গল্প: ন-অন্তর

গল্প: ন-অন্তর

ন-অন্তর
দিলারা হাফিজ

গল্পটা শুরু হতে পারতো একজন পরম পুরোহিতকে নিয়ে।
তা হবে না হয়তো।
পূজারি কিংবা পুরোহিত দু’জনেই পবিত্র পূজা-মন্দিরের শীতল প্রেমের প্রলেপ, সরোবরের ফুটন্ত পদ্ম, লাল নীল কিংবা শাদা।
সে যাই হোক, খুব শাদামাটা মানবিক প্রেমও যে দেবোত্তর সম্পত্তির অংশ বিশেষ—সে কথা জানে এবং মানে যে—কোনোঅপ্রেমিক পাষণ্ড হৃদয়ের অধিকারী যে’জন, সেও।
সেই দেবোত্তর সম্পত্তির ভাগ কখন যে, কিভাবে পেয়ে যাবে কেউ, তার খানিকটা —-তা আগে ভাগে কখনো প্রেডিক্ট করা যায় না।
এই ভাবনায় অনেকটাই বাহুল্য সময় কাটায় নয়াদীপ।এরকম একটি খাপছাড়া নাম কেন যে রাখা হয়েছিল তার জন্যে, মাঝেমধ্যে সে ভাবনাও আঁকড়ে ধরে তাকে কালো ডায়া পিঁপড়ের মতো।
দিনের দোতারা এভাবেই বাজায় সে কূল-কিনারাবিহীন নদীর মতো, লম্বা হয়ে শুয়ে শুয়ে বিছানাকে ভাবে সে পদ্মা-মেঘনা-যুমনাররেপ্লিকা।
ভেতরে তার নর-জন্মের বিষাদ থই থই করে। জলভেঙে গুড়ি গুড়ি হয়ে ছিঁটে আসে তার শরীর ও মনে। মাথায় অনুভব করেবৈঠার টান, এক সময় এই অধরা টানে টনক নড়ে নয়াদীপের।
তখন উদাস কণ্ঠে হাঁক ছেড়ে সুরকে ডেকে নেয় তার নিজের কাছে। বঞ্চনার কথা ভেবে নিজেকেই নিজে ক্ষুব্ধ করে তোলে সে। নাম, পদবী, লিঙ্গ কোনোটি তার মনপূত নয় যেন।
সুরেলা কণ্ঠে নয়াদীপ গানটি গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে যায়। আপন মনে কবিতার মতো করে বলে,
“বনমালি তুমি, পর জনমে হয়ো রাধা”—- কোনো মানে আছে এই কথার? এই জনমে নাহলেও পরের জন্মে অবশ্যই নারী হয়েজন্মাবার এই সাধ, এবং সুরে সুরে তার ঘোষণা ব্যক্ত করার কোনো মানে আছে?
এই সব সঙ্গীত আজকাল তবু কেন যে, মনের জলে ঢিল মারে; তা বলা-কওয়া সহজ কাজ নয়।
এভাবেই একমনে বিড়বিড় করে নয়াদীপ, স্ফটিক স্বচ্ছ ঘৃণার এক বুড়বুড়ি তোলে নিজের অজান্তেই। নিজেকে পাগল পাগল ভাবে, কখনো বা নিজেকে ভারী সামঞ্জস্যহীন মনে হয় নিজের কাছেই। মনে মনে কবিতা লেখার কথা চিন্তা করে নয়াদীপ।
ভাবে, কবিতা লেখা উচিত হবে কি? পলিকাদার এই দেশে এমনিতে এতো কবি, তারমধ্যে আমিও এক কানাইমাস্টার, যুক্ত হতেচাইলে জায়গা পাবো তো?
কবিতাও তো এক বিশাল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কালিওগ্রাফি, এক পংক্তি মনে হলেও পরবর্তী চরণগুলোর জন্যে মন ছটফট, ছটফট করেকেবলি।কিন্তু কবিতা আসে না সেভাবে চমকে দিয়ে, অথবা সঠিক সময়ে। যথোপযুক্ত অনায়াস শব্দে-বন্ধে-ছন্দে এবং রস-ব্যঞ্জনার নতুন নায়ের ভরা নায়োরী হয়ে কখনো যে এলো না সে।
অথচ “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতায় কত অনায়াসে কবি বললেন,
“আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে/
হে সুন্দরী,
বলো কোন পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী”।

বেটা রবি ঠাকুর,মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কি চমৎকার রসে, ব্যঞ্জনায় বলে দিলো তাঁর সব মনের কথা।
তাঁর মতো, আমিও তো, হেই সুন্দরীর পায়ে পড়তে চাই, পড়িও, তবু তো দেখা পাই না তার।
সে নাকি আবার কবির জীবন-দেবতা।এসব বুঝতে গেলে মনে হয় আমার মাথাটা আউলা-ঝাউলার এক কাকের বাসা।
মনটাও কেমন যেন শূন্যতার গিরিখাদ হয়ে পড়ে, পড়িমরি করে আলোক-লতায় সোনারঙ রহস্যকলি ফোটাতে চায় মন, কিন্তুপারি কই?
রবি ঠাকুরের সময়কাল আর আমার ফেইসবুকের টাইম কি এক হইবো কোনোকালে। উনার সময়ে তো প্রযুক্তির এতো ধারারডিস্টার্ভবেন্স ছিলো না। মার্ক জাকারবার্গের মতো সময় খাদক কেউ ছিলো না। উপরন্তু সামাজিক নেটওয়ার্কিং পরিষেবার নাম কতযে উঁইপোকা, তার কি শেষ আছে কোনো!
ঠাকুরের সামনে ছিলো এক কালিদাস তাও তো সে সংস্কৃত ভাষার কবি।
আরো পরে আসে তপসে মাছ নিয়ে ইয়ার্কিমারা ঈশ্বরগুপ্ত, রোমান্টিসিজমে ডুবে থাকা বিহারীলাল চক্রবর্তী।
চক্রবর্তী সাহেবও কি কম যান?
কি সব অদ্ভুত কথা কবিতা নামে চালিয়ে গেছেন, “না বুঝিয়া থাকা ভালো, বুঝিলেই নেভে আলো”।
কও তো দেখি, এসব কি কবিতা বলে স্বীকার করবে আজকালকার পোলাপান সকলে?
সবশেষে উপায়োন্তর না পেয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যের আধুনিক যুগের সিংহদরোজা খুলে দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
বাংলা ভাষা ছাড়াও নব্য ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে যাত্রা শুরু করেছিলেন শিল্পের পথে। খৃস্টান নারী ও ইংরেজি ভাষার প্রেমেপড়ে ধর্মান্তরিত হলেন তিনি।
নামের আগে পদবী জুড়ে দিলেন মাইকেল।
বিয়ে করলেন ইংরেজ রমনী রেবেকাকে প্রথম, টিকলো না।
দ্বিতীয়বারে হেনরিয়েটা। মৃত্যু পর্যন্তঅবশ্য ঐ মহিলা রয়ে গেছিলো তাঁর পাশেই।
প্রবাসে ফ্র্যান্সের ভার্সাই নগরের পথে পথে খেয়ে না খেয়েই কবি পের্ত্রাকের অনুসরণে প্রথম লিখলেন বাংলা সনেট। আরো পরে, বাংলা ভাষায় নিজেকে শতভাগ সমর্পন করে দিয়ে লিখলেন “বঙ্গভাষা”নামক ১৪ চরণের অজর এই সনেটটি, যা পাঠ না করলেবাংলাভাষার বিবিধ রতনরাজি ও মনি-মুক্তোর খবর অনেকেরই অজানা থেকে যেতো বৈকি!
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে ॥

এই না হলে মাইকেল! যার দেখাদেখি কবি রফিক আজাদও
মোমবাতির দু’ধারের সলতেই আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছে এক ফুঁৎকারে।
তবে মানতেই হবে যে, শতকে, হাজারে একটাই মধুসূদন জন্মেছে এই বাংলায়।তার অনুসারীও কম নয়।
তবে একথাও তো মানতে হবে, বিদ্যাসাগর মহাশয় পাশে না থাকলে প্রবাসে মধুর জীবন অনেক বেশি বিষে জর্জরিত হয়ে হারিয়েযেতো কবেই!
এযুগে কোথায় পাবো রাজা রামমোহন রায়কে অথবা মহাসাগর বিদ্যাসাগর মহাশয়কে।
আহা! কি কৌশলেই না সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদে নেমেছিলেন রামমোহন রায়। নইলে আজো পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকে এক চিতায়সহমরণের আগুনে পুড়ে পুড়ে কাঠ কয়লা হতে হতো। ভাবা যায়!
আর এক মনীষী বিদ্যাসাগর, বিধবা বিবাহ শুরু করে দিয়ে নারী-জীবনকে একাকীত্বের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করে গেছেন। নারী-বান্ধব দুই মনীষী ভাগ্যিস জন্মেছিলেন এই বাংলায়,নইলে বঙ্গললনাদের এই অগ্রগতি কি এতো সহজ হতো? মনে হয় না।
যদিও বেগম রোকেয়ার অবদান অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে তাদের।
আমাদের বাল্যকালে বিদ্যাসাগর রচিত আদর্শলিপিই ছিলো একমাত্র ভরসা। জীবনের প্রথম মূল্যবোধের শিক্ষা ও পাঠ শুরুহতো তাঁকে দিয়ে।
আর এই যুগে আমরা আছি মরণফাঁদে। না এনালোগ, না পুরোপুরি ডিজিটাল। এদিকেও না, ওদিকটাও মারাই না।
বিভ্রান্তির তন্ত্র-মন্ত্রজালে খাবি খাচ্ছি কেবলি।
শালার, এই যুগে প্রযুক্তির এতো বাড়-বাড়ন্ত যে, ফেসবুক, ওয়ার্টঅ্যাপ, ফেসটাইম, ম্যাসেঞ্জার, ইনবক্স আরো কত কি!নানা রকমঅপশন দিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধদের সারাক্ষণ বিজি রাখছে।
ভাবনার নিরিবিলি সময় কোথায় পাই?
বই-টই পড়ে যে নিজেকে লেখালেখির জন্যে তৈরী করবো, তারও উপায় নেই। পণ্ডিত গুগোল মহাশয় সব বলে দেন তৎক্ষণাৎ।ভুল শুদ্ধ যাই হোক না কেন। কেইবা তার বিচার করবে?
কাজেই ঠাকুর বাবু তো বইলাই খালাস, “
“আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে,
দৈবে হতেম দশম রত্ন নব রত্নের ভালে”।

আমার তো সেই সুবিধাও নেই। চারপাশে আছে কেবল আগাছার মতো সময়খেকো প্রযুক্তির বরপুত্রদের বসত।
প্রজারঞ্জক সেই রাজ্যও নেই, রাজাও নেই যে, আমাকে লালন পালন দেবে।
গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা আমি এক। কৃষ্ণ গহবরের কি যে ধন্ধে আছি, কি করে বোঝাই কারুকে।অতসী নামের একটি মেয়েকেপ্রাণমন দিয়ে ভালোবেসে কি পেলাম, প্রবঞ্চনা ছাড়া। মাকে রাজি করিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সামনে বছর ঘটা করে ঘরে তুলবোতাকে।
কিছুতেই রাজি হলো না। এক পর্যায়ে ধর্মের দোহাই পেরে নিজেই সটকে পড়লো। তার বাবা নাকি কিছুতেই মানবে না মুসলমানছেলের সঙ্গে তার মেয়ের এই বিজাতীয় প্রেম কিংবা বিবাহ কোনোটাই।অতসীর বাবার দুই বোনই নাকি মুসলমান ছেলেকে বিবাহকরেছে, সেই দুঃখে নিজের দুই মেয়ে, বিধবা মাকেসহ পুরো পরিবার নিয়ে দেশান্তর হয়েছে সে।কাজেই বাবার মনে দুঃখ বাড়াতে চায়না মেয়েরা তার।
বাহ্, বেশ ভালো কথা। সে কথা প্রেমের সূচনালগ্নে বললেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো। দু’বছর সম্পর্কটাকে টেনেটুনে এনে তারপরমনে পড়লো, বাপে মনে দুঃখ পাইবে।
আ হা হা প্রেম!
কিচ্ছুটি বলার নেই আর। ভালোই আছি একাকী জীবনে।প্রেম ট্রেম নিয়ে কোনো ভাবনা রেখাপাত করে না মনে।
তবে, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প-মণ্ডিত ঘৃণার গোলা যখন ছুটতে থাকে, এই ক্ষুদ্র আমার শরীরমনেও তা স্পর্শ করে বৈকি!
মনে হয়, যুদ্ধের জন্যে ভেতরে ভেতরে গুড়ে পাক দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ।উথাল-পাতাল বাতাসে তার গন্ধ পাই আজকাল।
শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় গোপনে অগোপনে তৈরী হচ্ছে বায়ুঅস্ত্র যেন তিল-তিসির নাড়ু-মোয়া শিশু অহম সোনাদের হাতে হাতে।
এরমধ্যে প্রতিবেশি চীনকে তার উত্থানের মাশুল গুনতে হচ্ছে। বড়র চেয়ে বড় হতে চাওয়া কি দুঃসাহস নয়?
যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় খড়গ উঁচু করে ধরে তো আছেই সেই ধর্মান্ধেরা।লক্ষ্য তো একই বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে সকলের।
ক্ষমতা, ক্ষমতা,ক্ষমতা!!!
এই লক্ষ্য অর্জনে ক্ষমতালিপ্সুরা পথ চলতে গিয়ে যখন উপলক্ষ্যের ঘাটে এসে খেই হারিয়ে ফেলে, তখন গোলমেলে সময়অসময়ের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে। আমাদের মতো উলু-খাগড়ার জীবন যায় যায় দশা। তখন মুসলমানদের কেয়ামতেরহালহকিকত আসমান জুড়ে তড়পায়।ইহুদীরা আনন্দে ডুগডুগি বাজায়, খৃস্টানেরা মনে করে আমরা পৃথিবীর রাজা, জনসংখ্যায়আমরাই প্রথম। মুসলমানেরা দ্বিতীয়, তাতে কি?
ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায় তো আমাদের পক্ষেই। শালার সৌদি মুসলমান বুঝে হোক, না বুঝে হোক আজো আমাদের ধ্বজা ধরেআছে। কাজেই কুছ পরোয়া নেহি, পৃথিবীকে শায়েস্তা করা ২/১ মিনিটের কাজ মাত্র। এরকম এক পৃথিবীতে কি করে আনন্দেথাকবো।
যদিও পৃথিবীর আদিম সভ্যতার মূলেও রোপিত হয়ে আছে ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব পারাবাত। কাজেই, একথা খুব ভালো করেই জানিযে, সভ্যতার শুরু থেকে শেষে পর্যন্ত একই চিত্রকল্প দেখে যেতে হবে দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি।
অস্থির, অসুস্থ, প্রতিযোগিতামূলক এই সময়ে শিল্প, সাহিত্য, ব্যক্তিগত প্রেম কিছুতেই মনের সায় পায় না নয়াদীপ।
মাঝে মধ্যে সঙ্গীতের সুরে ডুবে গিয়ে , ভুলে থাকতে চায় তার অতীত বর্তমান অনিশ্চিত ভবিতব্যের সবকিছু। সবার আগেনয়াদীপ ভুলে যেতে চায় তার নাম, পদবী এবং লিঙ্গ পরিচয়।
কি করে তা সম্ভব?
তারও গবেষণা হওয়া খুব জরুরী বৈকি?

এভাবে ভাবতে ভাবতে নয়াদীপ ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়। মায়ের ডাকে খুব ভোর-সকালে ঘুম ভাঙ্গে তার অকস্মাৎ। চোখ কচলেচোখে গেথে নেয় আরো একটি দিনের সূর্যালোক।গায়ের কম্বল সরিয়ে বিছানা ছেড়ে সে দাঁড়ায় এসে জানালার পাশে।
এইটুকু তার পৃথিবী।