প্রবন্ধ: অমিয় চক্রবর্তী: সাধারণ ভাষায় অসাধারণ প্রকাশের কবি

প্রবন্ধ: অমিয় চক্রবর্তী: সাধারণ ভাষায় অসাধারণ প্রকাশের কবি

অমিয় চক্রবর্তী: সাধারণ ভাষায় অসাধারণ প্রকাশের কবি
আবু আফজাল সালেহ

‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।/ফালগুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।/শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।/লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;/আকাশে বিদ্যুতজ্বলা বর্শা হানে/ইন্দ্রমেঘ;/কালো দিন গলির রাস্তায়।/কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে…’-(বৃষ্টি)। বাংলা কবিতাসাহিত্যে পঞ্চপাণ্ডব ও তিরিশের কবিদের ভূমিকা অনুস্বীকার্য। বিশেষকরে, আধুনিক কবিতায় নতুনত্ব আনার ক্ষেত্রে পঞ্চপাণ্ডবের অগ্রণী ভ‚মিকা রয়েছে। রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে কবিতায় নতুন স্বর সৃষ্টি করেছেন তাঁরা। এসময়ের অনেক কবিই ইংরেজিসাহিত্য সম্পর্কে ধারণা ভালো ছিল; চর্চাও করতেন। ফলে বিদেশীসাহিত্যের প্রভাব রয়েছে তিরিশের কবিদের; পঞ্চপাণ্ডবের। পঞ্চপাণ্ডবের একজন হচ্ছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। আজকের আলোচনা তাকে নিয়েই; ফলে তাঁর জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত একটি কবিতাংশ দিয়েই শুরু করেছি।

অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম: ১০ এপ্রিল, ১৯০১ – মৃত্যু: ১২ জুন, ১৯৮৬) বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি। তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে’র সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নামও আবশ্যিকভাবে চলে আসবে। অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘কবিতাবলী’(১৯২৪)। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: উপহার(১৯২৭), খসড়া(১৯৩৮), এক মুঠো(১৯৩৯), মাটির দেয়াল(১৯৪২), অভিজ্ঞান বসন্ত(১৯৪৩), পারাপার(১৯৫৩), পালাবদল(১৯৫৫), ঘরে ফেরার দিন(১৯৬১), হারানো অর্কিড(১৯৬৬), পুষ্পিত ইমেজ(১৯৬৭), অমরাবতী(১৯৭২), অনিঃশেষ(১৯৭৬), চলো যাই(১৯৬২), উল্লেখযোগ্য। গদ্যগ্রন্থ : চলো যাই(১৯৬২) এবং সাম্প্রতিক(১৯৬৩) । ইংরেজি ভাষায় রচিত ৯টি গ্রন্থ রয়েছে : The Dynasts and the Post-War Age in Poetry(অক্সফোর্ড ১৯৩৮); Modern Tendencies in English Literature(কলকাতা ১৯৪২); Amiya Chakrabarty in Enghlish Translation(শান্তিনিকেতন, ১৯৯০) উল্লেখযোগ্য।

অমিয় চক্রবর্তী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। বিশ্বের নানান দেশে নানাবিধ তিনি ভ্রমণ করেন। ফলে, একারণে কবি ইয়েটস, জর্জ বার্নাড’শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্টফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর,বোরিস পান্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য লেখকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিক্ষকতা ও কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। এর প্রভাব তাঁর অনেক কবিতায় দেখা যায়। পর্যটনস্থান-কেন্দ্রিক অনেক কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বপরিবেশের অনেক ভৌগোলিক স্থানের নাম, বর্ণনা ও চিত্র লক্ষ করার মতো। এই কারণে কবির ভ্রামণিক কবিতার বেশিরভাগই অনন্য হয়েছে। এমন একটি কবিতাংশ তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। তাঁর ‘‘ওক্লাহোমা’’ কবিতা থেকে- ‘সাক্ষাত সন্ধান পেয়েছ কি ৩-টে ২৫শে?/বিকেলের উইলো বনে রেড এরো ট্রেনের হুইসিল/শব্দ শেষ ছুঁয়ে গাঁথে দূর শূন্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল;/মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেলো মিশে।।/অবসান গেল মিশে।।/মাথা নাড়ে ‘জানি’ ‘জানি’ ক্যাথলিক গির্জাচুড়া স্থির,/পুরোনো রোদ্দুরে ওড়া কাকের কাকলি পাখা ভিড়;/অন্যমনস্ক মস্ত শহরে হঠাৎ কুয়াশায়/ইস্পাতি রেলের ধারে হুহু শীত-হাওয়া ট’লে যায়…।’

কবি-সাহিত্যিকরা জীবন-জীবিকাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। জীবন ও সংসারের জটিল হিসাব-নিকাশ কবিতার ছত্রে ছত্রে উঠে আসে কবির কবিতায়। অমিয় চক্রবর্তীও ব্যতিক্রম নয়। প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গে ছোটদের জন্য শুভকামনাও রয়েছে। ‘‘পিঁপড়ে’’ কবিতায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জীবন-জীবিকা বা জটিল হিসাবের কিছু কবিতাংশ তুলেই ধরা যাক-
(১) ‘তালিকা প্রস্তুত/কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-/হই না নির্বাসিত-কেরানি।/বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।/যার একখন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।/যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,/হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।/কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি/গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।/আপন জনকে ভালোবাসা,/বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।/তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরো আছে-/দূর-সংসারে এলো কাছে/বাঁচবার সার্থকতা…’-(বড়োবাবুর কাছে নিবেদন)

(২) ‘গেলো/গুরুচরণ কামার, দোকানটা তার মামার,/হাতুড়ি আর হাপর ধারের(জানা ছিল আমার)/দেহটা নিজস্ব।/রাম নাম সত হ্যায়/গৌর বসাকের প’ড়ে রইল ভরন্ত খেত খামার।/রাম নাম সত হ্যায়।।/আমরা কাজে রই নিযুক্ত, কেউ কেরানি কেউ অভুক্ত,/লাঙল চালাই কলম ঠেলি, যখন তখন শুনে ফেলি/রাম নাম সত হ্যায়/শুনবো না আর যখন কানে বাজবে তবু এই এখানে/রাম নাম সত হ্যায়…।’-(সাবেকি)

(৩) ‘আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক/কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা-/স্তব্ধ শুধু চলায় কথা বলা-/আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,/আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক…।’ -(পিঁপড়ে)

রোমান্টিসিজম ধরা দিয়েছে ধরা দিয়েছে অমিয় চক্রবর্তীর কোনও কোনও কবিতায়। তিনি বৃষ্টির কবি, বৃষ্টির সুর তাঁর কবিতায়; রাত্রির নিস্তব্ধতাগুলো দারুণ ব্যঞ্জনাময় হয়েছে কবিতার ছত্রে-ছত্রে। ‘‘রাত্রি’’কবিতায় প্রেম ধরা দিয়েছে এভাবে, ‘‘অতন্দ্রিলা’’-য়- ‘অতন্দ্রিলা,/ঘুমোওনি জানি/তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে/বলি, শোনো,/সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়-/ সূক্ষ্ণজাল রাত্রির মশারি-/কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,/আলাদা নিশ্বাসে-/এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই/কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা-/অতন্দ্রিলা,/হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না,/দেখি তুমি নেই…।’

তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নধ্যি বেশি পেলেও তাঁর কবিতা ছিল সর্ম্পূণ রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন “অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ণ রহস্য”। বলেছিলেন,তাঁর কবিতায় আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে মননশীলতা, বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ। কবিতার জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’(১৯৬০), ভারতীয় ‘ন্যাশনাল একাডেমী পুরস্কার’, ‘দেশিকোত্তম’(১৯৬৩) এবং ‘পদ্মভূষণ’(১৯৭০) ইত্যাদি উপাধি/পুরস্কার পেয়েছেন।

সমালোচক ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ অমিয় চক্রবর্তীর অনন্যতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা একেবারেই অন্যরকম। কোন পোগান বা চীৎকৃত বাক্যের থেকে অনেক দূরে : মননাশ্রিত, এ্যাবস্ট্রাক্ট অথচ মমতার ঘন নিবিড়…।’ বেশি বেশি উপমা ব্যবহার ছাড়াও যে অসাধারণ কবিতা লেখা যায়, তা দেখিয়েছেন চক্রবর্তী। তাঁর কবিতার ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের কৌশল, পঙ্ক্তি গঠন ইত্যাদি অসাধারণ হয়েছে। সংস্কৃত শব্দগুলোও তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে সহজে; তবে এসব শব্দচয়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় সাধারণ ভাষা; কিন্তু বক্তব্য হালকা হয়ে যায়নি। তাইতো বলা যায়, সাধারণ শব্দ-চয়নে তাঁর কবিতাগুলো অসাধারণ হয়েছে, অনন্য হয়েছে। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা এখনও প্রাসঙ্গিক- এখানেই তিনি স্বতন্ত্র।