গল্প: অধরা

অধরা
শামীমা সুলতানা
সেদিনের কথা আজও ভোলে নাই নীরু। সকালের সৌম্য কুসুম রোদে মেহেদী রাঙা বাসন্তি শাড়িতে তাকে হলুদিয়া পাখির মতোই লাগছিলো। তাদের কলেজে আজ নবীনদের আড়ম্বরপূর্ণ অভ্যার্থনার আয়োজন। সেখানে বরণডালা হাতে নাচতে হবে নীরুকে। এতোদিনের সাদা রঙের কলেজ ড্রেস পড়া সাধারণ এক তরুণী আজ হঠাৎ করেই মোহনীয় রূপে চমক জাগায় মঞ্চের আনাচে কানাচে । উথলে ওঠা তারুণ্য এক ঝাঁক নক্ষত্রের আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছিল মঞ্চ। সে সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে একটা আকাশ লাগে। এক সমুদ্র কালির খোঁচায়ও শেষ হবে না সৌন্দর্যের ধারাপাত। অনুষ্ঠান কাভারে ছিল বেসরকারি টিভি রেডিও। ক্যামেরার ঝলকে ওঠা ফ্লাশে রূপের চমক ছড়ায়। বৈদ্যুতিক শক খায় অনেকেই। এমন পাগল করা নয়ন পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই।
এই শুভ্র সকালটাতেই তৈরি হয়েছিল এক মহাকাব্য। তৈরি হয়েছিল মহাজাগতিক নতুন নক্ষত্রঘেরা আরও একটি পৃথিবী।
তারপর এগিয়ে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। কতো নক্ষত্রের পতন ঘটেছে উল্কাপাতে। নতুনের আনাগোনায় শূন্যতা ভরে গেছে বৃক্ষাদির।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এক হিম প্রভাত
নীরু হাঁটছে। তার এক মূঠোয় কচি নরম হাত। আরেক পাশে সুদর্শন স্বামী। পাশাপাশি তিনজন বেলাভুমির হাওয়ায়। কচিমুখে খলবলিয়ে কথা বলে। অজানা পৃথিবীর সব জানা চাই তার।দুইজনে জবাব দেয়।কখনো ঢেউ গোনে। আবার শামুক ঝিনুক কুড়িয়ে নেয় অঞ্জলিতে।
ঢেউয়ের ছোঁয়াছুঁয়ি ভালো লাগে নীরুর। আহ! কী সুখ! কী তৃপ্তি! বালির বলয়ে পা দুটো ঢেকে দিয়ে চোখ বুজে শোনে সাগরের গর্জন। এই সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখার নয়। সকল ইন্দ্রিয় দিযে অনুভবে ছুঁতে হয়।
স্বামীর হাতটা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সাগরের বিশালতায় ডুব দেয় নীরু। হিমেল হাওয়ায় শ্বাস টানে জোরে জোরে। বালি কাঁকড় ক্ষুদে শামুক ঝিনুক পা ছুঁয়ে দেয়। নীরুর মনে হয় সেই চুম্বন।যে চুমুতে তার শরীর শিহরিত ছিল।যে চুম্বনকে ছুঁয়েছিল প্রথম যৌবন। ফ্লাশব্যাকে ফিরে ফিরে দেখে সেই অতীত।
এই সেই স্বপ্ন। যে স্বপ্ন দেখেছিল এক যুগ আগে। যে স্বপ্নের রূপকার সেই সাংবাদিক।বাতাসের গোঙানিতে কানে কানে জানিয়ে যায় সেই সব স্মৃতিময় দিন।সাগরের গর্জনে আর ঢেউয়ের ঝাঁপটায় শরীর দুলে দুলে ওঠে।খুলে যায় স্মৃতির কপাট।ভেসে ওঠে প্রিয় কিছু দৃশ্য একটা মুখচ্ছবি। সাগর আরও কাছে আসে। ঠিক তার বুকের বা’পাশে। ভিজিয়ে দেয় বুক মুখ চুল।ভিজে যায় চোখ। সাগর ধুয়ে দেয় সেই অশ্রু। ছোট ছোট ঢেউ এসে খেলা করে খালি পায়ের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে। মুঠিবদ্ধ হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে নীরু। মুঠিবদ্ধ দুই জন তার সবচেয়ে আপনার জন।। তবুও বুকের মাঝে মুচড়ে ওঠে ক্রন্দন। সাগর গর্জে ওঠে বারবার।নোনাজল উপচে পড়ে চোখ বেয়ে। নুয়ে পড়া অতীত, ভেজা ভেজা মন ধুয়ে ফেলে নীরু। আজ তার মুক্তির দিন। আজ তার বন্দী মন উড়িয়ে দেয় মেঘের ভেলায়।
এভাবে কেটে যায় বেশ অনেকটা সময়। সুর্যটা আগুন গরম তেজ ছড়ায়। তেজ ছড়িয়ে পড়ে সাগরের ঠাণ্ডা হাওয়ায়। গরম শুষে নিয়ে তপ্ত হয় বাতাস।ঘেমে নেয়ে ওঠে ওরা তিনজন।
নীরু ধাক্কা পেয়ে জেগে ওঠে।
চল এবার–নিপুণ আলতো করে ধাক্কা দেয় জমে যাওয়া নীরুকে।
নিপুণ ওর স্বামী।
অনেক অনেক ভালবাসে তাকে। নিপুণের পাগল করা ভালোবাসায় নীরু ভুলতে চায় অতীত। বাঁচতে চায় কচি মুখের এই সন্তানকে সাথে নিয়ে।
নীরু নিপুণ আর ছেলে নির্ঝর। আজ ওরা হাঁটছে। পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে হাঁটছে ।আজ ওরা ইনানী বীচের এবড়ো থেবড়ো পাথর টপকায়। পাথরের তলে চাপা দিয়ে যায় অতীত বিষণ্ণতা।
হঠাৎ চোখ আটকে যায়।
নীরু থমকে দাঁড়ায়।
ধাক্কা খায় নীরু।
এখান থেকে কী পালাবে? নাকি একবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে নীরু। নিজের সুখের সংসারটা দেখাবে? নাকি শাতিল দম্পতির আলো ঝরা হাসির আড়ালে মুখ লুকাবে সে?
ইচ্ছে জাগে,প্রবল ইচ্ছে জাগে বন্য হবার|। প্রতিহিংসা জেগে ওঠে নীরুর মনে।
শাতিলকে ঝাঁকি দিয়ে জানাতে চায়। একটা বড় রকম নাড়া দিয়ে ওর পৈশাচিক বিবেককে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
কয়েক গজ দূর থেকে নির্বাক চেয়ে দেখে নীরু। শাতিলের প্রিয়তম স্ত্রী সন্তান আর শাতিলের বিষে ভরা চোখ দুটো দেখে এক দৃষ্টিতে।
শাতিল সামনে তাকায়।আচমকা ভূত দেখা দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়ায়। চার চোখের পলকে থমকে যায় রক্তের গতি।
নীরুর চোখে বিজয়ীর হাসি। নির্বাক দৃষ্টিতে বলা হয়ে যায় সব। ঘৃণার আগুন ছিল ওই চোখে। ভস্ম হয় শাতিল।
ম্রিয়মাণ বিবেকের কারাগারে বন্দী হয় শাতিল। ছেলেটার চোখে মুখে তার কৈশোরের আদল।।শাতিলের কৈশোরকালীন ডুপ্লিকেট।
নীরু সব হতাশা ঝেড়ে দেয় ইনানী বীচের ওই এবড়ো থেবড়ো পাথরে বসা পাথর বুকে। বীরদর্পে হেঁটে যায় গ্রীবা উঁচিয়ে।
শাতিল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে থাকে।পদঙ্কিত বীচে নীরু দম্ভভরে চিহ্ন আঁকে। সেই পদচিহ্ন বীচে নয় এঁকে যায় শাতিলের বুক জুড়ে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখি আজ নীরু। এক হাতে স্বামী আরেক হাতে সন্তান। হাসছে মুখ হাসছে মন।খোলা চুলের সুবাস উড়ছে বাতাসে। সুগন্ধের ঝাঁপটা লাগে শাতিলের মুখে।সেই গন্ধে ওলট পালট হয় ওর জীবন, দাম্পত্য। ওই কিশলয় হাসি ফিরে পেতে বার বার সেই কলেজ প্রাঙ্গন খোঁজে। পুরনো এ্যালবাম ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজতে থাকে সোনালী সুখ।খুঁজতে থাকে নীরুর ভালোবাসায় ভেসে যাওয়া অতীত।নিখাদ প্রেম আর ওর নিজের প্রবঞ্চনার কালিমাময় অধ্যায়। শাণিত কষ্টে হৃৎপিণ্ডে রক্ত ঝরে।
নীরু শাতিলের উষ্ণ ভালোবাসার জোয়ার জলে তৈরি হয়েছে এক মানব ভ্রুণ।সে খবর লোকচক্ষুর অন্তরালে অধরা থেকে গেল।