গল্প: ক্ষণ-স্থায়ী
ক্ষণ-স্থায়ী
সুভাষ চন্দ্র দত্ত
ক্যালেন্ডার বলছে, দুর্গাপুজোর আজ ষষ্ঠী। বারান্দায় এসে বসতেই মা কফি এনে ধরল সামনে, দেখলাম মা তৈরি, বসার ঘরে বাবাও তৈরি হয়েই একমনে কাগজ পড়ছে। বুঝলাম আমিই বাকি। মোবাইল বেজে উঠতেই দেখলাম মলি, জানতাম ফোনটা আসবেই। আজ যে… ফোনের দিকে তাকিয়েই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, কল কেটে গেছে কখন টের পাইনি।
করোনা থাকলেও কলকাতার আকাশে-বাতাসে পুজোর যে আমেজ এবারও, তা এখানে নেই, এ যেন অন্য যেকোনো ছুটির রবিবার।
চাকরিসূত্রে জামশেদপুরে বেসরকারী কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। একবছর হল বাবা-মাকেও পাকাপাকিভাবে আমার কাছেই এনে রেখেছি। বছর পাঁচেক আগে ছোট বোন মলির বিয়ে হয়েছে এখানেই,ভগ্নিপতি দীপ্ত, ডাক্তার ,ওদের কয়েক পুরুষের বসবাস জামশেদপুরেই। ওর বিয়ের সময় একমাত্র ননদ বৈশাখীর সঙ্গে আলাপ। কয়েকবছরে দেখতেদেখতে বৈশাখির সঙ্গে সেই পরিচয়, ভালোলাগা ও পরে ভালোবাসা হয়ে যায়। বাড়িতেকেও কিছু না জানলেও মলি দীপ্তর থেকে কিছুই লুকায়নি কখনও। দুজন দুজনকে ভালোবাসি, সারাটা জীবন একসঙ্গে সংসার করতে চাই। আগের বছরই দেরি না করে আগস্টে কলকাতায় গিয়ে বাবা-মার কাছে গোটা বিষয়টা জানালাম। ভেবেছিলাম আপত্তি নিশ্চয়ই হবেনা। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে বিয়েতে বেঁকে বসলেন আমার মা। বৈশাখীকে নাকি মায়ের মোটে পছন্দ না, কিছু শিশুসুলভ কারণ দেখিয়ে সাময়িকভাবে আমায় নিরস্ত্র করলেন। আমিও ছুটি নষ্ট না করে ফিরে এলাম। অদ্ভুতভাবে ওদের বাড়িতে সে রকম কোনো আপত্তি করলনা কেউ। মাকে বোঝাতে শেষ ভরসা মলি,ওই ব্যালেন্স রেখে বাড়িতে রাজি করোনার চেষ্টা করতে পারে।
সেইমতো আগের বার পুজোর আগেই বাবা-মাকে নিয়ে এলাম জামশেদপুর। মলির বাড়িতে নিমন্ত্রণ হল। আমি তো অবাক, মা দেখলাম বৈশাখীর সঙ্গে বেশ মিশে গেছে, মনে আশার আলো জাগল, নাহ এবার তাহলে আরেকবার বলে দেখা যেতে পারে পুজো মিটলে।কিন্তু 2দিন যেতেই হঠাৎই মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অনিয়ম ধকল সেই থেকেই হয়ত জ্বর, ভেবেই ট্রিটমেন্ট চলছিল, দুদিনপর স্বাদ গন্ধ চলে যাওয়ায় মনে হল করোনা নয়ত। দীপ্তর কথা মতন টেস্ট করালাম,রিপোর্ট এলো নেগেটিভ। ফলে এবার পালা দেখাশোনা করে সুস্থ করে তোলা মাকে।কিন্তু কাজটা করবে কে? আমার ছুটি নেই, বাবা নিজেই অসুস্থ, মলি সন্তানসম্ভবা ফলে ওকে তো এসবে টানাই যাবে না ।চিন্তার অবসান ঘটিয়ে মলি ফোনে বললো “দাদা চিন্তা করিসনা,আমি কদিন তোদের ওখানে গিয়ে মাকে দেখাশোনা করবো ভেবেছিলাম কিন্তু বৈশাখি নিজেই বলছে ওই মার কাছে এসে সারাদিন থাকবে।”
মনে মনে ভাবলাম এত গোল্ডেন চান্স মাকে রাজি করানোর।
দিন সাতেকের মধ্যেই বৈশাখীর সেবায় মা আস্তে আস্তে সুস্থ হলেন। মাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল নাহ এবার আর মা না করবেন না। বৈশাখী ফিরে যেতে মা বাবাকে ডেকে বললেন, “তুমি কদিন পর ওদের বাড়ির সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করে ফেলো।” দরজার বাইরে থেকে সব শুনে তখন আমার আনন্দের সীমা নেই। ফোনে বৈশাখীকে জানালাম।
মহালয়ার দিন দুবাড়ির দেখা সাক্ষাৎ হল, বিয়ে নিয়ে আলোচনাও এগোলো। আমি আর বৈশাখিও বিয়ে নিয়ে প্ল্যানিং এ ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এরইমধ্যে একদিন হঠাৎই ফোনে বৈশাখী বললো,” জানো আমার না শরীরটা খারাপ লাগছে, জ্বর, স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছি না,দাদা টেস্ট করাতে নিয়ে গিয়েছিল,কাল হয়ত রিপোর্ট দেবে।” ওকে চিন্তা করতে বারণ করলাম বটে কিন্তু আমার সেদিনটা এক অদ্ভুত ভয়ে কাটল। পরেরদিন মলি খবর দিল, রিপোর্ট পজেটিভ সঙ্গে স্বাসকষ্ট। দেরি না করে নার্সিংহোমে দেওয়া হচ্ছে। পরের 2দিনে ডাক্তাররা আশা দিলেন না, অক্সিজেনের লেভেল ক্রমেই কমছে। ষষ্ঠীর সকালেই সব শেষ হয়ে গেল।
আবারও ফোনটা বাজতেই ঘোর কাটল.. তাকিয়ে দেখলাম মলি। আজ বৈশাখীর প্রথমমৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ওবাড়িতে কাজ। আমার যে বিশ্বাসই হয়না! ফোনের ওয়ালপেপারে আমার বৈশাখী তো আজও জীবন্ত।