প্রবন্ধ: রাঢ়-বাংলার কবিগান

প্রবন্ধ: রাঢ়-বাংলার কবিগান

রাঢ়-বাংলার কবিগান
সৌম্য ঘোষ

গ্রামবাংলা থেকে উদ্ভূত কবিগান একসময় বিশেষ করে অষ্টাদশ ঊনিশ শতকে নগর কলকাতার জমিদার ও বণিকমহলের খুবই আদৃত ছিল। রাতের মেহফিলে ঢোল-কাঁসি নিনাদিত আদিরসাত্মক আর উত্তেজক এই গানের লড়াই দারুণ জমে উঠেছিল। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যুগ শুরু। কবিগান আবার যথারীতি গ্রামে ফিরে আসে। আজও রাঢ়-বাংলার গ্রামীণ মানুষের অন্যতম বিনোদন এই কবিগান।

কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গায়ককে কবি হতে হয়। তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান পরিবেশনকারীদের বলা হয় কবিয়াল।
কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন “কবিয়াল” বা “সরকার”। তার সহকারী গায়কদের বলা হয় “দোহার”। এঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুনরাবৃত্তি করেন।কবিগান শুরু হয় “বন্দনা” বা “গুরুদেবের গীত”-এর মাধ্যমে। “বন্দনা” অংশটি সরস্বতী, গণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এটি কবিয়াল যেমন উপযুক্ত করেন, তেমনভাবে গান। এরপর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়। এটিকে কেউ কেউ “আগমনী” বলেন। এরপর চারটি বিষয়ভিত্তিক গান গাওয়া হয় —- “সখী সংবাদ”, “বিরহ”, “লহর” ও “খেউড়”। তারপর প্রতিযোগিতামূলক অংশটি শুরু হয়। কবিগানের আসরে এই অংশটিকে “কবির লড়াই”-ও বলা হয়। এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান বেঁধে অপর গীতিকার-সুরকারকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।
বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় মিশ্ররীতির নাটকীয় লোকসঙ্গীত কবির লড়াই বা কবিগান। দুজন পাল্লাদার বা কবিয়ালের সক্রিয় অংশগ্রহণে মূলতঃ রামায়ণ মহাভারত বিবিধ পুরাণ মঙ্গলকাব্য বা হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্রের অন্তর্গত দুটি চরিত্রের উপস্থাপনায় নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জমে ওঠে কবির লড়াই বা পালাগান। বন্দনাগান ছড়া পাঁচালিগান পয়ারকাটা চুটকিগল্প আর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কবিগান প্রাণবন্ত। আর পাঁচটা লোকআঙ্গিক লুপ্ত বা বিলীয়মান হলেও কবিগান এখনও টিকে রয়েছে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এ গান পুরোপুরি পেশানির্ভর। মাটি ও মানুষের গান। দর্শক বা শ্রোতারা হলেন গ্রামীণ খেটে খাওয়া আপামর হিন্দু-মুসলমান।

কবিগানের উৎস-উদ্ভবকাল নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেছেন কবিগানের জন্ম হয়েছে প্রাচীন যাত্রা থেকে। কারো মতে প্রাচীন ঝুমুরগান। কেউ বা বলেছেন প্রাচীন পাঞ্চালিকাসাহিত্য থেকে এই লোক-আঙ্গিকের উদ্ভব। কবিগান মানেই দুটিপক্ষের ঠোকাঠুকি। ঢোল-কাঁসি দোহারের সঙ্গতে বাঁধা আসরে দুই ওস্তাদের ছড়াকাটাকাটি এবং চাপান উতোর অর্থাৎ প্রশ্ন ও জবাবি গানের লড়াই।

সজনীকান্ত দাস তার
‘বাংলার কবিগান’ গ্রন্থে লেখেন, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন সাংগীতিক ধারার মিলনে কবিগানের জন্ম। এই ধারাগুলির নাম বহু বিচিত্র – তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও ড. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতনামা সাহিত্য গবেষকগণ কবিগান নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন।

ড. সুশীল কুমার দের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কবিওয়ালাদের প্রকৃত বিকাশকাল হল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়। এই সময় বাংলা কাব্যের ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক উপাদানগুলি ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছিল। বাংলা কাব্যও বৈষ্ণব কবিতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব এই বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল নব্য কবিগান এবং পাঁচালি গান কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে কলকাতায় কবিগানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও গ্রামবাংলায় এর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র কমেনি।

“ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।
ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই।।
কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।
উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম।।
রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।
নোয়াখালির নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই।।
দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।
পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি।।
বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগণার গোপ।
গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র-বংশলোপ।।
হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল।
ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরি হরি বোল।”
−———– ভোলা ময়রা

রবীন্দ্রনাথ ‘কবিসঙ্গীত’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন—- প্রথমে নিয়ম ছিল দুই প্রতিপক্ষ দল পূর্ব থেকে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর-প্রত্যুত্তর লিখে আনতেন। পরবর্তীকালে আসর করে দুজন কবিয়াল পরস্পর বাগযুদ্ধে কবির লড়াই জমিয়ে দিতেন। তিনি লিখেছেন — “কথার কৌশল, অনুপ্রাসের ছটা, এবং উপস্থিত মতো জবাব ছিল কবিগানের মুখ্য আকর্ষণ।” হারজিত যতক্ষণ না নিষ্পন্ন হত ততক্ষণ চলত গানের লড়াই। এমনকি তিনরাত্রি পর্যন্ত গড়িয়ে যেত কবির লড়াই।

ঊনিশ শতকে কবিগানের বিষয়বস্তু বলতে গুরুদেবের গান অর্থাৎ বন্দনাংশ, সখিসংবাদ ও বিরহমূলক গান। এছাড়া যুক্ত হয়েছিল ভবানীবিষয়ক লহর ও খেউড় গান। কবিগানে পড়েছিল ক্রমশ মার্গসঙ্গীতের প্রভাব। গবেষকদের মতে পূর্ণাঙ্গ কবিগানের পালায় দশটি বিভাগ ছিল যথা – চিতেন পরচিতেন ফুকা মেলতা মহড়া শওয়ারি খাদ দ্বিতীয়মহড়া দ্বিতীয়ফুকা ও অন্তরা। কবিগান সম্পর্কে শিক্ষিতজনের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দশজন কবিয়ালদের জীবনী ও ২৭০টি গান সংগ্রহ করেন। প্রথমযুগের কবিয়ালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গোঁজলা গুঁই, হরু ঠাকুর, রাসু, নিত্যানন্দ দাস, কেষ্টা মুচি, এন্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা, রাম বসু, আকাবাঈ প্রমুখ।
মুখে মুখে রচিত হতো কবিগান যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রোতাদেরকে চমক লাগানো ও মনঃসংযোগের লক্ষ্যে এতে শব্দ-ব্যবহারের কলা-কৌশলও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

একই শব্দ একাধিকবার অল্প ব্যবধান বা ব্যবধান ছাড়াই ব্যবহার করে ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টি করা।
একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা।
ছন্দভঙ্গির পরিবর্তন করা।

একাধিক সংখ্যক কবিয়াল বা কবিওয়ালা জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে কেবলমাত্র বীরভূম জেলাতেই শ তিনেক খ্যাতনামা কবিয়াল বিদ্যমান ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল ছিলেন গোঁজলা গুঁই (আনু. ১৭০৪ – ?)। তার রচিত একটিমাত্র গান ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। খুব সম্ভবত তিনি পেশাদার কবির দল গঠন করতে পেরেছিলেন। টপ্পা রীতিতে ও টিকারা-সংগীতে কবিগান করতেন। তার শিষ্য লালু–নন্দলাল, কেষ্টা মুচি, রঘুনাথ দাস ও রামজি থেকেই অষ্টাদশ শতাব্দী এবং পরবর্তীতে বিখ্যাত কবিয়ালদের উদ্ভব হয়। শোনা যায় রঘুনাথ দাস দাঁড়া-কবির প্রবর্তক। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিখ্যাত কবিয়ালরা ছিলেন হরু ঠাকুর (১৭৪৯–১৮২৪), নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১), রাম বসু (কবিয়াল) (১৭৮৬–১৮২৮), ভোলা ময়রা ও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও ভবানী বণিক।

মুর্শিদাবাদ জেলার জনপ্রিয় কবিয়ালরা হলেন গুমানি লম্বোদর, জানকি রায়, কিশোরী কোঁড়া, কাঞ্চন মণ্ডল প্রমুখ। বীরভূম জেলার অন্যতম কবিয়াল হলেন কেনারাম মোদক, শিবশংকর পাল, জ্ঞান সাহা। নদিয়া জেলার অন্যতম কবিয়াল হলেন নৈরুদ্দিউন, গৌতম হাজরা, হারাধন দে, মুকুল ভট্টাচার্যরা। বর্ধমান জেলার কবিয়ালরা হলেন সাহেবজান, চাঁদ মুহম্মদ, মধুসূদন ঘোষাল, সনৎ বিশ্বাস, দিলীপ চ্যাটার্জি, সুবিকাশ ব্যানার্জি, সুভাষ মণ্ডল, শুভাশিস ব্যানার্জি প্রমুখরা। বাঁকুড়ার জনপ্রিয় কবিয়াল গণেশ ভট্টাচার্য। দেশ বিদেশে সমানভাবে তিনি আদৃত। পূর্ববঙ্গের ঘরানার অন্যতম লব্ধ-প্রতিষ্ঠ কবিয়াল অসীম সরকার, প্রভাত সরকার, সজল সরকার আদিত্য সিংহরা।
চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন কবিয়াল।
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের কবিয়ালরা হলেন বলহরি দে (১৭৪৩–১৮৪৯), শম্ভুনাথ মণ্ডল (১৭৭৩-১৮৩৩), তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৫–১৯১৪), রমেশচন্দ্র শীল (১৮৭৭–১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২–১৯৭৪), বিনয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩–১৯৮৫), স্বরূপেন্দু সরকার (১৯৩৩-২০০৯) এবং গৌতম মজুমদার (১৯৭৪-২০১৯) সাতু রায়, ঠাকুরদাস চক্রবর্তী।

“যার গম্ভীর ওঁকারে হুংকার শুনি
কাঁপায়ে মেদিনী প্রাণ,
যার স্নিগ্ধ ঝংকার সুললিত স্বরে
পশুপাখি ধরে তান,
সেই কবীন্দ্র রবীন্দ্র ভারতের চন্দ্র
স্বয়ং যেথায় অধিষ্ঠান,
সেথায় আমি কি গাহিবো গান?”

_____ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই কবিগান শুনিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের প্রখ্যাত কিংবদন্তি কবিয়াল শেখ গুমানি দেওয়ান। ভোলা ময়রা পরবর্তী যুগে গুমানি সাহেব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গীয় কবিগানের ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিয়াল। কবিগুরুকে কবিগান শোনানোর সৌভাগ্য একবার তার হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কাব্য জগতের মহীরুহের সম্মুখে তিনি উচ্চকণ্ঠে এই কবিগান গেয়েছিলেন।

কিন্তু কবিগান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি কালি-কলম ব্যবহার করেননি। ১৩০২ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় তিনি কবিগানকে ‘নষ্ট পরমায়ু’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর “লোকসাহিত্য” গ্রন্থে “কবি সংগীত’ প্রবন্ধে কবিগান বিষয়ে এরূপ সমালোচনা উল্লিখিত আছে। সম্ভবত তিনি কদাচিৎ কবিগান শুনেছেন বা দেখেছেন, যেটি ছিল খেউড়তুল্য অশ্লীল। জনগণের কথা ব্যতিরেকে অর্থ প্রাচুর্যে মদমত্ত বণিক শ্রেণীর বিলাসী মনকে আনন্দ দিতে কদর্যভাবে ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন তৎকালীন সিংহভাগ কবিয়াল গান। কবিগানের ভাব ও ভাষার প্রতি কটাক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন —– ” কবির দলের গানে অনেক স্থলে অনুপ্রাস, ভাব-ভাষা এমনকি ব্যাকরণকে ঠেলিয়া ফেলিয়া তাদের নিকট প্রগলভতা প্রকাশ করিতে অগ্রসর হয়। অথচ তার যথার্থ কোন নৈপুণ্য নাই, কারণ তাহাতেই ছন্দোবদ্ধ অথবা কোন নিয়ম রক্ষা করিয়াই চলিতে হয় না।”
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথের এই কটাক্ষ মেনে নেননি। এর সমালোচনার উত্তরে তিনি বলেন —-
” ভারতচন্দ্রের পর যখন রাজসভায় পণ্ডিতবর্গের প্রশংসার গন্ডি ছাড়াইয়া বঙ্গভাষা জনসাধারণের দুয়ারের উপস্থিত হইল তখন সংস্কৃতের তোড়জোড় ও আসবাব তাহাকে কতকটা ছাড়িয়া আসিতে হইল। কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেক সংস্কৃত শব্দ বঙ্গভাষায় ঢুকিয়া পড়িয়াছিল, সুতরাং জনসাধারণের ভাষা তখন ময়নামতির গানের ভাষার মতো একেবারে পাড়াগেঁয়ে রকমের ছিল না।” কবিয়ালদের অনুপ্রাস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—– “সংগীত যখন বর্বর অবস্থায় থাকে তখন তাহাতে রাগরাগিণীর যতই প্রভাব থাক তাল প্রয়োগের খচমচ কোলাহল যথেষ্ট থাকে। সুরের অপেক্ষায় সেই ঘন ঘন সশব্দ আঘাতে অশিক্ষিত চিত্ত সহজে মাতিয়া ওঠে। একশ্রেণীর কবিতার অনুপ্রাস সেইরূপ ক্ষণিক ত্বরিত সহজ উত্তেজনার ফল। সাধারণ লোকের কর্ণ এত শীঘ্রই আকর্ষণ করিবার এমন সুলভ উপায় আর নাই।” কবিগুরুর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বলেছিলেন —— “এই শ্রেনীর লেখকদের ভাষা আলোচনা করলে এই অনুপ্রাসের সম্বন্ধে অনেক কথা পরিষ্কার হইবে। আমি এ কথা বলিতেছি না যে সর্বত্রই অনুপ্রাস গুলি উচ্চাঙ্গের কবিত্ব সূচক হইয়াছে, কিন্তু বহু স্থানে যে ভাষার শ্রীবৃদ্ধি করিয়াছে তাতে সন্দেহ নাই। অনেক সময় সেগুলি এরূপ সহজ হয়ে আসিয়াছে যে কবি সেগুলি কোন চেষ্টা করিয়া আনেন নাই, তাহা অনুপ্রাস বলিয়া চোখে থাকিবে না অথচ সেগুলি ভাষার লালিত্য বাড়াইয়া দিয়াছে।”
তবে কবিগানের নিন্দা করলেও কবিয়ালদের জন্ম,কর্ম ও শিক্ষার প্রতিকূল পরিবেশের কথা রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন, এক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সহমর্মিতা। তিনি বলেছেন —– “আমি যদি পল্লী কৃষকের ঘরে জন্মাতাম, কিংবা মাঝি, মালো, কর্মকার বা তন্তুবায়ের ঘরে, আর আমার যদি থাকতো সহজাত কবিত্বশক্তি, তাহলে আমি বড়জোড় একটা কীর্তনের বা পাঁচালী দল খুলতাম অথবা কবিয়াল রূপে গ্রামে গ্রামে গাওনা করে বেড়াতাম। সমাজের প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিহত হয়ে আমার এর চেয়ে বেশি হওয়ার কিছু সম্ভাবনা থাকতো না। আমি জানি অনেক সম্ভাবনতার কুঁড়িই এভাবে অকালে ঝরে যায়, যেগুলি ফুল হতে পারে না এবং দেখেছি তেমন দু’দশ জন।”
যাইহোক, কবিগুরুর কবিগান বিষয়ক সমালোচনা অনেক পণ্ডিত গবেষকগণ স্বীকার করেননি। তবে এ কথা ঠিক যে, কবিগান যদি শুধু মনোরঞ্জন করত এবং মনোরঞ্জনের পথে পা বাড়াতে দ্বিধা না করতো তাহলে কবিগানের অস্তিত্ব আজ আর খুঁজে পাওয়া যেত না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেই বলতে দ্বিধা নেই তার মন্তব্য করা “নষ্ট পরমায়ু” কবিগান আজও হেলেদুলে গ্রামবাংলার মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে এবং তাদের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বকবির শংসাপত্র না পেলেও কবিয়ালদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি বৃদ্ধি হয় নাই। গ্রাম গঞ্জের বিশাল জনমানুষে এদের অস্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা আজও সর্বোপরি উজ্জ্বল।

বালিকা বধূ নামে এক বাংলা চলচ্চিত্রে চারণকবি মুকুন্দ দাসের চরিত্রটি চিত্রিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুকুন্দ দাসের গান কিভাবে জনসাধারণকে প্রভাবিত করেছিল, তাও এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।

এক বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন জন্মসূত্রে পর্তুগিজ। তার জীবনী অবলম্বনে দুটি জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। একটি ছবিতে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি অভিনেতা উত্তম কুমার। অপর ছবিটির নাম ‘জাতিস্মর’, তাতে কবিয়াল এন্টনির ভূমিকায় ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কবিয়াল ভোলা ময়রা গায়ক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তার গানে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে থাকত। এই জাতীয় জনপ্রিয় বিনোদন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভোলা ময়রার বিশেষ প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের।”এঁনার জীবন অবলম্বনেও ভোলা ময়রা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
বর্তমানে কবিগান পুরোপুরি মৌখিক। বিষয়বস্তুতে এসেছে পরিবর্তন। পুরাণ সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক রাজনীতি ও ক্যারিকেচার পালার অন্যতম বিষয়বস্তু। কয়েকটি জনপ্রিয় পালা হল কৃষ্ণ-দুর্যোধন রাম-রাবণ কৃষ্ণ-গান্ধারী শাক্ত-বৈষ্ণব চাঁদ-মনসা বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ সেকাল-একাল কংগ্রেস-সিপিএম হিন্দু-মুসলমান ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি। বর্তমানে আবার জনকল্যাণ মূলক সরকারি প্রকল্পের বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে কবিগান হচ্ছে যেমন কন্যাশ্রী, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, সাক্ষরতা ইত্যাদি। তবে গ্রাম-বাঙলায় পেশাদারি কবিগান মেলা উৎসবে পূজো-আর্চায় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছানুসারে দিন বা রাতে মঞ্চস্থ হয়। গানের স্থায়িত্বকাল মোটামুটি পাঁচ থেকে ছয়ঘণ্টা। প্রতি দলে থাকেন একজন কবিয়াল ছাড়া দুজন দোহার ঢুলিদার। ইদানিং বাদ্যযন্ত্র হিসাবে হারমোনিয়াম ক্যাসিও ফুলোট বেহালাও ব্যবহৃত হচ্ছে। কবিয়ালের পোশাক সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। গলায় উত্তরীয়। দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলার তুলনায় বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, বাঁকুড়া আর মুর্শিদাবাদ জেলার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রিয় বিনোদন এই কবিগান।

বর্তমানে প্রথম পালায় বন্দনার পর সংক্ষেপে কবিগানের ইতিবৃত্ত আলোচনা করা হয়। এরপর শ্রোতারাই ঠিক করেন পালা নির্বাচনসহ কে কোন ভূমিকায় লড়াই করবেন। দুই কবিয়াল দুই দুই বা তিন তিন পালায় বিন্যস্ত করে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি প্রতিযুক্তি তত্ত্ব সাজিয়ে নিজ নিজ চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন। এইভাবেই জমে ওঠে কবির লড়াই। ছড়া চুটকি গল্প ইত্যাদির পাশাপাশি হরতালি ও টপ্পা পাঁচালি কবিগানের মূল আকর্ষণ। শেষে আবার দুই কবিয়ালের মধ্যে বোল কাটাকাটি হয় যা খানিকটা তরজাগানের মতো। এটি মূলতঃ সঙ্গীত-নাট্য। প্রচলিত বোলের পালাগুলি হলো বেদবতী-রাবণ ললিতা-কৃষ্ণ হরিশ্চন্দ্র-শৈব্যা কর্ণ-কুন্তী-বিল্লমঙ্গল-চিন্তামণি ইত্যাদি।

এখনও রাজ্যের নানা প্রান্তের গ্রামে কবিগানের আসর বসে। আগের মতো অত বেশি সংখ্যায় নয়, দর্শকদের ভিড়ও উপচে পড়ে না আর, আক্ষেপ করছিলেন মনোরঞ্জন সরকার। কবিগানের ধারাকে আজও যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মধ্যমগ্রাম-সোদপুর রোডে দক্ষিণ তালবান্দার বাসিন্দা মনোরঞ্জনবাবু ৩৫ বছর ধরে কবিগান গাইছেন। নিজেকে পরিচয় দেন লোককবি হিসেবে। তাঁর আসল পদবি বসু হলেও কবিগানের ‘সরকার’ থাকতে থাকতে এখন এটাই তাঁর পদবি হয়ে গিয়েছে।
রীতিমতো নাড়া বেঁধে শিখেছেন কবিগান। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে প্রথম নিশিবাবু, রসিকবাবুর কবিগান শোনেন মনোরঞ্জন। তারপর বেলঘরিয়ার নিমতায় সুরেন্দ্রনাথ সরকারের কাছে নাড়া বাঁধেন। সেখানেই আলাপ হয় দোহার কালাকেষ্টর সঙ্গে। এরপর বাংলাদেশে গিয়ে খুলনা ও গোপালগঞ্জে কালিদাস সরকারে কাছে ১২ বছর তালিম নেন। কবিয়াল মনোরঞ্জনবাবুর একটি দলও আছে। স্ত্রী কানন বসুও সেই দলের সদস্যা। মহারাষ্ট্র, বিহার, দিল্লি, ওড়িশা, বৃন্দাবন, উত্তরাখণ্ড, নৈনিতাল, ত্রিপুরা এমনকী বাংলাদেশেও তিনি কবিগান করেছেন।
প্রৌঢ় মনোরঞ্জনবাবুর আক্ষেপ, “শহরাঞ্চলে আসরের জন্য মাঠ পাওয়া যায় না। আর শহরের ব্যস্ত মানুষ এ গান বেশিক্ষণ শুনতেও চান না। গ্রামের জনপ্রিয়তা থাকলেও, অনুষ্ঠানের সময় এখন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
কেন কমেছে কবিগানের জনপ্রিয়তা? মনোরঞ্জনবাবু জানান, ‘‘কবিগানের পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গীয় দুটি ধারা। পশ্চিমবঙ্গীয় ধারা কলকাতার বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে। সেই ধারায় কবিগানের আসরে ব্যক্তিকুৎসা, ব্যক্তিগত আক্রমণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি পূর্ববঙ্গীয় ধারায় প্রধানত লোকসংস্কৃতি, লোকাচার, সামাজিকতা ও শিক্ষামূলক বিষয়ের উপরে গান বাঁধা হত। ফলে পূর্ববঙ্গীয় ধারার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কমেছে।”
এখন যে কবিগান শোনা যায়, সেটাও পূর্ববঙ্গীয় ধারার সংশোধিত রূপ বলে মনে করেন মনোরঞ্জনবাবু। পূর্ববঙ্গের কবিয়ালদের হাত ধরে সেই ধারা বিকাশলাভ করে ও পরে তারক গোঁসাই তার সংস্কার করেন। সেই ধারার ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছেন বেথুয়াডহরির অমূল্য সরকার, বেলঘরিয়ার সুরেন্দ্রনাথ সরকার, সাতগাছিয়ার শ্রীনিবাস সরকার, ঠাকুরনগরের নারায়ণ বালা, প্রমুখ শিল্পী। বাংলাদেশের বাগেরহাট নিবাসী রাজেন্দ্র সরকার বা পাগল রাজেনকে এখনও কবিসম্রাট বলা হয়।
তবে বাংলার সংস্কৃতির মূলস্রোত থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে কবিগান। বাংলার পুরনো দিনের গান নিয়ে গবেষণা করেন দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি, এঁদের কবিত্বশক্তি ছিল। অ্যান্টনি প্রথম প্রথম অন্যকে দিয়ে গান বাঁধাত। পরে নিজেই লিখত গান। কবিদের লড়াই খেউড়ের অঙ্গ ছিল না, তাঁরা পরস্পরকে আক্রমণ করতেন রামায়ণ, মহাভারত, সংস্কৃত সাহিত্যের ভিত্তিতে।” তাঁর আক্ষেপ, অনেকেই তরজা আর কবিগানের তফাত বোঝেন না। ফিল্ম-নাটকে কবিগানের নামে তরজা বা খেউড় চলে।
কী ভাবে হয় কবিগান? কবিয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সঙ্গতকারী ও দোহাররা বসে থাকেন। কবিয়াল উঠে দাঁড়িয়ে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলে শুরু করেন গান। গান শুরু হয় মূলত ‘বন্দনা’ দিয়ে। দু’জন কবিয়াল থাকলে জমে ওঠে গানের লড়াই। তবে এর জন্য দরকার দীর্ঘদিনের তালিম। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্রপাঠ ও নানান বিষয়ে পড়াশোনা আর কাব্যপ্রতিভার দরকার হয়। পাশাপাশি শিখতে হয় মঞ্চ উপস্থাপনার মতো নানা বিষয়ও। মনোরঞ্জনবাবুর মতো অভিজ্ঞ কবিয়ালরা মাঝে মাঝে কর্মশালা করেন। কবিগানের মরসুম হল দুর্গাপুজো থেকে বৈশাখ মাস। মরসুমে ১০০-১১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করেন তাঁরা। অনুষ্ঠানপিছু ৮-১২ হাজার টাকার
বায়না হয়।
কবিগানের প্রসারের জন্য ২০০৬ সালে রাজ্যের তৎকালীন অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসের উদ্যোগে বনগাঁয় তৈরি করা হয়েছে কবিগান অ্যাকাডেমি। সেখানে বিভিন্ন শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হয়। উপেনবাবু বলেন, “কবিগানকে সমৃদ্ধ করতে এবং ভারত-বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে একে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।” অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বনগাঁতে যে কবিগান অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছে সেখানে কী পড়ানো হবে তার পাঠক্রম তৈরির কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ওখানে কবিগান নিয়ে গবেষণারও ব্যবস্থা রয়েছে। উপেনবাবু বলেন, “শিক্ষিত কবিয়ালরা সঠিকভাবে বিষয়বস্তু নির্বাচন করে গান গাইলে শহরের মানুষও ফের কবিগান শুনবেন বলেই আমরা মনে করি।” কবিগান নিয়ে ফের উৎসাহ জাগায় কিনা, এখন তা-ই দেখার।

তথ্যঋণ: –
(১) “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য”— ড: দীনেশচন্দ্র সেন।
(২) “কবিগান”—-দীপক বিশ্বাস।
(৩) বাদল দিনের কদম ফুল—- বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি।
(৪) রাঢ়-বাংলার কবিগান — স্বপনকুমার ঠাকুর / ভিরাসত আর্ট পাব্লিকেশন।