মজিদ মাহমুদের কবিতা

মা-দিবস
আমার কোনো মা নেই
আমি মাতৃগর্ভজাত নই
একটি স্টেম সেল থেকে আমার জন্ম
আমার কোনো জন্মদিন নেই
নেই নিজস্ব রূপ ও পরিচয়
আমি দেখতে ঠিক তার মত
যার কোষ থেকে আহরিত
আমি বুঝতে পারি না
সে আমার বাবা না ভাই
নাকি অন্য কেউ
আমরা যখন হেঁটে যাই
একজন আরেকজন ভাবি
তার মা আছে, পিতাও
তারাও আলাদা করতে পারে না
রঙ চুল উচ্চতা কথা বলার ঢঙ
সব তার মতো
তার প্রেমিকারা সঙ্গত কারণে
দ্বিচারিনী-
তারা যদিও জানে
আমরা দু’জন ভিন্ন মানুষ
আমিও তার মতো
উদ্দীপনায় সাড়া দিই
আমার জন্ম গবেষণা জারে
আমি তাকে মা বলতে পারি
অন্তত মাতৃগর্ভ, কিন্তু
তার নাড়িভড়ি নেই
ঘিলু ও জননতন্ত্র নেই
তবে আমি আর বেশিদিন
সুস্থ বাঁচতে পারব না
শুনেছি আমার কোষদাতা পিতা
কঠিন অসুখে আক্রান্ত
তার লিভার ও কিডনি অচল
আমার কিডনি ও লিভার
তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন
যেহেতু আমার মা নেই
রক্ষা করবার কেউ নেই
আমার মতো এরকম অসংখ্য
মাতৃহীন সন্তান
তোমাদের চারপাশেই রয়েছে
মাতৃদিবসে তোমাদের আদিখ্যেতা
একুশ শতকে-
আমাদের কষ্ট দেয়।
ঘুমাতে দাও
কেউ যে তুমি আছ-
সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনার সঙ্গে ভাসছ
মুহুূর্তে আলোর তরঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছ
তুমি যতদূর যাচ্ছ শূণ্যতা ততদূর প্রসারিত হচ্ছে
আমরা যদিও একমাত্র আলোতেই বিচরণ করি
তবু তুমি বিস্তৃত অন্ধকারে থেকে যাও
তাই অন্ধদের প্রতি তোমার পক্ষপাত
যাদের নেই বস্তুর দৃশ্যগত স্মৃতি
যাদের হৃদয়ের তলদেশ অনুন্মোচিত
তুমি সেখানেও থাকছ স্বাচ্ছন্দ্যে
যারা আমায় ছেড়ে গেছে
যারা প্রেম থেকে করেছে বঞ্চিত
যারা করেছে গোপন সম্পর্কের তথ্য ফাঁস
তুমি তাদের সঙ্গেও দিব্বি মানিয়ে নিয়েছ
প্রতিবেশিরা আমায় করছে কটাক্ষ
অথচ রাত এলে এখনো অসহ্য যন্ত্রণায়
একা একা কাঁদতে থাকি
খুঁজি তোমার অদৃশ্য অবয়ব
তবু নগ্ন আলোর অস্থির প্রবঞ্চনা
আমায় করে উপহাস
তোমার স্মৃতি ছাড়া নেই কোনো আড়াল
আমায় নাও তোমার অন্ধকার কক্ষে
আমায় একটু ঘুমাতে দাও।
জন্ম ও নিয়তি
জন্মদিন যদিও শহুরে সংস্কৃতির অংশ
তবু বিষণ্ণ হই, ভাবি, এই দিনই কি সেই দিন
যেদিন আমি জন্মেছিলাম!
বিহঙ্গ কি জানে, জানে কি প্রাণিকুল-
যাদের জীবাশ্ম ভরেছে পৃথিবীর ভা-ার
সব জীবনে বছর ঘোরে না
কারো জীবন পল ও দ-ে
আহ্নিক গতির ঋতুচক্র ঘটে প্রকৃতির নিয়মে
সময় কি ফিরে আসে নিজস্ব আলয়ে!
আমি শুধু সেই শিশুটির কথা ভাবি
এক নারী বাঁশ ও খড়ের চালার নিচে
জুবুথুবু বৈশাখি ঝড়ে প্রসব বেদনায়-
গোশালায় মা মরিয়ম যেন ছোট যিশু কোলে
কিছুক্ষণ আগে এক বৃদ্ধা বলল চিৎকার করে-
শুনছ তোমরা- ‘সানুর ছাওয়াল হয়েছে,
বিশ্বাসের ব্যাটা এবার দিতে পার আজান’
আজ সেই পোয়াতির মুখ মনে পড়ে
একটি ন্যাকড়ার ভেতরে মানুষের পুত্তলি নিয়ে
কিভাবে রাত্রি জেগেছিল ভয়াবহ শঙ্কায়
কার চোখে রেখেছিল চোখ তরুণী মাতা
আজ কোথাও নেই সেই মুখ
শিশুটিও মরে গেছে নিজের ভেতরে
কেবল বীজের চিহ্ন লেগে আছে পল্লবে কা-ে
বায়ু তুমি কি রেখেছ ধরে তার দুরন্ত পদচ্ছাপ
নদী তুমি কি লুকিয়ে ফেলেছ সন্তরণের চিহ্ন
নাকি ফাঁপা বৃথা সময়ের মধ্যে
গির্জার ঘন্টার ধ্বনি বাজে অবিরাম
শব-সৎকারে ব্যতিব্যস্ত অনন্ত পুরোহিত
আকাশ ও মৃত্তিকার মাঝে কিছু ধোঁয়ার কু-লী
যুদ্ধ কিংবা মহামারী শেষে
এমনকি শান্তি প্রতিষ্ঠা কালে
অপরিবর্তিত থাকে আমাদের নিয়তি।
উদ্যানের গাছগুলি
অনেকে বলেন- গাছগুলি চলৎশক্তিহীন
মৃত্তিকার বন্ধন ছেড়ে কোথাও যায় না তারা
আমার কাছে বৃক্ষ এক চলমান রেলগাড়ির নাম
ইস্টিশন ছেড়ে ট্রেন চলে গেলে
তাদের করুণ মুখগুলো হয়ে ওঠে সচল
ইঞ্জিনের গতি বেড়ে গেলে
কাঁপতে থাকে দুধারের হরিৎ বর্ণালী
ফিরে এলে- তারাও ফিরে আসে
মায়ের সুশীতল ছায়া নিয়ে
মাকেও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে দেখিনি
মেঘের ছায়া হয়ে দুধার ঘিরে রাখে আজীবন
দৃষ্টি ব্যাহত হলে আকাশ নেমে আসে
তবু বলি না- মা আমার হাঁটতে পারে না
দূরে গেলেও থাকে আশীর্বাদের ছায়া
আর কিছু পল্লবতরু আমার মাসিও বটে-
ছাত্রকালে রমনা আর সোহরাওয়াদী উদ্যানে যেতাম
ভোরের বাতাসে- কলি ও বিপাশা কুড়াত ফুল
দাঁড়াতাম সেই সব পাদপের নিচে
আনন্দে নেচে উঠত সেই পল্লব-বিটপী
ডানা ঝাপটা দিয়ে পাখি উড়ে যেতো
নীরব বোধিদ্রুম জানাত আমার আগমন বার্তা
অনেক দিন হলো বিশ^বিদ্যালয় ছেড়েছি
এই সব মহীরুহের কথা এখনো মনে পড়ে
কেউ যেন ডেকে বলেÑ
মাতৃষ¦সা খালাদের ভুলে যেতে আছে!
এখনো কালেভদ্রে যাওয়া হয় সেখানে
মনে হয় এই সব মহীরুহ আমার চেনা
এরাই কোলেপিঠে করেছিল মানুষ।
শ্রী শ্রী সন্ন্যাসী-তলা
এক সন্ন্যাসী আমায় বলেছিল শৈশবে
একটি নদীর ধারে বটবৃক্ষ তলে
শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা মাকালীন মন্দির
পাশে তার ছিল ভক্তদের ভিড়
বক্ষ ও যোনীদেশ ঢাকা ছিল নৃমু-ের মালা
খড়্গ ও ত্রিশূল হস্তে মা মিটাচ্ছিলেন জ¦ালা
জন্ম দিয়েছি বলেই তোরে করব বিনাশ
পদতলে জগত পিতা করে হাঁসফাঁস
যেখানে বসেছিল সাপ্তাহিক হাট
সম্মুখে ছিল ভুবনডাঙ্গার মাঠ
বলেছিল- বালক দেখতে পাচ্ছ কিছু
হাট থেকে বাড়ি ফিরি বাবার পিছু
বলেছিল- এই খানে বটবৃক্ষের তলে
সবাই একে একে যায় রসাতলে
এসেছিল যারা এই হাটে একদিন
সেই সব প্রেতযোনি নাচে ধিনাধিন
কেউ নেই তারা আজ দৃশ্যের বাটে
শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে শুষ্ক কাষ্ট খাটে
দৃশ্যের সকলে হয়েছে গত
তুমি কেবল মৃত্তিকার অমোচনীয় ক্ষত
এই মাঠে একদিন খা-ব দাহন
কুরু-পা-ব ভ্রাতৃঘাতী রণ
তারা আজ নিশ্চিন্তে ঘুমায় মাঠে
ভুলো না সেই কথা নিমগ্ন-পাঠে
মানুষের থাকিবার সাধ- তবু এই খানে
থেমে যায় মৃতদের গানে।
পরিহাস
আগে এই কবরস্থানে আসলে খুব ভয় হতো
খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না
মনে হতো কিছু মানুষের শরীর ঘিরে
অদৃশ্য আত্মারা বেড়াচ্ছে ঘুরে
টের পেতাম তাদের নিঃশ^াসের বায়ু
যদিও কবরগুলো এখন
খ্রিস্টান সেমিট্রির মতো বাঁধানো
নানা রকম বাহারি গাছ ফুলের সমারোহ
ভেতরে রাস্তা ও বসার সুবন্দোবস্ত
আগের মতো জুতা খুলতে হয় না আর
প্রত্যেক এপিটাফে রয়েছে নাম
সালাম আব্দুল করিম রহমান
ফৌজিয়া আকলিমা জান্নাত আরা
এখানে ঘুঁচে গেছে নারী-পুরুষের ফাঁড়া
যদিও কেউ ডাকে না নাম ধরে আর
পৌত্র-দৌহিত্র পরিবার
কেউ জানে না তারাও একদিন
চেয়েছিল তাদের আত্মার শান্তি
তারা কি এখানেই আছে শুয়ে
যাদের কবর বাতাসে- মহামারী ত্রাসে
কলেরা গুটিবসন্ত আর জাহাজ ডুবিতে
গিয়েছিল ভেসে
এখানে হয় নানা প্রশ্নের উদয়
এখানেই হয়তো আছে
মা-পিতা ভাই-বোন শিক্ষক আত্মীয় স্বজন
যাদের অস্থিতে গজিয়েছে ঘাস
তারা আজ করে পরিহাস।