গল্প: নগর ও নাগরিকের গান

নগর ও নাগরিকের গান
মো. আরিফুল হাসান
আমরা ছিলাম তিনজন আর তখন ছিলো বসন্তরাত। আমরা একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম আর সেখান থেকে একজন লাফ দিলো। আমাদের দ্বিতীয়জন যখন লাফ দিতে যাবে তখন সে আমার চোখে চোখ রেখে বললো, বিশ্বাস রেখো, আর অচিরেই আমরা মিলিত হবো এমন এক স্থানে যেখানে ব্যর্থতা আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমি তার চোখে চোখ রেখে আশ্বস্ত করলাম; সে লাফিয়ে পড়লো।
আমি দেখলাম তারা দুজনেই লাফিয়ে পড়লো এবং তাদের দুজনেরই করুণ মৃত্যু হলো। তারা আমাকে বলে গিয়েছিলো আমি যেনো সৎকার না করি এবং আমি যেনো তাদেরকেই অনুসরন করি। কিন্তু একটি চিন্তা আমার মাথার মধ্যে খেলে গেলো, Ñচিন্তাটি পরে বলছি। আমাদের মাঝে কথা হয়েছিলো যে আমরা তিনজনেই পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়বো এবং আমাদের মৃতদেহগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। ভয়ানক অরণ্যের ভেতর আমাদের লাশগুলোকে কেউ সৎকার করতে আসবে না এবং আমরা খুব সহজেই শেয়াল-সিংহের খাদ্য হতে পারবো।
তমালটা একবার গিয়েছিলো চিরিয়াখানায়। সে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলো যেনো তারা তাকে বাঘ-সিংহের খাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করে। কর্তৃপক্ষ তাকে পাগল ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছিলো এবং সেদিন তমালের মন ভীষণরকম খারাপ হয়েছিলো। নদীরপাড়ে সে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, কী ভাগ্য নিয়ে জন্মালাম, শিয়াল-কুকুরের খাদ্য হওয়ারও যোগ্যতা নেই। আমি তাকে সেদিন কোনো সান্তনা দিতে পারিনি; প্রকৃতপক্ষে আমিও ছিলাম বিধ্বস্ত, বিক্ষিপ্ত।
আমি গিয়েছিলাম রেস্টুরেন্টে; সেখানে জুই আসার কথা ছিলো। জুঁই এসেছিলো, সাথে ছিলো পলাশ। পলাশকে দেখে আমার মন খারাপ হলো। কোনো মেয়ে স্বামী নিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে আসে? একটুও কি বুদ্ধি নেই জুঁইয়ের মাথার ভেতর? ফলে আমাদের সাথে সংখ্যায় আরও একজন বৃদ্ধি পেলো এবং পলাশকে নিয়ে আমরা হয়ে পড়লাম- তিন।
আমরা প্রতিদিন সকালে হাড্ডিখোলার দিকে যেতাম এবং ফিরে এসে টাউনহলের মাঠে ঘুমিয়ে যেতাম। রোদ যখন চড়তে থাকতো তখন আমাদের দেহের ঘামে ভিজে যেতো সবুজ ঘাস। আমরা তখন উঠে ভ্রাম্যামান দোকানটাতে চা খেতাম এবং মাঝে মাঝে তমাল একটি বনরুটি খেতো। আমাদের চা খাওয়া শেষ হলে আমরা ইদগাহ মাঠে চলে যেতাম এবং সেখানে কিছুক্ষণ বালকদের ফুটবল খেলা দেখে তারপর যেতাম ধর্মসাগর পাড়ে।
ধর্মসাগর পাড়ে একদিন তমাল এক পতিতার খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজে দিয়েছিলোÑ সেটি ছিলো কাঠগোলাপ। পতিতাটি কোনোকিছু মনে করার চাইতে তার দালাল তার উপর ক্ষেপে গেলো বেশি। সে তমালের গায়ে হাত তুলতে চাইলো এবং আমরা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এলাম। তমাল এরপর থেকে আর পতিতাদের খোঁপায় কক্ষনো গোলাপফুল গুঁজে দেয়নি এবং এটি সে সতেচতনভাবে করে গেছে।
পলাশের আমাদের সাথে যোগ দেয়াটা নাটকীয় এবং বিস্ময়কর! একদিন সে আমাদের কাছে এসে বললো, জুঁইকে ডিভোর্স দিয়ে এসেছি এবং আমি এখন থেকে তোমাদের দলে মিশতে চাই। সেই থেকে আমাদের জীবনে জুঁই চাপ্টার ক্লোজ হলো এবং মাঝে মাঝে মনের কোণে উঁকি দিলেও তাকে জোর করে লুকিয়ে রাখতাম। আমরা ছিলাম প্রাণহীনÑ বস্তুত সবাই ছিলাম মৃত্যুপুজারী এবং আমাদের কোনো গন্তব্য ছিলো না।
জুঁই যে আমার জীবনে আসবে না সেটি বুঝতে পেরেছিলাম দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সপ্তাহে। জুঁই চুলে একগাদা মালা জড়িয়ে ক্যাম্পাসে আসলো এবং সবার সামনে আমাকে চুমু খেলো। সহপাঠীদের চোখ তাজ্জব হয়ে গেলে আমি তাদের বলেছিলাম, এই জুঁই কখনো আমার হবে না এবং অবশেষে তাই হলো।
আমি ক্যাম্পাস ফেলে চলে এলাম এবং আর কখনো বইমুখো হইনি। বই মানে পাঠ্য বই, মানে অনার্সক্লাসে যেসব বই পড়ানো হয় সেসবের কথা বলছি। তাছাড়া অন্যান্য বইপত্র আমি ঠিকই পড়েছি যেমন মাসিক কালি ও কলম, ছোটরা গণগ্রন্থাগারের বইপত্র কিংবা টাউনহল লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তাম।
পলাশকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার এমন আচমকা পরিবর্তনের মানে কী? পলাশ আমাদের জানিয়েছিলো যে সে এসবকিছু বলতে চায় না এবং সে পুনরাবৃত্তি করতে চায় না কোনো মনখারাপ করা দৃশ্যপট। আমি বললাম, যাবার সময় কি জুঁই খুব কান্না করেছিলো? না! একদমই না Ñসে বললো। সে বললো যাবার সময় জুঁই খুব স্বাভাবিক ছিলো এবং সে মিষ্টি করে হাসছিলো। আমি বুঝতে পারলাম এ হাসিটা সেই হাসি যে হাসি দিয়ে সে একদিন আমাকে ক্যাম্পাসে সবার সামনে চুম্বন করেছিলো।
তমালের ব্যাপারটা আলাদা। সে মা-বাবা হারা আজ বারো বছর। ভাইয়েরা তার সম্পদ কেড়ে নিয়েছে ফলে সে শহরে ভাসমান। আমাদের বন্ধু বলে আমরা তাকে ফেলে যেতে পারি না এবং দিনরাত্রির অধিকটা সময় আমরা একসাথেই কাটাই। আমাদের ঘুম অথবা খাওয়াদাওয়া এগুলোর প্রায়ই কোনো নিয়ম থাকে না এবং আমরা যা পাই তাই খাই যেখানে ঘুম পায় সেখানে ঘুমিয়ে পড়ি।
তমাল গিয়েছিলো চাকরির জন্য। আমি তাকে বললাম, তুমি কি দাসপ্রথাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছো নাকি বিলীন করতে। সে বলেছিলো বিলীন করতে। এবং সে কিছুদিন চাকরিটা করেছিলোও। আমরা ভাবতাম, যাক তমালটার একটা গতি হলো আর তমালটা ভাবতো আমরা দুজন কী মৌজেই না আছি। আমরা তমালের কথা ভাবতে ভাবতে অপেক্ষা করতাম, তমালটা সন্ধ্যেবেলা চাকরি শেষ করে আসতো আর আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম। তখন তমাল আমাদেরকে চা পানি খাওয়াতো এবং আমরা সারাদিনের দূরত্ব ভুলে যেতাম।
তমালের চাকরিটা টিকেনি এটি ঠিক নয়, তমাল চাকরিটা করেনি। একদিন সে অফিসের একটি হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিলো এবং এমন সময় তার মালিক এসে মেজাজ দেখাতে শুরু করলো। তমাল আর স্থির থাকতে পারেনি সে চাকরিটা ছেড়ে চলে আসে। আমার কাছে এসে প্রশ্ন করে, আচ্ছা, চাকরিটা যদি আমি না করি তাহলে কী হবে? কিছুই হবে না। Ñনির্লিপ্ত উত্তর দিলাম আমি। সেও আমার কথা বিশ্বাস করলো এবং তারপর থেকে আর চাকরির জন্য চেষ্টা করেনি।
একসন্ধ্যায় আমরা দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম এবং দূরে কোথাও। আমাদের সাথে তখন ছিলো কাফকার বই এবং ক্রাইম এÐ পানিশম্যান্ট আমাদের বগলে ধরা ছিলো। পলাশ সেদিন পড়ে এসেছিলো নেমেসিস এবং তার মনে হতে থাকলো নাটকা এবার শেষ হওয়া উচিত। আমরা তিনজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা দূরে কোথাও চলে যাবো এবং এই নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি চাই আমাদের।
আমরা শেষবারের মতো আমাদের পরিকল্পনা নিশ্চিত করে নিলাম এবং আমাদের যাবার দিনক্ষণ ধার্য্য হলো। আমরা যেতে পারলাম না এবং এই ব্যর্থতা আমাদেরকে আরও বেশি বিধ্বস্ত করে গেলো। আমরা তখন চিন্তা করলাম তাহলে কি মুক্তি নেই আমাদের? তাহলে কি সব দরজা বন্ধ? কোনো দরজা দিয়ে পালানোর পথ কি অবশিষ্ট নেই। আমরা চিন্তিত হলাম এবং বিহŸল হলাম এই ভেবে যে আমাদের আসলে মুক্তি নেই।
তারপর আমরা অনেকদিন একইরকম কাটিয়েছি। সেই রাত করে বাসায় ফেরা এবং নির্ঘুম দুতিনঘন্টা গড়াগড়ি খেয়ে আবার সূর্য উঠার আগেই বেরিয়ে পড়া। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটলো একদিন। পলাশের ফোন না পেয়ে আমরা পলাশের বাসায় গেলাম এবং দেখলাম সে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পাশেই দেখলাম ক্লোরনের খোলা পাতা এবং পরপর বিশটি ট্যাবলেট সে গতরাতে খেয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম পলাশ মারা যাবে এবং সে শীঘ্রই এমন এক স্থানে পৌছোবে যেখানে তাকে হতাশা বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারবে না।
সে মারা যায়নি। আমরা তিনদিন হাসপাতালে থেকে তাকে সুস্থ্য করে নিয়ে এলাম। কিন্তু সে মারা যাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আমরা তাকে বোঝাতে গেলাম না কারন আমরাও মরতে না পারার দুঃখে মনে মনে মরে আছি। পলাশ গিয়েছিলো এরপর নদীতে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু ঝাপ দেয়ার পর মনে হলো সে তো সাঁতার জানে। তীরে ফিরে এসে সে জীবনের প্রতি আরও বেশি ঘৃণাবাদী হয়ে উঠলো এবং তাকে প্রায়সময় পাগলের মতো বিভ্রান্ত দেখাতে লাগলো।
তমাল বলেছিলো, মরবার অধিকারও কি আমাদের নেই? আমরা কোনো কথা বললাম না এবং আমাদের মাথা ছিলো নিচু আর ঘাসে ছিলো দৃষ্টি আবদ্ধ। আমরা জগৎযন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাইছিলাম কিন্তু আমাদের সামনে কোনো রাস্তা খোলা ছিলো না। ছুটির দিনগুলোতে আমাদের কোনো বিশেষ প্লান বা প্রোগ্রাম থাকতো না কারন আমরা ছিলাম বারোমাসি ছুটির অন্তর্ভুক্ত। ফলে প্রতিটা দিন আমাদের কাছে বিরক্তিকর লাগতো এবং আমরা প্রার্থনা করতাম দ্রæত যেনো দিনটি ফুরিয়ে যায় এবং রাত নামলে প্রার্থনা করতাম আর যেনো ভোর না আসে।
আমাদের প্রার্থনা কবুল হলো কিনা জানি না। একদিন তমাল একটি উৎকৃষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হলো। সে বললো, যে পতিতাটির খোঁপায় সে কাঠগোলাপ ফুল গুঁজে দিয়েছিলো সে তাকে বিয়ে করতে চায় এবং পতিতাটিও তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে। তমালের প্রস্তাবটি হলো আমরা যেনো তার বিয়ের দিন আত্মহত্যা করি এবং এ বিষয়ে সে আমাদেরকে সাহায্য করবে। তার পরের প্রস্তাবটা আরও বেশি মারাত্মক, সে বললো, তোমাদের মাংস দিয়ে আমি অথিতিদের আপ্যায়ন করবো এবং সব শেষে তোমাদের মগজ চুষতে চুষতে আমিও আত্মহত্যা করবো।
তমাল সেটা পারেনি। পতিতার দালাল তাকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিলো এবং আমরা বিয়ে বাড়ির ভোজ হতে না পারার দুঃখে আবারও উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে লাগলাম। তমালের অবশ্য এ জন্যে মন খারাপ হয়নি সে আমাদেরকে শোনালো আরও করুণ কোনো কথা। সে বললো, আসলে পতিতাটি অন্য শহরে যায়নি এবং সে পৃথিবীর বুকে বেঁচেও নেই। আমাদের তাজ্জব লাগলো তার কথা শোনে। আমরা জানতে চাইলাম, তুমি কীভাবে জানলে? সে আামদের উত্তর দিয়েছিলোÑ স্বপ্নে দেখেছি।
এরপর আমাদের মনে পড়লো জুঁইয়ের কথা। জুঁই কেমন আছে এখন? সে কোথায় আছে? কিন্তু কোনো খোঁজখবর না পেয়ে আমরা জুঁইয়ের প্রসঙ্গে বেশিক্ষণ নিবিষ্ট থাকতে পারলাম না। আমাদের পরবর্তী কথা হলো পলাশের ভবিষ্যৎ বাচ্চা নিয়ে। ডিভোর্সের সময় জুঁইয়ের পেটে পলাশের বাচ্চা ছিলো এবং সে জুঁইকে অনুরোধ করেছিলো বাচ্চাটিকে নষ্ট করে ফেলতে। কিন্তু জুঁই নাকি রাজি হয়নি। সে জানিয়েছে, বাচ্চাটি তার নিজের পরিচয়ে বড় হবে। পলাশ বলেছিলো, এতোদিনে হয়তো পৃথিবীতে বাচ্চাটি প্রথম আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে। সে একটি নবজাতকের এই যন্ত্রণাময় পৃথিবীতে পরিভ্রমনের বিষয়টিকে খুব দুঃখের সাথে দেখলো।
আমাদের সর্বশেষ পরিকল্পনা হলো আমরা পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা বান্দরবনের আইয়াং তøং পাহাড়ের কাছে পৌঁছালাম কারন আমরা জানতাম তাজিংডং সর্বোচ্চ উচ্চতার হলেও সেখানে দর্শনাথীদের ভীড়ভাট্টা লেগে থাকে। আমরা আইয়াং তøং পাহাড় বেয়ে উঠছিলাম এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছিলাম। পলাশই সবচেয়ে আগে পড়বে সিদ্ধান্ত হলো। আমাকে দেয়া হলো শেষে, কারন তারা মনে করে আমার জীবনে আসলে বড়সড় তেমন কোনো দুঃখ নেই। তাই প্রাণের বন্ধুদের চোখের সামনে মরতে দেখে যে দুঃখ পাবো আমি যেনো সেই দুঃখে আত্মহত্যা করতে পারি।
আমরা পাহাড় বেয়ে উঠছিলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়। আমরা পাহাড়ের অর্ধাঅর্ধি এসে ভাবলাম কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া যেতে পারে এবার কারন ভুমি ও আকাশের মাঝামাঝি এই পাহাড়ের বুকে ঘুমানোর আর কোনো সুযোগ পাবো না আমরা। আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম এবং গভীর ঘুম থেকে জেগে দেখলাম রাত মধ্যরাত হয়ে গেছে। আমরা ভাবলাম, মৃত্যুর জন্য এই তো উৎকৃষ্ট সময়। আমরা চাঁদের আলোতে পাহাড় বেয়ে চূড়ায় উঠলাম এবং প্রথম পলাশ লাফিয়ে পড়লো। তার পতনের ঝপাৎ শব্দ অনেক নিচে থেকে আমাদের কানে এসে পৌঁছলো। ঝিলিক দিয়ে উঠলো তমালের চোখ। সে আমার চোখে চোখ রেখে বললো যেনো বিশ্বাসঘাতকতা না করি এবং সেও লাফিয়ে পড়লো।
আমি যে চিন্তাটির কথা পরে বলবো বলেছিলাম সেটি আর এখন বলবো কিনা ভাবছি। কারন, আমার পরিকল্পনাÑআমার চিন্তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আমি ভেবেছিলাম পাহাড় থেকে নেমে যাবো এবং খুঁজে বের করবো আমার দু বন্ধুর মৃতদেহ। কিন্তু পরক্ষণেই তমালের শেষকথাগুলো আমার কানে বাজতে থাকলো। আমি চিন্তা ও অচিন্তার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকলাম। হঠাৎ আমার চিন্তা-পরিকল্পনা সবকিছুকে গুলিয়ে দিয়ে সেখানে আবির্ভাব হলো পলাশ এবং তমালের। আমি দেখলাম তমালের হাতে একটি খড়্গ আর পলাশ ধরে আছে হাতে একমশাল আগুন। তারা আমাকে বলছিলো যে তোমার গলাকেটে তোমাকে পুড়িয়ে দেয়া হবে। আমি প্রাণপণে না না করছিলাম কিন্তু তারা আমার কথা শুনছিলো না।
পাহাড়ের কোলে একটি ঝোঁপের ভেতর আমাদের মরদেহ তিনটি পড়ে আছেÑ থেতলানো, বিধ্বস্ত। রাত প্রায় শেষ হতে চললো। একটা হায়েনা এসে আমাদের চারপাশে একবার ঘুরলো। তারপর আকাশের দিকে মুখ করে গভীর শোকের কণ্ঠে গগনবিদারী ডাক ডেকে উঠে। মুহুর্তেই সেখানে আরও তিনচারটি হায়েনা এসে জড়ো হয়। তারা আমাদেরকে খাবে কিনা বুঝতে পারছি না। কিন্তু না, খাবার কোনো আয়োজনই দেখলাম না তাদের মধ্যে। তারা আমাদেরকে ঘিরে বসে থাকলো। আমি হায়েনাগুলোর চোখ থেকে পানি পড়তে দেখলাম। তখন সুবহে সাদেকের আগের মুহুর্ত। প্রথম হায়েনাটি- যেটি আমাদেরকে প্রথম দেখেছিলো, সেটি তার অন্য সাথীদেরকে ডেকে বললো, আসলে মৃত্যুর সাথে কেউ কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না; কক্ষনো না।