গল্প: দাদুর চশমা

গল্প: দাদুর চশমা

দাদুর চশমা
সৈয়দা কানিজ রাসুল

দাদুর খাটের তলাটি শুভ’র খুব প্রিয় জায়গা। তার কারণ অন্য সব খাট থেকে এটা বেশ উঁচু। দাদু বলেন এটি খাট নয়, পালঙ্ক। শুভ দিব্যি এই পালঙ্কের নিচে বসে খেলাধুলা করে, ছবি আঁকে। মাঝেমধ্যে ঘুমিয়েও পড়ে। দাদুর খাটের তলাটি থাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দাদু এ ব্যাপারে খুবই সচেতন। খাটের তলায় হাবিজাবি জিনিসপত্র দিয়ে জঞ্জাল করে রাখতে একদমই পছন্দ করেন না। জঞ্জাল বেশি হলে পোকামাকড় এবং মশার উপদ্রব হয়। এজন্য প্রতিদিনই ঝাড়পোঁছ করা হয় খাটের তলাটি। তাই শুভ’র মতো ছোট বাচ্চা খাটের তলায় খেলাধুলা করলেও কেউ আপত্তি করে না।

শনিবার শুভ’র স্কুল ছুটি। সকাল বেলা নাশতা খেয়ে দাদু পালঙ্কের উপর বালিশে হেলান দিয়ে দৈনিক পত্রিকা পড়ছেন। সকালে হকার পত্রিকা দিয়ে গেলে শুভ প্রথমে সেটা দাদুকে দিয়ে আসে।এটা তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেছে। সেই পত্রিকা আগে কেউ পড়তে পারেনা। কেউ পড়লে শুভ বেদম কান্না জুড়ে দেয়।
শুভ দাদুর গা ঘেসে বসে আছে। দাদুর চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। শুভ দাদুকে অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে। সে খুব ধীরস্থির প্রকৃতির শিশু। ও যখন প্রথম হাঁটতে শিখে তখন খুব সাবধানে পা ফেলতো। যাতে সে পড়ে না যায়। হাঁটতে শিখলে ছোট শিশুরা দুমদাম আছাড় খায়। কিন্তু শুভ’র বেলায় ব্যতিক্রম। দাদু শুভ’র মাকে বলতেন, তোমার ছেলে খুব বুদ্ধিমান হবে। আর ও যে কাজই করবে খুব কনফিডেন্টলি করবে, বুঝেছ বৌমা?
শুভ চুপচাপ বসে লক্ষ্য করছে দাদুকে। পেপার উল্টাতে গিয়ে শুভ’র দিকে দৃষ্টিপাত করলেন দাদু। শুভকে দাদু জিজ্ঞেস করলেন,
–কি দাদু তুমি চুপচাপ কেন? কিছু বলবে?
–তোমার পেপার পড়া হয়েছে? আজ আমার স্কুল ছুটি। তুমি আমার সঙ্গে খেলবে?
–কিন্তু আমার যে এখনও পড়া শেষ হয়নি দাদু। শেষ হলেই তোমার সাথে খেলবো।
–তুমি এত কি পড় পেপারে? এত ছোট লেখা পড়তে ভালো লাগে তোমার?
–পেপারে অনেক খবর থাকে দাদু। সারা বিশ্বের খবর।
সারা দুনিয়াতে কি হচ্ছে পেপার পড়লে সব জানা যায়।
–সে তো টিভিতে খবর দেখলেও জানা যায়। তাহলে এত কষ্ট করে তুমি পড় কেন?
এবার দাদু সত্যিই অবাক হলেন শুভ’র বুদ্ধি দেখে। যা টিভিতে দেখা যায় তা কষ্ট করে পড়ার দরকার কি? কিন্তু শুভকে তো পেপার পড়ার ভালো দিকটি জানাতে হবে। তাই দাদু শুভকে বললেন,
–পড়া আর দেখার মাঝে অনেক তফাৎ দাদুভাই। জানো দাদু আমাদের সময় এই পেপারই সম্বল ছিল। তখন তো টেলিভিশন ছিলনা। আমরা খবরের কাগজ পড়ে সব কিছু জানতে পারতাম। পড়ার মাঝেও অনেক মজা আছে। পড়তে পড়তে সব কিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুঝলে দাদুভাই।

শুভ’র দাদু আবার পেপার পড়ায় মনোনিবেশ করেছেন। শুভ তার খেলনা পাজল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ওর বাবা বিভিন্ন প্রাণীর একসেট পাজল কিনে দিয়েছেন। শুভ সেগুলো দাদুর সঙ্গে কম্পিটিশন দিয়ে সাজিয়ে দেয়। দাদুর আগে শেষ করতে পারলে হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে সারা বাড়ি ঘুরে জানিয়ে দেয় সে দাদুকে হারিয়ে দিয়েছে। শুভ চুপচাপ দাদুর পেপার পড়া দেখছে। এই মুহূর্তে দাদুকে খুব জ্ঞানী মনে হচ্ছে ওর। দাদুর চশমার উপর শুভর খুব সুনজর। সেটা দাদু বুঝতে পেরে ওর হাত থেকে আগলে রাখেন নিজের চশমাটিকে। শুভ প্রায়ই ভাবে ঐ চশমাতে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। দাদু বলেন পড়লে নাকি সব কিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ও মনে মনে ভাবে চশমাটা এক সময় বাগাতে হবে। শুভ দেখল আসল পত্রিকা পড়া শেষ হলে চারপাতার ট্যাবলয়েটটি পড়া শুরু করেছেন দাদু। সে কৌতুহল মিশ্রিত চোখে জিজ্ঞেস করল,
–দাদু তুমি ছোট পেপার পড়ছ কেন? এটাতে তো আম্মু রান্নাবান্না দেখে। আজকে তো এতে রান্নাবান্না নেই।
–হাঃ….হাঃ….হাঃ রান্নাবান্না থাকলে কি এটা এখন আমার কাছে থাকতো? চলে যেত তোমার মায়ের আন্ডারে। এই দেখ, এটা শনিবারের ট্যাবলয়েট। এখানে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে। ‘লেখক হওয়ার পালা আপনার ’। নতুন লেখকদের জন্য দারুণ সুযোগ ! বুঝলে দাদু।
–কিন্তু তুমি তো অনেক বড় লেখক। তোমার লেখা এত্তো মোটা মোটা বই আছে। ও––বুঝেছি তুমি এখন পুরনো হয়ে গেছ। তাই নতুন লেখক হতে চাও তাইনা দাদু?
–হাঃ…হাঃ….হাঃ আমার দাদুর তো অনেক বুদ্ধি! বুঝেছি তোমারই হবে দাদু।

দাদুর হাসির কারণ শুভ বুঝতে পারেনা। শুভকে দাদু ওর বড় ভাই সামিনকে ডাকতে বললেন। সামিন এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। কাজেই দাদু ভাবছেন ওর এখন অনেক অবসর। কিন্তু সামিন সারাদিন কম্পিউটারে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকে। দাদু ওকে নানা রকম বই পড়তে উৎসাহিত করেন। ইন্টারনেটের যুগে ছেলেমেয়েরা আজকাল গল্পের বই বা দৈনিক পত্রিকাটিও পড়েনা। পড়ার অভ্যেসটা আজকাল উঠেই যাচ্ছে। দাদু তাঁর নাতিদের বই পড়ার অভ্যেসটা তৈরী করে দিতে চান। শুভ সামিনকে গিয়ে বলল,
–দাদু তোমাকে ডেকেছেন।
–কেন ডেকেছেন?
–আমি জানিনা। আমাকে একবার খেলতে দিবে?
–না এখন না, পরে।
শুভ কম্পিউটার পজ করে দাদুর কাছে গিয়ে বলল,
–তুমি আমায় ডেকেছ?
–হ্যাঁ দাদুভাই। তুমি এখন কি করছো?
–আমি এখন গেম খেলছি দাদু। খুব ইন্টারেস্টিং গেম।
–গেম খেলার মতো তোমার আশেপাশে যে আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে তা কি তুমি জান?
–তুমি কি বলবে তাড়াতাড়ি বল দাদু, আমার সময় নেই।
–এত তাড়াহুড়ো করলে আমি বলবো কি করে? এই দেখ, পত্রিকাতে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছে ‘লেখক হওয়ার পালা আপনার ’। তুমি যে কোন একটা বিষয় নিয়ে একটু ভাব। তারপর সেটা লিখে ফেল আর পাঠিয়ে দাও এই পত্রিকার ঠিকানায়।
–না না দাদু আমার দ্বারা ওসব কিছু হবেনা। আমি এখন ভ্যাকেশন এনজয় করছি। তাছাড়া আমার লেখা আসেনা দাদু।
–সময় পেলে তুমি গল্পের বই পড়, পত্রিকা পড়। পড়ার আনন্দই অন্যরকম। বই পড়তে পড়তে ঘটনা গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর পড়তে পড়তে মনে ভাবনার উদয় হয়। সেই ভাবনাগুলো খাতায় লিপিবদ্ধ কর। বার বার পড়ে সেটাকে সংশোধন করে লিখলে কিছু একটা সৃষ্টি হবে। আর সৃষ্টির আনন্দই আলাদা।
–দাদু আমি এখন যাই। গেম খেলা শেষ করতে হবে।

সামিন চলে গেল। দাদু ওর বিরক্তমুখে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন যুগ পাল্টেছে। যেদিকে যুগের হাওয়া বইছে সেদিকে ঝুঁকছে তরুণ প্রজন্ম। চোখ থেকে চশমা খুলে মাথা বালিশে এলিয়ে দিলেন। শুভ এতক্ষণ সামিন আর দাদুর কথা শুনছিল। দাদুকে হতাশ হতে দেখে ওর খুব কষ্ট হল। দাদু চোখ বন্ধ করে আছেন। শুভ খুব সন্তপর্ণে দাদুর চশমাটি নিয়ে খাটের তলায় আশ্রয় নিল, সঙ্গে শনিবারের ট্যাবলয়েটটিও নিয়ে গেল। চোখে দাদুর চশমা দিয়ে পেপার পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কি কান্ড৷! কিছুই তো দেখা যাচ্ছেনা। চোখের সামনে কোন ছবি ভেসে ওঠা তো দুরের কথা লেখাগুলোই সে ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছেনা ! বুড়ো বয়সে দাদু যে সব কি বলেন তার মাথামুণ্ডু নেই। দাদুর চশমা মাথার উপর তুলে দিয়ে কি লেখা যায় ভাবতে লাগলো শুভ।

সামিন চলে গেলে দাদু সামিনের কথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। হটাৎ তন্দ্রা কেটে গেলে দাদু উঠে বসলেন। হাত দিয়ে সারা বিছানায় চশমা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু পেলেন না। দাদু চিন্তিত মুখে সারা ঘরে খুঁজে দেখলেন। না কোথাও নেই । খাটের তলায় খুঁজতে গিয়ে দেখলেন শুভ চোখে চশমা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুকের উপর একটা খাতা। দাদু চশমাটি শুভ’র চোখ থেকে সাবধানে খুলে নিলেন । চশমা চোখে খাতাটি হাতে নিয়ে দেখলেন । শুভ একটা গল্প লিখেছে, ‘আমার বিড়াল ছানা ’। শুভ’র একটা পোষা বিড়াল আছে। নিজের পোষা বিড়ালকে নিয়ে লেখা গল্পটা পড়তে পড়তে দাদুর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো হাসি। সেই সঙ্গে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা আনন্দাশ্রুও।