গল্প: প্রহর

গল্প: প্রহর

প্রহর
সুদীপ ঘোষাল

জীবন, এক আশ্বর্য অনুভবের নাম।নাটকের শেষে ফিরতে হবে সবাইকে। গ্রীণরুমে।মানুষ মরে যাওয়ার পর কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে সেই অনুভব আর কাজ করে কি? এ এক চিরন্তন সজীব প্রশ্ন। সমস্ত অনুভূতির শেষে পড়ে থাকে দেহ। কোন রসায়নবিদ সৃষ্টি করেছেন মানব দেহ। রক্ত মাংসের সজীব মূর্তি।

অংশুমান রায় বসে বসে ভাবছে এইসব কথা। চাকরি বাকরি নেই।প্রচুর অলস সময়। কয়েকটা ছাত্র এসেছিলো সকালে পড়তে। দশটায় চলে যায়।তারপর একা একটু বসে থাকে ভাবুক অংশু। সুদপুরের কয়েক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই গ্রাম। অংশুর একটা ছেলে। পড়াশোনা করে। স্ত্রী রান্নাবান্নায় ব্যস্ত।অংশু বসে থাকে বারান্দায়।অংশু শামুকের মত গুটিয়ে থাকতে ভালোবাসে। প্রথম জীবনে তার এই স্বভাব ছিলো না।

একবার মনে আছে সুদপুর পুজো কমিটি অংশুকে বলেছিলো, আপনি তো লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আপনি যদি সপ্তমীর দিন কাটোয়ার কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে একটা দল এনে একটা অনুষ্ঠান করলে বড় ভালো হয়। আমরা পুজো কমিটির তরফ থেকে তাদের ঠিফিনের ব্যবস্থা করে দেবো। খুব ভালো হয়েছিলো অনুষ্ঠান।আর একবার পূর্ব বর্ধমানের অট্টহাস সতীপীঠে বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশু ও আরও কয়েকজন কবি সুমো গাড়িতে চেপে অট্টহাসে গিয়েছিলো। কি সুন্দর আবহাওয়া। খুব ভালো লেগেছিলো অংশুর। সর্বত্র মায়ের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।পঞ্চমুন্ডির আসনের সামনে দাঁড়িয়ে অংশু কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো।

এসব এখন বিয়ের পরে কিছুটা কমে গেছে অংশুর। এখানে সেখানে যাওয়া কমে গেছে।

সুদপুরে একটা হরিনামের দল সারা গ্রাম ঘুরতো বৈশাখ মাসে। অংশু অই দলের সঙ্গে থাকতো। সারা মাস ঘোরার পরে গঙ্গা স্নান। তারপর একদিন পাওনা প্রণামির টাকা খরচ করে নর নারায়ণ সেবা করা হতো।

এখন টিউটর অংশু কোথাও বেড়াতে যায় না। শুধু পড়ে আর লেখে। বিভিন্ন শহর গ্রাম থেকে তার কাছে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। ইদানিং একটা সমস্যা হয়েছে অংশুর। তার নামে একটা ছাত্রীকে জড়িয়ে কেউ একজন বদনাম রটিয়ে বেড়া। এখন পড়ানোটা ব্যবসার পর্যায়ে চলে গেছে। হয়ত কোনো একজন টাকা পয়সা খরচ করে পরিকল্পনা করে বদনাম রটাচ্ছে। অংশু ঠিক করলো,মেয়েদের আর পড়াবে না। তাহলে কিছুটা হলেও শান্তি পাওয়া যাবে। তা না হলে বাজারে বেরোলেই ছোড়া কথা, এই দেখ মাষ্টার চললো। বেহায়া জানে না মেয়েদের সঙ্গে এরকম করলে বিয়ে করতে হয়। আর একজন বললো,এই ও তো বিবাহিত। আবার সে বললো,ডবল বিয়ে হলে আপত্তি কি?ব্যাটার পয়সার অভাব নেই।
অংশুর এই অবুঝ মানুষগুলোকে দয়া করতে মন হয়। এদের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই। তাতে কাদা ছোড়াছুড়ি বেশি হয়। তার থেকে নীরবে এড়িয়ে যাওয়া ভালো। অংশুর লেখালেখিতে এরা খুশি নয়। রায় বাবু একদিন বললেন,কি হে তুমি নাকি লেখক। তা বাবা কত টাকা রোজগার হয়?
—না কাকু রোজগারের জন্য আমি লিখি না। আমার ভালো লাগে তাই একটু আধটু লিখি।
—-অ, বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর কি? কি হবে ভগবান, এই ভ্যাগাবন্ডদের হাতে পড়ে সাহিত্যের কি দশা।
—-তো কাকু। আপনি তো ভালো কথা বলেন। একটু লিখুন না। বংলা সাহিত্যের উন্নয়নের কথা ভেবে।
অংশু ব ল ছিলো কথাগুলো রাগে। কিন্তু কাকু ততক্ষণে পগার পাড়ে। চলে গেলেন চুপ করে। পাড়ার বেশির ভাগ লোক কিন্তু কাজে ব্যস্ত থাকেন। তারা অতশত খবর রাখে না। নিজের নিয়েই থাকে।

পাড়ার কেউ মারা গেলে শ্মশানে যাওয়া। নির্লজ্জ ভুরিভোজের বিরুদ্ধে কথা বলে নিবৃত্ত করা এইসব কাজে অংশু যুক্ত থাকতো। কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ে সারারাত জেগে রাত কাটানো, যাত্রা শুনতে যাওয়া এইসবকিছুতেই তার উৎসাহ থাকতো সর্বাধিক।কিন্তু কালের প্রবাহে একদিন সব স্তিমিত হয়ে যায় অচিরেই।

এখন অংশুর ছেলে বড় হয়েছে। তার নাম সন্তু।প্রাচীন পন্থায় মানুষ। এখন সে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে আই টি আই কলেজে ভরতি হয়েছে। বন্ধুবান্ধব হয়েছে বেশ কয়েকজন। তাদের সঙ্গে যাওয়া আসা করে। ট্রেনে যায়। ট্রেনে আসে। অংশু বল,মান্থলি কেটে নিবি। তাহলে প্রত্যেকদিন টিকিট কাটতে হবে না। খরচও কম হবে।

সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা।

মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না,চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার অবর্তমানে ভাশুরের ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা টিউটর । বড়দার তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেচেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় নয়টি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর জ্যাঠা।
তখন সন্তুর বয়স একুশ। হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়ীত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। জ্যাঠার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন জ্যাঠার ছেলেকে। চাকরী পেয়ে ওরা সবাই গোমো চলে গেলো।থাকলো সন্তু আর তার বাবা মা।

ভাগ্যক্রমে চাকরী পেলো সন্তু। বাবা অবসর নিয়েছেন।

সন্তুর বেতন কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা

ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতি। সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পরতো বারে বারে।
একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পরলো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো,কে?
—-আমি, দরজাটা খুলুন।
—–জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।
—–আমি পাপিয়া,
——এত রাতে
——আরে খুলুন না ছাই।
দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা থালা। বললো,আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়।
সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো।

বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে,ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে,বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো,আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন,ছেলেটা ভালো।যাবি প্রয়োজন হলে।

রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো,কিছু বলবে।

——-হূঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?

—–কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।

——আর পড়াতে
——দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আ মার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।

—–তাই,তাহলে ভালোই হলো।

সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে,আপনি এত অগোছালো কেন?
তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে।
সন্তু বললো,তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা
আমার কাজ করবে কেন?
—–আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?
—–না,না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গি পাবো।
—–বাবাকে বলবেন,আমি খুব পড়ি।
—–মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।

—–ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না।

——আমি এসব ভালোবাসি না।

সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়ীত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে।

পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো,কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তু কে ওর মা বলে,এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।

পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো,পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো,কি এটা।
—-পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।
—থাক,তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।
—-কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন,প্রাণ সবকিছু।
সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।

সংসারে কর্তব্য করে যায় এক জাতীয় মানুষ। তারা নিজের আবেগ,ভালোবাসা বিসর্জন দেয় সকলের জন্য। আর এক জাতীয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার ক’রে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। সন্তু এবার বাড়ির কাছে চলে এলো। খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল দশটায়।

মা খুব খুশি সন্তুর। বিয়েতে ভালো পাওনা। চাকরী পাওয়া ছেলে। কুড়ি ভরি সোনা।

সন্তুর বিয়েতে কলিগরা সবাই এসেছে। মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোনে পাপিয়ার গলা। বলছে,বজ আমার বিয়ে সন্তুদা। তুমি ভালো থেকো। সন্তু ফোনটা কেটে দিলো। কেউ শুনতে পেলে অসুবিধা হবে। মনকে শক্ত বেড়ি পরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো। বিয়ে হয়ে গেলো। শেষ রাতে অর্ধেক চাঁদের আলোয় সন্তু পাপিয়াকে দেখলো বাগানের মধ্যে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। আজ বিয়ের পরদিন। কালরাত্রি। বৌয়ের মুখ দেখতে নেই।

ফুলের শয্যায় কাঁটা। বৌ জয়ার শরীর খারাপ। সন্তুর বন্ধুরা পরের দিন বললো,নতুন অভিজ্ঞতা কেমন হলো? সন্তু বললো,ভাগ্য প্রসন্ন নয়। অপেক্ষায় আছি। বন্ধুরা হতাশ।

তারপর খাড়া বড়ি থোর,থোর বড়ি খাড়া। মামূলী জীবন। চাকরী। দিন কাবার। রাত। ভোর।রান্না।চান।জপ।খাওয়া।সাইকেল। অফিস।

মা বললেন,বোনেদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি
দুই বোনের একই দিনে বিয়ের ঠিক করেছি। তুমি লোন নাও।বৌমার গহনাগুলো দাও।মায়ের কথা অনুযায়ী সব কিছি হলো। জয়া সব সোনা দিয়ে দিলো। দুটো ননদের বিয়ে হলো।

সন্তুর এখন এক ছেলে ও দুই মেয়ে। মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রুমকি ও ঝুমকি দুই মেয়ে। রুমকি এখন ক্লাস টেনে পড়ে আর ঝুমকি সেভেনে। দুজনেই এক গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তো। রুমকি সেন্ট আপ হলো। কিন্তু ঝুমকি আ্যনুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলো। সন্তু আর জয়া খুব বকাবকি করলো। বললো,সারা বছর পড়বি না, তাহলে ফেল করবি না তো কি? গৃহশিক্ষক বললো,যা, গলায় দড়ি দেগা। ফেল করে বসে আছে। ঝুমকির মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। বাড়ির সবাই জানে কিন্তু কেউ একবারও তাকে ডাকলো না। ঝুমকি ভাবলো,কেউ আমাকে চায় না। ভালোবাসে না। সে শুনতে পেলো কে যেনো বলছে গলায় দড়ি দিয়ে মর। সব ঠিক হয়ে যাবে। কে বলছে? সে ভাবলো ঠিকই বলেছে। আমি খারাপ মেয়ে। গৃহশিক্ষক অজয় আমার যৌনাঙ্গে আঙুল দিয়ে রক্তাক্ত করে বলেছিলো,পড়াশোনা তোর হবে না। এইসবই হবে। গলায় দড়ি দেগা।

অজয়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়েছিলো। কাউকে বললে, প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলো। সেদিন তার দিদি ছিলো না। দিদিকেও হয়তো ভয় দেখিয়েছে।আবার ভাবছে, আমি মরে গেলে ওই মাতালটা আরও অনেক মেয়েকে মারবে। কিন্তু ওর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বাবা, মা পর্যন্ত আমাকে ডাকলো না। আমার খিদে পেয়েছে। একবারও ডাকলো না। ভাবতে ভাবতে তার ওড়নাটা গলায় গিঁট দিলো। খুব লাগছে। তারপর মাটির ঘরের কড়িকাঠে, ওড়নাটা, পেঁচিয়ে নিলো চেয়ারের ওপর উঠে।তারপর চেয়ারটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ঝুলে পরলো। তারপর ভাবছে। কেন করলো এই কাজ। খুব ভুল করলো। মা বাবার মুখ মনে পরলো তার।

সন্ধেবেলায় সন্তু এসে জয়াকে বললো,মেয়েটা খেয়েছে?ঘর খুলেছে?
জয়া বললো,জানিনা, যাও তুমি দেখো।

ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়েটা ঝুলছে। সন্তু ভাবে, এই সময় মা থাকলে ভালো হতো।

জয়া দেখতে এলো স্বামীকে, ধপ করে একটা আওয়াজ শুনে। এসে দেখলো,সন্তু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। জয়া দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে, ঝুলছে। বাড়ির আশেপাশে যারা ছিলো তাদের চিৎকার করে ডাকলো জয়া। লোকজন এলো।দরজা ভাঙলো। মৃতদেহ নিয়ে চলে গেলো দাহকাজে।

সন্তু আর জয়া দুবছর রাতে ঘুমোতে পারে নি। একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। হয়তো তাদের ভুলে মেয়েটা অভিমানে চলে গেলো অকালে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো সন্তু।

জয়া ভাবে তার জন্মকালের কথা। মায়ের মুখে শুনেছে,জন্মমাত্রই তাকে মৃত মনে করে বাড়ির লোকজন ফেলে দিয়েছিলো বাঁশতলায়। আঁতুড় ফেলার জায়গায়। বাগ্দীবুড়ি দেখতে পেয়েছিলো জ্যান্ত মেয়েটাকে।হাত, পা নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো কোলে। খবর ছড়িয়ে পরলো গ্রামে। তখন বাড়ির লোক এসে নিয়ে যায় মেয়ে। বাগ্দীবুড়ি নাম রেখেছিলো জয়া। ও তাদের বাড়ি এসে বলেছিলো,ও জীবন জয় করেছে। তাই ওর নাম জয়া। তারপর জয়া বড়ো হলো। কালো মেয়ে আলো রূপ নিয়ে ভরতি হলো স্কুলে। পড়াশোনায় খুব ভালো। অন্যদের থেকে আলাদা। নীরব শিল্পীর মতো তার স্বভাব। সবাই ভালো বলতো তাকে। তারপর কলেজে ভরতি হলো। কিন্তু কলেজে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হলো। তিন সন্তানের জননী হলো। কাজ হলো হাঁড়ি ঠেলা। আত্মীয়স্বজনের কাছে ভালো হবার ব্যর্থ চেষ্টা। কম বয়সে শিখলো অনেক। শক্তি জাগ্রত হলো শরীরে,মনে। সহজ পথে চলা শুরু হলো। তেল মাখানো কথাও বন্ধ হলো। শত্রু বাড়লো। তবু সে বললো,কুছ পরোয়া নেহি।

একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না,ছেলে মেয়েদের স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা,কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে বসে ঘুমে ঢুলে পরতো জয়া। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পরতো কিশোরীবেলার স্কুলের পথে আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রং বেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতো বায়েনবুড়ো কত মাছ। বায়েন বুড়োর কাছে চেয়ে একটা বোতলে ভরে রাখতো জল। আর তাতে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতো বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে নি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা পড়াতে আসতো। আমরা মেয়েরা সুর করে পড়তাম একসাথে। তারপর খাওয়ার পরে শোওয়ার পালা। ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পরতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। জয়া এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী,ছেলে,মেয়েরা চলে আসতো জয়ার স্বপ্ন নীড়ে। আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ,সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে।
সন্তু মেয়ের বিয়ে দিলো। তারপর গ্রাম ছেড়ে চলে এলো কোয়ার্টারে। গ্রামের বাড়িতে সবখানে ভেসে উঠতো মৃত মেয়ের মুখ। তাই এই সিদ্ধান্ত। কোয়ার্টারে সন্তুর মন হাঁপিয়ে উঠতো। অফিসে ছুটি পেলেই চলে যেতো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সেখানে বড়ো মেয়ের মুখ দেখে ভুলে যেতো মৃত মেয়ের মুখ। আর দুই মেয়ের মুখের আদলে দুবছর পরে ঘর আলো করে এলো নাতি। মেয়ের পুত্রসন্তানের মুখ দেখে সন্তু ও জয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো।

নাতি ও মেয়ে এসে দুমাস, তিনমাস করে থাকতো কোয়ার্টারে। এবার মন শক্ত করে সন্তু ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে। কোয়ার্টারে তার মন ভারী হয়ে যেতো। নিজেকে হারিয়ে ফেলতো বারে বারে। এবার গ্রামে এসে পুরোনো বন্ধুদের মাঝে সন্তু জীবন খুঁজে পেলো। সব কিছু স্বাভাবিক হলো।

সন্তু কাজ করতো বি,ডি,ও অফিসে। এই অফিস থেকেই গ্রামের গরীব মানুষরা সরকারী সাহায্য পেয়ে থাকে। তার প্রধান দায়ীত্বে ছিলো সন্তু। গ্রামে গ্রামে গিয়ে লিষ্ট করতো সে। গ্রামের লোকেরা খুব ভালোবাসতো সন্তুকে। কোনোদিন অন্যায়ভাবে কারও কাছে টাকা পয়সা ঘুষ নিতো না সন্তু। একবার রঘু ডাকাত বললো,আমার বাড়ি মিষ্টি, জল খান কেনে। আমি খুশি হবো। সন্তু বললো,আমাকে এক গ্লাস জল দাও। আর কিছু খাবো না। আমি এখন সরকারী কাজ করছি। এর জন্য আমি মাইনে পাই। জামাইমারি গ্রামে একবার সন্তু কাজে গেছিলো। ফিরতে রাত হয়ল গেলো। রাস্তায় দেখলো,অন্ধকারে ঝিনুকঘাটা পুলের তলায় একদল সশস্ত্র লোক। ওরা ডাকাত। কারও হাতে খাঁড়া,কারও হাতে বল্লম, কারও হাতে তীরধনুক। একজন এসে বললো,আংটি কই? সোনার চেনটাও দে। সন্তু বললো,দি,এই নাও। ওদের মাঝে রঘু ছিলো খাঁড়া হাতে। ও এগিয়ে এসে বললো,আরে ঠাকুর মশাই। আপনি। যান, যান কোনো ভয় নাই। দলের লোকদের উদ্দেশ্য করে বললো,তোরা লোক চিনিস না। আমাদের ব্লকের বড়বাবু।
সবাই জোড় হাত করে বললো,মাপ করবেন,আমরা বুজতে পারি লাই গো ঠাকুর মশাই। মদ খেয়ে আচি তো। যান, যান। কুনু ডর লাই। মজা করে হাঁটেন। কুথাও দাড়াবেন নি।

সন্তুর ধড়ে প্রাণ এলো। ঝিনুক ঘাটা পার হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলো। বাড়িতে এসে জল খেয়ে বাঁচলো।

সন্তু মায়ের কাছে শিক্ষা পেয়েছে সততার। তার জন্য আজ সে বেঁচে গেলো। মনে পরছে সন্তুর মায়ের কথা। সে আপন মনেই বলে চলেছে তার মায়ের কথা। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন ভক্তিগীত। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় রেখে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে, মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।

বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে জিম আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।

সন্তু ভাবে,মা ছোটো ভাইয়ের কাছে ভালো থাকতো। ভাইরা সবাই ভালো। শুধু আমি হয়তো খারাপ। তাই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার দেখা পাবো না। কোন যাদুগর ভ্যানিশ করে কোটি কোটি জীবকে তার আয়ু শেষে। এখন সন্তু চাকরী জীবন থেকে অবসর নিয়েছে। নাতি বড়ো হয়েছে। ছেলের বিয়ে দিয়েছে। নাতনি ঘুরে বেড়ায় বারান্দা জুড়ে। অবসর জীবনে সারা জীবনের ভাবনা এসে জুড়ে যায় হৃদয়ে। তার মনে পরছে বাল্য জীবনের স্মৃতি।

তেঁতুলতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা তেঁতুল।

আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা মজা দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে।তাল গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো তাড়ি ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। সকালের তালের রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতেসকালের তালের রস খেতে গেছিলাম। কারণ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালের রস তাড়িতে পরিণত হয়। মদের মতো নেশা হয়। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সন্ধেবেলায় হাড়ি রসে ভরে যেতো। ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। শয়তানের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। হাসি,খুশি সহজ সরল জীবন।

ছোটোবেলার কার্তিক পুজো,গণেশ পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । সেই ঘরে থেকেই আমরা ভয় দেখাতাম সুদখোর মহাজনকে।সুদখোর ভূতের ভয়ে চাঁদা দিতো বেশি করে। বলতো, তোরা পাহারা দিবি। তাহলে চাঁদা বেশি দেবো।

আমরা পড়তে যেতাম রেল লাইনের ওপাড়ে।

একদিন স্যার পড়াতে পড়াতে অনেক রাত হয়ে গেছে । প্রায় দশটা । বাড়ি ফিরতে হতো লাইনের পাশ দিয়ে ।

চারজনে ভয়ে ভয়ে লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছি । একটা ট্রেন চলে গেলো বুক কাঁপিয়ে ।

অমাবস্যা র রাতে অন্ধকার হয় শুনেছি । কিন্তু তার থেকেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি চারজন ।

হঠাৎ সামনে দেখি গলা থেকে মাথা পর্যন্ত কাটা একটা স্কন্ধ কাটা ভূত ।আমার আর অনুপের হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে ।

ছোটো থেকেই বিশুর সাহস বেশী । আমরা ভয়ে বু বু করছি । এমন সময় দেখলাম অনুপকে কে যেনো ছুঁড়ে পাশের হাই ড্রেনে ফেলে দিলো ।

বিশু দা হাঁক দিয়ে বললেন, কে রে ভয় দেখাচ্ছিস । কিন্তু ভূত কোনো সাড়া না দিয়ে থপাস করে বসে পড়লো ।

রতন দা বললেন, কে তুমি, বসে পড়লে কেনো ?

তারপর লাইনের পাথর কুড়িয়ে যেই না মারতে যাবেন তখন ভূতটা কথা বললো ।

বললো, আমি ভূত নই । আমি মানুষ ।

তারপর আমরা দেখলাম তার আপাদ মস্তক কালো জামা ও প্যান্ট দিয়ে ঢাকা ।

কালো জামার মাঝে সাদা গোল গোল ছাপ । ফলে অন্ধকারে আমরা সাদা ছাপ দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । শুধু দেহ টা ভেসে যাচ্ছে ।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে অনুপকে ছুঁড়ে ফেললো কে ?

জয়া বললো, ভয় পেলে মানুষের আপৎকালীন হরমোন বের হয় । ফলে মানুষ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য লাফিয়ে পড়ে । জয়া পাশের গ্রামের মেয়ে। তাকে আমরা এগিয়ে দিয়ে আসতাম তাদের গ্রামে।

রতনদা বললেন, আর বসে পড়ে লোক টা পেচ্ছাপ করছিলো ।আর আমরা মনে করেছি ভূত বসে পড়েছে ।

অনুপ ততক্ষণে ড্রেনের কাদা মেখে উঠে আসছে ভূত হয়ে ।

বাড়িতে গিয়ে বলার পরে সবাই হেসে ফেলেছেন ।
তারপর ভালো মন্দে কেটে যায় সময়।
অপরের ভালো কাজে বাধা দিয়ে একদল বাঁদরের দল মজা পায়। ভালো কাজ দেখলেই তাদের মাথাব্যথা। তারা সমাজের ভালো দেখতে চায় না। কারণ তাহলে তাদের অসুবিধা। গোলেমালে তাদের অনেক কাজ সহজে হয়। গোলমাল পাকাতেই তাদের পাকামি প্রকট করে আনন্দ পায়। পৃথিবীর পাকে তাদের পাকামি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভালো কাজ কিন্তু চিরদিন অমরত্ব পেয়ে যায় মানুষের হৃদয়ে।সন্তুর ভাবনার পাশে বসে আছে চিরনবীনের দল।

জয়া দেখে নাতনিকে। আর ভাবে তার ছোটোবেলা ফিরে এসেছে নাতনির রূপ ধরে। এই ভাবেই চিরকাল প্রবাহ চলে জীবনের।