-নানা ধরনের পত্রিকা ও গ্রন্থ এবং মাসিক কৃত্তিবাস।