প্রবন্ধ: ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক জেমস জয়েস

প্রবন্ধ: ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক জেমস জয়েস

ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক জেমস জয়েস
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

“If Socrates leaves his house today he will find the sage seated on his doorstep. If Judas go forth tonight it is to Judas his steps will tend. Every life is many days, day after day. We walk through ourselves, meeting robbers, ghosts, giants, old men, young men, wives, widows, brothers-in-law. But always meeting ourselves.” – James Joyce, ‘Ulysses’

মানুষ পূর্ণদৃষ্টিতে দেখলে বস্তুর বাহ্যিক আকার ও বহির্জগতের সব প্রকাশ তার চোখে পড়ে। কিন্তু বস্তুর মৌল রূপটি শুধু পূর্ণদৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে বাস্তব দুনিয়ার ছবি সম্পূর্ণটা দেখা সম্ভব। সুতরাং বাস্তব জগতের মায়াময় রূপ ভাল করে দেখতে গেলে ভিন্নতর আলোয় অতিপ্রাকৃত দুনিয়ার সৌন্দর্যও উপলব্ধি করতে হয়। আপাদমস্তক ঋণ-দায়গ্রস্ত জন স্ট্যানিস্লাস ও রক্ষণশীল ধার্মিক মহিলা ম্যারি জেনের দশম সন্তান জেমস জয়েস শৈশবকাল থেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিও ছিল ক্ষীণ। কিন্তু সহজাত শিল্পী জয়েস ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা কখনও অনুভব করেননি। সৃষ্টির উন্মাদনায় ও ভিন্নতর চৈতন্যে ভাষাশিল্পী জয়েস অন্য জগতের রূপ নিজের ক্ষীণ দৃষ্টিতেই দেখতে পেতেন। স্থান-কালের সীমানা অতিক্রম করে তাঁর চেতনাস্রোতে বস্তুজগতের বাস্তব রূপ ও অস্তিত্ব ভেসে যেত।

আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের মনুমেন্টাল উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ আমেরিকান জার্নাল ‘দ্য লিটল রিভিউ’-তে ১৯১৮ সালের মার্চ থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল। ১৯২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে জয়েসের চল্লিশতম জন্মদিনে প্যারিসের শেক্সপীয়র এ্যান্ড কোম্পানি থেকে ‘ইউলিসিস’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, প্রকাশক আমেরিকান সিলভিয়া বিচ্। প্রথমে মুদ্রিত হয় এক হাজার কপি। প্রকাশক দু’কপি বই জয়েসের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বই হাতে পেয়েই নিজের লেখা সম্বন্ধে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ও আপোসহীন জয়েস ভুল-ত্রুটির তালিকা তৈরি করতে বসেন। ওই বছরের অক্টোবরে লন্ডনের ইগোইস্ট প্রেস ২০০০ কপি ছাপলেও নিউ ইয়র্কের পোস্ট অথরিটি বইটি আইনসিদ্ধভাবে প্রকাশ না হওয়ার কারণে ৫০০ কপি বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

‘ইউলিসিস’ প্রকাশের মুহূর্ত থেকেই বইটির প্রকাশনা বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আইনের রায় দিয়ে প্রকাশনা বন্ধ করা, অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা, বেআইনী প্রকাশনা ইত্যাদি কত না ঘটনা ঘটেছে এই বইটিকে নিয়ে। ইংরেজি ভাষাভাষি দেশে ‘ইউলিসিস’ প্রথম আইনসম্মতভাবে প্রকাশিত হয় নিউ ইয়র্কে, রান্ডম হাউস বইটি প্রকাশ করে ১৯৩৪ সালে। তার পরই বইটি আমেরিকান সাহিত্যে ইতিহাস হয়ে যায়, অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতে মামলা ওঠে। রান্ডম হাউসই মামলায় জয়ী হয়ে বইয়ের প্রকাশ অব্যাহত রাখে।

চেতনাপ্রবাহ (Stream of Covsciousness) কৌশলের সার্থক ব্যবহার জয়েসের রচনারীতির বৈশিষ্ট্য। জীবনের চরম ও প্রকৃত সত্যের অকপট নগ্ন প্রকাশেই তাঁর আনন্দ, তথাকথিত ভদ্রলোকের শূচিবায়ুগ্রস্ততায় তাঁর আপত্তি। জয়েসীয় প্রকরণরীতি সেই এপিফ্যানি, মানে মনোজগতে কল্পনায় নতুন জগত, চরিত্র ও বিষয় সৃষ্টি করে আলোড়িত করা এবং অনায়াসে স্থান-কালের সীমা ঘুচিয়ে মহাজাগতিক সময়ে উপস্থিত হওয়া সবই উপন্যাসের ট্রিটমেন্ট হিসাবে বেশ অভিনব ও জটিল। এই জয়েসীয় এপিফ্যানির ব্যবহার স্থান-কালের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে এবং সাহিত্যপাঠ শেষেও সমান আনন্দদায়ক লাগে। জয়েসীয় রীতির একটি উদাহরণ দিচ্ছি – ‘ইউলিসিসে’ ব্রোথেল প্রসঙ্গ আছে, যেখানে আকস্মিকভাবে স্টিফেন তার মৃত মা’কে নিয়ে আসে। মা ও ছেলের কথোপকথনের পর জয়েস দুটি ল্যাটিন ফ্রেস সেই ভাষাতেই লিখে দেন। এই ল্যাটিন ফ্রেস দুটি থমাস অ্যাকুইনাসের ‘Summa Contra Gentiles’ থেকে উদ্ধৃত।

জয়েস তাঁর ‘দ্য ডেড’ নামক ছোটগল্পেও এমন এপিফ্যানির প্রয়োগ করেন, যেখানে গল্পের নায়ক গ্যাব্রিয়েল তার অসুস্থ স্ত্রী-র পাশে শুয়ে তার মৃত প্রেমিককে দেখে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভিজতে। ইউলিসিস-ও একটি ছোটগল্প হয়েই জয়েসের মনে বাসা বেঁধেছিল। তখনই গল্পটি লেখা না হলেও ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ইউলিসিস নামটি তাঁর মনে থেকে যায়। আরও সাত বছর পরে ২৯ অক্টোবর ১৯২১ তারিখে তিনি বৃহদায়তন উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ লেখা শেষ করেন। এই মডার্নিস্ট উপন্যাসটি হোমারের মহকাব্য ‘ওডেসি’র সমান্তরালে গড়ে ওঠা আধুনিক সাহিত্যসৃষ্টি। ‘ইউলিলিসে’ যা কিছু ঘটেছে সবই ডাবলিন শহরের একটিমাত্র দিনের (১৬ জুন, ১৯০৪) ঘটনা। উপন্যাসটির তিনটি কেন্দ্রীয় চরিত্র হল স্টিফেন ডিডেলাস (তাঁর পূর্ববর্তী রচনা ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’-এর নায়ক), লিওপোল্ড ব্লুম (এক ইহুদি, যে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্যানভাসার) এবং তার স্ত্রী মলি ব্লুম। এই চরিত্রগুলি ‘ওডেসি’র টেলিম্যাকাস, ইউলিলিস বা ওডেসিয়াস এবং পেনিলোপির আধুনিক প্রতিরূপ। ‘ইউলিলিস’ উপন্যাসের ঘটনাগুলিও ট্রয়ের যুদ্ধের পর ওডেসিয়াস-এর ঘরে ফেরার পথে যে সব মুখ্য ঘটনা ঘটেছে মোটামুটিভাবে তারই সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে।

‘ইউলিসিস’ উপন্যাস যে দিনটিকে নিয়ে সেটি হল ১৬ জুন, ১৯০৪। কাহিনির পরিসর মাত্র ১৬ ঘন্টারও কম। অন্যতম চরিত্র লিওপোল্ড ব্লুম সে দিন সকালে তার অবিশ্বাসী স্ত্রী মলি ব্লুমের জন্য প্রাতরাশ বানাতে বানাতে নানা স্মৃতি, গল্প, দৃশ্যের সন্নিবেশে যন্ত্রণার দহন ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় এক তরম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। প্রধান চরিত্র স্টিফেন ডিডেলাস, লিওপোল্ড ব্লুম ও মলি ব্লুমের জীবনের প্রাত্যহিক ব্যস্ততার অনুপুঙ্খ বিবরণের পাশাপাশি তাদের মনোজগৎ, স্বপ্ন-কল্পনায় অভাবনীয় চেতনা-স্রোতের জটিলতা এবং স্থান-কালের সম্পর্ক মিলিয়ে এক অস্পষ্টতার ভেতর স্বচ্ছন্দ যাত্রা। কখনও কবিতার পংক্তি, কখনও নাটকের আদর্শে সংলাপ তৈরি, কখনও রোস্তোঁরায় বা বেশ্যালয়ে জীবন্ত দৃশ্যের ভেতরে দৃশ্যাতীত অবচেতনার সৃষ্টি, কখনও জাতিগত নানা তর্ক-বিতর্কে সম্পূর্ণ অপরিচিত পথে এই উপন্যাসের পথ চলা।

‘ইউলিসিস’ প্রকাশিত হলে টি এস এলিয়ট উপন্যাসটির একটি রিভিউ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল – ‘Ulysses, Order and Myth!’ রিভিউটি ডায়াল পত্রিকার নভেম্বর ১৯২৩ সংখ্যায় ছাপা হয়। এলিয়ট তাঁর রিভিউতে বলেন ‘ইউলিসিস’ হল বিশ্বসাহিত্যের এক অনবদ্য মডার্নিস্ট পিস অব আর্ট। তিনি উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেন –“The most important expression which the present age has found.” ইউলিসিসের লেখার স্টাইল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরও এক মডার্নিস্ট লিখিয়ে ভার্জিনিয়া উলফের সঙ্গে তিনিও একমত হন যে আধুনিক চেতনাকে চিত্রিত করতে একজন লেখক নতুন লেখনী পদ্ধতিকে ধারণ করতেই পারেন। এলিয়ট বলেন জয়েস তাঁর সময়ের অনেক পরের সময়কে নিয়ে ভেবেছেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন ইউলিসিস হল – “. . . a conscious or probably unconscious dissatisfaction with the form.” প্রাচীন মিথকে আধুনিক জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনাবলীতে একটা অভিন্ন ঐক্যে আত্মীকৃত করার ক্ষেত্রে জয়েসের ক্ষমতাকে তিনি এই বলে প্রশংসা করেন – “. . . manipulating a continuous parallel between contemporaneity and antiquity.” তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতে অন্য লিখিয়েরা হয়ত জয়েসের এই ফর্মকে আত্মস্থ করবে।

জয়েসের একমাত্র গল্পের বই ‘ডাবলিনার্স’ (১৯১৪) নিয়েও অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। এর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল অশ্লীলতা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দেশদ্রোহিতার উপসর্গ ঘটার সম্ভাবনা। ১৯০৬ সালে প্রথম এক প্রকাশক ডাবলিনার্স গ্রহণ করেও ভাষার শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নে প্রত্যাখান করেন। একের পর এক প্রকাশক দ্বারা বইটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এমনকী ১৯০৯ সালে যে প্রকাশক শেষ পর্যন্ত বইটি ছেপেছিলেন তিনিও মুদ্রণ শেষে বইটি বিলি-বন্টন না করে নিজেই পুড়িয়ে ফেলেন। তবে এই প্রকাশকই বছর চারেক পরে নিজের মত বদলে আবার ‘ডাবলিনার্স’ ছাপতে শুরু করেন এবং ১৯১৪ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এই গল্পগ্রন্থের ‘অ্যারাবি’, ‘দ্য ডেড’, ‘দ্য সিস্টার্স’, ‘দ্য বোর্ডিং হাউস’, ‘অ্যান এনকাউন্টার’, ‘আফটার দ্য রেস’, ‘ইভলিন’, ‘টু গ্যালান্টস’, ‘কাউন্টারপার্টস’ প্রভৃতি গল্পগুলোয় বিশেষ জয়েসীয় রচনারীতির সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এই গল্পগ্রন্থটির আগে ১৯০৭ সালে প্রথমে প্রকাশ পেয়েছিল জয়েসের কবিতা সংকলন ‘চেম্বার মিউজিক’। কাব্যগ্রন্থটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জয়েসের ভাষার সুর, ধ্বনিময়তা ও ভাষার দ্ব্যর্থতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। তার থেকে এরকম ধারণা হতেই পারে যে ‘ইউলিসিসে’র মতো বৃহৎ ও জটিল উপন্যাসের ফাঁকে-ফোকরে বিভিন্ন ভাষার অনেক কবিতার পংক্তি ঢুকে যাওয়া মোটেই আকস্মিক নয়।

জয়েসের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। এর নায়ক স্টিফেন ডিডেলাসকে পরে ‘ইউলিলিসিসে’র তিন প্রধান চরিত্রের এক জন হিসাবে পাওয়া যায়। জয়েসের প্রতিরূপ স্টিফেনের বেড়ে ওঠা ও নির্মাণের মধ্যে তাঁর নিজের ধরণের শিল্পভাবনা প্রকাশ পায়। জয়েসকে বুঝে উঠতে গেলে যা যা বলা হয় – এপিফ্যানি, স্থান ও কালের দূরত্ব ঘোচানো সমন্বয়, মনোজগতে নির্মিত নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতার অন্তর্গত বয়ান এ সবই ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ উপন্যাসে অনুশীলিত হয়ে যায়। লেখকের নিজের শিল্পতত্ত্ব ও তার ক্রমবিকাশ স্টিফেন চরিত্রের বিকাশের সঙ্গে বিকশিত হয়। তাই জয়েস স্বচ্ছন্দে লেখেন – “Welcome, O life! I go to encounter for the millionth of time the reality of experience and to forge in the smithy of my soul the uncreated conscience of my race.” ইউলিসিস উপন্যাসের বিশাল পরিসরে প্রবেশের আগে জয়েস তাঁর স্বমুদ্রিত শিল্পকৌশলকে বৃহত্তর পাঠক-সমালোচকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এ হল লেখক জয়েসের সচেতন প্রয়াস।

জয়েসের বন্ধু এজরা পাউন্ড লন্ডনের সাহিত্য-মহলে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। তিনি আগেই বন্ধুর ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি মনে করতেন জয়েস একজন ভাল কবি, কিন্তু গদ্যকার হিসেবে তিনি অনন্য। গল্প-সংগ্রহ ডাবলিনার্স-এর চেয়ে উপন্যাস ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট এ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ তাঁর কাছে আরও বেশি সংহত মনে হয়েছিল। জয়েস কখনও ফরমায়েসি লেখা লিখতেন না। তাঁর এই মনোভাব পাউন্ডকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

জয়েসের একমাত্র নাটক ‘এক্সাইল’ নিয়েও সেই একই অভিযোগ – রচনাটি অশ্লীল, জটিল ও একেবারে অন্যরকম। ‘এক্সাইল’ ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হলেও সহজে মঞ্চায়িত হতে পারে না। আঙ্গিকের দিক থেকে রচনাটি প্রথাগত নাটকের মতো নয়, যেমনটি সকলে দেখে বা পড়ে অভ্যস্ত। নাটকটি বড় ও উপন্যাসধর্মী, সংলাপ দীর্ঘ ও জটিল, কিছু দৃশ্য অশ্লীল বলে মনে হতে পারে। তা ছাড়া পাত্র-পাত্রীদের নির্মাণ ও আচরণ স্বাভাবিক নয়। তাই সকলের মনেই প্রশ্ন – মঞ্চে এই নাটক পরিবেশন কীভাবে সম্ভব! তবু জয়েস অনড়, তিনি নাটক থেকে একটি লাইনও বাদ দেবেন না। চরিত্রগুলিও মঞ্চের অভিভাবকদের চাহিদা মতো বদলাবে না। এমনকী বার্ণাড শ পর্যন্ত বললেন নাটক থেকে অশ্লীল দৃশ্যটি বাদ দিলে কারও আর তেমন আপত্তি থাকবে না। জয়েস সেই উপদেশ হেসে উপেক্ষা করলেন। আসলে তিনি নিজের শিল্পভাবনা, বোধ ও আঙ্গিকের সঙ্গে কোনওভাবেই আপোস করবেন না।

প্রথম কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের কুড়ি বছর পর ১৯২৭ সালে জয়েসের দ্বিতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এখানেও তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, মাত্র ১৩টি কবিতার সংকলনের নাম দিয়েছিলেন ‘Poems Penyeach’। তিনি এই সংকলনের দাম রেখেছিলেন এক শিলিং। বারো পেনিতে এক শিলিং, অর্থাৎ এক পেনিতে একটি কবিতা। এর আদর্শেই বুদ্ধদেব বসু ১৯৪২ সালে কবিতা ভবন থেকে প্রকাশ করেছিলেন ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালা। প্রতি পৃষ্ঠার দাম এক পয়সা হিসাবে ১৬ পাতায় এক ফর্মা কবিতা সংকলনের দাম রেখেছিলেন চার আনা (সে আমলে ১৬ পয়সায় এক আনা)।
‘ডাবলিনার্স’ গল্প-সংকলনেই জয়েসীয় প্রকাশভঙ্গীর যথেষ্ট নিদর্শন রয়ে গেছে, বিশেষ করে ‘দ্য ডেড’ গল্পটিতে’। তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ বা একমাত্র নাটক ‘এক্সাইল’-এও জয়েসের নিজস্ব বৈশিষ্টপূর্ণ রচনারীতির ছাপ অত্যন্ত প্রকট। তাঁর মাস্টারপীস ‘ইউলিসিসে’র আয়তন প্রায় ৭০০ পাতা। ইংরেজি ভাষার প্রচলিত কাঠামো ও ব্যাকরণকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে উপন্যাসের ন্যারেশনেও তিনি ব্যবহার করেছেন ডাবলিনার্সদের ডায়ালেক্টে ব্যবহৃত শব্দ। তা ছাড়াও ব্যবহার করেছেন ফরাসি, জার্মান এমনকী ল্যাটিন শব্দ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য অনেকটা দার্শনিকের মতো, ষেমন – “Think you are escaping and run into yourself. Largest way round is the shortest way home.” শেষ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে তখনো পর্যন্ত বৃহৎ একটি বাক্য, যা হল মলি ব্লুমের স্বীকারোক্তি। ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসটি মাত্র ১৬ ঘন্টার ঘটনা, তারই মতো ‘এক্সাইল’ নাটকটিও ২৪ ঘন্টার কম সময়ের ঘটনা। ‘এক্সাইল’ নাটকে মাত্র চারটি প্রধান চরিত্র এবং দুটি পার্শ্বচরিত্র। তাদের দীর্ঘ সংলাপ, আন্তঃসম্পর্ক ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় নাটকটি শেষ হয়। এর পাঠ-অভিজ্ঞতা অনেকটা উপন্যাসের পাঠ-অভিজ্ঞতার মতো।

১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ‘ফিনেগানস ওয়েক’ জয়েসের শেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এটি একটি জটিল ও পরীক্ষামূলক উপন্যাস। তর্কসাপেক্ষে বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি ভাষার ফিকশন গোত্রের রচনাগুলির মধ্যে এটিই বোধহয় সবথেকে জটিল। যুদ্ধকালীন সময়ের জুরিখ শহর শরণার্থী, ফরিয়া, কালোবাজারী প্রভৃতির ভিড়ে ভরে উঠেছিল। শহরের পাব ও রেস্তোরাঁগুলোতেও উপচে পড়া ভিড়। জয়েস নীরবতা সহ্য করতে পারেন না, কোলাহলের মাঝে তাঁর লেখা বের হয়ে আসে। ‘ফিনেগানস ওয়েক’ বইটি প্রকাশের পর জয়েস তাঁর লেখা সম্পর্কে বলেছিলেন – “Really it is not I who am writing this crazy book. It is you, and you, and you, and that man over there, and that girl at the next table.”
১৮৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আয়ার্ল্যাণ্ডের রথগার-এ জয়েসের জন্ম। তাঁর গোঁড়া ক্যাথলিক মায়ের কাছে শৈশবের পড়া শেষ করে তিনি পরবর্তীকালে ক্যাথলিক স্কুল-কলেজে পড়েছিলেন। এই ধরণের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়া সত্বেও তিনি সে ভাবে ধর্মবিশ্বাসী বা রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারেননি। কলেজ-জীবন শেষে চার্চে পৌরোহিত্য করার বদলে তিনি ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হলেন। প্রবল ধর্মীয় আবহাওয়া, সেমিটিক বিদ্বেষ, জাতিগত রেষারেষি প্রভৃতিতে জয়েসের সংবেদনশীল শিল্পী-মন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্নাতক ডিগ্রির পর ১৯০২ সালে তিনি ডাবলিন ছেড়ে প্যারিসে চলে যান ডাক্তারি পড়তে। কিন্তু সেই পড়ায় তাঁর মন বসেনি। তিনি ডাবলিনের কাগজে সাহিত্যসমালোচনা লিখতে শুরু করেন। মায়ের গুরুতর অসুখের খবর পেয়ে তিনি ১৯০৩ সালে ডাবলিনে ফিরে এলেও ১৯০৪ সালে প্রেমিকা নোরাকে নিয়ে আবার প্যারিসে চলে যান।
রোম, বার্লিন, জুরিখ, লন্ডন প্রভৃতি ইউরোপের বিভিন্ন শহর ঘুরে ১৯১২ সাল থেকে জয়েস প্যারিসেই স্থায়ীভাবে বাস করছিলে, যদিও তাঁর লেখার পটভূমি, জায়গা, মানুষ, মনস্তত্ত্ব, দ্বন্দ্ব, বাস্তবতা সবই আয়ার্ল্যাণ্ডকে কেন্দ্র করে। জয়েস সাহিত্য-ভাবনা, শিল্পতত্ত্ব ও নৈতিকতার বিষয়ে তাঁর প্রিয় ডাবলিন শহরের নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদের মতো রক্ষণশীল ছিলেন না। ডাবলিনে তাঁর সাহিত্য ও রচনারীতির কোনও সমাদর ছিল না। হেনরিক ইবসেনের নাটকের উপর তাঁর লেখা প্রবন্ধ ডাবলিনের একটি পত্রিকা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। আজন্ম ডাবলিনার জয়েস ডাবলিন শহরে নিজের মত ও সাহিত্যরুচির দায়ে একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও কোনওদিন আপোস করেননি। ডাবলিন ছেড়ে ইউরোপের অন্যান্য বড় শহরে বসে তিনি স্বতন্ত্র আঙ্গিকে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। জনরুচির দাবির কাছে মাথা নত না করে তাঁকে বরাবরই নিজের ঢংয়ে সাহিত্য-সাধনার সংগ্রাম করতে হয়েছে এবং তিনি আমৃত্যু তাই করে গেছেন।

জয়েস সব সময় সাহিত্যগোষ্ঠী বা সাহিত্যচক্রের থেকে দূরে থেকেছেন। বলতে গেলে তিনি নিজেকে এ সবের থেকে একেবারে দূরে সরিয়ে রাখতেন। এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর একেবারে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। এমনকী ইয়েটস-এর এই প্রবণতার তীব্র সমালোচনা করে তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং তা পাঠ করেছিলেন। ‘আইরিশ একাডেমি অফ লেটার্সে’ যোগদানের ডন্য ইয়েটস এবং বার্ণাড শ-এর আমন্ত্রণ তিনি এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন। অথচ এমন আমন্ত্রণ যে কোনও সাহিত্যিক লুফে নিতেন। এজরা পাউন্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও জর্জ রাসেল ছাড়া তেমন কোনও বিখ্যাত সাহিত্যিকের সঙ্গে তাঁর মাখামাখিও ছিল না। নিজের লেখা নিয়ে কোনও সাহিত্যিকের সঙ্গে আলোচনাও তিনি পারতপক্ষে করতেন না। বরং তিনি মিশতেন প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে, শ্রমিক, ছাত্র ও ব্যতিক্রমী লিখিয়েদের সঙ্গে। তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন ছোট ভাই স্টানিশলাস। নিজের লেখা নিয়ে তিনি এই ভাইয়ের সহ্গে অনবরত আলোচনা করেছেন, তার মন্তব্য, আলোচনা ও সমালোচনা চেয়েছেন। এমনকী ডাবলিনার্স প্রকাশিত হবার পর তিনি এক কপি বই ডাবলিনে পাঠিয়েছিলেন আন্টি জোসেফিনার কাছে তাঁর মন্তব্যের জন্য।

জয়েসের প্রিয় কম্পোজার ছিলেন গিউসেপ্পি ভিয়েরি। তিনি এই ইতালিয় কম্পোজারের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। তা ছাড়া তিনি ফরাসি কম্পোজার ম্যাসুনের গান পছন্দ করতেন। তবে জার্মান সাহিত্য তিনি একেবারে পছন্দ করতেন না, গ্যয়টে সম্বন্ধে তিনি বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে জয়েস ছিলেন বেজায় আলসে মানুষ। তিনি বলতেন ফ্ল্যাটের প্রতিটি ঘরেই শোবার জন্য বিছানা থাকা উচিত যাতে পড়তে বা লিখতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সেখানেই শুয়ে পড়া যায়। বন্ধু ওয়েসিস অনেক কষ্টে তাঁকে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করতে রাজী করিয়েছিলেন। হাঁটার সময় মেঘ ডাকলে তিনি ভীষণ ভয় পেতেন। তিনি বলতেন বজ্রকে নিয়ে হাসি-তামাশা করা মোটেই উচিত নয়। বন্ধুদের খুব গুরুত্ব দিয়ে বলতেন তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন করার জন্য।

স্বদেশ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জয়েস সাহিত্যের তথাকথিত জনপ্রিয় ঘরানা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। বলতে গেলে জনগণের কোলাহলের মধ্যে থেকেও তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ দ্বীপের বাসিন্দা। ইংল্যান্ড ও আয়ার্ল্যান্ডের উঠতি লিখিয়েরা সাহিত্যচক্রে তাদের লেখায় আলোচনার ঝড় তুললেও জয়েস ছিলেন নিভৃতচারী। নিজেকে এই সব তথাকথিত সাহিত্যচক্র থেকে তিনি সযত্নে দূরে রাখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জুরিখে ছিলেন, কারণ সেখানে যুদ্ধের ভয় কম ছিল। কিন্তু তিনি বেশিদিন বাঁচলেন না, তাঁর পেটে আলসার হয়েছিল। ১৯৪১ সালের ১৩ জানুয়ারি জেমস জয়েসের মৃত্যু হয়। জীবৎকালে তাঁর সাহিত্যের যেমন প্রচুর সংখ্যক অনুরাগী ছিল না, তেমনই মৃত্যুর পর তাঁর শবযাত্রায়ও বিশেষ কেউ আসেনি।