মানিকরতন শর্মার অণুগল্প

জানালার ওপারে
মামার কোলে বসে আছে অর্ণিশ। থেমে থেমে কেঁদে যাচ্ছে সে। পাশের সিটটা খালি হলে অর্ণিশকে বসিয়ে দিল মামা। জানালা দিয়ে অর্ণিশ দেখছে পাখি, গাছ, নদী, মেঘ, আকাশ কেবল ছুটে যাচ্ছে দ্রুত। রেল গাড়িটা ঝমাঝম শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে এসব দেখতে গিয়ে তার বুকের কষ্টগুলো যেন আরো বেড়ে যায়। হঠাৎ মামার শাসনে কান্নার শব্দ থামিয়ে দেয় সে। কিন্তু বুক ভেঙে দুচোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। মা-বাবাকে ছেড়ে আট বছরের অর্ণিশ মামার বাড়ি যাচ্ছে পড়াশোনা করতে। বাড়িতে গিয়েও রাতে মা-বাবার কথা মনে করে চুপিচুপি কান্নায় বালিশ ভিজিয়েছে সে। এমন নীলকষ্টের কথা বলতে পারে না। ভেজা চোখ কোমল হাত দিয়ে মুছে নেয়। এভাবে সতেরোটি বছর পাড় করল অর্ণিশ।
অর্ণিশের ভাবনার ভুবনটা বিনির্মাণ করে ছিল তার দাদু। তিনি অর্ণিশকে দর্শন আর মানবপ্রেমের অনুষঙ্গ সূত্রগুলো কাজের ফাঁকেফাঁকে ধরিয়ে দিতেন। কলেজে পা দেবার কদিন আগে হঠাৎ চিরতরে চলে গেলেন তিনি। ভেঙে পড়ে অর্ণিশ। স্মৃতিগুলো জ্বলে ওঠে বুকের তেপান্তরে। বাড়ি ফিরতে গিয়ে রেলে চড়ে সে। জানালার ওপারে ছুটে চলা দৃশ্যগুলোর মাঝে দাদুর মুখ ও কথাবদ্ধ জীবনকে খোঁজতে থাকে। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে। কষ্টগুলো কেবল ঝাঁপসা হয়ে আসে। জানালা তাঁর বুকের উদাসী ভাবনাকে যেন উসকে দেয়।
একদিন কলেজ কুড়িডোরে দেখা হল বিমুগ্ধার সাথে। দুটো বছর মজে ছিল ওরা। একে অপরের মনের চোখে বসবাস করেছে পাখির নীড়ের মতো। হঠাৎ একদিন সূর্যগ্রাসের থাবায় বিমূঢ় হল অর্ণিশ। বুকের গহীনে চড়ে বসল বজ্রাশ্রয়ী কালো মেঘ। বিমুগ্ধা চেয়েছিল অর্ণিশকে। কিন্তু অর্ণিশের সময়টা ছিল বিক্ষুব্ধ। একদিন খুব সকালে অর্ণিশ বাসে চড়ে রওনা হয় নতুন দিগন্তে। বিরহ কষ্টগুলো জানালার ওপারে বাতাসের শরীরে কেবল মিশে যায়। আর তাকিয়ে দেখে একটা শাদা বক একা ওড়ে যাচ্ছে অফুরন্ত আকাশে।
ধূসর ফ্রেম
একাধিক কলের পর শেষে ঘুরাল অনন্দিতা। অপর প্রান্তে হতবাক বিনম্র। সেই কণ্ঠস্বর! সেই মাদকতা! পুরো সত্তায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। দীর্ঘ বত্রিশ বছর পর কথার ধ্বনি। স্বপ্নময় মনে হল তার। কলেজ ভূমিতে সেই স্মৃতিমুগ্ধতা।
বর্তমানে কে কাকে মনে রাখে, স্বার্থের ঘানিতে। দ্রুত ছুটে চলে আবর্তিত সংসার। আজকাল ঝরাপাতার মতো কেউ কাউকে মনে রাখে না।
পরিবারের সুখ-দুঃখ সন্তানের বেড়ে ওঠার রুটিনে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অনন্দিতা। কিন্তু ভুলেনি সে। বিনম্নের সেই চেনা মুখ, চোখের সেই অপলক মুগ্ধতা ভুলে যায় নি। যতই রাজসিক বৈভব ছুঁয়ে যাক তাকে। বিনম্রকে লুকিয়ে রেখেছে আপন গহ্বরে । আগলে রেখেছে গভীর মৌনতায় বিনম্রও।
দুটো বর্ণ বিভাজনের কারণে মিলন হয়নি ওদের। তাই বলে হারিয়ে যায় নি সেই প্রেমানুভূতির শ্বাস।
বয়স কিন্তু পেরিয়ে গেছে। নদীর জলে সূর্য ডুবার আভা ছড়িয়েছে অনেকÑবলেছে অনন্দিতা।
– তাতে কি ! মন তো এখনো নীলাকাশের পাখি। যেমনটি মজে ছিলেন রবি বাবুও।
-তুমি কী আজ রবি বাবু হবে!
-হতে দোষ কী।
সেই শেষ কল। আর ফিরে আসেনি তার কণ্ঠস্বর। অপেক্ষায় থেকেছে বিনম্র। ভাবে অপ্রাপ্তির মাঝেও প্রাপ্তি আছে। না দেখার মাঝেও দেখা আছে।
এখনো ঘুমাও নি ! এইটিই ছিল শেষ মেসেস অনন্দিতার।
একটু কাত হয়ে শুন। ইনজেকশন দিতে হবে, বললেন নার্স।
কতগুলো চেনা-অচেনা যন্ত্রণায় চোখ বুঝে সুঁচের ঘা নেয় বিনম্র।
একদিন
একদিন বিকালে প্রফেসরের অফিস রুমে বেশক’জন বন্ধু আসে। সাহেবী পোশাকে টেবিলের চারপাশে বসে আছে ওরা। একজন বলছে, জানিস অনুপ্রাস এখন ঝালকাটির ডিস্টিক জজ; গত পরশু আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে। আরেকজন বলছে, হুমায়ুন জানিস কোথায় আছে? অন্যজন বলে ওঠে, ওতো শুনেছি জার্মানির কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। রাকেশ বলে, আমাদের ব্যাচের শুভপ্রদা এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আছে।
আড্ডার এক কোণায় দাঁড়িয়ে তাদের কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল পিয়ন রহমত।
সকালের কঁচি রোদে হাতে কাচি আর পিঠে ঝুকুন নিয়ে বন্দে যায় নিলু। তখন কিবা বয়স! এই বারো তেরোতেই কবিতা লেখা শুরু করে সে। ধানের ক্ষেতে, কখনো পাখির বাসায়, কখনো পুকুরের জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরা, কখনো কাটা ঘুড়ির পেছন পেছন দমবন্ধ দৌঁড়; এসবের মাঝে ছন্দ খোঁজতে থাকে নিলু। প্রকাশও পেতে থাকে কাগজের পাতায়। তাঁর কবিতা বেতারেও কণ্ঠ মিলায় শিশুরা। সোনারোদ গা দিয়ে কবিতার পেছনে হাঁটতে গিয়ে নিলু আর অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা জজ হতে পারেনি।
রহমত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে আমাদের নিলু এখন বেঘোর সংসারী হয়েছে। ধান ফড়িং আর প্রজাপতির ভাষা খোঁজতে গিয়ে একদিন শুধু জীবনানন্দ দাশ হতে চেয়েছিল সে।