গল্প: চৈতন্যলাভ

চৈতন্যলাভ
শামীমা সুলতানা
আজ নিতুর বিয়ে।হৈচৈ হট্টগোলে মেতে আছে চারপাশ।অতিথি প্রতিবেশী মুরুব্বি সব মিলিয়ে হুলস্থুল কারবার। এটাতো শহর নয় পাড়া গাঁ। এখানে বিয়ের ‘ব’ উচ্চারণের সাথে সাথেই জেগে ওঠে পাড়া, স্বজন এমনকি বৃক্ষরাজি তারাও।হুলস্থুলে মাতোয়ারা গাঙপার খোলামাঠ আরও বাদবাকি সব।
আমি ঢাকায় থাকি সেই থেকে যখন আমার খোলা হাওয়ায় শিকল পড়ার সব আয়োজন সারা। তখন থেকেই গাঁও গেরামের কুটুম হয়েই বাঁচা।তবে আমাকে ভালোবাসে সবাই। আদর আপ্যায়ন আর প্রশংসায় কম যায় না কেউ-ই।
মামার ছিল জোর দাবী— ভাগনী, যেকোনো মূল্যে বিয়েতে থাকতেই হবে, না করলে মানছি না। হতেই হবে রাজি।
আমি তাদের লক্ষ্মী ভাগনী, সেই সাথে আদর্শ সবার । আত্মীয় পরিজন সবাই একে অন্যের সাথে করে আমার গুণগান। সবাই তাদের মেয়েদের বলবে– আরে আরে তোরা কেমন মেয়ে বল? ভালো মেয়ে হতে চাইলে মাহিনকে ফলো কর। ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্মী ছিল মাহিন। এই যে এতো বছরের সংসারজীবন- কোনদিন শুনেছিস বাবার বাড়ি এসেছে নালিশ? কোন দিন রাগ করে বাপের বাড়িতে, নাহ তাও আসেনি। আর ওর ছোটবেলার কাহিনী সেতো সবার মুখে মুখে সুখ্যাতি।
আমি মুখ টিপে হাসি। তবে আবার মন সে কী বলে কেউ খবর রাখেনি। আমিও মনের আঙিনায় খোয়ার পুষিনি।আইল ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে এখানে ঢুকবে এমন বদসাহস কারো হয়নি।মনের খবর আমি নিজেই নিতে চাইনি।অমন অনাসৃষ্টি মন সে আর খবর রাখার কী প্রয়োজন? সময় অসময় কাঁদুনি চুবানি। তাকে শাসনে রাখতে ব্যস্ত রাখি কাজে।
বলি শোন হে মন, কর্মই জীবন।কর্মগুণে খাঁটি হ বাদবাকি সব পাবি।
সে যাই হোক,আমি এখন গ্রামে বিয়ের আসরে।মামার এতো আব্দার তার কথা কী ফেলতে পারি? তাই কী কখনো হয়েছে? নাহ,কখনোই হয়নি। সংসার সবকাজ একপাশে জড়ো করে কপাট তুলে আমি এখন বিয়ে বাড়ি।শ্রদ্ধা ভক্তি আর আদর্শের দাম দিতে আমি লক্ষ্মী মেয়ে হাজির হয়েছি মামাবাড়ি।
এতো হট্টগোল সইতে পারি না। তাই কানে কুলুপ এঁটে মুরুব্বি গুরুজন আর হৈ-হুল্লোড় এড়িয়ে ঢুকে যাই কনের ঘরে।নিতু আমার মামাতো বোন হলেও আপনের চেয়ে কম নয়। শুধু মেঝো মামা নয় তিন মামার বংশের একমাত্র কন্যা কুমারী সে। ফুটফুটে সুন্দরী না বলে বালিকা বলাই ঢের বেশি ভালো। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি নিষ্পাপ ওই চোখে।কেমন আদর আদর মুখ, ওমুখে যেন চাঁদ তারার বসতি। চোখ জুড়ানো নিষ্পাপ ঠোঁটের হাসি।একটা প্রাণবন্ত গোলাপ কুঁড়ি।
আমি অপলক তাকিয়েই থাকি।
কী দেখছো আপু?
দেখছি একটা লালপরী, দেখছি জুঁই জবা চামেলি। দেখছি রাজকুমারী চম্পাবতী।
আমি দুষ্টুমি করেই চলছি।
ডানাকাটা পরীটা হঠাৎ আমার বুকে নুয়ে পরে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
আরে নিতু সোনা – কাঁদছিস কেন? মেকআপ নষ্ট হবে যে!
ওর হৃদয় ভাঙবার আওয়াজ শুনছি আমি।স্রোতের টানে ভাঙছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তীর।একটা পদ্মফুলের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার আওয়াজ। বাতাসে বজ্রপাত।
অনেকক্ষন হৃদয় নিংড়ে কাঁদলো নিতু।
আমি ও কাঁদতে দিলাম ওকে।ঝড় শেষে গুমোট আকাশ চকমকিয়ে ওঠে। নীতুও এখন মেঘমুক্ত আকাশ।মেঘের গর্জন নেই গুমোট কেটেছে কিছুটা।
কান্না শেষে শান্ত স্বরে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমার ঝকঝকে মেকআপ করা পরিপাটি মুখের ওপর।প্রশ্ন শুনে আমার আভিজাত্য লুটিয়ে পরে ধুলার ধরায়।আমার সুখ্যাতির অহংকার শিমুল তুলার মতোই বাতাসের আগে আগে পালায় লজ্জায়।
হঠাৎ রোদ্র শুষে নিলো আমার সমস্ত লাল কোষ। সাদা মেঘমালা লেপ্টে দিল মুখের ওপর। আকাশটা থমথমে ঈশান কালো, হিমালয় ধসে গেলো নীলজলে। পৃথিবীটা আচমকা হেলেদুলে নাচতে লাগলো আমাকে নিয়ে। আমি মাতালের মতোই টলতে থাকি।
সত্যিই তো! ওর কথার যুক্তি আছে।আমি কেন এতোদিন বুঝতে পারলাম না।
এবার তবে আমার কথা বলি।
আমি মাহিন। ষোলোআনা বাধ্যগত সন্তান। শুধু মা বাবা কেন? জ্ঞাতিগুষ্টি মুরুব্বিগোছের সবার।পথে হেঁটে যেতে নত রাখি চোখ। সেই থেকে মাটির প্রতি মায়া,ফসলের ক্ষেত পর্যন্তই আমার সীমানা। আকাশের উচ্চতা মাপতে হলে ঊর্ধ্বাকাশে তাকাতে হবে তাতে হোঁচট খাবার ভয়।তাই আমার উপরে তাকানো নিষেধ।পায়ের নিচে সহজিয়া মাটি কাদা সর্বসওয়া।
আমাকে আকাশ ডাকে,বাতাস কানে কানে গুনগুন করে। মন্ত্র জপে কতো কথার। আমি কুমন্ত্রণা ভেবে তিরস্কার করে খেদাই। আমাকে ডাকে পাহাড় পর্বত হিমালয়।সমুদ্রের তর্জন-গর্জন শুনতে ব্যগ্র আমার মন।কিন্তু বাঁধা নিষেধের জাল ছিঁড়বার আমার কী সাধ্য? আমি জড় বৃক্ষ জীবন।
আমাকে শেখানো হয়েছে বড়দের কথার ওজন পৃথিবী সমান।তাদের কথা এড়িয়ে যাওয়া মানে ধ্বসে পড়া।সহনশীলতা শেখানো হয়েছে চিরকাল।কিন্তু শেখানো হয়নি সহনশীলতা মানে অন্যায় মেনে নেওয়া নয়।
আমি ধ্বসে পড়তে চাই না। আমি হিমালয় ছোঁবো।আকাশ ডিঙ্গিয়ে উঁচুতে উড়বো।আমার স্বপ্ন শুভ আগামীর। অভিভাবকের শৃঙ্খলে পেঁচিয়ে নিচ্ছি স্বপ্ন।
আমি বন্ধু চিনি না। আমি ছেলেদের মাড়িয়ে চলি।মাটির সাথে চোখ মিশিয়ে পথ চলি। কারণ ভিন্ন লিঙ্গে শুধুই কাম,পাপ, রিপুর তাড়না।
বৃক্ষ শাখে ফুল ফোটে,কোকিল ডাকে,দখিনা বাতাসে মিহি সুবাস ভাসে।আমি আনচান করি কিন্তু বেঁধে ফেলি নিজেকে। শত ব্যস্ততায় ভরাডুবি মনকে ভাসিয়ে রাখি আর অনুশাসনের ঘেরাটোপে মুক্ত মনকে বন্দী করি।
অন্ধ আমি একা চলতে জানিনা।যেমন খুশি আমাকে চালিয়ে নিয়ে যায় আমার গুরুজন। আমি তাদের নমঃ নমঃ সম্মানে ভক্তিতে মাথায় রাখি।
মনে হাজার প্রশ্ন জাগে।
কিন্তু আমাকে শেখানো হয়েছে যাকিছু নিষিদ্ধ সে সম্পর্কে জানতে মানা, সেটা পাপ।আমার জ্ঞানের গণ্ডী গুরুজনের বুদ্ধিমত্তায় আটকে রাখি।এর বাইরের সব নিষিদ্ধ সব অপরাধ।
আমার সুনাম দিক্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে।
লক্ষ্মী, হীরেরটুকরো মেয়ে। দশ গাঁয়ে বিরল আমি।
আমার মেরুদন্ড সোজা হয়না তাদের ছাড়া। আমি ময়না টিয়া তিতিরের মতোই পোষাপাখি।
তারপর
তারপর বাড়ন্ত বয়সটাতে চোখেমুখে আলো ফেলে একজন। আমি অন্তরে আচঁড় পাই তার। সেই আঁচড় কেমন একটা সুখানুভূতি।ভাবতে ভালো লাগে তাকে। আমার শরীর মনে বিজলি চমকায় তার কথা ভেবে।কুরে কুরে সুখ খুঁজি, খুঁজি একচ্ছিদ্র নির্জনতা।
কিন্তু এই সুখ অনুভব পাপ।তাই একে চাপা দিতে হরেক কসরত করি হররোজ।
নাহ, আমাকে খুব বেশিদিন কষ্ট করতে হয়নি। কিশোরী নন্দিনীর এবার গতি করলো মুরুব্বিরা নিজেই। বরের পাশে একটা কাপড়ের পুঁটলির মতো বেঁধে আমাকে সমর্পণ করা হল। আমার দায়িত্বের হাত বদল হল। এখন আমার জীবন তার কাছে সমর্পিত, তার সেবায় তার ইচ্ছায় বর্তাবে আমার ভবিষ্যৎ। তিনি সুঠাম পুরুষ। এক নগন্য নির্বোধ বালিকাকে আশ্রয় দিয়ে ধন্য করেছে যেন। এ আমার এক জন্মের সৌভাগ্য।
বিদায়বেলা মা বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল — এটাই শেষ যাত্রা। এ বাড়ি আজ থেকে তোমার নয়। স্বামীর গৃহে মুখ লটকে পড়ে থাকবে।সহস্র কষ্ট বুকে গুমরে কাঁদলেও মেনে নিতে হবে সব।
গুরুজনদের গম্ভীর তথ্য কথা বুঝি না বুঝি মেনে নিলাম। মেনে নিতে হয় এটাই নিয়ম।যে নিয়মে পূবাকাশে সূর্য ওঠে পশ্চিমে তলিয়ে যায় চুপচাপ। শীত আসে গ্রীষ্ম ফিকে হয়।আমাকে শেখানো নিয়মগুলো অমনটাই সাত আসমানের তর্জমা।
কিন্তু আমার আগামী আমার অন্তরে চিরজাগ্রত স্বপ্ন আমার আকাশ? তার কী হবে? নাহ, ওসব ভাবলে গুরুজনের আদেশনামা ছিঁড়ে ফেলতে হবে নিউজপেপারের মতো। তাই ওড়ার ডানা দুটো ভেঙে ফেললাম নিজেই।
দিন যায় বছর যায়—-
বিদ্যা হয় বুদ্ধি হয়। ভালো মন্দ চেনবার মতো বিবেক উথলে ওঠে বুকের ভেতর। কেমন মচমচ করে ওঠে বুকের রিবগুলো। মনে হয় ভেঙেগুঁড়ে হৃদপিণ্ডের কপাট খুলে বেরিয়ে আসবে সব কষ্ট। পৃথিবীর তামাম নিয়ম সাজিয়ে নেবে মনের মতো। আর সেই যে বুকের ভেতর আঁচড় কাটা একটা মুখ ছিল সে আমাকে দহন করে জ্বালায় পোড়ায়। বুকের ভেতর কাঠপোড়া আগুন।আমি অঙ্গার হতে হতে কয়লা থেকে ছাই হই। তারপর একদিন দুইদিন তিনদিন। দিনক্ষণ জানা নাই। কখন যেন আগুন নিভে যায়, কষ্টে পোড়া শীত কমে শরতে নেমে আসে আমার সব কাল। আমার কোন অনুভুতি নেই, ভাব নেই, আকাশ নেই, স্বপ্ন ওড়া ডানা নেই। চব্বিশ ঘণ্টার কারাগারে বন্দী জীবনচষি। এটা আমার ভালো মানষী জীবন।
আজ নিতু আমাকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করলো।
বলল— আপু তুমি এতো বেশি ভালো কেন?
তোমার উদাহরণ দিয়ে ওরা আমাকে বিয়ে দিচ্ছে।সবাই বলছে মাহিন পেরেছে তুই কেন পারবি না। বিয়ে হবে, পড়াশোনা হবে, সংসার হবে কোনকিছুই বাদ যাবে না। মাহিন বিয়ের পর সব কিছু করেছে।তোকেও করতে হবে।
আমার মাথায় বজ্রপাত হয় তখন।
আমার উপলব্ধির তালা খসে পড়ে নিমিষে।
তাইতো!!
ভালো মেয়ে হওয়া ভালো মানুষ হওয়ার এই প্রাণবন্তকর প্রচেষ্টা আমার আমিকেই চপেটাঘাত করতে থাকে বারবার।
আমার বয়স যখন সবে ষোলো তখন তারা আমাকে বিয়ে নামক শিকলে বাঁধে নানাজনের উদাহরণ টেনে। আমি শিকলে জড়িয়ে নিয়ে তবুও চেষ্টা করে যাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এক পা দুই পা করে শিকলের দৈর্ঘ্যের মাপ ঠিক রেখে এগিয়ে যেতে। কিন্তু আমার উদাহরণ দিয়ে কেন অন্যকে বাঁধা হবে। এই শিকল ছেঁড়ার দায় আমার।এই তালা ভেঙে মুক্ত করতে হবে সহস্র প্রজাপতি। আকাশের মুক্ত মেঘে ভেসে বেড়াক পরীদের ডানা।
নাহ, আমি আর ভালো হতে চাই না।
আমি উদাহরণ হয়ে কিশোরী স্বপ্নদের দুমড়ে মুচড়ে দিতে রাজি নই।
আমার নিজস্ব স্বকীয়তা ব্যাঘ্র কন্ঠে হুঙ্কার দেয়।
আমি চিৎকার করে উঠি— নাহ, এ বিয়ে হবেনা।মুক্ত আকাশে উড়তে দাও নিতুকে।
আমি নিতুর পুতুল পোশাক খুলে ফেলে বুকে লেপ্টে নিয়ে ঢাকায় ফিরি।
আমি আজ অগ্নিশিখা
তবে বাজেদের তালিকায় প্রথমে আমার স্থান। আমার নামে অসভ্যের অপবাদ।
কিন্তু আমার সুখ বিশ্ব জোড়া
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
আমার মুক্তি ফল্গুধারায়।
আমি আজ সুখী।
পৃথিবীতে এতো সুর এতো ছন্দ সব এখন আমার।
যা কিছু আমার যা কিছু প্রাপ্য তা ছিনিয়ে নিতে শিখেছি।
ছাড় দেয়া মানে উদাহরণ তৈরি করা
ছেড়ে দেয়া মানে অন্যায়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা।
ছোট্ট নীতুও শেখাতে পারে।যা পারেনি এই ভণ্ড মূর্খ সমাজ সংসার।যা পারেনি ফানুষের আড়ালের কপট কাপুরুষ গুরুজন।
তাই বুঝি চির তরুণ কবি বলে গেলেন- বিশ্বজুড়ে পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র—
আমি শ্রদ্ধায় নত হই আধুনিক তারুণ্যের
আমি ঘৃণার বাষ্প ছড়াই কপট গুরুজনের গরাদে।
আমি আগুন
আমি জাগ্রত চিরশিখা।