গল্প:আশেপাশে কেউ আছে

আশেপাশে কেউ আছে
অরূপ পালিত
সাকিবের রেলওয়ের চাকরির বয়স সবে মাত্র পাঁচ বছরে পড়েছে , বর্তমানে উনি সহকারী চালক পদে আছেন, কিন্তু এই পাঁচ বছরে একা কোনো সময় চালকের আসনে বসেননি।
সাকিব কে ওস্তাদ অভয় দিলেন , হাত শক্ত হয়েছে এখন তোমার, আর কোন সমস্যা নেই। জীবনের এই প্রথম চালকের আসনের দায়িত্ব ,আর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা ,অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষটির কাছে গর্ব করে বলতে পারা , সব মিলিয়ে আনন্দে আত্মহারা মন !
গত ঈদে অনু কে নিয়ে কোন দিকে বের হয়নি বলে সে রাগ করেছিল। সাকিব ভেবে রাখেন আজকের শুভ খবর টি , কোন শপিংমলে নিয়ে গিয়ে কফি খাওয়ানোর পর দিবে।
মনে মনে ভয় ও কাজ করছে, সাকিবের মায়ের হুকুম, এইবার চট্টগ্রামে পা রেখে অনুর বাবার সাথে দেখা করতে হবে।
অনুর সৎ মা অনুর বিয়ের জন্য অন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছেন , অনুর মা’র ইচ্ছে উনার বোনের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। কারণ বোনেরা চট্রগ্রামের মাদার বাড়ির স্থানীয়, ছেলের বংশগত টিনসীটের ব্যবসা আছে।
অনুকে সাকিবের মা’র খুবই পছন্দ , মনে মধ্যে ছেলের হবু বউ ওর জন্য সবকিছু ঠিকঠাক, পারছেন না শুধু অনু কে তুলে নিয়ে আসতে।
অনুর ডাক নাম অপর্ণা , উনি আদর করে অনু বলে ডাকেন।
উনার এক কথা অনুর মা’র কাছে যাবেন না, অনুর বাবাকে ভালো লাগলে ও অনুর মাকে সাথে পছন্দ না। অপর্ণার বাবা ও ষ্টেশনের মাষ্টার , থাকেন মাদারবাড়ি রেল ক্রসিং এর পাশে।
ঈদে কাজের চাপে সাকিবের সঙ্গে অনুর বেশ কয়েকদিন কোন যোগাযোগ নেই।
সকাল থেকে কয়েক বার অনুকে ফোন করা হয়েছে, অনু রিসিভ করে নি, মনে হয় মায়ের ভয়ে মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছে ,সময় করে পরে ফোন দিবে।
এই দিকে সাকিবের মায়ের হুকুম ,ষ্টেশনে এসে আগে যেন মাকে ফোন করে, কিন্তু মা ও ফোন রিসিভ করে নি, মনে হলো় ঘুমিয়ে পড়েছে।
রেলটা চট্টগ্রামে ষ্টেশনে ঢুকতেই প্রায় পোণে বারটা বেজে গেছে , বিকেল থেকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়, কদমতলী ক্রসিংয়ে ঢুকতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে , রেলের আলোয় দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, এক মহিলা রেললাইনের উপরে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
অনেকক্ষণ হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করে কোন লাভ হচ্ছে না , কাছে যেতে মনে হচ্ছিল মেয়েটার এক পা ক্রসিং এর লাইনের মাঝখানে আটকে আছে , নিচু হয়ে দুইটা হাত দিয়ে পা টা তুলতে চেষ্টা করছে। উল্টো করে আছেন বলে চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় ব্রেক ধরা সম্ভব নয়, ব্রেক ধরতে গেলে কয়েক হাজার যাত্রীর প্রাণ ও যেতে পারে, হর্ন বাজিয়ে চোখ বন্ধ করে রেল ষ্টেশনে ১ নং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আসছে। রেল থামাতে
মূহুর্তের মধ্যেই সাকিবের প্রাণ টা হু হু করে কেঁদে উঠলো , প্রথম দিনে কোন নিষ্পাপ প্রান কেড়ে নিয়েছে কে জানে।
ষ্টেশনে পৌঁছে আর দেরি করেননি সাকিব , মনের ভেতর অপরাধ বোধ কাজ করছে , মনটা খুবই অস্থির হয়ে উঠলো , মোবাইল টর্চের লাইটটা জ্বালিয়ে দ্রুত রেল ক্রসিংয়ে চলে আসে।
ক্রসিংয়ে এসে সাকিব কোনো কাঁটা লাশ দেখতে পেল না , অবাক হয়ে যায়।
এমন জোরে বৃষ্টি ও না, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে চলে গেলে ও লাশটি তো থাকার কথা।মোবাইল টর্চের আলো দিয়ে অনেক্ষণ ধরে,রেল লাইনের এইদিক – সেদিক খেয়াল করলো , কুকুর বা অন্য কিছুতে লাশ নিয়ে গেছে কি না সন্দেহ হচ্ছে ।
লাশ দেখতে না পেয়ে ষ্টেশনে দিকে আবার চলে আসছে, এমন সময় কানে সাকিবের পায়ে পায়ে নূপুর এর শব্দ আসছে, সাকিব অবাক হয়ে যায় ওর পায়ে নূপুর বাজে কি ভাবে। মোবাইলের চার্জ ও যেন শেষ হয়ে আসছে, পেছনে সাহসে কুলায় না যে দেখতে , পায়ের নিচে মোবাইল টর্চের আলোতে অন্য লোকের ছায়া দেখতে পেল। সারা শরীর পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল।
মেয়েলি কণ্ঠ সাকিবকে বললো আমাকে একটু আলো দেখান না , কন্ঠটি কেমন পরিচিত। গাঁড় গুড়িয়ে দেখল অনু , হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সাকিব।
:এতো রাতে তুই একা কোথায় যাচ্ছিস?
বাবা এখন ও আসেন নি , অপেক্ষা করছি।
: সাকিব চেঁচিয়ে উঠলো, বাসায় চল কাল সকালে তোর মা’র সাথে বোঝাপড়া হবে।
অনু সাকিবের রাগ দেখে জড়িয়ে ধরে,মিষ্টি হেসে উঠে বলল, তুমি আসবে সেটা তো আমি জানতাম ,তাই এতরাত্রে অপেক্ষা করছি।
:তোর বাবা আসতে দেরি হবে , আজকে সব ট্রেনএর শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। তোকে বাসায় দিয়ে আমি উনাকে নিতে আসবো চল।
অনু সাকিবের হাতটা ধরে বলল,তোমাকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি ,আমার অনেক কথা জমা আছে, সবার সামনে বলতে পারি না।
: না বাসায় চল , এই রাস্তায় খারাপ লোকের চলাফেরা করে,এখন পুলিশে দেখলে আমি তোকে নিয়ে বিপদে পড়ে যাব।
: কোন বিপদ নেই , আমি তো এখন তোমার হবু বউ।
অনুর অনুরোধে হাতটা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পরে, সাকিবের মনে দুষ্টমি চলে আসে।
অনুকে বলে এখন আমি যা চাই তোকে তাই করতে পারি, তুই সেটা বুঝতে পারছিস।
অনু হেসে বললো কে মানা করেছে তোমাকে।
সাকিব হতভম্ব হয়ে যায়, যে অনু শরীরে হাত লাগলে চোখ বড়বড় করে , সে অনু কি বলল।
সাকিবের পরিক্ষা করতে ইচ্ছে করলো, অনু কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, অনু ও জরিয়ে ধরতে দ্বিধাবোধ করেনি, অনু কানে কানে বলল আমার কষ্ট হচ্ছে , আজ এতটুকু তে থাক।
এই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে দু’জনেই ভিজে গেছে, অনুর কাপড়ের আঁচল দিয়ে সাকিবের মুখটি মুছে দিয়ে ,দুই গালে দুইটা চুমু দেয়।
অনুর এমন আচরণে সাকিবের কেন যানি সন্দেহ লাগে। মোবাইলের চার্জ ও শেষ। ঘড়িতে তখন পোনে তিনটা , এতক্ষণ সময় কখন যে় পার করছে , নিজেরা্ও জানে না। অনুর গাঁড় ফিরাতে গিয়ে হাড়ের মট মট আওয়াজে সাকিবের গা শিউরে উঠলো ,
সাকিব অনুকে বলল বাসায় চল ,আমার ভয় করছে,আর আমার মা যদি শোনেন , এতো রাতে তোকে নিয়ে এই রেল লাইনে হাঁটছি বকা দিবে।
: আমি তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব না , মা আমাকে তোমার সাথে এই অবস্থায় দেখলে বকাবকি শুরু করবে।আমাকে আমার বাসার সামনে দিয়ে আস , বাবা আসলে একসাথে বাসায় যাব।
সাকিব জানে অনু একটু জেদি টাইপের , যেটা বলে সেটা করতে হয়। মনে মনে চিন্তা করে আজ চাঁদরাত , মার্কেটিং এর জন্যে চারদিকে মানুষের আনাগোনা, অনুকে বাসার সামনে রেখে চলে আসবে , এমন সময় কোথায় থেকে একটা বেলি ফুলের সুবাস আসছে ,অনু সাকিবের হাত ধরে বলল আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে, তুমি যাচ্ছ দেখে আমার কান্না পাচ্ছে।
সাকিব অনুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলল, তুমি অন্ততঃ কাপড় চোপড় বদলে আস , আমি ও আসছি।
:তোমার এতরাত্রে আর বের হতে হবে না, মা দেখ গিয়ে তোমার জন্য না খেয়ে বসে আছেন।
সাকিব বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে মাকে বলে মা খাবার দাও, আমি একটু রেয়াজউদ্দিন বাজারে যাব , কারো জন্য কিছু কিনতে পারিনি।
অনুদের জন্য কিছু লাগবে মা ?
মা ভাত দিয়ে বললেন, তুই খেয়ে উঠ , তোর সাথে কথা আছে।
সাকিব খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে মায়ের পাশে বসে , তখন মসজিদে ফজরের আযান দিচ্ছে।
: মা আমি কি মার্কেটে যাবার সময় অনুকে কি নিয়ে যাব।
সাকিবের মা সাকিবে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, সাকিবের ভেতরটা কেমন যেন হচ্ছে , আমার সব শেষ রে বাপ, ওই ডাইনি টা আমার আদরের বৌমাকে মেরে ফেলেছে , আমি ওকে জেলের ভাত খাওয়ায় ছাড়বো।
সাকিবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, হাত পা অবশ হয়ে আসছে, কিছুক্ষণ আগে অনুর সাথে কথা বলেছে, এইসব কথা মাকে কিভাবে বলবে।
: মা তুমি কান্নাকাটি না করে খুলে বলবে কি হয়েছে ?
: আজ তিন দিন হল অনু সন্ধ্যার সময় ওর বাবাকে ষ্টেশন থেকে আনতে যায়, উনি চোখে কম দেখতেন । সারাদিন বৃষ্টি ছিল , পিছলে পড়ে অনুর একটি পা রেললাইনের মাঝে আটকে পড়েছিল, রেল দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসলে অনু সেখানে কাঁটা পড়ে , রেলের এমন আইন মেয়েটার লাশ নিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক। তোকে জানাতে চাইলে অনুর বাবা অনুরোধ করেন না জানাতে।
আজ সকালে লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
সাকিব ঘর থেকে কখন বেরিয়ে আসেন, সাকিবের মা ও টের পায় নি।
কি অদ্ভুত অনুকে সাকিব যেখানে রেখে গেছে , সেখানে খালি বাড়ি , পাশে নতুন খবর , সাকিবের বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে, চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সাকিব, কিন্তু এই ভোরের সকালে কেউ নেই কোন দিকে, একটা বাতাস এসে সাকিবকে বুঝিয়ে দিল , অনু নিশ্চয় ওর আশে পাশে আছে।