গল্প: সেই রাতে

সেই রাতে
সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা
গহিন অরণ্যে মায়ের পাশ থেকে হারিয়ে যাওয়া দিকভ্রান্ত হরিণ শাবকের মতো শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটোছুটি করছিলো মিনহাজ উদ্দিন সরকার। উদ্দেশ্য একটাই। শিরিনকে খুঁজে বের করা। মস্ত বড় শহর। কোথায় খুঁজবে? যতটুকু সাধ্যের মধ্যে ছিল,শহরের অলি-গলি,বন্ধু-বান্ধবদের বাসা-বাড়ি কিংবা থানা কোথাও তো অবশিষ্ট রাখেনি। মন চাইলেই কী আর সব অসম্ভব সম্ভব হয়? বুকের গহীন হতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিচ্ছে যতসব অলক্ষুণে কথা। নিজের অজান্তে বলতে থাকে,ঘন্টা তিনেকের মধ্যে মেয়েটা কোথায় অদৃশ্য হলো? বাজে লোকের পাল্লায় পড়লো নাতো? হন্য হয়ে বিভিন্ন পথ মাড়িয়ে সে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত শরীরখানা টেনে হিঁচড়ে সে পা ফেলে বাসার গন্তব্যে। মোবাইল স্ক্রীনে সময় দেখেন। রাত প্রায় সোয়া একটা। একে তো মাঘ মাস। তার ওপর শৈত্যপ্রবাহ। যেদিকে চোখ যায়, ঘন কুয়াশার শ্বেত চাদরে ঢাকা পড়ে আছে নিস্তব্ধ নগরী। সারা শহর হতাশচিত্তে ঘুরে সে থমকে দাঁড়ায় গেটের সামনে। কিছুক্ষণ পর দারোয়ানকে ক্ষীণস্বরে ডাকে, চাচা…চাচা…ও চাচা গেট-টা খুলুন। রাত তখন পৌনে তিনটা। গভীর নিদ্রায় দারোয়ান মোকাররম আলী। রাত এগারটার পর গেটে ওর কাজ থাকে না। গেটের ভেতর তালা ঝুলিয়ে নিত্য কাজের সমাপ্তি টানে। আচমকা গেটের ঝনঝনাঝন শব্দ শোনে কেঁপে ওঠে তার সারা শরীর। বিড়বিড় করে বলে ওঠে-‘ক্যাডা আইল অত রাইতে’? সাহসী হওয়ার তাগিদ থেকে লাঠিখানা তুলে নেয় হাতে। ঘুম চোখে এগিয়ে যায় গেটের সামনে। ডাক দেয়-‘ক্যাডা-রে’? বাইরে থেকে কোনো উত্তর আসেনা। মেজাজ বিগড়ে যায় মোকাররম আলীর। চোটপাট এর ভাষা তাৎক্ষণিক প্রয়োগ করতে গিয়ে অশ্রাব্যভাষায় খেঁকিয়ে ওঠে-‘‘ঐ ফকিরণীর পোলা, মুখত পাত্তর দিঅছ না-রে। ঐ কানক্রি পোলা। কতা কঅছ না ক্যান। কতা কইতে কী শরমিন্দা লাগে”? দারোয়ানের কদর্য ভাষা শুনলেও টু’শব্দটি বের হয় না মিনহাজের মুখ দিয়ে। অদৃশ্য দুটো হাত যেন চেপে ধরে আছে তার কণ্ঠস্বর। অগত্যা লাঠিখানা গেটের সাথে সেঁটে মোকাররম আলী ফিরে যায় তার সংরক্ষিত বসত ঘরে। পা দু’খানা ঝুলিয়ে নড়বড়ে চৌকির ওপর গিয়ে বসে পরে। মুখে পান পুরতে পুরতে বিড়বিড় করে বলে-‘রাইত-বিরাইতর জ্বালাতন আর ভাল্লাগেনা। আরামের ঘুমখান হারাম করি দিলো,ঐ হারামির পোলা। খানিক পর আবারো গেটের ঝাঁকুনি। কোমরের সাথে লুঙ্গিখানা শক্ত করে গিঁট দেয় মোকাররম আলী। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় গেটের কাছে। লাঠিটা আবারও তুলে নেয় হাতে। আবারও সে রূঢ় কণ্ঠস্বর-‘‘ঐ কানক্রি পোলা, তোর মার নেগ লাগি না-রে? জিগাইলে কতা কইতে পারোস্ না ? ঐ মান্দির পোলা। বাইর হইলে খবর করি ছাড়–ম কইলাম”!
বাইরে দাঁড়ানো মিনহাজ অস্ফুট কন্ঠস্বর-চাচা,আমি মিনহাজ। ফোর্থ ফ্লোরের ভাড়াটিয়া। কষ্ট করে গেটটা খুলুন। মিনহাজের কণ্ঠ শুনে সত্তরোর্ধ্ব ওই বৃদ্ধ ভারি লজ্জিত হয়। কুঁচকে যাওয়া তার মুখখানি সামলে গেটের তালা খুলতে খুলতে বলে, মিনহাজ চাচা নাকি?
– জ্বি চাচা।
– তয় এত্তো রাইতে কোত্তুন আইয়েন?
– আগে গেট খুলুন। তারপর শুনবেন। গেটের ভিতর এক পা রেখে মিনহাজ সাহেব বললেন, শিরিনের খোঁজে…।
– কি কঅন চাচা, শিরিণ আম্মা কই গ্যাছে?
– সন্ধ্যার দিকে ওর সাথে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সেই যে গেলো…।
– হ চাচা, এশারের নামাজ-এর লাই যহন ওযু বানাইতেছি, তহন দেহি কী শিরিন আম্মা বাইর হইয়া যার। শিরিন আম্মারে জিগাইলাম,আম্মা কই যান? আম্মা কি-স্-সু কইল না। মিনহাজ দ্বিতীয়বার টু’শব্দটি না করে দ্রুত হেঁটে
উপরের সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। চতুর্থ তলায় পৌঁছে সে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তালা যেভাবে ঝুলানো রেখে গেছে,বিন্দুমাত্র তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে খানিক দাঁড়িয়ে রইলো। হৃৎপিন্ড ধুকপুক করছে। টেবিলের ওপর থেকে পানির জগটা টেনে নেয় কাছে। কয়েক চুমুক পানি পান করে। মোবাইল স্ক্রিনে
সময় দেখে। চারটা বেজে দশ। খানিক পর পরিচিত জন ও স্বজনদের কাছে বাটন চাপলো। রেজাল্ট নেগেটিভ। শ্বশুর বাড়ি থেকে ফোন এলো। হতাশায় কিছুটা স্বস্তি পাবে এই ভেবে-শিরিন নিশ্চয়ই ওদের বাড়ি পৌঁছেছে। আশাহত হলেন, যখন শুনল শিরিন সেখানে যায়নি। শরীর ঘেমে হিমশীতল বরফের চাঁই। ফোন দিল থানায়। অপর প্রান্ত থেকে একটা সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এল-হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ?
– ম্যাডাম, আপনাদের ‘সেকেন্ড অফিসার’ মোস্তফা সাহেব কি ডিউটিতে আছেন?
– স্যারতো মোবাইল ফোর্স নিয়ে বাইরে গেছেন-মহিলা বললেন।
– হু আর ইউ? হ্যাভ ইউ এ্যানি ইনফরমেশন?
– মিনহাজ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল, ‘‘আই এম দ্য কলিগ অব মিস্টার মোস্তফা। ইফ হি উইল কাম
ব্যাক অন হিজ ডিউটি প্লিজ স্ েআই এম শিহাব ফোনড হিম।
– ওকে। স্যার আসলে বলব।
টেবিলের ওপর মোবাইল ফোনটা রেখে ক্লান্ত-শ্রান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। স্বজনদের কাছ থেকে কল আসছিল অবিরাম। যে বিশ্বাস জন্মেছিল বুকের গহিনে,উবে গেল তা মুহূর্তে। বিনিদ্র রজনী পার করল বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। জানালার ফাঁক গলে দৃষ্টি দেয় বাইরে। ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। শেষরাতের তারা অস্ফষ্ট দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে পা ফেলে। জানতে চাইলো,কে?
– আঁই আপনাগো দারোয়ান মোকাররম আলী। দরজাখান খুলেন।
– দরজা খুলে মিনহাজ জিজ্ঞেস করল-চাচা, শিরিনের কোন সংবাদ…?
– না চাচা, তয় থানা থেকে এক লোক আইছে। আপনার লগে দেহা গইরতে চান।
– কি জন্য এসেছে, আপনাকে কিছু বলেনি?
– না চাচা। তয় কিল্লাই আইছে জিগাইছিলাম, কই-আঁরে কইত পাইরতো নহ্। আপনেরে যাইতে হইব। শার্টটি গায়ে চড়িয়ে মিনহাজ দারোয়ানের সঙ্গী হল। গেটের কাছাকাছি পৌঁছতেই আগন্তুক মিনহাজকে সালাম দিয়ে বলল,আপনে নিশ্চয়ই মিনহাজ সা-ব?
– জ্বি ।
– আপনের লগে একখান দরকারি আলাপ আছিল।
– আপনার পরিচয়?
– আঁই থানা ক্যাশিয়ার-মাসুম বিল্লাহ।
– বলুন। কী বলতে চান?
– ইয়ানে কঅন যাইতো নহ্। সি-ক্রে-ট ব্যাপার।
মিনহাজ মাসুম বিল্লাহকে সাথে নিয়ে গেটের পাশে গেল। চলার পথে মাসুম বিল্লাহ বললো স্যার, আপনাগো মতন ভদ্রলোকর লাই আঁই জানও দিত পারি! তয় কথা হইলো,গত রাইতে থানার মোবাইল ফোর্স সাতরং হোটেল থেকে কিছু খারাপ মাইয়া ধরি লই আইছে। এগারজন মাইয়ার মধ্যি যহন ঐ মাইডারে দেহি, তহন আঁর বুকের মধ্যি ছেদ করি উডে। লগে লগে দারোগা স্যার-অ-রে কইলাম, স্যার, মনে হয় এই মাইয়া এ লাইনে নোতুন। তহন দারোগা স্যার কইল, আপনি নাকি ভাবিরে…। তয় স্যারে আঁরে আপনের কাছে পাডাইল। স্যারে কইল, হেদের মধ্যি যদি ভাবিসাবরে শনাক্ত কইরতে পারেন, তয় বাসায় জলদি লয় আইসতে পারিবেন।
মাসুম বিল্লাহ’র মুখে অনাকাক্সিক্ষত কথা শুনে পাষাণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিনহাজ। এ মুহূর্তে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। নিতান্ত এক অসহায় বালকের মতো নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ওর দিকে। থানার কথিত ক্যাশিয়ার মাসুম বিল্লাহ কিন্তু থেমে থাকার পাত্র সে নয়। হাত কচলাতে কচলাতে বলে-তয় স্যার, ‘আরো এক্কান কথা আছে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মিনহাজ বললো-বলুন, কী বলতে চান’?
– স্যার,এসব কাজে কিছু খরচাপাতি আছে। এমাউন্টটা কী কমু স্যার?
– না,তা বলার দরকার নাই। থানায় আসলে…।
খানিক চুপ থেকে মাসুম বিল্লাহ এবার বললো,স্যার মামলা কিন্তু কোর্ডে নেওন যাইতো নহ্। জলদি আইওনের চেষ্টা কইরেন। ভাবিসাবরে কোর্ডে চালান দিলে জেল জরিমানাও গুনবেন,আপনের ইজ্জত লইও টানাটানি হইবো। তয়,কয়ছিলাম কী সময় হাতে থাইক্তে কাম-আন খতম করি দিতে হইবো। নয়তো…। মিনহাজের মাথায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ অনুরণিত হতে থাকে মাসুম বিল্লাহর অনৈতিক কথায়। নিজেকে স্থির রেখে মাসুম বিল্লাহকে বললো, ঠিক আছে ভাই,আপনি এখন যান। এ নিয়ে আপনার টেনশন করতে হবেনা। থানায় আসলে সব হবে।
মাসুম বিল্লাহ সালাম দিয়ে বিদায় নিতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে মিনহাজের কানে ফিসফিস করে বলে-স্যার, কাক-পক্ষী টের পঅনের আগে আইস্নে। ভুল করিয়েন না।
এ মূহূর্তে কী করবে মিনহাজ তার কূল-কিনারা পাচ্ছে না। মাথাটা বেশ ধরেছে। বাসায় গিয়ে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বিড়বিড় করে নিজের অজান্তে বলে-সত্যিই কী শিরিন কল গার্লের খাতায় নাম লিখিয়েছে? কেন, কিসের তাড়নায়? ওকে তো আমি কোনোদিক থেকে অসুখী রাখিনি? এ ক’দিন নাহয় একটু সমস্যায় ছিলাম? তাই বলে কী ওকে…? ছিঃ ছিঃ ভাবতে আমার গা ঘিন ঘিন করছে! নিজের মনকে আশ্বস্ত করে-না, না, না। তা কখনও হতে পারে না। শিরিন আমাকে নয়,আমার দারিদ্র্যকে ভালোবেসে সে মাতৃ-পিতৃকূল বিসর্জন দিয়েছিল। তা কখনও মিথ্যা হতে পারে না। এ গর্হিত কাজ সে কখনও করতে পারে না। ভাবতে ভাবতে রাজ্যের সকল ঘুম কখন যে তার চোখের পাতায় জাঁকিয়ে বসল টেরই পেল না। ঘুম যখন ভাঙল অপলক দৃষ্টি ফেললো দেয়াল ঘড়িটার দিকে। বেলা প্রায় দু’টা। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে শার্ট গায়ে চড়ালো। ছুটে গেলো থানায়। থানার গেটে যখন পৌঁছল, আসামি বহনকারী বড় আকারের প্রিজন ভ্যানখানা ততক্ষণে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলে মিনহাজের পাশ কেটে। হতাশচিত্তে মিনহাজ পা বাড়াল কোর্টের দিকে।
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। লোকে লোকারণ্য মহানগর হাকিমের আদালত প্রাঙ্গণ। বাঁশির হুঁইসেল শুনে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা উৎসুক দর্শক সতর্ক অবস্থান থেকে একটু দূরে সরে যায়। মিনহাজও ওদের কাতারে থেকে নিজেকে আড়াল করে। খানিকটা দূরে আচমকা দৃষ্টি পড়ে এক ঝাঁক তরুণীর ওপর। কোমড়ে দড়ি বেঁধে সারিবদ্ধ করে ওদের নিয়ে আসা হচ্ছে হাকিমের আদালতে। পিছন সারিতে যে তরুণীটি ছিল,তার ওপর দৃষ্টি পড়তেই মিনহাজের বুকে দাবানলের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। কী করবে এ মুহূর্তে ? এ কলঙ্কজনক অধ্যায়ের শেষ পরিণতিই বা কী হবে? উত্তর মেলে না সহজেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো আদালত প্রাঙ্গণে। এক এক করে ওদের এগারজনকে তোলা হয় আদালতের কাঠগড়ায়। প্রথম দশজনকে জরিমানাসমেত একমাস তথা অনাদায়ে আরো পনের দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন সাজা দিলেন মহানগর হাকিম। পিছন সারির যে তরুণী, যার ওপর দর্শকের দৃষ্টি। ওকে তোলা হল কাঠগড়ায়। কী ভেবে কিছুটা বিচলিত হলেন মহানগর হাকিম শফিকুর রহমান সাহেব। তার বিস্ময়ভরা অপলক দৃষ্টি স্থির হল তরুণীর ওপর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হল; দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হাকিম তাঁর দীর্ঘদিনের বিচারিক মামলায় এ প্রথম সংক্ষুদ্ধ হলেন। আচমকা টেবিলের নিচে গড়িয়ে পড়ে শফিক সাহেবের হাতের কলমটা। পিয়ন দবিরুদ্দিন দৌঁড়ে এসে কলমটা তুলে টেবিলের ওপর রাখল। টেবিলের মৃদু শব্দ হাকিম সাহেবের চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায়। আবার সতর্কভাবে নিজের কাজে মনোযোগী হলেন। জিজ্ঞেস করলেন ঐ তরুণীকে, কী নাম আপনার ? তরুণী কী বললেন, হাকিম সাহেব বুঝতে পারলেন না। হাউমাউ কান্নার শব্দে মুখের ভাষা তলিয়ে গেলো মুহূর্তে। হয়তোবা তরুণী স্বীয় কর্মকাণ্ডের জন্য নিজের ওপর তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন চোখের অনাকাক্সিক্ষত অশ্র“ দিয়ে। খানিক পর তরুণী আঁচলে চোখ মুছে এদিক-ওদিক তাকালেন,যদি কোন চিরচেনা কাউকে তাৎক্ষণিক খুঁজে পান! হাকিম সাহেবের কাঠগড়া সংলগ্ন চেয়ারে বসা উপস্থিত সকলেই থ বনে গেলেন।
হাকিম সাহেবের সাবলীল কন্ঠস্বর স্তিমিত হলো। সপ্রতিভ ভঙ্গিমায় আবারও জিজ্ঞেস করলেন-বলুন,কী নাম আপনার?
– ঐন্দ্রিলা জামান শিরিণ।
– দারোগা সাহেব রুদ্রমূর্তি ধারণ করে হেঁকে বললেন, মহামান্য আদালত। এ মেয়ে মিথ্যুক, ধূর্ত প্রকৃতির। এ লাইনে নতুন হলেও জ্ঞান-বুদ্ধি ওর ষোলআনা। আদালতের কাছে ও মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। ওর নাম প্রকৃত নাম ঐন্দ্রিলা…নয়, শেফালী আক্তার।
– দারোগা সাহেব। প্লিজ। আমি মামলার বাদীকে নয়, বিবাদীকে প্রশ্ন করছি-হাকিম বললেন।
– আচ্ছা শিরিন, সত্যি করে বলুনতো আপনি মিস্ না মিসেস্?
– জ্বি স্যার, আমি মিসেস্।
– আপনার স্বামীর নাম?
– মিনহাজ উদ্দীন সরকার।
– পেশা?
– প্রাইভেট ব্যাংকের ‘ক্যাশ অফিসার’।
– বিশ্বাস করলাম, আপনি বিবাহিত এবং আপনার স্বামী একজন ব্যাংকার। আপনার স্বামী নিশ্চয়…!
– জ্বি না স্যার।
– তা না হলে, কেন আপনি স্বামীর ঘর ছেড়ে হোটেলে গেলেন? তাও রাতের বেলায়!
– স্যার, সে রাতের দু’দিন আগে ছিল আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। মিনহাজ আমার স্বামী প্রমিজ করেছিলেন, আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী জাঁকজমকপূর্ণ না করে দূরে কোথাও রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেলিব্রেট করবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম, ঊনার পক্ষে তা কখনও সম্ভব নয়। কারণ, ঊনার অভাব ছিল নিত্য সঙ্গী। আর্থিক দৈন্যতার কথা মাথায় রেখে আমি সব কিছু মানিয়ে চলতাম। সেদিনও আমি ঊনার ঐ প্রসঙ্গ তুলে বাদ দিতে বলেছিলাম। উনি শোনেননি। আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন,শত কষ্ট হোক এটা আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। দিনটা আমরা উদযাপন করব রেস্টুরেন্টে। যদিও নিজ থেকে আমি কখনও কোন ব্যাপারে আগ্রহবোধ দেখাইনি। এমন কি পারতপক্ষে কখনও কিছু চাইতাম না। কিন্তু সে রাতে ঊনার আচরণে আমি খুবই মর্মাহত হই, ইমোশ্নাল হয়ে পড়ি।
– শোনেন মিসেস্ শিরিন। দাম্পত্য জীবনে ত্র“টি-বিচ্যুতি থাকে। তাই বলে কী…? স্যরি, এক্সট্রিমলি স্যরি, মিসেস্ শিরিন। আপনি একজন সুশিক্ষিতা মহিলা। কিন্তু নির্বোধ এর মতো নিন্দিত কাজটি জন সম্মুখে উদ্ভাসিত করলেন। একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করলেন, তাই নয় কী? আদালত মনে করে, আপনারা দু’জনই
সাংসারিক বোঝাপড়ার দিক থেকে এখনও অপরিপক্ব। দাম্পত্য জীবনে অসংখ্য ভুল-ত্র“টি থাকতে পারে এবং থাকবে। দু’জন দু’জনের প্রতি সিমপেথি থাকাটাই মুখ্য। এতে হয় কি জানেন, একটা সুন্দর সংসার পরিপূর্ণতা পায়, সুদৃঢ় হয়।
– স্যার সেই রাত্রে এ পরিস্থিতির শিকার হবো,অতটা ভাবিনি।
– আজ থেকে সে শিক্ষাটাই ‘মূলমন্ত্র’ হিসাবে গ্রহণ করুন।
– জ্বি স্যার।
– আচ্ছা মিসেস্ শিরিণ; ইমোশ্নালের কথা কী যেন বলছিলেন? মহামান্য আদালতের কাছে কী একটু ব্যাখ্যা করবেন?
– জ্বি স্যার। সেদিন ঊনি খুব রাত করে বাসায় ফেরেন। দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলাম। ঊনি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান। রাত গভীর হওয়ায় আমি তর্কে গেলাম না। অভুক্ত থেকে পাশের কক্ষে শুয়ে পড়ি। সকালে
উঠে দেখি,আমাকে কিছু না বলে ঊনি বেরিয়ে গেছেন। দ্বিতীয় দিনও একই অবস্থা। কোন কারণ জানতে
পারিনি। তৃতীয় দিন অর্থাৎ গত রাত্রে অত্যন্ত রাবিশ ভাষায় ঊনার সাথে তর্ক জুড়ে দিই। ঊনি ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে আমার গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেন। ওই দুর্বিনীত আচরণে আমি প্রচন্ডভাবে হতবাক হয়ে পড়ি। বিক্ষুব্ধ হই। কান্না করে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করি। ঊনি এগিয়ে এলেন না। অতঃপর আমার অন্তর্যাতনা হলো বিস্ফোরিত। যে লোকটির জন্য নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন এমনকি সকল আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করলাম। যার সদা হাসিমাখা মুখ দেখতে; টিউশনি করার তাগিদ নিয়ে পথে নামলাম। আর ঊনি কিনা…! আমি কী ঊনার দৃষ্টিতে এতই খারাপ?
– হোটেলে না গিয়ে আপনি অন্য কোথাও তো যেতে পারতেন?
– স্যার, বাসা হতে বেরিয়ে প্রথমে আমার এক বান্ধবীর বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ওদের বাসায় তালা ঝুলছে। ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে ফোন করে জানতে পারি ওরা বেড়াতে গেছে। বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বাস স্টেশনে যাই। ততক্ষণে বাস চট্টগ্রাম ছেড়ে গেছে। একে তো রাত, তার ওপর একজন মহিলা। স্যার, অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোটেলে আশ্রয় নিই।
– পুলিশে আপনাকে ধরলো কেন?
– রাত প্রায় দু’টা। ঘুম আসছিল না চোখে। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। আচমকা হোটেল রুমের বাইরে হৈ-হুল্লোড় শব্দ শুনতে পাই। ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়ি। পরক্ষণে বুঝলাম,সজোরে আমার রুমের দরজা ভাঙা হচ্ছে। নিজেকে সেফ-সাইডে নিতে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ি। অল্প কিছুক্ষণ পর পুলিশের দু’জন লোক লুকোনো জায়গা থেকে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনে তাদের গাড়িতে তুলে। ঘটনা বিহব্বলতায় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করি,থানা হাজতের অন্ধকার রুমে।
– আপনার সাথে আর কে ছিল?
– এই মেয়েগুলো।
হাকিম সাহেব শিরিনের দিকে স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দৃষ্টি সরিয়ে কলমটা তুলে নেন হাতে। কী যেন লিখতে যাবেন, সে মুহূর্তে কোর্ট দারোগাকে বললেন-‘‘দারোগা সাহেব,এজলাসে দাঁড়ানো এ মহিলার মুখ দিয়ে এতক্ষণ যে করুণ আর্তি শুনলাম,ধরে নেব কী এ গল্প মিথ্যুক ও একজন ধূর্ত প্রকৃতির মহিলার বানানো গল্প! আপনার সেন্স কী বলে”?
– সত্যিই স্যার, আমাদের ভুল হয়েছে। আমি আদালতের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
– দারোগা সাহেব, আজকের ঢাকার পত্রিকা নিশ্চয়ই পড়েছেন।
– জ্বি স্যার পড়েছি।
– আজকের এ ঘটনা কাল খুলনার এক আদালতে ঘটেছিল। যদিও ঘটনাটি ছিল একটু ভিন্ন।
– জ্বি স্যার।
– শোনেন দারোগা সাহেব,আমাদের পুলিশ বাহিনী কিন্তু সত্যিই জিনিয়াস! আপনারাই পারেন খুব দেখাতে’।
– আচ্ছা মিসেস্ শিরিন এ আদালত যদি আপনাকে জামিন দেয়, আপনি এখন যাবেন কোথায়?
– স্বামীর কাছে।
– কলগার্লের লিস্টে আপনার নাম উঠেছে। এ সংবাদ যখন আপনার স্বামী জানতে পারবেন…?
– স্যার, ঊনি একজন ভালো মানুষ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ঊনি ব্যাপারটা সঠিকভাবে নেবেন।
– যদি না নেন। তখন কি করবেন?
– তা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
– আপনাকে জিম্মায় নেবেন, এমন কেউ কী আদালতে আছেন। শিরিন এদিক-ওদিক তাকালেন। বললেন-না স্যার, কেউ নেই। ঠিক সে মুহূর্তে বাইরে দাঁড়ানো মিনহাজ দ্রুত আদালতে প্রবেশ করে চিৎকার করে বললেন,
স্যার আমিই…।
– হাকিম নড়ে-চড়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন-আপনার নাম ?
– মিনহাজ উদ্দিন সরকার।
– প্লিজ, কাঠগড়ায় আসুন।
শোয়েব কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো শিরিণ আর মিনহাজের মধ্যে। হাকিম সাহেব বললেন-স্যরি মিনহাজ সাহেব, এটা আবেগ ছড়ানোর জায়গা নয়, মহানগর হাকিমের আদালত। বলুন, আপনার পাশে দাঁড়ানো মহিলা আপনার কি হন?
– আমার স্ত্রী।
– আপনার পেশা?
– স্যার আমি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা।
– একজন ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী ঘর ছাড়ল কেন?
-স্যার, গত তিন দিন আগে ব্যাংকের লকার থেকে আনুমানিক বিশ লক্ষ চুরি যায়। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তা সন্দেহ’র তীর নিক্ষেপ করেন আমার ওপর। মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়ি আমি। আমার তেমন কোন সম্পত্তি নেই, যা বিক্রি করে বিরাট অংকের দেনা শোধ করব।
– এখন ম্যানেজ হলো কীভাবে ?
– স্যার,আধ ঘন্টা পূর্বে আমার সে ঊর্ধ্বতন কর্তার ফোন পেলাম। যিনি টাকা সরিয়ে রেখেছেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের ব্যাংকের গার্ড ।
– যাক, ঐদিক থেকে আপনি এখন ফ্রি-মুডে আছেন।
– জ্বি স্যার। তা না হলে আমার আত্মহত্যার পথ ছাড়া সামনের কোন পথ খোলা থাকত না।
– এখন এখানে কি জন্য এসেছেন?
– শিরিনের খোঁজে।
– আপনার স্ত্রী এখানে এসেছেন, তা কি করে জানলেন?
– স্যার, থানায় গিয়ে।
– ধরুন, আদালত বিচার বিবেচনায় সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আপনার স্ত্রীর জামিন দিল। তখন কী করবেন?
– স্যার, বাসায় নিয়ে যাব।
– বাসায় নিয়ে কোন মারধর…?
– না স্যার। ঐ সব বিকারগ্রস্ত লোকদের কাজ।
মহানগর হাকিম শফিকুর রহমান সাহেব তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালেন। খানিক পর শিরিনের উদ্দেশে বললেন, মিসেস শিরিন, আপনার কি অভিমত? যাবেন? ঊনার সাথে।
– স্যার, যাকে পাওয়ার আশায় সব কিছু বিসর্জন দিয়ে এসেছি। তার ঘরে যাওয়া ছাড়া, আমার আর কোথায়-ই বা হতে পারে শেষ ঠিকানা?
– শুনুন মিসেস্ শিরিন, আজকের এ দিনটি বেশি বেশি স্মরণে রাখবেন। ভবিয্যতে যেন এ ভুলটির পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আগামী দিনগুলোতে আপনাদের দাম্পত্য জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করছি। আদালত আপনার সঠিক
স্টেটমেন্ট এর ওপর ভিত্তি করে লঘু কিংবা গুরু শাস্তিদান থেকে বিরত থেকে আপনার জামিন মঞ্জুর করেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মহানগর হাকিম শফিকুর রহমান সাহেব। ফিরে গেলেন খাস কামরায়।
আর শিরিন। যে শিরিন একরাশ হতাশা বুকে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন পথ চলতে চলতে কোন অতল মহাসাগরে ডুবতে বসেছিল-মিনহাজের আপাত বৈপরীত্যে সে শিরিন আবার মিনহাজের অপার মমতায় ফিরে যায় নিজ বাসভূমে-প্রিয় প্রাঙ্গণে। অবাক পৃথিবী সবিস্ময়ে চেয়ে থাকে। মানুষের জীবনের এ অদ্ভুত দোলাচল। ফিরে যায় মিনহাজ-শিরিন আর এক ভালোবাসার জগতে-আর এক নতুন পৃথিবীতে।