খাতুনে জান্নাতের শিল্প অনুগদ্য: নিজস্ব ভাবনা

খাতুনে জান্নাতের শিল্প অনুগদ্য: নিজস্ব ভাবনা

খাতুনে জান্নাতের শিল্প অনুগদ্য: নিজস্ব ভাবনা

১.
কবিতা ও কবি: শিল্পের অনুধ্যান

প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্ব শিল্প-শৈলী সমৃদ্ধ আলাদা মনন, বোধ ও ভাষা। কবি নিজস্ব মতামত, রূপ ও বৈচিত্র্যের মাধুর্য দিয়ে ভাষার ফুল ফোটান। তার-জন্য তাঁকে হতে হয় বিশ্বস্ত ও ধ্যানী। ধ্যানের আলোকরশ্মি দিয়ে তিনি আঁধার, কাঁটা ও পাথর কেটে কেটে পথ করে নেন। তাতেই ঝর্ণার কলকল ছন্দে, ফুলের নির্যাস ও জীবনের আতর সাথে নিয়ে তিনি এগিয়ে যান। বুনন করেন শব্দ, ধ্বনি, প্রতীক, রূপক, অলঙ্কারের রূপ-মঞ্জুরী। তিনি জাগতিক প্রলোভন ও প্ররোচনার ঊর্ধ্বে নিয়ত অবস্থান করেন। আকরিক সেঁচে যেমন নিষ্কাশন করতে হয় ধাতুর অবয়ব; কবি নিজেকে নিষ্কাশন করে বের করে আনেন বাক্যের নিপুণ কৌশলে রূপক, ছন্দ ও অলঙ্কারের সংমিশ্রণে কবিতার দ্যুতি। সমাজ ও প্রচলিত জীবনের তলায় প্রবেশ করে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রক্ষেপণ করেন। কবি নিবিষ্ট থাকেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রস-আহরণে। নিজস্ব সীমারেখা ছাড়িয়ে তাঁকে হতে হয় বৈশ্বিক অভিনিবেশে আবিষ্ট। তিনি ভালোবাসেন মানুষ। মানুষের জৈবনীক রঙ্গমঞ্চ হতে ধ্বনিত হয় জীবনের কথোপকথন। সহজ জাগতিক হাস্য রসাত্মকতার ভেতরেও কবির হৃদয়ে ধ্বনিত হতে থাকে হৃদয়ের মর্মস্থল হতে মানুষের ক্রন্দন। মানুষের জীবনে সুখের চেয়ে বঞ্চনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। মানবতার দলন ও স্খলনে ব্যথিত, মর্মাহত হন। তাঁর হৃদয়ে কখনো কখনো রক্তক্ষরণও হয়। তাই তো নিজেকে নিবিষ্ট করেন সৃষ্টির অতলান্তিক স্রোত ও আবেগ ধারার অনুভবে; থাকেন অন্তলীন আত্মভুবনে।

বদলে যাওয়া সমাজ ও রীতির গভীর থেকে তুলে আনা জীবনবাহী প্রনোদনা থাকে কবির কলমে। কবির কলম আগামীর চোখও। তাঁকে হতে হয় একজন শ্রেষ্ঠ দ্রষ্টা। যান্ত্রিক জগৎ ছিটকে দেয় মানুষের মনন ও চিন্তন। যখন বিচ্যুত হয়ে পড়ে মানুষ মানবিক বোধ ও বিবেক থেকে সে বোধ ও বিবেক জাগ্রত করার হাতিয়ারও হয়ে উঠতে পারে কলম। নিসর্গ থেকে সৌন্দর্য ও আবীর কুড়িয়ে পিপাসার কাতরতায় কবি পরিতৃপ্ত করেন মনের দিকচক্রবাল। এক জীবন নয় যেন একটি জীবন। হাজার জীবনের আয়ু বহন করে মানব জীবন। মানুষের গভীরে রয়েছে বিশাল শক্তির আয়োজন। মানুষের গভীরে রয়েছে শত আলোক পিণ্ড, সে আলোক থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মি নিয়ে সে শক্তির স্ফূরণে সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন কবি। তার বোধ বাড়াতে গভীর প্রজ্ঞার জাগরণ ঘটাতে হয়। তিনি সে চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁকে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিতের পথ হেঁটে আসতে হয়। তাঁকে ভাষা শুদ্ধ-রূপে পঠন, শিক্ষন ও লিখনের প্রক্রিয়া আত্মস্থ করতে হয় এবং দূরে রাখতে হয় নিজেকে পারস্পরিক ঈর্ষা ও কোন্দল থেকে। প্রচার ও প্রসারমুখী চিন্তন খণ্ডন করে দিতে পারে জ্ঞান স্পৃহা, প্রতিহত করতে পারে ধারাবাহিক জঙ্গমতা। তাই তাঁকে প্রচারমুখী পথ ও মতের বাইরে অবস্থান নিতে হয়। তিনি তাই লিখবেন যা তিনি বিশ্বাস বা লব্ধ করেছেন।

কবির নেশা, পেশা, ধ্যান ও আরাধনা লিখন। তার সকল আনন্দের মূল স্রোত ও কেন্দ্র লিখনী। ভাস্কর যেমন পাথর কেটে কেটে মূর্ত করেন অবয়ব। একটি লেখাকে শতরূপে সংযোগ ও পরিহারের মাধ্যমে সঠিক রূপ পরিগ্রহ করাতে শ্রম দিতে তিনি ক্লান্ত হন না। । এখানে ভর করে তার একাগ্রতা,স্বরূপতা ও নিপুণতা, এখানে ভর করে জীবনের স্পৃহা ও সাধনার পরম লব্ধতা। একটি সঠিক কাঠামোগত কবিতা বা গদ্য কবিকে যে পুলকের আনন্দরাশি দিতে পারে তা আর কোথাও তিনি পান না। প্রেমের, ঘৃণার, হারানোর দহন, স্মৃতি কাতরতার খণ্ড খণ্ড টুকরো ছবি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাণ প্রবাহ কবির হাতে হয়ে উঠে মূর্তিময়ী রূপে; বিমূর্ত ভাবের অনুভবে কবি তার সার্থক রূপায়ণ করে অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করেন পরম তৃপ্তি বোধের মধ্যে দিয়ে। এখানেই তার পরিশ্রমের ফসল পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে আর এখানেই তিনি সার্থক রূপকার ও রূপ-স্রষ্টা…
শিল্পের প্রস্তুতি ও শিল্পের অনুভাবনা
কত বিনিদ্র রাতের খসড়া এক করে তৈরি হয় একজন লেখক জীবন। পৃথিবী নীরব হলে জেগে উঠে একাকীত্ব। কালের দহন, ক্ষরণ, বৈভব, বিড়ম্বনাসহ সমাচার বহন করা মন নিয়ে যে কোন কাজে গভীরভাবে নিমগ্ন হতে গেলে প্রশান্তি ও নীরবতা অপরিহার্য। ভাবনার করিডোর ধরে হেঁটে যায় হাজার বছরের মানুষের আর্তনাদ ও ঐতিহ্যের আবহ। যুদ্ধ, ধ্বংস, মহামারী ও প্রাণ বিয়োগ ব্যথা। বেঁচে থাকার আনন্দ। প্রিয় কণ্ঠের অনুরণন। প্রতারণার প্রদাহ। নারীর প্রতি সীমাহীন প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য।নির্যাতিতের ক্রন্দন। পাওয়া না পাওয়া বুকের কোথাও হিমের প্রহর কাঁপিয়ে দিয়ে যায় অথবা আনন্দের বাগানে ফুল ফোটায়। কখনো হৃদয়ের আকাশ ভরে তারায় তারায়। চায়ের চুমুক, সিগারেটের ধোয়া, পানীয়ের শীথিল নহর, খাতা, বই, কলম ও কাটাকাটি। কত রাতে ভেস্তে যায় সব আয়োজন। কত দিন রাতে আয়োজনহীন পাতার পর পাতা সাজতে থাকে বাজতে থাকে বিরহের সেতার। অলক্ষ্যে সুর ও স্বরের সম্মিলিত ধ্বনি প্রতিধ্বনি কাব্যদেবী জেগে উঠে কোন অসতর্ক-সতর্ক মুহূর্তে। জেগে উঠে গদ্যের প্রতিমা। দার্শনিক মতামত। বিজ্ঞানী আবিষ্কারের খুশিতে বলে উঠেন ইউরেকা। রাতের নাভিতে কত কালের মধুচন্দ্রিমা, শোলক বলা তিথি, প্রেমের অক্ষয় অনুরাগ, প্রিয় চুমুর চুম্বক, স্পর্শের বাহারি রঙধনু, সহবাসের প্রবাহমান সুখানুভূতি, আহরিত শব্দের পরিপাটি সংগম। মননের গভীর তন্ত্রীতে আলোড়িত হয় ছন্দের দোলা, বাক্য বিভা, করুণ কোন বার্তা। কখনো অনুভূতির রসাস্বাদনে অধরা কোন অনুভূতি লট্কে ঝটকে থাকে; ধরেও ধরা যায় না। এমনি পেষণে তৈরি হতে থাকে সৃষ্টির জগৎ। কত দীর্ঘ ও নাতিদীর্ঘ বলয় হেঁটে আসা পৃথিবী, বিলীন হয়ে যাওয়া ফসিল, বৃক্ষের প্রেম কথা, অগ্নি ও প্রলয়ের গীতিকাব্য। ধূলিতে উড়ে আসে প্রতাপী-বিলুপ্ত জাতির অশ্ব-খুরধ্বনি। হৃদয় তন্ত্রীতে বেজে উঠে নিষ্পেষিত জনের ব্যথা ও বিড়ম্বনার শত বাধা ও বেদনার হাড়ের ইতিহাস।
পৃথিবীতে সেই টিকে থাকে যে নিজেকে বেশি মূল্যবান মনে করে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে মুখোমুখি হতে হয় সংগ্রাম ও সমজোতার। যদি না শিল্প হয়ে উঠে কালোত্তীর্ণ। কালের প্রবাহে তা একসময় নিজ বিভা বলে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে ক্ষুন্ন হয় নৈতিকতা, করতে হয় দমন পীড়ন। সংগ্রাম দু’ধরনের এক নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থায়ী করণের জন্য নিষ্ঠুরতম আয়োজন আরেকটি দমন পীড়ন থেকে মুক্তি লাভের পথ কর্ম-পরিক্রমা। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যে সর্বদা অন্যের কথা ভাবে; সে নিজেকে পীড়িতদের পক্ষের জন মনে করে। সে নিষ্ঠুরতার হাত থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম নয় মানুষকে মানবিক হতে উৎসাহিত করে। মানব মনের অন্তর্গত সু ভাবনাগুলোর উদ্ভাসিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কেননা যে কোন সংগ্রামের সাথে জড়ির থাকে হত্যা, মৃত্যু ও ধ্বংস। লেখক নিজকে উজাড় করে অন্যের নিমিত্তে প্রাণে বহন করেন নিবিড় মমতা ও ক্রন্দন। তার মন মানবিকতার পদদলনে আর্তনাদ করে। একজন লেখকের প্রাণও শামিল হয় নির্যাতিতের বেদনা ও রক্ত-ক্ষরণের সাথে। তিনি সকল ধর্মের, সকল গোত্রের, দেশ ও কালের উর্ধ্বে অবস্থান করেন। শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন এক আলোকিত রূপময় শব্দ সম্ভার ও অনুভূতির আলোকে। আলোয় আলোয় মুগ্ধ শব্দাবলী মুক্ত হয়ে পাঠকের অন্তঃকরণে সুপ্ত ও মগ্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। ভাষা ও বোধকে তৈরী করতে হয় একদিকে নির্যাতিতের ধারক বাহকরূপে অন্যদিকে স্বাধীনতার আলোকোজ্জ্বল স্তরের সোপান ধরে তোরণে পৌঁছার সংকল্পে। যা মিথ্যে তা ঝরে পড়ুক, যা আদি ও আসল তাই মূর্ত হোক। তবে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা বা অত্যাচারের নিষ্ঠুর হাত দমনে যে মনোসংগ্রাম ও আধুনিকরণতাকে স্বাগত জানাতেও দ্বিধা থাকে না একজন সৃষ্টিশীল মানুষের মনন ও চিন্তনে।
যদিও মানব জীবনও সংগ্রাম ও কৌশলে টিকে থাকার ইতিহাস। হাজার হাজার শতাব্দী ধরে নিজের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ পরিবর্তিত করে এসেছে এক কোষ থেকে বহুকোষী পর্বের স্তর। এ পর্বের কিছু মানুষ মন ও মননে পশুত্ব স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানবিকতার স্তরে পৌঁছেছে। এটা ধ্যান ও সাধনার নিরন্তর শৈল্পিক মনোবৃত্তি। এখানেই মানুষ শুধু ভোগী নয় লালন করে স্রষ্টা-সত্তা। হয়তো বিবর্তনের হাত ধরে সৃষ্টিশীল মানুষ আরও নতুন কোন অবয়বে নতুন কোনো স্তরে পৌঁছে যাবে; এটা কল্পনা, আশা বা স্বপ্ন যাই হোক স্রষ্টা-মানুষ ক্রিয়াশীল থাকে ভবীষ্যৎ পরিভ্রমণে। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক অনুধ্যান করেন সৌন্দর্য সৃষ্টির। মনের গভীর অতলে নাড়া দেন। পৃথিবীর রুক্ষ-আবিলতা ঢেকে প্রকৃতির রূপ মাধুরী ধারণ করেন আপন প্রতিভার স্ফূরণ ঘটান । সে সৌন্দর্যে ডুবে পাঠক অর্জন করে সৌন্দর্য পিয়াসী অন্তঃকরণ ও শৈল্পিক চেতনা। যা যুগে যুগে মনের পশুত্ব বিসর্জন দিতে সহায়তা করে। এ চর্চা মনকে করে শাণিত, মননকে করে উজ্জীবিত। প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র আত্মিক জগতে প্রবেশ করে শিল্প স্ফূরণ ঘটায় শিল্পীর। যা সমাজকে, দেশকে জগৎকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করে।


শিল্পের অসুখই গড়ে শিল্পীর অবয়ব

ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মহা-মিলনে যে মানবীয় শারীরিক ও মানসিক অবয়ব তাতে সংশ্লিষ্ট থাকে দুই প্রজন্মের পূর্ব জনের কাছ থেকে পাওয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কাজেই মানব ভ্রূণ এক সুদীর্ঘ বৈচিত্রময় বৈশিষ্ট্য বহন করে। সে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের পর যেটুকু নিজস্বতা নিয়ে জন্মায়; তাকেও ঘর, সমাজ, জীবন, পরিবেশ মিলে মিশে ইংরেজিতে যাকে বলে স্কুলিং বা বাংলায় শিখন তা মনের আবহে এত বৈচিত্র এনে দেয়- যা এতই দুর্বহ হয়ে ওঠে যে ভেতরের মানুষটি আর তেমন থাকে না। তাকে প্রতিনিয়ত তৈরি করে যেতে হয় পরিবর্তিত অবয়ব।
কিন্তু মানুষ যখন মনের গহনে সৃষ্টিশীলতার তাড়না বোধ করে তখন ভেতরের একক মানুষ তার নিজস্বতা বা নিজেকে খুঁজে পেতে চান। মনের অন্তঃদহনের প্রাবল্যে বাইরের চাকচিক্যময় পৃথিবী তার কাছে হয়ে পড়ে অসার আর তাই অন্তরে বোধ করেন প্রবল শূন্যতাবোধ। তিনি গা ভাসিয়ে দিতে পারেন না সামাজিক স্রোতে। তিনি খুঁজে পেতে চান সৃষ্টির কোমলতা। হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাজাতে চান সহজিয়া গান। মানুষে মানুষে কেন এত বৈরিতা, কেন অহেতুক কোন্দল ও হানাহানি। সংসার জীবন যেন স্বার্থের গুরু-লঘু ছত্রছায়ায় আবর্তিত। উঁচু- নীচু ভেদাভেদের কারণ ও উৎস খুঁজতে থাকেন মনের নিজস্ব আলো জ্বেলে। মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তার অন্তর্নিহিত সুতোর টান দেখতে না পেয়ে এ শূন্যতা বোধাক্রান্ত মানুষটির চারপাশ হয়ে ওঠে অপরিচিত, মন পড়ে থাকে ঘোরে; যেন ধরেও ধরা যায় না, চিনেও চেনা হয় না পরিবেশ ও নিজেকে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি খাপ খাওয়াতে পারেন না। কেউ কেউ সুস্থতা হারিয়ে ফেলেন। যিনি টিকে থাকেন তিনি চিনতে চান দেশ, কাল, সমাজ, জাতি ও ধর্মের ইতিহাস। কেন এবং কে আমি এও এক বিমূর্ত প্রশ্ন ঘোরে। হয়তো কিছুই নয় বিবর্তনের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এও ‘তো স্বাভাবিক নয় বিশেষ প্রক্রিয়া’। আর এভাবেই তিনি ছোটেন মনের অলক্ষ্যে ‘নেই নেই’ হাহাকার কোথাও বাজে। তিনি খুঁজতে থাকেন আপন-সুর। নূপুরের ধ্বনি নয়, কোকিলের কুহু নয়, পূজার বাদ্য বা সেতার ও বিউগল, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি যেন ভয় জাগানিয়া স্বর। তার এ সমস্ত সূক্ষ্নাতিসূক্ষ্ন ভাবনা ভিমরুলের বাজনায় বাজিয়ে হুল ফুটিয়ে দিতে আসে। পালাই পালাই করে প্রাণ! তার মন খুব গোপনে কথা বলে নিজের সঙ্গে নিজে। তখন মানসিক ও আত্মিক রূপ স্ফুরিত হতে থাকে, সঞ্চিত হতে থাকে নিজস্ব কথা, নিজস্ব চিত্র অঙ্কিত হতে থাকে রঙ ও অঙ্কনে। কখনো বিক্ষত হয় ঘুমের শরীর; প্রবল কামের তাপে শিল্পের স্পন্দন বাড়তে থাকে। অনুভবের কোষে কোষে চলে নিয়ত সঞ্চরণ। ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে ঘুরে বেদনার হলে হলে এপাশ ওপাশ করে দিন-রাতের আসর। নীরবে ধর্ষিত হয় অবলা সময়।
এ অসুখ কমাতে খেতে হয় জ্ঞান সাগরে হাবুডুবু, হৃদয়ের অতলে ঢুকে স্থির করতে হয় স্থিরচিত্র। কেউ বা ধ্যানের অতল থেকে খুঁজে আনে আপন আয়না। কখনো বাড়াতে হয় পুঞ্জাক্ষির মতো মনের শত চোখ। দুঃখ গুলোকে দলা পাকিয়ে জমিয়ে রাখতে হয় গোপনতর মনিকোঠায়। ক্ষত বিক্ষত স্বপ্ন জোড়া দিয়ে সাজাতে হয় তাকে জীবনের ক্যানভাস। ছেঁড়া শাড়ির মতো সুঁইয়ের বুননে হেঁটে যেতে হয় সুতার আইলে। একাকীত্ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে বিগলিত হয়; হতে দিতে হয় জ্বলন, ক্ষরণ, দহনের স্রোতে। স্রোত প্রবাহিত করে কখনো ফেলে দেয় অতীতের গর্ভে কখনো ভবিষ্যতের ঝুলন্ত জানালায়। তিনি ভাসতে থাকেন কার্নিশে চেপে পায়ের আঙুল; যেন চুম্বক তাঁকে নিয়ে খেলছে ঘূর্ণন খেলা। ডুবতে থাকেনভয়াবহ কালের করাল গ্রাসে। হিংসা-প্রেম-ভাব ও উদ্বেগের বৃত্তে তিনি কেন্দ্রবিন্দু। প্রেম একটি ঝুলনা। এধার ওধার বাবুইয়ের দোল খাওয়া বাসা। দোল খেতে খেতে দেখবেন প্রবহমান পৃথিবীর রাশ উৎসব। সম্পর্ক যেন সম্পর্ক নয় যত কাছেই যাওয়া যাক না কেন যতই বাঁধা হোক গিট খুলে খুলে যায় যেন নাইলনের দড়ি। স্নায়ুর সঙ্গে খেলা করে সংসার সমুদ্র যানের তলা কেটে দেয়া সামাজিক ইঁদুরের দল। নক্ষত্রের আহ্বানে হাত বাড়ালে বাহু শূন্যের তটে খুঁজে পাওয়া যায় নিজেকে।
কেউ তাকে নিয়ে উল্লাসে মেতে থাকে; কেউ কেউ নিম-মুখে থুথু। তাতে যদি অটল সেগুন বৃক্ষ হওয়া যায়। হিংসার কোপানলে ভষ্মীভূত গৃহিণীর মতো সারিয়ে নিতে পারে ক্ষত। তবেই শিশিরের টুপটাপ ঝরাবে পাতা যখন ইচ্ছে যেমন। তিনি সৃষ্টি করবেন শিল্পের তাঁতে তন্তুগুটি থেকে মসলিনের বাখান। তিনি যা বলবেন তা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বা নিঃশেষিত সরল। যা দেখাবেন তার আদিরস, যা অনুভব করেছেন তার কিনার ছুঁয়ে যাবে দখিনা বাতাস। বৈশাখী দামামা যৌবনের উদ্দামে উরুছোঁয়া আবেগের শিহরণে উন্মাতাল।
তিনি সৃষ্টি করে যাবেন নক্ষত্রের ইতিবৃত্ত। তিনি ভাসবেন না বিভেদের ঘূর্ণি তালে; ভাসলে ডুবে যাবেন অতলের ঘন কার্বনের গলনে আর পুড়তে থাকবেন নরক বহ্নিতে। আবার সৌষ্ঠব ধরে হবেন স্বর্গের উর্বশী। সুঘ্রাণ বইবে ধর্ষক উন্মুখ হবে। যদি পেয়ে যান সাপের শাণিত ধারের মতো শব্দের ছোবল, যদি পেয়ে যান সৃষ্টির তলোয়ার; যদি শূন্যে ভেসে বেড়ানোর মতো ভাষার অস্তরাগের লাল ধুলোবালি ; তবে শিল্প-চাষী, তবেই শিল্পের কৃষাণী, তবেই শিল্পী বুনবে প্রাণের বীজ ঘুরে ঘুরে অন্তলীন চেতনার উদ্যানে।

৪.
শিল্পের প্রস্তুতি ও শিল্পের অনুভাবনা
…………………………
কত বিনিদ্র রাতের খসড়া এক করে তৈরি হয় একজন লেখক জীবন। পৃথিবী নীরব হলে জেগে উঠে একাকীত্ব। যে কোন কাজে গভীর নিমগ্ন হতে গেলে প্রশান্তি ও নীরবতা অপরিহার্য। ভাবনার করিডোর ধরে হেঁটে যায় হাজার বছরের মানুষের আর্তনাদ ও ঐতিহ্যের আবহ। যুদ্ধ, ধ্বংস, মহামারী ও প্রাণ বিয়োগ ব্যথা। বেঁচে থাকার আনন্দ। প্রিয় কণ্ঠের অনুরণন। প্রতারণার প্রদাহ। নারীর প্রতি সীমাহীন প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য।নির্যাতিতের ক্রন্দন। পাওয়া না পাওয়া বুকের কোথাও হিমের প্রহর কাঁপিয়ে দিয়ে যায় অথবা আনন্দের বাগানে ফুল ফোটায়। কখনো হৃদয়ের আকাশ ভরে তারায় তারায়। চায়ের চুমুক, সিগারেটের ধোয়া, পানীয়ের শীথিল নহর, খাতা, বই, কলম ও কাটাকাটি। কত রাতে ভেস্তে যায় সব আয়োজন। কত দিন ও রাতে আয়োজনহীন পাতার পর পাতা সাজতে থাকে বাজতে থাকে বিরহের সেতার। অলক্ষ্যে সুর ও স্বরের সম্মিলিত ধ্বনি প্রতিধ্বনি কাব্যদেবী জেগে উঠে কোন অসতর্ক-সতর্ক মুহূর্তে। জেগে উঠে গদ্যের প্রতিমা। দার্শনিক মতামত। বিজ্ঞানী আবিষ্কারের খুশিতে বলে উঠেন ইউরেকা। রাতের নাভিতে কত কালের মধুচন্দ্রিমা, শোলক বলা তিথি, প্রেমের অক্ষয়-অনুরাগ, প্রিয় চুমুর চুম্বক, স্পর্শের বাহারি রঙধনু, সহবাসের প্রবাহমান সুখানুভূতি, আহরিত শব্দের পরিপাটি সংগম। মননের গভীর তন্ত্রীতে আলোড়িত হয় ছন্দের দোলা, বাক্যবিভা, করুণ কোন বার্তা। কখনো অনুভূতি রসাস্বাদনে অধরা কোন অনুভূতি লট্কে ঝটকে থাকে ধরেও ধরা যায় না। এমনি পেষণে তৈরি হতে থাকে সৃষ্টির জগৎ। কত দীর্ঘ ও নাতিদীর্ঘ বলয় হেঁটে আসা পৃথিবী, বিলীন হয়ে যাওয়া ফসিল, বৃক্ষের প্রেম কথা, অগ্নি ও প্রলয়ের গীতিকাব্য। ধূলিতে উড়ে আসে প্রতাপী বিলুপ্ত জাতির অশ্ব খুর ধ্বনি। হৃদয় তন্ত্রীতে বেজে উঠে নিষ্পেষিত জনের ব্যথা ও বিড়ম্বনার শত বাধা ও বেদনার হাড়ের ইতিহাস।
পৃথিবীতে সেই টিকে থাকে যে নিজেকে বেশি মূল্যবান মনে করে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে মুখোমুখি হতে হয় সংগ্রাম ও সমজোতার। (যদি না শিল্প হয়ে উঠে কালোত্তীর্ণ। কালের প্রবাহে তা একসময় নিজ বিভা বলে দাঁড়িয়ে যায়।) এখানে ক্ষুন্ন হয় নৈতিকতা, করতে হয় দমন পীড়ন। সংগ্রাম দু’ধরনের এক নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থায়ী করণের জন্য নিষ্ঠুরতম আয়োজন আরেকটি দমন পীড়ন থেকে মুক্তি লাভের পথ কর্ম-পরিক্রমা। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যে সর্বদা অন্যের কথা ভাবে সে নিজেকে পীড়িতদের পক্ষের জন মনে করে। সে নিষ্ঠুরতার হাত থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম নয় মানুষকে মানবিক হতে উৎসাহিত করে। মানব মনের অন্তর্গত সু ভাবনাগুলোর উদ্ভাসিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কেননা যে কোন সংগ্রামের সাথে জড়ির থাকে হত্যা, মৃত্যু ও ধ্বংস। লেখক নিজকে উজাড় করে অন্যের নিমিত্তে প্রাণে বহন করে নিবিড় মমতা ও ক্রন্দন। তার মন মানবিকতার পদদলনে আর্তনাদ করে। একজন লেখকের প্রাণও শামিল হয় নির্যাতিতের বেদনা ও রক্ত-ক্ষরণের সাথে। তিনি সকল ধর্মের, সকল গোত্রের, দেশ ও কালের উর্ধ্বে অবস্থান করেন। শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন এক আলোকিত রূপময় শব্দ সম্ভার ও অনুভূতির আলোকে। আলোয় আলোয় মুগ্ধ শব্দাবলী মুক্ত হয়ে পাঠকের অন্তঃকরণে সুপ্ত ও মগ্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। ভাষা ও বোধকে তৈরী করতে হয় একদিকে নির্যাতীতের ধারক বাহকরূপে অন্যদিকে স্বাধীনতার আলোকোজ্জ্বল স্তরের সোপান ধরে তোরণে পৌঁছার সংকল্পে। যা মিথ্যে তা ঝরে পড়ুক, যা আদি ও আসল তাই মূর্ত হোক। তবে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা বা অত্যাচারের নিষ্ঠুর হাত দমনে যে মনোসংগ্রাম ও আধুনিকরণতাকে স্বাগত জানাতেও দ্বিধা থাকে না একজন সৃষ্টিশীল মানুষের মনন ও চিন্তনে।
যদিও মানব জীবনও সংগ্রাম ও কৌশলে টিকে থাকার ইতিহাস। হাজার হাজার শতাব্দী ধরে নিজের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ পরিবর্তিত করে এসেছে এক কোষ থেকে বহুকোষী পর্বের স্তর। এ পর্বের কিছু মানুষ মন ও মননে পশুত্ব স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানবিকতার স্তরে পৌঁছেছে। এটা ধ্যান ও সাধনার নিরন্তর শৈল্পিক মনোবৃত্তি। এখানেই মানুষ শুধু ভোগী নয় লালন করে স্রষ্টা-সত্তা। হয়তো বিবর্তনের হাত ধরে সৃষ্টিশীল মানুষ আরও নতুন কোন অবয়বে নতুন কোন স্তরে পৌঁছে যাবে; এটা কল্পনা, আশা বা স্বপ্ন যাই হোক স্রষ্টা-মানুষ ক্রিয়াশীল থাকে ভবীষ্যৎ পরিভ্রমণে। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক অনুধ্যান করেন সৌন্দর্য সৃষ্টির। মনের গভীর অতলে নাড়া দেন। পৃথিবীর রুক্ষ-আবিলতা ঢেকে প্রকৃতির রূপ মাধুরী ধারণ করেন আপন প্রতিভার স্ফূরণ ঘটান । সে সৌন্দর্যে ডুবে পাঠক ও শ্রোতা অর্জন করে সৌন্দর্য পিয়াসী অন্তঃকরণ ও শৈল্পিক চেতনা। যা যুগে যুগে মনের পশুত্ব বিসর্জন দিতে সহায়তা করে। এ চর্চা মনকে করে শাণিত, মননকে করে উজ্জীবিত। প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র আত্মিক জগতে প্রবেশ করে শিল্প স্ফূরণ ঘটায় শিল্পীর। যা সমাজকে, দেশকে জগৎকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করে।

৫.
ছন্দের আলোয় মনের মুক্তি

আমরা বসত করছি এক নিরবধি ছন্দ আবিষ্ঠতায়। ছন্দ রয়েছে আমাদের চারপাশে।হাস্যময় ফুল, পাতার নিবিড়তা ও শিশুর কোলাহলে, প্রতিদিনের প্রেমরস ও আবেগের সিঞ্চিত ফল্গুধারায়। ছন্দ বহমান বাতাসের সিম্ফনী ও নদী-সাগরের কল্লোলে।পাখির কণ্ঠে যে সুর প্রকৃতি জাগিয়ে তোলে তার তাল, লয় ও ধ্বনি আমাদের মোহিত করে, প্রাণবন্ত করে; প্রাণকে জাগ্রত করতে অনুপ্রাণিত করে।শাহরিক বাস্তবতা ও দ্বন্দ্ব সংস্কারে ভগ্নছন্দ কে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ যে প্রচেষ্টা তাও মনে করিয়ে দেয় সহজাত মানব মন ছন্দ প্রেমী ও ছন্দে নিয়ত চলার প্রচেষ্টায় নিমজ্জিত থাকার অভিলাষবাহী।
কবিতা প্রাকৃত জনের মুখের ও মনের বহুমাত্রিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হ’য়ে যুগে যুগে প্রাত্যহিক ও মনের গহনকে রঙিন করেছে। কবিতা সৃজিত আবেগের অবগুণ্ঠনে, সুপ্তি মগ্নতার নিগূঢ় উচ্চারণে। তা নিমজ্জিত থাকে, নিবেদিত থাকে ছন্দসুধারসে। তেমনি যে প্রাকৃত ধ্বনি যুগে যুগে আমাদের শিল্পস্বত্তাকে জাগ্রত করে রাখে তা নানাবিধ ছন্দ-সুর ও ব্যঞ্জনা লালিত্য হয়ে এসেছে। তারই গুণ টেনে নিয়ে এসেছে আমাদের পূর্বজ কবিগণ এবং আগামীর হাতে পৌঁছে দিচ্ছে বর্তমান কবিতা শ্রমিক। এর সাথে আরো জড়িত দায় বোধ ও প্রকৃতি কে ধারণ করার সহজাত মনোপলদ্ধি। আসলে প্রকৃতির অংশ আমরা অথবা প্রকৃতিই আমরা। এই আমাদের এক সত্তা বিশ্লিষ্ট হয়ে বহুসত্তার রূপে।এই রূপ ও প্রেম সাধনা ই আরাধ্য। প্রেমের রূপ তো ছন্দময়, হৃদয়িক ভাব, বিরহ ও গভীর হবে তা বলাই বাহুল্য।
বিচিত্র শব্দ বা সুর ও চিত্রের এক মহাসৌন্দর্যের সম্মিলন মানব জীবন।প্রেম, বিচ্ছেদ ও মিলনের এক গূঢ় সংযোজন ই মানুষের মন।মানুষ সুরের আবহে থাকতে চায় আর তা থেকে বিচ্যুত হয় বলেই জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে। কবিতা ও সংগীত সে সুরকে সমন্বিত করেছে বলেই মানুষ সংগীতকে, কবিতাকে নিজের আত্মার বা গভীর মনের সুর বলে মেনে নেয়।তা থেকে বিচ্যুত মানেই ভেঙে পড়া ভাঙা সাঁকোর মতো সকল সংযোগ বিচ্ছিন্নতা।
আর এ ছন্দময়তা ধরে রাখতে কবিতার ফুলকে সাজাতে তার দলমঞ্জুরিকে নির্দিষ্ট অবয়ব গড়ে গঠিত হতে হবে অথবা ফুলে ফুলে সাজিয়ে নিতে হবে মালা আর তা নিবেদিত হবে প্রেমার্থীর জন্য। কবিতার পাঠকই সে প্রেমী যে নিবেদন গ্রহণ করে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই তো সে মাল্য হতে হবে হৃদয় উজাড় করা নৈবেদ্য। পরিপূর্ণ রূপ রসে মাদকময়। তা গঠন করতে নিজেকে ভেঙে ভেঙে পূর্ণ হতে হয়। পুরনো অবয়ব ভেঙে প্রয়োজনে নতুন অবয়ব গড়ে তুলতে হয়। তাকে হতেই হবে ছন্দময়, আলোক ময়, গঠনমূলক। মানব জীবন বিশৃঙ্খলতা ও অস্থিরতায় নিমজ্জমান। প্রতিদিন ক্ষুধা-তৃষ্ণা, মন্দা, মারী, প্রতারণা, বিশ্বাসহন্তার ছুরিতে কাটছে সময়। কিন্তু সহজাত ভাবে মানুষ প্রেমপুজারী।তার প্রাণ শুদ্ধতার পথে চলমান। সে প্রাণ কে জাগ্রত করাও কবিতার কাজ। আমাদের অন্তরের স্রোতকে বহমান করতে কবিতাকে ছন্দ নাওয়ের পাটাতনে চড়তে হবে। আগাতে হবে কূল ও গতির স্রোত ধরে। প্রবাহিত হবে দুই কিনারের সকল সৌন্দর্য অবলোকন ও অবগাহন করে।
অনেকেই বলে থাকেন অক্ষর, মাত্রা, ছন্দ ও আবেগ সাথে নিয়ে অনুভূতির অনুসঙ্গে গড়ে মেপে মেপে কবিতার পোশাক সাজানো হাস্যকর। কিন্তু আমার অনুভূতি অনুভূতি ই; তাকে ওসব নিয়মে বেঁধে ফেললে অনুভূতি উপলব্ধিতে যাই ধরা পড়বে ছন্দোবদ্ধ হয়েই ধরা পড়বে। যে কোন কাজের প্রস্তুতি থাকে। পরীক্ষা পাশ করতে হলে পাঠ্যপুস্তক পাঠ করতে হয়। চাকুরীর ইন্টারভিউতে আরও বিস্তৃত পঠনের প্রয়োজন পড়ে। সব কাজের মতো এখানে ও রয়েছে ব্যাপক কাজ ও জ্ঞান আহরণের বিশালতা অর্জনের মতো কাজ ও অনুধ্যান। কেউ কেউ প্রকৃতিগত ভাবে হয়তো জ্ঞানী থাকে। সেটা আভ্যন্তরীণ। এ আভ্যন্তরীণ প্রজ্ঞা র সাথে বহিঃ জগতের সম্মিলন কিন্তু সে অনুভূতি কে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। সুর- ছন্দ- প্রজ্ঞা-আবেগ এক হয়ে মিশে সৃষ্টির সৌন্দর্য ত্বরান্বিত করে আর তা গ্রহণ করলে অনুভূতি খণ্ডবিখণ্ড না হয়ে মঞ্জরিত হয় শুদ্ধ প্রাণোদ্যানে সঠিক বিটপের শাখায়।এতে অনুভূতির বিচ্যুতি না ঘটে সনির্বন্ধ লাভ করে। “ছন্দ জেনে নিয়ে ছন্দ ভাঙো।” পূর্বজ কবিদের এসব বাণী হেলায় ফেলে দেয়ার মাঝে কোন কৃতিত্ব নাই। ভবিষ্যৎ তো নাই ই।
অক্ষর, মাত্রা, ছন্দ, অলঙ্কার, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প আবেগ বা অনুভূতির নির্যাস ও জ্ঞানের দ্যুতি একসাথে মিলে মিশে হয় কবিতা।তা দিয়েই গঠিত কবিতা যদি আমাদের মুগ্ধ করে, আলোকিত করে, খুলে দেয় মনের দুয়ার তবে আমরা কেন ভেঙে দিতে চাই ঐতিহ্য ও সংযুক্তির সকল আবীর? তা থেকে কি মিলছে আমাদের? উপন্যাস বা গল্প সাহিত্যের পথ ও পাঠক যত বিস্তৃত হচ্ছে কবিতা সাহিত্যের জগৎ ও পাঠক তত কমে যাচ্ছে; মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে কবিতার বলয় থেকে।ছন্দোবদ্ধ কবিতা মানে অনেকে অন্তমিলযুক্ত কবিতাই বোঝেন। তাই বলে থাকেন এসব কবিতা আজকাল কেউ পড়ে না। এটা একটা ভুল ধারণা। অন্তমিল না দিয়েও বহ উত্তীর্ণ কবিতা বাংলা কবিতা সাহিত্যে রয়েছে। একে তো কবিতার পাঠকের চেয়ে কবির সংখ্যাই বেশি।শুধু বেড়ে উঠছে সংগঠন, কবিতার বাণিজ্য বাড়ছে ঠিক নয় কবি নামধারী মানসিকভাবে দুর্বলতর কবিদের মূলধন করে ফায়দা লুটছে সংগঠনকারী। শত শত পুরস্কার বিতরণ হচ্ছে রিলিফ বিতরণের মতো। ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আর শোকেসে রেখেই পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে কবি। কবিতার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে কবি। পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক বা তার বন্ধু বা পত্রিকার সাথে জড়িতরাই বড় কবি।টেলিভিশনেও একই চিত্র বন্ধুত্বের মান বড় মেধার নয়। নীরবে কাঁদছে কবিতা। মননের বা মেধার চর্চা নাই কোথাও। মান বাড়ছে না লেখার বা কবিতার। কেননা কবিতা ভাবনা বা মনের গহনের খোঁজ কেউ করছে না। অন্যদিকে গুটিকয় আবৃত্তি শিল্পীর দ্বারা পরিচালিত কবিতা ই কবিতা হয়ে থাকছে। এখানে ও কথা ‘কবিতার পাঠক কখনো সাধারণ্যে ছিলো না ’।
কিন্তু একথা ও তো সত্যি যে একসময় মানুষ মুগ্ধ ছিল কবিতায়। প্রেমাস্পদকে একটা কবিতার বই দিয়ে সুখী হত প্রেমিক বা প্রেমিকা এখন কেউ আর এমনটি ভাবেন বলে দেখা যায় না। প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে যে সব কথা ,‘‘কবিরাই কবিতার পাঠক” অথবা “সবাই শোনাতে চায় কেউ শুনতে চায় না।” অথবা ‘‘কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি।’’ এসব প্রচলিত কথা কবিতার জন্য হানিকর। কবির জন্য তো বটেই। তার উপর মানুষ দায়বদ্ধ সময়ের কাছে। এ সময়ই হয়ে পড়বে একদিন ইতিহাস। তাই যেন আগামীর হাতে এক সমৃদ্ধতর ইতিহাস পৌঁছে দেয়া যায় তাই হোক আমাদের আরাধ্য-অন্বিষ্ট। মানুষ যে কথা বলতে চায় বলতে পারে না যে কথা শুনতে চায় কবিতায় সে কথার অনুরণন শুনতে পেয়ে কেঁপে ওঠে আর তা শুনতে না পেয়ে সরে যায় এ জগৎ থেকে। কেননা মানুষের ভেতরে বাস করে এক অবোধ মানুষ। আর কবিতাকে লালন করতে হবে সে অবোধ মানুষের অন্তরের প্রতিচ্ছবি, কবিতাকে জাগ্রত করতে হবে সে অবোধ মানুষটিকে…