গল্প:উপলব্ধি
উপলব্ধি
মুসা আলি
ফুলশয্যার রাতে রুবিনাকে শুধুমাত্র রুবি বলে ডেকে যে স্বামী নতুন রোমাঞ্চ তৈরি করতে পারল, তার মধ্যে যে এত জটিল ভাব-প্রবণতা থাকতে পারে, রুবিনা তা এতটুকু বুঝে উঠতে পারে নি। একেবারে অন্য ধরনের মানুষ, ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারার গোঁসাই। কোনো কাজে-কম্মে নেই, এক নম্বরের বাউন্ডুলে, কেবল রাজনীতির তালে ঘোরে। অবশ্য সামনাসামনি কথার কপচানিতে সেরাদের সেরা। ওইটুকুই সম্বল। সংসারের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ও সব রুবি জানে। যেন সংসার চালানোর কোনো দায় তার উপরে পড়ে না। খেতে বসে বাটিতে ভালো তরকারি না দেখলে সাধের স্বামীর মুখে ভেসে থাকে মেঘলা আকাশের ছবি। এমন ভাব দেখায় যে, সময়কালে সংসারের কর্তা হিসেবে মুখের ওই বৈচিত্র্যটুকু ক’জন দেখাতে পারে। একটা কঠিন প্রশ্নে দুলতে থাকে তার মন, কষ্ট করে স্বামীত্ব বয়ে বেড়ানোর উপযুক্ত প্রতিদান না থাকলে জীবনের কোনো মানে থাকে না।
পরে পরে রুবিও জেনে ফেলল, সংসার চালাতে গেলে তাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্তত ক’জনের পেট পূরণের জন্যে দুবেলা যা লাগে, সেই গুরুভার তাকেই বহন করতে হবে। স্বাভাবিক কারণে গ্রামের অনেক মানুষের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। তারাও জানত রুবির সাংসারিক দৈন্যদশার কথা। রুবির মূল উপলব্ধি ছিল, পেটের দায় মুখে বলতে না পারলে সংসার চলবে না। এভাবেই পেটের চাহিদা, মুখ ফুটে বলার ক্ষমতা, ভিতরে ভিতরে মনের খেদ এবং মননের অনুভূতি রুবির জীবনে সমগোত্রীয় সমতলভূমি হয়ে উঠল, উঁচু পাহাড়ের পাশে খানা, ডোবা আর শুয়ে থাকা সবুজ কৃষিক্ষেতের মতো।
সবেমাত্র পৌষমাস শুরু হয়েছে। নতুন সকাল। খুব সম্ভব শনিবার। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্য তখনও পূব আকাশে দেখা দেয় নি, তবে শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। একটু পরে কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের সাতরঙ পূর্বের আকাশ রাঙিয়ে দেবে। শীতের সকালে উষ্ণতা ছড়ানোর সব গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম বন্ধু। জীবনকে রক্ষা করা, আরও সজীব করে তোলা এবং জড়তা ভঙ্গের সমস্ত রসদ লুকিয়ে রয়েছে তার আত্মিকতার গভীরে। পৃথিবীর বয়স বাড়ে, কিন্তু প্রাচীনতম বন্ধুর যৌবন অটুট থাকে সমানতালে। নতুন প্রজন্মের মানুষ নতুন করে যাত্রা শুরু করে, একান্ত বন্ধুর মতো সূর্য তাদের জীবনে ঐকান্তিক সুহৃদ হয়ে দেখা দেয়।
গা সোয়া রোদ ঠেলে রুবি রুস্তম বিশ্বাসের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাবু রুস্তম তখন বারান্দার উপর ইজি চেয়ারে বসে চায়ের গরম পেয়ালায় চুমুক দিতে ব্যস্ত। শরীরী আরাম টানার কসরতে সত্যি সত্যি মশগুল। রুবিকে সামনে দেখে তাঁর ফলকা প্রশ্ন, কী খবর রে?
তোমার কাছে এলুম।
তা তো দেখতে পাচ্ছি, কীজন্যে এসেছিস, সেটাই বল?
রুবির দায় তো একটাই। কাজ আছে কিনা তা জেনে নেওয়া। তবুও রুস্তম প্রশ্ন করলেন এই কারণে যে রুবির দুঃখের তাৎক্ষণিক গভীরতা জানতে পারলে ঠিকমতো দরদাম সারতে পারবেন কিন্তু তা উত্তর দেওয়া রুবির পক্ষে কত বেশি লজ্জার, সেই বোধটুকু রুস্তম বুঝতে চান না। রুবি জানে, দুঃখি না হলে অন্যের দৈন্যতার ভাগে কোনো অধিকার থাকে না। কিন্তু বাবু রুস্তম বোঝেন, দৈন্যতাকে ঠিকমতো নাড়াচাড়া দিতে না পারলে তাঁর মহাজনি মনোভাবে ভাটার স্রোত ছাড়া কিছুই থাকবে না।
রুবিকে দেখে বিঘে পঞ্চাশ জমির মালিক রুস্তমের মাথায় একটা নতুন প্রসঙ্গ বিদ্যুতের মতো খেলে গেল। কাটাছেঁড়ার পর্ব সারতে কয়েক মিনিট নিলেন। মাঠের ধান গাদাজাত হয়ে খামারে উঠে গেছে। পরের রবিবার ঝাড়ামাড়ার কাজ শুরু করতে চাচ্ছেন। হাতে গোনা মাত্র কটা দিন বাকি। এর মধ্যে খামারবাড়ির চত্বরটুকু কাদাগোবরে লেপে না দিলে নয়। শুকনোর জন্যে দু’তিন দিন সময় দিতে হবে। গত বছর রুবি একাজ সেরে দিয়েছিল। বাজারমূল্য অনুসারে খুব বেশি দিতেও হয় নি। মেয়েটা ভালো। কথা বললে রাখতে জানে। তাই বিশ্বাসবাবুর খুব দরকার রুবিকে। রুস্তমের হিসেবি প্রশ্ন, একটা কাজ আছে, পারবি?
বলেন শুনি।
ভাবছি, সামনের রোববার ঝাড়ামাড়ার কাজ শুরু করব। তার আগে কাদা গোবরে কষ দিতে পারলে রোদ হাওয়ায় বেশ শুকিয়ে যেতে পারে। কত নিবি বল্?
আপনিই বলে দ্যান। ক’দিনে সারতে হবে তাও বলেন।
রুবির কোলে ছেলে, বছর তিনেক বয়স। সবে কথা বলতে শিখেছে। রুস্তমের মধ্যে হাল্কা বিরক্তি বাড়ছে হাওয়ায় ভেসে যাওয়া মেঘের মতো। কেবল ভাবছেন, ছেলেটাকে সামলানোর জন্যে বেশ কিছুটা সময় দিতে হবে রুবিকে। পারবে কী কাজটা সারতে? আবার প্রশ্ন করল রুস্তম, ভালো করে ভেবে দ্যাখ রুবি, না পারলে না বলতে পারিস। আমাকে রবিবার ঝাড়ামাড়ার কাজ শুরু করতেই হবে।
আমি পারব মেজবাবু।
কোলের ওটাকে সামলে কাজটুকু সারতে পারবি তুই?
যে রাঁধে সে চুল বাঁধে।
বেশ বললি রে, দুপালি চাল আর গোটা কুড়ি টাকা দেব। কাল সকালে লাগতে পারবি?
দিন দুই সময় দ্যান মেজবাবু। কালকে একটা অন্য কাজের বরাত পেয়েছি। পরশু ঠিক লাগব। মনের মতো করে লেপে দেব, গত বছরের মতো।
কিন্তু শুকনোর জন্যে অন্ততঃ তিনটে দিন তো লাগবে। তার মানে রবিবার ঝাড়াই-মাড়াই এর কাজ শুরু করতে পারব না।
এত করে বলছেন যখন, কাল সকালে লাগব। গত বছরের মতো সেরে দেব। জানেন মেজবাবু, ছেলেটার জন্যে একটু খরচ লাগে। দু’জন থেকে তিনজন হয়ে গেলে যা হয় আর কী। আমার লোকটাকে তো চেনেন। আমি যা নিয়ে ভাবছি, সেসব ওর মাথায় ঢোকে না। কেবল বলে, সমাজ পরিবর্তন হলে সব সমাধান একসঙ্গে পেয়ে যাব। জোসেফকে তো চেনেন আপনি। ওই ওর কানদুটো ভারী করে তুলছে। তাতেই মজে রয়েছে সারাদিন। সংসারের কথা কিছুতেই মাথায় নিতে চায় না। যেন সব দায় আমার।
রুস্তম বুঁদ হয়ে রুবির কথাগুলো শুনলেন। বলা ভালো, শুনতে শুনতে নিজের রোমন্থন সেরে ফেললেন কেবলমাত্র নিজস্ব স্বার্থের কথা ভেবে। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির চাপে রুবির পক্ষে বেশি দাবি করা সম্ভব হবে না। সামনে আরেকটু সরে বসে বললেন, একটা কথা সব সময় মনে রাখবি, আমরা পরস্পর প্রতিবেশি। তুই আমাকে দেখিস বলে আমাকেও তোকে দেখতে হয়। এটাই তো আমাদের পরম্পরা। সেই চল ভাঙতে যাব কেন?
রুবির মনে খুশির জোয়ার। নতুন মূল্যায়নের ছবি। বদান্যতায় মেজবাবুর তুলনা হয় না। আকাশের মতো উঁচু। মনের কথা বলে আপন করে নেওয়ার যাদু রয়েছে লোকটার মধ্যে।
পরের দিন সকালে হাড়-কাঁপানো শীত, উত্তরের বাতাসে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হয়েছে। সূর্য একবাঁশ উপরে উঠলেও ঠাণ্ডার প্রকোপ এতটুকু কমে নি। হাতে লেগে থাকা ভিজে কাদা-গোবর রুবিকে বার বার স্যাকা দিচ্ছে। অবশ্য তার মতো হতদরিদ্রকে এ নিয়ে এত কিছু ভাবা ঠিক নয়। শীতের সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে রুবি অর্থনৈতিক বিভেদের পাহাড় দেখতে পেয়েছে কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ নিয়ে তার কী বলার আছে? মাঠে নেমে কাদাজলে দাঁড়িয়ে অনেককে ধান কাটার কাজ সারতে হয় শীতের শুরুতে। ভরা বর্ষায় তাদের কষ্ট নিজের চোখে দেখেছে রুবি। তার স্পষ্ট অনুভূতি, কেবল দিনান্তে পাওনার কথা ভেবে কারুর পক্ষে মাঠ ছাড়া সম্ভব হয় না।
সাতটার সময় রুস্তম জেগে উঠে দেখলেন, সূর্যের তাপ সবে জমতে শুরু করেছে। শীতের সময় তাঁকে খুব সাবধানে থাকতে হয়। দশটা না হওয়া পর্যন্ত উলের চাদর, পায়ের মোজা আর কানঢাকা গরম টুপি খোলেন না। বছর দশেক আগে এক শীতের রাতে একটু দেরি করে বাড়িতে ফেরার ফলে টানা দশদিন নিউমোনিয়ায় ভুগতে হয়েছিল। সেই থেকে সাবধানতার শেষ নেই। দস্তুর মতো শিখেছেন, দামি উলের পোষাক পরে কীভাবে শীতকে জব্দ করতে হয়। কেবল বুঝতে শেখেন নি, তাঁর বা তাঁদের আর্থিক বৈষম্যের কারণে রুবিদের কপালে তা সাইলকের মতো কত বেশি নির্মম হয়ে চেপে বসতে পারে।
রুস্তম তখনও আরাম করে গরম বিছানায় বসে ছিল। যেন ঘরের বাইরে যাবার এতটুকু ইচ্ছে নেই। বার দুই বড়ো হাই তুলে দুচোখ ঘুরিয়ে আলনায় ঝুলে থাকা উলের দামি সোয়েটারটা দেখে নিলেন। ক’দিনের মধ্যে তাঁকে একটা নতুন কোট কিনতেই হবে। বাজেট ধরা হয়েছে মাত্র সাত হাজার। এ নিয়ে রুস্তমের মনের অবস্থা ঠিক ভরা বসন্তের মতো। গতকাল সাবিকে শুনিয়ে বলেছেন, জানো সাবি, কলকাতার অভিজাতরা এর চেয়ে অনেক দামি দামি উলের জিনিস ব্যবহার করেন। বিয়ের ক’মাস পরে মানসিকতায় সৌখিন রুস্তম সাবিনাকে শুধু সাবি বলে ডাকতে শুরু করেছিল। ছোটো ডাকনামে মনের অনুরাগ মেশানোর চল বাঙালি সমাজে করোনা ভাইরাসের মতো বাড়ছে।
রান্নাঘরে বসে সাবি টের পেল, রুস্তম বিছানার উপরে বসে চা খাবার অপেক্ষায় রয়েছে। তারপর খামার বাড়িতে যাবে। টানা ত্রিশ বছরের ঘরসংসার। রুস্তমের সব আচরণ তার মুখস্ত হয়ে গেছে। কখন কী করতে হবে, কী বলতে হবে, সবই জেনে ফেলেছে সাবি, সাংসারিক পরীক্ষায় ফাস্ট-ক্লাস পাওয়া ছাত্রীর মতো। সব প্রশ্নপত্র জানা বলেই সত্তর শতাংশের বেশি নম্বর পাওয়া তার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। রুস্তমের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কই গো, হয়েছে?
ওভেনে বসিয়েছি, শীতের সময়, আরেকটু ফোটাতে হবে। মাত্র মিনিট পাঁচেক পরে সাবি চা বিস্কুট নিয়ে ঘরের ভিতরে এল। গরম পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বাবু রুস্তম বার বার আ আ শব্দে মনের মৌতাত প্রকাশ করতে থাকলেন, এক পলক ভাবলেন, নিশ্চয় এতক্ষণ রুবি এসে খামারবাড়িতে গোবর মাটির কষ দিতে শুরু করেছে। সাবিকে বললেন, হ্যাঁগো, সঙ্গে যাবে তো?
সাবি খুব খুশি। সকালে প্রকৃতি দেখার সখ সেই বাল্য বয়স থেকেই। অনেকদিন খামারবাড়ির দিকে যাওয়া হয় নি। প্রকৃতিঘেরা মনোরম পরিবেশ, গ্রামের শেষে রুস্তমের খামারবাড়ি গড়ে উঠেছে। প্রায় বিঘে তিনেক জায়গা নিয়ে তার চৌহদ্দি। চারদিকে আম গাছের সবুজ সমারোহ, মাঝে ফাঁকা জায়গাটুকুতে ধান ওঠে, ঝাড়ামাড়া হয়, গাছ থাকার কারণে সকালে কিংবা বিকেলে খামারের মধ্যে সেভাবে রোদ লাগে না। তখন সূর্যের মুখ ঢাকা থাকে গাছের আড়ালে।
কাদা গোবর দিয়ে কষ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রুবি। খামারের কোণে বসে ছেলেটা দুচোখ ভরে মাকে দেখছে। কখনো আমগাছের সবুজ পাতার দিকে চেয়ে আছে। কান্নাকাটি করলে রুবি দুপা ছড়িয়ে ছেলেকে বুকের দুধ খাইয়ে দিচ্ছে। তারপর সান্ত্বনা দিতে দিতে রুবির মন্তব্য, কাজটা শেষ করতে দেরে সোনা-মানিক।
সাবিও মা। দেখতে দেখতে তার মধ্যে মাতৃত্ব আর মমত্বের স্পন্দন জেগে উঠল। রুস্তমকে বলল, একটা কথা বলব, রাখবে?
বলো শুনি।
দেখে মনে হচ্ছে, ছেলেটার জন্যে রুবির অনেকটা সময় নষ্ট হচ্ছে। বাড়ি থেকে একবাটি মুড়ি এনে দেব? খুঁটে খুঁটে খাক আর খেলুক। তাহলে রুবি অনেকটা সময় পেয়ে যাবে, কাজটুকু সাপটে নিতে পারবে।
রুস্তমের তাৎক্ষণিক গোপন মতলব সাবির ইচ্ছার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তেলে জলে মিশে যাওয়ার মতো। মন্দ বলে নি সাবি, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দেবার মতোই। ছকটা রুস্তমের মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। ভালো প্লান দিতে পারল মেয়েটা। দুঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল। পায়ে পায়ে সরে গিয়ে পূবকোণে আমগাছের ছায়ায় দাঁড়ালেন। সূর্যের সাতরঙের আভায় সবুজ পাতায় সৃষ্টি হয়েছে অনন্য সৌন্দর্যশ্রী। নিজের রঙতুলিতে সাজলে সমগ্র পরিবেশ এমনি রঙিন হয়ে ওঠে। ক’মাস পরে পঞ্চায়েত নির্বাচন। প্রার্থী হওয়ার জন্যে ইতিমধ্যে কেউ কেউ তাঁকে অনুরোধ করে গেছে। তাদের আন্তরিক মন্তব্য, গ্রামের মধ্যে দায়েঘায়ে কেবল আপনিই তো পাশে থাকেন।
কথাটা মনে ধরেছে তাঁর। ধরবেই বা না কেন? আমমানুষের সঙ্গে এতদিন একটানা লেগে রয়েছেন। এর তো একটা ভালো ফলশ্রুতি থাকা উচিত। পরের সপ্তাহে প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে বসাবসি রয়েছে। কীভাবে এগোবেন, সেই গ্রাফও ঠিক করে ফেলেছেন রুস্তম। জেলার সাংগঠনিক কর্তারা ওই আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন। কেউ বিরুদ্ধে বলতে পারে তা ভাবতে পারছেন না তিনি।
রুস্তমের বদ্ধমূল ধারণা, ভোটযুদ্ধে একটা মোটা খরচ লাগে। তাঁকে প্রার্থী করলে এসব নিয়ে সংগঠনকে এতটুকু ভাবতে হবে না। শুধু মনোনয়ন পেলেই হল। রুস্তমের এও বিশ্বাস, মনোনীত হলেই পাল্টা খরচের বহর দেখিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারবেন, অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় তাঁর হিম্মত কত বেশি। এ দেশে রাজনীতির সঙ্গে টাকার জোরের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দেশ স্বাধীন হবার পরে পরে। সময় গড়িয়ে যাবার তালে তালে সেই জোরের খেলা আরও বেড়েছে। নির্বাচন আধিকারিককে কলা দেখিয়ে গোপন অর্থের অপব্যবহার বেশ রমরমিয়ে চলে। রুস্তমের মধ্যে নতুন পুলক। যেদিকে তার জোর, দেশের রাজনীতির মূল স্রোত সেদিকে ছুটে চলেছে। স্থির বিশ্বাস, আর্থিক মানদণ্ড নিয়ে ভাবলে কেউ তাঁর ধারে কাছে দাঁড়াতে পারবে না। তবুও একটা ভয় রয়েছে রুবির ঢ্যামনা স্বামীকে নিয়ে। একটা আস্ত বেআক্কেলে। বউ-এর রোজগারে খায়, তা নিয়েও কোনোরকম লজ্জা বোধ করে না। যোসেফের সঙ্গে মিলেমিশে রাজনীতি করার সূত্রে স্রেফ বাজে কথা বলতে শিখেছে। আড়ালে আবডালে তাঁকে অনেকবার শোষক বলে ঠাট্টা করেছে। কেন যে ছেলেটা তাকে সহ্য করতে পারে না? ক’দিন আগে গোকুল এসে জানিয়েছিল, গত সপ্তাহে পাড়ার বসাবসিতে ওই ঢ্যামনা তাঁকে চোরা সামন্তপ্রভু বলে উল্লেখ করেছিল। হারামির বাচ্চা হারামি। তোর বউ সারা বছরে কত কাজ পায়, তা নিয়ে ভাববি নে। অন্যের রোজগারে যাকে পেট চালাতে হয়, সেই হারামি হক্ কথা বলা নিয়ে কীভাবে যে এত বড়াই করতে পারে!
একটা নতুন ফিকির এসে রুস্তমের মাথায় চরকির মতো ঘুরছে। রুবিকে দিয়ে ওই বজ্জাতকে বাগে আনা যেতে পারে। সূর্যের আলোয় সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনার মধ্যে নিজেই পুলকিত হতে থাকলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাবিকে বললেন, মন্দ বলো নি তুমি, তাহলে তো তোমাকে একবার বাড়িতে যেতে হচ্ছে। বড়ো বাটিতে মুড়ি নিয়ে এস। ছেলেটার খিদে মিটবে, মন ভরবে, আনন্দে খেলবে, গাছের ছায়ায় একটু ঘুমিয়ে নিতেও পারবে। ততক্ষণ রুবির অনেক কাজ সারা হয়ে যাবে।
সাবি বাড়ির পথে হাঁটছে। রুস্তম চেয়ারে বসে পঞ্চায়েত ভোটের ভাবনায় ডুবে গিয়েছেন। ভাবতে পারলেন যে সকলে চাচ্ছে যখন, তাঁকে প্রার্থী হতেই হবে। দুচোখের সামনে রুবির বরের মুখটা দপ্ করে একবার ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল। বউ খাটলে যে ছেলেটার পেটে ভাত জোটে, গ্রামের বেশ কিছু লোক কেন যে তার কথায় ওঠে বসে! চিন্তা চেতনা এত নিম্নমানের হলে দেশ চলবে কী করে?
আরেকটা প্রসঙ্গ রুস্তমকে বার বার ছ্যাকা দিতে থাকল। পঞ্চায়েত মানে তো খুব কানাকানির লড়াই। দু’এক ভোটে হারজিত হয়ে থাকে। সেই অর্থে রুবির যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে তাঁকে জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে। বাড়িতে দু’দুটো ভোট। রুস্তমের ভাবনায় রুবি তখন আর শুধুমাত্র কাজের মেয়ে নয়, সম্মানীয় নির্বাচক মণ্ডলীর সদস্য। ভাগ্যনির্ধারকদের গুরুত্বকে আগেও কেউ অস্বীকার করতে পারে নি, আজও সেই গুরুত্ব সমান স্তরে রয়ে গেছে।
রুস্তম মনে মনে একটু হাসলেন। রুবির ভোট যে তাঁর পক্ষে পড়বে, তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। যতবার মেয়েটি কাজের জন্যে এসেছে, রুস্তম কোনোদিন না বলেননি। হয়তো সুকৌশলে বাজার দর অনুপাতে একটু কম দিয়েছেন, তা নিশ্চয় রুবির পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব হয় নি। নিছক মেয়েমানুষ, পড়াশোনা নেই, বাজারদর বোঝার মতো সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক ভাবনা ওর মাথায় থাকার কথা নয়। এও ভাবলেন যে পঞ্চায়েত নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রুবির পারিশ্রমিক একটু বাড়িয়ে দেবেন তিনি। মেয়েটি কব্জায় থাকলে ওর বদ বরকেও অনেকখানি টেনে রাখা সম্ভব। ভোট যুদ্ধের আগে সেটাও কম পাওনা নয়। নারীর মোহিনী মায়ায় ভোলে না, এমন পুরুষ পৃথিবীতে নেই। কত রাজার মাথা ঘুরে গেছে, রুবির বর তো সামান্য ছেলে। বাবু রুস্তমের স্থির বিশ্বাস, রুবিই পারবে বদমেজাজী বেলালকে বশে রাখতে।
সাবি এসে বলল, এই তো এনেছি, তুমি নিজের হাতে বাটিটা রুবির ছেলের হাতে তুলে দাও। তাহলে রুবিও খুব খুশি হতে পারবে।
রুস্তম বিড় বিড় করে বলল, এখন ওকে খুশি করা খুব দরকার। তাতেই দেখতে পাচ্ছেন নিজস্ব জয়লাভের আগাম হাতছানি। মুখে মৃদু হাসি, রুবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ছেলেটা তোকে খুব জড়াচ্ছে রে। এভাবে চললে তো কাজটা দু’দিনে শেষ করতে পারবি নে। মুড়ির বাটিটা তোর ছেলের হাতে দে। খেতে খেতে সময় পার করুক। তুই ততক্ষণ জোরে হাত চালিয়ে কাজটা কমিয়ে আনতে পারবি।
রুবি যারপরনাই খুশি। লোকটার শরীরে সত্যি সত্যি দয়ামায়া আছে। তা না হলে এতটুকুন বাচ্চার জন্যে এত মুড়ি দিতে পারতেন না। ফুরনের কাজ, মুড়ি দেবার প্রসঙ্গ আসে না। তবুও তো—। একটা অতীত স্মৃতি ভিড় করে দাঁড়ালো রুবির মনের ইজেলে।
গত বছর শ্রাবণ মাস, একটানা বর্ষা-বাদলের দিন। বৃষ্টি চলছে তো চলছে। থামার জন্যে প্রকৃতির মধ্যে এতটুকু হেলদোল নেই। খোলা বারান্দায় বসে উপোসি মন নিয়ে ঝুপঝাপ বৃষ্টির শব্দ শোনাই যেন একমাত্র কাজ। পেটের খিদে যে তাতে মিটবে না, রুবির মতো নিরন্ন ভোক্তা তা বেশ বুঝতে পারছিল। ভিতরের চঞ্চলতায় বার বার অস্থির হতে থাকল। গত কাল দুজনকে উপোস থাকতে হয়েছে। আজকের জন্যেও কোনো অবলম্বন সংগ্রহে আসে নি। বেলাল মনমরা হয়ে রুবির পাশে বসে ছিল। হুঙ্কার দিল রুবি, এভাবে বসে না থেকে রাজনীতির বড়ো কর্তাদের বাড়িতে গিয়ে বাস্তব হিসেবটা মিলিয়ে নাও গে। টানা সাতদিনে কেউ তোমার খোঁজখবর নিতে এল কী? তাহলে সময় নষ্ট করে, গতর নিংড়ে ওদের সঙ্গে লেগে থেকে লাভ কী? মিথ্যে দুরাশার পিছনে শুধু শুধু—। কবে বিপ্লব হবে, তাতে কী কী সুবিধে পাবে, তা ভেবেই তো নিজের হাতে সংসারটাকে ডুবিয়ে দিতে বসেছ।
রুবির তিরস্কার বেলাল মেনে না নিয়ে পারল না। মাথা ঝাঁকিয়ে তা প্রমাণ দিচ্ছিল। রুবি তো ঠিক কথাই বলেছে। টানা সাত দিনে একজনও কেউ এল না তার সঙ্গে দেখা করতে। ওরা সকলেই জানে, টেনেটুনে চলা সংসারে থেকেও এতদিন সংগঠনে অনেক বেশি সময় দিয়ে আসছে সে।
বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ছপছপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তখন ছাতার নীচে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন রুস্তম। ছিপছিপে গড়নে পঞ্চাশ উর্দ্ধ মানুষটাকে খুব মানানসই লাগে। হাল্কা বাতাসে ভেসে যাওয়া মেঘের মতো রুবির মনে একটাই প্রশ্ন বার বার দোল খাচ্ছে। —ডাকব মেজবাবুকে? কিছু মনে করবেন না তো?
পেটের খিদে কোনোকালেই মনের এ সীমা মেনে নেয় নি। সেই খাঁড়া যেন রুবির মাথার উপরে দুলছিল, সন্ধে হতে বেশি দেরি নেই। পেটে জ্বলছে চোঁয়া খিদের জ্বালা। এ রাতটুকু কী দুজনকে অন্ধকারে বসে কেবল শরীরের ঝিমুনি সহ্য করতে হবে? অগত্যা ডাকল রুবি, মেজবাবু শুনছেন?
রুস্তম ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, উস্কখুস্ক মুখে রুবি এক চিলতে বারান্দার উপরে বসে রয়েছে। বৃষ্টির ঝাঁটে অর্ধেক বারান্দা ভিজে সপসপে। সামনে সরে এসে বললেন, কিছু বলবি?
অগ্রিম কিছু টাকা দেবেন, কাজ করে শোধ দেব।
রুস্তম না বলতে পারলেন না। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি নিজের পক্ষে আনতে তাঁর মতো ঘোড়েল মানুষ এ তল্লাটে একটাও নেই। বুঝলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রুবিদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। বেলাল নিশ্চয় কিছু সংগ্রহ করে উঠতে পারে নি। এই সুযোগ। টাকা ধার দিয়ে হারামিটাকে আরেকটু সমঝে দিতে পারবেন। এখন টাকা দিলে কাজের সময় একটু কম দিলেও রুবি না বলতে পারবে না। অন্তত এই আক্কেলটুকু রুবির জীবনে আছে। বললেন, কত দিতে হবে বল্?
যা খুশি দ্যান, কাজকম্ম নেই।
অঙ্কটা তোকে তো বলতে হবে।
তাহলে পাঁচশ দ্যান।
নে, কাজপত্তর হলে খেটে শোধ করে দিস্।
রুবি ঘাড় নাড়ল, পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন রুস্তম। পাশের পাড়াতে যেতে হবে তাঁকে। সেখানেও রুবির মতো কয়েকজন আছে। পেটের খিদে নিয়ে দিন গুণছে তারা।
সন্ধের মুখোমুখি সময়ে বাড়িতে ফিরলেন রুস্তম। মুশলধারে বৃষ্টি তখনও চলছে। গুড় গুড় শব্দে একটা বাজ পড়ল আকাশ কাঁপিয়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ভরে উঠল সর্বত্র। বারান্দার উপর উঠে স্থিতধী রুস্তমের একমাত্র কামনা, আল্লা আরও কয়েকটিা দিন একটানা বৃষ্টি দাও।
উপোসি রুবি মেজবাবুর বদান্যতায় এত খুশি হল যে বাচাল স্বামীর গায়ে বাম হাতের ঠেলা দিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারলে তো কাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়? যারা বিপদে দেখে না, তারা কিসের বন্ধু? আর দেরি না করে দোকানে যাও, আজকের মতো আলু চাল কিনে আনো। এক টাকার কেরোসিন আনতে ভুলে যেও না, কাল সকালে বাজারে গিয়ে মূল কেনাকাটা সেরে ফেলতে পারবে। বেশি করে চাল ডাল তরকারি কিনে নিলেই হল।
বেলাল ছাতা মাথায় রাস্তায় নামল। রুবি এভাবেই একটা স্মৃতির উপকাহিনি শেষ করল নিজে নিজেই পাঠ করে।
বিকেলে রুস্তম আবার এলেন কাজের অগ্রগতি দেখতে। লালমুখো সূর্য ফিকে হতে হতে একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে। দিনান্তে রুস্তমের প্রতি রুবির শেষ কথা, কাল বিকেল পর্যন্ত বাকি কাজটুকু সেরে দিতে পারব মেজবাবু। কাদা গোবরে মিশিয়ে আকেরবার সব জায়গায় ঝাঁটা মেরে দেব, সেজন্যে কিছু দিতে হবে না।
তোর বাঁধা কাজ, যা ভালো বুঝিস কর।
এমনি করে রুবি সারা বছরে বেশ কয়েকটা কাজ পায় রুস্তমের দৌলতে। কোনো কোনো দিন মেজবাবু নিজেই এসেছেন তার বাড়িতে কাজের কথা বলতে। রুবির একটাই দুঃখ, এত করে বলেও নিজের লোককে মেজবাবুর পক্ষে টেনে আনতে পারল না। লোকের কথা শুনে চললে এমনিই হয়। বাজে কথায় কান ভারী করে ওরা শুধু শুধু তার মদ্দলোককে সামাজিক জব্দে ফেলে রেখেছে।
সন্ধের আবছা অন্ধকার ঝুপ ঝুপ করে নামছে। ফেরার পথে রুবি বিস্তর খুশি, প্রথম দিনেই অর্ধেকের বেশি কাজ সামলে নিতে পেরেছে। মেজবাবু কেন যে বার বার তাকে কাজের জন্যে ডাকে, তা বেশ বুঝতে পারছিল। সে যেভাবে সব কাজ গুছিয়ে করতে পারে, তা অন্য কারুর পক্ষে সম্ভব নয়।
সন্ধের অন্ধকারে বারান্দার চেয়ারে বসে রুস্তম নিজের ছকে একেবারে বিভোর হয়ে আছেন। তাঁকে যে কোনো মূল্যে পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী হতেই হবে, গত নির্বাচনে নিজেই ইচ্ছা করে দাঁড়াতে চান নি। টানা পাঁচ বছররের অভিজ্ঞতায় খুব করে বুঝেছেন, একান্ত অনিচ্ছায় এত বহুমূল্যবান সময় এভাবে হাতছাড়া করা ঠিক হয় নি। নির্বাচিত হলে কী লাভ পকেটে ঢুকত, সেই হিসেব রুস্তমের মুখস্থ হয়ে গেছে। আর কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। ছক কষে লোকজন লাগিয়ে পিছনের গ্রাফকে কতখানি মজবুত করে তুলতে হবে, সেই চিন্তা মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে।
ভয় তো একজনকেই, রুবির ইচোড়ে পাকা বরকে, হারামির বাচ্চা হারামি। একটানা পিছনে লেগেই রয়েছে, অবশ্য রুবিকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে চলে। একটু চেষ্টা করলে মেয়েটা পারবে বেলালকে টেনে রাখতে। বড়ো বাটিতে মুড়ি দেওয়ার ফলে রুবির চোখে মুখে যে খুশির ম্যাপ ভেসে উঠেছিল, তা আরেকবার মনে করতে পারলেন রুস্তম।
ও পাড়ার মতলব ইতিমধ্যেই খেয়ে বসে আছে, তবে একটু যে বেশি নিয়েছে তা নিয়ে রুস্তমের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। ছেলেটা কিছুতেই দশের কমে রাজি হল না। সব প্ল্যান পোগ্রাম সারতে নাকি দশ হাজার তেমন কিছু নয়। রবীনও কথা দিয়েছে, সেও চেষ্টা নেবে বেলালকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে। রুস্তম মনে মনে খুশি না হয়ে পারলেন না। রুবি টানবে বেলালকে, রবীনও টানবে বেলালকে। জাল ছিঁড়ে বেরনো এত সহজ হবে না।
গুণতে থাকলে দিনের গতি দ্রুত শেষ হয়ে যায়। প্রয়োজনের ক্ষতে দ্রুত মিলিয়ে যাবার এমনি প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। আসলে সময়ের চেয়ে ব্যক্তির প্রয়োজন আগে ছুটলে সময়ের অঙ্ক কেমন যেন আগেভাগে শেষ হয়ে যায়।
সেদিন সন্ধে এল সেভাবেই। বাবু রুস্তমের যাবার আগেই গ্রামের অর্ধেক লোক জাঁকিয়ে বসল আসর জুড়ে। যেতে যেতে রুস্তম কেবল ভাবছিল নিজেকে নিয়েই। জেলা থেকে নেতৃত্ব এসেছেন সমগ্র বিষয়টা পর্যালোচনা করতে। আলোচনার শুরুতে রবীন বলল, এবছর প্রার্থীপদ নির্বাচন নিয়ে সকলকে রুস্তমদার কথা ভাবতে বলছি। দায়ে ঘায়ে কেবল ওঁকেই কাছে পেয়ে থাকি। পাশে দাঁড়িয়ে রুবি সভার আলোচনা শুনছিল। সে ভাবল, মেজবাবু প্রার্থী হলে ভালোই হবে। বাড়ি থেকে বের হবার সময় বেলালকে শাসিয়ে বলেছিল, মেজবাবুর বিরুদ্ধে একটা কথা না বলতে। লোকটার মহাজনি যেমন চলছে চলুক।
আলোচনা গভীরতর রূপ নিল। বেলাল স্থানীয় সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। তখনও সে নিশ্চুপ ছিল। অনেকের মধ্যে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিল। বেলাল এভাবে চুপ করে থাকছে কেন? একটা মতামত তো দিতে হবে।
রবীন বলল বেলালকে, আমি কী খারাপ নাম প্রস্তাব করেছি?
বেলাল রবীনের সব হিসাব উল্টে দিয়ে বলল, স্রেফ টাকার জোরে কেউ প্রার্থী হলে ভোটের পরে সেই জোর সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যাবে।
কথাগুলো যে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তা বুঝতে রুস্তমের এতটুকু অসুবিধা হল না। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল তাঁর শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, মনের বিহ্বলতায় আর মস্তিষ্কের ছোটো ছোটো ঘরে। একটাও লোক বেলালের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারল না। রবীনও কেমন যেন বেলালের চাপে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রাত দশটায় সভা শেষ হলে মাথায় প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে রুস্তম টলতে টলতে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন। ভেবে পেলেন না, কীভাবে তাঁর পাতা এত শক্ত জাল ছিঁড়ে বেলাল বের হয়ে যেতে পারল।
বাড়িতে ঢুকে বারান্দার চেয়ারে বসলেন মুখ গুম করে। সাবি ছুটে এল কাছে। প্রবল শীতেও হাঁপাচ্ছেন রুস্তম। হাত-পাখায় হাওয়া করতে শুরু করল সাবি। রুস্তমের মাথায় হাত রেখে বলল, শরীর খারাপ করে নি তো?
ওসব কিছু নয়।
তাহলে এভাবে মন খারাপ করে বসে পড়লে যে?
কোনো উত্তর দিলেন না রুস্তম। প্রবল বিক্ষিপ্ত ঝড়ে একটাই প্রশ্ন বড়ো হয়ে উঠছে। এত ত্যাগের কোনো মূল্য নেই? খেলার মাঠে মাটি ফেলতে সাহায্য করা, একটানা বর্ষা চললে গরিবদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া, রমজানের ঈদে সবচেয়ে বেশি খিরপায়েস বিলি করা, বকর ঈদে বেশি টাকার কোরবানি দেওয়া—এসবের কোনো মূল্য নেই?
রাত বাড়ছে পলে পলে। দুর্ভাবনায় রুস্তমের শাসকষ্ট গভীরতর হয়ে উঠল। এমন দুর্যোগের রাত তাঁর জীবনে আগে কখনো আসে নি। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার যেন তাঁকে গিলে খেতে চাচ্ছে। ডাহুকি ডাকছে গাছে গাছে। রাত প্যাঁচার ছুটোছুটি। শেয়ালের দলগত হুক্কাহুয়া। জেগে থাকতে থাকতে রুস্তম কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামের কোনো কাজে আর এক পয়সাও দেবেন না। কেন দিতে যাবেন? সারা জীবন বোকামি করে লাভ কী?
নতুন সকাল-সূর্যের সাতরঙে লালে লাল। রুস্তমের উদ্বেলতা গভীর থেকে গভীরতম হয়ে উঠল। কঠিন প্রতিজ্ঞায় দুলতে লাগলেন। সম্পদশালী মানুষ সামনাসামনি প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে কেবল নিজের আর্থিক শক্তির উপর দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে ভালোবাসেন। রুস্তমও সেভাবেই…।
সকাল সাতটায় চা বিস্কুট খাওয়া শেষ করেও অবসাদের কারণে উঠি উঠি করে বিছানা ছাড়তে পারলেন না। স্বামীর মনের যন্ত্রণা বুঝতে সাবির কোনো অসুবিধা হল না। কী নেই তাদের? খামারে বসানো রয়েছে বড়ো বড়ো ধানের গাদা, কদিন পরে গোলায় উঠবে শ শ মন ধান, বাজারে খাটছে লক্ষ লক্ষ টাকা। এত কিছু রুস্তমের ক্ষেত্রে কোনো কাজে এল না? দাম্পত্য প্রেমের স্রোতে সাবিও স্বামীর মানসিক জোয়ারে ভেসে চলল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রুস্তম হাঁটছেন খামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পিছনে হাঁটছে সাবি। এ সময় সঙ্গ দেওয়া খুব প্রয়োজন। রুস্তমের ধারণা, রুবি এসে নিশ্চয় এতক্ষণ প্রায় সব কাজ সেরে ফেলতে পেরেছে। কিন্তু খামার বাড়িতে ঢুকে দেখলেন ভিন্ন চিত্র। বাচ্চাটা অঝরে কাঁদছে। রুবি কিছুতেই থামাতে পারছে না। রুস্তমকে দেখে বাচ্চাটার কান্না আরও বেড়ে গেল। রুস্তমের বিমূঢ় প্রশ্ন, ছেলেটা এভাবে কাঁদছে কেন রে? আমাকে দেখেই তো ওর কান্না আরও বেড়ে গেল।
মুড়ি খাবার লোভে বোধ হয়। ও কিছু নয়, বকে দিলে চুপ করে যাবে।
সাবিও মা, তার মাতৃত্বে নতুন ঝড় শুরু হল। রুবির মনের আকাশেও এক ফালি মেঘ। ভাবতে পারল যে গতকাল কষমাটির কাজ শেষ করে বেশ ক’গাল মুড়ি খেতে পেরেছিল সে। এক গ্লাস পানি টানার পরে মনে হয়েছিল রাতে আর কিছু না খেলে চলবে।
সাবি সরে এসে দাঁড়ালো রুস্তমের পাশে। তার দুচোখ আকুল বাচ্চা ছেলেটার দিকে। চাপা স্বরে রুস্তমকে বলল, একটা অনুরোধ করব?
বলো শুনি।
দেখছ না, রুবির ছেলেটা কেমন উসখুস করছে। বোধ হয় আমাদের দেখতে পেয়ে। তুমি যদি বলো তো— রুবি মেয়েটা বড়ো ভালো। তোমাকে না জানিয়ে অনেকবার ওকে দিয়ে সংসারের এটা ওটা করিয়ে নিয়েছি। কোনোদিন না বলে নি। বিনিময়ও চায় নি। তোমার প্রতি ও খুব আন্তরিক। তাই যদি গতকালের মতো একবাটি মুড়ি এনে রুবির বাচ্চাটার হাতে দেওয়া সম্ভব হত।
মনের যন্ত্রণায় অস্থির রুস্তম খিঁচিয়ে উঠলেন, আমি কী ওদের জন্যে মুড়ির বস্তার মুখ খুলে রেখেছি।
কথাগুলো কানে গেল রুবির। শরীর ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
রুস্তমের রাগান্বিত প্রশ্ন, কী রে, বাকি জায়গাটুকু কষ দিবি নে?
নিরুত্তর রুবি ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। মনের গভীরে পাড় ভাঙার শব্দ, লাভার উদ্গিরনের ছবি, উত্তাল ঢেউয়ে সমুদ্রের তির ভাঙার গর্জন। বাচাল বেলালের মুখচ্ছবি রুবির মনের চিলেকোঠায় বার বার ভেসে উঠছে।
উপলব্ধির নতুন সূর্যোদয়।