গল্প: প্যাটার্ন লক

গল্প: প্যাটার্ন  লক

প্যাটার্ন লক
শিশির পাল

সারা বিশ্বে লকডাউন। করোনা ভাইরাসের অতঙ্কে সবাই গুটিয়ে আছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকা আর সাংসারিক কাজকর্ম করা । এই ক’দিনে জিষ্ণু ঘর গোছানো, নতুন নতুন রান্না এইসব ঘরোয়া কাজ কিছু শিখে গেছে । লক ডাউনের এটা একটা সুফলও বলা যেতে পারে। সব চেয়ে বেশি লাভ হয়েছে , ইউটিউব থেকে বেশ কয়েকটা প্রিয় গান ও হারমোনিকায় তুলে নিয়েছে। গল্প লিখতে ভালবাসে । বেশ কিছুদিন ধরে লেখালেখি বন্ধ ছিল অফিসের কাজের চাপে। কিন্তু ইচ্ছেটা ভেতরে ভেতরে সবসময়ই আছে। ভাল প্লট ইদানিং মাথায় আসছে না কিছুতেই। না লেখার একটা অস্থিরতাও ওর আছে। জিষ্ণু একটা মাল্টিন্যাশেনাল কোম্পানির ডিজিএম (হিউম্যান রিসোর্স) । এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম । বাড়িতেই লকড ডাউন।

প্রতিদিন বিকেলে বাড়ির ছাদে সবাই গিয়ে বসে। এটা এখন রোজকার রুটিন।ছেলে ক্রিসকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করছিল জিষ্ণু।মোবাইলটা পাশেই নামানো ছিল। দমদমপার্কের এই বাড়িটা জিষ্ণুর একটা বড় অবলম্বন। অফিসের যতই চাপ থাক, বাড়ি ফিরে ক্রিস আর রাইকে পেলেই সব উধাও। ওর একটা খুব অবাক করা লম্বা হলঘর আছে এখানে। এই হলটার একটা আলাদা নামও আছে। জিষ্ণু দিয়েছে। ইচ্ছে আকাশ । এখানেই জিষ্ণু তার নিজের মত কাজ করে। যা ইচ্ছে তাই । লেখালেখি। হারমোনিকা বাজানো । এই রুমে অবশ্য ক্রিসেরও একটা আলাদা পরিসর আছে।সেও তার নিজের মত কাজ করে। ছবি আঁকতে ভালবাসে ক্রিস। রাই পায়চারি করছিল ছাদে। জিষ্ণুর মোবাইলে একটা ফোন আসে। সেটা রাই ধরে। কথা শেষ হলে রাই দেখে মোবাইলটা লক হয়ে যায়। প্যাটার্ন লক।

“তোমার মোবাইলটা লক কেন ?” একটু অবাক হয়েই কথাটা বলে রাই। জিষ্ণুর মোবাইল এর আগে কখনো লক দেখেনি ও। ওদের দুজনের মোবাইল সাধারণত দুজনের কাছেই কোনও বাধা ছাড়াই ঘোরাঘুরি করে। কোনও লুকাছুপি নেই।
“আসলে, ব্যাঙ্কের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটা ইনস্টল করার সময় ওটা বাই ডিফল্ট লক করতে হয়েছে।”
জিষ্ণুর উত্তর টা ঠিক পছন্দ হল না, রাইয়ের। সে বলল, “প্যাটার্নটা বলো ।” জিষ্ণু একটু চুপ। এই অবস্থায় যদি মোবাইলটা ওপেন করে দেওয়া হয় তাহলে সমূহ বিপদ। সামলানো যাবে না। কিন্তু উপায় নেই। জিষ্ণু জানে , যে ভাবেই হোক এটাকে বাধা দিতে হবে। বলে, “দাও মোবাইলটা , আমি খুলে দিচ্ছি।” রাই এর সন্দেহ বোধহয় গাঢ় হয়।
“না । তুমি বলো। আমি খুলছি।”
জিষ্ণু বেশ অপ্রস্তুত। কিছুটা ভীতও বলা যায়। সন্ধ্যা নেমে আসছে ছাদে। চারপাশে স্ট্রিট লাইট জ্বলতে শুরু করেছে । পাড়াতেই , কাছেই একটা কালি মন্দির। আরতির আবহ ভেসে আসে। ক্রিসও তার ব্যায়াম থামিয়ে বাবা মা’র কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
রাই আবার বলে, “আমাকে বলো। তোমার কি কোনও অসুবিধা আছে ?”
“না। তা কেন থাকবে !”
জিষ্ণু , এ ছাড়া আর কী উত্তর দেবে। পরিবেশটাকে সহজ করতে চেষ্টা করে। রাই ছাড়ে না।

সন্ধ্যার ঝুরঝুরে অন্ধকার । জিষ্ণু ঘামছে। বোঝা যাচ্ছে না বাইরে থেকে।বোধহয় বেরোনোর রাস্তা নেই। জিষ্ণু, আর ঝুঁকি নিলো না। প্রায় ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে নেয়। তারপর , দ্রুত নীচে নেমে আসে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। রাই, ক্রিসও প্রায় পেছনে পেছনেই আসে। জিষ্ণু দরজা বন্ধ করায় ঢুকতে পারে না। এক মিনিটেরও কম সময়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে জিষ্ণু । দেখে মা , ছেলে দুজনেই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দরজার মুখে।প্রবল উৎকণ্ঠার ছাপ রাইয়ের চোখে মুখে। জিষ্ণু মোবাইল ছাড়িয়ে নিয়েছে।দৌড়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে । রাই এর কাছে আর কী প্রমাণ দরকার। জিষ্ণুকে মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সব সন্দেহের সমাপ্তি । জিষ্ণু মোবাইল থেকে সব ডিলিট করে দিয়েছে। কিন্তু এই এত অল্প সময়ে !

এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বাড়ির পরিবেশটা পাল্টে যায়। রাই এর চোখ মুখ দিয়ে আগুন বেরোয়। অন্ধের মতো গালাগালি দিতে থাকে। রাই বরাবরই খুব বদমেজাজি। সন্দেহবাতিকও কিছুটা। জিষ্ণু তাই সতর্কও থাকে। এরকম হয়ে যাবে, বুঝতে পারেনি।

“কী করছিলে তুমি মোবাইলটা নিয়ে? দরজা বন্ধ করে ? কী এমন ছিল, মোবাইলে, যা, আমাকে দেখানো গেল না ! দেখাও আমাকে। আমি জানতে চাই।” বলেই, মোবাইলটা ছাড়িয়ে নেয়।

জিষ্ণু ইতস্তত করে। বলে, “না, তেমন কিছুই ছিল না। আমি ইচ্ছে করেই এই নাটকটা করলাম। এই রকম একটা আবহ তৈরি করব বলেই। অনেকদিন ধরেই একটা ভাল গল্পের প্লট খুজছি।”
“ও সব যা তা বলো না। তুমি গল্প লিখবে আর আমি জীবনের সব হারাবো ! কী ভাব, নিজেকে ? তুমি ছাড়া সবাই বোকা। ঘাসে মুখ দিয়ে চলি আমি !”
রাই জোরে জোরে কথা বলে।রাগে হাঁপায়। আবার বলে, “এটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। প্রায় মাস ছয়েক আগে। তোমার অফিসে যখন গিয়েছিলাম।”
এবার জিষ্ণু হেসে ফেলে। হাসির আওয়াজটা, আগুনে ঘি দেওয়ার মতো ছড়িয়ে যায়।
“তোমার অফিসের ওই মেয়েটাকে আমি সেদিনই আন্দাজ করেছিলাম।”
জিষ্ণুর হাসিটা ভেতর থেকেই আসে।একটু স্বস্তিও পায়। যাক ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে তাহলে!
জিষ্ণু বলে, “বাহ । তার মানে তুমি তো অনেক আগে থেকেই গোয়েন্দাগিরি করছো ! এটা তো ঠিক নয়। তুমি এলিগেসন দিতেই পারো ! কিন্তু প্রমান না করলে , সেটা তো দুর্ভাগ্যের। আমার চরিত্রে কাদা ছেটানোর আগে, একটু ভাবো। ক্রিস সব শুনছে।ওর শিশুমনে যে ছাপ তুমি রাখছো, যখন নিজে ভুল প্রমাণিত হবে, পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে ? ক্রিসের মন থেকে ওই বাজে ধারণাটা পারবে মুছে দিতে ? দয়া করে চুপ করো। আমার সঙ্গে আলাদা বসে কথা বলো ! আমি আর কোনো কথা শুনবো না।”
রাই যে থামবে না, জিষ্ণু জানে।

একটা বড় অশান্তি হলে, তার রেশটা অনেকদিন থাকে। এখন এই লকডাউনে তার চূড়ান্ত বিভীষিকাময় রূপটা উঠে এলো জিষ্ণু আর রাইয়ের সংসারে।

এটা হওয়ারই ছিল । রাই একটু বেশিই পজেসিভ।ওর অধিকারে অন্য কেউ এসে গেলে, সেটা মানিয়ে নেওযার মতো মন ওর নেই। জিষ্ণু ঠিক অন্য মেরুর। যথাযথ উদার। তবে দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। পরিবারের প্রতি সে অত্যন্ত যত্নশীল। রাইকে তার প্রতিটা আব্দার সাধ্যমত মিটিয়ে দেয়।হয়তো এখান থেকেই রাই আরও বেশি পজেসিভ হয়ে গেছে। সে জানে জিষ্ণু কোনও ভাবেই তাকে অযত্ন করবে না। এই বিশ্বাস যে ওর ধাক্কা খেতে পারে তার কোনও ধারণাই এতকাল রাইয়ের ছিল না।

বিবাহিত জীবন দশ বছরের। তাদের জানাশোনা আরও পাঁচ বছর বেশি। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই একজন আর একজনের সীমারেখায় ঢুকে নিজেদের সবকিছুই এক করে নিয়েছিল। কই সেদিনের সেই সব উত্তাল সময় কোথায় এখন ? সাদামাঠা দৈনন্দিন কি মুছে দিয়েছে, লড়াই করার প্রবল জেদ। সংসার, চাকরি , দায়িত্বের বোঝা বয়ে নিয়ে হেঁটে চলা প্রত্যহ কি ঢেকে দিয়েছে ভালোলাগার ছোট ছোটো সুখ দুঃখ কথা ? নিয়মিত অফিস। অফিস থেকে বিকেলে রুটিন মাফিক টানা লম্বা ফোন রাইকে। এই ডেইলি দীর্ঘ ফোন নিয়ে অফিসেও মাঝে মাঝে কথা শুনতে হয় জিষ্ণুকে। কিন্তু এটাকে ও ম্যানেজ করে নিয়েছে। এই একঘেয়েমি থেকে বেরোতেই জিষ্ণু হাঁপিয়ে ওঠে। রাই কী ভাবে তা নিয়ে জিষ্ণু ভাবে না। তাই আজ জীবনে ঝড় এসে সব উল্টে পাল্টে দিচ্ছে। জিষ্ণু ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে। ধুলোবালি উড়ে আসা শুকনো পাতা ভর্তি ওর এক চিলতে উঠোনে, এখন মেঘ বৃষ্টির আনাগোনা। এটাই তো চেয়েছিল জিষ্ণু। এমনই বৃষ্টিতে সে ভিজবে। সংসারের প্রতিদিনকে সে অন্য রঙে আঁকতে চায় এখন। আর এটা রাই কিছুতেই হতে দেবে না।

জীবদ্দশার সবচেয়ে অস্থির ও অশান্তির সময়পর্ব হিসেবে যদি কিছু সংজ্ঞায়িত করা যায়, জিষ্ণুর বা রাইয়ের, তাহলে সেটা এই লক ডাউন। প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা দিন যেন আগুন নিয়ে খেলা। বাড়িটা যেন জতুগৃহ। রাই যে শেষ অব্দি কী করবে তার কোনও নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট আভাস পাচ্ছে না জিষ্ণু।

লকডাউন শেষ। ওয়ার্ক ফ্রম হোম স্টপ করে জিষ্ণু এখন অফিসে। দমদমপার্কের বাড়ি থেকে এভারেস্ট হাউসের দশতলার অফিসঘর। কোয়ারেন্টিনের থেকে মুক্তির মতো এক অপার স্বাধীনতা অনুভব করে জিষ্ণু। সত্যিই কি মুক্তি !

জেনারেল ম্যানেজার জিষ্ণুকে ডেকে পাঠান। ওনার চেম্বারে। জিষ্ণু আসে। অন্যদিনের মতোই। লক ডাউনের পর একদিন ফরমাল মিট হয়েছিল। জিএম নিজেই সবাইকে ডেকে কথা বলেছিলেন। জিএম এর সঙ্গে লক ডাউনের পর জিষ্ণুর একা দেখা হয়নি ।আজ দুদিন পর প্রথম মিট।

জিষ্ণু দেখে, স্যার একাই আছেন। জেনারেল ম্যানেজারের চেম্বারের সঙ্গে একদিকে লাগোয়া বোর্ড রুম। অন্যপাশে ওয়েটিং হল। সাহেবের রুমটা জওহরলাল নেহরু রোডের দিকে । জিষ্ণুকে বসতে হাত দেখান। থ্যাংকস জানিয়ে জিষ্ণু বসে। ময়দানের অনেকটা অংশ এই চেম্বার থেকে দেখা যায়। নীচে তাকালে, বিড়লা প্লানেটরিয়াম। জিষ্ণু কিছু বলার আগেই জিএম বলেন , “গুড মর্নিং জিষ্ণু। আর ইউ ওকে ? আর , অল অ্যাট হোম ওকে, পোস্ট লকডাউন ? রাই, ক্রিস ?”

বড় অফিসাররা এখানেই স্বতন্ত্র।তাঁরা জানেন, অধস্তন কর্মচারীর সম্পর্কে সব কিছুই মনে রাখতে হয়।অনান্য অনেক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখার মতো। এটা হিউম্যান রিসোর্সের বড় পার্ট।পুরো ফ্যামিলির কথা এভাবে বলাটাও একটা সাইলেন্ট মোটিভেশন ।

রাইয়ের মুখটা মনে আসে। ক্রিসেরও। আর লক ডাউনে কাটানো যাচ্ছেতাই দিনগুলো। জিষ্ণু বুঝতে দেয় না। বলে, “ইয়েস স্যার। এভরিথিং ইজ ফাইন। উই অল আর ওকে। হাউ অল আর ইউ ডুইং স্যার ?হোপ, ইউ হ্যাড বেস্ট টাইম উইথ ইউর ফ্যামিলি ডিউরিং লকডাউন ।”
“ইয়েস উই হ্যাড।” জিএম বলেন। তারপর বলেন, “জিষ্ণু, একটা খুব পার্সোনাল এবং সেনসিটিভ কথা। ডোন্ট মাইন্ড। ডিউরিং লক ডাউন, রাইয়ের সঙ্গে কোনও বড় ঝামেলা হয়েছে ?”
জিষ্ণু অনিবার্য অবাক। একটা ঝড়ের ইঙ্গিত ও আঁচ করতে পারে । বাইরের সিটিজেন পার্কের উপর রোদ। দূষণ কমে যাওয়া কলকাতায় ভিক্টরিয়া মেমরিয়ালের চূড়া স্পষ্ট দেখা যায়। পরির মূর্তিটা অবশ্য বোঝা যায় না। জিষ্ণু উত্তর দেয় না। অপ্রস্তুত বোধ করে।

জিএম বলেন, “আমি জানি। এরকম কোনও ব্যাপার নেই।তাহলে তো এই ছ’মাসে অফিসের আনাচে কানাচে শোনা যেত। আর সৌমনা ইজ অ্যান এক্সসেলেন্ট লেডী। আই বিলিভ, সি ইজ বেস্ট নোন টু হার লিমিটেশনস। তাকে দেখে একবারের জন্যও এসব কথা ভাবা যায় না।”

জিষ্ণু আরও অবাক হয়। জিএম স্যার তো সব কথা বলছেন। জানলেন কী ভাবে ? রাই কি সন্দেহের বশে এতসব কথা অফিসে বলে দিয়েছে ? জিএম বলতেই থাকেন। “অবশ্য , বাইরে থেকে দেখা আর ভেতরে অন্য কিছু ঘটে যাওয়ার মধ্যে তো বিস্তর ফারাক। সুতরাং, বাইরের মানুষ হিসেবে, ওই জায়গাটা আমরা বুঝতে পারব না।”
জিষ্ণু আর পেরে ওঠে না। ওর কান গরম হয়ে যায়। লজ্জায় , অস্বস্তিতে মুখ লাল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত, জিএম স্যার বলেই ফেললেন একটা আশঙ্কার কথা।একটা সূক্ষ্ম সন্দেহের কথা। জিষ্ণু যে নিপাট ভদ্রমানুষ, তা তো অফিসের সবাই জানে। তারপরেও এমন সন্দেহ আসে কী করে !
জিষ্ণু বলে, “স্যার আয়াম নট ফিলিংগ ওকে। আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ আফটর এ লিটল হোয়াইল।” বলেই উঠে যায় চেয়ার থেকে। জিএম বলেন, “প্লিজ হ্যাভ পেসেন্স।” বলেই কলিং বেল বাজান। গার্ড এলে বলেন, “পাশের ঘর থেকে ওনাদের ডেকে আনো।”

জিষ্ণু বসে না। ওর চোখে বিস্ময়। দ্যাখে রাই ওর অফিসে। একেবারে জিএম স্যারের কাছে। বাহ। এরই মধ্যে সব কথা বলা হয়ে গেছে ! সব পরিষ্কার এবার। জিষ্ণু অপেক্ষা করে। নতুন কিছুর।প্রবল এক উত্‍কণ্ঠা নিয়ে।

রাই, জিষ্ণু দুজনেই পাশাপাশি বসে। জিএম বলেন, “একটু চা আনাই।” বলেই চায়ের অর্ডার দেন। রাইকে বলেন, “ম্যাডাম দেখুন, আমরা অফিসে জিষ্ণুকে, সৌমনার ব্যাপারে কখনও উৎসাহী দেখি না। ইন ফ্যাক্ট, আজ অব্দি ছোট কোনও ঘটনাও শুনিনি। শুধু একটাই ব্যাপার বলার, যেটা নিয়ে জিষ্ণুকে অনেকবারই বলেছি, ও প্রতিদিন বিকেল তিনটে থেকে চারটের সময় একটা লম্বা পার্সোনাল কল করে। যেটা সবাই দেখে। আমি তো দেখে দেখে, শেষে বাধ্য হয়ে ওকে ওটা অ্যাপ্রুভড করে দিয়েছি। আনঅফিসিয়ালি অফিসিয়াল হয়ে গেছে।”
বলেই জিএম একটু হাসেন। জিষ্ণু আর রাই কিন্তু গম্ভীর। জিএম কথা বলার পর একটা সংক্ষিপ্ত স্তব্ধতা।
রাই এবার একটু যেন অবাক হয়। জিএম স্যারকে বলেন, “দেখুন। এটা আমার কাছে অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। অনেক কিছুই মাথায় আসছে। ইভেন সেপারেশনের কথাও। আবার আপনার এই কথা শোনার পর, আমার ক্যালকুলেশনও গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার আরও একটু সময় দরকার।”

চা থেকে হালকা বাষ্প উঠছে। তাহলে কি রাই শুধুশুধুই সন্দেহ করছে ? ক্রিসকে তো কত কথাই বলেছে। অফিসে জিষ্ণুর পজিশনটাই বা কী হবে। তাহলে কি সেদিন বন্ধ ঘরে মোবাইল নিয়ে ঢুকে থাকা আর বাইরে বেরিয়ে এসে বলা, “ইচ্ছে করেই এই নাটকটা করলাম ” এটাই ঠিক ! অঙ্ক তো মিলে যাচ্ছে। জিষ্ণু ঠিকই বলেছে। ওটা নাটক ছাড়া কিছু ছিল না। ও শুধু চেয়েছিল রাইকে এরকম সিচুয়েশন ক্রিয়েট করে অস্থির রাখতে। একঘেয়ে দৈনন্দিনকে রঙিন করার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কীই বা হতে পারে ! এটা সত্যিই একটা অসম্ভব ভালো গল্পের প্লট ! রাই এবার বলে, “স্যার, একটা অনুরোধ। আমি আপনার কাছে এসেছি। এইসব ফ্যামিলি ম্যাটার যে ডিসকাস করলাম , এগুলো আর পাঁচকান না হলেই ভালো। আসলে, ডিপ্রেশান আর ভয় থেকেই এই অবস্থা।”

জিএম হাসেন।এবার একটু জোরে। শব্দটা গোটা ঘরে ছড়িয়ে যায় । বলে, “ম্যাডাম। আমরা এতবড় কোম্পানি চালাই।এত উঁচু পোস্ট হোল্ড করি।আমরা জানি কোথায় কোন ইনফরমেশনের কী ভ্যালু আছে। আপনি রেস্ট অ্যাসুওরড থাকুন। কেউ জানবে না। সৌমনা তো নয়ই। আর জিষ্ণু ইজ ব্রিলিয়ান্ট এন্ড ওয়ান অফ দ্য মোস্ট পারফর্মিং এমপ্লয়িজ অফ দিস কোম্পানি, সো, ওকে আমরা হারাতে পারি না। কোনো অবস্থাতেই। “

কথাগুলো শুনে রাই আশ্বস্ত হয়। জিষ্ণুকে নিয়ে একটা অহংকারও অনুভব করে ভেতরে ভেতরে। এবার একটু হাসিমুখ।রাইয়ের। চেম্বারের পরিবেশটাও এক লহমায় পাল্টে যায়। রাই তো জানে, প্রতিদিন নিয়ম করে বিকেল তিনটে থেকে চারটেই যে ফোনে জিষ্ণু বিজি থাকে, তার সঙ্গে সমান সময় , ফোনের অন্যপ্রান্তে, বিজি থাকে রাই নিজেই। কিন্তু সেটা আর জিএম কে বলে না। লকডাউনে যাচ্ছেতাই হয়ে যাওয়া সম্পর্কটা আর একবার পরীক্ষায় উতরে গেল। ওরা আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে জিএম স্যারের চেম্বার থেকে। রাই বুঝতে পারে। জিষ্ণু এখনও একই আছে । সততায় সমুদ্রের মত গভীর। উদারতায় আলোর মতো স্বচ্ছ । ভালোবাসায় আকাশের মতো সীমাহীন।